মা’আরেফুল কোরআন-৩ || কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস || ওহী লিপিবদ্ধকরণ || তেলাওয়াত সহজ করার প্রচেষ্টা ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস

রাসূল (সা)-এর আমলে কোরআন সংরক্ষণ

কোরআন শরীফ যেহেতু এক সাথে নাযিল হয়নি, বরং বিভিন্ন সময়ে প্রয়ােজনমত অল্প অল্প করে নাযিল করা হয়েছে, এজন্যে নবুওয়ত যুগে কোরআনকে গ্রন্থাকারে একত্রে লিপিবদ্ধ করে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য প্রথম প্রথম কোরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে হেফজ বা কণ্ঠস্থ করার প্রতিই বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রথমাবস্থায় যখন ওহী নাযিল হতাে তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ওহীর শব্দগুলাে সাথে সাথে দ্রুত আবৃত্তি করতে থাকতেন, যেন সেগুলো অন্তরে দৃঢ়বদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুরা কেয়ামায় আয়াত নাযিল হলাে, যাতে আল্লাহ পাক তাঁকে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, কোরআন কণ্ঠস্থ করার জন্য ওহী নাযিল হতে থাকা অবস্থায় শব্দগুলাে দ্রুত সাথে সাথে উচ্চারণ করে যাওয়ার প্রয়ােজন নেই। আল্লাহ তা'আলাই আপনার মধ্যে এমন তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি সৃষ্টি করে দেবেন যে, একবার ওহী নাযিল হওয়ার পর-তা আর আপনি ভুলতে পারবেন না। তাই গুহী নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অন্তরে দৃঢ়বদ্ধ হয়ে যেতাে। এভাবেই নবী করীম সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র সিনা কোরআনুল করীমের এমন সুরক্ষিত ভাণ্ডারে পরিণত হয় যে, তন্মধ্যে সামান্যতম সংযােগ-বিয়োগ কিংবা ভুলচুক হওয়ার কোন আশংকা ছিল না। এরপরও অধিকতর সাবধানতার খাতিরে প্রতি বছর রমযান মাসে তিনি সে সময় পর্যন্ত নাযিলকৃত সমগ্ৰ কোৱআন হযরত জিবরাঈল (আ)-কে তেলাওয়াত করে শােনাতেন, হযরত জিবরাঈল (আ)-এর নিকট থেকেও শুনে নিতেন। ওফাতের বছর রমযান মাসে হুযুর (সা) দু'দুবার হযরত জিবরাঈল (আ)-কে শােনান এবং জিবরাঈল (আ) থেকে শােনেন। (বােখারী শরীফ)

হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে প্রথমে কোরআনের আয়াতগুলাে ইয়াদ করাতেন, তারপর আয়াতের মর্মার্থ শিক্ষা দিতেন। সাহাবায়ে-কেরামের মধ্যেও কোরআন মুখস্থ করা এবং মর্মার্থ শিক্ষা করার এমন প্রবল আগ্রহ ছিল যে, প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতেন। অনেক মহিলা পর্যন্ত বিবাহের মােহরানা বাবদ এরূপ দাবি পেশ করতেন যে, স্বামীরা তাদেরকে শুধু কোরআন শরীফের তালীম দেবেন, এ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণযােগ্য হবে না। শত শত সাহাবী সব কিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে শুধু কোরআনের তালীম গ্রহণ করার সাধনাতেই জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তারা কোরআন শরীফ শুধু মুখস্থই করতেন না, নিয়মিত রাত জেগে নফল নামাযে তেলাওয়াতও করতেন। হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রা) বর্ণনা করেন যে, মক্কা থেকে কেউ হিজরত করে মদীনায় এলেই তাকে কোরআনের তা'লীম গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কোন একজন আনসারের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হতো। মসজিদে নববীতে সর্বক্ষণ কোরআন শিক্ষা দান ও তেলাওয়াতের শব্দ এমন বেড়ে গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ প্রদান করতে হয় যে, সবাই যেন আরাে আন্তে কোরআন পাঠ করেন, যাতে পরস্পরের তেলাওয়াতের মধ্যে টক্কর না হয়। (মানাহেলুল-ইরফান, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৪) 

সীমাহীন আগ্রহ ও অসাধারণ অধ্যবসায়ের ফলে খুব অল্প দিনেই সাহাবীগণের মধ্যে। একদল হাফেজে কোরআন তৈরি হয়ে গেলেন। এ জামায়াতের মধ্যে খােলাফায়ে রাশেদীন বা প্রথম চার খলীফা ছাড়াও হযরত তালহা (রা), হযরত সা'আদ (রা), হযরত ইবনে মাসউদ। (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আস (রা), আমর ইবনুল আস (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা), হযরত মুয়াবিয়া (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা), হযরত আয়েশা (রা), হযরত হাফসা (রা), হযরত উম্মে সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহুম-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

মােটকথা, প্রাথমিক অবস্থায় কোরআন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে হিফজ-এর প্রতিই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। কারণ তখন লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। বই-পুস্তক প্রকাশের উপযােগী ছাপাখানা এবং অন্য উপকরণের অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং সেই অবস্থায় যদি শুধু লেখার উপর নির্ভর করা হতাে, তবে কোরআনের সংৰক্ষণ যেমন জটিল সমস্যা হয়ে পড়তো, তেমনি ব্যাপক প্রচারের দিকটিও নিঃসন্দেহে অসম্ভব হয়ে যেতো। তাছাড়া আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল এমন প্রখর যে, এক এক ব্যক্তি হাজার হাজার কবিতা গাথা মুখস্থ করে কাখত। মরুভূমির বেদুঈনরা পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে তাদের পরিবার ও গােত্রের কুঠিনমার ইতিহাস প্রকৃতি মুখস্থ করে রাখত এবং যত্রতত্র তা অনর্গল বৰে যেতাে। কোরআন হেফাজতের কাজে সেই অনন্য স্মৃতিশক্তিকে কাজে লাগানাে হয়েছে। হেফজের মাধ্যমেই অতি অতু সময়ের মধ্যে সমগ্র আরবের ঘরে ঘরে পবিত্র কোরআনের বাণী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। 

ওহী লিপিবদ্ধকরণ

হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কোরআন পাক হিফজ করানাের পাশাপশি লিপিবদ্ধ করে রাখারও বিশেষ সুব্যবস্থা করেছিলেন। বিশিষ্ট কয়জন লেখাপড়া জানা সাহাবীকে এ দায়িত্বে নিয়ােজিত করে রাখা হয়েছিল। 

হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বর্ণনা করেন, আমি ওহী লিখে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম। যখন তার প্রতি ওহী নাযিল হতো, তখন সর্ব শরীরে মুক্তার মতাে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিত।'এ অবস্থা শেষ হওয়ার পর আমি দুম্বার চওড়া হাড় অথবা লিখন উপযােগী অন্য কোন কিছু নিয়ে হাযির হতাম। লেখা শেষ করার পর কোরআনের গুন আমার শরীর পর্যন্ত এমন অনুভূত হতাে যে, আমার পা ভেঙে পড়তাে মনে হতো আমি যেন চলৎশক্তি লেখা শেষ হলে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলতেন। যা লিখেছ আমাকে পড়ে শোনাও। আমি লিখিত অংশ পড়ে শােনাতাম। কোথাও কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তিনি অক্ষ তা অন্ধ কৰি দিতেন। এরপর সংশ্লিষ্ট অংশই অন্যদের সামনে তেলাওয়াত করতেন। (মাজমাউয-যাওয়ায়েদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৬; তিবরানী)

হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) ছাড়াও যারা ওহী লিপিবদ্ধ করে রাখার দায়িত্ব পালন করতেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম চার খলীফা, হযরত উবাই ইবনে কা'ব, হক যুবাইর ইবনে আওয়াম, হযরত মুয়াবিয়া, হযরত মুগীরা ইবনে শােবা, হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ, হযরত সাবেত ইবনে কায়েস, হযরত আব্বাস ইবনে সায়ীদ রাযিয়াল্লাহু আনহুম-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। (ফতহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮, যাদুল মা'আদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্টা ৩০;

হযরত উসমান রাযিয়াল্লহ আনহু বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি কোন আয়াত নাযিল হওয়ার পর পরই ওহী লিপিবদ্ধ করার কাজে নিয়ােজিত সাহাবীকে ডেকে সংশ্লিষ্ট আয়াতটি কোন সূরায় কোন আয়াতের পর সংযােজিত হবে তা বলে দিতেন এবং সেভাবেই তা লিপিবদ্ধ করা হতো। (রুহুল বারী, ১ম খণ্ড, প, ১৮)

সে যুগে আরবে যেহেতু কাগজ খুবই দুষ্প্রাপ্য ছিল, এজ্জন্য কোরআনের আয়াত প্রধানত পাথর-শিলা, শুকনা চামড়া, খেজুর গাছের শাখা, বাঁশের টুকরা, গাছের পাতা এবং পশুর হাড়ের উপর লেখা হতাে। কোন কোন সময় কেউ কেউ কাগজের টুকরা ব্যাবহার করেছেন বলেও জানা যায়। (ফতহুল বারী; ম খণ্ড, পৃ. ১১)

লিখিত পাণ্ডুলিপিগুলাের মধ্যে এমন একটি ছিল, যেটি স্বয়ং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বিশেষ তত্ত্বাবধানে নিজের জন্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সেটি পরিপূর্ণভাবে কিতাব আকারে না হয়ে পাথর-শিলা, চামড়া প্রভৃতি সে যুগের প্রচলিত লেখন সামগ্রীর সমষ্টিরূপে রক্ষিত হয়েছিল। নিয়মিত লেখকগণ ছাড়াও সাহাবীগণের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কিছু কিছু আয়াত এবং সূরা লিখে রেখেছিলেন। ব্যক্তিগত লিখনের রেওয়াজ ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় তার বোন ও ভগ্নিপতির হাতে কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত সম্বলিত একটি পাণ্ডুলিপি ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। (সীরাতে ইবনে হেশাম)

হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে কোরআন সংরক্ষণ

হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের যুগে চামড়া, হাড়, পাথর-শিলা, গাছের পাতা প্রভূতিতে লিখিত কোরআন শরীফের নােসখী-এক করে পরিপূর্ণ কিতাবের আকারে সংকলিত করার তাকিদ প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগেই অনুভূত হয়। সাহাবীগণ ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য যেসব অনুলিপি তৈরী করেছিলেন, সেগুলাে পূর্ণাঙ্গ ছিল না। অনেকেই আবার আয়াতের সাথে তফসীরও লিখে রেখেছিলেন। 

হযরত আবু বকর (রা) সবগুলাে বিচ্ছিন্ন পাণ্ডুলিপি একত্র করে পরিপূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করত কোরআন পাককে একত্রে সংশ্চিত করার উদোগ গ্রহণ করলেন।

"কি কারণে হযরত আবু বক্কর (রা) কোরআন শরীফের একখানা পরিপূর্ণ পাণ্ডুলিপি তৈরি করে সংরক্ষিত করার অতি প্রয়ােজনীয়তার কথা বেশি করে অনুভব করেছিলেন, সে সম্পর্কে হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বর্ণনা করেনঃ ইয়ামামার যুদ্ধের পর একদিন হযরত আবু বকর (রা) আমাকে জরুরী তলব দিলেন। আমি সেখানে পৌঁছে দেখি, হযরত উমর (রা) সেখানে রয়েছেন। আমাকে দেখে হযরত আবু বকর (রা) বললেনঃ হযরত উমর (রা) এসে আমাকে বলছেন, ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফেজে কোরআন শহীদ হয়ে গেছেন। এমনভাবে বিভিন্ন যুদ্ধে যদি হাফেজ সাহাবীগণ শহীদ হতে থাকেন, তবে এমন পরিস্থিতি উদ্ভব হওয়া বিচিত্র নয়, যখন কোরআনের কিছু অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সে মতে আমার অভিমত হচ্ছে, অনতিবিলম্বে আপনি বিশেষ নির্দেশ প্রদান করে কোরআন শরীফ একত্রে সংকলিত করার ব্যবস্থা করুন।

আমি হযরত উমর (রা)-কে বলেছি যে, যে কাজ হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম করেন নি, সে কাজ আমার পক্ষে করা সমীচীন হবে কিনা। '

“হযরত উমর (রা) জবাব দিয়েছেন। আল্লাহর কসম, এ কাজ হবে খুবই উত্তম। একথা তিনি বারবার বলতে থাকায় আমার মনও এ ব্যাপারে সায় দিচ্ছে। অতঃপর হযরত আবু বকর (রা) আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, “তুমি কী জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন উদ্যমী যুবক; তােমার সততা ও সাধুতা সম্পর্কে কারাে কোন বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ নেই। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের যমানায় তুমি ওহী লিপিবদ্ধ করার কাজ করেছ। সুদুৱাং তুমিই বিভিন্ন লােকের কাছ থেকে কোরআনের বিক্ষিপ্ত সুরা ও আয়াতসমূহ একত্র করে লিখতে শুরু কর।” | হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বলেন : আল্লাহর কসম, এরা যদি আমাকে একটি পাহাড় স্থানান্তর করার নির্দেশ দিতেন, তবুও বােধ হয় তা আমার পক্ষে এতটুকু কঠিন বলে মনে হতাে না, যত কঠিন মনে হতে লাগলাে পবিত্র কোরআন একত্রে লিপিবদ্ধ করার কাজটি। আমি নিবেদন করলামঃ আপনি কি করে সে কাজ করতে চান, যে কাজ খােদ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম করেন নি। হযরত আবু বকর (রা) জবাব দিলেন? আল্লাহর কসম, এ কাজ খুবই উত্তম হবে। বারবার তিনি আমাকে একই কথা বলতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলা এ কাজের যথার্থতা সম্পর্কে আমার মনেও প্রত্যয় সৃষ্টি করে দিলেন। এরপর থেকেই আমি খেজুরের ডাল, পাথর, হাড়, চামড়া প্রভৃতিতে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন সূরা ও আয়াত একত্র করতে শুরু করলাম। লােকজনের স্মৃতিতে সংরক্ষিত কোরআনের সাথে যাচাই করে সেগুলাে ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করার কাজ সমাপ্ত করলাম। (সহীহ বােখারী, কিতাবু ফাযায়িলিল কোরআন)

প্রসঙ্গত এখানে যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) কর্তৃক কোরআন শরীফ একত্রে সংকলন করার ব্যাপারে গৃহীত কার্যক্রমটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা প্রয়ােজন বলে মনে করি।

আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি নিজেও হাফেজে কোরআন ছিলেন। সুতরাং নিজের স্মৃতি থেকেই সম্পূর্ণ কোরআন লিপিবদ্ধ করতে সমর্থ ছিলেন । তাছাড়া শত শত হাফেজ বর্তমান ছিলেন, তাদের একত্র করেও সমগ্র কোরআন একত্রে লিপিবদ্ধ করা সহজ ছিল, বিশেষত হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের তত্ত্বাবধানে যে পাণ্ডুলিপিটি তৈরি হয়েছিল, সেটি থেকেও তিনি নকল করে নিতে পারছেন। কিন্তু তা না করে সবগুলাে উপকরণ একত্র করেই এ কাজ সম্পাদন করেন। প্রতিটি আয়াতের ক্ষেত্রেই তিনি নিজের স্মৃতি, লিখিত দলীল, অন্যান্য হাফেজের তেলাওয়াত প্রভৃতি সবগুলাের সাথে যাচাই করে সর্বসম্মত বর্ণনার ভিত্তিতেই তার পাণ্ডুলিপি লিপিবদ্ধ করেছেন। হয়ূর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্পমি যেসব লােককে দিয়ে ওই লিপিবদ্ধ করাতেন, সাধারণ ঘোষণা প্রচার করে সে সবগুলাে লােখা একত্র করার ব্যবস্থা। করেন। যেসব লিখিত দলীল সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক হযরত যায়েদ (রা)-এর নিকট হাযির করা হলাে, সেগুলাে যাচাই করার জন্য নিম্নোক্ত চারটি পদ্ধতি অবলম্বন করলেন-
১. সর্বপ্রথম তিনি তাঁর স্মৃতিতে রক্ষিত কোরআনের সাথে সেগুলাে যাচাই করতেন।

২. হযরত উমর (রা)-ও হাফেজে কোরআন ছিলেন। হযরত আবু বকর (রা) তাকেও হযরত যায়েদ (রা)-এর সঙ্গে এ কাজে নিয়ােজিত করেছিলেন। তাঁরা যৌথভাবে লিখিত নােসখাগুলাে গ্রহণ করতেন এবং একজনের পর অন্যজন স্ব-স্ব স্মৃতির সঙ্গে যাচাই করতেন। (ফতহুল বারী, আবু দাউদ)

৩. এমন কোন লিখিত আয়াতই গ্রহণ করা হহে না, যে পর্যন্ত অন্তত দু'জন বিশ্বস্ত সাক্ষী এ মর্মে সাক্ষ্য না দিছেন যে, এগুলাে খােদ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাঙ্কামের সামনে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। (এতকাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬০)

৪. অতঃপর লিখিত আয়াতগুলাে অন্যান্য সাহাবী কর্তৃক লিখিত পাণ্ডুলিপির সাথে সুষ্ঠুভাবে যাচাই করে মূল পাণ্ডুলিপির অন্তর্ভুক্ত করা হতাে। (আল-বােরহান, ফী উলুমিল-কোরআন, যারাকশী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৮)।

হযরত আবু বকরের যমানায় কোরআন সংকলন করার ব্যাপারে অবলম্বিত উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলো উত্তমরূপে অনুধাবন করার পরই হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা)-এর কথাটির অর্থ পরিষ্কার বােঝা যাবে যে, সূরা বারাআত-এর শেষ আয়াত-  لَقَدۡ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ থেকে শেষ পর্যন্ত অংশটি শুধু হযরত আবু খুযায়মা (রা)-এর কাছে পাওয়া যায়। এ কথার অর্থ এ নয় যে, এ আয়াত কয়টি শুধু সাহাবী হযরত আবু খুযায়মা (রা)-ই জানতেন, অন্য কেউ জানতেন না কিংবা অন্য কারাে স্মৃতিতে ছিল না অথবা অন্য কারাে কাছে লিখিত আকারে ছিল না বরং এই কথার অর্থ এই যে, খােদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের তত্ত্বাবধানের লিখিত দলীল হিসাবে এবং উপরিউক্ত চার শর্তে উত্তীর্ণ এ অংশটুকু কেবল আবু খুযায়মা (রা)-ই পেশ করেছিলেন। অন্যথায় শত শত হাফেজের স্মৃতিতে ও লিখিত পূর্ণ কোরআনের নােসখায় এ কয়টি আয়াতও অবশ্যই ছিল। শুধু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের যমানায় ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য পৃথকভাবে লিখিত এ আয়াত আবু খুযায়মা (রা)-ই পেশ করেছিলেন। (আল বােরহান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৪-২৩৫)

মােটকথা, হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) অসাধারণ সাবধানতার সাথে কোরআন শরীফের পরিপূর্ণ নােসখা তৈরি করে ধারাবাহিকভাবে কাগজে লিপিবদ্ধ করেন। (আল-এতকান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬০)

কিন্তু যেহেতু প্রতিটি সূরা পৃথক পৃথক করে লেখা হয়েছিল, এজন্য সেটি অনেকগুলাে সহীফায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তখনকার পরিভাষায় এ সহীফাগুলােকে “উন্ম' বা মূল পাণ্ডুলিপি বলে আখ্যায়িত করা হতাে। এ পাণ্ডুলিপির বৈশিষ্ট্য ছিল।

১. আয়াতগুলাে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত ধারায় লিপিবদ্ধ করা হলেও সূরাগুলাের ধারাবাহিকতা ছিল না। প্রতিটি সূরা পৃথক পৃথক লিখিত হয়েছিল। (আলএতকান)

২. এ নােসথায় পূর্ববর্ণিত কোরআনের সাতটি কেরাআতই সন্নিবিষ্ট হয়েছিল। (মানাহেলুল| এরফান, তারীখুল-কোরআন, কুর্দী)

৩. যেসব আয়াতের তেলাওয়াত প্রচলিত ছিল সবগুলাে আয়াতই এতে ধারাবাহিকরূপে লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

৪, নােসখাটি এ উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, যেন প্রয়ােজনৰােধে উম্মতের সবাই এইটি থেকে নিজ নিজ নােসখা শুদ্ধ করে নিতে পারেন।

হযরত আবু বকর (রা)-এর উদ্যোগে সংকলিত এ নােসখাটি তার কাছেই রক্ষিত ছিল। তার ইন্তিকালের পর এটি হযরত উমর (রা) নিজের হেফাজতে নিয়ে নেন। হযরত উমর (রা)-এর শাহাদাতের পর নােসখাটি উম্মুল মু'মিনীন হযরত হাফসা (রা)-এর কাছে রক্ষিত থাকে। শেষ পর্যন্ত হযরত উসমান (রা) কর্তৃক সূরার তরতীব অনুসারে লিখন পদ্ধতিসহ কোরআনের সর্বসম্মত শুদ্ধতম নােসখা প্রস্তুত হয়ে চারদিকে বিতরিত হওয়ার পর হযরত হাফসা (আ)-এর নিকট রক্ষিত নােসখাটি নষ্ট করে ফেলা হয়। কেননা তখন সর্বসম্মত লিখন-পদ্ধতি ও সূরার তরতীববিহীন কোন নােসখ অবশিষ্ট থাকলে সর্বসাধারণের পক্ষে বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলেই এরূপ করা হয়েছিল। (ফতহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৬) 

হযরত উসমান (রা)-এর আমলে কোরআন সংরক্ষণ

হযরত উসমান (রা) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর ইসলাম আরবের সীমান্ত অতিক্রম করে ইরান ও রােমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি নতুন এলাকার লােক ইসলাম গ্রহণ করার পর যেসব মুজাহিদ কিংবা বণিকের মাধ্যমে তারা ইসলামের দৌলত লাভ করেন, তাদের নিকটই কোরআন শরীফ শিক্ষা করতেন। ইতিপূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, কোরআন শরীফ সাত হরফ বা কেরাআতে নাযিল হয়েছিল। সাহাবীগণও হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে বিভিন্ন ক্বেরাআতেই কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষা করেছিলেন। সে জন্য প্রত্যেক সাহাবীই যে কেরাআতে শিক্ষা করেছিলেন সে কেরাআতেই স্ব স্ব শাগরেদগণকে কোরআন শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। এভাবেই বিভিন্ন ক্বেরাআত পদ্ধতি ও বহু দূরদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। যেসব এলাকার লােকেরা এ তথ্য অবগত ছিলেন যে, কোরআন শরীফ সাত কেরাআত পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে, সে সব এলাকায় কোন অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু দূর-দূরান্তের লােকদের কাছে কোরআনের বিভিন্ন কেরাতি ইত্যাদি সম্পর্কিত পূর্ণ তথ্য ও জ্ঞানের অপ্রতুলতা হেতু কোথাও কোথাও কুেরাআতের পার্থক্যকে কেন্দ্র করে নানা মতভেদ এমনকি ঝগড়া-বিবাদ পর্যন্ত হতে আরম্ভ করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কেৱঅতি পদ্ধতিকে শুদ্ধ এবং অন্যদের কুেরাআতকে ভুল বলে চিহ্নিত করতে শুরু করে। ফলে ভুল বােঝাবুঝি শুরু হয়। এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম থেকে বহুল সমর্থিত, নিঃসন্দেহ বর্ণনা-সূত্রে প্রাপ্ত, কেরাআত রীতিকে ভুল অভিহিত করার গােনাহু থেকে মানুষকে রক্ষা এবং পারস্পরিক মতবিরােধের অতি একটা নির্ভরযােগ্য সমাধান অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তখন পর্যন্ত মদীনা শরীফে রক্ষিত হযরত যায়েদ বিন সাবেত (রা) কর্তৃক লিখিত নােসখা ব্যতীত অন্য কারাে নিকট এমন কোন নােসখা ছিল না, যা অভ্রান্ত দলীলরূপে দাঁড় করানাে যেতে পারে। কেননা অন্য যেসব নােসখা ছিল সেগুলো যেহেতু ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল, সুতরাং সেগুলোর লিখন পদ্ধতিতে সবগুলাে শুদ্ধ ক্বেরাআত উল্লিখিত থাকত না। এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পন্থা ছিল এই যে, এমন এক লিপি-পদ্ধতির মাধ্যমে কোরআন শরীফ লিপিবদ্ধ করে সমগ্র মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে দেওয়া, যার মাধ্যমে সাত কেরাআতেরই তেলাওয়াত সম্ভব হয় এবং কেরাআতের ক্ষেত্রে কোন মতভেদ দেখা দিলে সে নােসখা দেখে মীমাংসা করে নেওয়া যায়। হযরত উসমান (রা) ভার খিলাফতের যমানায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিরাট কাজটিই সম্পাদন করে গেছেন।

এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করার যে পটভূমি হাদীস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা) আর্মিনিয়া ও আযারবাইজান এলাকায় জিহাদে নিয়ােজিত হন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করেন যে, কোরআন শরীফ তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে নানা ধরনের মতভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। তখন মদীনায় ফিরে এসেই তিনি সােজা, হযরত উসমান (রা)-এর দরবারে হাযির হলেন এবং নিবেদন করলেন । আমীরুল মু'মিনীন, এ উম্মত আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে ইহুদী-নাসারাদের ন্যায় মতভেদের শিকারে পরিণত হওয়ার আগেই আপনি এর একটা সুষ্ঠু প্রতিবিধানের ব্যবস্থা অবলম্বন করুন।
হযরত উসমান (রা) বিষয়টি খুলে বলতে বললেন। হযরত হুযায়ফা (রা) বললেনঃ আমি আর্মেনিয়া এলাকায় জিহাদে লিপ্ত থাকা অবস্থায় লক্ষ্য করেছি, সিরিয়া এলাকার লােকেরা হযরত উবাই ইবনে কা'ব-এর কেরাআত পদ্ধতি অনুসরণে কোরআন তেলাওয়াত করছে। অপরপক্ষে ইরাকের লােকেরা আবদুল্লাহ ইবনে মসউদের কেরাআত পদ্ধতি অনুসরণ করছে। যেহেতু সিরিয়ার লােকেরা ইবনে মসউদের কুেরাআত পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় এবং ইরাকের লােকদের পক্ষেও উবাই ইবনে কা'বের কেরাআত পদ্ধতি শােনার সুযােগ হয়নি। ফলে এদের মধ্যে তেলাওয়াতের ব্যাপারে এমন মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত একে অন্যকে কাফের আখ্যায়িত করা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। | হযরত উসমান (রা) নিজেও এরূপ একটা বিপদের আশংকা করছিলেন। খােদ মদীনা শরীফেও বিভিন্ন ওস্তাদের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত লাগরেদগণের মধ্যে কেরাআতের পার্থক্যকে ভিত্তি করে বেশ উত্তপ্ত মতবিরােধ সৃষ্টি হচ্ছিল। অনেক ক্ষেত্রে এ মতবিরােধের উত্তাপ ওস্তাদগণের কাতারে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল। এমনকি তারা একে অপরের কেরাতকে ভুল বলতে শুরু করেছিলেন।

হযরত হুযায়ফা ইবনুল-ইয়ামান (রা) কর্তৃক দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর হযরত উসমান (রা) এ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট সাহাবীগণকে একত্র করলেন। সকলকে লক্ষ্য করে বললেনঃ আমি শুনতে পেয়েছি যে, এক শ্রেণীর লোক অন্যদেরকে লক্ষ্য করে বলছে যে, আমাদের কেরাআত তােমাদের চাইতে উত্তম এবং সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ অথচ এ ধরনের মন্তব্য কুফরীর পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। সুতরাং এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আপনারা কি পরামর্শ দেন ?

সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ সম্পর্কে কি চিন্তা করেছেন? হযরত উসমান (রা) বললেন, আমার অভিমত হচ্ছে সকল শুদ্ধ বর্ণনা একত্র করে এমন একটা সর্বসম্মত নোসখা তৈরি করা কর্তব্য, যাতে কেরাআত পদ্ধতির মধ্যেও কোন মতভেদের অবকাশ না থাকে। সাহাবীগণ সর্বসম্মতিক্রমে হযরত উসমান (রা)-এর অভিমত সমর্থন করলেন এবং এ ব্যাপারে সর্বোতভাবে সহযােগিতা প্রদান করার অঙ্গীকার করলেন। | এরপর হযরত উসমান (রা) সর্বশ্রেণীর লােককে সমবেত করে একটি জরুরী ঘোষনা দিলেন। তাতে তিনি বললেনঃ আপনারা মদীনা শরীফে আমার অতি নিকটে বসবাস করেও কোরআন শরীফের ব্যাপারে একে অন্যকে দোষারােপ ও মতভেদ করছেন। এতেই বােঝা যায় যে, যারা আমার থেকে দূর থেকে দূরতর এলাকায় বসবাস করেন, তাঁরা এ ব্যাপারে আরাে বেশি মতভেদ এবং ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়েছেন। সুতরাং আসুন, আমরা সকলে মিলে। কোরআন শরীফের এমন একটা লিখিত নােসখা তৈরী করি, যাতে মতভেদের কোন সুযােগ থাকবে না এবং সবার পক্ষেই সেটি অনুসরণ করা অপরিহার্য কর্তব্য বলে গণ্য হবে।

এ উদ্দেশ্যে হযরত উসমান (রা) সর্বপ্রথম উম্মুল মু'মিনীন হযরত হাফসা (রা)-এর কাছ ' থেকে হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক লিপিবদ্ধ ‘মাসহাফগুলাে চেয়ে আনলেন। এ মাসহাফ | ' সামনে রেখে সুরার তরতীবসহ কোরআনের শুদ্ধতম মাসহাফ' তৈরি করার উদ্দেশ্যে কোরআন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত চারজন মশহুর সাহাবী হযরত যায়েদ বিন সাবেত, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, হযরত সায়ীদ ইবনুল-আস ও হযরত আবদুর রহমান বিন হারেস বিন হিশাম (র) সমন্বয়ে গঠিত এক জামাতের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁদের প্রতি নির্দেশ ছিল হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক সংকলিত মাসহাফকেই শুধু এমন একটা সর্বসম্মত লিখন-পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করা, যে লিপির সাহায্যে প্রতিটি শুদ্ধ ক্বেরাআত-পদ্ধতি অনুযায়ীই তেলওয়াত করা সম্ভব হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন সাহাবীর মধ্যে হযরত যায়েদ (রা) ছিলেন আনসারী এবং অবশিষ্ট তিনজন কোরাইশ। হযরত উসমান (রা) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, যদি লিখন পদ্ধতির ব্যাপারে হযরত যায়েদ (রা)-এর সাথে অন্য তিনজনের মতবিরােধ দেখা দেয়, তবে কোরাইশদের লিপি পদ্ধতি অনুসরণ করবে। কারণ কোরআন যার প্রতি নাযিল হয়েছিল, তিনি নিজে কোরাইশ ছিলেন। কোরাইশদের ব্যবহৃত ভাষাই কোরআনে ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে, চারজন সাহাবীকে লেখার দায়িত্ব অর্পণ করা হলেও অন্য অনেককেই তাদের সাথে সাহায্যকারী হিসাবে যুক্ত করা হয়েছিল। তারা কোরআন লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে নিম্নোক্ত কাজগুলাে সম্পাদন করেন।

এক, হযরত আবু বকর (রা)-এর উদ্যোগে লিখিত যে নােমুখাটি তৈরি করা হয়েছিল, তাতে সূরাগুলাে ধারাবাহিকভাবে না সাজিয়ে প্রতিটি সূরা পৃথক পৃথক নােসখায় লিখিত হয়েছিল। তাঁর সবগুলাে সূরাকে ক্রমানুপাতে একই মাসহাফ'-এ সাজিয়ে দেন। (মুসতাদরাক, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৯)।

দুই, আয়াতগুলাে এমন এক লিখন পদ্ধতি অনুসরণে লেখা হয়, যাতে সবগুলাে শুদ্ধ ক্বেরাআত পদ্ধতিতেই তা পাঠ করা যায়। এ কারণেই অক্ষরগুলাের মধ্যে নােকতা এবং যের-যুবর-পেশ সংযুক্ত হয়নি। (মানাহেলুল এরফান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৪)। | 

তিন, তখন পর্যন্ত কোরআনের সর্বসম্মত এবং নির্ভরযােগ্য একটিমাত্র নােসখা মওজুদ ছিল। তারা একাধিক নােসখা তৈরী করেন। সাধারণ বর্ণনামতে হযরত উসমান (রা) পাঁচখানা নােসখা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু আবূ হাতেম সাজেস্তানী (রা)-এর মতে সাতটি নােসখা তৈরি হয়েছিল। এগুলাের মধ্যে একটি মক্কা শরীফে, একটি সিরিয়ায়, একটি ইয়ামানে, একটি বাহরাইনে, একটি বসরায় এবং একটি কুফায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবশিষ্ট একটি নােসখা বিশেষ যত্ন সহকারে মদীনা শরীফে সংরক্ষিত হয়েছিল। (ফতহুল-বারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৭)

চার, লেখার ব্যাপারে তারা প্রধানত হযরত আবু বকর (রা)-এর মানায় লিখিত নােসখা অনুসরণের সাথে অধিকতর সাবধানতাবশত ঐ সমস্ত পদ্ধতি অনুসরণ করেন, হযরত আবু বকর (রা)-এর যমানায় মূল পাণ্ডুলিপি তৈরি করার সময় যা অনুসৃত হয়েছিল, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের যমানায় লিখিত যে সমস্ত অনুলিপি সাহাবীগণের নিকট সংরক্ষিত ছিল, সেগুলাে পুনরায় একত্র করা হয়। মূল অনুলিপির সাথে সেসব অনুলিপিও নতুনভাবে যাচাই করে দেখা হয়। সাহাবীগণের নিকট যেসব অনুলিপি ছিল, তন্মধ্যে সূরা আহযাব-এর এ আয়াত-  من المؤمنين رجال صدقوا ما عاهدوا الله عليه. শুধু হযরত খুযায়মা বিন সাবেত আনসারী (রা)-এর নােসখায় লিখিত পাওয়া গিয়েছিল। | এর অর্থ এ নয় যে, এ আয়াত অন্য কারাে স্বরণ ছিল না কিংবা হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক সংকলিত অনুলিপিতে লিখিত ছিল না। কেননা, হযরত যায়েদ বিন সাবেত (রা) বর্ণনা করেন | যে, মাসহাফ তৈরি করার সময় সূরা আহযাবের সে আয়াতটি বিচ্ছিন্ন কোন নোসখাতেই পাওয়া যাচ্ছিল না, সেটি আমি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে অনেকবার তেলাওয়াত করতে শুনেছি। এ বর্ণনা থেকে স্পষ্টই বােঝা যায় যে, এ আয়াত হযরত যায়েদ (রা)-সহ অনেক সাহাবীরই স্মরণ ছিল কিংবা এতদ্বারা একথাও বােঝায় না যে, এ আয়াত অন্য কোন লিপিতেও ছিল না। বরং হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক তৈরি করা নোসখায় এ আয়াত লিখিত ছিল। বিচ্ছিন্ন নােসখাগুলাে মূলের সাথে যাচাই করার সময় খােদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের যমানায় সাহাবীগণের ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেসব নােসখা লিখিত হয়েছিল, সেগুলাের মধ্যে এ আয়াত কেবল হযরত খুযায়মা বিন সাবেত (রা)-এর লিখিত নােসখাতে পাওয়া গিয়েছিল।

পাঁচ. কোরআন পাকের এ সর্বসম্মত মাসহাফ তৈরি হওয়ার পর সমগ্র উম্মত এ মাসহাফ-এর ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়ার পর হযরত উসমান (রা) আগেকার বিক্ষিপ্ত সকল নােসখা আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে দেন। কেননা এরপরও ব্যক্তিগত ও অবিন্যস্তভাবে লিখিত নােসখাগুলাে অবশিষ্ট থাকতে দিলে সূরার ক্রমানুপাতিক গ্রন্থনা এবং সর্বসম্মতভাবে প্রতিটি কেরাআতে পাঠোপযােগী লিখন পদ্ধতির ব্যাপারে ঐকমত্য সুষ্ট হওয়ার পরও পুনরায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশংকা অবশিষ্ট থেকে যেতাে।

হযরত উসমান (রা)-এর এ কাজকে সমগ্র উম্মত প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে এ কাজ সমাপ্ত করার ব্যাপারে তাকে সমর্থন ও সহযােগিতা প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা)-এর মন্তব্য, উসমান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ভাল ছাড়া কিছু বলো না। কেননা আল্লাহর কসম, তিনি কোরআনের মাসহাফ তৈরির ব্যাপারে যা কিছু করেছেন, তা আমাদের সামনে আমাদের পরামর্শেই করেছেন।” (ফফুল-বারী, ৯ম অথ, পৃ. ১৫) 

তেলাওয়াত সহজ করার প্রচেষ্টা

হযরত উসমান (রা) কর্তৃক মাসহাফ তৈরির কাজ চূড়ান্ত হওয়ার পর সমগ্র উম্মত ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন যে, হযরত উসমান (রা) অনুসৃত লিখন পদ্ধতি ব্যতীত কোরআন শরীফ অন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণে লিপিবদ্ধ করা জায়েয নয়। ফলে পরবর্তীতে সমস্ত মাসহাফ'ই হযরত উসমান (রা)-এর লিখন পদ্ধতি অনুসরণে লিখিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ হযরত উসমান (রা)-এর তৈরি করা মাসহাফ-এর অনুলিপি তৈরি করেই দুনিয়ার সর্বত্র কোরআন-করীম ব্যাপকভাবে প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যেহেতু মূল উসমানী অনুলিপিতে নােকতা ও যের-যুবর-পেশ ছিল না, সেজন্য অনারবদের পক্ষে এ মাসহাফ-এর তেলাওয়াত অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর ছিল। ইসলাম দ্রুত আরবের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে উসমানী' অনুলিপিতে নােকতা ও যের-যবর-পেশ সংযােজন করার প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে শুরু করে। সর্বসাধারণের জন্য তেলাওয়াত সহজতর করার লক্ষ্যে মুল উসমানী 'মাসহাফ'-এর মধ্যে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়া অবলম্বিত হয়। সংক্ষেপে প্রক্রিয়াগুলোর বিবরণ নিম্নরূপঃ

নোক্‌তা

প্রাচীন আরবদের মধ্যে হরফে নোক্তা সংযোজন করার রীতি প্রচলিত ছিল না। বস্তুত তখনকার দিনের লোকদের পক্ষে নোকতাবিহীন লিপি পাঠ করার ব্যাপারে কোন অসুবিধাও হতো না। প্রসঙ্গ ও চিহ্ন দেখেই তাঁরা বাক্যের পাঠোদ্ধার করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কোরআন শরীফের ব্যাপারে আদৌ কোন অসুবিধার আশংকা এজন্য ছিল না যে, কোরআন তেলাওয়াতে মোটেও অনুলিপি নির্ভর ছিল না। হাফেজগণের তেলাওয়াত থেকেই লোকেরা তেলাওয়াত শিক্ষা করতেন। হযরত উসমান (রা) মুসলিম জাহানের বিভিন্ন এলাকায় কোরআনের 'মাসহাফ' প্রেরণ করার সময় সাথে বিশিষ্ট তেলাওয়াতকারী হাফেজও প্রেরণ করেছিলেন, যেন লোকজনের মাসহাফের পাঠোদ্ধারের ব্যাপারে তাঁরা পথপ্রদর্শন করতে পারেন।

কোরআন করীমের হরফসমূহে সর্বপ্রথম নোক্তার প্রচলন কে করেছিলেন, এ সম্পর্কিত বর্ণনায় মতভেদ দেখা যায়। কোন কোন বর্ণনাকারীর মতে এ কাজ বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ তাবেয়ী হযরত আবুল আসওয়াদ দোয়ালী (র) আনজাম দেন। (আল-বোরহান, ১ম খণ্ড, পৃ. 200)

অনেকের মতে, আবুল আসওয়াদ দোয়ালী এ কাজ হযরত আলী (রা)-এর নির্দেশে আনজাম দিয়েছিলেন। (সুবহুল-আশা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫৫)

কারো কারো মতে কুফার শাসনকর্তা যিয়াদ ইবনে সুফিয়ান আবুল আসওয়াদকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছিলেন। অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ হযরত হাসান বসরী (র), হযরত ইয়াহ্ইয়া ইবনে ইয়ামা'র ও হযরত নসর ইবনে আসেম লাইসী (র)-এর দ্বারা এ কাজ করিয়েছিলেন। (তাফসীরে কুরতুবী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬)

হরকত

নোকতার ন্যায় প্রথম অবস্থায় কোরআন শরীফে হরকত বা যের-যবর-পেশ ইত্যাদিও ছিল না। সর্বপ্রথম কে হরকত-এর প্রবর্তন করলেন এ ব্যাপারেও বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে। কারো কারো মতে সর্বপ্রথম হযরত আবুল আসওয়াদ দোয়ালী হরকত প্রবর্তন করেন। আবার অনেকেরই অভিমত হচ্ছে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামা'র ও নসর ইবনে আসেম লাইসীর দ্বারা একাজ করিয়েছিলেন। (কুরতুবী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৩)

এ সম্পর্কিত সবগুলো বর্ণনা একত্র করে বিষয়টি আনুপূর্বিক পর্যালোচনা করলে অনুমিত হয় যে, কোরআন শরীফের জন্য হরকত সর্বপ্রথম হযরত আবুল আসওয়াদ দোয়ালীই আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আবিষ্কৃত হরকতসমূহ আজকাল প্রচলিত হরকতের মত ছিল না। বরং যবর দিতে হলে হরফের উপরিভাগে একটা নোক্তা এবং যের দিতে হলে নিচে একটা নোকতা বসিয়ে দেওয়া হতো। অনুরূপ পেশ-এর উচ্চারণ করার জন্য হরফের সামনে একটা নোকতা ও তানবীন-এর জন্য দু'টি নোকতা ব্যবহার করা হতো। আরো কিছুকাল পরে খলীল ইবনে আহমদ (র) হামযা ও তাশদীদের চিহ্ন তৈরি করেন। (সুবহুল-আ'শা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬১)

এরপর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ উদ্যোগী হয়ে হযরত হাসান বসরী (র), ইয়াহ্ইয়া ইবনে ইয়া'মার ও নসর ইবনে আসেম লাইসী প্রমুখকে কোরআন শরীফে নোকতা ও হরকত প্রদানের "জন্য নিয়োজিত করেছিলেন। হরকতগুলোকে আরো সহজবোধ্য করার জন্য উপরে, নিচে বা পাশে অতিরিক্ত বিন্দু ব্যবহার করার হযরত আবুল আসওয়াদ প্রবর্তিত পদ্ধতির স্থলে বর্তমান আকারে হরকতের প্রবর্তন করা হয়, যেন হরফে নােকতার সঙ্গে হরকতের নােকতার সংমিশ্রণে জটিলতার সৃষ্টি না হয়।

মনযিল

সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীগণের অনেকেই সপ্তাহে অন্তত এক খতম কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। এজন্য তাঁরা দৈনিক তেলাওয়াতের একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। সে পরিমাণকেই 'হেযব” বা মনুযিল বলা হতাে। এ কারণেই কোরআন শরীফ সাত মঞ্জিলে বিভক্ত হয়েছে। (আল-বােৱহন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫০)

পারা

কোরআন শরীফ সমান ত্রিশটি খণ্ডে বিভক্ত। এ খগুগুলােকে 'পারা" বলে অভিহিত করা হয়। পারার এ বিভক্তি অর্থ বা বিষয়বস্তুভিত্তিক নয় বরং পাঠ করার সুবিধার্থে সমান ত্রিশটি খণ্ড করে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। কেননা অনেক সময় দেখা যায়, কোন একটা প্রসঙ্গের মাঝখানেই এক পারা শেষ হয়ে নতুন পারা আরম্ভ হয়ে গেছে। | 

ত্রিশ পারায় বিভক্তি করা কার দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে, সে তথ্য উদ্ধার করা কঠিন। অনেকের ধারণা হযরত উসমান (রা) যখন কোরআন শরীফের অনুলিপি তৈরি করেন, তখন এ ধরনের ত্রিশটি খন্ডে তা লিখিত হয়েছিল এবং তা থেকেই ত্রিশ পারার প্রচলন হয়েছে। কিন্তু পূর্ববর্তী যুগের কোন নির্ভরযােগ্য আলেমের কিতাবেই আমরা এ তথ্যের সমর্থন পাইনি। আল্লামা বদরুদ্দীন যুরকাশী (র) লিখেন, কোরআনের ত্রিশ পারা বহু আগে থেকেই চলে আসছে, বিশেষত মাদ্রাসায় শিশুদেরকে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রেই এ ত্রিশ পারার রেওয়াজ বেশি চলে আসছে। | (আল-বােরহান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫০; মানাহেলুল এরফান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০২)।

মনে হয়, ত্রিশ পারার এ বিভক্তি সাহাবায়ে কিরামের যুগের পর শিক্ষাদান কার্যে সুবিধার জন্য করা হয়েছে। 

রুকু

আখমাস’ ও ‘আশার'-এর আলামত পরবর্তী পর্যায়ে পরিত্যক্ত হয়ে অন্য একটা আলামতের | ব্যবহার প্রচলিত হয়। বর্তমানকাল পর্যন্ত প্রচলিত এ চিহ্নটিকে রুকু বলা হয়। এ চিহ্নটি আয়াতে আলােচিত বিষয়বস্তুর অনুসরণে নির্ধারণ করা হয়েছে। একটা প্রসঙ্গ যেখানে এসে শেষ হয়েছে, সেখানে পৃষ্ঠার পাশে রুকুর চিহ্নম্বরূপ একটা অক্ষর অংকিত করা হয়। | এই চিহ্নটি কখন কার দ্বারা প্রচলিত হয়েছে, অনেক তালাশ করেও এ সম্পর্কিত কোন নিরযােগ্য তথ্য আমরা উদ্ধার করতে সক্ষম হইনি। তবে বােঝা যায় যে, এ চিহ্ন দ্বারা আয়াতের এমন একটা মােটামুটি পরিমাণ নির্ধারণ করা উদ্দেশ্য, যেটুকু সাধারণত নামাযের এক রাকাআতে পঠিত হতে পারে। নামাযে এটুকু তেলাওয়াত করে রুকু করা যেতে পারে, এদিকে লক্ষ্য রেখেই বােধ হয় একে রুকু বলা হয়।

সমগ্র কোরআন শরীফে ৫৪০টি রুকু রয়েছে। যদি তারাবীহ নামাযে প্রতি রাকাআতে এক রুকু করে পড়া হয় 'তবে সাতাশে রাতে কোরআন খতম হয়ে যায়। (ফতওয়ায়ে আলমগিরী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৪, তারাবীহ অধ্যায়) '। 

কয়েকটি যতিচিহ্ন

শুদ্ধ তেলাওয়াতের সুবিধার্থে আয়াতের মধ্যে কয়েক প্রকারের যতিচিহ্নের প্রচলন করা হয়েছে। এ চিহ্নগুলাের দ্বারা কোথায় থামতে হবে কোন্ জায়গায় কিছুটা শ্বাস নেওয়া যাবে সম্পর্কিত নির্দেশাবলী জানা যায়। এ চিহ্নগুলােকে পরিভাষায় 'রুমূযে আওকাফ বলা হয়। এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, একজন আরবী না জানা লোেকও যেন সহজে বুঝতে পারেন, কোথায় কতটুকু থামতে হবে। কোন্‌খানে থামলে পর অর্থের বিকৃতি ঘটতে পারে। এ চিহ্নগুলাের অধিকাংশ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে তাইফুর সাজাওয়াশী কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছিল। (আন্-নশরু ফী বেরাআতিল-আশূর, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২৫)' 





******************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url