মহররম মাসের মর্যাদা || মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার কারণ || আশুরার আমলসমূহ বা করণীয় || আশুরায় বর্জনীয় ও বিদআত ||





আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

মহররম মাসের মর্যাদা

হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। এ মাসটি একটি বরকতময় ও হারাম মাসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এ মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়।

মহররম অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রহস্যময় তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এ মাসকে ঘিরে, সঙ্গে সঙ্গে এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল, এসব কারণেই এ মাসটি মর্যাদাপূর্ণ। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে মহররম বা মর্যাদাপূর্ণ মাস। মহররম সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে- 'নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।' (সুরা তাওবা : ৩৬)

মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার কারণ

মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার মধ্যে বিশেষ একটি কারণ হচ্ছে- আশুরা (মহররমের ১০ তারিখ)। এ বসুন্ধরার ঊষালগ্ন থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ও হৃদয়বিদারক কাহিনী। আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে- হজরত মুসা (আ.)-এর ফিরআউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ। এই দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা চিরকালের জন্য লোহিত সাগরে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদার দাবিদার ফিরআউন ও তার বিশাল বাহিনী।

অনেকে মনে করেন, ফিরআউন নীলনদে ডুবেছিল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এই ধারণা ভুল। বরং তাকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ঘটনা ইমাম বুখারি তাঁর কিতাবে এভাবে বর্ণনা করেন- 'হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সাঃ) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে।

তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আঃ) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আঃ)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)

উপরোক্ত হাদিসের আলোকে কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়, হজরত মুসা (আ.) অভিশপ্ত ফিরআউনের কবল থেকে আশুরার দিন রক্ষা পেয়েছিলেন। তা হাদিসের প্রায় সব গ্রন্থেই (বুখারি, মুসলিমসহ) পাওয়া যায়। 

আরও পড়ুন-

আশুরা ও হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের ঘটনা সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা

উপরে উল্লিখিত হাদিস থেকে আমরা এ কথাও বুঝতে পারলাম যে, আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। অনেকেই না বুঝে অথবা ভ্রান্ত প্ররোচনায় পড়ে আশুরার ঐতিহ্য বলতে রাসুল (সাঃ)-এর প্রিয়তম দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের দলপতি হজরত হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত ও নবী পরিবারের কয়েকজন সম্মানিত সদস্যের রক্তে রঞ্জিত কারবালার ইতিহাসকেই বুঝে থাকেন। তাদের অবস্থা ও কার্যাদি অবলোকন করে মনে হয়, কারবালার ইতিহাসকে ঘিরেই আশুরার সব ঐতিহ্য, এতেই রয়েছে আশুরার সব রহস্য। উপরোল্লিখিত হাদিসের আলোকে প্রতীয়মান হয়, আসলে বাস্তবতা কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং আশুরার ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। হজরত হুসাইন (রাঃ)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনার অনেক আগ থেকেই আশুরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যঘেরা দিন। কারণ কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬১ হিজরির ১০ মহররম। আর আশুরার রোজার প্রচলন চলে আসছে ইসলাম আবির্ভাবেরও বহুকাল আগ থেকে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে আবহমানকাল থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা যেমন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি হিজরি ৬১ সনে আশুরার দিন কারবালার ময়দানের দুঃখজনক ঘটনাও মুসলিম জাতির জন্য অতিশয় হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক। প্রতিবছর আশুরা আমাদের এই দুঃখজনক ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এও বাস্তব যে এ ঘটনাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পেরে আজ অনেকেই ভ্রষ্টতা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত।

আশুরার আমলসমূহ বা করণীয়

আশুরায় রোজা রাখা

১. হজরত আবু মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনকে ঈদ হিসেবে গণ্য করত। হুজুর (সাঃ) সাহাবিদেরকে বললেন, ‘তোমরা ওই দিন রোজা রাখো’ (বুখারি-১৮৬৮)।

২. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি হুজুর সা:কে এ দিন অর্থাৎ আশুরার দিন এবং এ মাস তথা রমজান মাস ভিন্ন আর কোনো দিনকে অধিক মাহাত্ম্যপূর্ণ করতঃ রোজা রাখতে দেখিনি’ (বুখারি- ১৮৭৯, মিশকাত-১৯৪২)।

৩. হজরত সালমা ইবনে আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম (সাঃ) আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে আদেশ করলেন সে যেন লোকদের মধ্যে ঘোষণা করে দেয় যে, যে ব্যক্তি কিছু খেয়ে ফেলেছে সে যেন দিনের বাকি সময়টুকু রোজা রাখে। আর যে কিছু খায়নি সে যেন পূর্ণ দিন রোজা রেখে দেয়। কেননা, আজ আশুরার দিন’ (বুখারি-১৮৭০)।

৪. হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাসের রোজার পর সবচেয়ে ফজিলতের রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা’ (তিরমিজি-৭৩৮)।

৫. হজরত আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ ফরমাইয়াছেন, ‘আশুরার দিবসের রোজা পালন সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, এর মাধ্যমে তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা করে দেবেন। এ বিষয়ে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রাঃ) প্রমুখ নবী করিম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি আশুরার দিবসের রোজা পালন করতে উৎসাহিত করেছেন’ (তিরমিজি-৭৫০)।

৬. হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘রমজানের রোজার পর আল্লাহর মাস মহররমের রোজাই হলো শ্রেষ্ঠ রোজা এবং ফরজ নামাজের পর রাতের নামাজই শ্রেষ্ঠ নামাজ’ (মুসলিম, মেশকাত-১৯৪১)।

৭. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আশুরার দিনে রোজা রাখলেন এবং তাতে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। সাহাবিরা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই দিনকে তো ইহুদি এবং নাসারারা সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ বললেন, ‘আমি যদি আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকি নিশ্চয়ই আমি নবম তারিখেও রোজা রাখব।’

আশুরার রোজার ফজিলত

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই রোজা নিজে পালন করেছেন এবং উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তাই এর পূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উম্মতের কল্যাণ। এ ছাড়া অসংখ্য হাদিসে আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস শুনি- 'হজরত আবু কাতাদা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম-১১৬২)। 'রাসুল (সাঃ) বলেন- 'রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।' (সুনানে কুবরা-৪২১০)

আশুরার রোজা ও ইহুদি সম্প্রদায় : মুসলিম শরিফে হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত- 'মহানবী (সাঃ) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, 'তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। (মুসলিম-১১৩৪)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন ‘আমি নবী করিম (সাঃ)-কে রোজা রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখেনি, যত আগ্রহী হতে দেখেছি এই আশুরার রোজা ও রমজান মাসের রোজার প্রতি’ (বুখারি: ৪/২৪৫, ২০০৬, মুসলিম: ১১৩২)। আশুরার আগে একদিন বা পরে একদিন রোজা রাখো’ (মুসনাদে আহমদ: ১/২৪১)

উল্লিখিত হাদিস ও অন্য হাদিসের আলোকে ফকিহরা বলেন, রোজা দুই দিন রাখা মোস্তাহাব ৯ ও ১০ তারিখ, তা না হলে ১০ ও ১১ তারিখ। কারণ, এ ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করা উচিত। তাই ফকিহরা আশুরার দিনেই শুধু একটা রোজা রাখাকে মাকরূহ বলেছেন।

কিভাবে পালন করবেন আশুরার সওম

আশুরার সওম পালন সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একত্র করলে আশুরার সওম পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে কয়েকটি সিদ্ধান্তে আসা যায়ঃ 

(ক) মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে সওম পালন করা। এ পদ্ধতি অতি উত্তম। কারণ রসূলে কারীম (সাঃ) এভাবেই আশুরার সওম পালনের সংকল্প করেছিলেন। যেমন ইতিপূর্বে আলোচিত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর হাদীস এর প্রমাণ বহন করে। 
(খ) মুহাররম মাসের দশম ও একাদশ দিবসে সওম পালন করা। এ পদ্ধতিও হাদীস দ্বারা সমর্থিত। 
(গ) শুধু মুহাররম মাসের দশম তারিখে সওম পালন করা। এ পদ্ধতি মাকরূহ। কারণ এটা ইহুদীদের আমলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। 
(ইকতেজাউ সিরাতিল মুস্তাকীম: ইমাম তাইমিয়া) ও (রদ্দুল মুহতার : ইবনে আবেদীন) 

কোন কোন আলেমের মতে আশুরা উপলক্ষে নবম, দশম ও একাদশ তারিখে মোট তিনটি সওম পালন করা ভাল। এতে আশুরার ফজীলত লাভ করার ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ থাকে না।তবে সর্বাবস্থায় এ রকম আমল করা ঠিক হবে না। এভাবে আমল তখনই করা যেতে পারে যখন আশুরার তারিখ নিয়ে সন্দেহ দেখা যায়। 

যেমন মুহাম্মাদ বিন সীরিন (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার মুহাররমের তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিলে তিনি উপরোক্ত নিয়মে তিনটি সওম পালন করেন। (ফাতহুল বারী : ইবনে হাজার) ও (যাদুল মাআ’দ : ইবনুল কায়্যিম)

আশুরায় বর্জনীয় ও বিদআত


ওপরে উল্লিখিত তিনটি আমল ছাড়া আরো বিভিন্ন আমল আশুরার দিনে সমাজে প্রচলিত, যা থেকে বিরত থাকা প্রকৃত মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।

আশুরার দিন সুরমা লাগানো

হানাফি মাজহাবের কেউ কেউ আশুরার দিন সুরমা লাগানোর কথা বলেছেন। যেমন তাহতাবি ও হিদায়া নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃত কথা হলো, আশুরার দিন সুরমা লাগানো বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। এটি বানানো হাদিস। তাই বেশির ভাগ হানাফি আলেম এটিকে বিদআত বলেছেন। ফাতওয়ায়ে শামিতে এসেছে : আশুরার দিন সুরমা লাগানোর হাদিসকে মোল্লা আলী কারী (রহ.) জাল হাদিসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) দুরারে মুনতাসিরাতে হাকিম সূত্রে এটিকে ‘মুনকার’ বলেছেন। আল্লামা জারাহি (রহ.) ‘কাশফুল খিফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, আশুরার দিন সুরমা লাগানোর হাদিস নবী (সাঃ) থেকে প্রমাণিত নয়। তাই তা বিদআত। তবে খাবারে প্রশস্ততার হাদিস প্রমাণিত ও সহিহ। হাফিজ সুয়ুতি দুরারে তা-ই বলেছেন। ’ (রদ্দুল মুহতার আলাদ দুররিল মুখতার, খণ্ড-২, পৃ. ৪১৯, ৪৩০)

আশুরার দিনকে ঈদ বানানো

আশুরার দিনকে ঈদ বানানো যাবে না। বরং রোজা রাখা হবে। আর ঈদের দিন তো রোজা রাখা হারাম। মুসলিম শরিফে এসেছে, আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘খায়বরবাসী আশুরার দিন রোজা রাখত। এটিকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করত। তাদের নারীদের অলংকার ও সুন্দর পোশাক পরিধান করাত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাদের বললেন, তোমরা রোজা রাখো। ’ (কুশাইরি, হাদিস : ১১৩১)

আশুরার দিনে পিপাসার্ত থাকা

জালালুদ্দীন সুয়ুতি (রহ.) লিখেছেন : কিছু মনপূজারি লোক আশুরার দিন কুসংস্কারে লিপ্ত হয়। যেমন—পিপাসার্ত থাকা, পেরেশান হওয়া, ক্রন্দন করা ইত্যাদি। এগুলো বিদআত। এগুলো আল্লাহ, তাঁর রাসুল, সালফে সালেহীন, আহলে বাইত প্রমুখ অনুমোদিত নয়। নিশ্চয়ই হুসাইন (রাঃ)-এর হত্যার মাধ্যমে পূর্ব যুগে ফিতনার সূচনা হয়। তাতে আমাদের করণীয় হলো, যা মসিবতের সময় করণীয়। সেটি হলো, ইন্না লিল্লাহ... পড়া, ধৈর্য ধরা, হা-হুতাশ না করা, নিজের আত্মাকে কষ্ট না দেওয়া। অথচ বর্তমানে বিদআতিরা এসব করে থাকে। তাতে তারা অনেক মিথ্যা ও সাহাবাদের ব্যাপারে খারাপ বিবরণ পেশ করে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অপছন্দ করেন। (হাকিকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদআতি : ১/১৪৭)

আশুরায় মাতম করা ও শোক পালন

আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) লিখেছেন: বিভিন্ন বিপদের দিনকে শোকের দিন বানানো ইসলাম সমর্থন করে না। এটি জাহেলি কাজ। শিয়া সম্প্রদায় আশুরার দিনে এসব করে এ দিনের মর্যাদাবান রোজা ছেড়ে দেয়। (হাকিকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদআতি, খণ্ড-১, পৃ. ১৪৮)।

তেল মালিশ, মেহেদি ব্যবহার, দানা রান্না করা, নতুন কাপড় পরিধান

আবুল আব্বাস আনসারি লিখেছেন : মুহাদ্দিস ও ফকিহদের কাছ থেকে সুরমা লাগানো, গোসল করা, মেহেদি লাগানো, দানা রান্না করা, নতুন কাপড় পরিধান করা এবং আশুরার দিন খুশি পালন করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়। তাঁরা বলেন, তাতে কোনো সহিহ হাদিস রাসুল ও সাহাবা থেকে বর্ণিত নেই। এমনকি কোনো ইমাম, চার প্রসিদ্ধ ইমাম ও অন্য কেউ মুস্তাহাব বলেননি। এ বিষয়ে কোনো বিশ্বস্ত কিতাবে সহিহ বা দুর্বল কোনো অভিমতও নেই। (আস সওয়াইকুল মুহরিকা আলা আহলির রফযি ওয়াদ দালাল ওয়ায যানদিকা, খণ্ড-২, পৃ. ৫৩৫)

হুসাইন (রাঃ)-এর বিরোধীরাই এসব বিদআত আবিষ্কার করেছে। এগুলো মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে শরিয়তের কোনো দলিল নেই। জুমহুর আলেমদের মতে, সেদিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। (ইসলাহুল মাসাজিদ, খণ্ড-১, পৃ. ১৬৭)

আশুরার দিনে গোশত না খাওয়া

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (রহ.) লিখেছেন : ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, আশুরার দিন সুরমা লাগানো, তেল লাগানো, সুগন্ধি লাগানো মিথ্যুকদের বানানো কথা। এর বিপরীতে আরেক দল এটিকে শোক ও মাতমের দিন বানিয়েছে। দুই দলই বিদআতি। সুন্নাতের বিপরীতে এদের অবস্থান। আর রাফেজিরা বৈধ প্রাণীর গোশত ভক্ষণ নিষিদ্ধ মনে করে। (রিসালাতুন ফির রদ্দি আলার রাফিযা : ১/৪৯)

আশুরার দিনে বিশেষ নামাজ পড়া

রায়িদ ইবনে সাবরি (রহ.) লিখেন, আশুরার দিন এভাবে নামাজ পড়বে—জোহর ও আসরের মাঝখানে চার রাকাত নামাজ পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সুরায়ে ফাতিহা ও ১০ বার আয়াতুল কুরসি পড়বে, ১১ বার সুরা ইখলাস পড়বে, পাঁচবার সুরা নাস ও ফালাক পড়বে। যখন সালাম ফিরাবে, ৭০ বার আসতাগফিরুল্লাহ বলবে। (মুজামুল বিদাঈ, পৃ. ৩৪১)

এভাবে অনেকেই আশুরার দিন নামাজ পড়ার বিভিন্ন পদ্ধতি ও ফজিলত বর্ণনা করেন। এগুলো বানোয়াট কথা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস। শিয়া সম্প্রদায় এগুলো রচনা করেছে।

শিয়ারা আশুরার দিনকে শোকের দিন পালন করে। এটি বনি উমাইয়ার প্রতি বিদ্বেষের কারণে। এটি হুসাইন (রাঃ)-এর প্রতি মোহাব্বত বা শোকের কারণে নয়। কেননা হজরত আলী (রাঃ) হুসাইন (রাঃ)-এর পিতা ছিলেন। পিতা অবশ্যই পুত্র থেকে উত্তম। আলী (রাঃ)-কেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তাঁর মৃত্যুর দিনকে শোকের দিন হিসেবে পালন করা হয় না। হুসাইন ও আলী (রাঃ)-এর চেয়ে উত্তম ওসমান (রাঃ)-কেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর শাহাদাতের দিনকেও শোকের দিন পালন করা হয় না। তাঁদের চেয়ে উত্তম হজরত ওমর (রাঃ)। তাঁর শহীদ হওয়ার দিনকে তো তারা শোকের দিন হিসেবে পালন করে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক জ্ঞান নিয়ে সঠিকভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন।




***************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url