প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৩৪] || মহানবীর জীবনী ||





পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।

ওহোদ যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল পর্যালোচনা

ওহোদ যুদ্ধের গুরুত্ব

১. বদর যুদ্ধে কাফেরদের গ্লানিকর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার এবং উঠতি মুসলিম শক্তিকে অংকুরে বিনাশ করার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

২. মাত্র ৭০০ মুসলিম সেনার কাছে সুসজ্জিত ৩০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনীর ন্যাক্কারজনক পিছু হটায় কুরায়েশ বাহিনী আদপেই হিম্মত হারিয়ে ফেলে। ফলে দু’বছর পর সম্মিলিত আরব বাহিনীর সাথে খন্দকের যুদ্ধে আগমনের আগে এককভাবে কুরায়েশ বাহিনী আর কখনো মদীনায় হামলা করেনি।

৩. ইহূদী ও মুনাফিকদের সার্বিক অপতৎপরতা ও যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ৩০০ মুনাফিক বাহিনীর পৃষ্ঠপ্রদর্শনেও মুসলিম বাহিনী ফিরে না যাওয়ায় কাফের বাহিনী সবদিক দিয়ে নিরাশ হয়ে পড়ে।

৪. তীরন্দাযদের ভুল থেকে মুসলিম বাহিনী শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ভবিষ্যতে এরূপ কোন ভুল তারা আর করেনি।

৫. মুসলিম বাহিনীর শক্তি বিষয়ে বিরোধীদের মধ্যে সমীহ বোধ সৃষ্টি হয়। যা ভবিষ্যৎ বিজয়সমূহের সোপান হিসাবে বিবেচিত হয়।

ওহোদ যুদ্ধের ফলাফল

১. এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী শেষ দিকে বিপর্যয়ে পড়লেও কাফের পক্ষ বিজয়ী হয়নি।

২. মুনাফিকরা চিহ্নিত হওয়ায় মুসলিম বাহিনী স্বস্তি লাভ করে এবং আরও শক্তিশালী হয়।

৩. শেষের দিকে বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও মদীনার উপর চড়াও না হওয়ায় এবং মুসলিম পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় কাফের বাহিনীতে হতাশা ও ফাটল সৃষ্টি হয়।

৪. পরদিন মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবনে কাফের বাহিনী ফিরে দাঁড়ানোর বদলে দ্রুত মক্কায় পালিয়ে যায়।

৫. মুসলিম বাহিনীর ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং কাফের বাহিনী হিম্মত হারিয়ে ফেলে।

ওহোদ যুদ্ধের শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ

(১) হক ও বাতিলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় আমীর ও মামূরকে সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও অটুট আনুগত্যের বন্ধনে দৃঢ় থাকতে হয়। জিহাদের ময়দানে ও সমাজ জীবনে এটি সমভাবে প্রযোজ্য।

(২) আল্লাহভীরু ও নির্লোভ আমীরের সাথে দুনিয়াদার ও লোভী কর্মী টিকে থাকতে পারে না। ইবনে উবাই ও তার সাথীদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।

(৩) দুনিয়াবী লোভ সৎ ও বিশ্বস্ত কর্মীকেও সাময়িকভাবে প্রতারিত করে। যা সর্বোচ্চ ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। বিশ্বস্ত তীরন্দাযদের পদস্খলন তার বাস্তব প্রমাণ।

(৪) ভাল ও মন্দ বাছাইয়ের জন্য হকপন্থী সংগঠনের উপর মাঝে-মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা নেমে আসে। ওহোদের সাময়িক বিপর্যয় আমাদের সেই শিক্ষা দেয়।

(৫) জান্নাত পিয়াসী মোখলেছ নেতা-কর্মীরাই সর্বদা আখেরাতে বিজয়ী হয়ে থাকে। ওহোদের মত শত বাধা পেরিয়েও ইসলামের অগ্রযাত্রা তার বাস্তব প্রমাণ।

(৬) ইসলামী বিজয়ের জন্য আল্লাহর উপরে দৃঢ় নির্ভরশীলতা সর্বাপেক্ষা যরূরী।

(৭) বাতিলপন্থী যত শক্তিধরই হৌক, নৈতিক শক্তির কারণে ইসলামপন্থীদের সামনে তারা সর্বদা দুর্বল। আবু সুফিয়ানের নীরব পশ্চাদ্গমন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

(৮) দুনিয়া ও আখেরাতে বিজয় কেবল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত।

ওহোদ পরবর্তী যুদ্ধসমূহ

গাযওয়া হামরাউল আসাদ

৩য় হিজরীর ৮ই শাওয়াল রবিবার। আবু সুফিয়ানের বাহিনী পুনরায় মদীনা আক্রমণ করতে পারে, এই আশংকায় রাসূল (ছাঃ) ওহোদ যুদ্ধের পরদিনই তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং মদীনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মক্কার দিকে ১২ কি. মি. দূরে হামরাউল আসাদে পৌঁছেন। তিনি সেখানে তিনদিন অবস্থান শেষে মদীনায় ফিরে আসেন। (বিস্তারিত ৩৫৪ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।

সারিইয়া আবু সালামাহ

৪র্থ হিজরীর ১লা মুহাররম। ত্বালহা ও সালামা বিন খুওয়াইলিদ নামক কুখ্যাত ডাকাত দু’ভাই বনু আসাদ গোত্রকে মদীনা আক্রমণের প্ররোচনা দিচ্ছে মর্মে খবর পৌঁছলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় দুধভাই আবু সালামাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মুহাজির ও আনছারদের ১৫০ জনের একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। বনু আসাদের প্রস্তুতি গ্রহণের পূর্বেই তাদের ‘ক্বাত্বান’ (قَطَن) নামক ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণের ফলে তারা হতচকিত হয়ে পালিয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী তাদের ফেলে যাওয়া উট ও বকরীর পাল ও গণীমতের মাল নিয়ে ফিরে আসে। এই যুদ্ধ থেকে ফিরে কিছু দিনের মধ্যে আবু সালামা মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তার বিধবা স্ত্রী উম্মে সালামা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। আবু সালামা ইতিপূর্বে ওহোদের যুদ্ধে যখমী হয়েছিলেন’।[1]

সারিইয়া আব্দুল্লাহ বিন উনাইস

৪র্থ হিজরীর ৫ই মুহাররম সোমবার। মুসলমানদের উপরে হামলার জন্য নাখলা অথবা উরানাহ নামক স্থানে খালেদ বিন সুফিয়ান বিন নুবাইহ আল-হুযালী সৈন্য সংগ্রহ করছে মর্মে বলে সংবাদ পেয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আব্দুল্লাহ বিন উনাইস আল-জুহানী আনছারীকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তিনি তাকে হত্যা করে মদীনায় ফিরে আসেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে তার নিহত হওয়ার সংবাদ প্রদান করেন।[2]

সারিইয়া বি’রে মাঊনা

৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। নাজদের নেতা আবু বারা ‘আমের বিন মালেকের আমন্ত্রণক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদবাসীদের কুরআন পড়ানোর জন্য ও দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য মুনযির বিন ‘আমের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৭০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন। যাদের সকলে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ক্বারী ও বিজ্ঞ আলেম। যারা দিনের বেলায় কাঠ কুড়াতেন এবং রাত্রি জেগে নফল ছালাত আদায় করতেন। তাঁরা মাঊনা নামক কূয়ার নিকটে অবতরণ করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর পত্র নিয়ে হারাম বিন মিলহান গোত্রনেতা ‘আমের বিন তুফায়েল-এর নিকটে গমন করেন। কিন্তু সে পত্রের প্রতি দৃকপাত না করে একজনকে ইঙ্গিত দেয় তাকে হত্যা করার জন্য। ফলে হত্যাকারী তাকে পিছন দিক থেকে বর্শা বিদ্ধ করে। এ সময় রক্ত দেখে হারাম বিন মিলহান বলে ওঠেন,اللهُ أكْبَرُ، فُزْتُ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ ‘আল্লাহু আকবর! কা‘বার রবের কসম! আমি সফল হয়েছি’। অতঃপর ‘আমের বিন তুফায়েলের আবেদনক্রমে বনু সুলাইমের তিনটি গোত্র উছাইয়া, রে‘ল ও যাকওয়ান(عُصَيَّة، رِعْل، ذَكْوَان) চতুর্দিক হতে তাদের উপরে আক্রমণ চালায় এবং সবাইকে হত্যা করে। একমাত্র ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী রক্ষা পান মুযার গোত্রের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে। এতদ্ব্যতীত বনু নাজ্জারের কা‘ব বিন যায়েদ জীবিত ছিলেন। তাঁকে নিহতদের মধ্য থেকে যখমী অবস্থায় উঠিয়ে আনা হয়। পরে তিনি ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধের সময় একটি অজ্ঞাত তীরের আঘাতে শহীদ হন।[3]

এসময় জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে খবর দিয়ে বললেন, প্রেরিত দলটি তাদের রবের সাথে মিলিত হয়েছে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করেছেন। এ ঘটনার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের বিরুদ্ধে ৪০ দিন অন্য বর্ণনায় এক মাস যাবত কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।

হারাম বিন মিলহানের মৃত্যুকালীন শেষ বাক্যটি হত্যাকারী জাববার বিন সালমা (عُصَيَّة، رِعْل، ذَكْوَان) এর অন্তরে এমনভাবে দাগ কাটে যে, পরে তিনি ইসলাম কবুল করেন’ (ইবনু হিশাম ২/১৮৬)।

সারিইয়া রাজী

৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে ‘আযাল ও ক্বাররাহ(عَضَلٌ وَالْقَارَّةُ) গোত্রের সাতজন লোককে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরয করে যে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। এক্ষণে তাদেরকে দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য ও কুরআন পড়ানোর জন্য কয়েকজন উঁচু মর্তবার ছাহাবীকে পাঠালে আমরা উপকৃত হ’তাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে ‘আছেম বিন ছাবিত (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৬জন মুহাজির ও ৪জন আনছারসহ ১০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন।[4] ‘আছেম হযরত ওমরের শ্বশুর ছিলেন এবং ‘আছেম বিন ওমরের নানা ছিলেন। তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী রাজী‘ নামক ঝর্ণার নিকটে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা মতে হুযায়েল গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দায তাদের উপর হামলা করে। যুদ্ধে ‘আছেম সহ ৮জন শহীদ হন এবং দু’জনকে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তারা হ’লেন হযরত খোবায়েব বিন ‘আদী ও যায়েদ বিন দাছেনাহ(زيد بن الدَّثِنَةِ)।

সেখানে ওক্ববা বিন হারেছ বিন ‘আমের খোবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বিন খালাফ যায়েদকে হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা নেয়। শূলে চড়ার আগে খোবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি, এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর কাফেরদের বদ দো‘আ করেন এবং মর্মন্তুদ কবিতা বলেন, যা ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ ও জীবনী গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। খোবায়েবের সেই বিখ্যাত দো‘আটি ছিল নিম্নরূপ- اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে এক এক করে গুণে রাখ। তাদেরকে এক এক করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও অবশিষ্ট রেখো না’। অতঃপর তাঁর পঠিত সাত বা দশ লাইন কবিতার বিশেষ দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ-

وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا + عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ فِي اللهِ مَصْرَعِي
وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ + يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ

‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোন পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে শোয়ানো হচ্ছে’। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।[5]

যায়েদ বিন দাছেনাকে হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবার সহ বেঁচে থাক? তিনি বলেন,لاَ وَاللهِ الْعَظِيمِ مَا أُحِبُّ أَنْ يَفْدِيَنِي بِشَوْكَةٍ يُشَاكَهَا فِي قَدَمِهِ ‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে তাঁর পায়ে একটি কাঁটারও আঘাত লাগুক’। একথা শুনে বিস্মিত আবু সুফিয়ান বললেন,مَا رَأَيْتُ مِنَ النَّاسِ أَحَدًا يُحِبُّ أَحَدًا كَحُبِّ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا ‘মুহাম্মাদের সাথীরা মুহাম্মাদকে যেরূপ ভালোবাসে সেরূপ কাউকে আমি দেখিনি’। হারাম এলাকা থেকে বের করে ৬ কি. মি. উত্তরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার গোলাম নিসতাস ইবনুদ দাছেনাকে হত্যা করে। অতঃপর একইদিনে খোবায়েবকে সেখানে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয় (আল-বিদায়াহ ৪/৬৫-৬৬)।

বীরে মা‘উনার মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ছাহাবী ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী প্রহরীদের লুকিয়ে অতীব চতুরতার সাথে খোবায়েবের লাশ এনে সসম্মানে দাফন করেন (আল-বিদায়াহ ৪/৬৬)। অন্যদিকে দলনেতা ‘আছেম-এর লাশ আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা লোক পাঠান। কিন্তু আল্লাহ তার লাশের হেফাযতের জন্য এক ঝাঁক ভীমরুল প্রেরণ করেন। ফলে মুশরিকরা তার লাশের নিকটে যেতে পারেনি। কেননা ‘আছেম আল্লাহর নিকটে অঙ্গীকার দিয়েছিলেন,لاَ يَمَسَّهُ مُشْرِكٌ، وَلاَ يَمَسَّ مُشْرِكًا أَبَدًا فِي حَيَاتِهِ ‘যেন কোন মুশরিক তাকে স্পর্শ না করে এবং তিনিও কোন মুশরিককে তাঁর জীবদ্দশায় কখনো স্পর্শ না করেন’। পরে হযরত ওমর (রাঃ) বলেন,مَنَعَهُ اللهُ بَعْدَ وَفَاتِهِ، كَمَا امْتَنَعَ مِنْهُ فِي حَيَاتِهِ ‘আল্লাহ তাঁকে মুশরিকের স্পর্শ থেকে মৃত্যুর পরেও হেফাযত করেছেন, যেমন তাকে জীবিত অবস্থায় হেফাযত করেছিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/১৭১)।

খোবায়েবকে হত্যার জন্য খরীদ করেন হুজায়ের বিন আবু ইহাব তামীমী, যিনি বদর যুদ্ধে নিহত হারেছ বিন ‘আমের-এর সহোদর ভাই ছিলেন। তার দাসী, যিনি পরে মুসলমান হন, তিনি বলেন যে, খোবায়েব আমার বাড়ীতে আটক ছিল। একদিন আমি তাকে বড় এক থোকা আঙ্গুর খেতে দেখি। অথচ তখন মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না। তিনি বলেন, হত্যার সময় উপস্থিত হ’লে তিনি আমাকে বলেন, আমার জন্য একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিন, যাতে হত্যার পূর্বে আমি ক্ষৌরকর্ম করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারি। তখন আমি আমার বাচ্চাকে দিয়ে তাঁকে একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিলাম। পরক্ষণে আমি বলে উঠলাম, হায়! আমি এটা কি করলাম? আল্লাহর কসম! লোকটি নিজের হত্যার বদলে আমার বাচ্চাকে হত্যা করবে। অতঃপর যখন সে বাচ্চার হাত থেকে ক্ষুরটি নিল, তখন বলল, তোমার জীবনের কসম! তোমার মা যেন আমার বিশ্বাসঘাতকতার ভয় না করেন, যখন তিনি তোমাকে এই ক্ষুরসহ আমার কাছে পাঠিয়েছেন। অতঃপর সে বাচ্চাকে ছেড়ে দিল’ (ইবনু হিশাম ২/১৭২)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, কুরায়েশরা খোবায়েবকে হারেছ বিন ‘আমেরের বাড়ীতে কয়েকদিন বন্দী রাখে। এ সময় তাকে কোন খাদ্য বা পানীয় দেওয়া হয়নি। একদিন হঠাৎ হারেছ-এর ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটি ধারালো ছুরি নিয়ে খেলতে খেলতে তার কাছে চলে আসে। তিনি তাকে আদর করে কোলে বসান। এ দৃশ্য দেখে বাচ্চার মা চিৎকার করে ওঠেন। তখন খোবায়েব বলেন, মুসলমান কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। মৃত্যুর পূর্বে খোবায়েবের শেষ বাক্য ছিল-اللَّهمَّ إنَّا قَدْ بَلَّغْنَا رِسَالَةَ رَسُولِكَ، فَبَلِّغْهُ الْغَدَاةَ مَا يُصْنَعُ بِنَا ‘হে আল্লাহ, আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে তুমি তাঁকে আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি পৌঁছে দাও’।

ওমর (রাঃ)-এর গবর্ণর সাঈদ বিন ‘আমের (রাঃ) যিনি খোবায়েবের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের নিহত হবার দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কতবড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে থোকা থোকা আঙ্গুর খেতে দেখা গেছে। অথচ ঐসময় মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না’ (ইবনু হিশাম ২/১৭২)।

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পরপর দু’টি হৃদয় বিদারক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দারুণভাবে ব্যথিত হন। অতঃপর তিনি বনু লেহিয়ান, রে‘ল ও যাকওয়ান এবং উছাইয়া গোত্র সমূহের বিরুদ্ধে এক মাস যাবত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে বদ দো‘আ করে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।[6]

সারিইয়া ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী

৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বি’রে মাঊনার মর্মান্তিক ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র ছাহাবী ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী বি’রে মাঊনা হ’তে মদীনায় ফেরার পথে ক্বারক্বারা নামক বিশ্রাম স্থলে পৌঁছে বনু কেলাব গোত্রের দু’ব্যক্তিকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। এর মাধ্যমে তিনি সাথীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত গোত্রের সঙ্গে যে রাসূল (ছাঃ)-এর সন্ধিচুক্তি ছিল, তা তিনি জানতেন না। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বিনিময় স্বরূপ রক্তমূল্য প্রদান করেন। কিন্তু এই ঘটনা পরবর্তীতে বনু নাযীর যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।[7]

[1]. ইবনু সা‘দ ২/৩৮; যাদুল মা‘আদ ৩/২১৮; আল-বিদায়াহ ৪/৬১; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৮০১; আর-রাহীক্ব ২৯০-৯১ পৃঃ; বর্ণনাটি যঈফ (তা‘লীক্ব পৃঃ ১৫৭)।
[2]. ইবনু সা‘দ ২/৩৯; ইবনু হিশাম ২/৬১৯-২০। বর্ণনাটি যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২০২৫)।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, আব্দুল্লাহ বিন উনাইস (রাঃ) ১৮ দিন পর মদীনায় ফিরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে খালেদের কাটা মাথা এনে রাখেন। এসময় রাসূল (ছাঃ) তাকে একটি লাঠি হাদিয়া দেন এবং বলেন, এটি ক্বিয়ামতের দিন তোমার ও আমার মাঝে নিদর্শন হবে। আব্দুল্লাহ উক্ত লাঠিটি আমৃত্যু সাথে রাখেন এবং অছিয়ত করেন যে, এটি আমার কাফনের সাথে দিয়ে দিয়ো। অতঃপর উক্ত লাঠি সহ তাকে দাফন করা হয় (আর-রাহীক্ব ২৯১ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬২০; যাদুল মা‘আদ ৩/২১৮)। বর্ণনাটি যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২০২৬)। ১৮ দিন পর মাথা নিয়ে আসার কথা ইবনু হিশামে নেই। যাদুল মা‘আদে আব্দুল মুমিন বিন খালাফ (মৃ. ৭০৫ হি.)-এর বরাতে লেখা হয়েছে। কিন্তু মুবারকপুরী এটি সরাসরি লিখেছেন। যা একেবারেই ভিত্তিহীন।

[3]. আল-ইছাবাহ, কা‘ব বিন যায়েদ ক্রমিক ৭৪১৭; যাদুল মা‘আদ ৩/২২২; ইবনু সা‘দ ২/৩৯-৪০।
[4]. অন্য বর্ণনায় এসেছে, মারছাদ বিন আবী মারছাদ আল-গানাভী-র নেতৃত্বে (ইবনু হিশাম ২/১৬৯)।
[5]. ইবনু হিশাম ২/১৭৬; বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[6]. বুখারী হা/৪৫৬০; মুসলিম হা/৬৭৫; আবুদাঊদ হা/১৪৪২; নাসাঈ হা/১০৭৩; মিশকাত হা/১২৮৮-৯১ ‘বিতর’ অধ্যায়, ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ।
[7]. ইবনু হিশাম ২/১৮৬; আর-রাহীক্ব ২৯৪ পৃঃ।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url