সিরাতুন নবী (সাঃ) || (পর্ব-২৯) || রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে ইহুদী ও মুশরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা ||





রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে ইহুদী ও মুশরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিরুদ্ধে কুরাইশ এবং ইহুদীদের মিলিত প্রচেষ্ঠা

কুরাইশদের সর্বপ্রকার উদ্যোগ যখন ব্যর্থ হলো তখন কুরাইশদের কাছে অন্ধকার নেমে আসলো। হতভম্ভ হয়ে গেল তারা। এমন অবস্থায় তাদের মধ্যেকার অন্যতম শয়তান নাযর বিন হারিস একদিন কুরাইশগণকে আহবান জানিয়ে বললেন, ‘ওহে কুরাইশ ভাইগণ। আল্লাহর শপথ তোমাদের সম্মুখে এক মহা দুর্যোগপূর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে, অথচ তোমরা আজ পর্যন্ত এর কোন প্রতিকার কিংবা প্রতিবাদ কোনটাই করতে পার নি। মুহাম্মাদ (ﷺ) যখন তোমাদের মধ্যে যুবক ছিল, তখন সকলের প্রিয় পাত্র ছিল। সবার চেয়ে সত্যবাদী ও বিশ্বাসী ছিল। এখন যখন তার কান ও মাথার মধ্যেকার চুল সাদা হতে চলল (অর্থাৎ বয়সবৃদ্ধি পেয়ে মধ্য বয়সে পৌঁছল) এবং তোমাদের নিকট কিছু বাণী ও বক্তব্য উপস্থাপন করল তখন তোমরা বলছ যে, সে একজন যাদুকর। না, আল্লাহর শপথ যে যাদুকর নয়। আমরা যাদুকর দেখেছি তাদের ঝাড় ফুঁক ও গিরাবন্দিও দেখেছি, কিন্তু এর মধ্যে সে রকম কোন কিছুই দেখছিনা’।

তোমরা বলছ যে, সে একজন কাহিন।

কিন্তু তাকে তো কাহিন বলেও মনে হয় না। আমরা কাহিন দেখেছি, দেখেছি তাদের অসার বাগাড়ম্বর, উল্টোপাল্টা কাজ কর্ম এবং বাক চাতুর্য। কিন্তু এঁর মধ্যে তেমন কিছুই দেখিনা।

তোমরা বলছ, সে কবি, কিন্তু তাঁকে কবি বলেও তো মনে হয় না। আমরা কবি দেখেছি এবং কাব্যধারা হাজয, রাজ্য ইত্যাদিও শুনেছি। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কাছে যা শুনেছি, কোনদিন কারো কাছেই তা শুনিনি। তার কাছে যা শুনেছি তা তো অদ্ভুত জিনিস।

তোমরা তাকে বলছ পাগল! কিন্তু তাকে পাগল বলার কোন হেতুই তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা তো অনেক পাগলের পাগলামি দেখেছি, দেখেছি তাদের উল্টোপাল্টা কাজকর্ম, শুনেছি তাদের অসংলগ্ন ও অশ্লীল। কথাবার্তা এবং আরও কত কিছু। কিন্তু এর মধ্যে তেমন কোন ঘটনাই কোন দিন দেখিনি। ওহে কুরাইশগণ! আল্লাহর শপথ, তোমরা খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছ। খুব ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে পরিত্রাণের পথ খোঁজ করো।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি ইহুদী পন্ডিতদের তিনটি প্রশ্ন

কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সত্যবাদিতা, ক্ষমাশীলতা, উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি যাবতীয় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে টিকে থাকা, সকল প্রকার প্রলোভনকে প্রত্যাখ্যান, প্রত্যেক বালা-মসিবতে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা ও অনমণীয়তা প্রত্যক্ষ করলো তখন মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সত্যিকার নাবী হওয়ার সপক্ষে তাদের সন্দেহ আরো ঘনিভূত হলো। ফলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্কে ভালভাবে যাচাই-বাছাই করার নিমিত্তে ইহুদীদের সাথে মিলিত হল। নাযর বিন হারিসের পূর্বোক্ত নসিহত শ্রবণ করে তারা তাকে ইহুদীদের শহরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। সুতরাং সে ইহুদী পণ্ডিতদের নিকটে আসলে তারা তাকে পরামর্শ প্রদান করলো যে, তোমরা তাকে তিনটি প্রশ্ন করবে। প্রশ্নগুলোর ঠিকঠক উত্তর দিতে পারলে বুঝা যাবে সে সত্যিকার নাবী। আর উত্তর দিতে না পারলে বুঝা যাবে, এটা তার নিজস্ব দাবি। যে তিনটি বিষয়ের প্রশ্ন করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হলো তা হচ্ছে-

১. তোমরা তার কাছে প্রথম যুগের সেই যুবকদের সম্পর্কে জানতে চাবে যে, তাদের অবস্থা আপনি বর্ণনা করুন। কেননা তাদের বিষয়টা নিতান্তই আশ্চর্যজনক ও রহস্যে ঘেরা।

২. তোমরা তাকে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, যে পৃথিবীর পূর্ব হতে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিল। তার খবর কী?

৩. তোমরা তাকে রূহ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে যে, রূহটা মূলত কী জিনিস?

তিনটি প্রশ্নের উত্তরে সূরাহ কাহফ ও সূরাহ বানী ইসরাঈল নাজিল

অতঃপর নাযর বিন হারিস মক্কায় ফিরে এসে বললো, “আমি তোমাদের নিকট এমন বিষয় নিয়ে এসেছি যা আমাদের এবং মুহাম্মাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবে।” এরপর সে ইহুদী পণ্ডিতগণ যা বলেছে তা তাদের জানিয়ে দিল। কথামতো কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে উক্ত তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার কয়েকদিন পর সূরাহ কাহফ অবতীর্ণ হয় যে সূরাহতে সেইসব যুবকদের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে- তারা হলো আসহাবে কাহফ, সারা পৃথিবী সফরকারী ব্যক্তি হলো- জুল কারনাইন। আর রূহ সম্পর্কে নাযিল হয় সূরাহ বানী ইসরাঈল। ফলে কুরাইশদের কাছে এ বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য ও হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সীমালংঘনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে বসে।

এ হচ্ছে কুরাইশগণ কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর দাওয়াত মুকাবেলা করার সামান্য চিত্র। বাস্তব কথা হলো তারা রাসূলুল্লাহ-এর দাওয়াতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে সর্ব প্রকারের চেষ্টা চালিয়েছে। তারা একস্তর থেকে অন্যস্তর, এক প্রকার থেকে অন্য প্রকার, কঠিন হতে নম্র, নম্র হতে কঠিন, তর্ক-বিতর্ক হতে আপোশরফা, মিমাংসা হতে আবার তর্ক-বিতর্ক, হুমকি-ধমকী প্রদান হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, তারা প্রলোভন দেখাতো, তাতে কাজ না হলে তারা কখনো কোন প্রতিশ্রুতি দিত অতঃপর মুখ ফিরিয়ে নিত। তাদের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন তারা একবার সামনে অগ্রসর হচ্ছে আবার পিছনে হটছে। তাদের কোন স্থীরতা নেই আর নেই কোন প্রত্যাবর্তন স্থল। তাদের এরকম বিভিন্নমুখী কর্মতৎপরতার দাবি ছিল যে, এর মাধ্যমে ইসলামী দাওয়াত স্তব্ধ ও বন্ধ হয়ে যাবে এবং কুফরী প্রাধন্য পাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো- তাদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা, কর্মতৎপরতা, উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে একটি হাতিয়ার বাকী থাকল তা হলো অস্ত্ৰধারণ। তবে অস্ত্ৰধারণ কেবল মুসিবতই বৃদ্ধি করে না বরং ভিত্তিমূলকে নড়বড়ে করে দেয়। ফলে তারা এখন কী করবে ভেবে না পেয়ে পেরেশান হয়ে গেল।

আবূ ত্বালিব ও তার আত্মীয় স্বজনের অবস্থান

আবূ ত্বালিব যখন দেখলেন যে, কুরাইশগণ সার্বিকভাবে সকল ক্ষেত্রে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে তখন তিনি স্বীয় প্রপিতামহ আবদে মানাফের দু’পুত্র হাশিম ও মুত্তালেব বংশধারার পরিবার বর্গকে একত্রিত করেন। তারপর এ কথা বলে তাদের আহবান জানান যে, এতদিন পর্যন্ত তিনি এককভাবেই তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের দেখাশোনা এবং সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে যেহেতু তাঁর পক্ষে এককভাবে আর সেই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়, সেহেতু সম্মিলিতভাবে সেই দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি সকলের প্রতি অনুরোধ জানালেন। আবূ ত্বালীবের এই অনুরোধ আরবী সম্প্রদায়িকতার আকর্ষণের প্রেক্ষিতে সেই দু’পরিবারের সকলেই তা মেনে নিলেন। কিন্তু আবূ ত্বালীবের ভাই আবূ লাহাব তা গ্রহণ না করে কুরাইশ মুশরিকগণের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজকর্ম করার এবং তাদের সাহায্য করার কথা ঘোষণা করলেন।[১]

বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের বিরুদ্ধে মুশরিকদের অবস্থান

মুশরিকদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো এবং তারা দেখতে পেল যে, বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের মুসলিম ও কাফির সকলের সম্মিলিতভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সাহায্যদানের অঙ্গীকার করেছে। এ সব কারণে মুশরিকদের হতবুদ্ধিতা আরো বেড়ে গেল।

পূর্বোলি­খিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুশরিকগণ ‘মুহাসসাব’ নামক উপত্যকায় খাইফে বনী কিনানাহর ভিতরে একত্রিত হয়ে সর্বসম্মতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হল যে, বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের সাথে ক্রয় বিক্রয়, সামাজিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, কুশল বিনিময় ইত্যাদি সবকিছুই বন্ধ রাখা হবে। কেউ তাদের কন্যা গ্রহণ করতে কিংবা তাদের কন্যা দান করতে পারবে না। তাদের সঙ্গে উঠাবসা, কথোপকথন মেলামেশা, বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কোনকিছুই করা চলবে না। হত্যার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যতদিন তাদের হাতে সমর্পণ না করা হবে ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

মুশরিকগণ এ বর্জন বা বয়কটের দলিলস্বরূপ একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, তারা কখনো বনু হাশিমের পক্ষ হতে কোন সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না এবং তাদের প্রতি কোন প্রকার ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে না, যে পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যার জন্য মুশরিকগণের হাতে সমর্পন না করবে সে পর্যন্ত এ অঙ্গীকার নামা বলবৎ থাকবে।

ইবনে কাইয়ূমের বর্ণনা সূত্রে বলা হয়েছে যে, এ অঙ্গীকারপত্রখানা লিখেছিলেন মানসুর বিন ইকরামা বিন ‘আমির বিন হাশিম। কেউ কেউ উল্লে­খ করেছেনে যে, এ অঙ্গীকার নামা লিখেছিলেন নাযর বিন হারিস। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এ অঙ্গীকার নামার সঠিক লেখক ছিলেন বোগায়েয বিন ‘আমির বিন হাশিম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার প্রতি বদ দোওয়া করেছিলেন যার ফলে তার হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল।[২]

যাহোক এ অঙ্গীকার স্থিরীকৃত হল এবং অঙ্গীকারনামাটি ক্বাবা’হর দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হল। যার ফলে আবূ লাহাব ব্যতীত বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের কী কাফের, কী মুসলিম সকলেই আতঙ্কিত হয়ে ‘শেয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরি সংকটে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়ত সপ্তম বর্ষের মুহারম মাসের প্রারম্ভে চাঁদ রাত্রিতে। তবে এ ঘটনা সংঘটনের সময়ের ব্যাপারে আরো মতামত রয়েছে।

তথ্যসূত্রঃ
[১] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৬৯পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১০৬ পৃঃ।
[২] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ।



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url