ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা || পার্থিব জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা || মানুষের মূল পরিচয় || (দ্বিতীয় পর্ব)





পার্থিব জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা

মানুষ নিজের সম্পর্কে গোড়া থেকেই একটা প্রকাণ্ড রকমের ভুলধারণা পোষণ করে আসছে এবং আজ পর্যন্তও তার সে ভুল ধারণা বর্তমান রয়েছে। কক্ষনো তাকে বাড়াবাড়ির পথ অবলম্বন করে এবং নিজেকে সে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত সত্তা বলে মনে করে নেয়। তার মন-মস্তিস্কে স্পর্ধা, অহংকার ও বিদ্রোহের ভাবধারা পূর্ণ হয়ে যায়। কোন শক্তিকে তার শক্তির ওপরেতো দূরের কথা, নিজের সমকক্ষ ভাবতেও সে প্রস্তুত হয়না। বরং مَنۡ اَشَدُّ مِنَّا قُوَّۃً (আমার চেয়েও শক্তিশালী আর কে?) এবং اَنَا رَبُّکُمُ الۡاَعۡلٰی (সূরাঃ আন-নাযি'আত, আয়াত-২৪) অর্থাৎ (আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু) এর ধ্বনি সে উচ্চারন এবং নিজেকে সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন ভেবে জোর-জুলুমের দেবতা এবং অন্যায়-অবিচার ও ধ্বংস-বিপর্যয়ের সাক্ষাৎ মূর্তিরুপে দেখা দেয়। এবার কখনও সে কড়াকড়ির রোগে আক্রান্ত হয় এবং নিজেকে নিজে দুনিয়ার সবচেয়ে নীচসত্তা বলে ধারণা করে বসে। গাছ, পাথর, দরিয়া, পাহাড়, জানোয়ার, হওয়া, আগুন, মেঘ, বিজলী, চন্দ্র, সূর্য, তারকা, মোট কথা এমন প্রতিটি জিনিসের সামনেই সে মাথা নত করে দেয়, যার ভেতর কোন প্রকার শক্তি কিংবা উপকার-অপকার দেখতে পায়। এমনকি, তার নিজেরই মতো মানুষের মধ্যেও যদি সে কোন শক্তি দেখতে পায়, তাকেও সে দেবতা এবং মাবুদ বলে মানতে এতটুকুও দ্বিধা করেনা।

মানুষের মূল পরিচয়

ইসলাম এ দু’চরম ধারনাকে বাতিল করে দিয়ে মানুষের সামনে তার প্রকৃত পরিচয় পেশ করেছে। সে বলেঃ  
(৭)یَّخۡرُجُ مِنۡۢ بَیۡنِ الصُّلۡبِ وَ التَّرَآئِبِ (৬) فَلۡیَنۡظُرِ الۡاِنۡسَانُ مِمَّ خُلِقَ ؕ (৫)فَلۡیَنۡظُرِ الۡاِنۡسَانُ مِمَّ خُلِقَ ؕ

“আপন তত্ত্বের প্রতি মানুষের লক্ষ্য করা উচিত যে, সে কোন জিনিস থেকে পয়দা হয়েছে,? সে পয়দা হয়েছে সবেগে নির্গত এক পানি থেকে যা পিঠ ও বক্ষ অস্থির মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে”।– ( সুরা আততারিকঃ৫-৭ )

 “মানুষ কি লক্ষ্য করেনা যে, আমরা তাকে এক বিন্দু পানি থেকে সৃষ্টি করেছি? এখন সে খোলাখুলি দুশমনে পরিণত হয় এবং আমাদের জন্যে দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকে আর নিজের আসলকে ভুলে গেছে।”

(৯)  ثُمَّ سَوّٰىهُ وَ نَفَخَ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِهٖ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ (৮) ثُمَّ جَعَلَ نَسۡلَهٗ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ مَّآءٍ مَّهِیۡنٍ ۚ (৭)  الَّذِیۡۤ اَحۡسَنَ کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقَهٗ وَ بَدَاَ خَلۡقَ الۡاِنۡسَانِ مِنۡ طِیۡنٍ

“মানুষের সৃষ্টির সূচনা করেছেন মাটি থেকে; অতপর মাটির নির্যাস থেকে যা এক অপবিত্র পানি তার বংশধারা চালিয়েছেন। তৎপর তার গঠনকার্য ঠিক করেছেন এবং তার ভেতরে আপন রুহ ফুঁকে দিয়েছেন”। [সূরাআসসাজদাঃ৭-৯]

 فَاِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ثُمَّ مِنۡ عَلَقَۃٍ ثُمَّ مِنۡ مُّضۡغَۃٍ مُّخَلَّقَۃٍ وَّ غَیۡرِ مُخَلَّقَۃٍ لِّنُبَیِّنَ لَکُمۡ ؕ وَ نُقِرُّ فِی الۡاَرۡحَامِ مَا نَشَآءُ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ثُمَّ نُخۡرِجُکُمۡ طِفۡلًا ثُمَّ لِتَبۡلُغُوۡۤا اَشُدَّکُمۡ ۚ وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّتَوَفّٰی وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرَدُّ اِلٰۤی اَرۡذَلِ الۡعُمُرِ لِکَیۡلَا یَعۡلَمَ مِنۡۢ بَعۡدِ عِلۡمٍ شَیۡئًا ؕ وَ تَرَی الۡاَرۡضَ هَامِدَۃً فَاِذَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡهَا الۡمَآءَ اهۡتَزَّتۡ وَ رَبَتۡ وَ اَنۡۢبَتَتۡ مِنۡ کُلِّ زَوۡجٍۭ بَهِیۡجٍ 

 “আমরা তোমাদেরকে মাটি থেকে, তারপর পানি বিন্দু থেকে, অতপর জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে, তৎপর পূর্ণ বা অপূর্ণ মাংসপিন্ড থেকে পয়দা করেছি, যেন তোমাদেরকে আপন কুদরত দেখাতে পারি এবং আমরা যে শুক্র-বিন্দুকে ইচ্ছা করি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাতৃ গর্ভে রেখে দেই, অনন্তর তোমাদেরকে বাচ্চা বানিয়ে বের করি; অতপর তোমাদেরকে বাড়িয়ে যৌবন পর্যন্ত পৌছিয়ে দেই; তোমাদের ভেতর থেকে কেউ মৃত্যুবরণ করে, আর কেউ এমন নিকৃষ্টতম বয়স পর্যন্ত গিয়ে পৌছে যে, বোধ শক্তি লাভ করার পর আবার অবুঝ হয়ে যায়।” [সূরা আলহাজ্জঃ৫]

(৮)  فِیۡۤ اَیِّ صُوۡرَۃٍ مَّا شَآءَ رَکَّبَکَ (৭) الَّذِیۡ خَلَقَکَ فَسَوّٰىکَ فَعَدَلَکَ ۙ (৬)  یٰۤاَیُّهَا الۡاِنۡسَانُ مَا غَرَّکَ بِرَبِّکَ الۡکَرِیۡمِ

“হে মানুষ! তোমার সেই দয়ালু রব সম্পর্কে কি জিনিস তোমাকে প্রতারিত করেছে? যিনি তোমাকে পয়দা করেছেন তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-গুলো ঠিক করেছেন, তোমার শক্তি ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করেছেন এবং যে আকৃতিতে ইচ্ছা করেছেন তোমার উপাদানসমূহ সংযোজিত করেছেন। [সূরা ইনফিতারঃ৬-৮]

“এবং আল্লাহ্ই তোমাদেরকে তোমাদের মায়েদের পেট থেকে বের করেছন; যখন তোমরা বের হলে, তখন এমন অবস্থায় ছিলে যে, তোমরা কিছুই জানতেনা। তিনি তোমাদেরকে কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, অন্তঃকরণ দিয়েছেন, যেন তোমরা শোকর করো।’’

(৬০) نَحْنُ قَدَّرْنَا بَيْنَكُمُ ٱلْمَوْتَ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوقِينَ (৫৯) ءَأَنتُمْ تَخْلُقُونَهُۥٓ أَمْ نَحْنُ ٱلْخَٰلِقُونَ (৫৮) أَفَرَءَيْتُم مَّا تُمْنُونَ
(৬৩) أَفَرَءَيْتُم مَّا تَحْرُثُونَ (৬২) وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ ٱلنَّشْأَةَ ٱلْأُولَىٰ فَلَوْلَا تَذَكَّرُونَ (৬১) عَلَىٰٓ أَن نُّبَدِّلَ أَمْثَٰلَكُمْ وَنُنشِئَكُمْ فِى مَا لَا تَعْلَمُونَ
(৬৬) إِنَّا لَمُغْرَمُونَ (৬৫) لَوْ نَشَآءُ لَجَعَلْنَٰهُ حُطَٰمًا فَظَلْتُمْ تَفَكَّهُونَ (৬৪) ءَأَنتُمْ تَزْرَعُونَهُۥٓ أَمْ نَحْنُ ٱلزَّٰرِعُونَ
(৬৯) ءَأَنتُمْ أَنزَلْتُمُوهُ مِنَ ٱلْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ ٱلْمُنزِلُونَ (৬৮) أَفَرَءَيْتُمُ ٱلْمَآءَ ٱلَّذِى تَشْرَبُونَ (৬৭) بَلْ نَحْنُ مَحْرُومُونَ
(৭২) ءَأَنتُمْ أَنشَأْتُمْ شَجَرَتَهَآ أَمْ نَحْنُ ٱلْمُنشِـُٔونَ (৭১) أَفَرَءَيْتُمُ ٱلنَّارَ ٱلَّتِى تُورُونَ (৭০) لَوْ نَشَآءُ جَعَلْنَٰهُ أُجَاجًا فَلَوْلَا تَشْكُرُونَ
(৭৪) فَسَبِّحْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلْعَظِيمِ (৭৩) نَحْنُ جَعَلْنَٰهَا تَذْكِرَةً وَمَتَٰعًا لِّلْمُقْوِينَ

“তোমরাকি শুক্রবিন্দু সম্পর্কে চিন্তা করেছ যা তোমরা মেয়েদের গর্ভে নিক্ষেপ করে থাকো? তা থেকে (বাচ্চা) তোমরা পয়দা করো, না আমরাই করে দিয়েছি। এবং আমরা তোমাদের দৈহিক আকৃতি বদলে দিতে এবং অন্য এক চেহারায় তোমাদের তৈরি করতে-যা তোমরা জানো না-অপারগ। আর তোমরা নিজেদের প্রথম পয়দায়েশের কথাতো জানোই; তাহলে কেন তোমরা তা থেকে সবক হাসিল করোনা? অনন্তর তোমরা কি লক্ষ্য করেছো যে, তোমরা যে ফসলাদির চাষাবাদ করো, তাকি তোমরা উৎপাদন করো, না আমরা উৎপাদনকারী? আমরা যদি ইচ্ছা করি তো তাকে খড় কুটায় পরিণত করতে পারি এবং তোমরা শুধু কথা বানাতে থাকবে যে, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি বরং সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছি। অতঃপর তোমরা কি সেই পানির প্রতি লক্ষ্য করেছো, যা তোমরা পান করে থাকো? তা কি তোমরা মেঘ থেকে বর্ষণ করিয়েছো, না বর্ষণকারী আমরা? আমরা যদি ইচ্ছা করি তো তাকে তিক্ত বানিয়ে দিতে পারি। সুতরাং কেন শোকর আদায় করোনা? তৎপর সেই আগুনের প্রতি কি তোমরা লক্ষ্য করেছো, যা তোমরা প্রজ্জলিত করো? যে কাঠ দিয়ে জ্বালানো হয়, তা কি তোমরা পয়দা করেছো, না আমরা জন্মদানকারী? আমরা তাকে এক স্মারকবস্তু এবং পথিকদের জন্যে জীবনের পাথেয় স্বরূপ সৃষ্টি করেছি। সুতরাং হে মানুষ, তোমার মহিমান্বিত রবের পবিত্রতা ঘোষণা করো।” – ( সূরা আল ওয়াকিয়াঃ৫৮-৭৪ )

 (৬৭) وَ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فِی الۡبَحۡرِ ضَلَّ مَنۡ تَدۡعُوۡنَ اِلَّاۤ اِیَّاهُ ۚ فَلَمَّا نَجّٰىکُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اَعۡرَضۡتُمۡ ؕ وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ کَفُوۡرًا 
(৬৮) اَفَاَمِنۡتُمۡ اَنۡ یَّخۡسِفَ بِکُمۡ جَانِبَ الۡبَرِّ اَوۡ یُرۡسِلَ عَلَیۡکُمۡ حَاصِبًا ثُمَّ لَا تَجِدُوۡا لَکُمۡ وَکِیۡلًا 
(৬৯)  اَمۡ اَمِنۡتُمۡ اَنۡ یُّعِیۡدَکُمۡ فِیۡهِ تَارَۃً اُخۡرٰی فَیُرۡسِلَ عَلَیۡکُمۡ قَاصِفًا مِّنَ الرِّیۡحِ فَیُغۡرِقَکُمۡ بِمَا کَفَرۡتُمۡ ۙ ثُمَّ لَا تَجِدُوۡا لَکُمۡ عَلَیۡنَا بِهٖ تَبِیۡعًا 

“যখন সমুদ্রের ভেতর তোমাদের ওপর ঝড়ের বিপদ নেমে এলো তখন তোমরা নিজেদের সমস্ত বাতিল মাবুদকে ভুলে গেলে এবং তখন আল্লাহর কথাই শুধু মনে এলো। তারপর তিনি যখন তোমাদেরকে উদ্ধার করে স্থলভাগে পৌছিয়ে দিলেন, তখন তোমরা আবার বিদ্রোহের ভুমিকায় অবতরণ করলে; মানুষ বাস্তবিকই বড় অকৃতজ্ঞ। তোমরা কি এসম্পর্কে নিঃশঙ্ক হয়ে গেলে যে, আল্লাহ্ তোমাদেরকে মাটির মধ্যে প্রোথিত করতে পারেন কিংবা তোমাদের ওপর বায়ুর ঝড় এমনি প্রবাহিত করতে পারেন এবং তোমরা নিজেদের কোন সাহায্যকারী পাবেনা? তোমরা কি এব্যাপারে নিঃশঙ্ক হয়ে গেলে যে, আল্লাহ তোমাদেরকে পূণর্বার সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারেন এবং তোমাদের ওপর বায়ুর এমন প্রচণ্ড ঝটিকা প্রবাহিত করতে পারেন, যা তোমাদের নাফরমানীর ফলে তোমাদেরকে নিমজ্জিত করে দিতে পারে, অনন্তর তোমরা আমাদের পশ্চাদপবন করার কোনই সাহায্যকারী পাবেনা”-( সূরা বনি ইসরাঈলঃ৬৭-৬৯)

এ আয়াত সমূহে মানুষের গর্ব ও অহংকারকে একেবারে চূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এতে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে যে, তোমার প্রকৃত তত্বের প্রতি একটু লক্ষ্য করে দেখ। এক বিন্দু নাপাক ও তুচ্ছ পানি মাতৃগর্ভে গিয়ে বিভিন্ন রুপ নাপাকীর দ্বারা বর্ধিত হয়ে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। আল্লাহ ইচ্ছা করলে সেই মাংসপিণ্ডে প্রাণই না দিতে পারেন এবং তা এমন অসম্পূর্ণ অবস্থায়ই বেরিয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তাঁর আপন ক্ষমতা বলে সেই মাংস-পিণ্ডে প্রাণসঞ্চার করেন, তার ভেতর অনুভূতি ও চেতনার সৃষ্টি করেন এবং মানুষের পক্ষে দুনিয়ার জীবনে প্রয়োজনীয় শক্তি ও হাতিয়ার দ্বারা সজ্জিত করেন। এভাবে তুমি দুনিয়ায় আগমন করো। কিন্তু তোমার প্রাথমিক অবস্থা হচ্ছে এইযে, তুমি একটি অসহায় শিশুতে পরিণত হয়ে আসো, তোমার ভেতর নিজের কোন প্রয়োজনই পূরণ করার ক্ষমতা থাকেনা। আল্লাহই তাঁর নিজস্ব কুদরত বলে এমন ব্যবস্থা করে দেন যে, তোমার লালন-পালন হতে থাকে, তুমি বড়ো হতে থাকো; যৌবনে পদার্পণ করো; শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী হও; পুনরায় তোমার শক্তি-সামর্থ্যের অবনতি শুরু হয়, তুমি যৌবন থেকে বার্ধক্যে পদার্পণ করো; এমনকি একসময় তোমার ওপর শৈশবকালের মতোই অসহায় অবস্থা চেপে বসে। তোমার চেতনা শক্তি তোমায় ত্যাগ করে যায়; তোমার শক্তি-সামর্থ্য দুর্বল হয়ে যায়, তোমার জ্ঞান-বুদ্বি লুপ্ত হয়ে যায়; অবশেষে তোমার জীবন প্রদীপ চিরকালের মতো নিভে যায়। ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু ছেড়ে তোমাকে কবর গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। এই সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তুমি নিজেকে নিজে এক মুহূর্তের জন্যেও জিন্দা রাখতে সমর্থ নও। বরং তোমার চেয়ে উচ্চতর একশক্তি তোমাকে জীবিত রাখেন এবং যখন ইচ্ছা করেন তোমাকে দুনিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। পরন্তু যতদিন তুমি জিন্দা থাকো, প্রাকৃতিক বিধানকেই তোমার আকড়ে থাকতে হয়। এই হাওয়া, এইপানি, এইআলো, এইউত্তাপ, এইজমিরফসল, এই প্রাকৃতিক সাজ-সরঞ্জাম-যার ওপর তোমার জীবন নির্ভরশীল এর কোনটিই তোমার আওতাধীন নয়। না তুমি এগুলোকে পায়দা করো, আর না এরা তোমার হুকুমের অনুসারী। এই বস্তুগুলোই যখন তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তখন তুমি এদের মোকাবিলায় অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়ো। এক বায়ুর ঝঞ্ঝা তোমাদের জনপদ সমুহকে মিসমার করে দেয়। এক বন্যা-তুফান তোমাদেরকে ডুবিয়ে ফেলে। এক ভূমিকম্প তোমাদেরকে ধুলিস্মাৎ করে দেয়। তুমি যতোই অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হও, আপন জ্ঞান-বুদ্ধি (যা তোমার নিজের সৃষ্ট নয়) দ্বারা যতোই উপায় উদ্ভাবন করো, নিজের বিবেকের (যা তোমার অর্জিত নয়) দ্বারা যতোই সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করো না কেন, প্রাকৃতিক শক্তির সামনে এসবই অকেজো হয়ে যায়। অথচ এহেন শক্তি নিয়ে তুমি বড়াই করো, আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে ওঠো, কাউকে পরোয়া পর্যন্ত করো না, ফেরাউনী ও নমরুদীপনার পরাকাষ্ঠা দেখাও, নির্মম অত্যাচারী, সীমাহীন জালেম কিংবা চরম অহংকারী হও, আল্লাহর সামনে বিদ্রোহ প্রদর্শন করো, আল্লাহর বান্দাদের উপাস্য (মাবুদ) হয়ে বসো এবং আল্লাহর দুনিয়ায় অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করো।

বিশ্ব-প্রকৃতিতে মানুষের মর্যাদা

এতো গেলো অহংকার নিরসন করার ব্যাপার। অন্যদিকে ইসলাম মানুষকে বলে দিয়েছে যে, সে নিজেকে নিজে যতোটা তুচ্ছ মনে করে নিয়েছে, ততোটা তুচ্ছ সে নয়। সেবলেঃ 

 وَ لَقَدۡ کَرَّمۡنَا بَنِیۡۤ اٰدَمَ وَ حَمَلۡنٰهُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ رَزَقۡنٰهُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلۡنٰهُمۡ عَلٰی کَثِیۡرٍ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِیۡلًا

“আমরা বনী আদমকে ইজ্জত দান করেছি এবং স্থল ও জল পথে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি এবং বহু জিনিসের ওপর যা আমরা পয়দা করেছি তাকে এরূপ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” – ( সূরাবনীইসরাঈলঃ৭০ )

 اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰهَ سَخَّرَ لَکُمۡ مَّا فِی الۡاَرۡضِ

“(হেমানুষ!) তুমি কি লক্ষ্য করোনা যে, দুনিয়ায় যা কিছু রয়েছে, আল্লাহ তার সবই তোমাদের জন্যে অধীন করে দিয়েছেন?” –(সূরাআলহাজ্জঃ৬৫)

৫ وَ الۡاَنۡعَامَ خَلَقَهَا ۚ لَکُمۡ فِیۡهَا دِفۡءٌ وَّ مَنَافِعُ وَ مِنۡهَا تَاۡکُلُوۡنَ
৬ وَ لَکُمۡ فِیۡهَا جَمَالٌ حِیۡنَ تُرِیۡحُوۡنَ وَ حِیۡنَ تَسۡرَحُوۡنَ 
৭ وَ تَحۡمِلُ اَثۡقَالَکُمۡ اِلٰی بَلَدٍ لَّمۡ تَکُوۡنُوۡا بٰلِغِیۡهِ اِلَّا بِشِقِّ الۡاَنۡفُسِ ؕ اِنَّ رَبَّکُمۡ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ۙ
৮ وَّ الۡخَیۡلَ وَ الۡبِغَالَ وَ الۡحَمِیۡرَ لِتَرۡکَبُوۡهَا وَ زِیۡنَۃً ؕ وَ یَخۡلُقُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ
৯ وَ عَلَی اللّٰهِ قَصۡدُ السَّبِیۡلِ وَ مِنۡهَا جَآئِرٌ ؕ وَ لَوۡ شَآءَ لَهَدٰىکُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ 
১০ هُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً لَّکُمۡ مِّنۡهُ شَرَابٌ وَّ مِنۡهُ شَجَرٌ فِیۡهِ تُسِیۡمُوۡنَ 
১১ یُنۡۢبِتُ لَکُمۡ بِهِ الزَّرۡعَ وَ الزَّیۡتُوۡنَ وَ النَّخِیۡلَ وَ الۡاَعۡنَابَ وَ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ
১২ وَ سَخَّرَ لَکُمُ الَّیۡلَ وَ النَّهَارَ ۙ وَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ وَ النُّجُوۡمُ مُسَخَّرٰتٌۢ بِاَمۡرِهٖ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ
১৩ وَ مَا ذَرَاَ لَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ مُخۡتَلِفًا اَلۡوَانُهٗ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لِّقَوۡمٍ یَّذَّکَّرُوۡنَ 
১৪ وَ هُوَ الَّذِیۡ سَخَّرَ الۡبَحۡرَ لِتَاۡکُلُوۡا مِنۡهُ لَحۡمًا طَرِیًّا وَّ تَسۡتَخۡرِجُوۡا مِنۡهُ حِلۡیَۃً تَلۡبَسُوۡنَهَا ۚ وَ تَرَی الۡفُلۡکَ مَوَاخِرَ فِیۡهِ وَ لِتَبۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِهٖ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
১৫ وَ اَلۡقٰی فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِکُمۡ وَ اَنۡهٰرًا وَّ سُبُلًا لَّعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ 
১৬ وَ عَلٰمٰتٍ ؕ وَ بِالنَّجۡمِ هُمۡ یَهۡتَدُوۡنَ 
১৭ اَفَمَنۡ یَّخۡلُقُ کَمَنۡ لَّا یَخۡلُقُ ؕ اَفَلَا تَذَکَّرُوۡنَ
১৮ وَ اِنۡ تَعُدُّوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰهِ لَا تُحۡصُوۡهَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ 

“এবং জানোয়ার পয়দা করেছেন, যার ভেতর তোমাদের জন্যে শীত থেকে বাঁচার সামান এবং লাভজনক বস্তু নিহিত রয়েছে এবং তার ভেতর থেকে কোন কোনটি তোমরা আহার করে থাকো। ঐগুলোর ভেতর তোমাদের জন্যে নিহিত রয়েছে একপ্রকার সৌন্দর্য, যখন প্রত্যুষে তোমরা ঐগুলো নিয়ে যাও এবং সন্ধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে আসো তারা তোমাদের বোঝা বহন করে এমন স্থানে নিয়ে যায়, যেখানে তোমরা প্রাণান্তকর কষ্ট ছাড়া পৌছতে পারোনা তোমাদের রব বড় মেহেরবান ও দয়া প্রদর্শনকারী তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা তোমাদের সওয়ারির জন্য এবং জীবনের সৌন্দর্য সামগ্রী আল্লাহ আরো অনেক জিনিস পয়দা করে থাকেন যা তোমাদের জানা পর্যন্ত নেই তিনিই আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন তার কিছু তোমাদের পান করার জন্যে, আর কিছু গাছ-গাছড়ার প্রতিপালনের কাজে লাগে, যা দ্বারা তোমরা আপন জানোয়াররে আহার্য লাভ করে থাকো সি পানি থেকে আল্লাহ তোমাদের জন্যে ফস্ল, জয়তুন, খেজুর, আঙ্গুর এবং সকল ফল উৎপাদন করেন এ জিনিসগুলোতে তাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে যারা ভেবে-চিন্তে কাজ করে। তিনিই তোমাদের জন্যে রাত দিন এবং চন্দ্র-সূর্যকে অধীন করে দিয়েছেন। এবং নক্ষত্ররাজিও সেই আল্লাহর হুকুমের ফলে অধীন হয়ে রয়েছে। এর ভেতরে তাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে, যারা বিবেক-বুদ্বির সাহায্য কাজ করে। আরো বহু রঙ্গের জিনিস তিনি তোমাদের জন্যে দুনিয়ায় পয়দা করেছেন, তাতে শিক্ষাগ্রহণকারীদের জন্যে বড়ো নিদর্শন রয়েছে। এবং সেই আল্লাহই সমুদ্রকে অধীন করে দিয়েছন, যেনো তা থেকে তাজা গোশত (মাছ) বের করে খেতে পারো এবং সৌন্দর্যের উপকরণ ( মুক্তা ইত্যাদি ) বের করতে পারো, যা তোমরা পরিধান করো। আর তোমরা দেখে থাকো যে, নৌকা ও জাহাজসমূহ পানি ভেদ করে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে ভেসে চলে যায়। তাই সমুদ্রকে এ জন্যে অধীন করা হয়েছে যেনো আল্লাহর ফযল তালাশ করতে পারো (অর্থাৎ ব্যবসায় করতে পারো) সম্ভবত তোমরা শোকর আদায় করবে তিনিই দুনিয়ায় পাহাড় লাগিয়ে দিয়েছেন, যেনো পৃথিবী তোমাদের নিয়ে ঝুঁকে না পরে এবং দরিয়া ও রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন, যাতে তোমরা গন্তব্য পথের সন্ধান পেতে পারো; এরূপ আরো বহুবিধ আলামত বানিয়ে দিয়েছেন; এমনকি, তার তারকারাজি দ্বারা লোকেরা রাস্তা চিনে থাকেআর যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামত হিসেব করো, তাহলে তা বেশুমার দেখতে পাবে।” -( সূরা আন নাহলঃ ৫-১৮ )

উপরোক্ত আয়াতসমূহে মানুষকে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ায় যতো জিনিস রয়েছে, তার সবই তোমাদের খেদমত ও ফায়দার জন্যে অধীন করে দেয়া হয়েছে এবং আসমানের জিনিস সম্পর্কেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য এই গাছ-পালা, এই দরিয়া, এই সমুদ্র, এই পাহাড়, এই জীব-জন্তু, এই রাত-দিন, এই আলো-অন্ধকার, এই চন্দ্র-সূর্য, এই তারকারাজি মোটকথা যা কিছু তুমি দেখতে পাচ্ছো এর সবই তোমার খাদেম, তোমার ফায়দার জন্যে নিয়োজিত এবং তোমার জন্যে কার্যোপযোগী করে বানানো হয়েছে তুমি এগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছো; তোমাকে এদের চেয়ে বেশী ইজ্জত দান করা হয়েছে, তোমাকে এদের সেবার যোগ্য রুপে তৈরি করা হয়েছে তাহলে কেন তুমি তোমার ঐ খাদেমদের সামনে মাথা নত করো? কেন ওদেরকে তোমার প্রয়োজন পূরণকারী মনে করো? কেন ওদের সামনে যাঞ্চার হাত প্রসারিত করো? কেন ওদের কাছে সাহায্য কামনা করো? কেন ওদেরকে ভয় করো ও শঙ্কিত হও? কেন ওদের শ্রেস্টত্ব ও মহিমা কীর্তন করো? এভাবে তো তুমি নিজেই নিজেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করছো নিজের মর্যাদা নিজেই ক্ষুণ্ণ করছো; নিজেকেই নিজের খাদেমের খাদেম ও গোলামের গোলামে পরিণত করছো!





****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url