সীরাতুন নবী (সাঃ) - ০৯ || আব্দুল মুত্তালিবের যমযম কূপ খনন ও এক পূত্রকে কুরবানী মানত || হস্তী বাহিনীর ঘটনা ||







এই পর্বের পাঠ্য বিষয়সমূহঃ

আব্দুল মুত্তালিব কর্তৃক যমযম কূপ খনন


এ ঘটনার সার সংক্ষেপ হচ্ছে আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নযোগে অবগত হন যে, তাঁকে যমযম কূপ খননের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এবং স্বপ্নযোগে তার স্থানও নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। তারপর ঘুম থেকে জেগে উঠে তিনি খনন কাজ আরম্ভ করে দেন। খনন কাজ চলাকালে কূপ থেকে ঐ সমস্ত জিনিস উত্তোলন করা হয় বনু জুরহুম গোত্র মক্কা ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে কূপের মধ্যে যা নিক্ষেপ করেছিলেন। নিক্ষিপ্ত দ্রব্যের মধ্যে ছিল কিছু সংখ্যক তলোয়ার ও লৌহবর্ম এবং দুইটি সোনার হরিণ। আব্দুল মুত্তালিব তলোয়ারগুলো দ্বারা ক্বাবা’হ গৃহের দরজা ঢালাই করেন, সোনার হরিণ দুটি দরজার সঙ্গে সন্নিবেশিত করে রাখেন এবং হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেন।

যমযম কূপ খনন কালে আরও যে ঘটনাটির উদ্ভব হয়েছিল তা হচ্ছে যখন কূপটি প্রকাশিত হয় তখন কুরাইশগণ আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে বিবাদ আরম্ভ করেন এবং দাবী করেন যে, খনন কাজে তাঁদেরকেও অংশ গ্রহণ করতে দিতে হবে।

আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘যেহেতু এ কূপ খননের জন্য তিনি স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়েছেন সেহেতু এ খনন কাজে তাঁদের অংশ গ্রহণ করতে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অন্যান্য কুরাইশগণও ছাড়বার পাত্র নন। এ ব্যাপারে মতামত গ্রহণের জন্য তাঁরা বনু সা‘দ গোত্রের এক মহিলা ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এ উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু পথের মধ্যে তাঁরা এমন কতিপয় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন যাতে তাঁদের নিকট এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা যমযম কূপের খনন কাজ আব্দুল মুত্তালিবের জন্যই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাই তাঁরা আর অগ্রসর না হয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ প্রেক্ষিতেই আব্দুল মুত্তালিব মানত করেছিলেন যে আল্লাহ তা‘আলা যদি অনুগ্রহ করে তাঁকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন এবং সকলেই বয়োপ্রাপ্ত হয়ে জীবনের এ স্তরে গিয়ে পৌঁছে যে তাঁরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম তাহলে তিনি তাঁর একটি সন্তানকে বায়তুল্লাহর জন্য উৎসর্গ করবেন।[1]

[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৪২-১৪৭ পৃঃ।

হস্তী বাহিনীর ঘটনা

দ্বিতীয় ঘটনার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, আবরাহা সাবাহ হাবশী (তিনি নাজ্জাশী সম্রাট হাবশের পক্ষ হতে ইয়ামানের গভর্ণর ছিলেন) যখন দেখলেন যে, আরববাসীগণ ক্বাবা’হ গৃহে হজ্জব্রত পালন করছেন এবং একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন সেখানে আগমন করছেন তখন সানআয় তিনি একটি বিরাট গীর্জা নির্মাণ করলেন এবং আরববাসীগণের হজ্জব্রতকে সেদিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আহবান জানালেন। কিন্তু বনু কিনানাহ গোত্রের লোকজন যখন এ সংবাদ অবগত হলেন তখন তাঁরা এক রাত্রে গোপনে গীর্জায় প্রবেশ করে তার সামনের দিকে মলের প্রলেপন দিয়ে একদম নোংরা করে ফেললেন। এ ঘটনায় আবরাহা ভয়ানক ক্রোধান্বিত হন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ কল্পে ক্বাবা’হ গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ষাট হাজার অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীসহ মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি নিজে একটি শক্তিশালী হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করেন। সৈন্যদের নিকট মোট নয়টি অথবা তেরটি হস্তী ছিল।

আবরাহা ইয়ামান হতে অগ্রসর হয়ে মুগাম্মাস নামক স্থানে পৌঁছলেন এবং সেখানে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করে নিয়ে মক্কায় প্রবেশের জন্য অগ্রসর হলেন। তারপর যখন মুজদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী স্থান ওয়াদিয়ে মুহাস্সারে পৌঁছলেন তখন তার হাতী মাটিতে বসে পড়ল। ক্বাবা’হ অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোন ক্রমেই তাকে উঠানো সম্ভব হল না। অথচ উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব মুখে যাওয়ার জন্য উঠানোর চেষ্টা করলে তা তৎক্ষণাৎ উঠে দৌঁড়াতে শুরু করত। এমন সময়ে আল্লাহ তা‘আলা এক ঝাঁক ছোট ছোট পাখী প্রেরণ করলেন। সেই পাখীগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাথরের ছোট ছোট টুকরো সৈন্যদের উপর নিক্ষেপ করতে লাগল। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি করে পাথরের টুকরো বা কংকর নিয়ে আসত একটি ঠোঁটে এবং দুইটি দু’পায়ে। কংকরগুলোর আকার আয়তন ছিল ছোলার মতো। কিন্তু কংকরগুলো যার যে অঙ্গে লাগত সেই অঙ্গ ফেটে গিয়ে সেখান দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে হতে সে মরে যেত।

এ কাঁকর দ্বারা সকলেই যে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল তা নয়। কিন্তু এ অলৌকিক ঘটনায় সকলেই ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে পড়ল এবং প্রাণভয়ে পলায়নের উদ্দেশ্যে যখন বেপরোয়াভাবে ছুটাছুটি শুরু করল তখন পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকেই প্রাণত্যাগ করল। কংকরাঘাতে ছিন্নভিন্ন এবং পদতলে পিষ্ট হয়ে পলকে বীরপুরুষগণ মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়তে লাগল। এদিকে আবরাহার উপর আল্লাহ তা‘আলা এমন এক মুসিবত প্রেরণ করলেন যে তাঁর আঙ্গুল সমূহের জোড় খুলে গেল এবং সানা নামক স্থানে যেতে না যেতেই তিনি পাখির বাচ্চার মতো হয়ে পড়লেন। তারপর তাঁর বক্ষ-বিদীর্ণ হয়ে হৃদপিন্ড বেরিয়ে এল এবং তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হলেন।

মক্কা অভিমুখে আবরাহার অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হয়ে মক্কাবাসীগণ প্রাণভয়ে নানা দিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পলায়ন করে পাহাড়ের আড়ালে কিংবা পর্বত চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তারপর যখন তাঁরা অবগত হলেন যে, আবরাহা এবং তাঁর বাহিনী সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তখন তাঁরা স্বস্তির নিংশ্বাস ত্যাগ করে আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।[1]

অধিক সংখ্যক চরিতবেত্তাগণের অভিমত হচ্ছে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মলাভের মাত্র ৫০ কিংবা ৫৫ দিন পূর্বে মুহাররম মাস। অত্র প্রেক্ষিতে এটা ধরে নেয়া যায় যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের শেষ ভাগে কিংবা মার্চ মাসের প্রথম ভাগে। হস্তী বাহিনীর এ ঘটনা ছিল আগামী দিনের নাবী (ﷺ) এবং ক্বাবা’হ শরীফের জন্য আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও সাহায্যের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। এর পিছনে আরও যে একটি কারণ ছিল তা হচ্ছে নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর আমলেই দেখলেন যে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ছিল মুসলিমদের ক্বিবলাহহ এবং সেখানকার অধিবাসীগণও ছিল মুসলিম। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর উপর আল্লাহর শত্রুদের অর্থাৎ মুশরিকগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে বুখতুনাসসরের আক্রমণ (৫৮৭ খ্রীষ্ট পূর্ব অব্দে) এবং রোমানগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা (৭০ খ্রীষ্টাব্দে)। পক্ষান্তরে ক্বাবা’হর উপর খ্রীষ্টনদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যদিও তাঁরা তৎকালে মুসলিম ছিলেন এবং ক্বাবা’হর অধিবাসীগণ ছিলেন মুশরিক।

অধিকন্তু, এ ঘটনা এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছিল যে, এ সংক্রান্ত সংবাদটি তৎকালীন সভ্য জগতের অধিকাংশ অঞ্চলে (রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য ইত্যাদি) খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, হাবশী এবং রোমীয়গণের মধ্যে গভীর সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অপর দিকে পারস্যবাসীগণের দৃষ্টি রোমীয়গণের উপর সমভাবে নিপতিত ছিল এবং শেষ পর্যন্ত অবস্থা এ দাঁড়ায় যে, পারস্যবাসীগণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইয়ামান দখল করে বসে।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন রোমান এবং পারস্য এ দুইটি রাষ্ট্রই তৎকালীন পৃথিবীর উল্লে­খযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করত এবং যেহেতু হস্তীবাহিনীর ঘটনাটি এ দু’রাষ্ট্রের সকলের নিকটেই সুবিদিত ছিল সেহেতু বলা যায় যে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি ক্বাবা’হ গৃহের অলৌকিকত্বের প্রতি নিবদ্ধ হয়ে গেল। বায়তুল্লাহর উচ্চ সম্মান ও সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সুস্পষ্ট নিদর্শন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর একথা তাঁদের মনে দৃঢ়ভাবে স্থান লাভ করল যে, এ গৃহকে সংরক্ষণ ও পবিত্রকরণ এবং এর সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা এ অলৌকিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। অতএব ভবিষ্যতে এখানকার অধিবাসীগণের মধ্য থেকে কেউ যদি নবুয়ত দাবী করেন তবে সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে তা হবে আইন-সঙ্গত এবং বাঞ্ছনীয় ব্যাপার এবং তা হবে পার্থিব ব্যবস্থাপনার উর্ধ্বে খোদায়ী রাজত্বের ভিত্তি যা ঈমানদারদের সাহায্যার্থে অবতীর্ণ হয়েছিল গায়েবী সূত্র থেকে।

আব্দুল মুত্তালিবের ছিল সর্বমোট দশটি সন্তান। তাঁদের নাম ছিল যথাক্রমেঃ হারিস, জুবাইর, আবূ তালেব, আব্দুল্লাহ, হামজাহ, আবূ লাহাব, গায়দাক্ব, মুক্বাবভিম, যেরার, এবং ‘আব্বাস। কেউ কেউ বলেছেন যে তাঁর ছিল ১১টি সন্তান, একজনের নাম ছিল কুসাম। অন্য কেউ বলেছেন যে, ১৩টি সন্তান ছিল। অন্য দু’জনের নাম হল, ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘হাযল’। কিন্তু দশ জনের কথা যাঁরা বলেছেন তাঁরা বলেন যে, ‘মুক্বাবভিমেরই’ অপর নাম ছিল ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘গায়দাক্বেরর’ অপর নাম ছিল ‘হাযল’। তাঁদের মতে কুসাম নামে আব্দুল মুত্তালিবের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা ছিল ৬ জন। তাঁদের নামগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ উম্মুল হাকীম (তাঁর অপর নাম বায়যা), বাররাহ, আতিকাহ, সাফিয়্যাহ, আরওয়া এবং উমাইয়া।[2]

[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৫৬ পৃঃ।
[2] তালকীহুল ফহুম ৮-৯ পৃঃ এবং রহমাতুল্লি­ল আলামীন ২য় খন্ড ৫৬-৬৬ পৃঃ।

আব্দুল্লাহ (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা)

তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মানিত পিতা। তার (আব্দুল্লাহর) মাতার নাম ছিল ফাত্বিমাহ। তিনি ছিলেন ‘আমর বিন আয়েয বিন ইমরান মাখযুম বিন ইয়াকযাহ বিন মুররাহর কন্যা। আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানগণের মধ্যে আব্দুল্লাহ ছিলেন সব চাইতে সুন্দর এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি ছিলেন পিতার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তাঁর লকব বা উপাধি ছিল যবীহ। যে কারণে তাঁকে যবীহ বলা হতো তা হচ্ছে আব্দুল মুত্তালিবের প্রার্থিত পুত্র সংখ্যা যখন ১০ জন হল এবং তাঁরা সকলেই আত্মরক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করলেন তখন আব্দুল মুত্তালিব তাঁদের নিজ মানত সম্পর্কে অবহিত করেন (তাঁদের পক্ষ থেকে এক জনকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার ব্যাপারে) তাঁরা সকলেই এ প্রস্তাবে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।

আব্দুল মুত্তালিবের কুরবানী মানত এবং বারবার আব্দুল্লাহর নাম

কথিত আছে, আব্দুল মুত্তালিব ছেলেদের মধ্যে কাকে কুরবানী করা যায় এ ব্যাপারে লটারি করলেন। লটারিতে আব্দুল্লাহর নাম উঠল অথচ তিনি ছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ মুত্তালিব বললেন, হে আল্লাহ! সে-ই নাকি একশত উট? অতঃপর আবার আবদুল্লাহ ও একশতক উটের মধ্যে লটারী করলে একশত উটের নাম উঠে। আবার এও কথিত আছে যে, আব্দুল মুত্তালিব ভাগ্য-নির্ণায়ক তীরের উপর তাঁদের সকলের নাম লিখেন এবং হুবাল মূর্তির সেবায়েত বা তদারককারীগণের পন্থায় চক্রাকারে ঘোরানো ফেরানোর পর নির্বাচনগুটিকা বা লটারীর গুটি বের করেন। লটারীতে আব্দুল্লাহর নাম উঠে যায়। আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে যান ক্বাবা’হ গৃহের নিকট। তাঁর হাতে ছিল যবেহ কাজে ব্যবহারোপযোগী একটি ধারালো অস্ত্র। কিন্তু কুরাইশগণের মধ্যে বনু মাখযুম অর্থাৎ আব্দুল্লাহর নানা গোষ্ঠীর লোকজন এবং আব্দুল্লাহর ভাই আবূ ত্বালিব এ ব্যাপারে তাঁকে বাধা প্রদান করেন। তাঁর মানত পূরণে বাধাপ্রাপ্ত আব্দুল মুত্তালিব বললেন তাহলে মানতের ব্যাপারে তাঁর করণীয় কাজ কী হতে পারে? এতদ্বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারিনী বা তত্ত্ব বিশারদ কোন মহিলার নিকট থেকে এ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণের জন্য তাঁরা তাঁকে উপদেশ প্রদান করেন। আব্দুল মুত্তালিব জনৈক তত্ত্ববিশারদের নিকট গিয়ে এ ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ চাইলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আব্দুল্লাহ এবং ১০ টি উটের মধ্যে লটারী বা নির্বাচনগুটিকা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। নির্বাচনী গুটিকায় যদি আব্দুল্লাহর নাম উঠে যায় তাহলে ১০টি উটের সঙ্গে আরও ১০টি উট যোগ করে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করতে হবে যে পর্যন্ত না আব্দুল্লাহর নামের স্থানে ‘উট’ কথাটি প্রকাশিত হয় সে পর্যন্ত একই ধারায় নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে হবে যতক্ষণ না আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে যান। তারপর উটের যে সংখ্যা নির্ধারক নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করা হবে সেই সংখ্যক উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করতে হবে।

সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আব্দুল মুত্তালিব, আব্দুল্লাহ ও ১০টি উটের মধ্যে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতে আব্দুল্লাহর নামই প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববিশারদের নির্দেশ মুতাবেক দ্বিতীয় দফায় উটের সংখ্যা আরও বেশী বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতেও আব্দুল্লাহর নামই উঠে যায়। কাজেই পরবর্তী প্রত্যেক দফায় ১০টি উটের সং্যখা বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে থাকেন। এ ধারায় চলতে চলতে যখন একশত উট এবং আব্দুল্লাহর নাম নির্বাচনী গুটিকায় ব্যবহার করা হয় তখন উট কথাটি প্রকাশিত হয়। এ প্রেক্ষিতে আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহর পরিবর্তে ১০০ টি উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গীকৃত পশুর গোশত্ কোন মানুষ কিংবা জীবজন্তুর খাওয়ার ব্যাপারে কোন বাধা-নিষেধ ছিল না। উল্লে­খিত ঘটনার পূর্বে আরব এবং কুরাইশগণের মধ্যে শোনিতপাতের খেসারত বা মূল্য ছিল ১০টি উট। কিন্তু এ ঘটনার পর এর বর্ধিত সংখ্যা নির্ধারিত হয় ১০০টি উট। ইসলামও এ সংখ্যাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রিয় নাবী (ﷺ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে, ‘আমি দু’ যবীহর সন্তান’, ‘একজন ইসমাঈল (আঃ) এবং অন্য জন হচ্ছেন আমার পিতা আব্দুল্লাহ।[1]

আব্দুল মুত্তালিব স্বীয় সন্তান আব্দুল্লাহর বিবাহের জন্য আমিনাহহকে মনোনীত করেন। তিনি ছিলেন ওয়াহাব বিন আবদে মানাফ বিন যুহরা বিন কিলাবের কন্যা। বংশ পরম্পরা এবং মর্যাদার দিক দিয়ে তাঁকে কুরাইশ গোত্রের মধ্যে উন্নত মানের মহিলা ধরা হতো। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত বনু যুহরা গোত্রের দলপতি। বিবাহের পর আমিনাহ মক্কায় স্বামী গৃহে আগমন করেন এবং স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন কিন্তু অল্প দিন পরেই আব্দুল মুত্তালিব ব্যবসা উপলক্ষ্যে খেজুর আনয়নের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহকে মদীনা প্রেরণ করেন। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

কোন কোন চরিতবিদ বলেন যে, ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহ শামদেশে গমন করেছিলেন। এক কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে মক্কা প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মদীনায় অবতরণ করেন। সেই অসুস্থতার মধ্যেই সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নাবেগা জা’দীর বাড়িতে তাঁর কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ২৫ বছর। অধিক সংখ্যক ইতিহাসবিদদের অভিমত হচ্ছে তিনি পিতার মৃত্যুসময় জন্ম গ্রহণ করেন নি। আর অল্প সংখ্যক ঐতিহাসিকের অভিমত হচ্ছে, পিতার মৃত্যুর দু’মাস পূর্বেই নাবী কারীম (ﷺ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।[2] যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ মক্কায় পৌঁছল তখন আমিনাহ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় একটি শোকগাথা আবৃত্তি করেছিলেন। শোক গাথাটি হচ্ছে-

عَفَـا جانبُ البطحـاءِ من ابن هـاشـم

** 

وجاور لَحْدًا خارجـًــا في الغَــمَاغِم

دَعَتْـــه المنــايا دعــوة فأجـابـهــا
    **
 وما تركتْ في الناس مثل ابن هاشم

عشيـة راحـوا يحمــــلــون سريـره
    **
   تَعَاوَرَهُ أصــحــابــه في التزاحـــم

فإن تـك غـالتـه الــمنـايا ورَيْبَهـا

** 

فقـد كـان مِعْطـاءً كـثير التراحم

অর্থঃ ‘বাতহার জমিন হাশিমের পুত্রকে হারালো, সে চিৎকার ও গোলমালের মাঝে সমাধিতে সুখস্বপ্নবৎ পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। মৃত্যু মানুষের মধ্যে ইবনে হাশিমের মত কোন ব্যক্তিকে ছাড়ে নাই। (কতই দুঃখ জনক ছিল) যখন সেই সন্ধায় লোকেরা তাঁকে মৃতের খাটে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যদিও মৃত্যু এবং মৃত্যুর ঘটনাবলী তাঁর অস্তিত্বকে শেষ করেছে। তবুও তাঁর উন্নততর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি ছিলেন বড়ই দয়াবান এবং কোমল অন্তঃকরণের অধিকারী।[3]

মৃত্যুকালে তিনি যে সব সহায়-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল যথাক্রমে ৫টি উট, এক পাল ছাগল এবং একটি হাবশী দাসী যার নাম ছিল বরকত ও উপনাম উম্মে আয়মান। এ উম্মে আয়মানই নাবী কারীমকে দুগ্ধ খাইয়েছিলেন।[4]

[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫১-১৫৫ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৮৯-৯০ পৃঃ। মোখতাসারে সীরাতে রাসূল শাইখ আব্দুল্লাহ নাজদী ১২, ২২, ২৩।

[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৫৬-১৫৮ পৃঃ ফিকহুস সীরাত মুহাম্মাদ গাযালী ৪৫ পৃঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ।

[3] তাবাকাতে ইবনে সা‘দ ১ম খন্ড ৬২ পৃঃ।

[4] শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাত ১২ পৃঃ তালকীহুল ফোহম ১৪ পৃঃ সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ৯৬ পৃঃ।



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url