সাহাবাগণের জীবনকথা-৩১ || আলী ইবন আবী তালিব (রাঃ)- এর জীবনী





আলী ইবন আবী তালিব (রা)


হযরত আলী (রা) ছিলেন নবী খান্দানের সদস্য, যিনি নবীর (সা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “আলা মাদীনাতুল ইলম ওয়া আলী বাবুহা” আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী সেই নগরীর প্রবেশদ্বার।

আলী (রাঃ) এর বংশ পরিচয়

নাম আলী, লকব আসাদুল্লাহ, হায়দার ও মুরতাজা, কুনিয়াত আবুল হাসান ও আবু | তুরবি। পিতা আবু তালিব অবিন্দু মান্নাফ, মাতা ফাতিমা। পিতা-মাতা উভয়ে কুরাইশ বংশের হাশিমী শাখার সন্তান। আলী রাসূলুল্লাহর (সা) আপন চাচাতাে ভাই।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পরিবারেই আলী (রাঃ) এর বেড়ে উঠা


রাসূলুল্লাহর (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির দশ বছর পূর্বে তার জন্ম। আবু তালিব ছিলেন ছাপােষা মানুষ। চাচাকে একটু সাহায্য করার উদ্দেশ্যে রাসূল (সা) নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন আলীকে। এভাবে নবী পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে তিনি বেড়ে ওঠেন। রাসূল (সা) যখন নবুওয়াত লাভ করেন, আলীর বয়স তখন নয় থেকে এগারাে বছরের মাধ্যে। একদিন ঘরের মধ্যে দেখলেন, রাসূলে কারীম (সা) ও উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা (রা) সিজদাবনত। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কি? উত্তর পেলেন, এক আল্লাহর ইবাদাত করছি। তোমাকেও এর দাওয়াত দিচ্ছি। আলী (রাঃ) নবী (সাঃ) এর দাওয়াত বিনা দ্বিধায় কবুল করেন। মুসলমান হয়ে যান। কুফর, শিরক ও জাহিলিয়াতের কোন অপকর্ম তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

কিশোরদের মধ্যে প্রথম মুসলিম


রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সর্ব প্রথম হযরত খাদীজাতুল কুবরা (র) নামায আদায় করেন। এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। অবশ্য আবু বকর, আলী ও যায়িদ বিন হারিসা—এ তিন জনের কে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। (তাবাকাত। ৩/২১) ইবন 'আব্বাস ও সালমান ফারেসীর (রা) বর্ণনা মতে, উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার (রাঃ) পর আলী (রাঃ) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। 'তবে এ সম্পর্কে সবাই একমত যে, মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদীজা, বয়স্ক আযাদ পুরুষদের মধ্যে আবু বকর, দাসদের মধ্যে যায়িদ বিন হারিস ও কিশােরদের মধ্যে আলী (রা) প্রথম মুসলমান।

নবুওয়াতের তৃতীয় বছরে রাসূলে কারীম (সা) হুকুম দিলেন আলীকে, কিছু লোকের আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর। আবদুল মুত্তালিব খান্দানের সব মানুষ উপস্থিত হল। আর পর্ব শেষ হলে রাসূল (সা) তাদেকে সম্বােধন করে বললেন আমি এমন এক জিনিস নিয়ে এসেছি, যা দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য কল্যাণকর। আপনাদের মধ্যে কে আমার সঙ্গী হবেন। সকলেই নিরব। হঠাৎ আলী (রা) বলে উঠলেনঃ “যদিও আমি অল্পবয়স্ক, চোখের রােগে আক্রান্ত, দুর্বল দেহ, আমি সাহায্য করবো আপনাকে।

হিজরাতের রাতে আলী (রাঃ) এর সাহায্য


হিজরাতের সময় হল। অধিকাংশ মুসলমান মক্কা ছেড়ে মদীনা চলে গেছেন। রাসূলে কারীম (সা) আল্লাহর হুকুমের প্রতীক্ষায় আছেন। এ দিকে মক্কার ইসলাম বিরােধী শক্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাসূলে কারীমকে (সা) দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে (সা) এ খবর জানিয়ে দেন। তিনি মদীনায় হিজরাতের অনুমতি লাভ করেন। কাফিরদের সন্দেহ না হয়, এ জন্য আলীকে রাসূল (সা) নিজের বিছানায় ঘুমাবার নির্দেশ দেন এবং সিদ্দীকে আকবরকে সঙ্গে করে রাতের অন্ধকারে মদীনা। রওয়ানা হন। আলী (রা) রাসূলে কারীমের (সা) চাদর মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে অত্যন্ত

আনন্দ সহকারে ঘুমালেন। তিনি জানতেন, এ অবস্থায় তার জীবন চলে যেতে পারে। কিন্তু তার প্রত্যয় ছিল, এভাবে জীবন গেলে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কিছু হবে না। সুবহে সাদিকের সময় মক্কার পুরুষরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল, রাসূলে কারীমের (সা) স্থানে তারই এক ভক্ত জীবন কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হয়ে শুয়ে আছে। তারা ব্যর্থ হয় এবং আল্লাহ তাআলা আলীকে (রা) হিফাজত করেন।

এ হিজরাত প্রসঙ্গে হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ 'রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা রওয়ানার পূর্বে আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি মক্কায় থেকে যাব এবং লােকদের যেসব আমানত তার কাছে আছে তা ফেরত দেব। এ জন্যই তো তাকে “আল-আমীন' বলা হতাে। আমি তিনদিন মক্কায় থাকলাম। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা) পথ ধরে মদীনার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। অবশেষে বনী 'আমর ইবন আওফ যেখানে রাসূল (সা) অবস্থান করছিলেন, আমি উপস্থিত হলাম। কুলসুম ইবন হিমের বাড়ীতে আমার অশ্রয় হল।' অন্য একটি বর্ণনায়, আলী (রা) রবীউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝি কুবায় উপস্থিত হন। রাসূল (সা) তখনো কুবায় ছিলেন। (তাবাকতিঃ ৩/২২)।

মাদানী জীবনের সূচনাতে রাসূল (সা) যখন মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে মুখত বা দ্বীনী-ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করছিলেন, তিনি নিজের একটি হাত আলীর (রা) কাঁধে রেখে বলেছিলেন, আলী তুমি আমার ভাই। তুমি হবে আমার এবং আমি হব তােমার উত্তরাধিকারী।' (ভাবাকাত ঃ ৩/২২) পরে রাসূল (সা) আলী ও সাহল বিন হুনাইফের মধ্যে ভ্রাতুসম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন। (তাবাকাত ঃ ৩/২৩)

ইসলামের জন্য হযরত আলীর (রাঃ) অবদান


হিজরী দ্বিতীয় সনে হযরত আলী (রা) রাসূলে কারীমের (সা) জামাই হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। রাসুলুল্লাহর (সা) প্রিয়তমা কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমার (রা) সাথে তার বিয়ে হয়। | ইসলামের জন্য হযরত আলীর (রা) অবদান অবিস্মরণীয়। রাসূলে কারীমের (সা) যুগের সকল যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় তিনি দেন। এ কারণে হুজুর (সা) তাকে ‘হায়দার' উপাধিসহ যুল-ফিকার' নামক একখানি তরবারি দান করেন।

একমাত্র তাবুক অভিযান ছাড়া সকল যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন। এতে তার সাল। শশী মালের জন্য তিনি ছিলেন চিহ্নিত। কাতাদা থেকে বর্ণিত | বদরসহ প্রতিটি যুদ্ধে আলী ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) পতাকাবাহী। (তাবাকাতঃ ৩/২৩) উহুদে যখন অন্যসব মুজাহিদ পরাজিত হয়ে পলায়নৰত ছিলেন, তখন যে ক’জন মুষ্টিমেয় সৈনিক রাসূলুল্লাহকে (সা) কেন্দ্র করে ব্যুহ রচনা করেছিলেন, আলী (রাঃ) তাদের একজন। অবশ্য পলায়নকারীদের প্রতি আল্লাহর ক্ষমা ঘােষিত হয়েছে।

ইবন ইসহাক থেকে বর্ণিত। খন্দকের দিনে আমর ইবন আবদে উদ্দ বর্ম পরে বের হল। সে হুংকার ছেড়ে বললােঃ কে আমার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবর্তীর্ণ হবে? আলী উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর নবী, আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা) বললেনঃ 'এ হচ্ছে "আমর তুমি বস।' আমর আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল? আমার সাথে লড়বার মত কেউ নেই। তােমাদের সেই জান্নাত এখন কোথায়, যাতে তোমাদের নিহতরা প্রবেশ করবে বলে তােমাদের ধারণা? তােমাদের কেউই এখন আমার সাথে লড়তে সাহসী নয়? আলী (রাঃ) উঠে পড়লেন। বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা) বললেন : বস। তৃতীয় বারের মত আহবান জানিয়ে আমর তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলাে। আলী (রাঃ) আবারাে উঠে দাঁড়িয়ে আরজ করলেন? ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা) বললেনঃ সে তাে আমর। আলী (রা) বললেনঃ তা হােক। এবার আলী (রাঃ) অনুমতি পেলেন। আলী (রাঃ) তাঁর একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আমরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমর জিজ্ঞেস করলাে? তুমি কে? বললেনঃ আলী (রাঃ)। সে বললো আবদে মান্নাফের ছেলে আলী? বললেন, আমি আবু তালিবের ছেলে আলী। সে বললােঃ ভাতিজা, তােমার রক্ত ঝরানাে আমি পছন্দ করিনে। আলী বললেন। আল্লাহর কসম, আমি কিন্তু তােমার রক্ত ঝরানো অপসন্দ করিনে। এ কথা শুনে আমর ক্ষেপে গেল। নিচে নেমে এসে বারি টেনে বের করে ফেললো। সে তরবারি যেন আগুনের শিখা। সে এগিয়ে এসে আলীর ঢালে আঘাত করে ফেড়ে ফেললাে। আলী পাল্টা এক আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। এ দৃশ্য দেখে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠেন। তারপর আলী নিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে ফিরে আসেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবন কাসীর ৪/১০৬)।

সপ্তম হিজরীতে খাইবার অভিযান চালানাে হয়। সেখানে ইয়াহুদীদের কয়েকটি সুদৃঢ় কিল্লা ছিল। প্রথমে সিদ্দীকে আকবর, পরে ফারুকে আজমকে কিল্লাগুলি পদানত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউই সফলকাম হতে পারলেন না। নবী (সা) ঘােষণা করলেন। কাল আমি এমন এক বীরের হাতে ঝান্ডা তুলে দেব যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রিয়পাত্র। তারই হাতে কিল্লাগুলির পতন হবে। পরদিন সকালে সাহাবীদের সকলেই আশা করছিলেন এই গৌরবটি অর্জন করার। হঠাৎ আলীর ডাক পড়লাে। তাঁরই হাতে খাইবারের সেই দুর্জয় কিল্লাগুলির পতন হয়।

তাবুক অভিযানে রওয়ানা হওয়ার সময় রাসূল (স) আলীকে (রা) মদীনায় স্থলাভিষিক্ত করে যান। আলী (রা) আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যাচ্ছেন, আর আমাকে নারী ও শিশুদের কাছে ছেড়ে যাচ্ছেন? উত্তরে রাসূল (সা) বললেনঃ হারুন যেমন ছিলেন মুসার, তেমনি তুমি হচ্ছো আমার প্রতিনিধি। তবে আমার পরে কোন নবী নেই। (তাবাকাত ৩২৪)

নবম হিজরীতে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে প্রথম ইসলামী হজ্জ্ব অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) ছিলেন আমীরুল। তবে কাফিরদের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি বাতিল ঘােষণার জন্য রাসূল (সা) আলীকে (রা) বিশেষ দূত হিসেবে পাঠান।

দশম হিজরীতে ইয়ামনে ইসলাম প্রচারের জন্য হযরত খালিদ সাইফুল্লাহকে পাঠানাে হয়। দু'মাস চেষ্টার পরও তিনি সকলকাম হতে পারলেন না। ফিরে এলেন। রাসূলে করীম (স) আলীকে (রা) পাঠানাের কথা ঘােষণা করলেন। আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ আপনি আমাকে এমন লােকদের কাছে পাঠাচ্ছেন যেখানে নতুন নতুন ঘটনা ঘটবে অথচ বিচার ক্ষেত্রে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন : আল্লাহ তোমাকে সঠিক রায় এবং তোমার অন্তরে শক্তিদান করবেন। তিনি আলীর (সা) মুখে হাত রাখলেন। আলী বলেনঃ “অতঃপর আমি কক্ষনাে কোন বিচারে দ্বিধাগ্রস্ত হইনি। যাওয়ার আগে রাসূল (সা) নিজ হাতে আলীর (রা) মাথায় পাপড়ী পরিয়ে দুআ করেন। আলী ইয়ামনে পেীছে তাবলীগ শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সকল ইয়ামনবাসী ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং হামাদান গােত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে যায়। রাসূল (সা) আলীকে (রা) দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। তিনি দুম করেন । আহ, আলীকে না দেখে যেন আমার মৃত্যু না হয়। হযরত আলী বিদায় হজ্জের সময় ইয়ামন থেকে হাজির হয়ে যান।

রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের পর তাঁর নিকট-আত্মীয়রাই কাফন দাফনের দায়িত্ব পালন করেন। হযরত আলী (রা) গােসল দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। মুহাজির ও আনসাররা তখন দুরন্ত বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।

হযরত আবু বকর, হযরত উমার ও হযরত উসমানের (রা) খিলাফত মেনে নিয়ে তাঁদের হাতে বাইয়াত করেন এবং তাদের যুগের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে শরীক থাকেন। অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতেও হযরত উসমানকে পরামর্শ দিয়েছেন। যেভাবে আবু বকরকে “সিদ্দীক', 'উমারকে ‘ফারুক' এবং উসমানকে ‘গণী' বলা হয়, তেমনিভাবে তাকেও আলী মুজা' বলা হয়। হযরত আবু বকর ও উমরের যুগে তিনি মন্ত্রী ও উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। হযরত উসমান সব সময় দ্বার সাথে - পরামর্শ করতেন। (মরুজ জাহবঃ ২/২)।

বিদ্রোহীদের দ্বারা হযরত উসমান ঘেরাও হলে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে আলীই (রা) সবচেয়ে বেশী ভুমিকা পালন করেন। সেই ঘেরাও অবস্থায় হযরত উসমানের (রা) বাড়ীর নিরাপত্তার জন্য তিনি তার দুই পুত্র হাসান ও হুসাইনকে (রা) নিয়ােগ করেন। (আল-ফিতুল কুবঃ ডঃ হা হুসাইন) হযরত উমার (রা) ইনতিকালের পূর্বে দু'জন বিশিষ্ট সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাদের মধ্য থেকে কাউকে পবর্তী খলীফা নির্বাচনের অসীয়ার করে যান। আলীও ছিলেন ভঁদের একজন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আলীর (রা) সম্পর্কে মন্তব্য করেন । লােকেরা যদি আলীকে খলীফা বানায়, তবে সে তাদেরকে ঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে পারবে। (আল-ফিনাতুল কুরা) হযরত উমার ভার বাইতুল মাকদাস' সফরের সময় আলীকে (রা) মীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান।

হযরত আলী (রাঃ) এর খিলাফত


হযরত উসমানের (র) শাহাদাতের পর বিদ্রোহীরা হযরত তালহা, যুবাইর ও আলীকে (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চাপ দেয়। প্রত্যেকেই অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান। বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, হযরত আলী (রা) বার বার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন। অবশেষে মদীনাবাসীরা হযরত আলীর (রা) কাছে গিয়ে বলে, খিলাফতের এ পদ এভাবে শুন্য থাকতে পারে না। বর্তমানে এ পদের জন্য আপনার চেয়ে অধিক উপযুক্ত ব্যক্তি নেই। আপনিই এর হকদার। মানুষের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হন। তবে শর্ত আরোপ করেন যে, আমার বাইয়াত গােপনে হতে পারবে না। এজন্য সর্বশ্রেণীর মুসলমানের সম্মতি প্রয়ােজন। মসজিদে নববীতে সাধারণ সভা হলাে। মাত্র ষােল অথবা সতেরাে জন সাহাবা ছাড়া সকল মুহাজির ও আনসার আলীর (রা) হাতে বাইয়াত করেন।

উটের যুদ্ধের ঘটনা


অত্যন্ত জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে হয়ত আলীর (রা) খিলাফতের সূচনা হয়। খলীফা হওয়ার পর তার প্রথম কাজ ছিল হযরত উসমানের (রা) হত্যাকারীদের শাস্তি বিধান করা। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না। প্রথমতঃ হত্যাকারীদের কেউ চিনতে পারেনি। হযরত উসমানের স্ত্রী হযরত নায়িলা হত্যাকারীদের দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের কাউকে চিনতে পারেননি। মুহাম্মাদ বিন আবু বকর হত্যার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত উসমানের এক ক্ষোভ-উক্তির মুখে তিনি পিছুটান দেন। মুহাম্মাদ বিন আবু বকরও হত্যাকারীদের চিনতে পারেননি। দ্বিতীয়তঃ মীনা দুখন হাজার হাজার বিদ্রোহীদের কায়। তারা হযরত আলীর (রা) সেনাবাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তার এই অসহায় অবস্থা তৎকালীন অনেক মুসলমানই উপলব্ধি করেননি। তারা হযরত আলীর (রা) নিকট তক্ষুণি হযরত উসমানের (রা) 'কিসাস' দাবী করেন। এই দাবী উত্থাপনকারীদের মধ্যে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা) সহ 'তালহা ও যুবাইরের (রা) মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও ছিলেন। তাঁরা হযরত আয়িশার (র) নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সহ মক্কা থেকে সরার দিকে যাত্রা করেন। সেখানে হাঁদের সমর্থকদের সংখ্যা ছিল বেশী। আলী (রা) ভার বাহিনীসহ সেখানে পৌঁছেন। বসরার উপকণ্ঠে বিরােধী দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। হযরত আয়িশা (রা) আলীর (রা) কাছে তার দাবী পেশ করেন। আলীও (রা) তার সমস্যাসমূহ তুলে ধরেন। যেহেতু উভয় পক্ষেই ছিল সততা ও নিষ্ঠা ভাই নিস্পত্তি হয়ে যায়। হযরত তালহা ও যুবাইর ফিরে চললেন। আয়িশাও ফেরার প্রস্তুতি শুরু করলেন। কিন্তু হাংগামা ও অশান্তি সৃষ্টিকারীরা উভয় বাহিনীতেই ছিল। তাই আপােষ মীমাংসায় তারা ভীত হয়ে পড়ে। তারা সুপরিকল্পিতভাবে রাতের অন্ধকারে এক পক্ষ অন্য পক্ষের শিবিরে হামলা চালিয়ে দেয়। ফল এই দাঁড়ায়, উভয় পক্ষের মনে এই ধারণা জন্মালো যে, আপোষ মীমাংসার নামে ধোকা দিয়ে প্রতিপক্ষ তাদের ওপর অমল করে বসেছে। পরিপূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আলীর (রা) জয় হয়। তিনি বিষয়টি হযরত আয়িশাকে (রা) বুঝাতে সক্ষম হন। আয়িশা (রা) বসরা থেকে মদীনায় ফিরে যান।

যুদ্ধের সময় আয়িশা উটের ওপর সওয়ারি ছিলেন। ইতিহাসে তাই এ যুদ্ধ উটের যুদ্ধ' নামে খ্যাত। হিজরী ৩৬ সনের জামাদিউস সানী মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আশারায়ে মুবাশশার সদস্য হযরত তালহা ও যুবাইরসহ উভয় পক্ষে মােট তের হাজার মুসলমান শহীদ হন। অবশ্য এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। হযরত আলী (র) পনের দিন বসরায় অবস্থানের পর কুফায় চলে যান। রাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তরিত হয়।

এই উটের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের প্রথম আঘাতী সংঘর্ষ। অনেক সাহাবী এ যুদ্ধে কোন পক্ষেই যােগদান করেননি। এই আত্মঘাতী সংঘর্যের জন্য তাঁরা ব্যথিত ও হয়েছিলেন। আলীর (রা) বাহিনী যখন মদীনা থেকে রওয়ানা হয়, মদীনাবাসীরা তখন কান্নায় ভেংগে পতুছিলেন।

হযরত আয়িশা (রা) সাথে তো একটা আপোষ রক্ষায় আসা গেল। কিন্তু সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়ার (রা) সাথে কোন মীমাংসায় পৌছা পেল না। হযরত আলী (রা) তাঁকে সিরিয়ার গভর্ণর পদ থেকে বরখাস্ত করেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) বেঁকে বসলেন। আলীর (রা) নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন। তার বক্তব্যের মূলকথা ছিল, "উসমান (রা) হত্যার কিসাস না হওয়া পর্যন্ত তিনি আলীকে (রা) খলীফা বলে মানবেন না।' | হিজরী ৩৭ সনের সফর মাসে “সিফফীন' নামক স্থানে হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়রি (রা) বাহিনীর মধ্যে এক সংঘর্ষ ঘটে যায়। এ সংঘর্ষ ছিল উটের যুদ্ধ থেকেও ভয়াবহ। উভয় পক্ষে মােট ৯০,০০০ (নব্বই হাজার) মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত "আম্মার বিন ইয়াসীর, খুযাইমা ইবন সাবিত, ও আৰু আম্মারা আল-মাযিনীও ছিলেন। তাঁরা সকলেই আলীর (রা) পক্ষে মুয়াবিয়ার (রা) বাহিনীর হাতে শহীদ হন। উল্লেখ্য যে, আম্মার বিন ইয়াসির সম্পর্কে রাসূল (রা) বলেছিলেনঃ "আফসুস, একটি বিদ্রোহী দল 'আম্মারকে হত্যা করবে।' (সহীহুল বুখারী) সাতাশ জন প্রখ্যাত সাহাবী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হযরত মুয়াবিয়াও হাদীসটির একজন বর্ণনাকারী। অবশ্য হযরত মুয়াবিয়া (রা) হাদীসটির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এত কিছুর পরেও বিষয়টি ফায়সালা হলাে না।

সিফফিনের সর্বশেষ সংঘর্ষ


সিফফিনের সর্বশেষ সংঘর্ষে, যাকে “লাইলাতুল হার” বলা হয়, হযরত আলীর (রাঃ) জয় হতে চলেছিল। হযরত মুয়াবিয়া (রা) পরাজয়ের ভাব বুঝতে পেরে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মীমাংসার আহ্বান জানালেন। তার সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে উঁচু করে ধরে বলতে থাকে, এই কুরআন আমাদের এ দ্বন্দ্বের ফায়সালা করবে। যুদ্ধবিরতি ঘােষিত হলো। হযরত আলীর (রা) পক্ষে আবু মুসা আশয়ারী (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়া (রা) পক্ষে হযরত ‘আমির ইবনুল আস হাকাম বা সালিশ নিযুক্ত হলেন। সিদ্ধান্ত হলাে, এই দুইজনের সম্মিলিত ফায়সালা বিরােধী দু'পক্ষই মেনে নেবেন। 'দুমাতুল জান্দাল' নামক স্থানে মুসলমানদের বড় আকারের এক সম্মেলন হয়। কিন্তু সব ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করলে যে সিদ্ধান্তটি পাওয়া যায় তা হলাে, হযরত “আমর ইবনুল আস (রা) হযরত আবু মুসা আশয়ারীর (রা) সাথে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, শেষ মুহূর্তে তা থেকে সরে আসায় এ সালিশী বাের্ড শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। দুমাতুল জান্দাল থেকে হতাশ হয়ে মুসলমানরা ফিরে গেল। অতঃপর আলী (রা) ও মুয়াবিয়া (রা) অনর্থক রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে সন্ধি করলেন। এ দিন থেকে মূলতঃ মুসলিম খিলাফত দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

‘খারেজী' নামে নতুন দলের জন্ম


এ সময় ‘খারেজী' নামে নতুন একটি দলের জন্ম হয়। প্রথমে তারা ছিল আলী সমর্থক। কিন্তু পরে তারা এ বিশ্বাস প্রচার করতে থাকে যে, দ্বীনের ব্যাপারে কোন মানুষকে ‘হাকাম’ বা সালিশ নিযুক্ত করা কুফরী কাজ। আলী (রাঃ) আবু মুসা আশয়ারীকে (রা) হাকাম' মেনে নিয়ে কুরআনের খেলাফ কাজ করেছেন। সুতরাং হযরত আলী তার অনুগত দাবী করার বৈধতা হারিয়ে ফেলেছেন। তারা হযরত আলী থেকে পৃথক হয়ে যায়। যারা ছিল অত্যন্ত চরমপন্থী । তাদের সাথে আলীর (রা) একটি যুদ্ধ হয় এবং তীতে বহু লোক হতাহত হয়।

এই খারেজী সম্প্রদায়ের তিন ব্যক্তি আবদুর রহমান মুলজিম, আল-বারাক ইবন আবদিল্লাহ ও ‘আমর ইবন বর আত-তামীমী, নাহরাওয়ানের যুদ্ধের পর এক গােপন বৈঠকে মিলিত হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মুসলিম উম্মার অন্তর্কলহের জন্য দায়ী মূলতঃ আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস (রা)। সুতরাং এ তিন ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত মুতাবিক ইবন মুলহিম দায়িত্ব নিল আলীর (রা) এবং অলি-বারাক ও অমির দায়িত্ব নিল যথাক্রমে মুয়াবিয়া ও ‘আমর ইবনুল আসে ()। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, মায়ৰে নয় তাে মরবে। হিজরী ৪০ সনের ১৭ রমজ্জান ফজরের নামাযের সময়টি এ কাজের জন্য নির্ধারিত হয়। অতঃপর ইন মুলজিম কুফা, আল-বাৰাক দিমশুক ও আমির মিসরে চলে যায়।

হযরত আলীর (রাঃ) শাহাদত


হিজরী ৪০ সনের ১৬ রমজান শুক্রবার দিবাগত রাতে আততায়ীরা আপন আপন স্থানে ওৎ পেতে থাকে। ফজরের সময় হযরত আলী (রা) অভ্যাসমত আস-সালাত বলে মানুষকে নামাযের জন্য ডাকতে ডাকতে যখন মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, পাপাত্মা ইবন মুলজিম শাণিত তরবারি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তঁাকে আহত করে। আহত অবস্থায় আততায়ীকে ধরার নির্দেশ দিলেন। সন্তানদের ডেকে অসীয়ত বলেন। চার বছর নয় মাস খিলাফত পরিচালনায় পর ১৭ রমজান ৪০ হিজরী শনিবার কুফায় শাহাদাত বরণ করেন।

একই দিন একই সময় হযরত মুয়াবিয়া যখন মসজিদে যাচ্ছিলেন, তাঁরও ওপর হামলা হয়। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তিনি সামান্য আহত হন। অন্য দিকে আমর ইবনুল আস অসুস্থতার কারণে সেদিন মসজিদে যাননি। তার পরিবর্তে পুলিশ বাহিনী প্রধান খারেজ ইবন হুজফা ইমামতির দায়িত্ব পালনের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেন। ঘঁকেই ‘আমর ইবনুল আস মনে করে হত্যা করা হয়। এভাবে মুয়াবিয়া ও ‘আমর ইবনুল আস (রা) প্রাণে রক্ষা পান। (তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাঃ যিদরী বেক)

হযরত আলীর (রা) নামাযে জানাযার ইমামতি করেন হযরত হাসান ইবন আলী (রা)। কুফা জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে নাফে আশরাফে তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল। ৬৩ বছর।

আততায়ী ইবন মুলজিমকে ধরে আনা হলে আলী (রা) নির্দেশ দেন। সে কয়েদী। তার থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা কর। আমি বেঁচে গেলে তাকে হত্যা অথবা ক্ষমা করতে পারি। যদি আমি মারা যাই, তোমরা তাকে ঠিক ততটুকু আঘাত করবে যতটুকু সে আমাকে করেছে। তোমরা বাড়াবাড়ি করাে না। যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তাদের "ভালােবাসেন না।' (তাবাকাত ; ৩/৩৫)।

হযরত আলী (রা) পাঁচ বছর খিলাফত পরিচালনা করেন। একমাত্র সিরিয়া ও মিসর ছাড়া মক্কা ও মদীনাসহ সব এলাকা তার অধীনে ছিল। তার সময়টি যেহেতু গৃহযুদ্ধে অতিবাহিত হয়েছে, এ কারণে নতুন কোন অঞ্চল বিজিত হয়নি।

হযরত আলী (রা) তাঁর পরে অন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে যাননি। লােকেরা যখন তাঁর পুত্র হযরত হাসানকে (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল; তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তােমাদের নির্দেশ অথবা নিষেধ কোনটাই করছিনা। অন্য এক ব্যক্তি যখন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি আপনার প্রতিনিধি নির্বাচন করে যানে না কেন? বললেনঃ আমি মুসলিম উম্মাহকে এমনভাবে ছেড়ে যেতে চাই যেমন গিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)।

হযরত আলীর (র) ওফাতের পর দারুল বিলাফা- রাজধানী কুফরি জনগণ হযরত হাসানকে (রা) খলীফা নির্বাচন করে। তিনি মুসলিম উম্মার আন্তঃকলহ ও রক্তপাত পছন্দ করলেন না। এ কারণে, হযরত মুয়াবিয়া (রা) ইরাক আক্রমণ করলে তিনি যুদ্ধের পরিবর্তে মুয়াবিয়ার (রাঃ) হাতে খিলাফতের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া সমীচীন মনে করলেন। এভাবে হযরত হাসানের (রা) নজীরবিহীন কুরবানী মুসলিম জাতিকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে মুক্তি দেয়। খিলাফত থেকে তার পদত্যাগের বহরকে ইসলামের ইতিহাসে "আমুল জামায়াহ'– ঐক্য ও সংহছির বন্ধুর নামে অভিহিত করা হয়। পদত্যাপের পর হযরত হাসনি কুয়া ত্যাগ করে মদীনা চলে আসেন এবং নয় বছর পর হিজরী পঞ্চাশ সনে মদীনায় ইনতিকাল কয়েন। মাত্র ছয়টি মাস তিনি খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন।

আলীর (রাঃ) চারিত্রিক গুণাবলী


হযরত উমার (রা) আলী (রা) সম্পর্কে বলেছিলেন, 'আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ফায়সালাকারী আলী। এমন কি রাসূল (সা) বলেছিলেন, “আমি আলী- তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিচারক আলী।' তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত লক্ষ্য করে হযরত উমার (রা) একাধিকবার বলেছেনঃ “লাওলা আলী লাহালাকা উমার- আলী না হলে উমার হালাক হয়ে যেত।'

আলী (রা) নিজেকে একজন সাধারণ মুসলমানের সমান মনে করতেন এবং যে কোন ভুলের কৈফিয়তের জনা প্রস্তুত থাকছেন। একবার এক ইয়াহুদী তার বর্ম চুরি করে নেয়। আলী বাজারে বর্মটি বিক্রি করতে দেখে চিনে ফেলেন। তিনি ইচ্ছা করলে জোর করে তা নিতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। আইন অনুযায়ী ইয়াহুদীর বিরুদ্ধে কাজীর আদালতে মামলা দায়ের করেন। কার্জীও ছিলেন কঠোর ন্যায় বিচারক। তিনি আলীর (রা) দবীর সমর্থনে প্রমাণ চাইলেন। আলী (রা) তা দিতে পারলেন না। কাজী ইয়াহুদীর পক্ষে মামলার রায় দিলেন । এই ফায়সালার প্রভাব ইয়াহুদীর ওপর এতখানি পড়েছিল যে, সে মুসলমান হয়ে যায়। সে মন্তব্য করেছিল, এতাে নবীদের মত ইনসাফ। আলী (রা) আমীরুল মুমিনীন হয়ে আমাকে কাজীর সামনে উপস্থিত করেছেন। এবং তারই নিযুক্ত কাজী তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। তিনি ফাতিমার (রা) সাথে বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলে করীম (সা) পরিবাৱের সাথেই থাকতেন। বিয়ের পর পৃথক বাড়ীতে বসবাস শুরু করেন। জীবিকার প্রয়ােজন দেখা দিল। কিন্তু পুঁজি ও উপকরণ। কোথায়? গতরে খেটে এবং গনীমতের হিসসা থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হযরত উমারের (রা) যুগে ভাতা চালু হলে তার ভাতা নির্ধারিত হয় বছরে পাঁচ হাজার দিরহাম। হযরত হাসান বলেন, মৃত্যুকালে একটি গোলাম খরীদ করার জন্য জমা করা মাত্র সাত শ' দিরহাম রেখে যান। (তাবাকাতঃ ৩/৩৯)।

জীবিকার অনটন আলীর (র) ভাগ্য থেকে কোন দিন দূর হয়নি। একবার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহর (সা) সময়ে ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বেঁধে থেকেছি। (হায়াতুস সাহাবাঃ ৩৩১২) অলীক্ষা হওয়ার পরেও ক্ষুধা ও দারিদ্রের সাথে তাকে লড়তে হয়েছে। তবে তাঁর অন্তরটি ছিল অত্যন্ত প্রশস্ত। কোন অভাবীকে তিনি ফেরাতেন না। এজন্য তাকে অনেক সময় সপরিবারে অভুক্ত থাকতে হয়েছে। তিনি ছিলেন দারুণ বিনয়ী। নিজের হাতেই ঘর-গৃহস্থালীর সব কাজ করতেন। সর্বদা মােটা পােশাক পরতেন। তাও ছেড়া, ডালি লাগানাে। তিনি ছিলেন জ্ঞানের দরজা। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য তার কাছে এসে দেখতে পেত তিনি উটের রাখালী করছেন, ভূমি কুপিয়ে ক্ষেত্র তৈরী করছেন। তিনি এতই অনাড়ম্বর ছিলেন যে, সময় সময় শুধু মাটির ওপর শুয়ে যেতেন। একবার তাকে রাসূল (স) এ অবস্থায় দেখে সম্বোধন করেছিলেন, ইয়া আবা তুয়াব'- ওহে মাটির অধিবাসী প্রাকৃতজন। তাই তিনি পেয়েছিলেন, ‘আৰু তুরাব লকটি। খলীফা হওয়ার পরও তঁার এ সরল জীবন অব্যাহত থাকে। হযরত “উমারের (রা) মত সবসময় একটি দু বা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতেন, লােকদের উপদেশ দিতেন। (আল-ফিতনাতুল কুবরা)

হযরত আলী (রা) ছিলেন নবী খান্দানের সদস্য, যিনি নবীর (সা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “আলা মাদীনাতুল ইলম ওয়া আলী বাবুহা” আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী সেই নগরীর প্রবেশদ্বার। (তিরমিযী) তিনি ছিলেন কুরআনের হাফিজ এবং একজন শ্রেষ্ঠ মুফাসসির। কিছু হাদীসও সংগ্রহ করেছিলেন। তবে হার্দীস গ্রহণের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। কেউ তার কাছে কোন হাদীস বর্ণনা করলে, বর্ণনাকারীর নিকট থেকে শপথ নিতেন। (তাজকিরাতুল হফজ ১/১০) তিনি রাসূলুল্লাহর (রা) বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে বহু বিখ্যাত সাহাবী এবং ভাবেই হাদীস বর্ণনা করেছেন। পূর্ববর্তী খলীফাদের যুগে মুহাজিরদের তিনক্সন ও আনসারদের তিনজন ফাতওয়া দিতেন। যথাঃ *উমার, উসমান, আলী, উবাই বিন কা'ব, মুয়াজ বিন জাবাল ও আয়িদ বিন সাবিত। মাসরুক থেকে অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূলুল্লাহর (রা) সাহাবীদের মধ্যে ফাতওয়া দিতেন ? আলী, ইবন মাসউদ, যায়িদ, উবাই বিন কা'ব, আবু মূসা আল-আশয়ারী। (তাবাকাত : ৪/১৬৭, ১৭৫)

আলী ছিলেন একজন সুবক্তা ও ভালাে কবি। (কিতাবুল উমদা ইবন রশীক । ১/২১) তার কবিতার একটি “দিওয়ান' আমরা পেয়ে থাকি। রাতে অনেকগুলি কবিতায় মােট ১৪০০ শ্লোক আছে। গবেষকদের ধারণা, দ্বার নামে প্রচলিত অনেকগুলি কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তিনি যে তৎকালীন আরবী কাব্য জগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল, তাতে পঙ্কিতদেয় কোন সংশয় নেই। নাহজুল বালাগা” নামে উরি বার একটি সংকলন আছে যা তার অতুলনীয় বাপিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। (তারীখুল আদব আল-আরাবী ডঃ উমার ফাররুখ, ১৩০৯)

খাতুনে জান্নাত নবী কন্যা হযরত ফাতিমার (রা) সাথে ভঁর প্রথম বিয়ে হয়। যতদিন ফাতিমা জীবিত ছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। ফাতিমার মৃত্যুর পর একাধিক বিয়ে কগ্ৰেছেন। তাবারীর বর্ণনা মতে, তার চৌদ্দটি ছেলে ও সতেরটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। হযরত ফাতিমার গর্ভে তিন পুত্র হাসান, হুসাইন, মুহসিন এবং দু'কন্যা যয়নাব ও উপু কুলসুম জালাভ করেন। শৈশবেই মুহসীন মারা যায়। ওয়াকিদীর বর্ণনা মতে, মাত্র পাঁচ ছেলে হাসান, হুসাইন, মুহাম্মাদ (ইবনুল হানাফিয়া), আব্বাস এবং উমার থেকে তার বংশ ধারা চলছে।

ইমাম আহমাদ (র) বলেন, আলীর (রা) মর্যাদা ও ফীলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে যত কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে তা হয়নি। (আল-ইসাবা । ২৫০৮) ইতিহাসে তার যত গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে তার কিংশও তুলে ধরা সম্ভব নয়। রাসূল (সা) অসংখ্যবার তাঁর জন্য এ তার সন্তানদের জন্য দুআ করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ একমাত্র মুমিনরা ছাড়া তােমাকে কেউ ভালোবাসবে এবং একমাত্র মুনাফিকরা ছাড়া কেউ তােমাকে হিংসা করবে না।

হযরত আলীর এক সাথী হযরত দুবার ইবন সামরা আল কিনানী একদিন হযরত মুয়াবিয়ার কাছে এলেন। মুয়াবিয়া তাঁকে আলীর (রা) গুণাবলী বর্ণনা করতে অনুরােধ করেন। প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার চাপাচাপিতে দীর্ঘ এক বর্ণনা দান করেন। তাতে আলীর (রা) গুণাবলী চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। ঐতিহাসিকরা বলছেন এ বর্ণনা শুনে মুয়াবিয়া সহ তার সাথে বৈঠকে উপস্থিত সকলেই কান্নায় ভেংগে পড়েছিলেন। অতঃপর মুয়াবিয়া মন্তব্য করেন ? আল্লাহর কসম, আবুল হাসান (হাসানের পিঙ্গ) এমনই ছিলেন।' (আল-ইসতিয়াৰঃ ৩/৪৪)





**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url