সিরাতুন নবী (সাঃ) ৫৭ || মুসলিমগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন || পরস্পরে ইসলামী সাহায্যের অঙ্গীকার ||







মুসলিমগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন

মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং মুসলিমগণ যেভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সাহায্য সহযোগিতা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তেমনভাবে মুসলিমগণের মধ্যে এমন অপূর্ব এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন যার তুলনা মানব জাতির ইতিহাসে কোথাও মিলে না। মুসলিমগণের এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ‘মুহাজির ও আনসারগণের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আনাস বিন মালেকের গৃহে মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করিয়েছিলেন। এ সভায় সর্বশেষ নব্বই জন মুসলিম উপস্থিত ছিলেন, অর্ধেক সংখ্যক ছিলেন মুহাজির এবং অর্ধেক সংখ্যক আনাসার। ‘মুহাজির আনসার ভ্রাতৃত্বের’ মূলনীতি গুলো ছিল, ‘একে অন্যের দুঃখে দুঃখিত হবেন এবং মৃত্যুর পর নিজ আত্মীয়ের মতো একে অন্যের ওয়ারেস বা উত্তরাধিকারী হবেন। ওয়ারাসাত বা উত্তরাধিকারের এ ব্যবস্থা বদর যুদ্ধ পর্যন্ত চালু ছিল। তারপর যখন এ আয়াতে শরীফা,

‏(‏وَأُوْلُوْا الأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏ 75‏]‏

‘‘কিন্তু আল্লাহর বিধানে রক্ত সম্পর্কীয়গণ পরস্পর পরস্পরের নিকট অগ্রগণ্য।’ (আল-আনফাল ৮ : ৭৫)

বলা হয়ে থাকে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেবলমাত্র মুহাজিরীনদের মধ্যে আরও এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু প্রথম মতটিই অধিক প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য। কেননা, মুহাজিরীনগণ এমনিতেই পরস্পর ইসলামী ভ্রাতৃত্বে, দেশীয় ও গোত্রীয় ভ্রাতৃত্বে এবং আত্মীয়তার বন্ধনের কারণেই তাঁদের মধ্যে নতুন করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আনসারদের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন।[১]

এ ভ্রাতৃত্বের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুহাম্মাদ গাযালী লিখেছেন যে, ‘এ ছিল মূর্খতার যুগের বংশীয় সম্পর্ক ছিন্নকারী। আত্মীয়তা বা অনাত্মীয়তার সম্পর্ক যা কিছু হবে তা হবে ইসলামের জন্য। এরপর থেকে মানুষে মানুষে বংশ, বর্ণ ও দেশের সম্পর্ক মুছে যাবে। উঁচু, নীচু ও মানবত্বের মাপকাঠি হবে কেবলমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে, অন্য কোন কিছুর ভিত্তিতে নয়।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে শুধুমাত্র ফাঁকা বুলির পোষাক পরে ক্ষান্ত হন নি, বরং এ ছিল এমন এক কার্যকর অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি যা রক্ত ও ধন-সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এটা শুধু ফাঁকা বুলি এবং গতানুগতিক সালাম ও মুবারকবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এ ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ছিল সমবেদনা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। আর এ কারণেই তাঁর পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত এ নবতর জীবনধারা মানব জাতির ইতিহাসে এমন এক অধ্যায় রচনা করেছিল কোন কালেই যার কোন তুলনা মিলে না।[২]

সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাজিরগণ যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) এবং সা’দ বিন রাবীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এর পর সা’দ (রাঃ) আব্দুর রহমানকে (রাঃ) বললেন, ‘আনসারদের আমি সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি। আপনি আমার সম্পদ দু’ভাগে ভাগ করে অর্ধেক গ্রহণ করুন। তাছাড়া, আমার দুজন স্ত্রী রয়েছে। দুজনের মধ্যে যাকে আপনার পছন্দ হয় আমাকে বলুন, আমি তাকে তালাক দিব। ইদ্দত পালনের পর তাকে বিবাহ করবেন।’

আব্দুর রহমান (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ আপনার ধনজন ও মালমাত্তায় বরকত দিন। আপনাদের বাজার কোথায়?’ তাঁকে বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজার দেখিয়ে দেয়া হল। তিনি যখন বাজার থেকে ফিরে এলেন তখন তাঁর নিকট অতিরিক্ত কিছু পনির ও ঘি ছিল। এরপর তিনি প্রত্যহ বাজারে যেতে থাকলেন। তারপর একদিন যখন তিনি বাজার থেকে ফিরে এলেন তখন তাঁর শরীরে হলুদ রঙের চিহ্ন ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী?’ তিনি বললেন, ‘আমি বিবাহ করেছি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘স্ত্রীকে মোহর দিয়েছ তো?’ তিনি বললেন, ‘একটি খেজুরের বিচী পরিমাণ স্বর্ণ (অর্থাৎ সোয়া ভরি) দিয়েছি।[৩]

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে এরূপ একটি বর্ণনা এসেছে যে, আনাসারগণ রাসূলুল্লাহ (রাঃ)-এর নিকট এ বলে আবেদন পেশ করলেন যে, ‘আপনি আমাদের এবং মুহাজিরীন ভাইদের মধ্যে আমাদের খেজুর বাগানগুলো ভাগ বন্টন করে দিন’’। তিনি বললেন, ‘না’’।

আনসারগণ বললেন, ‘তবে আপনারা অর্থাৎ মুহাজিরগণ আমাদের কাজ করে দেবেন এবং তাদেরকে আমরা ফলের অংশ দিব।

তারা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমরা কথা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম।[৪]

এ থেকে সহজে অনুমান করা যায় যে, আনাসারগণ কিভাবে আন্তরিকতা ও আগ্রহের সঙ্গে আগু বেড়ে মুহাজির ভাইদের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং কতটুকু মহববত, খলুসিয়াত ও আত্মত্যাগের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। অধিকন্তু, মুহাজিরগণও তাঁদের আনসার ভাইদের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, সহমর্মী ও আত্মসচেতন ছিলেন তা এ ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায়। আনসারগণের আত্মত্যাগের সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু সুযোগের অপব্যবহার কখনই করেন নি। তাঁদের ভেঙ্গে যাওয়া জীবনধারাকে ন্যূনতম প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে সচল করে তোলার জন্য যতটুকু গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল তাঁরা ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গটি সম্পর্কে সত্য কথা এবং এর গৃঢ় রহস্য সম্পর্কে বলতে গেলে কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ভিত্তি ছিল অভাবিত ও অপূর্ব। আল্লাহ দর্শন এবং বিজ্ঞানের উর্বর পলল ভূমিতে উপ্ত হয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বীজ যার ফলে মুসলিমগণের সম্মুখে সৃষ্ট সকল সমস্যার সমাধান হয়েছিল সর্বোত্তম পন্থায়।


পরস্পরে ইসলামী সাহায্যের অঙ্গীকার

উপরি উল্লেখিত ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মতই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমগণের মধ্যে আরও একটি অঙ্গীকারপত্র সম্পাদন করেছিলেন যদ্দ্বারা জাহেলিয়াত যুগের সকল গোত্রীয় গন্ডগোলের মূলোৎপাটন এবং যাবতীয় কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজের বিলোপ সাধন ঘটে। এ অঙ্গীকারনামার দফাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল যার রূপ ছিল এ ধরণেরঃ

এটা লিখিত হচ্ছে নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে কুরাইশ, ইয়াসরেবী এবং তাঁদের অনুসারী ও তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুসলিমগণের জন্যঃ

১. এরা নিজেদের ছাড়া অন্য সকল মানব থেকে ভিন্ন একটি গোষ্ঠি।

২. কুরাইশ মুহাজিরগণ নিজেদের পূর্বেকার অবস্থা মোতাবেক নিজেদের মধ্যে দিয়াত (হত্যার বিনিময়) দেবেন এবং মু’মিনদের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে বন্দীদের মুক্তিপণ প্রদান করবেন। আনসারদের সকল গোত্র নিজেদের পূর্বেকার অবস্থা মোতাবেক নিজেদের মধ্যে দিয়াত প্রদান করবেন এবং তাঁদের সকল দল ঈমানদারদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত পন্থায় আপন বন্দীদের জন্য মুক্তিপণ প্রদান করবেন।

৩. ঈমানদারগণ কোন সহায় সম্পদহীন (অনাথ) কে মুক্তিপণ ও দিয়াত প্রদানের ব্যাপারে উত্তম পন্থা মোতাবেক প্রদান এবং সম্মান করা থেকে বিমুখ করবেন না।

৪. সকল ধর্মপ্রাণ মু’মিন ঐ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ করবেন যারা তাঁদের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে অথবা ঈমানদারদের বিরুদ্ধে অন্যায়, অত্যাচার, পাপ ও গন্ডগোলের পথ বেছে নেবে।

৫. মু’মিনগণ তাদের বিরুদ্ধে কাজ করবেন যদিও তাদের মধ্যে কেউ আপন পুত্রও হয়।

৬. কোন কাফিরের বদলে কোন মু’মিন কোন মু’মিনকে হত্যা করবেন না।

৭. কোন মু’মিন কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সাহায্য করবেন না।

৮. আল্লাহর যিম্মা (অঙ্গীকার) একই হবে। একজন সাধারণ মানুষের প্রদানকৃত যিম্মা সকল মুসলমানের জন্য সমানভাবে পালনযোগ্য হবে।

৯. যে সকল ইহুদী মুসলিমগণের অনুগামী হবে তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে এবং তারা অন্য মুসলিমগণের মতো হয়ে যাবে। তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা যাবে না। কিংবা তাদের বিরুদ্ধে অন্যকে সাহায্যও করা যাবে না।

১০. মুসলিমগণের সম্পাদিত সন্ধি হবে একই। কোন মুসলিম কোন মুসলিমকে বাদ দিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধের ব্যাপারে কোন সন্ধি করবেন না, বরং সকলে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতেই তা করবেন।

১১. মুসলিমগণ ঐ রক্তপাতের ব্যাপারে সমান অধিকার রক্ষা করবেন যা আল্লাহর পথে প্রবাহিত হবে।

১২. কোন কুরাইশ মুশরিককে আশ্রয় দেবে না, তাদের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে সাহায্য করবে না, আর কোন মু’মিনের হেফাজতের ব্যাপারে মুশরিকদেরকে প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড় করাবে না।

১৩. যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে হত্যা করবে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তার নিকট থেকে হত্যার বদলা গ্রহণ করা হবে যদি নিহতের অভিভাবক রাজী থাকেন।

১৪. যে সকল মু’মিন এর বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদের জন্য এছাড়া আর কিছু হালাল হবে না যে, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবেন, তাঁরা বিরুদ্ধাচারীর বিরুদ্ধাচরণ করবেন।

১৫. কোন মু’মিনের জন্য এটা সঙ্গত হবে না যে, যারা গুন্ডগোল সৃষ্টি করে (বিদ’আতী) তাদের কার্যকলাপে সাহায্য করে অথবা তাকে আশ্রয় দেয়, কিংবা যে তাকে সাহায্য করে তাকে আশ্রয় দেয়। যে এরূপ করবে কিয়ামতের দিন সে অভিশাপ এবং গযবে নিপতিত হবে এবং তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই কবুল হবে না।

১৬. তোমাদের মধ্যে যখনই যে কোন মতভেদ পরিলক্ষিত হবে তখনই তা আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-এর বিধি-বিধান মতো ফয়সালার ব্যবস্থা করবে।[৫]


তথ্যসূত্রঃ

[১] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৬ পৃঃ।
[২] ফিকহুস সীরাহ ১৪০ ও ১৪১ পৃঃ।
[৩] সহীহুল বুখারী বাবু এখাউন নাবী (সাঃ) বায়নাল মুহাজিরীনা অল আনসার, ১ম খন্ড ৩৫৫ পৃঃ।
[৪] প্রাগুক্ত বাবু ইয়াকলা আকফেনী মোউনাতান নাখলে ১ম খন্ড ৩১২ পৃঃ।
[৫] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫০২-৫০৩ পৃঃ।






******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url