মা’আরেফুল কোরআন-১ || ওহীর তাৎপর্য || ওহীর প্রয়ােজনীয়তা || ওহী নাযিল হওয়ার পদ্ধতি ||
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى .
ওহীর তাৎপর্য
কোরআন করীম যেহেতু 'ওহী'র মাধ্যমে সরওয়ারে-কায়েনাত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, সেহেতু কোরআন চর্চার আগে ওহী সম্পর্কিত কিছু দরকারী কথা জেনে নেওয়া কর্তব্য।
ওহীর প্রয়ােজনীয়তা
প্রত্যেক মুসলমানই জানেন যে, আল্লাহ পাক পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে মানব জাতিকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন এবং তাদের উপর কতকগুলো বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করে সমগ্র সৃষ্টি জগতকেই মানুষের সেবায় নিয়ােজিত করে দিয়েছেন। তদনুসারে জীবনে প্রত্যেক মানুষের উপরই দু'টি মৌলিক কর্তব্য বর্তায়। প্রথমত, সৃষ্টি জগতের যেসব বস্তু সে ব্যবহার করবে, সেগুলাের ব্যবহার যেন যথার্থ হয় এবং দ্বিতীয়ত, আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি বস্তু ব্যবহার করার সময় তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আদেশ-নিষেধের প্রতি পরিপূর্ণ লক্ষ্য রাখতে হবে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যেন তার কোন কাজ বা আচরণ আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে না হয়।
উপরিউক্ত দুটি বিষয়ে পূর্ণ সাবধানতা অবলম্বন করার জন্যই ইলম বা প্রানের প্রয়োজন। কেননা, প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা বস্তুনিচয়ের কোনটির মধ্যে কি গুণ নিহিত রয়েছে, আর কোন্ প্রক্রিয়ার দ্বারাই বা সেগুলাের মাধ্যমে উপকার লাভ করা যায়, সে সম্পর্কিত সুস্থ জ্ঞান আয়ত্ত করা ছাড়া বস্তুজগত দ্বারা পরিপূর্ণ উপকার লাভ করা সম্ভব নয়।
অপরদিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ কোনটি, কোন্ কোন্ কাজ আল্লাহর পছন্দ এবং কোনগুলাে অপছন্দ সে ব্যাপারে পূর্ণ ওয়াকেফহাল না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্ তা'আলার সন্তুষ্টি মােতাবেক জীবন যাপন করা সম্ভব হবে না।
এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ করার অবলম্বন স্বরূপ মানুষকে তিনটি বিষয় দান করেছেন। প্রথমটি তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়, দ্বিতীয়টি বােধি বা জ্ঞান এবং তৃতীয়টি ওহী।
মানুষ অনেক কিছুই পঞ্চ-ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পারে। বােধির মাধ্যমেও সে অনেক জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু যে সমস্ত বিষয় ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিভাতা কিংবা বােধিরও আওতার বাইরে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সেসব জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ওহীর জ্ঞান দান করেছেন। ওহীর মাধ্যমেই মানুষ তার বােধগম্য জগতেরও বহু উ জগতের খবর প্রাপ্ত হয়েছে।
‘ইলম’ বা জ্ঞানের উপরিউক্ত তিনটি উৎস আবার পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যস্ত। প্রতিটিরই আবার একটা নিজস্ব পরিমণ্ডল রয়েছে। নিজস্ব পরিমগুলের সীমারেখার বাইরে এর কার্যকারিতা থাকে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জিত হয়, বুদ্ধি সেখানে কোন কাজ দেয় না। যেমন, একটা চুনকাম করা দেয়াল চোখে দেখে আপনি বলে দিতে পারেন যে, দেয়ালটির রং সাদা। কিন্তু চোখে না দেখে আপনি যতই বুদ্ধি খাটান না কেন, দেয়ালের রং সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা আপনার পক্ষে সহজ হবে না।
অনুরূপ বুদ্ধির মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করতে হয়, তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার মাধ্যমে সহজ হয় না। যেমন, কোন একটা জিনিস শুধু চোখে কিংবা হাতে স্পর্শ করেই আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি না যে, এটা প্রকৃতির সৃষ্টি, না কোন কারিগরের তৈরি। বলা বাহুল্য, বস্তুর গুণাগুণ বিচার করে এ ব্যাপারে কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য বুদ্ধির সাহায্য গ্রহণ অপরিহার্য।
মােটকথা, পঞ্চ ইন্দ্রিয় যে সীমারেখা পর্যন্ত কাজ করে, বুদ্ধির সেখানে প্রয়ােজন পড়ে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের সীমা যেখানে শেষ হয়ে যায়, সেখান থেকেই বুদ্ধির কার্যকারিতা শুরু হয়। বুদ্ধির কার্যকারিতাও কিন্তু সীমাহীন নয়। একটা পর্যায়ে এসে বুদ্ধির কার্যকারিতাও শেষ হয়ে যায়। তাই দেখা যায়, এমন অনেক তথ্য এবং মানব মনের এমন অনেক জিজ্ঞাসা রয়েছে, যেগুলাের জবাব দিতে গিয়ে বুদ্ধি এবং অনুভূতির সম্মিলিত শক্তিও ব্যর্থ হয়ে যায়।
আবার সেই দেয়ালটির প্রসঙ্গেই আসা যাক। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, দেয়ালটি কিভাবে ব্যবহার করলে আল্লাহ তা'আলা সস্তুষ্ট হবেন এবং কিভাবে ব্যবহার করলে অসন্তুষ্ট হবেন। 'তবে এ প্রশ্নের জবাব ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজা বা বুদ্ধির নিকট থেকে আশা করা যায় না। এ ধরনের বুদ্ধি-অভিজ্ঞতার অতীত বিষয়াদি সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দান করার জন্যই আল্লাহ তা'আলা আম্বিয়ায়ে কিরামকে ওহীর জ্ঞান দান করেছেন। এ জ্ঞান কিছুসংখ্যক মনােনীত বান্দার। মাধ্যমে মানব জাতিকে দান করা হয়েছে। ওহীর জ্ঞানপ্রাপ্ত সেসব মনােনীত বান্দাগণই নবী-রাসূল নামে অভিহিত হয়েছেন।
মােটকথা, ওহী মানব জাতির প্রতি প্রদত্ত জ্ঞানের সেই উচ্চতর উৎস, যে উৎসের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অপরিহার্য সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসায় উপনীত হতে পারে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জান-অভিজ্ঞতা কিংবা বুদ্ধির প্রখরতা সেখানে সম্পূর্ণ অপারগ।
এতদসঙ্গে এ সত্যটুকুও স্বীকার করতে হয় যে, শুধুমাত্র বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা মানুষকে অভ্রান্ত পথনির্দেশ করার ব্যাপারে যথেষ্ট নয়, প্রকৃত পথনির্দেশ বা হেদায়েতের অন্য ওহীর ইলম অপরিহার্য।
বুদ্ধির সীমা যেখানে শেষ, এরপর থেকেই যেহেতু ওহীর জ্ঞানের কার্যকারিতা শুরু হয়, সে জন্য ওহীর বিষয়বস্তু শুধু বুদ্ধির মাপকাঠিতে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যেমন, যে কোন একটি বন্ধুর বর্ণ নিরূপণ করার জন্য দৃষ্টিশক্তির ব্যবহার জরুরী, শুধু বুদ্ধির প্রয়ােগ কার্যকর নয়; তেমনি দীনী আকীদার অনেক বিষয়ই ওহীর জ্ঞানের দ্বারা বুঝতে হয়। এ ক্ষেত্রে বুন্ধির উপর নির্ভর করা বৈধও নয়, যথার্থও নয়।
যদি কোন লােক আল্লাহুর অস্তিত্বই স্বীকার না করে, তবে তার সামনে ওহীর প্রমাণ উদ্যাপন করা অর্থহীন। কিন্তু যারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করে, তার অপরিসীম ক্ষমতার প্রতি ঈমান রাখে, তাদের পক্ষে বুদ্ধির মাধ্যমেই ওহীর যথার্থতা ও প্রয়ােজনীয়তার কথা অনুধাবন করা অসম্ভব নয়।
যদি আমরা বিশ্বাস করি যে, এ মহাবিশ্ব এবং এতে যা কিছু আছে, সে সবই একজন মহাজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, তিনিই পরম নিপুণতার সাথে এ বিশ্ব-প্রকৃতির পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন, কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্যে তিনি মানুষকে এ দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করতে হয় যে, দয়াময় সেই সৃষ্টিকর্তা এ অন্ধকার দুনিয়াতে কোন একটা ইঙ্গিত-ইশারা এবং আমাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করার নিয়ম-কানুন না দিয়ে প্রেরণ করেন নি। কেননা, আমরা এ দুনিয়ায় কেন প্রেরিত হয়েছি, এখানে আমাদের দায়িত্ব কি, আমাদের এ জীবনের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যই বা কি, কিভাবেই বা আমরা জীবনের সেই উদ্দেশ্য সাধন করতে সক্ষম হবাে এ সম্পর্কিত পরিপূর্ণ জ্ঞান স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই আমাদেরকে দিয়েছেন, প্রতিটি প্রয়ােজনের মুহূর্তে পরম যত্নে তা পরিবেশন করেছেন।
যে কোন সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ সম্পর্কে কি এরূপ ভাবা যায় যে, তিনি তার কোন লােককে বিদেশে সফরে পাঠালেন, কিন্তু পাঠানাের সময় কিংবা তারপরেও লােক মারফত বা পত্রযােগে তার কি কর্তব্য, কোন কোন কাজ সমাধা করে তাকে ফিরতে হবে, সফরে কিভাবে সে জীবন-যাপন করবে, সে সম্পর্কিত কোন নির্দেশই দিলেন না। যদি একজন সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে এরূপ দায়িত্বহীন আচরণ আশা করা না যায়, তবে সেই মহাজ্ঞানী আল্লাহ সম্পর্কে এরূপ ধারণা কি করে হতে পারে যে, যিনি এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং কল্পনাতীত নৈপুণ্যের সাথে এ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, আকাশ-বাতাস প্রভৃতি সবকিছু একটা সুনির্ধারিত নিয়মের ভেতর পরিচালনা করছেন, তিনি তাঁর বান্দাদের এ দুনিয়ায় কিছু গুরুদায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন, কিন্তু তাদের জন্য কোন নির্দেশনা, জীবনপথে চলার মত সঠিক হেদায়েত বা পথনির্দেশ প্রেরণ করার সুব্যবস্থা করেন নি।
আল্লাহ তা'আলার মহাজ্ঞ অস্তিত্ব সম্পর্কে যাদের ঈমান রয়েছে, তারা অবশ্যই স্বীকার করতে বাধ্য যে, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে অন্ধকারে হারিয়ে ফেলার জন্য হেদায়েতবিহীন অবস্থায় ছেড়ে দেননি--বান্দাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান বাতলানাের উদ্দেশ্যে একটা নিয়মিত পন্থা দান করেছেন। বলা বাহুল্য, সেই নিয়মিত পস্থাটিই ওহীয়ে-ইলাহী নামে পরিচিত।
উপরিউক্ত আলােচনার মাধ্যমে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ওহী ধর্মবিশ্বাসের অন্তর্গত একটা বিষয়ই শুধু নয়, বুদ্ধিভাবেই একটা বাস্তব প্রয়োজনও বটে, যা অস্বীকার করা আল্লাহ্ তা'আলার প্রজ্ঞাবান অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার নামান্তর মাত্র।
হুযুর (সা)-এর প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার পদ্ধতি
ওহী এবং রিসালাতের এ পবিত্র ধারা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ (সা) পর্যন্ত এসে সমাপ্তি লাভ করেছে। তারপর আর কোন মানুষের প্রতি ওহী নাযিল হয়নি-হওয়ার প্রয়োজনও নেই।
রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি বিচ্ছিন্নভাবে ওহী নাযিল হতাে। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত এক হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেন, একবার হযরত হাবেস ইবনে হিশাম (রা) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিকট জিজ্ঞেস করলেনঃ হুযুর, আপনার নিকট ওহী কিতাবে আসে? হুযুর (সা) জবাব দিলেন, কোন কোন সময় আমি ঘন্টার আওয়াজের মত শুনি। ওহী নাযিলে এ অবস্থাটা আমার পক্ষে খুব কঠিন প্রতীয়মান হয়। এ অবস্থা শেষ হওয়ার পর ঘন্টার মত আওয়াজের মাধ্যমে আমাকে যা কিছু বলা হয়, সে সবই আমার কণ্ঠস্থ হয়ে যায়। কখনও কখনও আমার সামনে ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে হাযির হন। (বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২)
এ হাদীসে ওহীর আওয়াজকে রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক ঘন্টার আওয়াজের সাথে তুলনা দেওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শায়খ মুহিউশীন ইবনুল আরাবী বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কানে এক ধরনের নৈসর্গিক আওয়াজ অনুভূত হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কালাম প্রাপ্তিও ছিল ওহী নাযিল হওয়ার একটা পদ্ধতি। এ আওয়াজকে হুযুর (সা) ঘন্টার অবিরাম আওয়াজের মতো বলে বর্ণনা করেছেন।
বিরতিহীনভাবে ঘণ্টা যখন একটানা বাজতে থাকে, তখন এ আওয়াজ কোন দিক থেকে আসছে, তা নির্ণয় করা সাধারণত শ্রোতার পক্ষে সম্ভব হয় না। মনে হয়, চারদিক থেকেই বুঝি আওয়াজ ভেসে আসছে। গুহীর আওয়াজ কেমন অনুভূত হতাে, একমাত্র ভুক্তভােগী ছাড়া অন্য কারাে পক্ষেই তা পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের জন্য বােধগম্য করার উদ্দেশ্যেই সেই পবিত্র আওয়াজকে ঘণ্টাধ্বনির সাথে তুলনা করা হয়েছে। (ফয়যুল-বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯, ২০)।
আওয়াজ সহকারে ওহী নাযিল হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর তা অত্যন্ত কঠিন অনুভূত হতাে। উক্ত হাদীসের শেষ ভাগে হযরত আয়েশা (রা) বলেন, শীতের দিনেও আমি হুযুর (সা)-এর প্রতি ওহী নাযিল হতে দেখেছি। ওহী নাযিল হওয়া শেষ হওয়ার পর প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও হুমূর (সা)-এর ললাটদেশ সম্পূর্ণরূপে ঘর্মাক্ত হয়ে যেতাে। অন্য এক বর্ণনায় হযরত আয়েশা (রা) বলেন, ওহী নাযিল হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর শ্বাস-প্রশ্বাস ফুলে ফুলে উঠতাে, পবিত্র চেহারাও বিবর্ণ হয়ে শুকনাে খেজুর শাখার ন্যায় ধুসর মনে হতো। একদিকে ঠাণ্ডায় সামনের দাঁতে ঠোকাঠুকি শুরু হতো এবং অপরদিকে শরীর এমন ঘর্মাক্ত হতাে যে, মুক্তার মতাে স্বেদবিন্দু ঝরতে থাকতো। (আল-একান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬)
ওহীর এই পদ্ধতি অনেক সময় এমন গুরুভার হতো যে, হুযুর (সা) কোন জানােয়ারের উপর সওয়ার অবস্থায় থাকলে সে জানােয়ার ওহীর চাপ সহ্য করতে অপারগ হয়ে মাটিতে বসে পড়ছে।
একবার হুযুর (সা) সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা)-এর কোলে মাথা রেখে একটু আরাম করছিলেন। এ অবস্থায়ই ওহী নাযিল হতে শুরু করলাে। হযরত যায়েদ (রা) বলেন, তখন তাঁর উরুদেশে এমন চাপ অনুভূত হচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল, তাঁর উরুর হাড় বােধ হয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। (যাদুল মা'আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮, ১৯)।
এ পদ্ধতিতে নাযিল হওয়া ওহীর হালকা মৃদু আওয়াজ কোন কোন সময় অন্যদের কানে গিয়েও পৌঁছাতো। হযরত উমর (রা) বর্ণনা করেন, কোন কোন সময় ওহী নাযিল হওয়া অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পবিত্র মুখমণ্ডলের চারদিকে মধুমক্ষিকার গুঞ্জনের ন্যায় গুন গুন শব্দ শােনা যেতো। (মসনদে আহমদ, কিতাবুস সিরাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১২)
ওহী নাযিল হওয়ার দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিল, ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ) মানুষের বেশে আগমন করে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট পয়গাম পৌঁছে দিতেন। এ অবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আ)-কে সাধারণত প্রখ্যাত সাহাবী হযরত দাহিয়া কালৰী (রা)-এর আকুতিতে দেখা যেতাে। কোন কোন সময় তিনি অন্য লােকের আকৃতি ধারণ করেও আসতেন।
মানুষের বেশে হযরত জিবরাঈল (আ)-এর আগমন এবং ওহী পৌঁছে দেওয়ার এ পদ্ধতিটাই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট সর্বাপেক্ষা সহজ মনে হতাে বলে তিনি ইরশাদ করেছেন। (আলএকান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৬)।
তৃতীয় পদ্ধতিটি ছিল, হযরত জিবরাঈল (আ) অন্য কোন রূপ ধারণ না করে সরাসরি নিজের আসল রূপেই আবির্ভূত হতেন। জীবনে মাত্র তিনবার আল্লাহর রাসূল (সা) হযরত জিবরাঈলকে আসল রূপে প্রত্যক্ষ করেছেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। একবার হযরত জিবরাঈল (আ)-কে আসল রূপে দেখবার আকাক্ষা প্রকাশ করায় তিনি স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার মিরাজের রাতে ও তৃতীয়বার নবুয়তের প্রাথমিক যুগে মক্কা শরীফের ‘আজইয়াদ নামক স্থানে। প্রথম দু'বারের কথা সহীহ সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয়বারের দেখা সম্পর্কিত বর্ণনা সনদের দিক দিয়ে দুর্বল ও সন্দেহযুক্ত। (ফতহুল-বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮ ও ১৯)
চতুর্থ পদ্ধতি ছিল, কোন মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ। এ বিশেষ মর্যাদা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম জাগ্রত অবস্থায় মাত্র একবার মিরাজের রাতে লাভ করেছিলেন। অন্য একবার স্বপ্নযােগেও তিনি আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছিলেন। (আল একনি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৪)।
ওহীর পঞ্চম পদ্ধতি ছিল, হযরত জিবরাঈল (আ) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে দেখা না দিয়ে হুযুর (সা)-এর পবিত্র অন্তরের মধ্যে কোন কথা ফেলে দিতেন। পরিভাষায় এ পদ্ধতিকে 'নাফছ ফির-রূহ' বলা হয় । (এতকান, ১ম অপ্ত, পৃ. ৪৩)
*********************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।