সাহাবাগণের জীবনকথা-৩২ || উসামা ইবন যায়িদ (রা)





উসামা ইবন যায়িদ (রা)

উসামা ইবন যায়িদ (রা)-এর জন্ম

হিজরাতের পূর্বে মক্কায় নবুওয়াতের সপ্তম বছর চলছে। রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীরা তখন কুরাইশদের চরম বাড়াবাড়ির শিকার। ইসলামী দাওয়াতের কঠিন দায়িত্ব ও বােঝা পালন করতে গিয়ে পদে পদে তিনি নানা রকম দুঃখ বেদনা ও মুসীবতের সম্মুখীন হচ্ছেন। এমন সময় তার জীবনে একটু খুশির আলেকিত আভা দেখা দিল। সুসংবাদ দানকারী খুশীর বার্তা নিয়ে এলো, “উম্মু অয়মন একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলাে। সেই সৌভাগ্যবান নবজাতক, যার ধরাপৃষ্ঠে আগমন সংবাদে আল্লাহর রাসূল এত উৎফুল্ল হয়েছিলেন, তিনি উসামা ইবন যায়িদ।

শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে রাসূলুল্লাহর (সা) এত উৎফুল্ল হওয়াতে সাহাবীরা কিন্তু বিম্বিত হননি। কারণ, রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট শিশুটির মাতা-পিতার স্থান সম্পর্কে সবাই অবগত ছিলেন। শিশুটির মা বারাকা আল হালাশিয়া'- যিনি “উ অয়মান' নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) জননী হযরত আমিনীর দাসী। তার জীবনকালে এবং ওয়াফাতের পরও এ মহিলা রাসূলুল্লাহকে (সা) প্রতিপালন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) দুনিয়াতে চোখ মেলে তাকেই মা বলে বুঝতে শেখেন। অত্যন্ত গভীর ৭ অকৃত্রিমভাবে রাসুলুল্লাহ (সা) তাকে ভালোবাসেন। প্রায়ই তিনি বলতেন। 'আমার মায়ের পর ইনিই আমার মা এবং আমার আহিলদের অবশিষ্ট ব্যক্তি। এ সম্মানিত মহিলাই হচ্ছেন এ নবজাতকের গৌরবান্বিত মা।

শিশুটির পিতা হলেন রাসুলুল্লাহর (সা) স্নেহভাজন, ইসলাম-পূর্ব যুগের ধর্মপুত্র, বিশ্বস্ত সংগী, ইসলামের পর রাসূলুল্লাহর (সা) সৰ্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি— যায়িদ ইবন হারিসা (রা)। | রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে মক্কার সমগ্র মুসলিম সমাজ শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে উৎফুল্ল হয়েছিল শিশুর পিতাকে যেমন তারা উপাধি দিয়েছিল “

উসামা ইবন যায়িদ (রা)-এর উপাধি

হযরত রাসূলিল্লাহ', তেমনি তারা তাকে উপাধি দিল “ইবনুল হিব' বা রাসূলুল্লাহর (সা) প্রীতিভাজনের পুত্র। তাদের এ উপাধি দান কিন্তু যথার্থই হয়েছিল। রাসূল (সা) তাকে এত অধিক ভালােবেসেছিলেন যে, তা দেখে বিশ্ববাসীর ঈর্ষা হয়। উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) দৌহিত্র হাসান ইবন ফাতিমার সমবয়সী। হাসান ছিলেন তাঁর নানা রাসূলুল্লাহর (সা) মত দারুণ সুন্দর। আর উসামা ছিলেন তাঁর হাবশী মা'র মত কালাে ও খাদা নাক বিশিষ্ট। কিন্তু রাসূল (সা) তাদের দু'জনকে স্নেহ ও ভালােবাসার ক্ষেত্রে মােটেই কম বেশী করতেন না। তিনি উসামাকে বসাতেন এক উরুর ওপর এবং হাসানকে অন্য উরুর। ওপর। তারপর দু'জনকে একসাথে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলতেনঃ 'হে আল্লাহ, আমি তাদের দু'জনকে ভালােবাসি, তুমিও তাদের উভয়কে ভালােবাস।' | শিশু উসামার প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) স্নেহ ও ভালােবাসা কত গভীর ও প্রবল ছিল তা বুঝা যায় একটি ঘটনা দ্বারা। শিশু উসামা একবার দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। তার কপাল কেটে রক্ত বের হতে লাগলাে। রাসূল (সা) প্রথমে হযরত

আয়িশাকে (রা) রক্ত মুছে দিতে বললেন। কিন্তু তাতে স্বস্তি পেলেন না। তিনি নিজেই উঠে গিয়ে রক্ত মুছে ক্ষতস্থানে চুমু দিতে লাগলেন এবং মিষ্টি মধুর ও দরদ মিশ্রিত কথা বলে তাকে শান্ত করতে লাগলেন।
শৈশবের মত যৌবনেও উসামা রাসূলুল্লাহর (সা) ভালোবাসা লাভ করেন। একবার কুরাইশদের অন্যতম নেতা হাকীম ইন হিমি ইয়মিনের যী ইয়াযিন বাদশার একখানা মূল্যবান চাদর ইয়ামন থেকে পঞ্চাশ দীনার দিয়ে খরীদ করেন। চাদরখানি তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) উপহার দিতে চাইলে তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ, হাকীম তখনও মুশরিক ছিলেন। তবে রাসূল (সা) তার নিকট থেকে অর্থের বিনিময়ে চাদরখানি খরিদ করেন। এক জুমআর দিন একবার মাত্র সে চাদরখানি রাসূল (সা) পরেন। তারপর তিনি তা উসামার গায়ে পরিয়ে দেন। উসামা সে চাদরখানি পরে তার সমবয়সী সুহাজির ও আনসার যুবকদের সাথে সকাল সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতেন। | যৌবনে উসামার মধ্যে এমন সব চারিত্রিক সৌন্দর্য ও গুণাবলী বিকশিত হলাে যা সহজেই রাসূলুল্লাহর (সা) স্নেহ ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তীক্ষ্ণ মেধা, দুঃসাহস, বিচক্ষণতা, পূতঃপবিত্র চরিত্র এবং তাকওয়া ও পরহিযগারী হিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

উসামা ইবন যায়িদ (রা)-এর জিহাদ

উহুদ যুদ্ধের দিন উসামা তার সমবয়সী অারো কতিপয় কিশোর সাহাবীর সাথে উপস্থিত হলেন রাসুলুল্লাহর (সা) সামনে। তাদের সবার ইচ্ছা জিহাদে অংশগ্রহণ করা। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে নির্বাচন করলেন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে অন্যদের ফিরিয়ে দিলেন। উসামা প্রত্যাখ্যাত হয়ে বাড়ীতে ফিরছেন। চোখ দুটি ভার পানিতে টলমল। তাঁর ব্যথা, রাসূলুল্লাহর (সা) পতাকাতলে জিহাদের সুযােগ থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন।

খন্দকের যুদ্ধ সমুপস্থিত। উসামাও হাজির। তাঁর সাথে আরাে কয়েকজন কিশাের সাহাবী। রাসুলুল্লাহ (সা) সৈনিক বাছাই করছেন। উহুদের মত এবারাে তাকে ছােট বলে। বাদ দেওয়া না হয়, এজন্য পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাড়ালেন। তার আগ্রহ দেখে রাসূলুল্লাহর (সা) অন্তর নরম হলাে। তাকে নির্বাচন করলেন। তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে উসামা চললেন জিহাদে। তিনি তখন ১২/১৩ বছরের এক কিশাের।

কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে প্রথম পর্যায়ের অভিযান সমূহে তিনি অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। হারকা’ অভিযানে তিনি সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করেন। সাত অথবা আট হিজরীতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। তখন তার বয়স চৌদ্দ। কিন্তু তার সীমাহীন যােগ্যতার কারণে রাসূল (সা) তাঁকে অভিযানের নেতৃত্ব দান করেন। এ অভিযানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) আমাদেরকে ‘হারকার দিকে পাঠালেন। শত্রুরা পরাজিত হয়ে পালাতে শুরু করলাে। আমি এক আনসারী সিপাহীর সাথে পলায়নরত এক সৈনিকের পিছু ধাওয়া করলাম। যখন সে আমাদের নাগালের মধ্যে এসে গেল, জোরে জোরে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' বলে উঠলাে। তার এ ঘােষণায় আনসারী হাত গুটিয়ে নিল; কিন্তু আমি বর্শা ছুড়ে তাকে গেঁথে ফেললাম। সে মারা গেল। অভিযান থেকে ফেরার পর বিষয়টি রাসূলুল্লাহর (সা) কর্ণগোচর হলাে। তিনি আমাকে বললেন উসামা, কালিমা তাইয়্যেবা পড়ার পর তুমি একটি লােককে হত্যা করেছ! আমি বললাম, প্রাণ বাঁচানাের জন্য সে এমনটি করেছে। তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। একই কথা বার বার আগুড়াতে লাগলেন। আমি তখন এত অনুতপ্ত হলাম যে, মনে মনে বললাম, 'হায়! আঙ্গিকের পূর্বে যদি আমি ইসলাম গ্রহণ না করতাম।' অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা) তাকে বলেন : ‘তুমি তার অন্তর ফেঁড়ে দেখলে না কেন?” | দুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়ে পালাতে লাগলাে। উসামা তখন রাসূলুল্লাহর (সা) চাচা আব্বাস, আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিসসহ মাত্র দু'জন সাহাবীর সাথে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে অটল হয়ে রুখে দাঁড়ালেন। বীর বিশ্বাসীদের ক্ষুদ্র এই দলটির সাহায্যে রাসূলুল্লাহ (সা) সেদিন নিশ্চিত পরাজয়কে বিজয়ের রূপদান করেন এবং পলায়নরত মুসলিম বাহিনীকে মুশরিক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেন।

মক্কা বিজয়েও উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) সংগী। রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে একই বাহনে সওয়ার হয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে উসামা, বিললি ও উসমান ইবন তালহা এ তিন ব্যক্তিই সেদিন কা'বার অভ্যন্তরে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। এ চারজনের পরই কা'বার দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

উসামা তার পিত্ত সেনাপতি যায়িদ ইবন হারিসার সাথে মুতা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখন তার বয়স আঠারাে বছরেরও কম। এ যুদ্ধে তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন পিতার শাহাদাত। তবে তিনি মুষড়ে পড়েননি। পিতার শাহাদাত বরণের পর যথাক্রমে জাফর ইবন আবী তালিব ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার নেতৃত্বে বাহাদুরের মত লড়াই করেন। যানিয়দের মত এ সেনাপতিও শাহাদাত বরণ করলে তিনি সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন এবং মুসলিম বাহিনীকে রােমান বাহিনীর পাতা থেকে উদ্ধার করেন। মুতার প্রান্তরে পিতা যায়িদের মরদেহ আল্লাহর হাওয়ালা করে যে ঘােড়ার ওপর তিনি শহীদ হয়েছিলেন, তার ওপর সওয়ার হয়ে তিনি মদীনায় ফিরে এলেন।

একাদশ হিজরীতে রাসুল (সা) রােমান বাহিনীর সাথে একটা চুড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবু বকর, উমার, সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্রমুখ প্রথম কাতারের সমর বিশারদ সাহাবী এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। রাসূল (সা) উসামা বিন যায়িদকে এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়ােগ করেন। তখন তার বয়স বিশের কাছাকাছি। রাসূল (সা) যা উপত্যকার নিকটবতী বালকা' ও 'দারম আল কিলয়ার আশে পাশে সীমান্তে হাজনি ফেলার নির্দেশ দিলেন।

বাহিনী যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলাে। এদিকে রাসূল (সা) পীড়িত হয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহর (সা) রােগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাহিনীসহ তিনি যাত্রাবিরতি করে মদীনার উপকণ্ঠে ‘জুরুফ' নামক স্থানে প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সেখান থেকে প্রতিদিন তিনি। রাসূলুল্লাহকে (সা) দেখতে আসতেন। উসামা বলেন রাসূলুল্লাহর (সা) রােগ বৃদ্ধি পেলে আমি দেখতে গেলাম। আরাে অনেকে আমার সংগে ছিলেন। ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম, রাসূল (সা) চুপ করে আছেন। রােগের প্রচণ্ডতায় তিনি কথা বলতে পারছেন। আমাকে দেখে প্রথমে তিনি আসমানের দিকে হাত উঠালেন, তারপর আমার শরীরের ওপর হাত রাখলেন। আমি বুঝলাম, তিনি আমার জন্য দু'আ করছেন।'

রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকাল হলাে। খবর পেয়ে তিনি মদীনায় ছুটে এলেন এবং কফিন দীনে অংশগ্রহণ করলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র মরদেহ কবরে নামানাের সৌভাগ্যও তিনি লাভ করেন। | হযরত আবু বকর (রা) খলীফা নির্বাচিত হলেন। তিনি উসামাকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আনসারদের ছােট্ট একটি দল মনে করলেন এ মুহূর্তে বাহিনীর যাত্রা একটু বিলম্ব করা উচিত। এ ব্যাপারে খলীফার সাথে কথা বলার জন্য দ্বারা হযরত উমারকে (রা) অনুরােধ করলেন। তারা উমারকে এ কথাও বললেন, যদি তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে অন্ততঃ তাকে অনুরােধ করবেন, উসামা থেকে একজন অধিক বয়সের লােককে যেন আমাদের সেনাপতি নিয়ােগ করেন।

হযরত আবু বকর বসে ছিলেন। হযরত উমারের (রা) মুখে আনসারদের বক্তব্য শোনার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ফারুকে আজমের দাড়ি মুট করে ধরে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন ? 'ওহে খাত্তাবের পুত্র! আপনার মা নিপাত যাক! আপনি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন রাসূলুল্লাহর (সা) নিয়ােগ করা ব্যক্তিকে অপসারণ করতে আল্লাহর কসম, আমার দ্বারা কক্ষণাে তা হবেনা। | “উমার (রা) ফিরে এলেন। লােকেরা জিজ্ঞেস করলাে, সমাচার কি? বললেন তােমাদের সকলের মা নিপাত যাক! তােমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের খলীফার নিকট থেকে অনেক কিছুই আমাকে শুনতে হলাে।

যুবক কমাণ্ডারের নেতৃত্বে বাহিনী মদীনা থেকে রওয়ানা হলাে। খলীফা আবু বকর (রা) চললেন কিছুদূর এগিয়ে দিতে। উসামা ঘােড়ার পিঠ, খলীফা পায়ে হেঁটে। উসামা বললেন ঃ 'হে রাসূলুল্লাহর (সা) খলীফা! আল্লাহর কসম, হয় আপনি ঘােড়ায় উঠুন, না হয় আমি নেমে পড়ি।' খলীফা বললেনঃ 'আল্লাহর কসম, তুমিও নামবে না, আমিও উঠবাে না। কিছুক্ষণ আল্লাহর পথে আমার পদযুগল ধুলিমলিন হতে দোষ কি?' তারপর উসামাকে বললেন : 'তােমার দ্বীন, তােমার আমানতদারী এবং তােমার কাজের সমাপ্তি আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) যে নির্দেশ তোমাকে দিয়েছেন, তা কার্যকর করার উপদেশ তােমাকে দিচ্ছি। তারপর উসামার দিকে একটু কে বললেন : তুমি যদি 'উমারের দ্বারা আমাকে সাহায্য করা ভালাে মনে কর, 'তাকে আমার কাছে থেকে যাওয়ার অনুমতি দাও।' উসামা আবু বকরের আবেদন মহর করলেন। উমারকে মদীনায় খলীফার সংগে থাকার অনুমতি দিলেন।

উসামা রাসূলুল্লাহর (সা) আদেশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেন। মুসলিম অশ্বারােহী বাহিনী ফিলিস্তিনের বালকা’ ও ‘কিলয়াতুত দারূম" সীমান্ত পদানত করে। ফলে এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের জন্য রেমিনি ভীতি চিরতরে দূরীভূত হয় এবং গােটা সিরিয়া, মিসর ও উত্তর আফ্রিকাসহ কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের বিজয়ার উন্মুক্ত হয়।

এ অভিযানে তিনি তাঁর পিতার হত্যাকারীকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন। যে ঘোড়ার ওপর তার পিতা শহীদ হয়েছিলেন, তার পিঠে বিপুল পরিমাণ গনিমতের ধন সম্পদ বােঝাই করে তিনি বিজয়ীর বেশে মদীনায় ফিরে এলেন। খলীফা আবু বকর (রা) মুহাজির ও আনসারদের বিরাট একটি দল সহ মদীনার উপকণ্ঠে তাঁকে স্বাগত জানান। উসামা মদীনায় পৌছে মসজিদে নববীতে দু'রাকায়াত নামায আদায় করে বাড়ী যান। ঐতিহাসিৱা তার এ বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ “উসামার বাহিনী অপেক্ষা অধিকতর নিরাপদ ও পনিমাত লাভকারী অন্য কোন বাহিনী আর দেখা যায়নি।

রাসূলুল্লাহর (সা) অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য উসামা মুসলিম সমাজের ব্যাপক ভালােবাসা ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার (রা) নিজ পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার অপেক্ষা উসামার ভাতা বেশী নির্ধারণ করেন। হযরত আবদুল্লাহ ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ করেনঃ “আব্বা, উসামার ভাতা চার হাজার, আর আমার ভাতা তিন হাজার। আমার পিতা অপেক্ষা তার পিতা অধিক মর্যাদাবান ছিলেন না এবং আমার থেকেও তার মর্যাদা বেশী নয়।' জবাবে হযরত উমর বলেনঃ 'আফসােস! তােমার পিতার চেয়ে তার পিতা রাসূলুল্লাহর (সা) অধিক প্রিয়। ছিলেন এবং তােমার থেকেও সে রাসূলুল্লাহর (সা) বেশী প্রিয় ছিল।' হযরত আবদুল্লাহ (রা) আর কোন উচ্চবাচ্য করেননি। | উসামার সাথে খলীফা উমারের দেখা হলেই বলতেনঃ ‘স্বাগতম, আমার আমীর।' এমন সম্বোধনে কেউ বিস্মিত হলে তিনি বলতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে আমার আমীর বা নেতা বানিয়েছিলেন।
হযরত উসমানের (রা) খিলাফতকালে ফিতনা-ফাসালের আশংকায় রাত্রীয় কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তবে হিতাকাংখী মুসলিম হিসাবে সর্বদা খলীফাকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং গােপনে গণ-অসন্তোষের বিষয়ে খলীফার সাথে আলোচনা করতেন। | হযরত উসমানের শাহাদাতের পর যখন বিশৃংখলা দেখা দিল, তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করলেন। হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার বিরােধ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলেন। এ সময় হযরত আলীকে একবার তিনি বলে পাঠালেন, 'আপনি যদি বাঘের চোয়ালের মধ্যে ঢুকতেন, আমিও সন্তুষ্টচিত্তে ডুকে যেতাম। কিন্তু এ ব্যাপারে অংশগ্রহণের আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।' মুসলমানদের রক্তপাতের ভয়ে যদিও তিনি এ দ্বন্দ্বে জড়াতে চাননি, তবে তিনি আলীকে (রা) সত্যপন্থী বলে মনে করতেন। এ কারণে, আলীকে সাহায্য না করার জন্য শেষ জীবনে তাওবাহ করেছেন।

হযরত উসামা প্রতিপালিত হয়েছিলেন নবীগৃহে। এ কারণে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া তার উচিত ছিল। রাসূলুল্লাহর (সা) ওয়াফাতের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আঠারাে বছর। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহর (সা) দীর্ঘ সাহচর্য লাভের সুযােগ তিনি পাননি। এ কারণে, এ ক্ষেত্রে তিনি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবন উমার প্রমুখ বিদ্বান সাহাবীদের মত আশানুরূপ সাফল্য লাভ করেননি। তা সত্ত্বেও যা তিনি অর্জন করেছিলেন তা মােটেও অকিঞ্চিৎকর নয়। তিনি নবীর (সা) বহু বাণী স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। বিশিষ্ট সাহাবীরাও মাঝে মাঝে শরীয়াতের নির্দেশ জানার জন্য তার শরণাপন্ন হতেন। হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস ‘কাউন' বা প্লেগ সম্পর্কে শরীয়াতের কোন নির্দেশ না পেয়ে উসামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তাউন' বা প্লেগ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট থেকে কিছু শুনেছেন কি? তিনি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি বাণী সা'দের নিকট বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সর্বমােট একশ’ আটাশটি। তন্মধ্যে পনেরটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন। হযরত হাসান, মুহাম্মাদ ইবন আব্বাস, আবু হুরাইরা, কুরাইব, আৰু উসমান নাহদী, 'আমর ইবন উসমান, আবু ওয়ায়িল, আমের ইবন সা'দ, হাসান বসরী (রা) প্রমুখ। সাহাবী ও তাবেঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

যেহেতু নবীগৃহে তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট তাঁর যাতায়াত ছিল অবাধ, এ কারণে নবীর (সা) শিক্ষার যথেষ্ট প্রভাব তাঁর ওপর পড়েছিল। অধিকাংশ সফরে রাসুলুল্লাহর (সা) সাথে একই বাহনে আরােহী হওয়ার সৌভাগ্য তিনি লাভ করেছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমাতের সুযােগও বেশী পরিমাণে লাত করেন। অঙ্কু ও পাক পবিত্রতার পানি তিনিই অধিকাংশ সময় এগিয়ে দিতেন। অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা) বিভিন্ন বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করতেন। ইফক বা হযরত আয়িশার (রা) প্রতি মুনাফিকদের বানোয়াট ও অশালীন উক্তি ছড়িয়ে পড়লে রাসূল (সা) ঘনিষ্ঠ যে দু'ব্যক্তির সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন, তারা ছিলেন হযরত আলী ও উসামা (রা)। মহান সেনানায়ক হযরত মুয়াবিয়ার খিলাফত কালের শেষ দিকে হিজরী ৫৪ সনে ৬০ বছর বয়সে মদীনায় ইনতিকাল করেন।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url