প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-১৬]






আবু ত্বালিব ও খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যু এবং মোহাম্মদ (সা:) এর তায়েফ গমন


আবু ত্বালিবের মৃত্যু

রজব ১০ম নববী বর্ষ
১০ম নববী বর্ষের মুহাররম মাসে ঠিক তিন বছরের মাথায় বয়কট শেষ হওয়ার ৬ মাস পরে রজব মাসে আবু ত্বালিবের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে আবু জাহল, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া প্রমুখ মুশরিক নেতৃবৃন্দ তাঁর শিয়রে বসে ছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্যুপথযাত্রী পরম শ্রদ্ধেয় চাচাকে বললেন, يَا عَمِّ قُلْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ كَلِمَةً أَشْهَدُ لَك بِهَا عِنْدَ اللهِ ‘হে চাচাজী! আপনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমাটি পাঠ করুন, যাতে আমি তার কারণে আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে সাক্ষ্য দান করতে পারি’। জবাবে আবু ত্বালিব বলেন, ‘হে ভাতিজা! যদি আমার পরে তোমার বংশের উপর গালির ভয় না থাকত এবং কুরায়েশরা যদি এটা না ভাবত যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে এটা বলেছি ও তোমাকে খুশী করার জন্য বলেছি, তাহ’লে আমি অবশ্যই ওটা বলতাম’ (ইবনু হিশাম ১/৪১৮)। অতঃপর যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন আবু জাহল ও তার সহোদর বৈপিত্রেয় ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বারবার তাঁকে উত্তেজিত করতে থাকেন এবং বলেন, أَتَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطّلِبِ؟ ‘আপনি কি আব্দুল মুত্ত্বালিবের ধর্ম ত্যাগ করবেন’? জবাবে আবু ত্বালিবের মুখ দিয়ে শেষ বাক্য বেরিয়ে যায়, أَنَا عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ ‘আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের দ্বীনের উপরে’ (আর-রাউযুল উনুফ ২/২২৩)। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে উঠলেন, لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْهُ ‘আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে যাব। যতক্ষণ না আমাকে নিষেধ করা হয়’। ফলে আয়াত নাযিল হয়- مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَنْ يَّسْتَغْفِرُوْا لِلْمُشْرِكِيْنَ وَلَوْ كَانُوْا أُوْلِيْ قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيْمِ- ‘নবী ও ঈমানদারগণের জন্য সিদ্ধ নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করুক মুশরিকদের জন্য। যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়, একথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী’ (তওবা ৯/১১৩)।

এরপর রাসূল (ছাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে আয়াত নাযিল হয়, إِنَّكَ لاَ تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَآءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ‘নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পার না যাকে তুমি ভালবাসো। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করে থাকেন। আর তিনি হেদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)।[1] উল্লেখ্য যে, সূরা তওবাহ মাদানী সূরা হ’লেও তার মধ্যে ১১১-১১৩ আয়াত তিনটি বায়‘আতে কুবরা ও আবু তালিবের মৃত্যু প্রসঙ্গে মক্কায় নাযিল হয় (তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।

এভাবে হেদায়াতের আলোকবর্তিকা স্বীয় ভাতিজাকে সবকিছুর বিনিময়ে আমৃত্যু আগলে রেখেও শেষ মুহূর্তে এসে পরকালীন সৌভাগ্যের পরশমণি হাতছাড়া হয়ে গেল। স্নেহসিক্ত ভাতিজার প্রাণভরা আকুতি ব্যর্থ হ’ল এবং শয়তানের প্রতিমূর্তি গোত্রনেতাদের প্ররোচনা জয়লাভ করল। পিতৃধর্মের বহুত্ববাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় হ’লেন। এ দৃশ্য যে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য কত বেদনাদায়ক ছিল, তা আখেরাতে বিশ্বাসী প্রকৃত মুমিনগণ উপলব্ধি করতে পারেন। কেননা যে চাচা দুনিয়াবী কারাগারের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা থেকে সর্বদা ঢালের মত তাঁকে রক্ষা করেছেন এবং নিজে অমানুষিক কষ্ট ও দুঃখ সহ্য করেছেন, সেই চাচা দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণের পরে পুনরায় জাহান্নামের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবেন, এটা তিনি কিভাবে ভাবতে পারেন? বলা বাহুল্য এভাবেই সর্বদা তাক্বদীর বিজয়ী হয়ে থাকে।

একদিন চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে আখেরাতে আবু তালিবের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা আযাবপ্রাপ্ত হবেন আবু ত্বালিব। তিনি আগুনের দু’টি জুতা পরিহিত হবেন, যাতে তাঁর মাথার মগয গলে টগবগ করে ফুটবে’।[2] প্রিয় চাচা আববাস (রাঃ) একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আবু তালেব আপনাকে যেভাবে হেফাযত ও সহযোগিতা করেছেন, তার বিনিময়ে আপনি কি তাঁকে কোন উপকার করতে পারবেন? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি তাকে জাহান্নামের গভীরে দেখতে পেলাম। অতঃপর তাকে (আল্লাহর হুকুমে) সেখান থেকে বের করে টাখনু পর্যন্ত উঠিয়ে আনলাম।وَلَوْلاَ أَنَا لَكَانَ فِى الدَّرْكِ الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ ‘যদি আমি না হ’তাম, তাহ’লে তিনি জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকতেন’ (মুসলিম হা/২০৯)। আবু সাঈদ খুদরীর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, সম্ভবতঃ ক্বিয়ামতের দিন আমার সুফারিশ তার উপকারে আসবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামের অগভীর স্থানে নেওয়া হবে, যা তার টাখনু পর্যন্ত পৌঁছবে এবং তাতেই তার মস্তিষ্ক আগুনে টগবগ করে ফুটবে, যেমন উত্তপ্ত কড়াইয়ে পানি ফুটে থাকে’।[3]

অতএব আবু তালিবের এই হালকা আযাব তার আমলের কারণে নয়, বরং তা হবে রাসূল (ছাঃ)-এর বিশেষ সুফারিশের কারণে। আর সেটা হবে রাসূল (ছাঃ)-এর বিশেষত্বের অন্তর্ভুক্ত ও তার উচ্চ মর্যাদার কারণে, যা আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। কেননা আবু ত্বালিব শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَّشَاءُ ‘আল্লাহ শিরকের পাপ ক্ষমা করেন না। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে চান, তার সব পাপ ক্ষমা করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। তিনি বলেন, فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ ‘ক্বিয়ামতের দিন মুশরিকদের জন্য সুফারিশকারীদের কোন সুফারিশ কাজে আসবে না’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৪৮)।

[1]. বুখারী হা/১৩৬০, ৩৮৮৪, ৪৭৭২; মুসলিম হা/২৪ প্রভৃতি।

[2]. মুসলিম হা/২১২; মিশকাত হা/৫৬৬৮ ‘জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ (মিশকাতে ‘বুখারী’ লেখা হয়েছে। কিন্তু বুখারীতে আবু ত্বালিব-এর কথা পাওয়া যায়নি)।

[3]. মুসলিম হা/২১০, ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘আবু তালিবের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর সুফারিশ ও সেকারণে তার শাস্তি লঘু করণ’ অনুচ্ছেদ-৯০।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
১. হক-এর স্বীকৃতি এবং হকপন্থীর প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতাই কেবল পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না আক্বীদার পরিবর্তন ঘটে এবং মৌখিক স্বীকৃতি থাকে।

২. আদর্শগত ভালোবাসাই পরকালে বিচার্য বিষয়, অন্য কোন ভালোবাসা নয়। মুহাম্মাদ-এর প্রতি আবু ত্বালিবের ভালোবাসা ছিল বংশগত কারণে। আদর্শগত কারণে নয়। সেকারণ তা পরকালে কোন কাজে আসেনি।

৩. তাওহীদের সাথে শিরক মিশ্রিত হ’লে কোন নেক আমলই আল্লাহর নিকটে কবুল হয় না। যেমন আল্লাহর উপরে বিশ্বাস ও তাকে স্বীকৃতি দান করা সত্ত্বেও অসীলা পূজার শিরক থাকার কারণে আবু ত্বালিবের কোন সৎকর্মই আল্লাহ কবুল করেননি। বর্তমান যুগেও যেসব মুসলিম নর-নারী বিভিন্ন কবর, ছবি-প্রতিকৃতি ও স্থানপূজায় লিপ্ত আছেন ও তাদের অসীলায় পরকালে মুক্তি কামনা করেন, তাদের এই কামনা জাহেলী আরবদের লালিত শিরকের সাথে তুলনীয়। যা পরকালে কোন কাজে আসবেনা।

৪. পিতৃধর্মে ত্রুটি থাকলে তা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে এবং সর্বাবস্থায় নির্ভেজাল তাওহীদকে অাঁকড়ে থাকতে হবে। সকল আবেদন-নিবেদন সরাসরি আল্লাহর নিকটেই করতে হবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে কেবল তাঁর বিধানই মেনে চলতে হবে।

কিন্তু অসীলা পূজারী মুশরিকরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের ধারণায় তাদের কল্পিত অসীলাকেই মুখ্য মনে করে। তার কাছেই সব আবেদন-নিবেদন পেশ করে এবং নিজেদের মনগড়া শিরকী বিধান সমূহ মেনে চলে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই বংশীয় রেওয়াজের প্রতি আকর্ষণ আবু ত্বালেব ছাড়তে পারেননি।

৫. কেবল আব্দুল্লাহ, আবু ত্বালেব ইত্যাদি ইসলামী নাম পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে না, যতক্ষণ না সমস্ত মনগড়া মা‘বূদ ছেড়ে একমাত্র হক মা‘বূদ আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি একনিষ্ঠ হবে। মৃত্যুর সময় আবু ত্বালিবকে শিরকের দিকে প্ররোচনা দানকারী অন্যতম নেতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ। অতএব ইসলামী নাম রাখার সাথে সাথে ইসলামী বিধান সমূহ মেনে চলা এবং আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলীর সাথে অন্যকে শরীক না করে নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাসের উপরে দৃঢ় থাকার উপরেই পরকালীন মুক্তি নির্ভর করে।

খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যু

রামাযান ১০ম নববী বর্ষ
স্নেহশীল চাচা আবু ত্বালিবের মৃত্যুর অনধিক তিন মাস পরে দশম নববী বর্ষের রামাযান মাসে প্রাণাধিক প্রিয়া স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা ‘তাহেরা’-র মৃত্যু হয় (আর-রাহীক্ব ১১৬ পৃঃ)। তবে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, আবু ত্বালিবের মৃত্যুর তিন দিন পরে খাদীজার মৃত্যু হয় (যাদুল মা‘আদ ৩/২৮)। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর এবং রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ছিল ৫০ বছর।

দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ বয়কটকালীন নিদারুণ কষ্ট অবসানের মাত্র ৬ মাসের মাথায় চাচা, অতঃপর স্ত্রীকে হারিয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত ও আশ্রয়হারা নবীর অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা চিন্তাশীল মাত্রই বুঝতে পারেন। চাচা আবু তালেব ছিলেন সামাজিক জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ঢাল স্বরূপ। অন্যদিকে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনে খাদীজা ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ততম নির্ভরকেন্দ্র। দাম্পত্য জীবনের পঁচিশ বছর সেবা ও সাহচর্য দিয়ে, বিপদে শক্তি ও সাহস যুগিয়ে, অভাব-অনটনে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে, হেরা গুহায় নিঃসঙ্গ ধ্যান ও সাধনাকালে অকুণ্ঠ সহমর্মিতা দিয়ে, নতুনের শিহরণে ভীত-চকিত রাসূলকে অনন্য সাধারণ প্রেরণা, উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়ে, অতুলনীয় প্রেম, ভালবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে তিনি ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক জীবন্ত নে‘মত স্বরূপ। তিনি ছিলেন শেষ সন্তান ইবরাহীম ব্যতীত রাসূল (ছাঃ)-এর সকল সন্তানের মা। তিনি ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ ‘জান্নাতী মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’লেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম’। [1]

খাদীজা (রাঃ) ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে জিব্রীল নিজের পক্ষ হ’তে ও আল্লাহর পক্ষ হ’তে রাসূল (ছাঃ)-এর মাধ্যমে তাঁকে সালাম দেন এবং জান্নাতে তাঁর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মুক্তাখচিত প্রাসাদের সুসংবাদ দেন।[2]

তিনিই একমাত্র স্ত্রী যার জীবদ্দশায় রাসূল (ছাঃ) অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং তার মৃত্যুর পরেও আজীবন রাসূল (ছাঃ) তাকে বারবার স্মরণ করেছেন। অন্য স্ত্রীদের সামনে অকুণ্ঠচিত্তে তার প্রশংসা করেছেন। এমনকি তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে খাদীজার বান্ধবীদের কাছে উপঢৌকন পাঠাতেন।[3]

[1]. আহমাদ হা/২৬৬৮, সনদ ছহীহ; তিরমিযী হা/৩৮৭৮; মিশকাত হা/৬১৮১।
[2]. বুখারী হা/১৭৯২, ৩৮২০; মুসলিম হা/২৪৩৩; মিশকাত হা/৬১৭৬।
[3]. বুখারী হা/৩৮১৮; মুসলিম হা/২৪৩৫; মিশকাত হা/৬১৭৭।

আবু ত্বালিব ও খাদীজার মৃত্যু পর্যালোচনা

সামান্য ব্যবধানে জীবনের দু’জন শ্রেষ্ঠ সহযোগীকে হারিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিদারুণভাবে মর্মাহত ও বেদনাহত হন। জীবন থাকলে মৃত্যু আসবেই। এটাই প্রাণীজগতের চিরন্তন নিয়ম। নিকটজনেরা এতে ব্যথিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। রহমাতুল্লিল ‘আলামীন হিসাবে দয়াশীল নবীর জন্য এটা ছিল আরও বেশী বেদনাময়। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে, এ কারণে এ বছরকে ‘দুঃখের বছর’ (عَامُ الْحُزْنِ) হিসাবে অভিহিত করতে হবে।[1] রাসূল (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরাম কখনো এরূপ নামকরণ করেননি। এমনকি সীরাতে ইবনে ইসহাক, ইবনু হিশাম বা পরবর্তী কোন সীরাত গ্রন্থে এ নামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এর একমাত্র উৎস আমি খুঁজে পেয়েছি ক্বাসত্বালানীর আল-মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়াহ কিতাবের মধ্যে। যেখান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন শায়খ সা‘আতী (الساعاتى) আহমাদ আব্দুর রহমান আল-বান্না (১৮৮৫-১৯৫৮ খৃঃ)। যিনি মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমীন-এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ হাসানুল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯ খৃঃ)-এর পিতা ছিলেন। তিনি স্বীয় কিতাব ফাৎহুর রববানী (২০/২২৬)-এর মধ্যে বলেন, وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُسَمَّى ذَلِكَ الْعَامَ عَامَ الْحُزْنِ، كَذَا فِى الْمَوَاهِبِ اللَّدُنِّيَةِ ‘আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত বছরকে ‘দুঃখের বছর’ হিসাবে অভিহিত করতেন। যেমন মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়াহ-তে বর্ণিত হয়েছে’। অথচ ক্বাসত্বালানী সেখানে সূত্র হিসাবে উল্লেখ করেছেন, فيما ذكره صاعد ‘ছা‘এদ যেমন বর্ণনা করেছেন’। আলবানী বলেন, ছা‘এদ একজন অপরিচিত ব্যক্তি। যাকে কেউ চেনে না এবং কেউ তাকে বিশ্বস্ত বলেননি’। আর ক্বাসত্বালানীর কথায় বুঝা যায় যে, তিনি এটাকে ‘সংযুক্তি’ (تعليق) হিসাবে এনেছেন কোনরূপ সনদ ছাড়াই। অতএব এটি ‘মু‘যাল’ পর্যায়ের দুর্বলতম বর্ণনা। যা বিশুদ্ধ নয়’।[2]

উল্লেখ্য যে, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল-ক্বাসত্বালানী (৮৫১-৯২৩ হি.) ছিলেন একাধারে ছহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ও রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনীকার। এতদ্ব্যতীত সীরাহ হালাবিইয়াহ-তে সনদ বিহীনভাবে বলা হয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত বছরকে ‘দুঃখের বছর’ হিসাবে অভিহিত করতেন’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/৫২১)। জীবনীকার মুহাম্মাদ আল-গাযালী (মৃ. ১৪১৬ হি.) একই শিরোনাম করেছেন (ফিক্বহুস সীরাহ ১৩১ পৃঃ)।

আমরা মনে করি যে, রাসূল (ছাঃ)-এর পুরা জীবনী সামনে রাখলে তার মধ্যে বদর বিজয় ও মক্কা বিজয়সহ অন্যান্য বিজয়ের আনন্দগুলি বাদ দিলে সেখানে বরং দুঃখের পাল্লাই ভারি হবে। এমনকি ব্যক্তি জীবনে ৪ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও কেবল ফাতেমা ব্যতীত ৬ সন্তানই তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেছেন। পিতা হিসাবে এটি তাঁর জীবনে কম দুঃখের ছিল না।

অতঃপর দাওয়াতী জীবনে তিনি ও তাঁর সাথী ছাহাবীগণ দ্বীনের জন্য যে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। বিশেষ করে তায়েফে নির্যাতনের ঘটনাকে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টদায়ক ও মর্মান্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন’।[3] অতঃপর মাদানী জীবনে তৃতীয় হিজরীতে ওহোদ যুদ্ধে তাঁর নিজের দাঁত ভাঙ্গা ও চাচা হামযাসহ ৭০ জন প্রাণপ্রিয় সাথীকে হারানো, চতুর্থ হিজরীর ছফর মাসে রাজী‘ কূয়ার নিকটে ১০ জন ছাহাবী ও তার কয়েকদিন পরে মাঊনা কূয়ার নিকটে ৭০ জন শ্রেষ্ঠ ক্বারী ছাহাবীকে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনা। যেজন্য তিনি মাসব্যাপী পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে ঐসব বিশ্বাসঘাতক শত্রুদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।[4] যে ঘটনাগুলির ফলে মাত্র ছ’মাসের কম সময়ের মধ্যে প্রায় ১৫০ জন ছাহাবী শহীদ হয়ে যান। তাদের হারানোর বেদনায় ব্যথিত হয়ে তিনি কিন্তু কখনো দুঃখের বছর কিংবা শোকের মাস বা শোকের দিবস ইত্যাদি পালন করেননি। যেমনভাবে বর্তমান যুগে করা হয়ে থাকে।

বস্ত্ততঃ কোন বছরই একচেটিয়া দুঃখের বা আনন্দের নয়। বরং প্রতিটি মুহূর্তেই আনন্দ ও বেদনার আগমন-নির্গমন ঘটে থাকে আল্লাহর হুকুমে। তিনি বলেন, فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا- إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْراً. ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’। ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (ইনশিরাহ ৯৪/৫-৬)। তাই কোন একটি সময়, দিন, মাস বা বছরকে আনন্দের বা দুঃখের বছর বলে অভিহিত করা আল্লাহর চিরন্তন বিধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের শামিল। রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ يُؤْذِينِى ابْنُ آدَمَ، يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ، بِيَدِى الأَمْرُ، أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ‘আল্লাহ বলেন, আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়। সে যামানাকে গালি দেয়। অথচ ‘আমিই যামানা’। আমার হাতেই সকল ক্ষমতা। আমিই রাত্রি ও দিবসের আবর্তন-বিবর্তন ঘটাই’।[5]

অতএব ভাল-মন্দ ও দুঃখ-আনন্দ নিয়ে জীবন। যা আল্লাহর অমোঘ বিধান। বান্দাকে তা মেনে নিয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একারণেই ইসলামে কোন দিবস পালনের বিধান নেই। কেবল আনন্দের দিন হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে জুম‘আ, ঈদায়েন, হজ্জ ও আইয়ামে তাশরীক্বের তিনদিন সহ গড়ে সাত দিন। যা হজ্জে আগমনকারী ব্যতীত অন্যদের জন্য ছয় দিন। প্রতিটি আনন্দের দিনই ইবাদতের পবিত্রতার সাথে সম্পৃক্ত। সেখানে আনন্দের নামে কোনরূপ অনর্থক আমোদ-ফুর্তি ও অনুষ্ঠানসর্বস্ব পার্থিবতার কোন সুযোগ নেই।

অতএব চাচা আবু ত্বালিব ও স্ত্রী খাদীজা (রাঃ)-এর স্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে ১০ম নববী বর্ষকে ‘দুঃখের বছর’ (عَامُ الْحُزْنِ) বলে অভিহিত করা ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। তাই এরূপ আখ্যায়িত করা হ’তে বিরত থাকা আবশ্যক।

[1]. আর-রাহীকুল মাখতূমে উপরোক্ত শিরোনাম করা হয়েছে। (ঐ, আরবী ১১৫ পৃঃ)।
[2]. আলবানী, দিফা‘ ‘আনিল হাদীছ ওয়াস-সীরাহ ১৮ পৃঃ; মা শা-‘আ ৬৭-৬৯ পৃঃ।
[3]. বুখারী হা/৩২৩১; মুসলিম হা/১৭৯৫।
[4]. বুখারী হা/৪০৯৬; মুসলিম হা/৬৭৭; আবুদাঊদ হা/১৪৪৩; মিশকাত/১২৮৯-৯০।
[5]. বুখারী হা/৪৮২৬; মুসলিম হা/২২৪৬; মিশকাত হা/২১ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

সওদার সাথে বিবাহ

শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ
খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর বিপর্যস্ত সংসারের হাল ধরার জন্য এবং মাতৃহারা কন্যাদের দেখাশুনার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাওদাহ বিনতে যাম‘আহ নাম্নী জনৈকা বিধবা মহিলাকে বিবাহ করেন ১০ম নববী বর্ষের শাওয়াল মাসে। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর ৪ কন্যার মধ্যে ৩য় ও ৪র্থ উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা তখন অবিবাহিতা ছিলেন। সাওদা ও তার পূর্ব স্বামী সাকরান বিন আমর(سَكْرَانُ بن عَمْرو) উভয়ে ইসলাম কবুল করার পর হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর সেখানেই অথবা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে তার স্বামী ইনতেকাল করেন। এ সময় মৃত স্বামীর পাঁচটি বা ছয়টি সন্তানের গুরুভার এসে পড়েছিল সওদার উপরে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য তার সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্বসহ সওদাকে বিয়ে করেন।[1] সওদা অত্যন্ত দৃঢ় ঈমানের ও বলিষ্ঠ চরিত্রের মহিলা ছিলেন। তিনিই প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর তার প্রভাবে তার স্বামী সাকরান ইসলাম কবুল করেন। তাঁরা ১ম হাবশায় হিজরতকারী ৮৩ জনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইসলামের জন্য তাদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয় (ইবনু হিশাম ১/৩২১-৩২)।

[1]. আহমাদ হা/২৯২৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৫২৩।

ত্বায়েফ সফর

শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ
চাচা আবু ত্বালিব ও স্ত্রী খাদীজার মৃত্যুর পর দশম নববী বর্ষের শাওয়াল মাস মোতাবেক ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালে মে মাসের শেষে অথবা জুন মাসের প্রথমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহকে সাথে নিয়ে প্রধানতঃ নতুন সাহায্যকারীর সন্ধানে পদব্রজে(مَاشِيًا عَلَى قَدَمَيْهِ) ত্বায়েফ রওয়ানা হন।[1] এ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ছিল ৫০ বছর। এই প্রৌঢ় বয়সে এই দীর্ঘ পথ প্রচন্ড গরমের মধ্যে তিনি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন। যা ছিল মক্কা হ’তে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৯০ কি. মি. দূরে।

অতঃপর ত্বায়েফ পৌঁছে তিনি সেখানকার বনু ছাকবীফ গোত্রের তিন নেতা তিন সহোদর ভাই আব্দু ইয়ালীল, মাসঊদ ও হাবীব বিন আমর ছাক্বাফী-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন। সাথে সাথে ইসলামকে সাহায্য করার জন্য তিনি তাদের প্রতি আহবান জানান। উক্ত তিন ভাইয়ের একজনের কাছে কুরায়েশ-এর অন্যতম গোত্র বনু জুমাহ(بنو جُمَح) এর একজন মহিলা বিবাহিতা ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৪১৯)। সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই রাসূল (ছাঃ) সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনজনই তাঁকে নিরাশ করেন। একজন বলেন,هُوَ يَمْرُطُ ثِيَابَ الْكَعْبَةِ (أى يُمَزِّقُهَا) إِنْ كَانَ اللهُ أَرْسَلَكَ ‘সে কা‘বার গোলাফ ছিঁড়ে ফেলবে, যদি আল্লাহ তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়ে থাকেন’। অন্যজন বলেন,أَمَا وَجَدَ اللهُ أَحَدًا يُرْسِلُهُ غَيْرَكَ؟ ‘আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে রাসূল হিসাবে পাঠানোর জন্য পাননি’?

তৃতীয় জন বলেন, والله لا أكلِّمُكَ أبدًا، إن كنتَ رسولاً لأنت أعظمُ خطرًا من أن أرُدَّ عليكَ الكلامَ، ولئن كنتَ تَكْذِبُ على الله ما ينبغى أن أُكلِّمَك ‘আমি তোমার সাথে কোন কথাই বলব না। কেননা যদি তুমি সত্যিকারের নবী হও, তবে তোমার কথা প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক। আর যদি তুমি আল্লাহর নামে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়ে থাক, তবে তোমার সাথে আমার কথা বলা সমীচীন নয়’।[2]

নেতাদের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে এবার তিনি অন্যদের কাছে দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু কেউ তার দাওয়াত কবুল করেনি। অবশেষে দশদিন পর তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্য পা বাড়ান। এমন সময় নেতাদের উস্কানীতে বোকা লোকেরা ও ছোকরার দল এসে তাঁকে ঘিরে অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ ও হৈ চৈ শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে তাঁকে লক্ষ্য করে তারা পাথর ছুঁড়তে আরম্ভ করে। যাতে তাঁর পায়ের গোড়ালী ফেটে রক্তে জুতা ভরে যায়’ (আর-রাওযুল উনুফ ৪/২৪)। এ সময় যায়েদ বিন হারেছাহ ঢালের মত থেকে রাসূল (ছাঃ)-কে প্রস্তরবৃষ্টি থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। এভাবে রক্তাক্ত দেহে তিন মাইল হেঁটে (আর-রাহীক্ব ১২৫ পৃঃ) তায়েফ শহরের বাইরে তিনি এক আঙ্গুর বাগিচায় ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় আশ্রয় নেন। তখন ছোকরার দল ফিরে যায়। বাগানটির মালিক ছিলেন মক্কার দুই নেতা উৎবা ও শায়বা বিন রাবী‘আহ দুই ভাই।[3] এই উৎবার কন্যা ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবা। যিনি ওহোদ যুদ্ধের দিন কাফের পক্ষে মহিলা দলের নেতৃত্ব দেন এবং পরে মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন।

ত্বায়েফ সফর বিষয়ে আয়েশা (রাঃ) বলেন,

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ لِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا رَسُولَ اللهِ هَلْ أَتَى عَلَيْكَ يَوْمٌ كَانَ أَشَدَّ مِنْ يَوْمِ أُحُدٍ فَقَالَ لَقَدْ لَقِيتُ مِنْ قَوْمِكِ وَكَانَ أَشَدَّ مَا لَقِيتُ مِنْهُمْ يَوْمَ الْعَقَبَةِ إِذْ عَرَضْتُ نَفْسِى عَلَى ابْنِ عَبْدِ يَالِيلَ بْنِ عَبْدِ كُلاَلٍ فَلَمْ يُجِبْنِى إِلَى مَا أَرَدْتُ فَانْطَلَقْتُ وَأَنَا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِى فَلَمْ أَسْتَفِقْ إِلاَّ بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ فَرَفَعْتُ رَأْسِى فَإِذَا أَنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أَظَلَّتْنِى فَنَظَرْتُ فَإِذَا فِيهَا جِبْرِيلُ فَنَادَانِى فَقَالَ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ وَمَا رَدُّوا عَلَيْكَ وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْكَ مَلَكَ الْجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ قَالَ فَنَادَانِى مَلَكُ الْجِبَالِ وَسَلَّمَ عَلَىَّ. ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنَّ اللهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ وَأَنَا مَلَكُ الْجِبَالِ وَقَدْ بَعَثَنِى رَبُّكَ إِلَيْكَ لِتَأْمُرَنِى بِأَمْرِكَ فَمَا شِئْتَ إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الأَخْشَبَيْنِ. فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، متفق عليه-

‘তিনি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন ওহোদের দিন অপেক্ষা কষ্টের দিন আপনার জীবনে এসেছিল কি? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ। তোমার কওমের কাছ থেকে যে কষ্ট পেয়েছি তার চাইতে সেটি অধিক কষ্টদায়ক ছিল। আর তা ছিল আক্বাবার (ত্বায়েফের) দিনের আঘাত। যেদিন আমি (ত্বায়েফের নেতা) ইবনু ‘আব্দে ইয়ালীল বিন ‘আব্দে কুলাল-এর কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে তাতে সাড়া দেয়নি। তখন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে আসার পথে ক্বারনুছ ছা‘আলিব (ক্বারনুল মানাযিল) নামক স্থানে পৌঁছার পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম। উপরের দিকে মাথা তুলে দেখলাম এক খন্ড মেঘ আমাকে ছায়া করে আছে। অতঃপর ভালভাবে লক্ষ্য করলে সেখানে জিবরীলকে দেখলাম। তিনি আমাকে সম্বোধন করে বললেন, আপনি আপনার কওমের নিকটে যে দাওয়াত দিয়েছেন এবং জবাবে তারা যা বলেছে, মহান আল্লাহ সবই শুনেছেন। এক্ষণে তিনি আপনার নিকটে ‘মালাকুল জিবাল’ (পাহাড় সমূহের নিয়ন্ত্রক) ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। ঐ লোকদের ব্যাপারে তাকে আপনি যা খুশী নির্দেশ দিতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অতঃপর মালাকুল জিবাল আমাকে সালাম দিল এবং বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ আপনার কওমের কথা শুনেছেন। আমি ‘মালাকুল জিবাল’। আপনার পালনকর্তা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন, যাতে আপনি আমাকে যা খুশী নির্দেশ দিতে পারেন। আপনি চাইলে আমি ‘আখশাবাইন’ (মক্কার আবু কুবায়েস ও কু‘আইক্বা‘আন) পাহাড় দু’টিকে তাদের উপর চাপিয়ে দিব। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, বরং আমি আশা করি আল্লাহ তাদের ঔরসে এমন সন্তান জন্ম দিবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না’।[4]

উপরোক্ত হাদীছটি ব্যতীত ত্বায়েফ সফর সম্পর্কে কোন কিছুই ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে সেখানে যে তিনি মর্মান্তিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, সে বিষয়ে উপরোক্ত হাদীছটিই যথেষ্ট। এজন্য কোন দুর্বল বর্ণনার প্রয়োজন নেই।[5]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৮; তারীখ ইবনু আসাকির হা/১০৫১৩; ইবনু হিশাম ১/৪১৯; যঈফাহ হা/২৯৩৩।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৪১৯; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/১৩৫; আর-রাহীক্ব ১২৫ পৃঃ।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৪২০; আল-বিদায়াহ ৩/১৩৪।
[4]. মুসলিম হা/১৭৯৫; বুখারী হা/৩২৩১; মিশকাত হা/৫৮৪৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৪ অনুচ্ছেদ; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৫৯৮। উপরোক্ত হাদীছে ابْنُ عَبْدِ يَالِيلَএসেছে। কিন্তু জীবনীকারগণ عَبْدُ يَالِيلَ বলেছেন। তারা ‘আব্দু কুলাল-কে ‘আব্দু ইয়ালীল-এর ভাই বলেছেন, পিতা নন’। যার সঙ্গে রাসূল (ছাঃ) কথা বলেছিলেন, তার নাম ছিল ‘আব্দু ইয়ালীল এবং তার পুত্রের নাম ছিল কিনানাহ। কেউ বলেছেন, মাসঊদ। কিনানাহ ইবনু ‘আব্দে ইয়ালীল ছিলেন ত্বায়েফের ছাক্বীফদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অন্যতম’ (ফাৎহুল বারী হা/৩২৩১-এর আলোচনা দ্রঃ)।
[5]. প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাগানে প্রবেশ করে আঙ্গুর গাছের ছায়া তলে বসে পড়লেন। এই সময় ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ নিয়ে ব্যাকুল মনে আল্লাহর নিকটে তিনি যে দো‘আ করেছিলেন, তা ‘মযলূমের দো‘আ’ নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। যদিও এটির সনদ যঈফ। দো‘আটি ছিল নিম্নরূপ :

اللَّهُمَّ إلَيْكَ أَشْكُو ضَعْفَ قُوَّتِي، وَقِلَّةَ حِيلَتِي، وَهَوَانِي عَلَى النَّاسِ، يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ، أَنْتَ رَبُّ الْمُسْتَضْعَفِينَ، وَأَنْتَ رَبِّي، إلَى مَنْ تَكِلُنِي؟ إلَى بَعِيدٍ يَتَجَهَّمُنِي؟ أَمْ إلَى عَدُوٍّ مَلَّكْتَهُ أَمْرِي؟ إنْ لَمْ يَكُنْ بِكَ عَلَيَّ غَضَبٌ فَلاَ أُبَالِيْ، وَلَكِنَّ عَافِيَتَكَ هِيَ أَوْسَعُ لِيْ، أَعُوذُ بِنُورِ وَجْهِكَ الَّذِي أَشْرَقَتْ لَهُ الظُّلُمَاتُ، وَصَلُحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ مِنْ أَنْ تُنْزِلَ بِيْ غَضَبَكَ، أَوْ يَحِلَّ عَلَيَّ سُخْطُكَ، لَكَ الْعُتْبَى حَتَّى تَرْضَى، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إلاَّ بِكَ-

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে আমার শক্তির দুর্বলতা, কৌশলের স্বল্পতা ও মানুষের নিকটে অপদস্থ হওয়ার অভিযোগ পেশ করছি- হে দয়ালুগণের সেরা! তুমি দুর্বলদের প্রতিপালক! আর তুমিই আমার একমাত্র পালনকর্তা। কাদের কাছে তুমি আমাকে সোপর্দ করেছ? তুমি কি আমাকে এমন দূর অনাত্মীয়ের কাছে পাঠিয়েছ যে আমাকে কষ্ট দেয়? অথবা এমন শত্রুর কাছে যাকে তুমি আমার কাজের মালিক বানিয়ে দিয়েছ? যদি আমার উপরে তোমার কোন ক্রোধ না থাকে, তাহ’লে আমি কোন কিছুরই পরোয়া করি না। কিন্তু তোমার মার্জনা আমার জন্য অনেক প্রশস্ত। আমি তোমার চেহারার জ্যোতির আশ্রয় প্রার্থনা করছি। যার কারণে অন্ধকার সমূহ আলোকিত হয়ে যায় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কর্মসমূহ সুন্দর হয়- এই বিষয় হ’তে যেন আমার উপরে তুমি তোমার গযব নাযিল না কর অথবা আমার উপর তোমার ক্রোধ আপতিত না হয়। কেবল তোমারই সন্তুষ্টি কামনা করব, যতক্ষণ না তুমি খুশী হও। নেই কোন শক্তি, নেই কোন ক্ষমতা তুমি ব্যতীত’ (ইবনু হিশাম ১/৪২০; ত্বাবারাণী, যঈফুল জামে‘ হা/১১৮২; যঈফাহ হা/২৯৩৩)।

(২) আঙ্গুর বাগিচার মালিক ওৎবা ও শায়বা যখন দূর থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর এ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা দেখলেন, তখন তারা দয়াপরবশ হয়ে তাদের খ্রিষ্টান গোলাম ‘আদ্দাস’ (عَدَّاس)-এর মাধ্যমে এক গোছা আঙ্গুর পাঠিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তা হাতে নিয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। বিস্মিত হয়ে আদ্দাস বলে উঠল, এ ধরনের কথা তো এ অঞ্চলের লোকদের মুখে কখনো শুনিনি’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি কোন দেশের লোক? তোমার ধর্ম কি? সে বলল, আমি একজন খ্রিষ্টান। আমি ‘নীনাওয়া’ (نينوى)-এর বাসিন্দা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘সৎকর্মশীল ব্যক্তি ইউনুস বিন মাত্তা (مِنْ قَرْيَةِ الرَّجُلِ الصَّالِحِ يُونُسَ بْنِ مَتَّى؟)-এর এলাকার লোক’? লোকটি আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনি ইউনুস বিন মাত্তা-কে কিভাবে চিনলেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ذَاكَ أَخِي، كَانَ نَبِيًّا وَأَنَا نَبِيٌّ ‘তিনি আমার ভাই। তিনি নবী ছিলেন এবং আমিও নবী’। একথা শুনে আদ্দাস রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে ঝুঁকে পড়ে তাঁর মাথা, হাত ও পায়ে চুমু খেল।

দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে উৎবা ও শায়বা দু’ভাই একে অপরকে বলতে লাগল, দেখছি শেষ পর্যন্ত লোকটা আমাদের ক্রীতদাসকেও বিগড়ে দিল। ক্রীতদাসটি ফিরে এসে তার মনিবকে বলল,يَا سَيِّدِي مَا فِي الأَرْضِ شَيْءٌ خَيْرٌ مِنْ هَذَا، لَقَدْ أَخْبَرَنِي بِأَمْرِ مَا يَعْلَمُهُ إلاَّ نَبِيٌّ- ‘হে মনিব! পৃথিবীতে এই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কেউ নেই’। তিনি আমাকে এমন একটি বিষয়ে খবর দিয়েছেন, যা নবী ব্যতীত কেউ জানে না’। তারা বলল, وَيْحَكَ يَا عَدَّاسُ، لاَ يَصْرِفَنَّكَ عَنْ دِينِكَ، فَإِنَّ دِينَكَ خَيْرٌ مِنْ دِينِهِ- ‘সাবধান আদ্দাস! লোকটি যেন তোমাকে তোমার ধর্ম থেকে ফিরিয়ে নিতে না পারে। কেননা তোমার দ্বীন তার দ্বীন অপেক্ষা উত্তম’ (ইবনু হিশাম ১/৪২১) বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৪১৯)। শায়খ আলবানী বলেন, ত্বায়েফের ঘটনা হিসাবে প্রসিদ্ধ অত্র বর্ণনাগুলির মধ্যে নেতাদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য ‘তোমরা যে ব্যবহার করেছ, তা গোপন রেখ’ (ইবনু হিশাম ১/৪১৯), অতঃপর আঙ্গুর বাগিচায় গিয়ে আল্লাহর নিকট অভিযোগ পেশ করে দো‘আ করা’ (৪২০ পৃঃ) ইত্যাদি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়’ (যঈফাহ হা/২৯৩৩; মা শা-‘আ ৬৫ পৃঃ)। আকরাম যিয়া উমারী বলেন, সীরাতে ইবনু হিশামে (১/৪১৯-২২) মুহাম্মাদ বিন কা‘ব আল-কুরাযী বর্ণিত ত্বায়েফের ঘটনা সমূহ ছহীহ সনদে বর্ণিত। কিন্তু তা ‘মুরসাল’। আর মুহাম্মাদ আল-কুরাযী হ’লেন ত্বায়েফের ঘটনা সমূহ বর্ণনার প্রধান উৎস’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/১৮৫ টীকা-৪)।



********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url