প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৬১] || মহানবীর জীবনী ||




রাসূল (ছাঃ) এর জীবনের শেষ দিন, তাঁর মৃত্যু, গোসল, কাফন, জানাযা ও দাফন সম্পাদন


[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

রাসূল (ছাঃ) এর জীবনের শেষ দিন

সোমবার ফজরের জামা‘আত চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ঘরের পর্দা উঠিয়ে একদৃষ্টে মসজিদে জামা‘আতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতে তাঁর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ঠোটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। রাসূল (ছাঃ)-এর জামা‘আতে আসার আগ্রহ বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসতে চান। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দেন এবং দরজার পর্দা ঝুলিয়ে দেন। রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর ভাষায় ‘ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা ছিল যেন ‘কুরআনের পাতা’(كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ)। অতঃপর এদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন’।[1]

কুরআনের বাস্তব রূপকার, মৃত্যুপথযাত্রী রাসূল (ছাঃ)-এর শুচিশুদ্ধ আলোকময় চেহারা যেন পরম পবিত্র সত্যসন্ধ কুরআনের কনকোজ্জ্বল পৃষ্ঠার ন্যায় দীপ্ত ও জ্যোতির্ময় দেখাচ্ছিল। আনাস (রাঃ)-এর এই অপূর্ব তুলনা সত্যি কতই না সুন্দর ও কতই না মনোহর! ছালাতের পাগল রাসূল (ছাঃ)-এর ভাগ্যে যোহরের ওয়াক্ত আসার সুযোগ আর হয়নি।...

এরপর সূর্য কিছুটা উপরে উঠলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতেমাকে কাছে ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি কাঁদতে থাকেন। পরে তাকে আবার ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি হেসে ওঠেন। প্রথমবারে রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন যে, এই অসুখেই আমার মৃত্যু ঘটবে। তাতে তিনি কাঁদেন। দ্বিতীয়বারে তিনি বলেন যে, পরিবারের মধ্যে তুমিই প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে (অর্থাৎ তোমার মৃত্যু হবে)। তাতে তিনি হাসেন।[2] এই সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁকে ‘জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী’سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ হবার সুসংবাদ দান করেন।[3] অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর রোগ-যন্ত্রণার কষ্ট দেখে ফাতেমা (রাঃ) বলে ওঠেন,وَاكَرْبَاهُ ‘হায় কষ্ট’! রাসূল (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,لَيْسَ عَلَى أَبِيْكِ كَرْبٌ بَعْدَ الْيَوْمِ ‘আজকের দিনের পর তোমার পিতার আর কোন কষ্ট নেই’।[4]

অতঃপর তিনি হাসান ও হোসায়েনকে ডাকেন। তাদেরকে আদর করে চুমু দেন ও তাদেরকে সদুপদেশ দেন। উভয়ের বয়স তখন যথাক্রমে ৮ ও ৭ বছর। এরপর স্ত্রীগণকে ডাকেন ও তাদেরকে বিভিন্ন উপদেশ দেন। এ সময় তাঁর রোগ-যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করে। তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আয়েশা! খায়বরে যে বিষমিশ্রিত খাদ্য আমি খেয়েছিলাম, সে বিষের প্রভাবে আমার শিরা-উপশিরা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে’।[5] তিনি গিলেননি, ফেলে দিয়েছিলেন। তাতেই যে সামান্য বিষক্রিয়া হয়, সেটিই মৃত্যুকালে তাঁকে কঠিনভাবে কষ্ট দেয়। আর এটাই স্বাভাবিক যে, পুরানো কোন অসুখ যা সুপ্ত থাকে, তা বার্ধক্যে বা মৃত্যুকালে মাথা চাড়া দেয়।

উল্লেখ্য যে, ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর বিজয় শেষে ইহূদী বনু নাযীর গোত্রের নেতা সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাঁকে দাওয়াত দিয়ে বিষমিশ্রিত বকরীর ভুনা রান খেতে দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই গোশত মুখে দিয়ে চিবানোর পর না গিলে ফেলে দেন(فَلَمْ يُسِغْهَا، وَلَفَظَهَا) এবং বলেন, এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে এতে বিষ মিশানো আছে’।[6] অতঃপর তিনি উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,الصَّلاَةُ الصَّلاَةُ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ‘ছালাত ছালাত এবং তোমাদের দাস-দাসী’ অর্থাৎ ছালাত ও স্ত্রীজাতির বিষয়ে তোমরা সর্বাধিক খেয়াল রেখো’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, একথাটি তিনি বারবার পুনরাবৃত্তি করেন’। আনাস (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বশেষ অছিয়ত’।[7]

[1]. বুখারী হা/৬৮০ ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৪৬।
[2]. বুখারী হা/৬২৮৫; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯।

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর মাত্র ছয়মাস পরে ১১ হিজরী ৩রা রামাযান মঙ্গলবার ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩০ অথবা ৩৫ বছর। তিনি হাসান, হোসায়েন, উম্মে কুলছূম ও যয়নব নামে দু’পুত্র ও দু’কন্যা সন্তান রেখে যান। তাঁর কবর সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, নিজের ঘরেই তাঁকে দাফন করা হয়। কেউ বলেন, বাক্বী‘ গোরস্থানে দাফন করা হয় (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১০৮-১০)।
[3]. বুখারী হা/৩৬২৪; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯।

আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী হা/৩৬২৩ দ্বারা বুঝা যায় যে, এই সুসংবাদ তাকে শেষ সপ্তাহে দেওয়া হয়’। হা/৩৬২৬ দ্বারা বুঝা যায় যে, মৃত্যু যন্ত্রণার সময় এই সুসংবাদ দেওয়া হয়। দু’টিই হ’তে পারে। কেননা আগে বলার পর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পুনরায় বলাতে দোষের কিছু নেই।

[4]. বুখারী হা/৪৪৬২, আনাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৫৯৬১।
[5]. বুখারী হা/৪৪২৮; মিশকাত হা/৫৯৬৫।
[6]. ইবনু হিশাম ২/৩৩৭-৩৮; বর্ণনাটি ছহীহ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৫৬৬; আহমাদ হা/৩৫৪৭; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/২৬৯৭; আহমাদ হা/২৬৫২৬; বায়হাক্বী হা/১৫৫৭৮; মিশকাত হা/৩৩৫৬।

রাসূল (ছাঃ) এর মৃত্যু যন্ত্রণা

এরপর মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হ’ল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্ত্রী আয়েশার বুকে ও কাঁধে ঠেস দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় আয়েশা (রাঃ)-এর ভাই আব্দুর রহমান (রাঃ) সেখানে উপস্থিত হন। তার হাতে কাঁচা মিসওয়াক দেখে সেদিকে রাসূল (ছাঃ)-এর দৃষ্টি গেল। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর আগ্রহ বুঝতে পেরে তাঁর অনুমতি নিয়ে মিসওয়াকটি চিবিয়ে নরম করে তাঁকে দিলাম। তখন তিনি সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন ও পাশে রাখা পাত্রে হাত ডুবিয়ে (কুলি সহ) মুখ ধৌত করলেন। এসময় তিনি বলতে থাকেন,لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর রয়েছে কঠিন যন্ত্রণা সমূহ’।[1] এমন সময় তিনি ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হাত কিংবা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে থাকলেন,

مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيْقًا، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَأَلْحِقْنِىْ بِالرَّفِيْقِ الْأَعْلَى، اللَّهُمَّ الرَّفِيقَ الْأَعْلَى-

‘(হে আল্লাহ!) নবীগণ, ছিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেককার ব্যক্তিগণ যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের সাথী করে নাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর ও দয়া কর এবং আমাকে আমার সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত কর। হে আল্লাহ! আমার সর্বোচ্চ বন্ধু!’ আয়েশা (রাঃ) বলেন, শেষের কথাটি তিনি তিনবার বলেন। অতঃপর তাঁর হাত এলিয়ে পড়ল, দৃষ্টি নিথর হয়ে গেল’। তিনি সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত হ’লেন।[2] আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার ঘরে, আমার পালার দিন এবং আমার বুক ও গলার মধ্যে হেলান দেওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে পার্থিব জীবনের শেষ দিন ও পরকালীন জীবনের প্রথম দিন আল্লাহ আমার মুখের লালার সাথে তাঁর মুখের লালা মিলিয়ে দিয়েছেন। আর আমার ঘরেই তাঁর দাফন হয়েছে’।[3]

আয়েশা (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন তাঁর মাথা ছিল আমার রানের উপর, তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তারপর হুঁশ ফিরে এল। তখন তিনি ছাদের দিকে চক্ষু নিবদ্ধ করলেন। অতঃপর বললেন,اللَّهُمَّ الرَّفِيْقَ الْأَعْلَي ‘হে আল্লাহ! হে সর্বোচ্চ বন্ধু’! আর এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এর দ্বারা আমি বুঝলাম, এখন তিনি আর আমাদের পছন্দ করবেন না। বুঝলাম, যে কথা তিনি সুস্থ অবস্থায় বলতেন, সেটাই ঠিক হ’ল। তা এই যে, لَنْ يُقْبَضَ نَبِيٌّ قَطُّ حَتَّى يُرَى مَقْعَدَهُ مِنَ الْجَنَّةِ ثُمَّ يُخَيَّرُ ‘কোন নবী মৃত্যুবরণ করেন না, যতক্ষণ না জান্নাতে তাঁর ঠিকানা দেখানো হয়। অতঃপর তাঁকে এখতিয়ার দেওয়া হয় দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অথবা মৃত্যুবরণ করে জান্নাতে যাওয়ার’। আমি বুঝলাম যে, তিনি আখেরাতকেই পছন্দ করলেন।[4] অতঃপর আমি তাঁর মাথা বালিশে রাখি এবং অন্যান্য মহিলাদের সাথে কাঁদতে কাঁদতে উঠে আসি’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন (আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী; (বাক্বারাহ ২/১৫৬)।

উপরোক্ত দুই বর্ণনার সমন্বয় এটাই হ’তে পারে যে, বুকের উপরে মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হ’লে তিনি তাঁকে স্বীয় রানের উপরে শুইয়ে দেন এবং তখনই রাসূল (ছাঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

দিনটি ছিল সোমবার (বুখারী হা/১৩৮৭) সূর্য অধিক গরম হওয়ার সময়(حِينَ اشتدَّت الضحي) অর্থাৎ ১০/১১ টার সময়। এ দিন তাঁর বয়স হয়েছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৬৩ বছর (বুখারী হা/৩৫৩৬)[5] চার দিন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২৫১)।

[1]. বুখারী হা/৪৪৪৯; মিশকাত হা/৫৯৫৯।
[2]. বুখারী হা/৪৫৮৬, ৫৬৭৪; মিশকাত হা/৫৯৫৯-৬০; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭০৭-০৮।
[3]. قَبَضَهُ اللهُ بَيْنَ سَحْرِى وَنَحْرِى وَدُفِنَ فِى بَيْتِى বুখারী হা/১৩৮৯, ৪৪৪৯, ৪৪৫১; মিশকাত হা/৫৯৫৯; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭০৭।
[4]. বুখারী হা/৬৩৪৮; মুসলিম হা/২৪৪৪; মিশকাত হা/৫৯৬৪; দারেমী হা/৭৭; মিশকাত হা/৫৯৬৮।
[5]. অধিকাংশ জীবনীকারের মতে দিনটি ছিল ১১ হিজরীর ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন। তবে যেহেতু ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল (মুসলিম হা/১১৬২; বুখারী হা/১৩৮৭)। অতএব সেটা ঠিক রাখতে গেলে তাঁর জন্ম ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার এবং মৃত্যু ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার হয়’ (বিস্তারিত দ্রঃ ‘জন্ম ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ)। রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ অস্পষ্ট রাখার মধ্যে শিক্ষণীয় এই, যাতে তাঁর উম্মত অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে না পড়ে এবং জন্ম দিবস ও মৃত্যু দিবস পালন করার মত বিদ‘আতী কাজে লিপ্ত না হয়।

রাসূল (ছাঃ) এর মৃত্যুতে শোকাবহ প্রতিক্রিয়া

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুতে শোকাতুর কন্যা ফাতেমা বলে ওঠেন,

يَا أَبَتَاهْ، أَجَابَ رَبًّا دَعَاهُ، يَا أَبَتَاهْ مَنْ جَنَّةُ الْفِرْدَوْسِ مَأْوَاهُ، يَا أَبَتَاهْ إِلَى جِبْرِيْلَ نَنْعَاهْ فَلَمَّا دُفِنَ قَالَتْ فَاطِمَةُ، عَلَيْهَا السَّلاَمُ، يَا أَنَسُ، أَطَابَتْ أَنْفُسُكُمْ أَنْ تَحْثُوا عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم التُّرَابَ- رواه البخارىُّ-

‘হায় আববা! যিনি প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আববা! জান্নাতুল ফেরদৌসে যার ঠিকানা। হায় আববা! জিব্রীলকে আমরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানাচ্ছি’। অতঃপর দাফন হয়ে গেলে তিনি বলেন, হে আনাস! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর মাটি ফেলে তোমাদের অন্তর কি খুশী হয়েছে’?[1]

সাধারণভাবে ছাহাবীগণের অবস্থা ছিল এই যে, তাঁরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (ছাঃ)-এর বিয়োগব্যথা সহ্য করতে পারছিলেন না। অনেকে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন। অনেকে জঙ্গলে চলে যান। ওমর ফারূক (রাঃ) হতবুদ্ধি হয়ে বলতে থাকেন, কিছু মুনাফিক লোক ধারণা করে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে। অথচ নিশ্চয়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। বরং স্বীয় প্রতিপালকের নিকটে গমন করেছেন। যেমন মূসা (আঃ) নিজ সম্প্রদায় থেকে ৪০ দিন অনুপস্থিত থাকার পর পুনরায় ফিরে এসেছিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। তিনি বলেন,وَلَيَبْعَثَنَّهُ اللهُ فَلَيَقْطَعَنَّ أَيْدِىَ رِجَالٍ وَأَرْجُلَهُمْ ‘অবশ্যই আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে দিবেন। অতঃপর তিনি ঐসব লোকদের হাত-পা কেটে দিবেন’ (বুখারী হা/৩৬৬৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,وَاللهِ مَا مَاتَ رَسُولُ اللهِ- صلى الله عليه وسلم- وَلاَ يَمُوتُ حَتَّى يَقْطَعَ أَيْدِىَ أُنَاسٍ مِنَ الْمُنَافِقِينَ كَثِيرٍ وَأَرْجُلَهُمْ ‘আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মরেননি এবং মরবেনও না, যতক্ষণ না তিনি মুনাফিকদের বহু লোকের হাত-পা কেটে দেন’ (ইবনু মাজাহ হা/১৬২৭, হাদীছ ছহীহ)।
[1]. বুখারী হা/৪৪৬২, আনাস হ’তে; মিশকাত হা/৫৯৬১।

উল্লেখ্য যে, আনাস বিন মালেক (রাঃ) ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর দীর্ঘ ১০ বছরের প্রিয়তম গোলাম’ (আবুদাঊদ হা/৪৭৭৪; আহমাদ হা/১৩৩৪১)। এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে কন্যা ফাতেমা নিম্নোক্ত শোকগাথা পাঠ করেছিলেন।-

صُبَّتْ عَلَيَّ مَصَائِبُ لَوْ أنَّهَا + صُبَّتْ عَلَى الْأَيَّامِ عُدْنَ لَيَالِيَا
مَاذَا عَلَى مَنْ شَمَّ تُرْبَة َ أَحْمَدٍ + أَنْ لاَ يَشَمَّ مُدَى الزَّمَانِ غَوَالِيَا

(১) ‘আমার উপরে এমন বিপদ আপতিত হয়েছে, যদি তা দিনসমূহের উপরে পড়ত, তবে সেগুলি রাতে পরিণত হয়ে যেত’। (২) ‘যে কেউ আহমাদের কবরের মাটি শুঁকবে, তার উপরে ওয়াজিব হবে যে, সে জীবনে আর কোন সুগন্ধি শুঁকবে না’। যাহাবী বলেন, এটি ‘ছহীহ নয়’ (لاَ يَصِحُّ) (যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৪২৬)।

রাসূল (ছাঃ) এর মৃত্যুতে আবুবকর (রাঃ)-এর ধৈর্যশীল ভূমিকা

শোকাহত ছাহাবায়ে কেরামের দিশাহারা অবস্থার মধ্যে ধৈর্য ও স্থৈর্যের জীবন্ত প্রতীক হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) মসজিদে নববী থেকে এক মাইল দূরে শহরের উঁচু সুন্হ (السُّنْحُ) এলাকায় অবস্থিত স্বীয় বাসগৃহ থেকে বের হয়ে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত আগমন করেন এবং মসজিদে নববীতে প্রবেশ করেন। অতঃপর কাউকে কিছু না বলে সোজা কন্যা আয়েশার গৃহে গমন করেন। এ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ একটি জরিদার ইয়ামনী চাদর(بُرْدُ حِبَرَةٍ) দ্বারা আবৃত ছিল। তিনি গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারার উপর থেকে চাদর সরিয়ে চুম্বন করলেন ও কেঁদে ফেললেন। অতঃপর বললেন, بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّىْ، وَاللهِ لاَ يَجْمَعُ اللهُ عَلَيْكَ مَوْتَتَيْنِ، أَمَّا الْمَوْتَةُ الَّتِىْ كُتِبَتْ عَلَيْكَ فَقَدْ ذُقْتَهَا ‘আপনার উপরে আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন! আল্লাহ আপনার উপরে দু’টি মৃত্যুকে একত্রিত করবেন না। অতঃপর যে মৃত্যু আপনার জন্য নির্ধারিত ছিল, তার স্বাদ আপনি আস্বাদন করেছেন’ (বুখারী হা/১২৪১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى طِبْتَ حَيًّا وَمَيِّتًا، وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ يُذِيقُكَ اللهُ الْمَوْتَتَيْنِ أَبَدًا ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎস্বর্গিত হৌন! আপনার জীবন ও মরণ সুখময় হৌক! যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, কখনোই আল্লাহ আপনাকে দু’টি মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করাবেন না’ (বুখারী হা/৩৬৬৭)। এরপর তিনি মুখ ঢেকে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। এমন সময় ওমর (রাঃ) সম্ভবতঃ স্বীয় বক্তব্যের পক্ষে লোকদের কিছু বলছিলেন। আবুবকর (রাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,أَيُّهَا الْحَالِفُ عَلَى رِسْلِكَ ‘হে কসমকারী! থামো’। কিন্তু তিনি থামলেন না (বুখারী হা/৩৬৬৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, اجْلِسْ ‘তুমি বস। কিন্তু তিনি বসলেন না’ (বুখারী হা/১২৪২)। অতঃপর তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। লোকেরা সব ওমরকে ছেড়ে তাঁর সাথে সাথে মসজিদে এলো। তখন তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণের শুরুতে হামদ ও ছানার পর রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করলেন। অতঃপর গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,

أَيُّهَا النَّاسُ! إِنَّهُ مَنْ كَانَ مِنْكُمْ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ، وَمَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ فَإِنَّ اللهَ حَىٌّ لاَ يَمُوْتُ، قَالَ اللهُ تَعَالَى وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَّنْقَلِبْ عَلَىَ عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَّضُرَّ اللهَ شَيْئاً وَسَيَجْزِي اللهُ الشَّاكِرِيْنَ-

‘হে লোক সকল! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করে, সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে, সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব তিনি মরেন না। তিনি বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল ব্যতীত কিছু নন। তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল গত হয়ে গেছেন। এক্ষণে যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তাহ’লে তোমরা কি পিছন পানে ফিরে যাবে? যে ব্যক্তি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে ফিরে যাবে, সে ব্যক্তি আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। সত্বর আল্লাহ তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন’ (আলে ইমরান ৩/১৪৪)। অতঃপর লোকেরা উক্ত আয়াতটি বারবার পাঠ করতে থাকে’ (বুখারী হা/১২৪২)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ভাষণ শোনার পর সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। সবার মনে হ’ল যেন আবুবকরের মুখে শোনার আগে উক্ত আয়াতটি তারা জানতেনই না। অতঃপর যেই-ই শোনেন, সেই-ই আয়াতটি পড়তে থাকেন’। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব বলেন, ওমর বললেন, আল্লাহর কসম! আবুবকরের মুখে উক্ত আয়াত শুনে আমি আমার দু’পা স্থির রাখতে পারিনি। অবশেষে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম এবং আমি নিশ্চিত হ’লাম যে, রাসূল (ছাঃ) মারা গেছেন (বুখারী হা/৪৪৫৪)। ওমর (রাঃ) আবুবকরের ভাষণ শুনে বসে পড়েন এবং বলেন,فَلَكَأَنِّى لَمْ أَقْرَأْهَا إِلاَّ يَوْمَئِذٍ ‘আমার মনে হচ্ছিল যেন আয়াতগুলি আমি এদিন ব্যতীত ইতিপূর্বে কখনো পাঠ করিনি’। আমি প্রথম আবুবকরের মুখে এটি শুনলাম এবং নিশ্চিত হ’লাম যে, রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন’।[1] আনাস (রাঃ) বলেন,مَا رَأَيْتُ يَوْماً قَطُّ كَانَ أَحْسَنَ وَلاَ أَضْوَأَ مِنْ يَوْمٍ دَخَلَ عَلَيْنَا فِيهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَا رَأَيْتُ يَوْماً كَانَ أَقْبَحَ وَلاَ أَظْلَمَ مِنْ يَوْمٍ مَاتَ فِيهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেদিন আমাদের নিকটে আগমন করেছিলেন, সেদিনের চাইতে সুন্দর ও উজ্জ্বলতম দিন আমি কখনও দেখিনি। পক্ষান্তরে যেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, সেদিনের চাইতে মন্দ ও অন্ধকারময় দিন আমি আর দেখিনি’।[2]

[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৬২৭; ইবনু হিশাম ২/৬৫৬।
[2]. দারেমী হা/৮৮; মিশকাত হা/৫৯৬২, সনদ ছহীহ।

রাসূল (ছাঃ) এর পরিত্যক্ত সম্পদ

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় ওফাতের পর দীনার-দিরহাম, বকরী-উট কিছুই রেখে যাননি। তিনি কোন কিছুর অছিয়তও করে যাননি।[1] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, (আমার মৃত্যুর পর) আমার ওয়ারিছগণ কোন দীনার ভাগ-বণ্টন করবে না। আমি যা রেখে যাব (অর্থাৎ বনু নাযীরের ফাই এবং খায়বরের ফাদাক খেজুর বাগান) স্ত্রীদের খোরপোষ এবং আমার ‘আমেল (কর্মচারী)-দের ব্যয় নির্বাহের পর তা সবই ছাদাক্বা হবে।[2] উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ-এর ভাই ‘আমর ইবনুল হারেছ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুকালে কোন দীনার-দিরহাম, দাস-দাসী বা অন্য কিছুই ছেড়ে যাননি। কেবল তাঁর সাদা খচ্চর, অস্ত্র ও (ফাদাকের) জমিটুকু ব্যতীত। যা তিনি ছাদাক্বা করে যান।[3] এর অর্থ হ’ল সংসারের ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্তগুলি ছাদাক্বা হবে (ফাৎহুল বারী, ঐ)। আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ لاَ نُوْرِثُ مَا تَرَكْنَاهُ صَدَقَةٌ ‘আমরা নবীগণ কোন ওয়ারিছ রেখে যাই না। যা কিছু আমরা ছেড়ে যাই, সবই (উম্মতের জন্য) ছাদাক্বা হয়ে যায়’।[4] তাঁর মৃত্যুর পর ফাতেমা (রাঃ) ফাদাক-এর উত্তরাধিকার দাবী করলে অত্র হাদীছ শোনার পর তা প্রত্যাহার করে নেন। যদিও শী‘আরা এজন্য আবুবকর (রাঃ)-কে দায়ী করে থাকে। অথচ আলী (রাঃ) খলীফা হওয়ার পরেও তিনি উক্ত দাবী করেননি।

[1]. মুসলিম ১৬৩৫ (১৮); মিশকাত হা/৫৯৬৪; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭২১। আলবানী মিশকাতের অত্র ক্রমিক সংখ্যাটি দু’বার এসেছে। ফলে এখান থেকে শেষ পর্যন্ত ভুল ক্রমিক দেওয়া হয়েছে। সঠিক গণনা মতে ৫৯৬৪-এর স্থলে ৫৯৭৩ হবে।
[2]. বুখারী হা/২৭৭৬; মুসলিম হা/১৭৬০; মিশকাত হা/৫৯৬৬; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭২৩।
[3]. বুখারী হা/২৭৩৯; মিশকাত হা/৫৯৬৫।
[4]. মুসলিম হা/১৭৫৭; মিশকাত হা/৫৯৬৭; বঙ্গানুবাদ হা/৫৭২৪; নাসাঈ হা/৬৩০৯; কানযুল ‘উম্মাল হা/৩৫৬০০।

রাসূল (ছাঃ) এর মৃত্যুর পর খলীফা নির্বাচন

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন যে, আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ) আমাকে বলেছেন, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর সর্বশেষ হজ্জের সময় জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘যদি ওমর মারা যান, তাহ’লে আমরা অমুকের হাতে বায়‘আত করব। আল্লাহর কসম! আবুবকরের বায়‘আতটি ছিল আকস্মিক ব্যাপার। যা হঠাৎ সংঘটিত হয়ে যায়’(مَا كَانَتْ بَيْعَةُ أَبِى بَكْرٍ إِلاَّ فَلْتَةً)। এ কথা শুনতে পেয়ে ওমর (রাঃ) ভীষণভাবে রাগান্বিত হন। তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ আজই সন্ধ্যায় আমি লোকদের মধ্যে দাঁড়াব এবং ঐ সব লোকদের সম্পর্কে সতর্ক করব, যারা তাদের শাসন কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিতে চায়। তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! এ কাজ করবেন না। কেননা হজ্জের মৌসুম নিম্নস্তরের ও নির্বোধ লোকদের একত্রিত করে। আর যখন আপনি দাঁড়াবেন, তখন এরাই আপনার উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। তারা আপনার কথা যথাযথভাবে আয়ত্ত করতে পারবেনা এবং যথাস্থানে রাখতেও পারবে না। অতএব মদীনায় পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সেটি হ’ল হিজরত ও সুন্নাতের পীঠস্থান। সেখানে আপনি জ্ঞানী ও সুধীদের সঙ্গে মিলিত হবেন। তারা আপনার কথা যথার্থভাবে আয়ত্ত করবে ও মূল্যায়ন করবে। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ইনশাআল্লাহ মদীনায় পৌঁছে আমার প্রথম কাজ হবে লোকদের সামনে এ বিষয়টি নিয়ে ভাষণ দেওয়া’।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর যিলহজ্জ মাসের শেষদিকে আমরা মদীনায় ফিরে এলাম। অতঃপর জুম‘আর দিন এলে আমরা আগেভাগে মসজিদে পৌঁছে যাই। সাঈদ বিন যায়েদ (রাঃ) আগেই মিম্বরের কাছে বসেছিলেন। আমিও গিয়ে তাঁর পাশে বসলাম এবং তাঁকে বললাম, আজ খলীফা এমন কিছু বলবেন, যা তিনি এযাবৎ কখনো বলেননি। অতঃপর ওমর (রাঃ) মিম্বরে বসলেন। অতঃপর আযান শেষে দাঁড়িয়ে হামদ ও ছানার পর বললেন, আমি আজ তোমাদেরকে এমন কিছু কথা বলতে চাই, যা বলার ক্ষমতা কেবল আমাকেই দেওয়া হয়েছে(قَدْ قُدِّرَ لِى أَنْ أَقُولَهَا)। সম্ভবতঃ মৃত্যু আমার সম্মুখে। যিনি কথাগুলো বুঝবেন ও মুখস্থ রাখবেন, তিনি যেন কথাগুলি অতদূর পৌঁছে দেন, যতদূর তার বাহন পৌঁছে যায়। আর যিনি এগুলি বুঝবেন না বলে আশংকা করেন, তিনি যেন আমার উপরে মিথ্যারোপ না করেন।

অতঃপর তিনি বলেন, (১) নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহাম্মাদকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁর উপরে কিতাব নাযিল করেছিলেন। সেখানে তিনি রজমের আয়াত নাযিল করেছিলেন। আমরা তা পড়েছি, বুঝেছি ও মুখস্থ করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে রজম করেছেন।[1] আমরাও রজম করেছি। আমি ভয় পাচ্ছি যে, দীর্ঘ দিন পরে কেউ বলতে পারে যে, আমরা কুরআনে রজমের আয়াত খুঁজে পাচ্ছি না। এভাবে তারা আল্লাহর নাযিলকৃত একটি ফরয বিধান থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে(فَيَضِلُّوا بِتَرْكِ فَرِيضَةٍ أَنْزَلَهَا اللهُ)।... (২) তিনি বলেছেন, তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন বাড়াবাড়ি করেছে নাছারাগণ ঈসা (আঃ)-কে নিয়ে। তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’। (৩) আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, খলীফা নির্বাচনকালে আবুবকর (রাঃ)-এর বায়‘আতটি ছিল ‘আকস্মিক ঘটনা’ (فَلْتَةً)। তবে আল্লাহ এই আকস্মিক বায়‘আতের ক্ষতি প্রতিহত করেছেন। কেননা সেসময় আবুবকর (রাঃ) ছিলেন আমাদের সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁর মত যোগ্য ব্যক্তি কেউ ছিলেন না।... রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর আমরা জানতে পারলাম যে, আনছারগণ আমাদের বিরোধিতা করছেন। তারা ছাক্বীফা বনী সা‘এদাহ-তে জমা হয়েছেন। অন্যদিকে আলী, যুবায়ের ও তাদের সাথীবৃন্দ আমাদের থেকে পিছিয়ে রয়েছেন। মুহাজিরগণ আবুবকরের নিকটে জমা হয়েছেন। এসময় আমি তাঁকে বললাম, চলুন আমরা আমাদের আনছার ভাইদের নিকটে যাই। তখন আমরা বের হ’লাম। রাস্তায় দু’জন আনছার (ওয়ায়েম বিন সা‘এদাহ এবং মা‘আন বিন ‘আদী) আমাদেরকে যেতে নিষেধ করেন (কারণ তারা সা‘দ বিন ‘উবাদাহকে আমীর হিসাবে গ্রহণ করেছে)। আমি বললাম, অবশ্যই আমরা তাদের কাছে যাব। অতঃপর আমরা সেখানে পৌঁছলাম। দেখলাম যে, তাদের অসুস্থ (খাযরাজ) নেতা সা‘দ বিন ‘উবাদাহ চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। তখন তাদের জনৈক বক্তা (ক্বায়েস বিন শাম্মাস, যিনি ‘খত্বীবুল আনছার’ নামে খ্যাত) উঠে বক্তব্য শুরু করলেন এবং হামদ ও ছানার পরে বললেন,أَمَّا بَعْدُ، فَنَحْنُ أَنْصَارُ اللهِ وَكَتِيبَةُ الْإِسْلاَمِ، وَأَنْتُمْ يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ رَهْطٌ مِنَّا، وَقَدْ دَفَّتْ دَافَّةٌ مِنْ قَوْمِكُمْ، قَالَ: وَإِذَا هُمْ يُرِيدُونَ أَنْ يَحْتَازُونَا مِنْ أَصْلِنَا، وَيَغْصِبُونَا الْأَمْرَ ‘আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী এবং ইসলামের সেনাদল। আর আপনারা হে মুহাজিরগণ আমাদের একটি দল মাত্র। আপনারা আপনাদের সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, অথচ এখন তারা আমাদেরকে আমাদের মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে এবং আমাদের থেকে খিলাফত ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে’। এরপর যখন তিনি চুপ হ’লেন, তখন আমি কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু আবুবকর আমাকে থামিয়ে দিলেন। অতঃপর আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, সেগুলি ছাড়াও তার চেয়ে সুন্দরভাবে তিনি কথা বললেন। কারণ তিনি ছিলেন আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও অধিক সম্মানিত। তিনি বললেন, أَمَّا مَا ذَكَرْتُمْ فِيكُمْ مِنْ خَيْرٍ، فَأَنْتُمْ لَهُ أَهْلٌ، وَلَنْ تَعْرِفَ الْعَرَبُ هَذَا الْأَمْرَ إلاَّ لِهَذَا الْحَيِّ مِنْ قُرَيْشٍ، هُمْ أَوْسَطُ الْعَرَبِ نَسَبًا وَدَارًا ‘তোমরা যা বলেছ, নিঃসন্দেহে তোমরা তার যোগ্য। কিন্তু আরবরা কখনই খিলাফতের জন্য কুরায়েশ বংশ ব্যতীত অন্য কাউকে স্বীকার করবে না। কারণ তারাই হ’ল আরবদের মধ্যে সর্বোচ্চ বংশের ও সর্বোচ্চ স্থানের (মক্কার)’।[2] অতএব আমি তোমাদের জন্য এই দু’জন ব্যক্তির যেকোন একজনের ব্যাপারে রাযী হ’লাম। তোমরা এদের মধ্যে যাকে চাও বায়‘আত কর। অতঃপর তিনি আমার ও আবু ওবায়দাহ ইবনুল জার্রাহ-এর হাত ধরলেন। যিনি আমাদের মাঝে বসে ছিলেন। আমি তার কোন কথা অপছন্দ করিনি এই কথাটি ছাড়া। কারণ আল্লাহর কসম! যে জাতির মধ্যে আবুবকর রয়েছেন, সে জাতির উপরে আমাকে আমীর নিয়োগ করার চাইতে আমার নিকট এটাই অধিক প্রিয় যে, আমি আমার গর্দান বাড়িয়ে দেই এবং আমাকে হত্যা করা হৌক।

অতঃপর আনছারদের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি (হুবাব ইবনুল মুনযির) বলে উঠলেন, আমাদের মধ্য থেকে একজন আমীর হবেন ও আপনাদের মধ্য থেকে একজন আমীর হবেন(مِنَّا أَمِيرٌ وَمِنْكُمْ أَمِيرٌ)। এ পর্যায়ে গোলমাল শুরু হয়ে যায় এবং লোকদের কণ্ঠস্বর উঁচু হ’তে থাকে। তখন আমি বিভক্তির আশংকা করলাম। অতঃপর বললাম, হে আবুবকর! হাত বাড়িয়ে দিন(اُبْسُطْ يَدَكَ يَا أَبَا بَكْرٍ)। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। অতঃপর আমি তাঁর হাতে বায়‘আত করলাম। তখন মুহাজিরগণ সকলে বায়‘আত করল। তারপর আনছারগণ সকলে বায়‘আত করল’। অতঃপর আমরা সা‘দ বিন উবাদাহর উপর লাফিয়ে পড়লাম। জনৈক ব্যক্তি বলে উঠল, তোমরা সা‘দকে হত্যা করলে। আমি বললাম, আল্লাহ সা‘দকে হত্যা করুন!

ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা ঐ সময় আবুবকর-এর হাতে বায়‘আতের চাইতে কোন কিছুকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি। আমাদের ভয় ছিল, যদি বায়‘আতের কাজ অসম্পন্ন থাকে এবং আমরা আনছারদের থেকে পৃথক হয়ে যাই, তাহ’লে তারা তাদের মধ্য থেকে কারু হাতে বায়‘আত করে নিতে পারে। তখন হয়ত আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের অনুসরণ করতে হ’ত। ফলে তা মারাত্মক বিশৃংখলার জন্ম দিত। অতএবمَنْ بَايَعَ رَجُلاً عَنْ غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ فَلاَ يُبَايَعُ هُوَ وَلاَ الَّذِى بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلاَ ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতিরেকে কারু হাতে বায়‘আত করবে, তাকে অনুসরণ করা যাবে না। আর ঐ ব্যক্তিকেও নয়, যে তার অনুসারী হবে। কেননা তাতে উভয়েরই নিহত হওয়ার আশংকা থাকবে’ (বুখারী হা/৬৮৩০, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে)।

আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, আবুবকর বলেন,نَحْنُ الأُمَرَاءُ وَأَنْتُمُ الْوُزَرَاءُ ‘আমরা হব আমীর এবং তোমরা হবে উযীর’। জবাবে হুবাব ইবনুল মুনযির বলেন, কখনই নয় ‘আমরা হব আমীর এবং তোমরা হবে উযীর’। তখন আবুবকর বললেন, না। ‘আমরা হব আমীর এবং তোমরা হবে উযীর’। তোমরা ওমর অথবা আবু উবায়দাহ এই দু’জনের যেকোন একজনের হাতে বায়‘আত কর। আমি বললাম, بَلْ نُبَايِعُكَ أَنْتَ، فَأَنْتَ سَيِّدُنَا وَخَيْرُنَا وَأَحَبُّنَا إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘বরং আমরা আপনার হাতে বায়‘আত করব। আপনি আমাদের নেতা। আপনি আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং আপনি আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি’। অতঃপর আমি তার হাত ধরলাম এবং বায়‘আত করলাম। তখন লোকেরা সবাই বায়‘আত করল’। একজন বলে উঠল, তোমরা সা‘দ বিন উবাদাকে হত্যা করলে। আমি বললাম, আল্লাহ তাকে হত্যা করুন (বুখারী হা/৩৬৬৮)![3]

আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, আবুবকর (রাঃ) সা‘দ বিন ওবাদাকে জিজ্ঞেস করেন,وَلَقِدْ عَلِمْتَ يَا سَعْدٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: - وَأَنْتَ قَاعِدٌ- قُرَيْشٌ وُلاَةُ هَذَا الْأَمْرِ فَبَرُّ النَّاسِ تَبَعٌ لِبَرِّهِمْ وَفَاجِرُهُمْ تَبَعٌ لِفَاجِرِهِمْ. فَقَالَ لَهُ سَعْدٌ: صَدَقْتَ نَحْنُ الْوُزَرَاءُ وَأَنْتُمُ الْأُمَرَاء ‘তুমি জানো হে সা‘দ! রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, আর তুমি সেখানে বসেছিলে, কুরায়েশরা হ’ল শাসন ক্ষমতার মালিক। সৎকর্মশীল লোকেরা তাদের সৎকর্মশীলদের অনুসারী হবে এবং দুষ্টুরা তাদের দুষ্টুদের অনুসারী হবে। তখন সা‘দ বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। আমরা উযীর ও আপনারা আমীর’।[4]

আনছারগণের মধ্যে যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ) আবুবকর (রাঃ)-এর হাত ধরে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,هَذَا صَاحِبُكُمْ فَبَايِعُوهُ ‘ইনি তোমাদের আমীর। তোমরা সবাই তাঁর হাতে বায়‘আত কর। অতঃপর সকলে বায়‘আত করার জন্য এগিয়ে এল’।[5]

আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ) বলেন, আবুবকর (রাঃ) বায়‘আত গ্রহণের পর জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি দিনে বা রাতে কখনই ইমারতের আকাংখী ছিলাম না। গোপনে বা প্রকাশ্যে কখনো আল্লাহর নিকট এমন প্রার্থনা করিনি। কিন্তু আমি ফিৎনার আশংকা করছিলাম। আমি জানি যে, নেতৃত্বে কোন শান্তি নেই। তথাপি আমি একটি গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি। যা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই, আল্লাহর তাওফীক ব্যতীত। আমি চাই আমার চাইতে একজন শক্তিশালী মানুষ আজ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুন’। তখন মুহাজিরগণ সকলে তাঁকে গ্রহণ করে নেন। এসময় আলী ও যুবায়ের (রাঃ) বলেন, আমাদের বায়‘আত গ্রহণে দেরী হয়েছে এ কারণে যে, তিনি আমাদেরকে পরামর্শ গ্রহণ থেকে দূরে রেখেছিলেন। অথচ আমরা মনে করি যে, রাসূল (ছাঃ)-এর পরে আবুবকর সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনিই তাঁর গুহার সাথী এবং দুই জনের দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমরা তাঁর মর্যাদা ও জ্যেষ্ঠতা সম্পর্কে জানি। রাসূল (ছাঃ) তাকে স্বীয় জীবদ্দশায় তাকেই ছালাতের ইমামতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন’ (হাকেম হা/৪৪২২, হাদীছ ছহীহ)।

ইবনু কাছীর বলেন, উপরোক্ত ঘটনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যে, আলী (রাঃ)-এর বায়‘আত রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর প্রথম দিনে হয়েছিল, না দ্বিতীয় দিনে হয়েছিল? এ ব্যাপারে এটাই সত্য যে, আলী (রাঃ) কোন সময়ের জন্যই আবুবকর (রাঃ) থেকে পৃথক ছিলেন না। তাঁর পিছনে কোন ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা থেকে দূরে ছিলেন না। তিনি তাঁর সাথে রিদ্দার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু যখন ফাতেমা (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে স্বীয় পিতার মীরাছ দাবী করা হয়। অথচ তিনি জানতেন না উক্ত বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ এই মর্মে যে, ‘আমরা কোন উত্তরাধিকার রেখে যাই না। যা কিছু রেখে যাই সবই ছাদাক্বা হয়ে যায়’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫৯৬৭), তখন আলী (রাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-এর খাতিরে বায়‘আত থেকে দূরে থাকেন। অতঃপর ছ’মাস পর তাঁর মৃত্যু হ’লে তিনি আবুবকরের হাতে পুনরায় বায়‘আত করেন। যা তিনি ইতিপূর্বে রাসূল (ছাঃ)-এর দাফনের পূর্বে একবার করেছিলেন’। তিনি বলেন, চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই বুঝতে পারেন যে, আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফত মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণের ঐক্যমতে সম্পাদিত হয়েছিল’ (আল-বিদায়াহ ৫/২৫০)।

আবু ওয়ায়েল (রাঃ) বলেন, আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ)-কে বলা হ’ল, কেন আপনি আমাদের খলীফা হলেন না? জবাবে তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) যাকে (ছালাতে) তাঁর প্রতিনিধি (ইমাম) করে গিয়েছিলেন, তিনিই খলীফা হয়েছেন। আল্লাহ যদি জনগণের কল্যাণ চান, তাহ’লে তাদেরকে আমার পরে তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির উপর একত্রিত করবেন। যেমন তিনি তাদেরকে তাদের নবীর পরে তাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির উপরে একত্রিত করেছেন’ (হাকেম হা/৪৪৬৭, হাদীছ ছহীহ)।

উপরের আলোচনায় একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফত নিয়ে আলী (রাঃ)-এর কোনরূপ আপত্তি ছিল না। যেমনটি শী‘আরা ধারণা করে থাকেন।

উল্লেখ্য যে, ওমর ফারূক (রাঃ)-এর খেলাফতকাল ছিল ১৩ হিজরী থেকে ২৩ হিজরী পর্যন্ত। সর্বশেষ ২৩ হিজরীতে হজ্জ সম্পাদন শেষে মদীনায় ফিরে তিনি জুম‘আর দিন উক্ত ভাষণ দেন। পরে ২৬শে যিলহাজ্জ বুধবার ফজরের ছালাত অবস্থায় মুগীরাহ বিন শু‘বাহ (রাঃ)-এর মাজূসী অথবা খ্রিষ্টান গোলাম আবু লুলু কর্তৃক আহত হন ও শাহাদাত বরণ করেন (আল-ইস্তী‘আব)।

[1]. ‘রজম’ অর্থ বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা।
[2]. তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍ ‘নেতা হবেন কুরায়েশ বংশ থেকে’ (আহমাদ হা/১২৩২৯; ইরওয়া হা/৫২০; ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৮)। তিনি আরও বলেছেন,قَدِّمُوا قُرَيْشًا وَلاَ تُؤَخِّرُوهَا ‘তোমরা কুরায়েশকে অগ্রগণ্য করো এবং তাদেরকে পিছনে রেখো না’ (ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৬৬; ইরওয়া হা/৫১৯ )।
[3]. মুসলিম হা/১৬৯১ (১৫); মিশকাত হা/৩৫৫৭; ইবনু হিশাম ২/৬৫৬-৬০।
[4]. আহমাদ হা/১৮; ছহীহাহ হা/১১৫৬।
[5]. হাকেম হা/৪৪৫৭; আল-বিদায়াহ ৫/২৪৯, সনদ ছহীহ।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) খলীফা বা আমীর নির্বাচন উম্মতের ঐক্যের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেকারণ রাসূল (ছাঃ)-এর দাফন কার্য পিছিয়ে যায়।
(২) নেতৃত্ব নির্বাচন জ্ঞানীদের পরামর্শের ভিত্তিতে এবং ঠান্ডা মাথায় হয়ে থাকে। অজ্ঞদের জোশের মাধ্যমে নয়।
(৩) নেতৃত্ব নির্বাচনে আল্লাহভীরুতা, বংশ মর্যাদা ও যোগ্যতার গুরুত্ব সর্বাধিক।
(৪) জ্ঞানীদের নির্বাচনের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন জ্ঞাপন করা আবশ্যক, বিরোধিতা করা নয়।

রাসূল (ছাঃ) এর গোসল ও কাফন

সোমবার দিনভর রাসূল (ছাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত নেতা বা ‘খলীফা’ নির্বাচনে ব্যয় হয়ে যায়। ছাক্বীফায়ে বনী সা‘এদায় সর্বসম্মতভাবে হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) উম্মতের খলীফা নির্বাচিত হন। পরদিন মঙ্গলবার সকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গোসল দেওয়া হয়। এই সময় পর্যন্ত রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ মুবারক একটি জরিদার ইয়ামনী চাদর দ্বারা আবৃত রাখা হয় এবং তাঁর কক্ষ ভিতর থেকে তাঁর পরিবারের সদস্যগণ বন্ধ করে রাখেন।

গোসলের কাজে অংশ নেন রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হযরত আববাস ও তাঁর দুই পুত্র ফযল ও কুছাম (قُثَمْ) এবং রাসূল (ছাঃ)-এর মুক্তদাস শুক্বরান (شُقْرَان), উসামা বিন যায়েদ ও আওস বিন খাওলী এবং হযরত আলী (রাঃ) সহ মোট ৭জন। আওস ছিলেন খাযরাজ গোত্রের একজন বদরী ছাহাবী। যিনি হযরত আলীকে আল্লাহর কসম দিয়ে গোসলের কাজে শরীক হওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৬৬২)। আওস বিন খাওলী রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ মুবারক নিজের বুকের উপরে ঠেস দিয়ে রাখেন। হযরত আববাস ও তাঁর পুত্রদ্বয় তাঁর দেহের পার্শ্ব পরিবর্তন করে দেন। উসামা ও শুক্বরান পানি ঢালেন এবং হযরত আলী রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ মুবারক ধৌত করেন। এসময় রাসূল (ছাঃ)-এর পরিহিত পোষাক খোলা হয়নি।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-কে তিনটি ইয়ামনী সাদা চাদর দিয়ে কাফন পরানো হয়। এগুলির মধ্যে ক্বামীছ ও পাগড়ী ছিল না।[1] তাঁর অন্য বর্ণনায় এসেছে, লোকেরা তাঁকে গোসল দেওয়ার সময় মতভেদ করল যে, অন্যান্য মাইয়েতের দেহ থেকে যেভাবে কাপড় খুলে নেওয়া হয়, সেভাবে করা হবে কি-না? তখন আল্লাহ তাদের উপর নিদ্রা চাপিয়ে দেন। যাতে তারা সবাই ঢুলতে থাকে। এরি মধ্যে হঠাৎ একজন গৃহ কোণ থেকে বলে উঠে, ‘তোমরা নবীকে গোসল দাও তাঁর দেহের কাপড় সহ। তখন সকলে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁকে গোসল দিল। এমতাবস্থায় তাঁর দেহে ক্বামীছ (জামা) ছিল। ক্বামীছের উপর দিয়েই তারা পানি ঢালে এবং ক্বামীছের উপর দিয়েই তাঁর দেহ কচলায়’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘যদি আমি আগে জানতাম যা পরে জানলাম, তাহলে রাসূল (ছাঃ)-কে কেউই গোসল দিতে পারত না, তাঁর স্ত্রীগণ ব্যতীত’।[2] এক্ষণে তাঁকে পরিহিত পোষাকসহ গোসল ও কাফন করা হয় বিধায় প্রথম বর্ণনায় কাফনের কাপড়ের মধ্যে ক্বামীছ বা জামা ছিল না বলার সেটিও একটি কারণ হ’তে পারে।

তিনটি কাপড়ে কাফন দেওয়ার কথা বিভিন্ন ছহীহ হাদীছে এসেছে। কিন্তু তিনটি কাপড়ের ব্যাখ্যা এসেছে আহমাদ (হা/১৯৪২), আবুদাঊদ (হা/৩১৫৩), তিরমিযী (হা/৯৯৭) সহ অন্যান্য হাদীছে ক্বামীছ, ইযার ও লিফাফাহ তথা জামা, লুঙ্গী ও বড় চাদর হিসাবে। যদিও ঐসব হাদীছগুলির সনদ দুর্বলতা মুক্ত নয়। তবে জামা সহ তিন কাপড়ে কাফন দেওয়া জায়েয হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই’।[3]

[1]. বুখারী হা/১২৬৪; মুসলিম হা/৯৪১ (৪৬); মিশকাত হা/১৬৩৫।
[2]. হাকেম হা/৪৩৯৮; বায়হাক্বী দালায়েল হা/৩১৯৬ সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৯৪৮।
[3]. বিস্তারিত দ্রঃ মির‘আত শরহ মিশকাত হা/১৬৫০-এর ব্যাখ্যা, ৫/৩৪৫ পৃঃ।

রাসূল (ছাঃ) এর দাফন

দাফন কোথায় হবে এ নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়। তখন আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) এসে বলেন,إِنِّى سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَا قُبِضَ نَبِىٌّ إِلاَّ دُفِنَ حَيْثُ يُقْبَضُ ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, নবীগণ যেখানে মৃত্যুবরণ করেন, সেখানেই কবরস্থ হন’।[1] এ হাদীছ শোনার পর সকল মতভেদের অবসান হয়। ছাহাবী আবু ত্বালহা রাসূল (ছাঃ)-এর বিছানা উঠিয়ে নেন। অতঃপর সেখানেই ‘লাহাদ’ (لَحَد) অর্থাৎ পাশখুলী কবর খনন করা হয়’ (ইবনু মাজাহ হা/১৫৫৭)। আবু ত্বালহা উক্ত কবর খনন করেন (ইবনু হিশাম ২/৬৬৩)। অতঃপর কবরে নামেন হযরত আলী, ফযল ও কুছাম বিন আববাস, শুক্বরান ও আউস বিন খাওলী’ (ইবনু হিশাম ২/৬৬৪)।
[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৬২৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬০৫।

রাসূল (ছাঃ) এর জানাযা

ঘরের মধ্যে খননকৃত কবরের পাশেই লাশ রাখা হয়। অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-এর নির্দেশক্রমে দশ দশজন করে ভিতরে গিয়ে জানাযা পড়েন। জানাযায় কোন ইমাম ছিল না। প্রথমে রাসূল (ছাঃ)-এর পরিবার-পরিজন, অতঃপর মুহাজিরগণ, অতঃপর আনছারগণ জানাযার ছালাত আদায় করেন। এভাবে পুরুষ, মহিলা ও বালকগণ পরপর জানাযা পড়েন। জানাযার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া মঙ্গলবার সারা দিন ও রাত পর্যন্ত জারী থাকে। ফলে বুধবারের মধ্যরাতে দাফনকার্য সম্পন্ন হয় (ইবনু হিশাম ২/৬৬৪)। মানছূরপুরী বলেন, ইসলামী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সন্ধ্যার পরেই দিন শেষ হয়ে যায় এবং পরবর্তী দিন শুরু হয়। সেকারণ মঙ্গলবার ও বুধবারের মতভেদ দূর করার জন্য আমরা ঘণ্টার আশ্রয় নিয়েছি। সে হিসাবে মৃত্যুর প্রায় ৩২ ঘণ্টা পরে রাসূল (ছাঃ)-এর দাফন কার্য সম্পন্ন হয়।[1] এভাবেই ৬৩ বছরের পবিত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন।

[1]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২৫৩, টীকা-৪ সহ; ২/৩৬৮ নকশা।




প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url