সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৫৮ || ইসলামী রাষ্ট্র ও মহা বিজ্ঞানময় মুসলিম সমাজের প্রবর্তন ||






ইসলামী রাষ্ট্র ও মহা বিজ্ঞানময় মুসলিম সমাজের প্রবর্তন

ইসলামী রাষ্ট্র ও মহা বিজ্ঞানময় মুসলিম সমাজের এ ক্রান্তি লগ্নে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক নতুন জীবনধারার ভিত্তি স্থাপন করেন। এ জীবনধারার বাহ্যিকতা প্রকৃতপক্ষে ঐ আভ্যন্তরীণ পরিপূর্ণতারই প্রতিবিম্ব (রশ্মি) ছিল যাকে নাবী (ﷺ)-এর সঙ্গ ও সাহচর্যের বদৌলতে অভাবনীয় এক সম্মানের আসনে সমাসীন করা সম্ভব হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর শিষ্যদের দীক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও উত্তম চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করতেন এবং অবিরামভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন।

তিনি তাঁর শিষ্যগণকে সদা-সর্বদা ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা, সম্মান, সম্ভ্রম এবং উপাসনা, আনুগত্য ও আদব ক্বায়দার তালীম দিতেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তা মেনে চলার জন্য প্রেরণা ও পরামর্শ দান করতেন।

একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,

أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ

‘কোন্ ইসলাম উত্তম? অর্থাৎ ইসলামের কোন্ আচার-আচরণটি উৎকৃষ্ট?’ তিনি বললেন,

‏[‏تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتُقْرِئُ السَّلَامَ عَلٰى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ‏]

‘তুমি খাদ্য খাওয়াও এবং চেনা-অচেনা (লোককে) সালাম দাও’’।[১]

আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি তাঁর দরবারে হাজির হয়ে তাঁর পবিত্র মুখমন্ডল প্রত্যক্ষ করেই স্পষ্টতঃ উপলব্ধি করলাম যে, এ কমনীয়, রমণীয়, সুষমাস্নিগ্ধ ও উজ্জ্বলতামন্ডিত মুখমন্ডলটি কোন মিথ্যুক মানুষের হতেই পারে না (এবং তার মুখ নিঃসৃত যে প্রথম বাণীটি শ্রবণ করেছিলাম তা ছিল,

‏[‏يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوْا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوْا الطَّعَامَ، وَصِلُوْا الْأَرْحَامَ، وَصَلُّوْا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ، تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ بِسَلَامٍ‏]‏

‘হে লোক সকল! তোমরা পরস্পর পরস্পরকে সালাম দেয়ার রেওয়াজ প্রবর্তন কর, খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় কর এবং রাত্রি বেলা মানুষ যখন নিদ্রাসুখে মগ্ন থাকবে তখন আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাক। (তবে) নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[২]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেন,

‏ ‏[‏لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لَا يَأْمَنْ جَارُهُ بَوَائِقَهُ‏]‏

‘‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যার প্রতিবেশী তার অন্যায়-অত্যাচার থেকে নিরাপদে না থাকে।[৩] তিনি আরও বলেছেন,

‏[‏الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِّسَانِهِ وَيَدِهِ‏]‏

‘‘(প্রকৃত) মুসলিম ঐ ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে।[৪]

তিনি আরও বলেছেন,

‏[‏لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتّٰى يُحِبُّ لِأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ‏]‏

‘তোমাদের মধ্যে কেউই (প্রকৃত) মুসলিম হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য ঐ সকল জিনিস পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে।’[৫]

তিনি আরও বলেছেন,

‏[‏المُؤْمِنُوْنَ كَرَجُلٍ وَّاحِدٍ، إِنْ اشْتَكٰى عَيْنُهُ اِشْتَكٰى كَلُّهُ، وَإِنْ اشْتَكٰى رَأْسُهُ اِشْتَكٰى كُلُّهُ‏]

‘‘সকল মু’মিন একটি মানব দেহের মত, যদি তার চোখে ব্যথা হয় তাহলে সমগ্র দেহেই ব্যথা অনুভূত হবে, আর যদি মাথায় ব্যথা হয় তাহলে তার সমগ্র শরীরেই ব্যথা অনুভূত হবে।[৬]

তিনি আরও বলেছেন,

[المُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضاً]

‘‘মু’মিন মু’মিনের জন্য একটি দালান ঘরের মতো, একাংশ অপর অংশকে শক্তি দান করে। [৭]

তিনি আরও বলেছেন,

[لَا تَبَاغَضُوْا، وَلَا تَحَاسَدُوْا، وَلَا تَدَابَرُوْا، وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَاناً، وَلَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ]

‘‘নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না, রাগ করবে না, একে অপর থেকে মুখ ফিরাবে না, আল্লাহর বান্দা ও আপোষের মধ্যে ভাই ভাই হয়ে থাকবে। কোন মুসলমানের জন্য হালাল নয় যে, সে তিন দিনের বেশী তার ভাইয়ের সাথে ক্রোধবশত কথা বার্তা বলবে না।[৮]

তিনি আরও বলেছেন,

[الْمُسْلِمُ أَخُوْ الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَسْلِمُهُ، وَمَنْ كاَنَ فِيْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِيْ حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِماً سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ]

‘মুসলিম মুসলমানের ভাই, না তার প্রতি অন্যায় করবে আর তাকে শত্রুর হাতে অর্পণ করবে। আর যে ব্যক্তি আপন (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট হবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটাতে থাকবেন। কোন মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। আর কেননা মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপন করে তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন।’[৯]

আরও বলেছেন,

[اِرْحَمُوْا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءَ]

‘তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি সদয় হও, আকাশবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’[১০]

তিনি আরও বলেছেন,

[لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالَّذِيْ يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلٰى جَانِبِهِ]

‘ঐ ব্যক্তি মুসলিম নহে, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশেই প্রতিবেশী অনাহারে কালাতিপাত করে।’[১১]

আরও বলেছেন,

[سِبَابُ الْمُؤْمِنِ فُسُوْقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ]

‘মুসলিমগণকে গালি দেয়া ফিসক (পাপ) তাদের হত্যা করা কুফুরী কাজ (অবিশ্বাসের কর্ম)।’[১২]

এভাবে তিনি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূরীভূত করাকে সদকা বলে গণ্য করতেন এবং এটাকে ঈমানের শাখাসমূহের মধ্যে একটি শাখা বলে গণ্য করতেন।[১৩]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দান-খয়রাতের ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন এবং এ সবের এমন এমন ফযীলত বর্ণনা করতেন যেদিকে মন এমনিতেই আকৃষ্ট হতো। তিনি বলতেন যে, সদকা এবং দান-খয়রাত পাপকে এমনভাবে মুছে ফেলে যে, যেমন পানি আগুনকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।[১৪]

তিনি আরো বলেছেন,

[أَيُّمَا مُسْلِمٍ كَسَا مُسْلِماً ثَوْباً عَلٰى عُرى كَسَاهُ اللهُ مِنْ خُضَرِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ أَطْعَمَ مُسْلِماً عَلٰى جُوْعٍ أَطْعَمَهُ اللهُ مِنْ ثِمَارِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ سَقٰى مُسْلِماً عَلٰى ظَمَأٍ سَقَاهُ اللهُ مِنْ الرَّحِيْقِ الْمَخْتُوْمِ]

‘‘কোন মুসলিম যদি কোন নগ্ন মুসলিমকে কাপড় পরিয়ে দেয় তা হলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ পোষাক পরিয়ে দিবেন এবং কোন মুসলিম যদি ক্ষুধার্ত মুসলিমকে খাদ্য খাওয়ায় তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন এবং কোন মুসলিম যদি কোন তৃষ্ণার্ত মুসলিমকে পানি পান করায় তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে মোহরকৃত পবিত্র শরাব পান করাবেন।[১৫] তিনি বলেছেন,

[اِتَّقُوْا النَّارَ وَلَوْ بِشَقِّ تَمَرَةٍ، فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ]

‘‘আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা করো যদিও খেজুরের অর্ধাংশ দিয়েও হয়, তাও যদি না পাও তা হলে কমপক্ষে ভাল কথার দ্বারা ভিখারীকে তুষ্ট করো।[১৬]

অথচ ভিক্ষা বৃত্তি হতে বিরত থাকার জন্য চরমভাবে নিষেধ করেছেন, ধৈর্যধারণ এবং অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার ফযীলত শুনাতেন, ভিক্ষুকগণের ভিক্ষাবৃত্তিকে তাদের মুখমন্ডলে অাঁচড়, পাচড়ও ক্ষত আখ্যায়িত করেছেন।[১৭] অবশ্য সীমাতিরিক্ত নিরুপায় হয়ে যারা ভিক্ষা করে তাদেরকে এর বাইরে রেখেছেন।

কোন ইবাদতের কী ফযীলত এবং আল্লাহর নিকট তার কী সওয়াব ও পুরষ্কার রয়েছে সে সবও তিনি আলোচনা করতেন। উপরন্তু, তাঁর নিকট যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হতো মুসলিমগণকে তার সঙ্গে শক্তভাবে জড়িয়ে রাখতেন। সেই সকল আয়াত তিনি মুসলিমগণকে পড়ে শোনাতেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের তা পড়ে শোনাতে বলতেন। উদ্দেশ্য ছিল এ কাজের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে বুঝ-সমঝ ও চিন্তাভাবনার উদ্রেক এবং দাওয়াতের যোগ্যতা, পয়গম্বরত্বের অনুভূতি ও সচেতনতার সৃষ্টি করা।

এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমগণের সুপ্ত সম্ভাবনা সমূহের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে মানবত্বের সর্বোচ্চ স্তরে তাঁদের উন্নীত করেন এবং জাগতিক ও পারত্রিক ভাবধারার সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটিয়ে আল্লাহর চেতনা ও ন্যায়-নীতির প্রতি নিবেদিত ও সমর্পিত এমন এক মানবগোষ্ঠির গোড়াপত্তন করেছিলেন ইতিহাসে যার কোন নজির নেই। এ মানবগোষ্ঠির মধ্যে তার সাক্ষাৎ শিষ্যদের বলা হতো সাহাবী (রাঃ)। মান-মর্যাদা এবং মানবত্বের উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে সাহাবীগণের স্থান ছিল নাবী রাসূলগণের পরেই। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, ‘যার অনুসরণের প্রয়োজন রয়েছে সে অতীত মানবগোষ্ঠির অনুসরণ করুক কেন না, জীবিতদের ব্যাপারে ফিৎনার ভয় রয়েছে।’

‘অতীত মানবগোষ্ঠি’ বলতে তিনি সাহাবীগণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁরা নাবী (ﷺ)-এর সঙ্গী ছিলেন। নাবী (ﷺ)-এর এই উম্মত-গোষ্ঠি ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট মানব, সব চাইতে পুণ্যবান, সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সব চাইতে নিবেদিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে নিজ নাবী (ﷺ)-এর বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান-ব্রতে শরীক হওয়ার দুর্লভ সুযোগ দানে ধন্য ও সম্মানিত করেছেন। তাঁদের পদাংক অনুসরণ করে তাঁদের চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। কারণ, তাঁরা ছিলেন হিদায়াত প্রাপ্তির উজ্জ্বলতার দৃষ্টান্ত।[১৮]

অন্যদিকে আবার, আমাদের পয়গম্বর রহাবারে আযম (ﷺ) সেরা পথপ্রদর্শক নিজেও এরূপ মানবিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলি, আল্লাহ প্রদত্ত পয়গম্বরত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ, মান-মর্যাদা মহানচরিত্র এবং সুন্দর সুন্দর কাজ-কর্মের অধিকারী ছিলেন যে, তার সংস্পর্শে এলে মন এমনিতেই তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়ত। ফলে তাঁর মুখ থেকে যখনই কোন কথা বের হতো তখনই সাহাবীগণ (রাঃ) তা বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। হিদায়াতের যে সকল কথা তিনি বলতেন জীবন-মরণ পণ করে সাহাবীগণ (রাঃ) তা সর্বাগ্রে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যেতেন।

আধ্যাত্মিকতার অলৌকিক চেতনায় উজ্জীবিত প্রেরণাবোধ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে নাবী কারীম (ﷺ) মদীনার সমাজ জীবনে এমন এক জীবনধারা প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন অখন্ড মানব জাতির ইতিহাসে যা ছিল সর্বোচ্চ মানের এবং সর্বাধিক পূর্ণত্বপ্রাপ্ত। এ জীবনধারায় তিনি এমন সব নিয়মনীতি এবং আচার-আচরণ প্রবর্তন করলেন যা যুগ-যুগান্তর ধরে অব্যাহত থাকা শোষণ, শাসন ও নিষ্পেষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানব জীবনকে শান্তি, স্বস্তি ও মুক্তির আস্বাদে ভরপুর করে তুলে এ জীবনধারার উপাদানগুলোকে এমন উঁচু মানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করা হয়েছিল যে, যুদ্ধ এবং শান্তি সকল অবস্থার সঙ্গেই সর্বাধিক যোগ্যতার সঙ্গে মোকাবেলা করে যে কোন পরিস্থিতির মোড় নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার মতো যোগ্যতা মুসলিমগণ অর্জন করেছিলেন। মুসলিমগণের এহেন পরিবর্তিত জীবনধারা কিছুটা যেন আকস্মিকভাবেই ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করে দেয়।


মদীনার অমুসলিমদের সাথে চুক্তি সম্পাদন

হিজরতের পর মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত মদীনার মুসলিম সমাজকে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস, সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ব বন্ধন এবং পরিচ্ছন্ন নিয়ম-শৃঙ্খলার উপর প্রতিষ্ঠিত করতে নাবী কারীম (ﷺ) যখন সক্ষম হলেন তখন মদীনার অমুসলিম জনগোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সমঝোতা গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। তাঁর এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সুখী, সমৃদ্ধ ও বরকতময় জীবনের পথ প্রশস্তকরণ, মদীনবাসী ও পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠির মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি ও একতার বন্ধন সুদৃঢ় করণ। এ লক্ষ্যে উদার উন্মুক্ত মনমানসিকতা নিয়ে এমন সব নিয়ম নীতি ও কার্যক্রম তিনি অবলম্বন করলেন যে, ধর্মান্ধতা ও স্বার্থান্ধতা-ক্লিষ্ট সম সাময়িক সমাজে যা ছিল একটি কল্পনাতীত ব্যাপার।

মদীনার মুসলিমগণের নিকটতম প্রতিবেশী ছিল ইহুদীগণ। মদীনায় মহানাবী (ﷺ)-এর হিজরতের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমগণের সুশৃঙ্খল সমাজ সংগঠন, ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন এবং ক্রমবর্ধমান শক্তি সামর্থ্যের ব্যাপারে তারা সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই মুসলিমগণের সাথে শত্রুতা পোষণ করলেও প্রকাশ্য কলহ কিংবা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়ার হাবভাবও প্রকাশ করে নি। কাজেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজন অনুভব করে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে তাদেরকে জানমালের সাধারণ নিরাপত্তা এবং ধর্মকর্মের স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তাতে দেশত্যাগ, মালক্রোক এবং ঝগড়া ফাসাদের ব্যাপারে কোন নীতি নির্ধারণ করা হয়নি।


অমুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির ধারাসমূহ

এ চুক্তি ঐ চুক্তির সঙ্গেই হয়েছিল যা মুসলিমদের পরস্পরের সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছিল যার উল্লেখ কিছু পূর্বে করা হয়েছে। নিম্নে তার উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ আলোচনা করা হলঃ

১. বনু আওফের ইহুদীগণ মুসলিমদের সঙ্গে মিলেমিশে একই উম্মতের মতো থাকবে, কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। এটা তাদের নিজেদের অধিকার হিসেবে যেমন গণ্য হবে, ঠিক তেমনিভাবে তাদের সঙ্গে যারা সম্পর্কিত তাদের এবং তাদের দাসদাসীদের বেলায়ও গণ্য হবে। বনু আউফ ছাড়া অন্যান্য ইহুদীদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।

২. মুসলিম এবং ইহুদী উভয় সম্প্রদায়ের লোকই নিজ নিজ আয়-উপার্জনের যিম্মাদার থাকবে।

৩. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষের সঙ্গে অন্য কোন শক্তি যুদ্ধে লিপ্ত হলে চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো সম্মিলিতভাবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

৪. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের লোকেরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক উপকারের ভিত্তিতে কাজ করে যাবে, কোন অন্যায়-অনাচার কিংবা পাপাচারের ভিত্তিতে নয়।

৫. মিত্র পক্ষের অন্যায়-অনাচারের জন্য সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।

৬. কেউ কারো উপর জুলুম করলে মজলুমকে সাহায্য করা হবে।

৭. চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে যত দিন চলতে থাকবে ততদিন ইহুদীদেরকেও মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ বহন করতে হবে।

৮. এ চুক্তিভুক্ত সকলের জন্যই মদীনায় কোন প্রকার হাঙ্গামা সৃষ্টি করা কিংবা রক্তপাত ঘটানো হারাম হবে।

৯. চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো কোন নতুন সমস্যা কিংবা ঝগড়া ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলে এর মীমাংসা করবেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)।

১০. কুরাইশ ও তাদের সহায়তাকারীদের আশ্রয় দেয়া চলবে না।

১১. ইয়াসরিবের উপর কেউ হামলা চালালে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং নিজ নিজ অঞ্চলে থেকে তা প্রতিহত করতে হবে।

১২. কোন অন্যায়কারী কিংবা পাপীর জন্য এ চুক্তি সহায়ক হবে না।[১৯]

এ চুক্তি সম্পাদনের ফলে মদীনা এবং সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ এক শান্তি-স্বস্তিময় সাম্রাজ্যের রূপ পরিগ্রহ করে যার রাজধানী ছিল মদীনা এবং সর্বময় নেতৃত্বে ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। এ সাম্রাজ্য পরিচালনের ভিত্তি ছিল ইসলামী বিধি-বিধান এবং পরিচালন ভাগের অধিকাংশ কর্মকর্তা ছিলেন মুসলিম। প্রকৃতপক্ষে এভাবে মদীনা ইসলামী হকুমতের রাজধানীতে পরিণত হয়ে যায়।

সুশৃঙ্খল এবং শান্তি-স্বস্তিময় অঞ্চলের সীমারেখা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নাবী কারীম (ﷺ) পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য গোত্রের সঙ্গে অবস্থার প্রেক্ষাপটে অনুরূপ চুক্তি সম্পাদন করেন। সে সব চুক্তির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হবে।

তথ্যসূত্রঃ
[১] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ ও ৯ পৃঃ।
[২] তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমি, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৮ পৃঃ।
[৩] সহীহুল মুসলিম, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[৪] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[৫] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[৬] সহীহুল মুসলিম, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[৭] মুত্তাফাকুন আলাইহি মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯০ পৃঃ।
[৮] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯৬ পৃঃ।
[৯] মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[১০] সুনানে আবূ দাউদ ২য় খন্ড ৩৩৫ পৃঃ, জামে তিরমিযী ২য় খন্ড ১৪ পৃঃ।
[১১] বাইহাকী, শোআবুল ঈমান, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২৪ পৃঃ।
[১২] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯৩ পৃঃ।
[১৩] মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত ১ম খন্ড ১২ ও ১৬৭ পৃঃ।
[১৪] আহমাদ তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ১ম খন্ড ১৪ পৃঃ।
[১৫] সুনানে আবূ দাউদ, জামে তিরমিযী, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৯ পৃঃ।
[১৬] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ১৯০ পৃঃ ২য় খন্ড ৮৯০ পৃঃ।
[১৭] দ্রষ্টব্য, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৩ পৃঃ।
[১৮] রাযীন, মিশকাত ১ম খন্ড ৩২ পৃঃ।
[১৯] দ্রষ্টব্য- ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫০৩-৫০৪ পৃঃ।




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url