ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা-৩ || মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি || প্রতিনিধি পদের গুরুত্ব || জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারনা ||







মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি

এ থেকে জানা গেল যে, মানুষ না এতোটা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যতোটা সে অহমিকা বশত নিজেকে নিজে মনে করে, আর না এতোটা তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট যতটা সে নিজেকে বানিয়ে নিয়েছে এখন প্রশ্ন ওঠে: তাহলে দুনিয়ায় মানুষের সঠিক মর্যাদা কি? এর জবাবে ইসলাম বলে:
৩০ وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡهَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡهَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ
৩১ وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ 
৩২ قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ
৩৩ قَالَ یٰۤاٰدَمُ اَنۡۢبِئۡهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَنۡۢبَاَهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۙ قَالَ اَلَمۡ اَقُلۡ لَّکُمۡ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ غَیۡبَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۙ وَ اَعۡلَمُ مَا تُبۡدُوۡنَ وَ مَا کُنۡتُمۡ تَکۡتُمُوۡنَ 
৩৪ وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ اَبٰی وَ اسۡتَکۡبَرَ ٭۫ وَ کَانَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ
৩৫ وَ قُلۡنَا یٰۤاٰدَمُ اسۡکُنۡ اَنۡتَ وَ زَوۡجُکَ الۡجَنَّۃَ وَ کُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَیۡثُ شِئۡتُمَا ۪ وَ لَا تَقۡرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَۃَ فَتَکُوۡنَا مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ
৩৬ فَاَزَلَّهُمَا الشَّیۡطٰنُ عَنۡهَا فَاَخۡرَجَهُمَا مِمَّا کَانَا فِیۡهِ ۪ وَ قُلۡنَا اهۡبِطُوۡا بَعۡضُکُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ ۚ وَ لَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ مُسۡتَقَرٌّ وَّ مَتَاعٌ اِلٰی حِیۡنٍ

 “ আর যখন তোমার পরোয়ারদিগার ফেরেশতাদেরকে বললেন যে, আমি দুনিয়ায় এক খলীফা ( প্রতিনিধি ) পাঠাতে চাই, তখন তারা আরজ করলো: তুমি কি দুনিয়ায় এমন প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাও যে সেখানে গিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং খুন-খারাবী করবে? অথচ আমরা তোমার মহত্ত্ব ঘোষণা করি এবং তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি আল্লাহ বললেন: আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না আর তিনি আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দিলেন অতপর তাকে ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেনঃ তোমরা যদি সত্যবাদী হও তো ঐ জিনিসগুলোর নাম বলে দাও তারা বললঃ পবিত্র তোমার সত্তা! তুমি যা কিছু আমাদেরকে শিখিয়েছো তা ছাড়া আর কিছুই জানি না তুমিই বিজ্ঞ এবং সর্বজ্ঞ আল্লাহ বললেনঃ হে আদম, তুমি ফেরেশতাদেরকে ঐ জিনিসগুলোর নাম বলে দাও সুতরাং আদম যখন তাদেরকে ঐ বস্তুগুলোর নাম বলে দিলেন, তখন আল্লাহ বললেন: আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আসমান ও জমিনের সমস্ত গোপন কথাই আমি জানি এবং যা কিছু তোমরা প্রকাশ করো আর লুকিয়ে রাখো তার সবকিছুরই আমি খবর রাখি আর যখন আমি ফেরেশতাদেরকে আদেশ করলাম, আদমকে সেজদা করো, তখন তারা সবাই সেজদা করল একমাত্র ইবলিস ছাড়া, সে অস্বীকার করলো, অহংকার প্রকাশ করলো এবং নাফরমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। আর আমরা আদমকে বললামঃ হে আদম, তুমি এবং তোমার স্ত্রী উভয়ে জান্নাতে থাকো এবং এখানে যা পাও তৃপ্তি সহকারে খাও কিন্তু ঐ গাছটির কাছেও যেও না, তাহলে তুমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু শয়তান তাদেরকে জান্নাত থেকে পদস্থলিত করলো এবং যে সুখ-সম্পদের মধ্যে ছিল,তা থেকে বের করে দিলো”। (সূরা আল বাকারাঃ ৩০-৩৬)

২৮ وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ
২৯ فَاِذَا سَوَّیۡتُهٗ وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ فَقَعُوۡا لَهٗ سٰجِدِیۡنَ 
৩০ فَسَجَدَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ کُلُّهُمۡ اَجۡمَعُوۡنَ 
৩১ اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ اَبٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنَ مَعَ السّٰجِدِیۡنَ 
৩২ قَالَ یٰۤـاِبۡلِیۡسُ مَا لَکَ اَلَّا تَکُوۡنَ مَعَ السّٰجِدِیۡنَ 
৩৩ قَالَ لَمۡ اَکُنۡ لِّاَسۡجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقۡتَهٗ مِنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ
৩৪ قَالَ فَاخۡرُجۡ مِنۡهَا فَاِنَّکَ رَجِیۡمٌ 
৩৫ وَّ اِنَّ عَلَیۡکَ اللَّعۡنَۃَ اِلٰی یَوۡمِ الدِّیۡنِ

“আর যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি বিবর্ণ শুষ্ক কর্দম থেকে এক মানুষ বানাতে চাই, অতপর আমি যখন তার সুষ্ঠ অবয়ব দান করবো এবং তার ভেতর আপন রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা তার জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়। বস্তুত তামাম ফেরেশতাই সেজদা করলো, শুধু ইবলিশ ছাড়া; সে সেজদাকারিদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানালো। আল্লাহ বললেনঃ হে ইবলিশ! তোর কি হল যে, তুই সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করলি? ইবলিশ বললঃ আমি এমন নই যে, সে মানুষকে সেজদা করবো,যাকে তুমি কালো বিবর্ণ শুষ্ক কর্দম থেকে সৃষ্টি করেছ। আল্লাহ বললেনঃ তুই এখান থেকে বেরিয়ে যা, তুই বিতাড়িত। প্রতিফল দিবস পর্যন্ত তোর উপর অভিসম্পাত”। (সূরা আল হিজরঃ ২৮-৩৫)

এ বিষয়টিকে কোরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত সার হল এইঃ আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ায় তাঁর প্রতিনিধি (নায়েব) হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, তাকে ফেরেশতাদের চেয়ে বেশি জ্ঞান দিয়েছেন, তার জ্ঞানকে ফেরেশতাদের তাসবীহ পাঠ ও পবিত্রতা বর্ণনার উপরে স্থান দিয়েছেন, ফেরেশতাদের তাঁর সেই প্রতিনিধিকে কে সেজদা করার আদেশ করেছেন, ফেরশতাগণ তাকে সেজদা করলো এবং এভাবে সমস্ত ফেরেশতা তাঁর সামনে নতমস্তক হোল; কিন্তু ইবলিশ এতে অস্বীকৃতি জানালো এবং এভাবে শয়তানী শক্তি তাঁর সামনে মাথা নত করলো না। অবশ্য তখনও সে ছিল মাটির তুচ্ছ এক পুতুল মাত্র; কিন্তু আল্লাহ তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়ে এবং জ্ঞান দান করে তাকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের যোগ্য করে দিলেন। ফেরেশতারা তার এই শ্রেষ্ঠত্ব কে স্বীকার করে নিল এবং তার সামনে নতমস্তক হোল। কিন্তু শয়তান তাকে স্বীকার করলো না। এই অপরাধে শয়তানের উপর লা’নত বর্ষিত হোল। কিন্তু সে মানুষকে কুমন্ত্রনা দেয়ার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত সুযোগ চেয়ে নিলো। তাই মানুষকে সে কুমন্ত্রনা দিলো, জান্নাত থেকে বহিষ্কার করালো আর তখন থেকে মানুষ ও শয়তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হোল। আল্লাহ মানুষকে বললেনঃ আমি তোমাকে যে হেদায়েত পাঠাবো তা মেনে চললে তুমি জান্নাতে যেতে পারবে, আর তোমার আদি দুশমন শয়তানের হুকুম তামিল করলে তোমার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।

প্রতিনিধি পদের গুরুত্ব

এই আলোচনা থেকে নিম্নরূপ বিষয় গুলি জানা গেলঃ

এই দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা হচ্ছে এই যে, সে আল্লাহর খলীফা। খলীফা বলা হয় নায়েব অথবা প্রতিনিধিকে। প্রতিনিধির কাজ হলোঃ যার সে প্রতিনিধি, তাঁর ই আনুগত্য করে চলবে। সে আর না কারো আনুগত্য করতে পারে, আর না আপন মনিবের প্রজা এবং তার চাকর, খাদেম ও গোলামকে নিজেরই প্রজা,নিজেরই চাকর, খাদেম ও গোলামে পরিণত করতে পারে। বরং এরূপ করলে সে বিদ্রোহী বলে অভিযুক্ত হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই শাস্তি লাভ করবে। সে যেখানে প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়েছে,সে সেখানে আপন মনিবের মাল-মাত্তা ব্যবহার করতে পারে, তাঁর প্রজাদের উপর শাষন চালাতে পারে, তাদের কাছ থেকে খেদমত নিতে পারে, তাদের তত্ত্বাবধান করতে পারে; কিন্তু এ হিসেবে নয় যে, সে নিজেই মনিব অথবা এ হিসেবেও নয় যে, উক্ত মনিব ছাড়া সে অন্য কারো অধিনস্থ বরং এই হিসেবে যে, সে আপন মনিবের প্রতিনিধি এবং যত জিনিস তার কর্তৃত্বাধীন সেগুলোর উপর সে মনিবের তরফ থেকে নিযুক্ত আমানতদার। এ কারনে সে সাচ্চা, মনঃপুত এবং পুরষ্কার লাভের যোগ্য প্রতিনিধি ঠিক তখনই হতে পারে, যখন সে আপন মনিবের আমানতের খেয়ানত না করবে,তাঁর দেয়া হেদায়েত অনুসরন করে চলবে এবং তাঁর বিধান লংঘন না করবে- তাঁর ধন সম্পদ, তাঁর প্রজা, তাঁর চাকর, তাঁর খাদেম এবং তাঁর গোলামদের উপর শাসন চালাতে তাদের কাছ থেকে খেদমত নিতে, এবং তাদের সাথে ব্যবহার ও তাদের তত্ত্বাবধান করতে তাঁরই রচিত আইন কানুন মেনে চলবে। সে যদি এরূপ না করে তবে সে প্রতিনিধি নয় –বিদ্রোহী হবে,মনঃপুত নয়-মরদুদ হবে, পুরষ্কার লাভের যোগ্য নয়-শাস্তির উপযোগী হবে। আল্লাহ বলেনঃ

৩৮ قُلۡنَا اهۡبِطُوۡا مِنۡهَا جَمِیۡعًا ۚ فَاِمَّا یَاۡتِیَنَّکُمۡ مِّنِّیۡ هُدًی فَمَنۡ تَبِعَ هُدَایَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ
৩৯ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ

“যারা আমার দেয়া হেদায়েত অনুসরন করবে,তাদের জন্য কোনরূপ শাস্তির ভয় বা কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আর যারা নাফরমানী করবে এবং আমার বাণী ও নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চাইবে,তাদের জন্য রয়েছে দোযখের অগ্নি;সেখানে তারা চিরকাল থাকবে”।(সূরা আল বাকারাঃ ৩৮-৩৯)

প্রতিনিধি বা আমানতদার কখনো এরূপ স্বাধীন হয়না যে,সে নিজের মর্জী মোতাবেক যা খুশী তাই করতে পারে; আপন মনিবের ধন-দৌলত ও তাঁর প্রজাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে এবং এসব ব্যাপারে তাকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করার থাকবে না। বরং তাকে আপন মনিবের সামনে জবাবদিহি করতে হয়,প্রতিটি কড়া –ক্রান্তির হিসেব তাকে দিতে হয়,তার মনিব তার প্রতিটি কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, এবং তাঁর আমানত, তাঁর মাল-মাত্তা এবং তাঁর প্রজাদের সে যা কিছু করেছে তার জিম্মাদারি তার উপর ন্যস্ত করে তাকে শাস্তি কিংবা পুরস্কার দান করতে পারে।

প্রতিনিধির সর্বপ্রথম কর্তব্য হলঃ সে যার প্রতিনিধি তাঁর আজ্ঞানুবর্তিতা, তাঁর শাসন ও তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে মেনে নেয়া। সে যদি এরূপ করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে না সে নিজের প্রতিনিধি পদের গুরুত্ব কে বুঝতে পারবে, আর না তার আমানতদারির পদে অভিষিক্ত হওয়া সম্পর্কে তার মনে কোন সুষ্ঠু ধারনা জন্মাবে; না তার জিম্মাদারি ও জবাবদিহি সম্পর্কে কোন অনুভূতি জাগবে; আর না তার উপর ন্যস্ত আমানত সম্পর্কে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করার মতন যোগ্যতা লাভ করবে। প্রথমত এই আমানত ও প্রতিনিধিত্বের ধারনা নিয়ে মানুষ যে কর্মনীতি অবলম্বন করবে, এছাড়া অন্য কোন ধারনা নিয়েও ঠিক তাই অনুসরন করবে, এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর যদি ধরেও নেয়া যায় যে অসম্ভবটিই তার পক্ষে সম্ভব তবুও তার কোন দাম নেই। কারন মনিবের আজ্ঞানুবর্তিতা অস্বীকার করে পূর্বেই সে বিদ্রোহী হয়েছে। এখন যদি সে নিজের ইচ্ছে-প্রবৃত্তি কিংবা অন্য কারো আনুগত্য করতে গিয়ে সৎকাজ করেও তবে যার আনুগত্য করেছে, তার কছেই তার পুরস্কার চাওয়া উচিৎ। তার মনিবের কাছে সেই সৎকাজ সম্পুর্ন অর্থহীন।

মানুষ তার মুল সত্তার দিক দিয়ে তুচ্ছ সৃষ্টি মাত্র। কিন্তু সে যা কিছু ইজ্জত লাভ করেছে, তা শুধু তার ভেতরে ফুঁকে দেওয়া রূহ ও দুনিয়ায় তাকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব দান করার কারণেই। এখন শয়তানের আনুগত্য করে তার রূহ কে কলুষিত না করা এবং নিজেকে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করে বিদ্রোহের পর্যায়ে অবনমিত না করার ওপরই তার এই ইজ্জতের হেফাজত নির্ভরশীল। এ দ্বায়িত্বে অবহেলা করলে তাকে সেই তুচ্ছ সৃষ্টিই থেকে যেতে হবে।

মালাকূতি শক্তি (অদৃশ্য জগতের শক্তি) মানুষের আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবেই তাঁর সামনে মাথা নত করেছে, কিন্তু শয়তানি শক্তি তাঁর প্রতিনিধিত্বকে স্বীকার করে না, বরং তাকে নিজের অনুগত বানাতে চায়। মানুষ যদি এই দুনিয়ায় প্রতিনিধিত্বের কর্তব্য পালন করে এবং আল্লাহরই প্রদর্শিত পথে চলে তাহলে মালাকূতি শক্তি তার সহায়তা করবে। তার জন্য ফেরেশতাদের সেনাবাহিনী অবতরন করবে। মালাকূত জগত কখনো তার প্রতি বিমুখ হবে না। এই সকল শক্তির সাহায্যে সে শয়তান ও তার অনুচরদের পরাজিত করে ফেলবে। কিন্তু সে যদি প্রতিনিধিত্বের হক আদায় করতে কুণ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথে না চলে, তাহলে মালাকূতি শক্তি তার সংশ্রব ত্যাগ করবে; কেননা এর ফলে সে নিজেই নিজের প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হবে। আর যখন তার সহায়তা করার মতন আর কোন শক্তি বর্তমান থাকবেনা এবং সে নিছক মাটির একটি পুতুলে পরিনত হবে, তখন শয়তানি শক্তি তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। অতপর শয়তান এবং তার অনুচরগণই হবে তার একমাত্র সহায়ক ও সাহায্যকারী, তাদের বিধি –বিধানেরই করবে সে আনুগত্য এবং তাদের মতোই তার পরিণাম।

আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার কারনে মানুষের মর্যাদা হচ্ছে দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত। দুনিয়ার প্রতিটি জিনিসই তার অধীন, তার ব্যবহারের জন্য নিয়োজিত এবং আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় তা থেকে সে খেদমত গ্রহনের অধিকারী। এই সকল অধীনস্থ জিনিসের সামনে নত হওয়া তার পক্ষে নিতান্তই অপমানকর। এদের সামনে নত হলে সে নিজেই নিজের ওপর যুলুম করে এবং আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হবে। কিন্তু এমন এক সত্ত্বাও রয়েছে যার সামনে নত হওয়া, যার আনুগত্য করা তার অপরিহার্য কর্তব্য (ফরয) এবং যাকে সেজদা করার ভিতর নিহিত রয়েছে তার জন্য ইজ্জত-সন্মান। সেই সত্ত্বাটি কে?- আল্লাহ তার মনিব, যিনি তাঁর জন্য মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি মনোনীত করেছেন।

মানব জাতির কোন বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণী আল্লাহর প্রতিনিধি নয় বরং গোটা মানবজাতিই প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত আর প্রতিনিধি বা খলীফা হিসেবে প্রতিটি মানুষই অন্য মানুষের সমান। এ জন্যই না কোন মানুষের অপর কোন মানুষের সামনে নত হওয়া উচিত। আর না কেউ নিজের সামনে অন্য কোন মানুষকে অবনত করানোর অধিকারী। একজন মানুষ শুধু অন্য একজন মানুষের কাছে মনিবের হুকুম ও তাঁর হেদায়েতের আনুগত্য করারই দাবী জানাতে পারে। এ দিক দিয়ে অনুগত ব্যক্তি হবে ‘আমের’(আদেশকারী) আর অননুগত ব্যক্তি হবে ‘মামুর’(আদিষ্ট)। কেননা যে ব্যক্তি প্রতিনিধিত্বের হক আদায় করলো সে হক না আদায়কারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের মানে এই নয় যে সে নিজেই তার মনিব।

আমানত ও প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে লাভ করেছে। এই জন্য প্রতিটি ব্যক্তি নিজ নিজ স্থানে এই পদ মর্যাদার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। না একজনের উপর অন্যান্যদের কৃতকর্মের জবাবদিহি ন্যস্ত হবে, আর না একজন অন্যজনের কৃত কর্ম থেকে ফায়দা হাসিল করতে পারবে। অনুরুপভাবে না কেউ এই জিম্মাদারী থেকে কাউকে নিষ্কৃতি দিতে পারবে, আর না কারোর দুষ্কৃতির বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপানো হবে।

মানুষ যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ায় থাকে আর যতদিন বাকি থাকে মাটির পুতুল(মানব দেহ) এবং আল্লাহর ফুঁকে দেয়া রূহের সম্পর্ক ততদিনই সে থাকে প্রতিনিধি। এই সম্পর্ক ছিন্ন হবার সাথে সাথেই সে দুনিয়ার খেলাফতের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। তার এই প্রতিনিধিত্বকালের কীর্তিকলাপের যাচাই – পর্যালোচনা হওয়া উচিত, তার উপর ন্যস্ত আমানতের হিসেব – নিকেশ হওয়া উচিত, প্রতিনিধি হিসেবে তার উপর অর্পিত দ্বায়িত্ব সে কিভাবে পালন করেছে, তার তদন্ত হওয়া উচিত। সে যদি খেয়ানত, বিশ্বাস ভঙ্গ, অবাধ্যতা, বিদ্রোহ এবং দ্বায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে তবে তার সাজা পাওয়া উচিত। পক্ষান্তরে সে যদি ঈমানদারি,বিশ্বস্ততা, দ্বায়িত্বজ্ঞান ও আনুগত্য পরায়ণতার সাথে কর্তব্য পালন করে থাকে তাহলে তার পুরস্কারও তার পাওয়া দরকার।

জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারনা

উপরোক্ত ‘খেলাফত’ ও ‘প্রতিনিধিত্ব’ শব্দ দুটো থেকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রতিনিধির প্রকৃত কর্তব্য এই যে,আপন প্রভুর মাল-মাত্তায় তার প্রতিনিধিত্বের ‘হক’ পুরোপুরি আদায় করার চেষ্টা করবে এবং প্রকৃত মালিক যেভাবে তার ভোগ-ব্যবহার করে থাকে,যতদূর সম্ভব সে-ও সেভাবে ভোগ-ব্যবহার করবে। বাদশাহ যদি তার প্রজাদের উপর কাউকে প্রতিনিধি(নায়েব) নিযুক্ত করেন, তবে তার পক্ষে সেই প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা ব্যবহারের প্রকৃষ্ট পন্থা হবে এই যে, প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ, স্নেহ-মমতা, দয়াশীলতা, নিরাপত্তা, সুবিচার ও ক্ষেত্র বিশেষে কড়াকড়ি করার ব্যাপারে খোদ বাদশাহ যেরূপ ভুমিকা গ্রহণ করে থাকেন, সে-ও ঠিক সেরূপ ভূমিকাই গ্রহণ করবে এবং বাদশাহের মাল-মাত্তা ও ধন-সম্পদ তারই মতো বুদ্ধিমত্তা (হিকমত), প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সাথে ভোগ-ব্যবহার করবে।

কাজেই মানুষকে আল্লাহর খলিফা-প্রতিনিধি আখ্যা দেয়ার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, আল্লাহর সৃষ্টির সাথে আচরণের বেলায় মানুষের অনুসৃত নীতি যদি স্বয়ং আল্লাহর মতই হয়, কেবল তখনই সে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব ও খেলাফতের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারবে। অর্থাৎ যেরূপ প্রতিপালনসুলভ মহত্বের সঙ্গে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির রক্ষনাবেক্ষণ ও প্রতিপালন করে থাকেন, সেরূপ মহত্ব নিয়েই মানুষ তার সীমাবদ্ধ কর্মক্ষেত্রে, আল্লাহ কর্তৃক তার আয়ত্ত্বাধীন করে দেয়া বস্তুসমূয়ের সংরক্ষণ ও লালন-পালন করবে। অনুরূপভাবে যে ধরনের রহমানী মহত্বের সঙ্গে আল্লাহ তার ধন-সম্পদ ব্যবহার করেন, যেরূপ সুবিচার ও নিরপেক্ষতার সাথে তিনি তার সৃষ্টির ভেতর শৃঙ্খলা বজায় রাখেন এবং যে ধরনের দয়া ও অনুকম্পার সঙ্গে তিনি তার ‘জবর’ ও ‘কাহর’ (অর্থাৎ দয়াশুন্যতা সূচক) এর গুনাবলী প্রকাশ করেন, আল্লাহর যে সৃষ্টির ওপর মানুষকে কর্তৃত্ব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং যাকে করা হয়েছে তার অধীনস্থতার সাথে এইমানুষ অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় হলেও ঠিক তেমনি ধরনেরই ব্যবহার করবে।

তাখলুকু বিআখলাকিল্লাহি এর প্রজ্ঞাময় বাক্যটিতে এ তাৎপর্যই বিধৃত হয়েছে। কিন্তু মানুষ যখন এ সত্যটি ভালোমত উপলব্ধি করতে পারবে যে, এ দুনিয়ায় সে কোন স্বাধীন শাসক নয়, বরং প্রকৃত শাসকের সে প্রতিনিধি মাত্র, কেবল তখনই সে এ উন্নত নৈতিক মর্যাদা লাভ করতে পারে। এ হচ্ছে প্রতিনিধি পদের প্রকৃত দায়িত্ব। এটাই দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু, এমনকি তার দেহ এবং দৈহিক ও মানসিক শক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কের স্বরূপ ও পরিধি সুনির্দিষ্ট করে দেয়।

প্রতিনিধিত্বের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এপর্যন্ত যা বলা হলো কুরআন মজিদে তার প্রতিটি কথারই বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। এ থেকে দুনিয়া এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিটি দিকই উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মানুষ প্রতিনিধি, মালিক নয়

কুরআনে বলা হয়েছে:

১৬৫ وَ هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَکُمۡ خَلٰٓئِفَ الۡاَرۡضِ وَ رَفَعَ بَعۡضَکُمۡ فَوۡقَ بَعۡضٍ دَرَجٰتٍ لِّیَبۡلُوَکُمۡ فِیۡ مَاۤ اٰتٰکُمۡ ؕ اِنَّ رَبَّکَ سَرِیۡعُ الۡعِقَابِ ۫ۖ وَ اِنَّهٗ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ 

“সেই আল্লাহই তোমাদেরকে দুনিয়ায় প্রতিনিধি বানিয়েছেন এবং তোমাদের ভেতর কাউকে কারুর চেয়ে উঁচু মর্যাদা দিয়েছেন, যেন তোমাদেরকে তিনি যা কিছু দান করেছেন, তার ভেতর তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন।” – (সুরাআলআন’আম: ১৬৫)

قَالُوا أُوذِينَا مِن قَبْلِ أَن تَأْتِيَنَا وَمِن بَعْدِ مَا جِئْتَنَا ۚ قَالَ عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ

“(মুসা বনী ইসরাঈলকে) বললেন: খুব শিগগীরই আল্লাহ তোমাদের দুশমনকে ধ্বংস এবং দুনিয়ায় তোমাদেরকে খলিফা বানবেন, যাতে করে তোমরা কিরূপ কাজ করো তা তিনি দেখতে পারেন।” – (সুরাআলআরাফ: ১২৯)

২৬ یٰدَاوٗدُ اِنَّا جَعَلۡنٰکَ خَلِیۡفَۃً فِی الۡاَرۡضِ فَاحۡکُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ بِالۡحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعِ الۡهَوٰی فَیُضِلَّکَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَضِلُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ لَهُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌۢ بِمَا نَسُوۡا یَوۡمَ الۡحِسَابِ 

“হে দাউদ: আমরা তোমাকে দুনিয়ায় প্রতিনিধি বানিয়েছি, সুতরাং তুমি লোকদের ভেতর সত্য সহকারে শাসন করো এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করোনা; কারন এ তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্যে এই কারণে কঠোর শাস্তি রয়েছে যে, তারা হিসেবের দিনকে ভুলে গিয়েছে।” – (সুরা সাদ: ২৬)

৮ اَلَیۡسَ اللّٰهُ بِاَحۡکَمِ الۡحٰکِمِیۡنَ 

“আল্লাহ কি সকল শাসকদের শাসক নন?” – (সুরা আততীন: ৮)

 اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰ

“হুকুমত আল্লাহ ছাড়া আর কারুর নয়.” – (সুরা আলআন’আম: ৫৭)

২৬ قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِکَ الۡمُلۡکِ تُؤۡتِی الۡمُلۡکَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡکَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ 

“বলো, হে আল্লাহ! সমস্ত রাজ্যের মালিক! তুমি চাও রাজ্য দান করো, আর যার কাছ থেকে ইচ্ছে করো রাজ্য ছিনিয়ে নাও. যাকে চাও সম্মান দান করো, আবার যাকে চাও অপমানিত করো.” - (সুরা আল ইমরান: ২৬)

৭:৩ اِتَّبِعُوۡا مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکُمۡ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا مِنۡ دُوۡنِهٖۤ اَوۡلِیَآءَ ؕ

“তোমাদের প্রতি তোমাদের আল্লাহর তরফ থেকে যা কিছু নাযিল হয়েছে শুধু তারই আনুগত্য করো এবং তিনি ছাড়া অপর কোন পৃষ্ঠপোষকদের আনুগত্য করোনা.” – (সুরা আল-আরাফ: ৩)

১৬২ قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ

“বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদাত, আমার জীবনও আমার মৃত্যু সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্যে।” – (সুরা আল আন’আম: ১৬২)

এই আয়াত সমূহ থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দুনিয়ায় যতো জিনিসই মানুষের ভোগ-ব্যবহারও কর্তৃত্বাধীন রয়েছে, তার কোনটারই-এমনকি তার নিজ স্বত্তার ও মালিকানা তার নয়। এগুলোর প্রকৃত মালিক, শাসক ও নিয়ামক হচ্ছেন আল্লাহ। এই জিনিসগুলোকে প্রকৃত মালিকের ন্যায় আপন খেয়াল-খুশীমত ভোগ ব্যবহার করার কোন অধিকার মানুষের নেই। দুনিয়ায় তার মর্যাদা হচ্ছে নিছক প্রতিনিধির এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথেচলা এবং তাঁর প্রদর্শিত পন্থায় ঐ জিনিসগুলোর ভোগ-ব্যবহার করা পর্যন্তই তার ইখতিয়ার সীমাবদ্ধ। এ নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে আপন প্রবৃত্তির আনুগত্য করা কিংবা প্রকৃত শাসক ছাড়া অন্যকোন শাসকের নির্দেশ মেনে চলা বিদ্রোহ এবং ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

দুনিয়ার জীবনে সাফল্যের প্রাথমিক শর্ত

কুরআনে বলা হয়েছে:

وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِالۡبَاطِلِ وَ کَفَرُوۡا بِاللّٰهِ ۙ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۵۲

“যারা বাতিলের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে, প্রকৃতপক্ষে তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” – (সুরা আল আনকাবুত: ৫২)

 وَ مَنۡ یَّرۡتَدِدۡ مِنۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِهٖ فَیَمُتۡ وَ هُوَ کَافِرٌ فَاُولٰٓئِکَ حَبِطَتۡ اَعۡمَالُهُمۡ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ

“তোমাদের ভেতর থেকে যে কেউ নিজের দ্বীন (অর্থাৎআল্লাহরআনুগত্য) থেকে ফিরে যায় এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, দুনিয়া ও আখেরাতে এমন লোকদের আমল বরবাদ হয়ে যায়.” - (সুরা আল বাকারা: ২১৭)

وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالۡاِیۡمَانِ فَقَدۡ حَبِطَ عَمَلُهٗ ۫ وَ هُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ

“যে কেউ ঈমান আনতে অস্বীকার করে তার যাবতীয় আমল নষ্ট হয়ে যায় এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে.” – (সুরা মায়েদা: ৫)

এ আয়াত সমূহ থেকে জানা গেল যে, আপন মনিবের শাসন কর্তৃত্ব স্বীকার করা এবং নিজেকে তার প্রতিনিধি ও আমানতদার মনে করে সকল কাজ সম্পাদন করার ওপরই দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের সাফল্য নির্ভর করে।এ স্বীকৃতি ছাড়া আল্লাহর ধন-সম্পদ ও দ্রব্য-সামগ্রী সে যতটুকু ভোগ-ব্যবহার করবে, তা শুধু বিদ্রোহাত্মক ভোগ-ব্যাবহারই হবে। আর এটা সাধারণ জ্ঞানের কথা যে, বিদ্রোহী যদি কোন দেশ দখল করে দেশ সেবার উত্তম নজীর ও পেশ করে, তবু দেশের আসল বাদশাহ তার এই ‘সত্কাজের’ আদৌ স্বীকৃতি দেবেনা। বাদশাহর কাছে বিদ্রোহী বিদ্রোহীই। তা ব্যক্তি চরিত্র ভালো হোক আর মন্দ, বিদ্রোহ করে সে দেশকে সুষ্ঠুভাবে চালিত করুক আর নাই করুক তাতে কিছু আসে যায়না।

দুনিয়া ভোগ-ব্যবহারের জন্যই

কুরআনে বলা হয়েছে:
১৬৮ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ کُلُوۡا مِمَّا فِی الۡاَرۡضِ حَلٰلًا طَیِّبًا ۫ۖ وَّ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّهٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ 
১৬৯ اِنَّمَا یَاۡمُرُکُمۡ بِالسُّوۡٓءِ وَ الۡفَحۡشَآءِ وَ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا عَلَی اللّٰهِ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ 

“হেমানুষ! দুনিয়ায় যেসব হালাল ও পবিত্র দ্রব্যাদি রয়েছে, তা থেকে খাও এবং কোন ব্যাপারে শয়তানের আনুগত্য করোনা; কারন সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। সে তোমাদেরকে পাপাচার, নির্লজ্জতা এবং আল্লাহর সম্পর্কে যাহা তোমরা জাননা এমন কথা বলার নির্দেশ দেয়” – (সুরা আল বাকারা: ১৬৮-১৬৯)

৮৭ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُحَرِّمُوۡا طَیِّبٰتِ مَاۤ اَحَلَّ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَعۡتَدُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡمُعۡتَدِیۡنَ 
৮৮ وَ کُلُوۡا مِمَّا رَزَقَکُمُ اللّٰهُ حَلٰلًا طَیِّبًا ۪ وَّ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡۤ اَنۡتُمۡ بِهٖ مُؤۡمِنُوۡنَ

“হে ঈমানদার গণ! যেসব পবিত্র জিনিস আল্লাহ তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন, তাকে নিজেদের জন্যে হারাম করোনা এবং সীমালংঘন করো না না; কারন, আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেননা। আর আল্লাহ তোমাদেরকে যেসব হালাল ও পবিত্র রিযিকদান করেছেন, তা থেকে খাও এবং যে আল্লাহর প্রতি তোমরা ঈমান রাখো, তাঁর নাফরমানী হতে দূরে থাক.” – (সুরা আলমায়েদা: ৮৭-৮৮)

৩২ قُلۡ مَنۡ حَرَّمَ زِیۡنَۃَ اللّٰهِ الَّتِیۡۤ اَخۡرَجَ لِعِبَادِهٖ وَ الطَّیِّبٰتِ مِنَ الرِّزۡقِ ؕ

“(হে নবী! বলো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যে যেসব সৌন্দর্য সামগ্রী (জিনাত) বের করেছেন, তাকে কে” - (সুরা আল আরাফ: ৩২)

 ۫ یَاۡمُرُهُمۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهٰهُمۡ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ یُحِلُّ لَهُمُ الطَّیِّبٰتِ وَ یُحَرِّمُ عَلَیۡهِمُ الۡخَبٰٓئِثَ وَ یَضَعُ عَنۡهُمۡ اِصۡرَهُمۡ وَ الۡاَغۡلٰلَ الَّتِیۡ کَانَتۡ عَلَیۡهِمۡ ؕ

“(আমাদের পয়গাম্বর) তাদেরকে নেক কাজের আদেশ দেন এবং অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত রাখেন, তাদের জন্যে পবিত্র জিনিস হালাল ও অপবিত্র জিনিস হারাম আর তাদের ওপরকার বোঝা ও বন্ধন সমূহ দূর করে দেন।” – (সুরা আরাফ: ১৫৭)

 لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَبۡتَغُوۡا فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ

“তোমরা আপন প্রভুর ফযল (অর্থাৎ ব্যবসায়ের দ্বারা জীবিকা) তালাশ করবে, এর ভেতরে তোমাদের জন্যে কোনই অনিষ্ট নেই.” - (সুরা আল বাকারা: ১৯৮)

وَ رَهۡبَانِیَّۃَۨ ابۡتَدَعُوۡهَا مَا کَتَبۡنٰهَا عَلَیۡهِمۡ اِلَّا ابۡتِغَآءَ رِضۡوَانِ اللّٰهِ 

“মসীহর অনুগামীগন নিজেরাই বৈরাগ্যবাদ উদ্ভাবন করে নিয়েছিল শুধু আল্লাহর সন্তোষ লাভের আশায়, এটা তাদের জন্যে আমরা বিধিবদ্ধ করিনি।” – (সুরা আল হাদিদ: ২৭)

১৭৯ وَ لَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَهَنَّمَ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۫ۖ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَهُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ هُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ

“আমরা জাহান্নামের জন্যে বহু জ্বিন ও মানুষ পয়দা করেছি। তাদের কাছে দিল রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা চিন্তা-ভাবনা করেনা, তাদের কাছে চক্ষু রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখেনা; তাদের কাছে কান রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা শোনে না, তারা জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। এরাই রয়েছে গাফলতে নিমজ্জিত।” -(সুরা আল আরাফঃ১৭৯)

এই আয়াতগুলোতে একথা সুস্পষ্ট যে, দুনিয়া ত্যাগ করাটা মানুষের কাজ নয়। দুনিয়া এমন কোন জিনিস নয় যে, তাকে বর্জন করতে হবে, তা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং তার কায়-কারবার, বিষয়াদি, ভোগোপকরণ ও সৌন্দর্য সুষমাকে নিজের প্রতি হারাম করে নিতে হবে। এ দুনিয়া মানুষের জন্যেই তৈরী করা হয়েছে; সুতরাং তার কাজ হচ্ছে, একে ভোগ-ব্যবহার করবে, বিপুলভাবে ভোগ-ব্যবহার করবে। তবে ভাল-মন্দ, পাক-নাপাক ও সমীচীন-অসমীচীনের পার্থক্যের প্রতি লক্ষ রেখে ভোগ করবে। আল্লাহ তাকে দেখার জন্য চক্ষু দিয়েছেন। যদি মানুষ তার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ইন্দ্রিয় নিচয় ও মানসিক শক্তিকে ব্যবহার না করে অথবা ভুল পথে ব্যবহার করে তো তার ও পশুর মধ্যে কোনই প্রভেদ থাকে না।




*************************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url