ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা-৪ দুনিয়াবী জীবনের রহস্য কৃতকর্মের দায়িত্ব ও জবাবদিহি






ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা, পর্ব-৪ এর আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

দুনিয়াবী জীবনের রহস্য

৫ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّکُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا ٝ وَ لَا یَغُرَّنَّکُمۡ بِاللّٰهِ الۡغَرُوۡرُ 

“(আখেরাত সম্পর্কে) আল্লাহর ওয়াদা নিশ্চিতরুপে সত্য; সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলে না দেয় এবং প্রতারক (শয়তান) তোমাদেরকে আল্লাহর সম্পর্কে নিশ্চিত করে না রাখে।” -(সূরা ফাতির: ৫)

وَ اتَّبَعَ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مَاۤ اُتۡرِفُوۡا فِیۡهِ وَ کَانُوۡا مُجۡرِمِیۡنَ 

“যারা নিজেদের প্রতি নিজেরা যুলুম করেছে, পার্থিব আনন্দ-উপভোগের-যা তাদেরকে দেয়া হয়েছিল-পেছনে পড়ে রয়েছে; এরাই ছিলো অপরাধী।” -(সূরা হুদঃ১১৬)

৪৫ وَ اضۡرِبۡ لَهُمۡ مَّثَلَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا کَمَآءٍ اَنۡزَلۡنٰهُ مِنَ السَّمَآءِ فَاخۡتَلَطَ بِهٖ نَبَاتُ الۡاَرۡضِ فَاَصۡبَحَ هَشِیۡمًا تَذۡرُوۡهُ الرِّیٰحُ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ مُّقۡتَدِرًا 
৪৬ اَلۡمَالُ وَ الۡبَنُوۡنَ زِیۡنَۃُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ الۡبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیۡرٌ عِنۡدَ رَبِّکَ ثَوَابًا وَّ خَیۡرٌ اَمَلًا

“তাদের সামনে পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত পেশ করো। তাহলো এই, যেন আসমান থেকে আমরা পানি বর্ষণ করলাম এবং তার ফলে দুনিয়া শস্য-শ্যামল হয়ে গেলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই শস্যাদি ভূষিতে পরিণত হয়ে গেল, যা দমকা হাওয়ায় ইতঃস্তত উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ প্রতিটা জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান। ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি হচ্ছে নিছক পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যোপকরণ মাত্র; কিন্তু তোমার প্রভুর দৃষ্টিতে ‘সওয়াব’ এবং ভবিষ্যত প্রত্যাশার দিক থেকে স্থায়ী নেকীই হচ্ছে অধিকতর উত্তম।” -(সূরা আল কাহাফঃ৪৫-৪৬)

৯ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُلۡهِکُمۡ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰهِ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ 

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-দৌলত ও তোমাদের সন্তানাদি যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে তোমাদের গাফেল করে না দেয়। যারা এরূপ করবে, প্রকৃতপক্ষে তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ।”-(সূরা মুনাফেকুনঃ৯)

৩৭ وَ مَاۤ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ بِالَّتِیۡ تُقَرِّبُکُمۡ عِنۡدَنَا زُلۡفٰۤی اِلَّا مَنۡ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا ۫ فَاُولٰٓئِکَ لَهُمۡ جَزَآءُ الضِّعۡفِ بِمَا عَمِلُوۡا وَ هُمۡ فِی الۡغُرُفٰتِ اٰمِنُوۡنَ 

“তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমদের সন্তানাদি এমন জিনিস নয় যা তোমাদেরকে আমাদের নিকটবর্তী করতে পারে। আমাদের নিকটবর্তী কেবল তারাই যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে।” -(সুরা আস সাবা: ৩৭)

২০ اِعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا لَعِبٌ وَّ لَهۡوٌ وَّ زِیۡنَۃٌ وَّ تَفَاخُرٌۢ بَیۡنَکُمۡ وَ تَکَاثُرٌ فِی الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَوۡلَادِ ؕ کَمَثَلِ غَیۡثٍ اَعۡجَبَ الۡکُفَّارَ نَبَاتُهٗ ثُمَّ یَهِیۡجُ فَتَرٰىهُ مُصۡفَرًّا ثُمَّ یَکُوۡنُ حُطَامًا ؕ وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ۙ وَّ مَغۡفِرَۃٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ رِضۡوَانٌ ؕ وَ مَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ 

“জেনে রাখ, দুনিঢার জীবন হচ্ছে একটি খেল, একটি তামাশা, এক বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের একের ওপর অপরের গর্ব করা এবং ধন-সম্পদ ও সন্তানাদিতে একের চেয়ে অন্যের প্রাচুর্য লাভের চেষ্টা করা। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, বৃষ্টি হলো এবং তার থেকে উৎপন্ন ফসল দেখে কৃষক খুব খুশী হলো। তারপর সে ফসল পাকলো এবং তুমি দেখতে পেলে যে তা বিবর্ণ হয়ে গেলো। অবশেষে তা ভূষিতে পরিণত হলো।” -(সূরা আল হাদীদঃ২০)

১২৯ وَ تَتَّخِذُوۡنَ مَصَانِعَ لَعَلَّکُمۡ تَخۡلُدُوۡنَ  ১২৮ اَتَبۡنُوۡنَ بِکُلِّ رِیۡعٍ اٰیَۃً تَعۡبَثُوۡنَ

“তোমরা কি প্রতিটি উঁচু জায়গায় নিষ্ফল স্মৃতি স্তম্ভ এবং বড় বড় ইমারত তৈরী করছো? সম্ভবত এই ধারণায় যে, তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে।” -(সূরা আশ শুয়ারাঃ ১২৮-১২৯)

১৪৯ وَ تَنۡحِتُوۡنَ مِنَ الۡجِبَالِ بُیُوۡتًا فٰرِهِیۡنَ  ১৪৮ وَّ زُرُوۡعٍ وَّ نَخۡلٍ طَلۡعُهَا هَضِیۡمٌ   ১৪৭ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ  ১৪৬ اَتُتۡرَکُوۡنَ فِیۡ مَا هٰهُنَاۤ اٰمِنِیۡنَ 

“তোমাদের কি নিশ্চিতভাবে ছেড়ে দেয়া হবে এখানকার এই জিনিস-গুলোর মধ্যে এই বাগ-বাগিচা, এই ঝর্ণাধারা, এই শস্য ক্ষেত এবং মনোহর আবরণযুক্ত খেজুরের বাগান? আর তোমরা পাহাড় কেটে বাড়ি তৈরী করছো এবং খুশীতে রয়েছো।” -(সূরা আশ শুয়ারাঃ১৪৬-১৪৯)

اَیۡنَ مَا تَکُوۡنُوۡا یُدۡرِکۡکُّمُ الۡمَوۡتُ وَ لَوۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ بُرُوۡجٍ مُّشَیَّدَۃٍ

“তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদের আসবেই-চাই তোমরা খুব সুদৃঢ় কেল্লার মধ্যেই থাকো না কেন।” -(সূরা আন নিসাঃ ৭৮)

 کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ۟ ثُمَّ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ

“প্রত্যেককেই মৃত্যুবরণ করতে হবে; তারপর তোমদের সবাইকে আমাদের দিকে নিয়ে আসা হবে।”-(সূরা আনকাবুতঃ৫৭)

১১৫ اَفَحَسِبۡتُمۡ اَنَّمَا خَلَقۡنٰکُمۡ عَبَثًا وَّ اَنَّکُمۡ اِلَیۡنَا لَا تُرۡجَعُوۡنَ

“তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছো যে, আমরা তোমাদেরকে নিষ্ফল পয়দা করেছি এবং তোমাদেরকে আমাদের দিকে ফিরিয়ে আনা হবে না?” - (সুরা মুমিনুন: ১১৫)

পূর্বে বলা হয়েছিল যে, দুনিয়া তোমদের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে; তোমরা একে খুব উত্তমরূপে ভোগ-ব্যবহার করো। এবার বিষয়টির অপর দিক পেশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, দুনিয়া তেমাদের জন্যে হলেও তোমরা দুনিয়ার জন্যে নও। অথবা দুনিয়া তোমাদের ভোগ-ব্যবহার করবে আর তোমরা তার মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে, এ জন্যেও তাকে সৃষ্টি করা হয়নি। দুনিয়ার জীবনে প্রতারিত হয়ে তোমরা কখনো এ ধারণা পোষণ করো না যে, তোমাদের এখানে চিরকাল থাকতে হবে। খুব ভালোমতো জেনে রাখো এই মাল-মাত্তা, ধন-দৌলত, শান-শওকত, সামানপত্র সবকিছুই অস্থায়ী জিনিস। সবকিছুই হচ্ছে কালের ধোঁকা মাত্র। এর সবারই পরিণাম হচ্ছে ধ্বংস। তোমাদের ন্যায় এর প্রতিটি বস্তুই মাটিতে মিশে যাবে। এ অস্থায়ী জগতের মধ্যে একমাত্র বাকী থাকার মতো জিনিস হচ্ছে মানুষের নেকী; তার দিল ও আত্মার নেকী; তার আমল ও আচরণের নেকী।

কৃতকর্মের দায়িত্ব ও জবাবদিহি

এরপর বলা হয়েছে-

১৫ اِنَّ السَّاعَۃَ اٰتِیَۃٌ اَکَادُ اُخۡفِیۡهَا لِتُجۡزٰی کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا تَسۡعٰی

“বিচারের সময় যাকে আমরা গোপন রাখার ইচ্ছে পোষণ করি-অবশ্যই সমুপস্থিত হবে, যাতে করে প্রত্যেকেই তার চেষ্টানুযায়ী ফল পেতে পারে।”-(সূরা ত্বাহা-১৫)

৯০ وَ مَنۡ جَآءَ بِالسَّیِّئَۃِ فَکُبَّتۡ وُجُوۡهُهُمۡ فِی النَّارِ ؕ هَلۡ تُجۡزَوۡنَ اِلَّا مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ

“তোমাদের কি তোমাদের আমল ছাড়া অন্য কোন জিনিসের দৃষ্টিতে প্রতিফল দেয়া হবে?” -(সূরা আন নমল: ৯০)

৩৯ وَ اَنۡ لَّیۡسَ لِلۡاِنۡسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی
৪০ وَ اَنَّ سَعۡیَهٗ سَوۡفَ یُرٰی
৪১ ثُمَّ یُجۡزٰىهُ الۡجَزَآءَ الۡاَوۡفٰی
৪২ وَ اَنَّ اِلٰی رَبِّکَ الۡمُنۡتَهٰی 

“আর মানুষ ততটুকুই ফল লাভ করবে যতটুকু চেষ্টা সে করেছে; তার প্রচেষ্টা শীগগীরই দেখে নেয়া হবে।অতপর সে পুরোপুরি ফল লাভ করবে। আর পরিশেষে সবাইকে তোমাদের পরোয়ারদেগারের কাছেই পৌঁছতে হবে।” -(সূরা আন নাজম: ৩৯-৪২)

৭২ وَ مَنۡ کَانَ فِیۡ هٰذِهٖۤ اَعۡمٰی فَهُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ اَعۡمٰی وَ اَضَلُّ سَبِیۡلًا 

“যে ব্যক্তি এ দুনিয়ায় অন্ধ থাকে সে আখেরাতেও অন্ধ থাকবে। আর সে সঠিক পথ থেকে দূরে সরে আছে।”-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ৭২)

 وَ مَا تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡهُ عِنۡدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ

“তোমরা নিজেদের জন্যে এ দুনিয়া থেকে যেসব নেকী পাঠাবে, আল্লাহর কাছে গিয়ে ঠিক তা-ই পাবে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ সবই দেখেন।” -(সূরা আল বাকারাঃ১১০)

২৮১ وَ اتَّقُوۡا یَوۡمًا تُرۡجَعُوۡنَ فِیۡهِ اِلَی اللّٰهِ ٭۟ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ هُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ

“সে দিনকে ভয় করো যে দিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। অতপর প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের বদলা পাবে এবং তাদের প্রতি কখনোই যুলুম করা হবে না।” -(সূরা আল বাকারাঃ২৮১)

یَوۡمَ تَجِدُ کُلُّ نَفۡسٍ مَّا عَمِلَتۡ مِنۡ خَیۡرٍ مُّحۡضَرًا ۚۖۛ وَّ مَا عَمِلَتۡ مِنۡ سُوۡٓءٍ ۚۛ

“সে দিন প্রত্যেকেই তার কৃত নেকী এবং তার কৃত বদী কে উপস্থিত পাবে।” -(সূরা আলে ইমরানঃ৩০)

“সেদিন যাবতীয় কৃতকর্মের (আমলের) পরিমাপ এক ধ্রুব সত্য। যাদের আমলের পাল্লা ভারী হবে, কেবল তারাই কল্যাণ লাভ করবে আর যাদের আমলের পাল্লা হালকা হবে, তারাই হবে নিজেদের ক্ষতিসাধনকারী।কেননা তারা আমাদের আয়াতের প্রতি যুলুম করছিলো।”

৮ وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ شَرًّا یَّرَهٗ  ৭ فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَهٗ ؕ

“যে ব্যক্তি অণু পরিমাণও নেক কাজ করবে তার প্রতিফল সে দেখতে পাবে, আর যে অণু পরিমাণও পাপ করবে, তার প্রতিফলও সে দেখতে পাবে।”-(সূরা আয যিলযাল ৭-৮)

 فَاسۡتَجَابَ لَهُمۡ رَبُّهُمۡ اَنِّیۡ لَاۤ اُضِیۡعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنۡکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی ۚ بَعۡضُکُمۡ مِّنۡۢ

“আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেছেন এবং বলেছেন, আমি তোমদের কোন আমলকারীর আমলকেই নষ্ট হতে দেবো না-সে পুরুষই হোক কিংবা নারী।”-(সূরা আলে ইমরানঃ১৯৫)

১০ وَ اَنۡفِقُوۡا مِنۡ مَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ اَحَدَکُمُ الۡمَوۡتُ فَیَقُوۡلَ رَبِّ لَوۡ لَاۤ اَخَّرۡتَنِیۡۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ اَکُنۡ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ 
১১ وَ لَنۡ یُّؤَخِّرَ اللّٰهُ نَفۡسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُهَا ؕ وَ اللّٰهُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ 

“আমরা তোমাদেরকে যা কিছু দান করেছি, তা থেকে খরচ করো, তোমাদের ভেতরকার কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। যখন সে বলবেঃ হে আমার প্রভূ! তুমি যদি আমাকে আর কিছুটা সময় দান করতে তাহলে তোমার পথে আমি খরচ করতাম এবং নেককারদের অন্তর্ভূক্ত হতাম। কিন্তু কারোর নির্ধারিত সময় আসার পর আল্লাহ তাকে কখোনই সময় দান করেন না। ”-(সূরা মুনাফিকুনঃ১০-১১)

১২ وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذِ الۡمُجۡرِمُوۡنَ نَاکِسُوۡا رُءُوۡسِهِمۡ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ ؕ رَبَّنَاۤ اَبۡصَرۡنَا وَ سَمِعۡنَا فَارۡجِعۡنَا نَعۡمَلۡ صَالِحًا اِنَّا مُوۡقِنُوۡنَ
১৩ وَ لَوۡ شِئۡنَا لَاٰتَیۡنَا کُلَّ نَفۡسٍ هُدٰىهَا وَ لٰکِنۡ حَقَّ الۡقَوۡلُ مِنِّیۡ لَاَمۡلَـَٔنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الۡجِنَّۃِ وَ النَّاسِ اَجۡمَعِیۡنَ
১৪ فَذُوۡقُوۡا بِمَا نَسِیۡتُمۡ لِقَآءَ یَوۡمِکُمۡ هٰذَا ۚ اِنَّا نَسِیۡنٰکُمۡ وَ ذُوۡقُوۡا عَذَابَ الۡخُلۡدِ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ

“হায়”! সেই সময়টা যদি তুমি দেখতে যখন অপরাধী তার প্রভূর সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়াবে এবং বলবেঃ হে আমাদের পরোয়ারদেগার! এবার আমরা দেখে নিয়েছি এবং শুনতেও পেয়েছি; এক্ষণে তুমি আমাদেরকে ফিরিয়ে দাও, আমরা ভালো কাজ করবো, এবার আমরা প্রত্যয় লাভ করেছি। কিন্তু বলা হবেঃ এবার তোমরা সেই গাফিলতের স্বাদ গ্রহণ করো, যে কারণে তোমরা এই দিন আমাদের সামনে হাযির হওয়ার ব্যাপারকে ভুলে গিয়েছিলে। আজকে আমরাও তোমাদের কে ভুলে গেছি। সুতরাং তোমরা যে ‘আমল’ করতে, তার বিনিময়ে আজ চিরস্থায়ী আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো।” -(সূরা আস-সাজদাঃ ১২-১৪

এখানে বলা হয়েছে যে, দুনিয়া হচ্ছে কাজের ক্ষেত্র; চেষ্টা ও সাধনার স্থান। আর পরকালীন জীবন হচ্ছে প্রতিফল লাভের ক্ষেত্র; নেকী ও বদীর ফল এবং কৃতকর্মের প্রতিদান পাবার স্থান। মানুষ তার মৃত্যু সময় পর্যান্ত দুনিয়ায় কাজ করার সুয়োগ পেয়েছে। এরপর সে কখনো আর কাজের সুযোগ পাবে না। সুতরাং এই জীবনে তাকে একথা স্মরণ রেখে কাজ করতে হবে যে, আমার প্রতিটি কাজ প্রতিটি আচরণ এবং ভালোমন্দ প্রতিটি আমলেরই একটি নিজস্ব প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে এবং সেই প্রভাব ও গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই আমি পরকালীন জীবনে ভালো বা মন্দ ফল লাভ করব। আমি যা কিছু পাবো তা তার এই জীবনের প্রয়াস প্রচেষ্টা এবং এখনকার কাজেরই প্রতিফল হিসেবে পাবো; আমার কোন নেকী না বিনষ্ট হবে আর না কোন পাপকে ছেড়ে দেয়া হবে।

ব্যক্তিগত দায়ীত্ব

এই দায়িত্বানুভূতিকে অধিকতর জোরদার করে তোলার জন্যে এ-ও বলে দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজস্ব কাজের জন্যে দায়িত্বশীল। তার এই দায়িত্বের ব্যাপারে না অন্য কেউ অংশীদার রয়েছে, আর না কেউ কাউকে তার কাজের ফল হতে বাঁচাতে পারে।

"عَلَیۡکُمۡ اَنۡفُسَکُمۡ ۚ لَا یَضُرُّکُمۡ مَّنۡ ضَلَّ اِذَا اهۡتَدَیۡتُمۡ"

তোমাদের ওপর তোমাদের আপন সত্তার দায়িত্ব রয়েছে। তোমরা যদি হেদায়াত পাও তাহলে অপর কোন বিভ্রান্ত ব্যক্তি তোমাদের কোন ক্ষতিসাধান করতে পারে না।” -(সূরা আল-মায়েদাঃ ১০৫)

وَ لَا تَکۡسِبُ کُلُّ نَفۡسٍ اِلَّا عَلَیۡهَا ۚ وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی

“প্রত্যেক ব্যক্তি যা কিছু অর্জন করে, তার বোঝা তারই ওপর ন্যস্ত; কেউ কারো বোঝা বহন করে না।” -(সূরা আল-আন’আমঃ ১৬৪)

لَنۡ تَنۡفَعَکُمۡ اَرۡحَامُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ ۚۛ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ۚۛ یَفۡصِلُ بَیۡنَکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ 

“কেয়ামতের দিন তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং তোমাদের সন্তানাদি কোনই কাজে আসবে না। সেদিন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করবেন, আর তাঁর দৃষ্টি রয়েছে তোমাদের আমলের প্রতি।” -(সূরা মুমতাহিনাঃ ৩)

اِنۡ اَحۡسَنۡتُمۡ اَحۡسَنۡتُمۡ لِاَنۡفُسِکُمۡ ۟ وَ اِنۡ اَسَاۡتُمۡ فَلَهَا ؕ

“তোমারা নেক কাজ করলে নিজেদের জন্যেই করবে আর দুষ্কর্ম করলে তাও নিজেদের জন্যে।” – (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭)

وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ؕ وَ اِنۡ تَدۡعُ مُثۡقَلَۃٌ اِلٰی حِمۡلِهَا لَا یُحۡمَلۡ مِنۡهُ شَیۡءٌ وَّ لَوۡ کَانَ ذَا قُرۡبٰی ؕ

“কোন ব্যক্তি অন্য কারোর গোনাহের বোঝা মাথায় নিবে না; যদি কারোর ওপর গোনাহের বড়ো বোঝা চেপে থাকে এবং সে সাহায্যের হাত প্রসারিত করার জন্যে কাউকে ডাকে, তবে সে তার বোঝার কোন অংশই নিজের মাথায় তুলে নিবে না- সে আত্বীয়-স্বজনই হোক না কেন।” -(সূরা আল-ফাতিরঃ ১৮)

 یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمۡ وَ اخۡشَوۡا یَوۡمًا لَّا یَجۡزِیۡ وَالِدٌ عَنۡ وَّلَدِهٖ ۫ وَ لَا مَوۡلُوۡدٌ هُوَ جَازٍ عَنۡ وَّالِدِهٖ شَیۡئًا ؕ

“হে মানব জাতি! আপন প্রভুকে ভয় করো আর সেই দিনকে ভয় করো, যেদিন না কোন পিতা তার পুত্রের কাজে আসবে আর না পুত্র তার পিতার কিছুমাত্র কাজে আসবে।” -(সূরা লোকমানঃ ৩৩)

مَنۡ کَفَرَ فَعَلَیۡهِ کُفۡرُهٗ ۚ وَ مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِاَنۡفُسِهِمۡ یَمۡهَدُوۡنَ

“যে ব্যক্তি কুফরী করেছে তার কুফরির বোঝা তারই উপর ন্যস্ত, আর যে ব্যক্তি নেক কাজ করলো সে ধরনের লোকেরাই নিজেদের কল্যাণের জন্যে রাস্তা পরিষ্কার করছে।” -(সুরা আর-রুমঃ ৪৪)

এখানে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি মানুষের ওপরই তার ভালো ও মন্দ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে। এর ভেতরে না এ আশা পোষণের কোন সুযোগ রাখা হয়েছে যে, আমাদের দোষ-ত্রুটি বা গাফিলতির কেউ কাফফারা আদায় করবে, আর না এ প্রত্যাশার কোন অবকাশ রয়েছে যে, কারো কোন আত্মীয়তা বা সম্পর্কের কারণে আমরা আমাদের অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতি পাবো এবং এ আশংকারও কোন সুযোগ রাখা হয়নি যে, কারো দুষ্কৃতি আমাদের নেক কাজকে প্রভাবিত করবে, কিংবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি আমাদের আমলের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির ওপর প্রভাবশীল হতে পারে। কেউ আগুনে হাত প্রদান করলে তার স্বাভবিক দাহ থেকে কোন জিনিস তাকে রক্ষা করতে পারে না। আবার কেউ মধু পান করলে তার মিষ্ট স্বাদ উপলব্ধি থেকেও কোন জিনিস তাকে বাধা দিতে পারে না। না দহনের জ্বালা ভেগের ব্যাপারে কেউ কারো শরীকদার হতে পারে, আর না মিষ্টি স্বাদ গ্রহণে কেউ কাউকে বঞ্চিত করতে পারে। ঠিক তেমনি পাপের কুফল এবং সৎকাজের সুফলের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিঃসঙ্গ ও অন্য নিরপেক্ষ। সুতরাং দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করার ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তিরই পূর্ণ দায়িত্ববোধ থাকা অপরিহার্য। দুনিয়া ও তার অন্তর্গত বস্তুনিচয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে এ ভেবে তার জীবন যাপন করা উচিত যে, তার প্রতিটি কাজের জন্যে সে নিজেই দায়িত্বশীল; পাপের বোঝাও তার একার উপরই ন্যস্ত, আর সৎকাজের ফায়দাও সে একাকীই ভোগ করবে।

ওপরে পার্থিব জীবন সম্পর্কিত ইসলামী ধারণার যে ব্যাখ্যা দান করা হলো তাতে তার বিভিন্ন অংশ ও উপাদানগুলো প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। এখন তার গঠন ও বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক এবং বিক্ষিপ্ত অংশগুলোর সমন্বয়ের ফলে যে পূর্ণাঙ্গ ধারণাটি গড়ে উঠে তা কতখানি প্রকৃতি ও বাস্তবের সাথে সংগতিপূর্ণ, পার্থিব জীবন সম্পর্কে অন্যান্য সংস্কৃতিগুলোর ধারণার তুলনায় এর কি মর্যাদা হতে পারে এবং এই জীবন দর্শনের ওপর যে সংস্কৃতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় তা মানুষের চিন্তা ও কর্মকে কোন বিশেষ ছাঁচে ঢালাই করে, তা-ও দেখা যাক।




*************************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url