“যিলহজ মাসের আমল ও কুরবানির বিধান” একটি বিস্তারিত আলোচনা ( দ্বিতীয় পর্ব)



কুরবানীর ফযীলত এবং কুরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্তসমূহ


বছর ঘুরে প্রতিবছরই যিলহজ মাস আসে। এই মাসটি এলে আমরা আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব কুরবানির ঈদ পালন করি। সাধ্যানুসারে আমরা পশু কুরবানী করি, আনন্দ করি। অথচ আমরা অনেকেই জানি না এই ‍যিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন হচ্ছে বছরের শ্রেষ্ট দিন। এই দিনগুলোতে আমরা কি আমল করবো, কিভাবে কাটাবো তা বেশিরভাগ মানুষই জানি না। এমন কি কষ্টের টাকায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে কুরবানি আমরা দিয়ে থাকি সেটা আদৌ ইসলামের বিধান মতে হচ্ছে কিনা আমরা সেটাও জানি না। অথচ এসব বিষয় জানা আমাদের জন্য অবশ্যই জরুরী। তাই আমরা যিলহজ মাসের আমল ও কুরবানির আদ্যপান্ত সকল বিষয় এখানে ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত তুলে ধরবো। মুল লেখক মুহতারাম আবদুল হামীদ ফাইযী সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

কুরবানীর ফযীলত

‘উযহিয়্যাহ’ কুরবানীর দিনসমূহে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহ-যোগ্য উট, গরু, ছাগল বা ভেঁড়াকে বলা হয়। উক্ত শব্দটি ‘যুহা’ শব্দ থেকে গৃহীত যার অর্থ পূর্বাহ্ন। যেহেতু কুরবানী যবেহ করার উত্তম বা আফযল সময় হল ১০ই যুলহজ্জের (ঈদের দিনের) পূর্বাহ্নকাল। তাই ঐ সামঞ্জস্যের জন্য তাকে ‘উযহিয়্যাহ’ বলা হয়েছে। যাকে ‘যাহিয়্যাহ’ বা ‘আযহাহ’ও বলা হয়। আর ‘আযহাহ’ এর বহুবচন ‘আযহা’। যার সাথে সম্পর্ক জুড়ে ঈদের নাম হয়েছে ‘ঈদুল আযহা’। বলা বাহুল্য, ঈদুযযোহা কথাটি ঠিক নয়।

কুরবানী শব্দটিও ‘কুর্ব’ ধাতু থেকে গঠিত। যার অর্থ নৈকট্য। কুরবান হল, প্রত্যেক সেই বস্তু, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আর সেখান থেকেই ফারসী বা উর্দু-বাংলাতে গৃহীত হয়েছে ‘কুরবানী’ শব্দটি।
কুরবানী করা কিতাব, সুন্নাহ ও সর্বাদিসম্মতিক্রমে বিধেয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

(فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ)

‘অতএব তুমি নামায পড় তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে এবং কুরবানী কর।[1]

এই আয়াত শরীফে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী (সা.)-কে নামায ও কুরবানী এই দু’টি ইবাদাতকে একত্রিত করে পালন করতে আদেশ করেছেন। যে দু’টি বৃহত্তম আনুগত্যের অন্যতম এবং মহত্তম সামীপ্যদানকারী ইবাদত। আল্লাহর রসূল (সা.) সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। সুতরাং তিনি ছিলেন অধিক নামায কায়েমকারী ও অধিক কুরবানীদাতা। ইবনে উমার (রা.) বলেন, ‘‘নবী (সা.) দশ বছর মদীনায় অবস্থানকালে কুরবানী করেছেন।’’[2]

আনাস (রা.) বলেন, ‘রসূল (সা.) দীর্ঘ (ও সুন্দর) দু’শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো মিশ্রিত (মেটে বা ছাই) রঙের দু’টি দুম্বা কুরবানী করেছেন।’[3]

তিনি কোন বছর কুরবানী ত্যাগ করতেন না।[4] যেমন তিনি তাঁর কর্ম দ্বারা কুরবানী করতে উম্মতকে অনুপ্রাণিত করেছেন, তেমনি তিনি তাঁর বাক্য দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি (ঈদের) নামাযের পূর্বে যবেহ করে সে নিজের জন্য যবেহ করে। আর যে নামাযের পরে যবেহ করে তার কুরবানী সিদ্ধ হয় এবং সে মুসলমানদের তরীকার অনুসারী হয়।’’[5]

তিনি আরো বলেন, ‘‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’’[6]

সকল মুসলিমগণ কুরবানী বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে একমত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই।[7]

তবে কুরবানী করা ওয়াজিব না সুন্নাত -এ নিয়ে মতান্তর আছে। আর দুই মতেরই দলীল প্রায় সমানভাবে বলিষ্ঠ। যাতে কোন একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। যার জন্য কিছু সংস্কারক ও চিন্তাবিদ্ উলামা কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। তাঁদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) অন্যতম। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবা, তাবেয়ীন এবং ফকীহগণের মতে কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (তাকীদপ্রাপ্ত সুন্নাত)। অবশ্য মুসলিমের জন্য মধ্যপন্থা এই যে, সামর্থ্য থাকতে কুরবানী ত্যাগ না করাই উচিত। ([8]) উচিত নিজের ও পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে কুরবানী করা। যাতে আল্লাহর আদেশ পালনে এবং মহানবী (সা.)-এর অনুকরণে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হতে পারে।

বস্তুতঃ কুরবানীতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদতের খাতে অর্থব্যয় (ও স্বার্থত্যাগ) হয়। যাতে তাওহীদবাদীদের ইমাম ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সুন্নাহ জীবিত হয়। ইসলামের একটি প্রতীকের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পরিবার ও দরিদ্রজনের উপর খরচ করা হয় এবং আত্মীয়-সবজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য হাদিয়া ও উপঢৌকন পেশ করা হয়। এত কিছুর মাধ্যমে মুসলিম ঈদের খুশীর স্বাদ গ্রহণ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আনুগত্য করতে পেরেই মুসলিম আনন্দলাভ করতে পারে। সেই খুশীই তার আসল খুশী। রমযানের সারা দিন রোযা শেষে ইফতারের সময় তার খুশী হয়। পূর্ণ এক মাস রোযা করে সেই বিরাট আনুগত্যের মাধ্যমে ঈদের দিনে তারই আনন্দ অনুভব করে থাকে। এই খুশীই তার যথার্থ খুশী। বাকী অন্যান্য পার্থিব সুখ-বিলাসের খুশী খুশী নয়। বরং তা সর্বনাশের কদমবুসী। আল্লাহ তা‘আলা কিছু জাহান্নামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘‘এ এ কারণে যে, তোমরা পৃথিবীতে অযথা আনন্দ করতে ও দম্ভ প্রকাশ করতে।’’[9]

কারুনের পার্থিব উৎফুল্লতা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন,

(إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْفَرِحِينَ)

‘‘স্মরণ কর, তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, (দর্পময়) আনন্দ করো না। অবশ্যই আল্লাহ (দর্পময়) আনন্দকারীদেরকে পছন্দ করেন না।’’[10]

অতঃপর জ্ঞাতব্য যে, যেমন হাজ্জ না করে তার খরচ সদকাহ করলে ফরয আদায় হয় না, তেমনি কুরবানী না করে তার মূল্য সদকাহ করে অভীষ্ট সুন্নাত আদায় হয় না। যেহেতু যবেহ হল আল্লাহর তা’যীম-সম্বলিত একটি ইবাদত এবং তাঁর দ্বীনের এক নিদর্শন ও প্রতীক। আর মূল্য সদকাহ করলে তা বাতিল হয়ে যায়।

পক্ষান্তরে কুরবানী নবী (সা.)-এর সুন্নাহ এবং সমগ্র মুসলিম জাতির এক আমল। আর কোথাও কথিত নেই যে, তাঁদের কেউ কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য সদকাহ করেছেন। আবার যদি তা উত্তম হত, তাহলে তাঁরা নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম করতেন না।[11]

ইবনুল কাইয়্যেম (রঃ) বলেন, ‘যবেহ তার সবস্থানে কুরবানীর মূল্য সদকাহ করা অপেক্ষা উত্তম। যদিও সে মূল্য কুরবানীর চেয়ে পরিমাণে অধিক হয়। কারণ, আসল যবেহই উদ্দেশ্য ও অভীষ্ট। যেহেতু কুরবানী নামাযের সংযুক্ত ইবাদত।
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, (فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ)

অর্থাৎ, অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায পড় ও কুরবানী কর।[12]
তিনি অন্যত্র বলেন,

(قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ)

অর্থাৎ, বল, অবশ্যই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই।[13]

বলা বাহুল্য, প্রত্যেক ধর্মাদর্শে নামায ও কুরবানী আছে; যার বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। আর এই জন্যই যদি কোন হাজী তার তামাত্তু’ বা ক্বিরান হাজ্জের কুরবানীর বদলে তার তিনগুণ অথবা তার থেকে বেশী মূল্য সদকাহ করে তবে তার পরিবর্তে হবে না। অনুরূপভাবে কুরবানীও। আর আল্লাহই অধিক জানেন।[14]

আরো জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, মূলতঃ কুরবানী যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির তরফ থেকেই প্রার্থনীয়। অবশ্য সে ইচ্ছা করলে তার সওয়াবে জীবিত অথবা মৃত আত্মীয়-সবজনকেও শরীক করতে পারে। যেহেতু নবী (সা.) তাঁর সাহাবাবৃন্দ (রা.) নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের তরফ থেকে কুরবানী করতেন।

একাধিক মৃতব্যক্তিকে একটি মাত্র কুরবানীর সওয়াবে শরীক করাও বৈধ; যদি তাদের মধ্যে কারো উপর কুরবানী ওয়াজিব (নযর) না থাকে তবে। রসূল (সা.) নিজের তরফ থেকে, পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে এবং সেই উম্মতের তরফ থেকে কুরবানী করেছেন; যারা আল্লাহর জন্য তাওহীদের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তাঁর জন্য রিসালাত বা প্রচারের সাক্ষ্য দিয়েছে।[15] আর বিদিত যে, ঐ সাক্ষ্য প্রদানকারী কিছু উম্মত তাঁর যুগেই মারা গিয়েছিল। অতএব একই কুরবানীতে কেউ নিজ মৃত পিতামাতা ও দাদা-দাদীকেও সওয়াবে শামিল করতে পারে।

মৃতব্যক্তির তরফ থেকে পৃথক কুরবানী করার কোন দলীল নেই। তবে করা যায়। যেহেতু কুরবানী করা এক প্রকার সদকাহ। আর মৃতের তরফ থেকে সদকাহ করা সিদ্ধ; যা যথা প্রমাণিত এবং মৃতব্যক্তি তার দ্বারা উপকৃতও হবে - ইনশাআল্লাহ। পরন্তু মৃতব্যক্তি এই শ্রেণীর পুণ্যকর্মের মুখাপেক্ষীও থাকে।

তবুও একটি কুরবানীকে নিজের তরফ থেকে না দিয়ে কেবলমাত্র মৃতের জন্য নির্দিষ্ট করা ঠিক নয় এবং এতে আল্লাহ তাআলার সীমাহীন করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। বরং উচিত এই যে, নিজের নামের সাথে জীবিত-মৃত অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনকে কুরবানীর নিয়তে শামিল করা। যেমন আল্লাহর নবী (সা.) কুরবানী যবেহ করার সময় বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! এ (কুরবানী) মুহাম্মদের তরফ থেকে এবং মুহাম্মদের বংশধরের তরফ থেকে।’ সুতরাং তিনি নিজের নাম প্রথমে নিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে বংশধরদেরকেও তার সওয়াবে শরীক করেছেন।

পক্ষান্তরে মৃতব্যক্তি যদি তার এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে কাউকে কুরবানী করতে অসীয়ত করে যায়, অথবা কিছু ওয়াকফ করে তার অর্জিত অর্থ থেকে কুরবানীর অসীয়ত করে যায়, তবে অসীর জন্য তা কার্যকর করা ওয়াজিব। কুরবানী না করে ঐ অর্থ সদকাহ খাতে ব্যয় করা বৈধ নয়। কারণ, তা সুন্নাহর পরিপন্থী এবং অসিয়তের রূপান্তর। অন্যথা যদি কুরবানীর জন্য অসিয়তকৃত অর্থ সংকুলান না হয়, তাহলে দুই অথবা ততোধিক বছরের অর্থ একত্রিত করে কুরবানী দিতে হবে। অবশ্য নিজের তরফ থেকে বাকী অর্থ পূরণ করে কুরবানী করলে তা সর্বোত্তম। মোটকথা অসীর উচিত, সূক্ষ্ণভাবে অসীয়ত কার্যকর করা এবং যাতে মৃত অসিয়তকারীর উপকার ও লাভ হয় তারই যথার্থ প্রয়াস করা।

জ্ঞাতব্য যে, রসূল (সা.) কর্তৃক আলী (রা.)-কে কুরবানীর অসিয়ত করার হাদীসটি যইফ।[16] পরন্তু নবীর নামে কুরবানী করা আমাদের জন্য বিধেয় নয়। তিনি ঈসালে-সওয়াবের মুখাপেক্ষীও নন।

উল্লেখ্য যে, মুসাফির হলেও তার জন্য কুরবানী করা বিধেয়। আল্লাহর রসূল (রা.) মিনায় থাকাকালে নিজ স্ত্রীগণের তরফ থেকে গরু কুরবানী করেছেন।[17]

[1] (সূরা আল কাউসার ২ আয়াত)
[2] (মুসনাদ আহমাদ, তিরমিযী)
[3] (বুখারী, মুসলিম)
[4] (যাদুল মাআদ ২/৩১৭)
[5] (বুখারী ৫২২৬নং)
[6] (মুসনাদ আহমাদ ২/৩২১, ইবনে মাজাহ ২/১০৪৪, হাকেম ২/৩৮৯)
[7] (মুগনী ১৩/৩৬০, ফাতহুল বারী ১০/৩)
([8]) অপরের দান বা সহযোগিতা নিয়ে হজ্জ বা কুরবানী করলে তা পালন হয়ে যাবে এবং দাতা ও কর্তা উভয়েই সওয়াবের অধিকারী হবে। ঋণ করে কুরবানী দেওয়া জরুরী নয়। যেমন সামর্থ্যবান কোন অসী বা মুআক্কেলের কুরবানী যবেহ করলে, তার নিজের তরফ থেকে কুরবানী মাফ হয়ে যাবে না।
[9] (সূরা মু’মিন ৭৫ আয়াত)
[10] (সূরা কাসাস ৭৬ আয়াত)
[11] (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৬/৩০৪)
[12] (সূরা আল কাউসার ২)
[13] (সূরা আনআম ১৬২ আয়াত)
[14] (তুহফাতুল মাওদূদ ৩৬পৃঃ)
[15] (মুসনাদ আহমাদ ৬/৩৯১-৩৯২, বাইহাকী ৯/২৬৮)
[16] (যইফ আবু দাউদঃ ৫৯৬নং, যইফ তিরমিযীঃ ২৫৫নং, যইফ ইবনু মাজাহঃ ৬৭২নং, মিশকাতঃ ১৪৬২নং হাদীসের টীকা দ্রঃ)
[17] (বুখারী ২৯৪, ৫৫৪৮, মুসলিম ১৯৭৫নং, বাইহাকী ৯/২৯৫)
 কুরবানীর মাহাত্ম্য সংক্রান্ত প্রচলিত কতিপয় অচল হাদীস
কুরবানীর জানোয়ার কিয়ামতের দিন তার শিং ও পশম এবং খুরসহ অবশ্যই হাজির হবে---।[1]
কুরবানী তোমাদের পিতা ইবরাহীমের সুন্নত। তার প্রত্যেকটি লোমের পরিবর্তে রয়েছে একটি করে নেকী।[2]
কুরবানীর প্রথম বিন্দু রক্তের সাথে পূর্বেকার সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যায়। পশুটিকে তার রক্ত ও গোশতসহ দাঁড়িপাল্লাতে ৭০ গুণ ভারী করে দেওয়া হবে।[3]
ভালো মনে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করলে তা জাহান্নাম থেকে পর্দার মত হবে[4]
তোমরা তোমাদের কুরবানীকে মোটা-তাজা কর। কারণ তা তোমাদের পুলসিরাত পারের সওয়ারী।[5]

[1] (যয়ীফ, যয়ীফ তারগীব ৬৭১নং)
[2] (হাদীসটি জাল, যয়ীফ তারগীব ৬৭২নং)
[3] (হাদীসটি জাল, যয়ীফ তারগীব ৬৭৪-৬৭৫নং)
[4] (হাদীসটি জাল, যয়ীফ তারগীব ৬৭৭নং)
[5] (অতি দুর্বল, সিলসিলাহ যয়ীফাহ ১২৫৫নং)

কুরবানীর আহকাম

কুরবানী করা আল্লাহর এক ইবাদত। আর কিতাব ও সুন্নাহয় এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমল নেক, সালেহ বা ভালো হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যদানকারী হয় না; যতক্ষণ না তাতে দু’টি শর্ত পূরণ হয়েছে;

প্রথমতঃ ইখলাস। অর্থাৎ, তা যেন খাঁটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন,

(إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ)

অর্থাৎ, আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী)দের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।[1]
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

(لَن يَنَالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ)

অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে কখনোও ওগুলির গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সংযমশীলতা); এভাবে তিনি ওগুলিকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে।[2]

দ্বিতীয়তঃ তা যেন আল্লাহ ও তদীয় রসূলের নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

(فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَّلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدا)

অর্থাৎ, যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।[3]

সুতরাং যারা কেবল বেশী করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয় -তা বলাই বাহুল্য।

গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে বলেই লোকে একই মূল্যের একটি গোটা কুরবানী না দিয়ে একটি ভাগ দিয়ে থাকে। বলে, একটি ছাগল দিলে দু’দিনেই শেষ হয়ে যাবে। লোকের ছেলেরা খাবে, আর আমার ছেলেরা তাকিয়ে দেখবে? উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট।

[1] (সূরা মায়িদাহ ২৭ আয়াত)
[2] (সূরা হাজ্জ ৩৭ আয়াত)
[3](সূরা কাহফ ১১০ আয়াত)

কুরবানীর শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী

কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছেঃ
১। কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেণী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। আর নির্ধারিত শ্রেণীর পশু চারটি; উঁট, গরু, ভেঁড়া ও ছাগল। অধিকাংশ উলামাদের মতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানী হল উঁট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেঁড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদা মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে।[1]

একটি উঁট অথবা গরুতে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে।[2] অন্য এক বর্ণনা মতে উঁট কুরবানীতেও দশ ব্যক্তি শরীক হতে পারে। ইমাম শাওকানী (রহ.) বলেন, হাজ্জের কুরবানীতে দশ এবং সাধারণ কুরবানীতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক।[3]

কিন্তু মেষ বা ছাগে ভাগাভাগি বৈধ নয়। তবে তার সওয়াবে একাধিক ব্যক্তিকে শরীক করা যাবে। সুতরাং একটি পরিবারের তরফ থেকে মাত্র একটি মেষ বা ছাগ যথেষ্ট হবে। তাতে সেই পরিবারের লোক-সংখ্যা যতই হোক না কেন।

কিন্তু উঁট বা গরুর এক সপ্তাংশ একটি পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হবে কি? এ নিয়ে উলামাগণের মাঝে মতান্তর রয়েছে। কেউ বলেন, যথেষ্ট নয়। কারণ, তাতে ৭ জনের অধিক ব্যক্তির শরীক হওয়া বৈধ নয়। তা ছাড়া পরিবারের তরফ থেকে একটি পূর্ণ ‘দম’ (জান) যথেষ্ট হবে। আর ৭ ভাগের ১ ভাগ পূর্ণ দম নয়।[4]

অনেকের মতে একটি মেষ বা ছাগের মতই এক সপ্তাংশ উঁট বা গরু যথেষ্ট হবে।[5]

বলা বাহুল্য, একটি পরিবারের তরফ থেকে এক বা দুই ভাগ গরু কুরবানী দেওয়ার চাইতে ১টি ছাগল বা ভেঁড়া দেওয়াটাই অধিক উত্তম।

কুরবানীর সাথে একটি ভাগ আকীকার উদ্দেশ্যে দেওয়া যথেষ্ট নয়। যেমন যথেষ্ট নয় একটি পশু কুরবানী ও আকীকার নিয়তে যবেহ করা। কুরবানী ও আকীকার জন্য পৃথক পৃথক পশু হতে হবে। অবশ্য যদি কোন শিশুর আকীকার দিন কুরবানীর দিনেই পরে এবং আকীকা যবেহ করে, তাহলে আর কুরবানী না দিলেও চলে। যেমন, দুটি গোসলের কারণ উপস্থিত হলে একটি গোসল করলেই যথেষ্ট, জুমআর দিনে ঈদের নামায পড়লে আর জুমআহ না পড়লেও চলে, বিদায়ের সময় হাজ্জের তওয়াফ করলে আর বিদায়ী তওয়াফ না করলেও চলে, যোহরের সময় মসজিদে প্রবেশ করে যোহরের সুন্নাত পড়লে পৃথক করে আর তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়তে হয় না এবং তামাত্তু হাজ্জের কুরবানী দিলে আর পৃথকভাবে কুরবানী না দিলেও চলে।[6]

বয়সের দিক দিয়ে উঁটের পাঁচ বছর, গরুর দুই বছর এবং মেষ ও ছাগের এক বছর হওয়া জরুরী। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘দাঁতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্লভ হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর।’’[7]

কিন্তু উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছ’মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে; তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক। অধিকাংশ উলামাগণ ঐ হাদীসের আদেশকে ‘ইস্তিহবাব’ (উত্তম) বলে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন যে, ঐ হাদীসের মর্মার্থ এ নয় যে, অন্য কুরবানীর পশু না পাওয়া গেলে তবেই ছ’মাস বয়সের মেষ শাবকের কুরবানী বৈধ। যেহেতু এমন অন্যান্য দলীলও রয়েছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ বয়সী মেষেরও কুরবানী বৈধ; প্রকাশতঃ যদিও কুরবানীদাতা অন্য দাঁতালো পশু পেয়েও থাকে। যেমন রসূল (সা.) বলেন, ‘‘ছ’মাস বয়সী মেষশাবক উত্তম কুরবানী।’’[8]

উক্ববাহ বিন আমের (রা.) বলেন, (একদা) নবী (সা.) কুরবানীর পশু বিতরণ করলেন। উকবার ভাগে পড়ল এক ছয় মাসের মেষ। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার ভাগে ছয় মাসের মেষ হল?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘‘এটা দিয়েই তুমি কুরবানী কর।’’[9]

কুরবানির পশু ত্রুটিমুক্ত হতে হবে

(ক) এক চোখে স্পষ্ট অন্ধত্ব। (খ) স্পষ্ট ব্যাধি। (গ) স্পষ্ট খঞ্জতা। (ঘ) অন্তিম বার্ধক্য। এ ব্যাপারে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন, ‘‘চার রকমের পশু কুরবানী বৈধ বা সিদ্ধ হবে না; (এক চক্ষে) স্পষ্ট অন্ধত্বে অন্ধ, স্পষ্ট রোগা, স্পষ্ট খঞ্জতায় খঞ্জ এবং দুরারোগ্য ভগ্নপদ।’’[10]

অতত্রব এই চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ (রহ.) বলেন, ‘এ বিষয়ে কোন মতভেদ আমরা জানি না।’[11]

[1] (আযওয়াউল বায়ান ৫/৬৩৪)
[2] (মুসলিম ১৩১৮নং)
[3] (নাইলুল আওত্বার ৮/১২৬)
[4] (ফাতাওয়া শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ৬/১৪৯)
[5] (মাজালিসু আশরি যিলহাজ্জাহ, শুমাইমিরী, ২৬পৃঃ আল-মুমতে’ ইবনে উসাইমীন ৭/৪৬২-৪৬৩)
[6] (মানারুস সাবীল ১/২৮০)
[7] (মুসলিম ১৯৬৩নং)
[8] (মুসনাদে আহমাদ ২/৪৪৫, তিরমিযী)
[9] (বুখারী ২১৭৮, মুসলিম ১৯৬৫নং)
[10] (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ)

মুগনী ১৩/৩৬৯)
ত্রুটিগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ
(ক) স্পষ্ট কানা (এক চক্ষের অন্ধ) যার একটি চক্ষু ধক্ষসে গেছে অথবা বেরিয়ে আছে। দৃষ্টিহীন হলে তো অধিক ত্রুটি হবে। তবে যার চক্ষু সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু নষ্ট হয়নি তার কুরবানী সিদ্ধ হবে। কারণ, তা স্পষ্ট কানা নয়।

(খ) স্পষ্ট রোগের রোগা; যার উপর রোগের চিহ্ন প্রকাশিত। যে চরতে অথবা খেতে পারে না; যার দরুন দুর্বলতা ও গোশতবিকৃতি হয়ে থাকে। তদনুরূপ চর্মরোগও একটি ত্রুটি; যার কারণে চর্বি ও গোশত খারাপ হয়ে থাকে। তেমনি স্পষ্ট ক্ষত একটি ত্রুটি; যদি তার ফলে পশুর উপর কোন প্রভাব পড়ে থাকে।

গর্ভধারণ কোন ত্রুটি নয়। তবে গর্ভপাত বা প্রসবের নিকটবর্তী পশু একপ্রকার রোগগ্রস্ত এবং তা একটি ক্রটি। যেহেতু গাভীন পশুর গোশত অনেকের নিকট অরুচিকর, সেহেতু জেনেশুনে তা ক্রয় করা উচিত নয়। অবশ্য কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট বা ক্রয় করার পর গর্ভের কথা জানা গেলে তা কুরবানীরূপে যথেষ্ট হবে। তার পেটের বাচ্চা খাওয়া যাবে। জীবিত থাকলে তাকে যবেহ করতে হবে। মৃত হলে যবেহ না করেই খাওয়া যাবে। কেননা, মায়ের যবেহতে সেও হালাল হয়ে যায়।[1] কারো রুচি না হলে সে কথা ভিন্ন।

(গ) দুরারোগ্য ভগ্নপদ। (ঘ) দুর্বলতা ও বার্ধক্যের কারণে যার চর্বি ও মজ্জা নষ্ট অথবা শুষ্ক হয়ে গেছে।

উল্লেখিত হাদীস শরীফটিতে উপরোক্ত ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী সিদ্ধ নয় বলে বিবৃত হয়েছে এবং বাকী অন্যান্য ত্রুটির কথা বর্ণনা হয়নি। কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের মতে, যদি ঐ ত্রুটিসমূহের অনুরূপ বা ততোধিক মন্দ ত্রুটি কোন পশুতে পাওয়া যায় তাহলে তাতেও কুরবানী সিদ্ধ হবে না; যেমন, দুই চক্ষের অন্ধ বা পা কাটা প্রভৃতি।[2]

খাত্তক্ষাবী (রঃ) বলেন, হাদীসে এ কথার দলীল রয়েছে যে, কুরবানীর পশুতে সামান্য ত্রুটি মার্জনীয়। যেহেতু হাদীসের বক্তব্য, ‘‘স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রোগা, স্পষ্ট খঞ্জ’’ অতএব ঐ ত্রুটির সামান্য অংশ অস্পষ্ট হবে এবং তা মার্জনীয় ও অধর্তব্য হবে।[3]

পক্ষান্তরে আরো কতকগুলি ত্রুটি রয়েছে যাতে কুরবানী সিদ্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তা মকরূহ বলে বিবেচিত হয়। তাই এ জাতীয় ত্রুটি থেকেও কুরবানীর পশুকে মুক্ত করা উত্তম।

[1] (আহমাদ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিববান, হাকেম, দারাকুত্বনী, ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ৩৪৩১নং)

[2] (শারহুন নওবী ১৩/২৮)

[3] (মাআলিমুস সুনান ৪/১০৬)

যে ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী মকরূহ

১। কান কাটা বা শিং ভাঙ্গা। এর দ্বারা কুরবানী মকরূহ। তবে সিদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ, এতে গোশতের কোন ক্ষতি বা কমি হয় না এবং সাধারণতঃ এমন ত্রুটি পশুর মধ্যে বেশী পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে পশুর জন্ম থেকেই শিং বা কান নেই তার দ্বারা কুরবানী মকরূহ নয়। যেহেতু ভাঙ্গা বা কাটাতে পশু রক্তাক্ত ও ক্লিষ্ট হয়; যা এক রোগের মত। কিন্তু জন্ম থেকে না থাকাটা এ ধরনের কোন রোগ নয়। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ পশুই আফযল।

২। লেজ কাটা - যার পূর্ণ অথবা কিছু অংশ লেজ কাটা গেছে তার কুরবানী মকরূহ। ভেড়ার পুচ্ছে গোশতপিন্ড কাটা থাকলে তার কুরবানী সিদ্ধ নয়। যেহেতু তা এক স্পষ্ট কমি এবং ইস্ফিত অংশ। অবশ্য এমন জাতের ভেঁড়া যার পশ্চাতে গোশত পিন্ড হয় না তার দ্বারা কুরবানী শুদ্ধ।

৩। কান চিরা, দৈর্ঘ্যে চিরা, পশ্চাৎ থেকে চিরা, সম্মুখ থেকে প্রস্থে চিরা, কান ফাটা ইত্যাদি।
৪। লিঙ্গ কাটা। অবশ্য মুষ্ক কাটা মকরূহ নয়। যেহেতু খাসীর দেহ হূষ্টপুষ্ট ও গোশত উৎকৃষ্ট হয়।
৫। দাঁত ভাঙ্গা ও চামড়ার কোন অংশ অগভীর কাটা বা চিরা ইত্যাদি।

কুরবানী পশুর মালিকানা

কুরবানী সিদ্ধ হওয়ার তৃতীয় শর্ত হল মালিকানা। অর্থাৎ, কুরবানীদাতা যেন বৈধভাবে ঐ পশুর মালিক হয়। সুতরাং চুরিকৃত, আত্মসাৎকৃত অথবা অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রীত পশুর কুরবানী সিদ্ধ নয়। তদনুরূপ অবৈধ মূল্য (যেমন সূদ, ঘুস, প্রবঞ্চনা প্রভৃতির অর্থ) দ্বারা ক্রীত পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যেহেতু কুরবানী এক ইবাদত যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা হয়। আর কুরবানীর পশুর মালিক হওয়ার ঐ সমস্ত পদ্ধতি হল পাপময়। আর পাপ দ্বারা কোন প্রকার নৈকট্য লাভ সম্ভব নয়। বরং তাতে দূরতক্ষ সৃষ্টি হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কিছু গ্রহণ করেন না।[1]

কুরবানীর পশু নির্ধারণে মুসলিমকে সবিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত, যাতে পশু সর্বগুণে সম্পূর্ণ হয়। যেহেতু এটা আল্লাহর নিদর্শন ও তা’যীমযোগ্য দ্বীনী প্রতীকসমূহের অন্যতম। যা আত্মসংযম ও তাকওয়ার পরিচায়ক। আল্লাহ তাআলা বলেন,

(ذلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإِنَّهَا مَنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ)

অর্থাৎ, এটিই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীর সম্মান করলে এতো তার হূদয়ের তাকওয়া (ধর্মনিষ্ঠা)। (সূরা হজ্জ্ ৩২ আয়াত)

এ তো সাধারণ দ্বীনী প্রতীকসমূহের কথা। নির্দিষ্টভাবে কুরবানীর পশু যে এক দ্বীনী প্রতীক এবং তার যত্ন করা যে আল্লাহর সম্মান ও তা’যীম করার শামিল, সে কথা অন্য এক আয়াত আমাদেরকে নির্দেশ করে। মহান আল্লাহ বলেন,

(وَالبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ الله)

অর্থাৎ, (কুরবানীর) উঁটকে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম করেছি। (সূরা হজ্জ ৩৬ আয়াত)

এখানে কুরবানী পশুর তা’যীম হবে তা উত্তম নির্বাচনের মাধ্যমে। ইবনে আববাস (রা.) প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কুরবানী পশুর সম্মান করার অর্থ হল, পুষ্ট গোশতবহুল, সুন্দর ও বড় পশু নির্বাচন করা।’[2]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মুসলিমগণ দামী পশু কুরবানীর জন্য ক্রয় করতেন, মোটা-তাজা এবং উত্তম পশু বাছাই করতেন; যার দ্বারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর তা’যীম ঘোষণা করতেন। যা একমাত্র তাঁদের তাক্বওয়া, আল্লাহর প্রতি ভীতি ও ভালবাসা থেকে উদ্গত হত।[3]

অবশ্য মুসলিমকে এই স্থানে খেয়াল রাখা উচিত যে, মোটা-তাজা পশু কুরবানী করার উদ্দেশ্য কেবল উত্তম গোশত খাওয়া এবং আপোসে প্রতিযোগিতা করা না হয়। বরং উদ্দেশ্য আল্লাহর নিদর্শন ও ধর্মীয় এক প্রতীকের তা’যীম এবং তার মাধ্যমে আল্লাহর সামীপ্যলাভ হয়।

কালো রঙ অপেক্ষা ধূসর রঙের পশু কুরবানীর জন্য উত্তম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কালো রঙের দুটি কুরবানী অপেক্ষা ধূসর রঙের একটি কুরবানী আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয়।’’[4]

এ পশু ক্রয়ের সময় ত্রুটিমুক্ত দেখা ও তার বয়সের খেয়াল রাখা উচিত। যেহেতু পশু যত নিখুঁত হবে তত আল্লাহর নিকট প্রিয় হবে, সওয়াবেও খুব বড় হবে এবং কুরবানীদাতার আন্তরিক তাক্বওয়ার পরিচায়ক হবে। কারণ, ‘‘আল্লাহর কাছে ওদের (কুরবানীর পশুর) গোশত এবং রক্ত পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাক্বওয়া (পরহেযগারী) পৌঁছে থাকে। এভাবে তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর; এ জন্য যে তিনি তোমাদেরকে পথপ্রদর্শন করেছেন। সুতরাং (হে নবী!) তুমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে সুসংবাদ দাও।’’ (সূরা হজ্জ ৩৭ আয়াত)

কুরবানীদাতা কুরবানীর পশু ক্রয়ের পর তাকে কথা দ্বারা (মুখে বলে) কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করবে এবং কুরবানীর দিন তাকে কুরবানীর নিয়তে যবেহ করবে।

যখন কোন পশু কুরবানীর বলে নির্ণীত হয়ে যাবে, তখন তার জন্য কতক আহকাম বিষয়ীভূত হবে। যেমনঃ-

১। ঐ পশুর সবতক্ষ কুরবানীদাতার হাতছাড়া হবে। ফলে তা বিক্রয় করা, হেবা করা, উৎকৃষ্টতর বিনিময়ে ছাড়া পরিবর্তন করা বৈধ হবে না। যেহেতু যা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে তার ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। তবে যেহেতু ওর চেয়ে উৎকৃষ্টতর পশুর বিনিময়ে পরিবর্তন করাতে কুরবানীর মান অধিক বর্ধিত হয়, তাই তা বৈধ। আর ওর চেয়ে মন্দতর পশু দ্বারা পরিবর্তন অবৈধ। কারণ, তাতে কুরবানীর আংশিক পরিমাণ হাতছাড়া হয়।

কুরবানীর পশু নির্দিষ্টকারী ব্যক্তি যদি মারা যায় তাহলেও তা বিক্রয় করা বৈধ নয়। বরং তার উত্তরাধিকারীগণ তা যবেহ করে ভক্ষণ করবে, দান করবে ও উপঢৌকন দিবে।

২। যদি তার কোন ত্রুটি দেখা দেয়, তাহলে ঐ ত্রুটি বড় না হলে (যাতে কুরবানী মকরূহ হলেও সিদ্ধ হবে। যেমন, কান কাটা, শিং ভাঙ্গা ইত্যাদি) তাই কুরবানী করবে। কিন্তু ত্রুটি বড় হলে (যাতে কুরবানী সিদ্ধ হয় না, যেমন স্পষ্ট খঞ্জতা ইত্যাদি) যদি তা নিজ কর্মদোষে হয়, তাহলে তার পরিবর্তে ত্রুটিহীন পশু কুরবানী করা জরুরী হবে। আর ঐ ত্রুটিযুক্ত পশুটি তার অধিকারভুক্ত হবে। তবে ঐ ত্রুটি যদি কুরবানীদাতার কর্মদোষে বা অবহেলায় না হয়, তাহলে ওটাই কুরবানী করা তার জন্য সিদ্ধ হবে।

কিন্তু নির্ণয়ের পূর্বে যদি কুরবানী তার উপর ওয়াজেব থাকে, যেমন কেউ কুরবানীর নযর মেনে থাকে এবং তারপর কোন ছাগল তার জন্য নির্ণীত করে এবং তারপর তার নিজ দোষে তা ত্রুটিযুক্ত না হয়ে অন্য কারণে হয়ে থাকে, তা হলেও ত্রুটিহীন পশু দ্বারা তার পরিবর্তন জরুরী হবে।

৩। কুরবানীর পশু হারিয়ে বা চুরি হয়ে গেলে, যদি তা কুরবানী দাতার অবহেলার ফলে না হয়, তাহলে তার পক্ষে অন্য কুরবানী জরুরী নয়। কারণ, তা তার হাতে এক প্রকার আমানত, যা যত্ন সত্ত্বেও বিনষ্ট হলে তার যামানত নেই। তবে ভবিষ্যতে ঐ পশু যদি ফিরে পায়, তবে কুরবানীর সময় পার হয়ে গেলেও ঐ সময়েই তা যবেহ করবে। কিন্তু যদি কুরবানী দাতার অবহেলা ও অযত্নের কারণে রক্ষা না করার ফলে হারিয়ে বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে তার পরিবর্তে অন্য একটি পশু কুরবানী করা জরুরী হবে।

৪। কুরবানীর পশুর কোন অংশ (গোশত, চর্বি, চামড়া, দড়ি ইত্যাদি) বিক্রয় করা বৈধ হবে না। কারণ, তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত বস্তু, তাই কোনও প্রকারে পুনরায় তা নিজের ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা বৈধ নয়। তদনুরূপ ওর কোনও অংশ দ্বারা কসাইকে পারিশ্রমিক দেওয়া বৈধ নয়। যেহেতু সেটাও এক প্রকার বিনিময় যা ক্রয়-বিক্রয়ের মত[5]

অবশ্য কসাই গরীব হলে দান সবরূপ অথবা গরীব না হলে হাদিয়া সবরূপ তাকে কুরবানীর গোশত ইত্যাদি দেওয়া দূষণীয় নয়। যেহেতু তখন তাকে অন্যান্য হকদারদের শামিল মনে করা হবে; বরং সেই অধিক হকদার হবে। কারণ সে ঐ কুরবানীতে কর্মযোগে শরীক হয়েছে এবং তার মন ওর প্রতি আশানিক্ষত হয়েছে। তবে উত্তম এই যে, তার মজুরী আগে মিটিয়ে দেবে এবং পরে কিছু দান বা হাদিয়া দেবে। যাতে কোন সন্দেহ ও গোলযোগই অবশিষ্ট না থাকে।[6]

৫। পশু ক্রয় করার পর যদি তার বাচ্চা হয়, তাহলে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানী করতে হবে।[7] এর পূর্বে ঐ পশুর দুধ খাওয়া যাবে; তবে শর্ত হল, যেন ঐ বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়[8]

[1] (মুসলিম ১০১৫নং)
[2] (তফসীর ইবনে কাষীর ৩/২২৯)
[3] (ফাতহুল বারী ১০/৯)
[4] (আহমাদ, হাকেম, প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৮৬১নং)
[5] (বুখারী ১৬৩০, মুসলিম ১৩১৭নং)
[6] (ফাতহুল বারী ৩/৫৫৬)
[7] (তিঃ ১৫০৩নং)
[8] (বাইহাকী ৯/২৮৮, আল-মুমতে ৭/৫১০)সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


*******************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url