“যিলহজ মাসের আমল ও কুরবানির বিধান” একটি বিস্তারিত আলোচনা ( প্রথম পর্ব)



যিলহজের প্রথম দশ দিনের আমলের গুরুত্ব এবং কুরবানির ইচ্ছা পোষন


বছর ঘুরে প্রতিবছরই যিলহজ মাস আসে। এই মাসটি এলে আমরা আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব কুরবানির ঈদ পালন করি। সাধ্যানুসারে আমরা পশু কুরবানী করি, আনন্দ করি। অথচ আমরা অনেকেই জানি না এই ‍যিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন হচ্ছে বছরের শ্রেষ্ট দিন। এই দিনগুলোতে আমরা কি আমল করবো, কিভাবে কাটাবো তা বেশিরভাগ মানুষই জানি না। এমন কি কষ্টের টাকায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে কুরবানি আমরা দিয়ে থাকি সেটা আদৌ ইসলামের বিধান মতে হচ্ছে কিনা আমরা সেটাও জানি না। অথচ এসব বিষয় জানা আমাদের জন্য অবশ্যই জরুরী। তাই আমরা যিলহজ মাসের আমল ও কুরবানির আদ্যপান্ত সকল বিষয় এখানে ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত তুলে ধরবো। মুল লেখক মুহতারাম আবদুল হামীদ ফাইযী সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

যিলহজের প্রথম দশ দিন

আল্লাহ তাআলার প্রত্যেক কাজ বা সৃষ্টি হিকমতে ভরপুর প্রত্যেক বস্তুতে তাঁর প্রতিপালকত্বের দলীল এবং একত্বের সাক্ষ্য বিদ্যমান। তাঁর সকল কর্মেই পরিস্ফুটিত হয় তাঁর প্রত্যেক মহামহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত গুণ। কিছু সৃষ্টিকে কিছু মর্যাদা ও বিশেষ গুণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা, কিছু সময় ও স্থানকে অন্যান্যের উপর প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেওয়ার কর্মও তাঁর ঐ হিকমত ও মহত্বের অন্যতম।

আল্লাহ পাক কিছু মাস, দিন ও রাত্রিকে অপরাপর থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন; যাতে তা মুসলিমের আমল বৃদ্ধিতে সহযোগী হয়। তাঁর আনুগত্যে ও ইবাদতে মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং কর্মঠ মনে নতুন কর্মোদ্যম পুনঃ পুনঃ জাগরিত হয়। অধিক সওয়াবের আশায় সেই কাজে মনের লোভ জেগে ওঠে এবং তার বড় অংশ হাসিলও করে থাকে বান্দা। যাতে মৃত্যু আসার পূর্বে যথা সময়ে তার প্রস্তুতি এবং পুনরুত্থানের জন্য যথেষ্ট পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে পারে।

শরীয়তে নির্দিষ্ট ইবাদতের মৌসম এই জন্যই করা হয়েছে যাতে ঐ সময়ে ইবাদতে অধিক মনোযোগ ও প্রয়াস লাভ হয় এবং অন্যান্য সময়ে অসম্পূর্ণ অথবা স্বল্প ইবাদতের পরিপূর্ণতা ও আধিক্য অর্জন এবং তাওবাহ করার সুযোগ লাভ হয়।

ঐ ধরনের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ মৌসমেরই নির্দিষ্ট এক একটা ওযীফাহ ও করণীয় আছে; যার দ্বারায় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায়। সেই সময়ে আল্লাহ পাকের বিশেষ অনুগ্রহ ও করুণা আছে; যার দ্বারায় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পুরস্কৃত করে থাকেন। অতএব সৌভাগ্যশালী সেই হবে, যে ঐ নির্দিষ্ট মাস বা কয়েক ঘণ্টার মৌসমে নির্দিষ্ট ওযীফাহ ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজ মওলার সামীপ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর সম্ভবতঃ তাঁর অনুগ্রহের অধিকারী হয়ে পরকালে জাহান্নাম ও তাঁর ভীষণ অনলের কবল হতে নিষ্কৃতি পাবে।

আমল ও ইবাদতের নির্দিষ্ট মৌসমসমূহে আল্লাহর অনুগত ও দ্বীনদার বান্দা লাভবান হয় এবং অবাধ্য ও অলস বান্দা ক্ষতির শিকার হয়। তাই তো মুসলিমের উচিত, আয়ুর মর্যাদা ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত হওয়া এবং সেই সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত অধিকরূপে করা ও মরণাবধি সৎকার্যে অবিচল প্রতিষ্ঠিত থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

(وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْن)

অর্থাৎ, ‘‘তোমার ইয়াকীন উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের উপাসনা কর।’’ (কুঃ ১৫/৯৯)

সালেম বিন আব্দুল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘ইয়াকীন’ (সুনিশ্চয়তা) অর্থাৎ মৃত্যু। অনুরূপ বলেছেন মুজাহিদ, হাসান, কাতাদাহ প্রভৃতি মুফাসসিরগণও।[১]

আল্লাহ তাআলা যিলহজের প্রথম দশ দিনকে অন্যান্য দিনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন। ‘‘এই দশ দিনের মধ্যে কৃত নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আর কোন আমল নেই।’’ (সাহাবাগণ) বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে এমন কোন ব্যক্তি (এর আমল) যে নিজের জান-মাল সহ বের হয় এবং তারপর কিছুও সঙ্গে নিয়ে আর ফিরে আসে না।[২]

তিনি আরো বলেন, ‘‘আযহার দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক পবিত্রতর ও প্রতিদানে অধিক বৃহত্তর আর কোন আমল আল্লাহ আয্যা অজাল্লার নিকট নেই।’’ বলা হল, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি?!’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে এমন ব্যক্তির (আমল) যে নিজের জানমাল সহ বহির্গত হয়, অতঃপর তার কিছুও সঙ্গে নিয়ে আর ফিরে আসে না।’’[৩]

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, একদা আমি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ছিলাম। অতঃপর আমলসমূহের কথা উত্থাপন করলাম। তিনি বললেন, ‘‘এই দশ দিন ছাড়া কোন এমন দিন নেই যাতে আমল অধিক উত্তম হতে পারে।’’ তাঁরা বললেন, ‘হে রসূলুল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ?’ তিনি তার গুরুত্ব বর্ণনা করলেন, অতঃপর বললেন, ‘‘জিহাদও নয়। তবে এমন কোন ব্যক্তি যে নিজের জান-মাল সহ আল্লাহর রাস্তায় বের হয় এবং তাতেই তার জীবনাবসান ঘটে।’’[৪]

অতএব এই দলীলসমূহ হতে প্রমাণিত হয় যে, সারা বছরের সমস্ত দিনগুলি অপেক্ষা যিলহজের ঐ দশ দিনই বিনা বিয়োজনে উত্তম। এমন কি রমযানের শেষ দশ দিনও ঐ দশ দিনের চেয়ে উত্তম নয়।

ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন, ‘মোট কথা বলা হয়েছে যে, এই দশদিন সারা বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দিন; যেমনটি হাদীসের উক্তিতে প্রতীয়মান হয়। অনেকে রমযানের শেষ দশ দিনের উপরেও এই দিনগুলিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, যে নামায, রোযা, সাদকাহ ইত্যাদি আমল এই দিনগুলিতে পালনীয় ঐ আমলসমূহই ঐ দিনগুলিতেও পালনীয়। কিন্তু (যিলহজের) ঐ দিনগুলিতে ফরজ হাজ্জ আদায় করার অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে।’

আবার অনেকে বলেছেন (রমযানের) ঐ দিনগুলিই শ্রেষ্ঠ। কারণ, তাতে রয়েছে শবেকদর, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।

কিন্তু এই দুয়ের মধ্যবর্তী কিছু উলামা বলেন, (যিলহজের) দিনগুলিই শ্রেষ্ঠ এবং রমযানের রাত্রিগুলি শ্রেষ্ঠ। অবশ্য এইভাবে সমস্ত দলীল সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর আল্লাহই বেশী জানেন।[৫]

উক্ত দলীলসমূহ এই কথার প্রমাণ দেয় যে, প্রত্যেক নেক আমল (সৎকর্ম); যা এই দিনগুলিতে করা হয় তা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। অর্থাৎ, ঐ কাজই যদি অন্যান্য দিনে করা হয় তবে ততটা প্রিয় হয় না। আর যা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় তা তাঁর নিকট সর্বোত্তম। আবার এই দিনগুলিতে আমল ও ইবাদতকারী সেই মুজাহিদ থেকেও উত্তম, যে নিজের জান-মাল সহ জিহাদ করে বাড়ি ফিরে আসে।

অথচ বিদিত যে, আল্লাহর রাহে জিহাদ ঈমানের পর সর্বোৎকৃষ্ট আমল। যেহেতু আবূ হুরাইরাহ (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! কোন আমল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ ও তদীয় রসূলের প্রতি ঈমান।’’ সে বলল, ‘তারপর কি?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদ।’’ সে বলল, ‘তারপর কি?’ তিনি বললেন, ‘‘গৃহীত হাজ্জ।’’[৬]

কিন্তু পূর্বোক্ত হাদীসসমূহ হতে প্রতিপাদিত হয়েছে যে, বৎসরের অন্যান্য দিনের সকল প্রকার আমল অপেক্ষা যিলহজের ঐ দশদিনের আমল আল্লাহর নিকট অধিক উত্তম ও প্রিয়তম। সুতরাং ঐ দশ দিনের আমল যদিও জিহাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়, তবুও অন্যান্য দিনের আমলের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর; যদিও বা সেই আমল (অন্যান্য দিনে) শ্রেষ্ঠ। আর নবী (সা.) কোন আমলকে ব্যতিক্রান্ত করেননি। তবে এমন এক জিহাদের কথা উল্লেখ করেছেন যা সর্বোৎকৃষ্ট জিহাদ; যাতে মুজাহিদ শহীদ হয়ে যায় এবং আর ফিরে আসে না; যার ঐ আমল উক্ত দশ দিনের সমস্ত আমলের চেয়েও উত্তম।

কোন বস্তুকে যখন সাধারণভাবে শ্রেষ্ঠ বলা হয়, তখন তার এই অর্থ নয় যে, ঐ বস্তু সর্বাবস্থায় ও সকলের পক্ষেই শ্রেষ্ঠ। বরং অশ্রেষ্ঠও তার নির্দেশিত বিধিবদ্ধ স্থানে সাধারণ শ্রেষ্ঠ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হতে পারে। যেমন, জিহাদ সাধারণভাবে শ্রেষ্ঠ আমল। কিন্তু অশ্রেষ্ঠ কোন নেক আমল তার নির্দেশিত নির্দিষ্ট ঐ দশ দিনে করা হলে তা জিহাদ থেকেও শ্রেষ্ঠতর।

অনুরূপভাবে, যেমন রুকু ও সিজদার মধ্যে তাসবীহ পাঠ কুরআন পাঠ হতেও উত্তম। (বরং ঐ অবস্থায় কুরআন পাঠ অবৈধ।) অথচ কুরআন পাঠ সাধারণ সর্ববিধ তাসবীহ ও যিকর হতে উত্তম।[৭]

যিলহজের দশ দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফযীলত

১। আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলির শপথ করেছেন। আর কোন জিনিসের নামে শপথ তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যেরই প্রমাণ। আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘শপথ ঊষার, শপথ দশ রজনীর----।’’

(সূরা ফাজর ১-২ আয়াত)

ইবনে আব্বাস (রা.) ইবনে যুবাইর (রা.) প্রভৃতি সলফগণ বলেন, ‘নিশ্চয় ঐ দশ রাত্রি বলতে যিলহজের দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে।’ ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, ‘এটাই সঠিক।’ শাওকানী (রহ.) বলেন, ‘এই অভিমত অধিকাংশ ব্যাখ্যাদাতাগণের।’[৮]

অবশ্য ঐ দশ রাত্রি বলতে এই দশ দিনকেই নির্দিষ্ট করে বুঝার ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিত আল্লাহর রসূল (সা.)-এর নিকট হতে আসেনি; যা সুনিশ্চিতভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। যার জন্যই এই ব্যাখ্যায় মতান্তর সৃষ্টি হয়েছে, আর আল্লাহই এ বিষয়ে অধিক জানেন।

২। নবী (সা.) সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, এই দিনগুলি দুনিয়ার সর্বোকৃৎষ্ট দিন। যেমন পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।

৩। তিনি এই দিনগুলিতে সৎকর্ম করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেহেতু এই দিনগুলি সকলের জন্য পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ এবং হাজীদের জন্য পবিত্রস্থানে (মক্কায়) আরো গুরুত্বপূর্ণ।

৪। তিনি এই দিনগুলিতে অধিকাধিক তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল ও তাকবীর পড়তে আদেশ করেছেন।[৯]

৫। এই দিনগুলির মধ্যে আরাফাহ ও কুরবানীর দিন রয়েছে।

৬। এগুলির মধ্যেই কুরবানী ও হাজ্জ করার মত বড় আমল রয়েছে।

হাফিয ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘একথা স্পষ্ট হয় যে, যিলহজের প্রথম দশ দিনের বিশেষ গুরুত্বের কারণ; যেহেতু ঐ দিনগুলিতে মৌলিক ইবাদতসমূহ একত্রিত হয়েছে যেমন, নামায, রোযা, সদাকাহ এবং হাজ্জ। যা অন্যান্য দিনগুলিতে এইভাবে জমা হয় না।[১০]

[১] (ইবনে কাসীর ৪/৩৭১)
[২] (বুখারী, আবূ দাঊদ)
[৩] (দারেমী ১/৩৫৭)
[৪] (আহমাদ, ইরওয়াউল গালীল ৩/৩৯৯)
[৫] (তাফসীর ইবনে কাসীর ৫/৪১২)
[৬] (বুখারী ১৬নং)
[৭]
[৮] (তাফসীর ইবনে কাসীর, ফাতহুল কাদীর ৫/৪৩২)
[৯] (সহীহ তারগীব ১২৪৮নং)
[১০] (ফাতহুল বারী ২/৪৬০)

কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা পোষন করলে

সুন্নাহতে এ কথা প্রমাণিত যে, যে ব্যক্তি কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা বা সংকল্প করেছে তার জন্য ওয়াজিব; যিলহজ মাস প্রবেশের সাথে সাথে কুরাবানীর পশু যবেহ না করা পর্যন্ত সে যেন তার দেহের কোন লোম বা চুল, নখ ও চর্মাদি না কাটে। এ বিষয়ে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘যখন তোমরা যিলহজ মাসের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন কুরবানী না করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ (কাটা) হতে বিরত থাকে।’’ অন্য এক বর্ণনায় বলেন, ‘‘সে যেন তার (মরা বা ফাটা) চর্মাদির কিছুও স্পর্শ না করে।’’[১]

বলিষ্ঠ মতানুসারে এখানে এ নির্দেশ ওয়াজিবের অর্থে এবং নিষেধ হারামের অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কারণ, তা ব্যাপক আদেশ এবং অনির্দিষ্ট নিষেধ, যার কোন প্রত্যাহতকারীও নেই। কিন্তু যদি কেউ জেনে-শুনে ইচ্ছা করেই চুল-নখ কাটে, তবে তার জন্য জরুরী যে, সে যেন আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে। আর তার জন্য কোন কাফফারা নেই। সে সবাভাবিকভাবে কুরবানীই করবে। আবার প্রয়োজনে (যেমন নখ ফেটে বা ভেঙ্গে ঝুলতে থাকলে বা মাথায় জখমের উপর চুল থাকলে এবং ক্ষতির আশঙ্কা হলে) কেটে ফেলতে কোন দোষ নেই। কারণ, সে মুহরিম (যে হাজ্জ বা ওমরার জন্য ইহরাম বেঁধেছে তার) অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যার জন্য অসুবিধার ক্ষেত্রে মাথা মুন্ডিত করাও বৈধ করা হয়েছে।

এই নির্দেশের পশ্চাতে যুক্তি এই যে, কুরবানীদাতা কিছু আমলে মুহরিমের মতই। যেমন, কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যলাভ করা ইত্যাদি। তাই কুরবানীদাতাও মুহরিমের পালনীয় কিঞ্চিৎ কর্তব্য পালন করতে আদিষ্ট হয়েছে।

এমন কোন ব্যক্তি যার চাঁদ দেখার পর কুরবানী করার ইচ্ছা ছিল না, সে চুল বা নখ কেটে থাকলে এবং তারপর কুরবানী করার ইচ্ছা হলে তারপর থেকেই আর তা কাটবে না।

কুরবানী করার জন্য যদি কেউ কাউকে ভার দেয় অথবা অসীয়ত করে, তবে সেও নখ-চুল কাটবে না। অবশ্য ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা অসী এই নিষেধের শামিল হবে না। অর্থাৎ তাদের জন্য নখ-চুল কাটা দূষণীয় নয়।

অনুরূপভাবে পরিবারের অভিভাবক কুরবানী করলে এই নিষেধাজ্ঞা কেবল তার পক্ষে হবে; বাকী অন্যান্য স্ত্রী-পুত্র বা আত্মীয়দেরকে শামিল হবে না। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কুরবানী না থাকলে তারা নিজেদের চুল-নখ কাটতে পারে। যেহেতু আল্লাহর রসূল (সা.) নিজ বংশধরের তরফ থেকে কুরবানী করতেন অথচ তিনি তাদেরকে নখচুল কাটতে নিষেধ করেছেন বলে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।

যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা করে পুনরায় হাজ্জ করার নিয়ত করে (অর্থাৎ হাজ্জও করে এবং পৃথকভাবে কুরবানীও করে) তবে ইহরাম বাঁধার পূর্বে (যিলহজের চাঁদ উঠে গেলে) চুল-নখাদি কাটা উচিত নয়। যেহেতু তা প্রয়োজনে সুন্নাত।

অবশ্য তামাত্তু হাজ্জকারী (হাজ্জের ওয়াজিব কুরবানী ছাড়া পৃথক কুরবানী দেওয়ার নিয়ত থাকলেও) উমরাহ শেষ করে চুল ছোট করবে। কারণ তা উমরাহর এক ওয়াজিব কর্ম। অনুরূপভাবে কুরবানীর দিনে পাথর মারার পর কুরবানী করার আগে মাথা নেড়া করতে পারে।

প্রকাশ যে, ‘যারা কুরবানী দিতে পারে না তারা কুরবানীর দিনে নখ-চুল ইত্যাদি কাটলে তাদের কুরবানী করার সওয়াব লাভ হয়’ এমন কথা এক হাদীসে থাকলেও তা সহীহ নয়।[২]

[১] (মুসলিম)
[২] (মিশকাত ১৪৭৯নং, যইফ আবূ দাঊদ ৫৯৫, যইফ নাসাঈ ২৯৪, যয়ীফুল জামে’ ১২৬৫নং)

যিলহজের দশ দিনের অযীফাহ

এই দশ দিনকে সামনে পাওয়া বান্দার জন্য আল্লাহর তরফ হতে এক মহা অনুগ্রহ। মুত্তাকী ও নেক বান্দাগণই এই দিনগুলির যথার্থ কদর করে থাকেন। প্রতি মুসলিমের উচিত, এই সম্পদের কদর করা, এই সুবর্ণ সুযোগকে হেলায় হারিয়ে না দেওয়া এবং যত্নের সাথে বিভিন্ন ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে এই দিনগুলিকে অতিবাহিত করা।

এই দিনগুলিতে পালনীয় বড় বড় নেক আমল রয়েছে। মুসলিম সেই আমলসমূহের সাহায্যে বড় পুণ্যের অধিকারী হতে পারে। যেমনঃ-

যিলহজের প্রথম নয়দিনে রোযা পালন

যিলহজের প্রথম নয়দিনে রোযা পালন করা মুসলিমের জন্য উত্তম। কারণ, নাবী কারীম (সা.) এই দিনগুলিতে নেক আমল করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর রোযা উত্তম আমলসমূহের অন্যতম; যা আল্লাহ পাক নিজের জন্য মনোনীত করেছেন। যেমন হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘‘আদম সন্তানের প্রত্যেক কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোযা আমারই জন্য এবং আমি নিজে তার প্রতিদান দেব।’’[১]

প্রিয় নবী (সা.)ও এই নয় দিনে রোযা পালন করতেন। তাঁর পত্নী (হাফসাহ রাঃ) বলেন, ‘‘নবী (সা.) যিলহজের নয় দিন, আশুরার দিন এবং প্রত্যেক মাসের তিন দিন; মাসের প্রথম সোমবার এবং দুই বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।’’[২]

ইমাম বাইহাক্বী (রহ.) ‘ফাযায়েলুল আওক্বাত’ এ বলেন, এই হাদীসটি আয়েশা (রাঃ) এর ঐ হাদীস অপেক্ষা উত্তম যাতে তিনি বলেন, ‘আমি রসূল (সা.)-কে (যিলহজের) দশ দিনে কখনো রোযা রাখতে দেখিনি।’[৩] কারণ, এ হাদীসটি ঘটনসূচক এবং তা আয়েশার ঐ অঘটনসূচক হাদীস হতে উত্তম। আর মুহাদ্দিসীনদের একটি নীতি এই যে, যখন ঘটনসূচক ও অঘটনসূচক দু’টি হাদীস পরস্পর-বিরোধী হয় তখন সমন্বয় সাধনের অন্যান্য উপায় না থাকলে ঘটনসূচক হাদীসটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ কেউ যদি কিছু ঘটতে না দেখে তবে তার অর্থ এই নয় যে, তা ঘটেই নি। তাই যে ঘটতে দেখেছে তার কথাটিকে ঘটার প্রমাণ স্বরূপ গ্রহণ করা হয়।

মোট কথা, যিলহজের মাসের এই নয় দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব। ইমাম নববী (রহ) বলেন, ‘ঐ দিনগুলিতে রোযা রাখা পাকা মুস্তাহাব।’[৪]

যদি কেউ যিলহজের প্রথম তারীখ থেকে রোযা রাখতে সক্ষম না হয়, তাহলে অন্ততঃপক্ষে তাকে এ মাসের ৯ম তারীখে রোযা রাখতে অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত। যেহেতু রসূল (সা.) তার গুরুত্ব ও ফযীলতের উপর উম্মতকে বিশেষভাবে অবহিত ক’রে রোযা রাখতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আরাফার দিন রোযা অতীত এক বছর ও আগামী এক বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।’’[৫]

পূর্ব ও পশ্চিমের দেশগুলিতে আরাফার দিন ১/২ দিন পরে হয়। সুতরাং ঐ সকল দেশের লোকেরা কোন দিন আরাফার রোযা রাখবে? এ নিয়ে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। অতএব তারা যদি উক্ত নয় দিনই রোযা পালন করে, তাহলে উত্তম হয়। নচেৎ রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ এবং আল্লাহর নিচের আকাশে অবতরণ যেমন একই সময় সম্ভব নয়, অনুরূপ ঈদ ও আরাফা ইত্যাদির দিন একই দিন হওয়া জরুরী নয়। সকলেই সওয়াবের অধিকারী হবে ইন শাআল্লাহ।

যিলহজের দশদিনে তাকবীর পাঠ

এই দিনগুলিতে তাকবীর, তাহমীদ, তাহলীল ও তাসবীহ পাঠ করা সুন্নাত এবং তা উচ্চস্বরে মসজিদে, ঘরে, পথে ও বাজারে এবং সেই সকল স্থানে যেখানে আল্লাহর যিকর বৈধ - পাঠ করা মুস্তাহাব। এই তাকবীর পুরুষরা উচ্চস্বরে বলবে এবং মহিলারা চুপেচুপে। যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত প্রচারিত হবে এবং ঘোষিত হবে তাঁর অনুপম তা’যীম। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,

(لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَيْهِ فِيْ أَيَّامٍ مَّعْلُوْمَاتٍ عَلى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْ بَهِيْمَةِ الأَنْعَام)

অর্থাৎ, ‘‘যাতে ওরা কল্যাণ লাভ করে এবং নির্দিষ্ট জানা দিনগুলিতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে- পশু হতে তিনি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছেন তার উপর --।’’[৬]

অধিকাংশ ব্যাখ্যাতার মতে ‘নির্দিষ্ট জানা দিন’ অর্থাৎ যিলহজের প্রথম দশ দিন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নির্দিষ্ট জানা দিন’ হল (যিলহজের) দশ দিন এবং ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন’ হল তাশরীকের কয়েকটি দিন।’’[৭] অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট জানা দিন’ অর্থাৎ তাশরীকের পূর্বের দিনগুলি; তারবিয়ার দিন এবং আরাফার দিন। আর ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন’ অর্থাৎ তাশরীকের দিনগুলি।

আর এই মতই ইবনে কাসীর আবূ মূসা আশআরী, মুজাহিদ, ক্বাতাদাহ, আত্বা, সাঈদ বিন জুবাইর, হাসান, যাহহাক, আত্বা খুরাসানী, ইবরাহীম নাখয়ী হতে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, ‘এই মত ইমাম শাফেয়ীর। আর ইমাম আহমদ বিন হাম্বল হতে এটাই প্রসিদ্ধ।’[৮]

সুতরাং এই কথার ভিত্তিতে আয়াতে উল্লেখিত আল্লাহর যিকর (স্মরণ) করার অর্থ হবে, আল্লাহ পাক যে গবাদি পশু মানুষের রুযীরূপে দান করেছেন তার উপর তাঁর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা (শুকরিয়া আদায় করা) এবং এতে তাকবীর ও কুরবানী যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেওয়া শামিল হবে। তাই আল্লাহর যিকর বলতে কেবল যবেহকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করাই নয়। কারণ হজ্জে কুরবানী যবেহ করার দিন ঈদের দিন হতেই শুরু হয়।[৯]

যিলহজের দিনগুলিতে পঠনীয় তাকবীর


اَللهُ أَكْبَر، اللهُ أَكْبَر، لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَر، اَللهُ أَكْبَر، وَللهِ الْحَمْد

‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লা-হিল হামদ।

এ ছাড়া অন্যান্যরূপেও তাকবীর পাঠ করার কথা পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের জানা মতে রসূল (সা.) হতে কোন নির্দিষ্টরূপ তাকবীর সহীহভাবে বর্ণিত হয়নি। যা কিছু এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে সবই সাহাবাগণের আমল।[১০]

ইমাম সানআনী (রহ.) বলেন, ‘তাকবীরের বহু ধরন ও রূপ আছে, বহু ইমামগণও কিছু কিছুকে উত্তম মনে করেছেন। যা হতে বুঝা যায় যে, এ বিষয়ে প্রশস্ততা আছে। আর আয়াতের সাধারণ বর্ণনা এটাই সমর্থন করে।’[১১]

কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তাকবীর এ যুগে প্রত্যাখ্যাত সুন্নতের মধ্যে পরিগণিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম দশ দিনে তো অল্প কিছু মানুষ ব্যতীত আর কারো নিকট হতে তাকবীর শুনাই যায় না। তাই উচ্চস্বরে তাকবীর পড়া উচিত; যাতে সুন্নাহ জীবিত হয় এবং উদাসীনদের মনে সতর্কতা আসে।

পক্ষান্তরে এ কথা প্রমাণিত যে, ইবনে উমার (রা.) এবং আবূ হুরাইরা (রা.) এই দশ দিন বাজারে বের হতেন এবং (উচ্চস্বরে) তাকবীর পড়তেন। আর লোকেরাও তাঁদের তকবীরের সাথে তাকবীর পাঠ করত।[১২] অর্থাৎ, তাঁদের তাকবীর পড়া শুনে লোকেরা তাকবীর পড়তে হয় একথা স্মরণ করত এবং প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক তাকবীর পাঠ করত। তাঁরা একত্রিতভাবে একই সুরে সমসবরে তাকবীর পড়তেন না।

এই দিনগুলিতে সাধারণ তাকবীর ও তাসবীহ আদি যে কোন সময়ে দিনে বা রাতে অনির্দিষ্টভাবে ঈদের নামায পর্যন্ত পাঠ করতে হয়। আর নির্দিষ্ট তাকবীর যা ফরয নামাযের জামাআতের পর (একাকী) পাঠ করা হয় আর তা অহাজীদের জন্য আরাফার (৯ম যুলহাজ্জ) দিনের ফজর থেকে এবং মক্কা শরীফে হাজীদের জন্য কুরবানীর দিনের যোহর থেকে শুরু হয় এবং তাশরীকের শেষ দিনের (১৩ই যিলহজের) আসর পর্যন্ত চলতে থাকে।

উল্লেখ্য যে, বিলীন বা বিলীয়মান কোন সুন্নাহকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করায় আল্লাহর নিকট মহা প্রতিদান ও বৃহত্তর সওয়াব রয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতের মধ্যে কোন সুন্নাত জীবিত করে যা আমার পরবর্তীকালে মৃত হয়ে পড়েছিল, তার জন্য সেই ব্যক্তির সমপরিমাণ সওয়াব হবে, যে তার উপর আমল করে এবং তাদের কারো সওয়াব কিছুও কম করা হবে না।’’[১৩]

হাজ্জ ও উমরাহ আদায় করা

এই দশ দিনের মধ্যে হাজ্জ আদায় করা সর্বোত্তম আমলসমূহের অন্যতম। অতএব যাকে আল্লাহপাক তাঁর গৃহের হাজ্জ করার তওফীক দান করেছেন এবং যে যথার্থরূপে হাজ্জ পালন করতে প্রয়াসী হয়, সে ইনশাআল্লাহ রসূলুল্লাহ (সা.) এর এই বাণীতে তার মহাভাগ থাকবে, ‘‘মঞ্জুরকৃত হাজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছু নয়।’’

কুরবানী করা

এই দশ দিনের করণীয় আল্লাহর নৈকট্যদানকারী আমলের মধ্যে কুরবানী করা অন্যতম। যার বিশদ বিবরণ পরে দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ।

অন্যান্য নেক ও সৎকার্যে অধিক মনোযোগ দেওয়া

এই দিনগুলিতে নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয়। আর তা হলে অবশ্যই এই দিনসমূহের কৃত আমলের মান ও মর্যাদা তাঁর নিকট অধিক। তাই মুসলিমের উচিত, যদি হাজ্জ করা তার সামর্থ্য ও সাধ্যে না কুলায় তবে এই মূল্যবান সময়গুলিকে যেন সৎকার্য, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য; নফল নামায, তিলাওয়াত, যিকর, দুআ, দান, পিতামাতার অধিক খিদমত, আত্মীয়তা, সৎকার্যের আদেশ ও অসৎকার্যে বাধা দান, ইত্যাদি দ্বারা আবাদ করে। অন্ততঃপক্ষে ঐ দিনগুলিতে আল্লাহর রসূল (সা.)-এর এই কথা স্মরণ করা উচিত, ‘‘যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতে আদায় করে অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকরে (তাসবীহ, তাহলীল, তিলাওয়াত, ইল্ম বা দ্বীনী আলোচনায়) বসে এবং তারপর দুই রাকআত নামায পড়ে তবে এক হাজ্জ ও উমরাহর সমপরিমাণ তার সওয়াব লাভ হবে।’’[1১৪]

আল্লাহর তরফ হতে বান্দার জন্য এটা এক সুবৃহৎ অনুগ্রহ এবং অতিশয় কল্যাণ। যার অনুগ্রহ ও করুণার শেষ নেই, যা চিন্তা ও ধারণায় কল্পনা করা যায় না। যাতে অনুমতিরও কোন স্থান নেই। যেহেতু তিনি পুরস্কর্তা ও অনুগ্রাহী। তাঁর ইচ্ছামত তিনি যা দিয়ে, যাকে ইচ্ছা, যে কোন আমলের মাধ্যমে ইচ্ছা পুরস্কৃত ও অনুগৃহীত করে থাকেন। তাঁর ইচ্ছা ও আদেশ রদ্দ করার কেউ নেই এবং কেউ তাঁর মঙ্গল ও অনুগ্রহকে রহিত করতে পারে না।

বিশুদ্ধ তাওবাহ করা

এই দশ দিনে মুসলিমদের জরুরী কর্তব্যের মধ্যে আল্লাহর নিকট তাওবাহ করা, তাঁর প্রতি প্রত্যাবর্তন করা, কৃতপাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পাপ ও অবাধ্যতা থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিনিবৃত্ত হওয়াও উল্লেখ্য। তাওবাহ হল- আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করা; যে গুপ্ত অথবা প্রকাশ্য জিনিস আল্লাহ ঘৃণা করেন সেই জিনিস হতে, যা তিনি পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন তার প্রতি, বিগত (পাপের) উপর লাঞ্ছনা ও অনুশোচনা প্রকাশ করে, বর্তমানে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং পুনরপি তার প্রতি না ফেরার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে - ফিরে আসার নাম।

মুসলিমের জন্য ওয়াজিব; যখন সে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে অথবা অকস্মাৎ কোন পাপ করে বসে তখন শীঘ্রতার সাথে তাওবাহর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করা এবং এ কাজে গয়ংগচ্ছ অথবা ঢিলেমি না করা। কারণ, প্রথমতঃ সে জানে না যে, তাকে কোন ঘড়িতে মরতে হবে। দ্বিতীয়তঃ এক পাপ অপর পাপকে আকর্ষণ করে। তাই সতক্ষর তাওবাহ না করলে হয়তো বা পাপের বোঝা নিয়েই মরতে হয় অথবা পাপের বোঝা আরো ভারি হতে থাকে।

গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ সময়কালে তাওবাহর বড় গুণ থাকে। যেহেতু ঐ সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন আনুগত্য-প্রবণ থাকে এবং সৎকাজের প্রতি হূদয় আকৃষ্যমাণ হয়। তখন হূদয় অন্যায় ও পাপকে সবীকার করতে চায় এবং কৃত পাপের উপর বড় অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়।

যদিও তাওবাহ করা এক প্রতিনিয়ত ওয়াজিব। তবুও যেহেতু তাওবাহ করা আমল কবুল হওয়ার এবং আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভ করার হেতুসমূহের অন্যতম তথা পাপ দূরীকরণ ও মোচন হওয়ার কারণ; আবার ইবাদত আল্লাহর সান্নিধ্য ও ভালোবাসা লাভের হেতু সেহেতু মুসলিম যখন বিশুদ্ধ তাওবাহর সাথে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মর্যাদাপূর্ণ আমল করে থাকে, তখন তার উভয়বিদ অতিরিক্ত কল্যাণ লাভ হয়; যা সফলতার প্রতি ঈঙ্গিত করবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ পাক বলেন,

(فَأَمَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَعَسَى أَن يَكُونَ مِنَ الْمُفْلِحِينَ)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তাওবাহ করে ও সৎকাজ করে, সে তো অচিরে সফলকাম হবে।’’ (সূরা ক্বাসাস ৬৭ আয়াত)

মুসলিম তাওবাহ করবে পুরুষের মত। সবামী সংসর্গ ত্যাগ করার উপর প্রসব বেদনাদগ্ধা নারীর মত তাওবাহ করবে না। বরং তাওবাহ করে তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। পক্ষান্তরে পাপ যদি সংসর্গ ও পরিবেশ-দোষে হয়, তাহলে সেই সংসর্গ ও পরিবেশ ত্যাগ করে সুন্দর নির্মল ইসলামী পরিবেশ গ্রহণ করবে এবং সৎলোকদের সংসর্গ গ্রহণ করে সৎকার্যে অবিচল থাকবে।

মুসলিমের উচিত, কল্যাণময় এই শ্রেণীর মৌসমের প্রতি প্রলুব্ধ হওয়া। কারণ, তা ক্ষণস্থায়ী। নিজের সংকট মুহূর্তে সাহায্য লাভের জন্য নেক আমলের পাথেয় সংগ্রহ করা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। যেহেতু পৃথিবীতে অবস্থান কাল অতি অল্প। কুচের সময় আসন্ন, পথ শঙ্কাপূর্ণ, যেথায় প্রবঞ্চনার আশঙ্কাই অধিক এবং বিপদের ভয় বড়। আর নিশ্চয় আল্লাহ পাক সূক্ষ্ণ ও সর্বদ্রষ্টা এবং তাঁরই নিকট সকলের প্রত্যাবর্তনস্থল। আর ‘‘যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ সৎকাজ করবে সে তা দর্শন করবে এবং যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ অসৎকাজ করবে সে তাও দর্শন করবে।’’[১৫]

[১] (বুখারী ১৮০৫, মুসলিম ১১৫১নং)
[২] (সহীহ আবূ দাঊদ ২১২৯নং, নাসাঈ)
[৩] (মুসলিম ১১৭৬নং)
[৪] (শারহুন নববী ৮/৩২০)
[৫] (মুসলিম ১৬৬২নং)
[৬] (সূরা হাজ্জ ২৮ আয়াত)
[৭] (বুখারী ২/৪৫৭)
[৮] (তাফসীর ইবনে কাসীর, আযওয়াউল বায়ান ৫/৪৯৭)
[৯] (ফতোয়া ইবনে তাইমিয়াহ ২৪/২২৫)
[১০] (ইরওয়াউল গালীল ৩/১২৫)
[১১] (সুবুলুস সালাম ২/১২৫)
[১২] (বুখারী)
[১৩] (তিরমিযী)
[১৪] (তিরমিযী)
[১৫] (সূরা যিলযাল ৭-৮আয়াত)

কুরবানীর প্রারম্ভিক ইতিহাস

কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সেই আদি পিতা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। আদম (আলাইহিস সালাম)-এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন,

(وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنْ الآخَرِ قَالَ لأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنْ الْمُتَّقِينَ)

অর্থাৎ, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অন্য জনের কুরবানী কবুল হল না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।[১]

কুরবানীর বিধান প্রত্যেক জাতির জন্যই ছিল।
মহান আল্লাহ বলেন,

(وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرْ الْمُخْبِتِينَ - الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَالصَّابِرِينَ عَلَى مَا أَصَابَهُمْ وَالْمُقِيمِ الصَّلاةِ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ)

অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ সবরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। সুতরাং তোমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ কর। আর সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে; যাদের হূদয় ভয়ে কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে।[২]

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর কুরবানীর আদর্শ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

(فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللهُ مِنَ الصَّابِرِينَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ- وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ- إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِينُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ - وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ)

অর্থাৎ, অতঃপর সে (ইসমাঈল) যখন পিতা (ইবরাহীমের)র সাথে চলা-ফিরার (কাজ করার) বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম তাকে বলল, ‘হে বেটা! আমি সবপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ।’ সে বলল, ‘আববা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন।’ অনন্তর পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তাকে যবেহ করার জন্য অধোমুখে শায়িত করল, তখন আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম। আর তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।[৩]

প্রকাশ যে, স্বপ্ন দেখে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ৩ সকাল উঁট কুরবানী করার কথা শুদ্ধ নয়।

‘‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
এই দিনই মিনা-ময়দানে
পুত্র-স্নেহের গর্দানে
ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে’
রেখেছে আববা ইবরাহীম সে আপনা রুদ্র পণ!’’

[১] (সূরা মাইদাহ ২৭ আয়াত)
[২] (সূরা হাজ্জ ৩৪-৩৫)
[৩] (সূরা সাফফাত ১০২-১০৮)




*************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url