মা’আরেফুল কোরআন-২ || কোরআন নাযিলের ইতিহাস || সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত || মক্কী ও মদনী আয়াতসমূহের বৈশিষ্ট্য ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

কোরআন নাযিলের ইতিহাস



কোরআন শরীফ আল্লাহর কালাম। তাই সৃষ্টির সূচনা থেকেই তা লওহে মাহফুজে সুরক্ষিত রয়েছে। খােদ কোরআনের ইরশাদ- بَلۡ هُوَ قُرۡاٰنٌ مَّجِیۡدٌ فِیۡ لَوۡحٍ مَّحۡفُوۡظٍ   "বরং তা (সেই) কোরআন (যা) লওহে মাহফুজে সুরক্ষিত রয়েছে।" অতঃপর দুই পর্যায়ে কোরআন নাযিল হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সম্পূর্ণ কোরআন একই সঙ্গে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে বাইতুল-ইযযতে নাযিল করা হয়। 'বাইতুল-ইযযত' যাকে বাইতুল মা'মুরও বলা হয়। এটি কা'বা শরীফের বরাবর দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে ফেরেশতাগণের ইবাদতগাহ। এখনে পবিত্র কোরআন এক সাথে লাইলাতুল কদরে নাযিল করা হয়েছিল। অতঃপর দ্বিতীয় পর্যায়ে রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি ধীরে ধীরে প্রয়োজনমত অল্প অল্প অংশ নাযিল হয়ে দীর্ঘ তেইশ বছরে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।

কোরআন নাযিলের এ দু'টি পর্যায়ের কথা খোদ কোরানের বর্ণনা থেকেই বােঝা যায়। এ ছাড়া নাসায়ী, বায়হাকী, হাকেম প্রমুখ মুহাদ্দিস হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এমন কতগুলাে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন, যার মর্মার্থ হচ্ছে যে, কোরআন মজীদ এক সাথে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে এবং পরে ধীরে ধীরে দীর্ঘ তেইশ বছরে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি নাযিল হয়েছে। (আল-এতকান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১)

কোরআন এক সাথে দুনিয়ার আসমানে নাযিল করার তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম আবু শামাহ (রা) বলেন, এতদ্বারা কোরআনের উচ্চতম মর্যাদা প্রকাশ করাই ছিল উদ্দেশ্য। তাছাড়া ফেরেশতাগণকেও এ তথ্য অবগত করানাে উদ্দেশ্য ছিল যে, এটিই আল্লাহর শেষ কিতাব, যা দুনিয়ায় মানুষের হেদায়াতের জন্য নাযিল করা হচ্ছে।

শায়খ যুরকানী (র) অন্য আর একটি তাৎপর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, এভাবে দুইবারে। নাযিল করে একথাও বােঝানাে উদ্দেশ্য ছিল যে, এই কিতাব সর্বপ্রকার সন্দেহ-সংশয়ের উর্ধ্বে। তদুপরি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র বক্ষদেশ ছাড়াও আরো দু'জায়গায় ইহা সুরক্ষিত রয়েছে একটি লওহে-মাহফুজে এবং অন্যটি বাইতুল মা'মুর-এ। (মানাহেলুল ইরফান ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৯)

এ ব্যাপারেও প্রায় সবাই একমত যে, রসূলে করীম (সা)-এর প্রতি কোরআনের পর্যায়ক্রমিক অবতারণ শুরু হওয়ার সময় তার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। সহীহ বর্ণনায় একথাও জানা যায় যে, এ অবতরণ শুরু হয়েছিল লাইলাতুল কদরে। রমযান মাসের সেই তারিখে, যে তারিখে হিজরতের পর বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সে রাতটি রমযানের কত তারিখে ছিল এ সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কারাে মতে সতেরই রমযান, কারাে মতে উনিশে রমযান এবং কারাে মতে সাতাইশে রমযানের রাত। (ইবনে জরীর)।


সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত

নির্ভরযােগ্য বর্ণনা মতে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলাে নাযিল হয়, সেগুলাে ছিল সূরায়ে আলাক-এর প্রাথমিক কয়েকটি আয়াত। | সহীহ বােখারীতে এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন- হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি ওহী নাযিলের সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। এরপর থেকেই তার মধ্যে নির্জনে ইবাদত করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এ সময় তিনি হেরা গুহায় রাতের পর রাত ইবাদতে কাটাতে থাকেন। এ অবস্থাতেই এক রাতে হেরা গুহায় তার নিকট আল্লাহর ফেরেশতা আসেন এবং তাকে বলেন اقر  ইকরা' (পড়ুন)। হুযুর (সা) জবাব দেন আমি পড়তে জানি না।

পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে হুযুর (সা) বলেন। আমার জবাব শুনে ফেরেশতা আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং এমনভাবে চাপ দেন যে, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এরপর ফেরেশতা আমাকে ছেড়ে দিয়ে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, 'পড়ুন”। আমি এবারও বলি, আমি পড়তে জানি না। তখন ফেরেশতা পুনরায় আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন চাপ দিলেন যে, আমি অত্যন্ত ক্লান্তি অনুভব করতে থাকি। এরপর ফেরেশতা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন'। এবারও আমি সেই একই জবাব দেই যে, আমি পড়তে জানি না। এ জবাব শুনে ফেরেশতা আবারও আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভীষণভাবে চাপ দিলেন যে, আমি চরম ক্লান্তি অনুভব করতে থাকি।

অতঃপর ফেরেশতা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলেন-

 ﴾اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ۚ﴿۱﴾ خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ ۚ﴿۲﴾  اِقۡرَاۡ وَ رَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ ۙ﴿۳

 “পড়ুন, আপনার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট বাঁধা রক্ত থেকে। পড়ুন এবং আপনার পালনকর্তা অত্যন্ত অনুগ্রহপরায়ণ।”

এটিই ছিল তাঁর প্রতি অবতীর্ণ সর্বপ্রথম কয়েকটি আয়াত। এরপর তিন বৎসরকাল ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ থাকে। এ সময়টুকুকে ‘ফাতরাতুল ওহীর কাল বলা হয়।

তিন বছর পর হেরা গুহায় আগমনকারী সেই ফেরেশতাকেই তিনি আসমান ও জমিনের মধ্যস্থলে দেখতে পেলেন। ফেরেশতা তাকে সূরা মুদ্দাসির-এর কয়েকটি আয়াত শােনালেন। এরপর থেকেই নিয়মিত ওহী নাযিলের ধারাবাহিকতা শুরু হলাে।


মক্কী ও মদনী আয়াত

আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে, কোরআন শরীফের সূরাগুলাের উপরে কোন কোনটিতে 'মক্কী এবং কোন কোনটিতে 'মদনী” লেখা রয়েছে। এব্যাপারে নির্ভুল ধারণা লাভ করা জরুরী।

মুফাসসিরগণের পরিভাষায় মক্কী সূরা বা আয়াতের মর্ম হচ্ছে যেসব সূরা বা আয়াত রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পূর্ব পর্যন্ত নাযিল হয়েছে, এবং মদনী আয়াত হলাে যেগুলাে মদীনায় হিজরত করার পর নাযিল হয়েছে।

কোন কোন লােক মক্কী আয়াত বলতে যেগুলাে মক্কা শহরে এবং মদনী বলতে যেগুলাে মদীনায় নাযিল হয়েছে সেগুলােকে বুঝে থাকেন। এ ধারণা ঠিক নয়। এমনও অনেক আয়াত আছে, যেগুলাে মক্কা শহরে নাযিল হয়নি, কিন্তু যেহেতু হিজরতের আগে নাযিল হয়েছে এজন্য এগুলােকে মক্কী বলা হয়। তেমনি যেসব আয়াত মদীনা, আরাফাত কিংবা মিরাজের সফরে নাযিল হয়েছে, এমন কি হিজরতের সময় মদীনায় পেীছার পূর্ব পর্যন্ত পথে পথে যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে, সেগুলোকেও মক্কী বলা হয়।

তেমনি অনেক আয়াত আছে, যেগুলাে মদীনা শহরে নাযিল হয়নি, কিন্তু সেগুলাে মদনী। হিজরতের পর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে অনেকগুলাে সফরে বের হতে হয়েছে। অনেক সময় মদীনা থেকে শত শত মাইল দূরে গিয়েছেন, কিন্তু এসব স্থানে অবতীর্ণ আয়াতগুলােকেও মদনীই বলা হয়। এমনকি যে সমস্ত আয়াত মক্কা বিজয়, হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রভৃতি সময়ে খােদ মক্কা শহর কিংবা তার আশেপাশে নাযিল হয়েছে, সেগুলােকেও মদনী বলা হয়।

কোরআন শরীফের আয়াতঃ

ان الله يأمركم أن تؤدوا الأت اللى أهلها .

খাস মক্কা শহরেই নাযিল হয়েছে, কিন্তু হিজরতের পরে নাযিল হওয়ার কারণে এই আয়াতও মদনী। (আল-বুরহান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৮; মানাহেলুল-ইরফান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৮)।

কোন কোন সূরার সম্পূর্ণটাই মক্কী, যেমন- সূরা মুদ্দাসসির অপরদিকে কোন কোন সূরার সম্পূর্ণটাই মদনী, যেমন সূরা আলে-ইমরান। কিন্তু এমনও রয়েছে যে,সম্পূর্ণ সূরা হয়ত মক্কী, কিন্তু তার মধ্যে দু'-একটি মদনী আয়াত সন্নিবেশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে সম্পূর্ণ মদনী সুরার মধ্যে দু'একটা মক্কী আয়াত সন্নিবিষ্ট হয়েছে, যেমন- সুরা আ'রাফ মক্কী কিন্তু সূরার واستلهم عن القرية التي كانت حاضرة البحر. থেকে শুরু করে وَ اِذۡ اَخَذَ رَبُّکَ مِنۡۢ بَنِیۡۤ اٰدَمَ পর্যন্ত কয়েকটি আয়াত মদনী। অনুরূপ সূরায়ে হজ্জ মদনী। কিন্তু এ সূরার মধ্যেই وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ وَّ لَا نَبِیٍّ اِلَّاۤ اِذَا تَمَنّٰۤی  থেকে শুরু করে عَذَابُ یَوۡمٍ عَقِیۡمٍ  পর্যন্ত চারটি আয়াত মক্কী অর্থাৎ হিজরত-পূর্ববর্তী সময়ে অবতীর্ণ।

উপরিউক্ত আলােচনায় এও জানা গেল যে, কোন সূরাকে মক্কী ৰা মদনী গণ্য করার ব্যাপারে অধিকাংশ আয়াতের অনুপাত গণ্য করা হয় অর্থাৎ মক্কী আয়াতের সংখ্যা বেশি হলে সে সূরাকে মক্কী ও মদনী আয়াতের সংখ্যা বেশি হলে সে সূরাকে মদনী গণ্য করা হয়েছে।

যেসব সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলাে হিজরতের আগে নাযিল হয়েছে, সেগুলাের অবশিষ্ট আয়াত হিজরত-পরবর্তী সময়ে নাযিল হওয়া সত্ত্বেও সেগুলােকে মক্কী সূরা বলেই অভিহিত করা হয়েছে। (মানাহেলুল ইরফান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯২)। 


মক্কী ও মদনী আয়াতসমূহের বৈশিষ্ট্য


ইলমে-তফসীরের বিশেষজ্ঞগণ মক্কী ও মদনী সূরাগুলাে বাছাই করে এমন কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন, যে বৈশিষ্ট্যের আলােকে সেগুলাের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে প্রথম দৃষ্টিতেই বােঝা যায়, সূরাটি মক্কী না মদনী। তাদের নির্দেশিত বৈশিষ্ট্যগুলাের কয়েকটি এমন যে, সেগুলােকে স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতির পর্যায়ে ফেলা যায়। কতগুলাে বৈশিষ্ট্য আবার এরূপ যে, এগুলাে দ্বারা অনুমান করা যেতে পারে, এ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সূরাগুলাে মক্কী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, না মদনী হওয়ার।

মূলনীতিগুলাে নিম্নরূপ :
(১) যেসব সুরায় كَلَّا শব্দ অর্থাৎ কখনই নয় ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলাে মক্কী। এ শব্দটি বিভিন্ন সুরায় তেত্রিশবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং সবগুলাে সূরা কোরআনুল করীমের শেষার্থে রয়েছে।

(২) যেসব সুরায় (হানাফী মাযহাব মতে) সিজদার আয়াত এসেছে, সেগুলাে মক্কী।

(৩) সূরা বাকারাহ্ ব্যতীত যেসব সূরায় আদম (আ) ও ইবলীসের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সেগুলাে মক্কী। | 
(৪) যে সব সরায় জিহাদের নির্দেশ অথবা নিয়ম-কানুন বর্ণিত হয়েছে, সেগুলাে মদনী। 

(৫) যেসব আয়াতে মুনাফিকদের প্রসঙ্গ বিবৃত হয়েছে সেগুলাে মদনী।

নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলাে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। কিন্তু স্থান বিশেষে বিপরীতও হয়ে থাকে। 

(১) মক্কী সূরাগুলাের মধ্যে সাধারণত یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ  অর্থাৎ “হে মানব সন্তানগণ' বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অপরপক্ষে মদনী সূরায়  یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤ অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ' বলে সম্বােধন করা হয়েছে।

(২) মক্কী আয়াত সাধারণত ছােট ও সংক্ষিপ্ত। অপর পক্ষে মদনী সূরা ও আয়াত সাধারণত দীর্ঘ ও বিশ্লেষণাত্মক।

(৩) মক্কী সূলােতে সাধারণত তওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত প্রমাণ করা, হাশর ও শেষ বিচারের চিত্র বর্ণনা, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা প্রদান এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। এগুলােতে আহকাম ও আইন-কানুন অপেক্ষাকৃত কম বিবৃত হয়েছে। অপরপক্ষে মদনী আয়াতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক নিয়মনীতি, আইন-কানুন, জেহাদের নির্দেশ এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।

(৪) মক্কী সূরাগুলাের মধ্যে প্রতিপক্ষ হিসাবে সাধারণত মুশরিক ও মূর্তিপূজকদের দেখানাে হয়েছে। অপরপক্ষে মদনী সূরাগুলাের মধ্যে আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের প্রসঙ্গ আলােচিত হয়েছে।

(৫) মক্কী সূরাগুলাের বর্ণনারীতি সাধারণত অত্যন্ত অলঙ্কারবহুল এবং এগুলােতে উপমা-উৎপ্রেক্ষা অত্যন্ত বর্ণাঢ্য ভঙ্গীতে উপস্থাপন করা হয়েছে। অধিকন্তু এসব সূরায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ শব্দ সম্ভারের সমাবেশ ঘটানাে হয়েছে। অপরপক্ষে মদনী সূরাগুলাের বর্ণনাভঙ্গী অপেক্ষাকৃত সরল ও সহজবােধ্য।

মক্কা ও মদনী সূরার বর্ণনাভঙ্গী ও শব্দ ব্যবহারে ক্ষেত্রে এ পার্থক্য হয়েছে সাধারণত সমাজ-পরিবেশ, যাদের সম্বোধন করা হয়েছে তাদের রুচির তারতম্যের প্রতি লক্ষ্য করে। মক্কার জীবনে মুসলমানদের মােকাবিলা ছিল যেহেতু আরবের মূর্তিপূজক মুশরিকদের সাথে এবং যেহেতু তখনও পর্যন্ত ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি সেজন্য তখনকার দিনে অবতীর্ণ আয়াতগুলােতে সাধারণত প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের সংস্কার, চরিত্র সংশােধন, মূর্তিপূজার অসারতা প্রমাণ এবং কোরআন করীমের অনন্য বর্ণনাভঙ্গীর মােকাবিলায় ভাষাজ্ঞানের গর্বে গর্বিত আরব সমাজকে নির্বাক করে দেওয়াই ছিল প্রধান লক্ষ্য। সেজনাই অত্যন্ত আবেগময় বর্ণনাভঙ্গীর অবতারণা করা হয়েছিল। অপরদিকে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর লােক দলে দলে এসে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করছিল। শিৱক ও মূর্তিপূজার অসারতা অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্যভাবেই সপ্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। সর্বোপরি আদর্শের ক্ষেত্রে সকল মােকাবিলা ছিল আহলে-কিতাব সম্প্রদায়ের সাথে, সে জন্য এই সময়কার আয়াতগুলােতে আইন-কানুন, নিয়মনীতি ও আহলে-কিতাবদের ভ্রান্ত ধারণাসমূহের যুক্তিপূর্ণ জবাব দানের প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্ণনাঙ্গীর ক্ষেত্রেও যুক্তিপূর্ণ সরল পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে।

কোরআন পর্যায়ক্রমে নাযিল হলাে কেন

আগেই বর্ণিত হয়েছে যে, কোরআনুল করীম একবারে একই সঙ্গে নাযিল না হয়ে ধীরে ধীরে তেইশ বছরে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। কোন কোন সময় হযরত জিবরাঈল (আ) খুব ছােট একখানা আয়াত, এমনকি কোন আয়াতের ছোট একটা অংশ নিয়েও এসেছেন। কোন কোন সময় আবার কয়েকটি আয়াতও এক সাথে নাযিল করা হয়েছে।

কোরআনের সর্বাপেক্ষা ছােট যে আয়াতাংশ নিয়ে হযরত জিবরাঈল (আ)-এর আগমন হয়েছে, তা ছিল সুরা নিসার একটি দীর্ঘ আয়াতের ছােট এক অংশ غَیۡرُ اُولِی الضَّرَرِ অথচ অপরদিকে সমগ্র সূরা আন্‌'আম একই সঙ্গে নাযিল করা হয়েছে।

কোরআন শরীফকে একবারে নাযিল না করে অল্প অল্প করে কেন নাযিল করা হলাে, এ প্রশ্ন আরবের মুশরিকরাও হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সামনে উত্থাপন করেছিল। এ প্রশ্নের জবাব আল্লাহ পাক নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে প্রদান করেছেন-

وقال الذين كفروا لولا نزل عليه القران جملة واحدة كذلك لنثبت به فؤادك ورتلناه ترتيلا . ولا ياتوك بمثل الأ جئناك بالحق وآحسن

অর্থাৎ “এবং কাফেররা বলে, কোরআন তার প্রতি একবারে কেন নাযিল করা হলাে না। এভাবে (ধীরে ধীরে আমি পর্যায়ক্রমে নাযিল করেছি) যেন আপনার অন্তরে তা দৃঢ়মূল করে দেওয়া যায়। এবং আমি ধীরে ধীরে তা পাঠ করেছি। তা ছাড়া এরা এমন কোন প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না, যার (মােকাবেলায়) আমি যথার্থ সত্য এবং তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা পেশ করব না।”

উপরিউক্ত আয়াতের তফসীর বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম রাধী কোরআন শরীফ পর্যায়ক্রমে নাযিল হওয়ার যে তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন, সেটুকু বুঝে নেওয়াই এখানে যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। তিনি লিখেছেন।

(১) রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উম্মী ছিলেন, লেখাপড়ার চর্চা করতেন । এমতাবস্থায় কোরআন যদি একই সাথে একবারে নাযিল হতাে, তবে তা স্মরণ রাখা বা অন্য কোন পন্থায় সংরক্ষণ করা হয় তার পক্ষে কঠিন হতাে। অপর পক্ষে হযরত মুসা। আলাইহিস সালাম যেহেতু লেখাপড়া জানতেন, সেজন্য তার প্রতি তওরাত একই সঙ্গে নাযিল করা হয়েছিল। কারণ তিনি লিপিবদ্ধ আকারে তওবাহ সংরক্ষণে সমর্থ ছিলেন।

(২) সমগ্র কোরআন যদি একই সঙ্গে নাযিল হতাে, তবে সঙ্গে সঙ্গে কোরআনের প্রতিটি হুকুম-আহকামের প্রতি আমল করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাড়াতো। এতদ্বারা শরীয়তে-মুহাম্মদীতে ধীরে ধীরে অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিটি আহকাম অনুসারিগণের পা-সওয়া করে নেওয়া এবং হাতে-কলমে সেসব নির্দেশের উপর আমল করার যে পন্থা অবলম্বিত হয়েছে, তা ব্যাহত হতো।

(৩) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম প্রতিদিনই তার কওমের তরফ থেকে যে নতুন নতুন নির্যাতনের সখীন হতেন, এ অবস্থায় কোরআনের আয়াতসহ হযরত জিবরাঈল (আ)-এর ঘন ঘন আগমন তার মানসিক শক্তি অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে সহায়ক হতাে।

(৪) কোরআন শরীফের একটা উল্লেখযােগ্য অংশ বিরুদ্ধবাদীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জওয়াব এবং বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। এমতাবস্থায় সেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার পর এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তে সে সম্পর্কিত আয়াত নাযিল হওয়াই ছিল স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত। এতে একাধারে যেমন মু'মিনদের অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হওয়ার ব্যাপারে সহায়ক হয়েছে, তেমনি সমকালীন বিভিন্ন প্রেক্ষিতে অগ্রিম সংবাদ প্রদানের ফলে কোরআনের অদ্ৰান্ততার দাবি অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য হয়েছে। (তাফসীরে কবীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৩৬) 




*****************************************

সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url