মা’আরেফুল কোরআন-৫ || সূরা আল-ফাতিহার ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য || বিসমিল্লাহর তফসীর || সূরাতুল ফাতিহার বিষয়বস্তু ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة الفاتحة

সূরা আল-ফাতিহা 

এই সূরাটি মক্কী এবং এর আয়াত সংখ্যা সাত

সূরা আল-ফাতিহার ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য

সূরা আল-ফাতিহা কোরআনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সুরা । প্রথমত এ সূরা দ্বারাই পবিত্র কোরআন আরঙ্গ হয়েছে এবং এই সূরা দিয়েই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত নামায আরম্ভ হয়। অবতরণের দিক দিয়েও পূর্ণাঙ্গ সূরাপে এটিই প্রথম নাযিল হয়। সূরা "ইকরা', 'মুযযাম্মিল' ও সূরা মুদ্দাসিরের কটি আয়াত অবশ্য সূরা আল-ফাতিহার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এ সূরার অবতরণই সর্বপ্রথম। যে সকল সাহাবা (রা) সূরা আল-ফাতিহা সর্বপ্রথম নাযিল হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের সে বক্তব্যের অর্থ বােধ হয় যে, পরিপূর্ণ সূরারূপে এর আগে আর কোন সূরা নাযিল হয়নি। এ জন্যই এই সূরার নাম ফাতিহাতুল-কিতাব বা কোরআনের উপক্রমণিকা রাখা হয়েছে।

সূরাতুল ফাতিহা একদিক দিয়ে সন্ত্র কোরআনের সারসংক্ষেপ। এ সূয় সন্ত্র কোরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্তাকারে বলে দেওয়া হয়েছে। কোরআনের অবশিষ্ট সূরাগুলাে প্রকারান্তরে সূরাতুল ফাতিহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। কারণ, সমগ্র কোরআন প্রধানত ঈমান এবং নেক আমলের আলোচনাতেই কেন্দ্রীভূত। আর এ দুটি মূলনীতিই এ সূরায় সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে। তফসীরে রুহুল মাআনী ও রুহুল বয়ানে এর বিস্তারিত আলােচনা রয়েছে। তাই এ সূরাকে সহীহ হাদীসে ‘উম্মুল কোরআন “উম্মুল কিতাব’, ‘কোরআনে আযীম' বলেও অভিহিত করা হয়েছে। (কুরতুবী)

অথবা এ জন্য যে, যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত বা অধ্যয়ন করবে তার জন্য এ মর্মে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যেন প্রথমে পূর্বঘােষিত যাবতীয় ধ্যান-ধারণা অন্তর থেকে দূরীভূত করে একমাত্র সত্য ও সঠিক পথের সন্ধানের উদ্দেশ্যে এ কিতাব তেলাওয়াত আর করে এবং আল্লাহর নিকট এ প্রার্থনাও করে যে, তিনি যেন তাকে সিরাতুল-মুত্তাকীমের হেদায়েত দান করেন।

এ সুরার প্রথমেই রয়েছে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা। এর অর্থ হচ্ছে প্রশংসার মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে হেদায়েতের দরখাস্ত পেশ করা হলাে। আর এ দরখাস্তের প্রত্যুত্তরই সমগ্র কোরআন, যা  الٓـمّٓ ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর নিকট সঠিক পথের যে সন্ধান চেয়েঁছে, আল্লাহ পাক তার প্রত্যুত্তরে '  الٓـمّٓ ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ  বলে ইশারা করে দিলেন যে, হে আদম সন্তানগণ, তোমরা যা চাও তা এ গ্রন্থেই রয়েছে।

হযরত রাসূলে করীম (সা) এরশাদ করেছেন যে, যার হাতে আমার জীবন-মরণ, আমি তার শপথ করে বলছি সূরা আল-ফাতিহার দৃষ্টান্ত তওরাত, ইনীল, যবুর প্রভৃতি অন্য কোন আসমানী কিতাবে তাে নেই-ই, এমনকি পবিত্র কোরআনেও এর দ্বিতীয় নেই। ইমাম তিরমিযী আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আরাে বলেছেন যে সূরায়ে ফাতিহা প্রত্যেক রােগের ঔষধবিশেষ।

হাদীস শরীফে সূরা আল-ফাতিহাকে সূরায়ে শেফাও বলা হয়েছে। (কুরতুবী)
বােখারী শরীফে হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, সমগ্র কোরআনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সূরা হচ্ছে  اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ - কুরতুবী)



بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি

بِسْمِ اللَّهِ কোরআনের একটি আয়াতঃ
সমস্ত মুসলমান এতে একমত যে, بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ কোরআন শরীফের সূরা নামূলের একটি আয়াত বা অংশ এবং এ ব্যাপারেও একমত যে, সূরা তওবা ব্যতীত প্রত্যেক সূরার প্রথমে بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ লেখা হয়। بِسْمِ اللَّهِ  সূরা আল-ফাতিহার অংশ না অন্যান্য সকল সূরারই অংশ, এতে ইমামগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পােষণ করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (র) বলেছেন بِسْمِ اللَّهِ সূরা নামূল ব্যতীত অন্য কোন সূরার অংশ নয়। তবে এটি এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আয়াত যা প্রত্যেক সুরার প্রথমে লেখা এবং দুটি সূরার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য এটি অবতীর্ণ হয়েছে।

কোরআন তেলাওয়াত ও প্রত্যেক কাজ বিসমিল্লাহসহ আরম্ভ করার আদেশঃ জাহেলিয়াত যুগে লােকদের অভ্যাস ছিল, তারা তাদের প্রত্যেক কাজ উপাস্য দেব-দেবীদের নামে শুরু করতাে। এ প্রথা রহিত করার জন্য হযরত জিবরাঈল (আ) পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম যে আয়াত নিয়ে এসেছিলেন, তাতে আল্লাহর নামে কোরআন তেলাওয়াত আরম্ভ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। যথা. اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ

আল্লামা সুতী (র) বলেছেন যে, শুধু কোরআনই নয়, বরং অন্যান্য আসমানী কিতাবও বিসমিল্লাহ দ্বার আরম্ভ করা হয়েছিল। কোন কোন আলিম বলেছেন যে, বিসমিল্লাহ পবিত্র কোরআন ও উম্মতে মুহাম্মদীর বিশেষত্ব। উল্লেখিত দুটি মতের মীমাংসা হচ্ছে এই যে, আল্লাহু তা'আলার নামে আরম্ভ করার আদেশ সকল আসমানী কিতাবের জন্যই বিদ্যমান ছিল। তবে بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ এর শব্দগুলাে কোরআনের বিশেষত্ব, যেমন, কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, স্বয়ং রাসূলে করীম (সা)-ও প্রথমে প্রত্যেক কাজ  بِاسْمِكَ اَللَّهُمَّ বলে আরম্ভ করতেন এবং কোন কিছু লেখাতে হলেও এ কথা প্রথমে লেখাতেন। কি بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ অবতীর্ণ হওয়ার পর এ বর্ণগুলােকেই গ্রহণ করা হলাে এবং সর্বকালের জন্য বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে সব কাজ শুরু করার নিয়ম প্রবর্তিত হলাে। (কুরতুবী, রুহুল মা'আনী)।

কোরআন শরীফের স্থানে স্থানে উপদেশ রয়েছে যে, প্রত্যেক কাজ বিসমিল্লাহ বলে আরম্ভ কর। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে, “যে কজ বিসমিল্লাহ ব্যতীত আরম্ভ করা হয়, তাতে কোন বরকত থাকে না।
এক হাদীসে এরশাদ হয়েছে, ঘরের দরজা বন্ধ করতে বিসমিল্লাহ বলবে, বাতি নেভাতেও বিসমিল্লাহ বলবে, পাত্র আবৃত করতেও বিসমিল্লাহ বলবে। কোন কিছু খেতে, পানি পান করতে, ওযু করতে, সওয়ারীতে আরােহণ করতে এবং তা থেকে অবতরণকালেও বিসমিল্লাহ বলার নির্দেশ কোরআন-হাদীসে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। (কুরতুবী)।

প্রত্যেক কাজে বিসমিল্লাহ বলার রহস্যঃ
ইসলাম প্রত্যেক কাজ বিসমিল্লুাহ বলে শুরু করার নির্দেশ দিয়ে মানুষের গােটা জীবনের গতিই অন্য সকল কিছুর দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে একমাত্র আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বারবার আল্লাহর নামে কাজ শুরু করার মাধ্যমে সে প্রতি মুহুর্তেই আনুগত্যের এ স্বীকারােক্তি নবায়ন করে যে, আমার অস্তিত্ব ও আমার যাবতীয় কাজকর্ম আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্য ছাড়া হতে পারে না। এ নিয়তের ফলে তার ওঠাবসা, চলাফেরাসহ পার্থিব জীবনের সকল কাজকর্ম ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়।

কাজটা কতই না সহজ! এতে সময়ের অপচয় হয় না, পরিশ্রমও হয় না, কিন্তু উপকারিতা একান্তই সদূরপ্রসারী। এতে দুনিয়াদারীর প্রতিটি কাজ দীনের কাজে রূপান্তরিত হয়ে যায় । মুসলমনি-আমুসলমান নির্বিশেষে সকলেই পানাহার করে, কিন্তু মুসলমান আহার গ্রহণের পূর্বে বিসমিল্লাহ বলে এ স্বীকারােক্তি জানায় যে, আহাৰ্যবস্তু যমীনে উৎপন্ন হওয়া থেকে শুরু করে পরিপক হওয়া পর্যন্ত তাতে কত পরিশ্রমই না নিয়ােজিত হয়েছে। আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্রের কত অবদানেই না এক একটি শস্যদানার দেহ পুষ্টি লাভ করেছে। মানুষ, প্রকৃতি এবং উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত অন্যান্য জীব-জানােয়ারের যে অবদান খাদ্যের প্রতিটি কণায় বিদ্যমান, তা আমার শ্রম বা চেষ্টা দ্বারা সম্ভবপর ছিল না। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই অনুগ্রহ করে এগুলোকে বিবর্তনের সকল স্তর অতিক্রম করিয়ে উপাদেয় আহার্যরূপে আমাকে দান করেছেন।

মুসলমান-অমুসলমান সকলেই শােয়, ঘুমায়, আবার জেগে ওঠে। কিন্তু মু'মিন তার শোয়ার এবং জেগে ওঠার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আল্লাহর সাথে তার যােগাযােগের সম্পর্ক নবায়ন করে। ফলে তার জাগতিক কাজকর্মও আল্লাহর যিকিরে কপান্তরিত হয়ে বন্দেগীরূপে লিখিত হয়। একজন মু'মিন কোন যানবাহনে আরােহণকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে, এ যানবাহনের সৃষ্টি এবং আমার ব্যবহারে এনে দেওয়া ছিল মানবীয় ক্ষমতার উর্ধ্বে। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সুধু এক পরিচালনা পদ্ধতির বদৌলতে কোথাকার কাঠ, কোথাকার লােহা, কোথাকার কারিগর, কোথাকার চালক সবকিছু সমবেত করে সবগুলোকে মিলিয়ে আমার খেদমতে নিয়ােজিত করেছেন। সামান্য কয়টি পয়সা ব্যয় করে আল্লাহর এতবড় সৃষ্টি আমার নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারছি এবং সে পয়সা আমি নিজে কোন জায়গা হতে সঙ্গে নিয়ে আসিনি; বরং তা সংগ্রহ করার সকল ব্যবস্থাও তিনিই করে দিয়েছেন। চিন্তা করুন, ইসলামের এ সামান্য শিক্ষা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় পৌছে দিয়েছে। এজন্য এরূপ বলা যথার্থ যে, বিসমিল্লাহ এমন এক পরশপাথর যা শুধু তামাকে নয়, বরং মাটিকেও স্বর্ণে পরিণত করে।
فلله الحمد على دين الاسلام وتعليماته .

মাসআলাঃ
কোরআন তেলাওয়াত শুরু করার আগে প্রথমে أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ এবং পরে  بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ পাঠ করা সুন্নত। তেলাওয়াতের মধ্যেও সূরা তওবা ব্যতীত সকল সূরার প্রথমে বিসমিল্লাহ্ পাঠ করা সুন্নত।

বিসমিল্লাহর তফসীর

বিসমিল্লাহ বাক্যটি তিনটি শব্দ দ্বারা গঠিত। প্রথমত বা বর্ণ, দ্বিতীয়ত ‘ইসম' ও 'তৃতীয়ত “আল্লাহ'। আরবী ভাষায় ‘বা' বর্ণটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে তিনটি অর্থ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে এবং এ তিনটির যে কোন একটি অর্থ এক্ষেত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে। এক—সংযােজন। অর্থাৎ এক বস্তুকে অপর বস্তুর সাথে মিলানাে বা সংযােগ ঘটানাে অর্থে। দুই—এস্তেয়ানাত-অর্থাৎ কোন বস্তুর সাহায্য নেওয়া। তিন—কোন বস্তু থেকে বরকত হাসিল করা।

ইসম শব্দের ব্যাখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক। মােটামুটিভাবে এতটুকু জেনে রাখা যথেষ্ট যে, 'ইসম’ নামকে বলা হয়। আল্লাহ' শব্দ সৃষ্টিকর্তার নামসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মহত্তর ও তার যাবতীয় শুণের সম্মিলিপ্ত রূপ। কোন কোন আলিম একে ইসমে আযম বলেও অভিহিত করেছেন।

এ নামটি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য প্রযােজ্য নয়। এজন্যই এ শব্দটি দ্বিবচন বা বহুবচন হয় না। কেননা, আল্লাহ এক ; তার কোন শরীক নেই। মােটকথা, আল্লাহ এমন এক সত্তার নাম, যে সত্তা পালনকর্তার সমস্ত গুণের এক অসাধারণ প্রকাশবাচক। তিনি অদ্বিতীয় ও নজীরবিহীন। এজন্য বিসমিল্লাহ শব্দের মধ্যে বা'-এর তিনটি অর্থের সামঞ্জস্য হচ্ছে আল্লাহর নামের সাথে, তার নামের সাহায্যে এবং স্ত্রীর নামের বরকতে।

কিন্তু তিন অবস্থাতেই যতক্ষণ পর্যন্ত তার নামের সাথে তার নামের সাহায্যে এবং তার নামের বরকতে, যে কাজ করা উদ্দেশ্য তা উল্লেখ করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বাক্যটি অসম্পূর্ণ থাকে। এজন্য ইলমে নাহবের' (আরবী ব্যাকরণশাস্ত্র) নিয়মানুযায়ী স্থান-উপযােগী ক্রিয়া উহ ধরে নিতে হয়। যথা, “আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি বা পড়ছি।' এ ক্রিয়াটিকে উহ্যই ধরতে হবে, যাতে আৱষ্ক আল্লাহর নামে' কথাটি প্রকাশিত হয়। সে উহ বিষয়টিও আল্লাহর নামের পূর্বে হবে না। আরবী ভাষার নিয়মানুযায়ী শুধু 'বা' বর্ণটি আল্লাহর নামের পূর্বে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ব্যাপারে মাসহাফে-উসমানীতে সাহাবাগণের সম্মিলিত অভিমত উদ্ধৃত করে মন্তব্য করা হয়েছে যে, 'বা' বর্ণটি “আলিফ'-এর সঙ্গে মিলিয়ে এবং “ইসম' শব্দটি পৃথকভাবে লেখা উচিত ছিল। এমতাবস্থায় শব্দের রূপ হতো بِسْمِ اللَّهِ ! কিন্তু মাসহাফে-উসমানীর লিখন পদ্ধতিতে “হাম' বর্ণটি উহ্য রেখে 'বা'-কে 'সীন'-এর সাথে যুক্ত করে লিখে ‘বা'-কে ইসমের অংশ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে আরম্ভটা আল্লাহর নামেই হয়'। একই কারণে অনত্রি আলিফকে উহ রাখা হয় না। যথা اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ  এতে ‘বা'-কে ‘আলিফের সাথে লেখা হয়েছে। মােটকথা, বিসমিল্লাহর বেলায় বিশেষ এক পদ্ধতি অনুসরণ করেই ‘বা' বর্ণকে ‘ইসম'-এর সঙ্গে মিলিত করে লেখার নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে। الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ এ রহমান ও রহীম উভয়ই আল্লাহর গুণবাচক নাম। রহমান অর্থ সাধারণ ও ব্যাপক রহমত এবং রাহীম অর্থ পরিপূর্ণ ও বিশেষ রহমত।

সাধারণ রহমতের অর্থ হচ্ছে যে, এ রহমত বা দয়া সমগ্র জাহানে যা সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যা সৃষ্টি হবে, সে সকলের জন্যই সমভাবে প্রযােজ্য। পরিপূর্ণ রহমত অর্থ হচ্ছে যে, তা সম্পূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ। আর এ জন্যই ‘রহমান” শব্দ আল্লাহ্ তা'আলাৱ 'যাতের জন্য নির্দিষ্ট। কোন সৃষ্টিকে রহমান বলা চলে না। কারণ আল্লাহ ব্যতীত এমন কোন সত্তা নেই, যার রহমত বা দয়া সমন্ত বিশ্ব-চরাচরে সমভাবে বিস্তৃত হতে পারে। এজন্য আল্লাহ” শব্দের ন্যায় ‘রহমান শব্দেরও দ্বি-বচন বা বহুবচন হয় না। কেননা, এ শব্দটি একক সত্তার সাথে সংযুক্ত বা একক সবার জন্য নির্দিষ্ট। তাই এখানে দ্বিন্ধীয় বা তৃতীয় কারাে উপস্থিতির সম্ভাবনা নেই। (কুরতুবী)

রহীম' শব্দের অর্থ 'রহমান' শব্দের অর্থ থেকে স্বতন্ত্র। কারণ, কোন ব্যক্তির পক্ষে অন্য ব্যক্তির প্রতি দয়া প্রদর্শন করা সম্ভব, সুতরাং সে দয়া বা রহমত এ শব্দে প্রযােজ্য হওয়া অসম্ভব নয়। এ জন্য রহীম' শব্দ মানুষের জন্যও বলা যেতে পারে। আল-কোরআনে রাসুল (সা)-এর জন্যও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয়েছে- بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ .

মাসআলাঃ
আজকাল আবদুর রহমান, ফজলুর রহমান প্রভৃতি নাম সংক্ষেপ করে শুধু রহমান' বলা হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ‘রহমান" বলে ডাকা হয়। এরূপ সংক্ষেপ করা। জায়েয নয় ; পাপের কাজ।

জ্ঞাতব্যঃ বিসমিল্লাহুতে আল্লাহ্ তা'আলার সুন্দর নাম ও পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীর মধ্যে মাত্র দু'টি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। শব্দ দুটিই “রহমত শব্দ হতে গঠিত হয়েছে, যা রহমতের ব্যাপকতার প্রতি ইশারা করে। এতে একথাও বােঝানাে হয়েছে যে, এ বিশ্ব চরাচর, আকাশ, বাতাস, সৃষ্টিরাজি পয়দা করা, এ সবের রক্ষণাবেক্ষণ ও লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করাও আল্লাহ তা'আলার গুণাবলীতে সংযুক্ত। কোন বস্তুকেই তিনি স্বীয় প্রয়ােজনে বা অন্য কারাে প্ররােচনায় বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সৃষ্টি করেন নি। বরং তাঁর রহমত বা দয়ার 'তাকিদেই সৃষ্টি করে এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রতিপালনের ব্যবস্থা করেছেন।

তাআব্বুজ' শব্দের অর্থ أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ  পাঠ করা। আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে যখন কোরআঁন পাঠ কর, তখন শয়তানের প্রতারণা হতে আল্লাহ তা'আলার নিকট আশ্রয় চাও। দ্বিতীয়ত, কোরআন পাঠের প্রাক্কালে আ'উযুবিল্লাহ পাঠ করা ইজমায়ে-উম্মত দ্বারা সুন্নত বলে স্বীকৃত হয়েছে। এ পাঠ নামাযের মধ্যেই হােক বা নামাযের বাইরেই হােক। কোরআন তেলাওয়াত ব্যতীত অন্যান্য কাজে শুধু বিসমিল্লাহ পাঠ করা সুন্নত, আ'উযুবিল্লাহ নয় । যখন কোরআন তেলাওয়াত আরম্ভ করা হয়, তখন আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ উভয়টিই পাঠ করা সুন্নত। তেলাওয়াতকালে একটি সূরা শেষ করে অপর সূরা আরঞ্চ করার পূর্বে শুধু সূরা তওবা ব্যতীত অন্য সব সূৱা তেলাওয়াতের আগে বিসমিল্লাহ পাঠ করতে হয়। তেলাওয়াত করার সময় মধ্যে সূরা-বারাআত এলে তখন বিসমিল্লাহ পড়া নিষেধ। কিন্তু প্রথম তেলাওয়াতই যদি সল্লা বারাআত দ্বারা আরম্ভ হয়, তবে আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ উভয়টিই পাঠ করতে হবে। (আলমগিরী)

"বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম', কোরআনের সূরা নামল-এর একটি আয়াতের অংশ এবং দুটি সূরার মাঝখানে একটি পূর্ণাঙ্গ আয়াত। তাই অন্যান্য আয়াতের ন্যায় এ আয়াতটির সম্মান করাও ওয়াজিব। ওযু ছাড়া উহাকে স্পর্শ করা জায়েয নয়। অপবিত্র অবস্থায় যথা হায়েয-নেফাসের সময় (পবিত্র হওয়ার পূর্বে) তেলাওয়াতরূপে পাঠ করাও না-জায়েয। তবে কোন কাজকর্ম আরম্ভ করার পূর্বে (যথা-পানাহার) দেয়াস্বরূপ পাঠ করা সব সময়ই জায়েয।

মাসআলাঃ নামাযের প্রথম রাক'আত আরম্ভ করার সময় আউযুবিল্লাহ-এর পরে বিসমিল্লাহু পাঠ করা সুন্নত। তবে আস্তে পাঠ করবে, না সরবে পাঠ করবে, এতে ভিন্ন ভিন্ন মত দেখা যায়। ইমাম আবু হানীফা (র) ও তাঁর অনুসারী ইমামগণ নীরবে পাঠ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। নামাযের প্রথম রাকআতের পর অন্যান্য রাকআতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা সুন্নত বলে সকলে একমত হয়েছেন। কোন কোন রেওয়ায়েতে প্রত্যেক রাক'আতের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়াকে ওয়াজিব বলা হয়েছে। (শরহে-মানিয়্যাহ)

মাসআলাঃ নামাযে সূরা-ফাতিহা পাঠ করার পর অন্য সুরা পাঠ করার পূর্বে বিসমিল্লাহ পাঠ না করা উচিত। নবী করীম (সা) এবং খােলাফায়ে রাশেদীন থেকে ইহা পাঠ করার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 'শরহে মানিয়্যাতে একে ইমাম আবু হানীফা (র) ও ইমাম আবু ইউসুফ ()-এর অভিমত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শরহে মানিয়াত, দুররে মুখতার, বুরহান প্রভূতি কিতাবে এ অভিমতকেই গ্রহণযােগ্য বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু ইমাম মুহাম্মদ (র) বলেছেন, যেসব নামাযে নীরবে কেরাআত পড়া হয়, সেসব নামাযে বিসমিল্লাহ পড়া উত্তম। আবার কোন কোন বর্ণনাতে ইহা ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। শামী কোন কোন ফেকাহ শাস্ত্রবিদের মতামত বর্ণনা করে এ মন্তকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে এতেও সকলেই একমত হয়েছেন যে, যদি কেউ তা পাঠ করে তবে তাতেও কোন দোষের। কারণ নেই।



পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। ১. যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। ২. যিনি অত্যন্ত মেহেরবান ও দয়ালু। ৩, যিনি বিচার-দিনের মালিক। ৪, আমরা একমাত্র তােমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। ৫. আমাদেরকে সরল পথ দেখাও। ৬. সে সমস্ত লােকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করে। ৭. তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তােমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

তফসীরের সার-সংক্ষেপ
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা'আলার যিনি সকল সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা। (সৃষ্টির প্রতিটি প্রকাৱকেই এক একটি আলম' বা জগতৰূপে গণ্য করা হয়। যথা-ফেরেশতা জগত, মানব-জগত, জ্বিন-জগত।)

الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ ۙ যিনি অত্যন্ত মেহেরবান ও দয়ালু مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ যিনি বিচার ও প্রতিদান-দিবসের মালিক। (কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তার আমলের প্রতিদান দেওয়া হবে।) اِیَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ। আমরা তােমারই ইবাদত করি আর তােমারই সাহায্য প্রার্থনা করি ।  اِهۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ আমাদিগকে সরল পথ দেখাও صِرَاطَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡهِمۡ ۬ সে সমস্ত লােকের পথ, যাদেরকে 'তুমি নেয়ামত দান করেছ। غَیۡرِ الۡمَغۡضُوۡبِ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا الضَّآلِّیۡنَ  যাদের উপর তােমার গযব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট তাদের পথ নয়।

হেদায়েতের পথ ত্যাগ করার দুটি পন্থা। এক এই যে, পথের পুরােপুরি খোঁজ-খবর নেয়নি لضَّآلِّیۡنَ শব্দে তাই বােঝানাে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পুরােপুরি খোঁজ-খবর নেওয়ার পর এবং তা সঠিক প্রমাণিত হওয়ার পরও উহাতে আমল করেনি مَغۡضُوۡبِ عَلَیۡهِمۡ দ্বারা ঐ সমস্ত লােককে বােঝানাে হয়েছে। কেননা, জেনে-শুনে যাৱা কাজ করে না, তাদের আচরণ অসন্তুষ্টির কারণ হওয়াই স্বাভাবিক। 

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

সূরাতুল ফাতিহার বিষয়বস্তু

সূরাতুল-ফাতিহার আয়াত সংখ্যা সাত । প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং শেষের তিনটি আয়াতে মানুষের পক্ষ হতে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা ও দরখাস্তের বিষয়বস্তু, যা আল্লাহ্ তা'আলা নিয়েই দয়াপরবশ হয়ে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। মধ্যের একটি আয়াত প্রশংসা ও দোয়া-মিশ্রিত বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণ।

মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেছেন-নামায় (অর্থাৎ সূরাতুল-ফাতিহা) আমার এবং আমার বান্দাদের মধ্যে দুভাগে বিভক্ত; অর্ধেক আমার জন্য আর অর্ধেক আমার বান্দাদের জন্য। আমার বান্দাগণ যা চায়, তা তাদেরকে দেওয়া হবে। অতঃপর রাসূল (সা) বলেছেন যে, যখন বান্দাগণ বলে  اَلۡحَمۡدُ لِلّٰ ', তখন আল্লাহ বলেন যে, আমার বান্দাগণ আমার প্রশংসা করছে। আর যখন বলে, الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ তখন তিনি বলেন যে, তারা আমার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করছে। আর যখন বলে مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ তখন তিনি বলেন যে, আমার বান্দাগণ আমার গুণগান করছে। আর যখন বলে اِیَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ তখন তিনি বলেন যে, এ আয়াতটি আমি এবং আমার বান্দাগণের মধ্যে সংযুক্ত। কেননা, এর এক অংশে আমার প্রশংসা এবং অপর অংশে বান্দাগণের দোয়া ও আরজ হয়েছে। এ সঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে যে, বান্দাগণ যা চাইবে তারা তা পাবে।
অতঃপর বান্দাগণ যখন বলে اِهۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ (শেষ পর্যন্ত) তখন আল্লাহ বলেন, এসবই আমার বান্দাগণের জন্য এবং তারা যা চাইবে তা পাবে। (মাযহারী)

 اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ  সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা'আলার। অর্থাৎ দুনিয়াতে যে কোন স্থানে যে কোন বস্তুর প্রশংসা করা হয়, বাস্তবে তা আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা, এ বিশ্ব চরাচরে অসংখ্য মনােরম দৃশ্যাবলী, অসংখ্য মনােমুগ্ধকর সৃষ্টিরাজি আর সীমাহীন উপকারী বস্তুসমূহ সর্বদাই মানৰ মনকে আল্লাহ তা'আলার প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকে এবং তার প্রশংসায় উধুদ্ধ করতে থাকে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বােঝা যায় যে, সকল বস্তুর অন্তরালেই এক অদৃশ্য। সত্তার নিপুণ হাত সদা সক্রিয় রয়েছে।

যখন পৃথিবীর কোথাও কোন বস্তুর প্রশংসা করা হয়, তখন প্রকৃতপক্ষে তা উক্ত বস্তুর সৃষ্টিকর্তার প্রতিই গিয়ে বর্তায়। যেমন কোন চিত্র, কোন ছবি বা নির্মিত বন্ধুর প্রশংসা করা হলে। প্রকৃতপক্ষে সে প্রশংসা প্রস্তুতকারকেরই করা হয়।

এ বাক্যটি প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামনে বাস্তবতার একটি নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের সামনে যা কিছু রয়েছে এ সব কিছুই একটি একক সত্ত্বার সাথে জড়িত এবং সকল প্রশংসাই সে অনন্ত অসীম শক্তির। এ সব দেখে কারাে অন্তরে যদি প্রশংসাবাণীর উদ্রেক হয় এবং মনে করে যে, তা অন্য কারাে প্রাপ্য, তবে এ ধারণা জ্ঞান-বুদ্ধির সংকীর্ণতারই পরিচায়ক। সুতরাং নিঃসন্দেহে একথাই বলতে হয় যে, اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ  যদিও প্রশংসার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে অতি সূক্ষ্মতার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সকল সৃষ্ট বস্তুর উপাসনা রহিত করা হলাে। তাছাড়া এর দ্বারা অত্যন্ত আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে একত্ববাদের শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে। আল-কোরআনের এ ক্ষত্র বাক্যটিকে একদিকে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করা হয়েছে এবং অপরদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিমগ্ন মানব মনকে এক অতিবাস্তবের দিকে আকৃষ্ট করত যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর পূজা-অর্চনাকে চিরতরে রহিত করা হয়েছে। এতদসঙ্গে অতি হেকমতের সাথে বা অকাট্যভাবে ঈমানের সর্বপ্রথম স্তম্ভ ‘ইদ’ বা একত্ববাদের পরিপূর্ণ নকশাও তুলে ধরা হয়েছে। একটু চিন্তা করলে বােঝা যায় যে, বাক্যটিতে যে দাবি করা হয়েছে, সে দাবির স্বপক্ষে দলীলও দেওয়া হয়েছে। فتبارك الله أحسن الخالقين এ ক্ষুদ্র বাক্যটির পরেই আল্লাহু তা'আলার প্রথম গুণবাচক নাম 'রাব্দুল আলামীন'-এর উল্লেখ করা হয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে এর তফসীর লক্ষণীয়। আরবী ভাষায়, শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পালনকর্তা। লালন-পালন বলতে বােঝায়, কোন বস্তুকে তার সম মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রেখে ধীরে ধীরে বা পর্যায়ক্রমে সামনে অগ্রসর করে উন্নতির চরম শিখরে পৌছে দেওয়া।

এ শব্দটি একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। সম্বৰূপ রূপে অন্যের জন্যেও ব্যবহার করা চলে, সাধারণভাবে নয়। কেননা, প্রত্যেকটি প্রাণী বা সৃষ্টিই প্রতিপালিত হওয়ার মুখাপেক্ষী, তাই সে অন্যের প্রকৃত প্রতিপালনের দায়িত্ব নিতে পারে না।

الۡعٰلَمِیۡنَ শব্দটি  عٰلَمِ শব্দের বহুবচন। এতে পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টিই অন্তর্ভুক্ত। যথা-আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-সূর্য, তারা-নক্ষত্ররাজি, বিজলী, বৃষ্টি, ফেরেশতাকুল, জ্বিন, যমীন এবং এতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে। জীবজন্তু, মানুষ, উল্লিদ, জড় পদার্থ সব কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। অতএব رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ -এর অর্থ হচ্ছে-আল্লাহ তা'আলা সমস্ত সৃষ্টির পালনকর্তা। তাছাড়া একথাও চিন্তার ঊর্ধ্বে নয় যে, আমরা যে দুনিয়াতে বসবাস করছি এর মাধ্যও কোটি কোটি সৃষ্ট বস্তু রয়েছে। এ সৃষ্টিলুলোর মধ্যে যা কিছু আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং যা আমরা দেখি না সে সবগুলােই এক একটা আলম বা জগত।

তাছাড়া আরাে কোটি কোটি সৃষ্টি রয়েছে, যা সৌরজগতের বাইরে, যা আমরা অবলোকন করতে পারি না। ইমাম রার্থী তফসীরে-কবীরে লিখেছেন যে, এ সৌরজগতের বাইরে আরাে সীমাহীন জগত রয়েছে। যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত এবং একথা সর্বজনবিদিত যে, সকল বস্তুই আল্লাহর ক্ষমতার অধীন। সুতরাং তার জন্য সৌরজগতের অনুরূপ আরাে সীমাহীন কতকগুলাে জগত সৃষ্টি করে রাখা অসম্ভব মােটেই নয়।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেছেন যে, চল্লিশ হাজার জগত রয়েছে। আর এ পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত একটি জগত। বাকীগুলির প্রত্যেকটিও অনুরূপ। হযরত মাকাহিল (রা) থেকেও বর্ণিত হয়েছে যে, জগতের সংখ্যা ৮০ হাজার। (কুরতুবী) এতে সন্দেহ করা হয় যে, মহাশূন্যে বায়ু না থাকায় মানুষ বা কোন প্রাণীর বাস। করার উপযােগী নয় বলে কোন প্রাণী সেখানে জীবিত থাকতে পারে না । ইমাম রাহী এর উত্তরে বলেছেন যে, এটা এমন কোন জরুরী ব্যাপার নয় যে, এই জগতের বাইরে মহাশূন্যে যে অন্যান্য জগত রয়েছে, সেসব জগতের অধিবাসীদের প্রকৃতি ও অভ্যাস এই জগতের অধিবাসীদের। মতই হতে হবে, যে জন্য তারা মহাশূন্যে জীবিত থাকতে পারবে না। বরং এরকমই বা হবে না কেন যে, সেসব জগতের অধিবাসীদের অভ্যাস ও প্রকৃতি এই জগতের অধিবাসীদের অভ্যাস ও প্রকৃতি হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আজ থেকে প্রায় সাতশ' সত্তর বছর আগে যখন মহাশূন্য ভ্রমণের উপকরণও আবিষ্কৃত হয়নি, সে যুগেই মুসলিম দার্শনিক ইমাম রাযী এসব তথ্য লিখেছেন। আজকলি রকেট প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক যানের যুগে মহাশূন্য ভ্রমণকারীরা যা কিছু বলেন, তা ইমাম রাখীর বর্ণনার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

এ জগতের বাইরে মহাশূন্যের কোন সীমা-পরিসীমা মানুষের জানা নেই। অতএব, নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন যে, সীমাহীন মহাশূন্যে আর কত সৃষ্টি রয়েছে। এই দুনিয়ার নিকটতম গ্রহ-উপগ্রহ চন্দ্র ইত্যাদির বাসিন্দা সম্পর্কে বর্তমান যুগের বিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, তাও তাে এই যে, এ সমস্ত গ্রহ-উপগ্রহে যদি কোন প্রাণীজগতের অস্তিত্ব থেকেও থাকে, তবে তাদের স্বভাব-চরিত্র এ দুনিয়ার বাসিন্দাদের অনুরূপ হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। বরং গ্রহণযোগ্য যুক্তি হলে এই যে, তাদের স্বভাব-চরিত্র, আদত-অভ্যাস, আহার্য ও প্রয়োজন এখানকার বাসিন্দাগণ হতে সম্পূর্ণ পৃথক ও ভিন্ন হবে। এ জন্য একটিকে অপরটির উপর কিয়াস করার কোন কারণ থাকতে পারে না। ইমাম রাখীর এই উক্তির সমর্থনে, আমেরিকার মহাশূন্য ভ্রমণকারী জনৈক বিজ্ঞানী আকাশ প্রমণ হতে প্রত্যাবর্তন করে মহাশূন্য সম্পর্কে কিছুটা অনুমান ব্যক্ত করেছেন এবং বলেছেন যে, মহাশূনের সীমাৱেখা সম্পর্কে কোন কিছুই বলার উপায় নেই। মহাশূন্যের আয়তন ও সীমারেখা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা অনুমান করাও কঠিন ব্যাপার।

আল-কোরআনের এ ছােট বাক্যটির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বােঝা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর সৃষ্টিজগতের লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কত সুদৃঢ় ও কত অচিন্ত্যনীয় ব্যবস্থা করে রেখেছেন ! আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত এবং গ্রহ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধূলিকণা পর্যন্ত এই ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত এবং একজন অতি প্রাজ্ঞ পরিচালকের অধীনে প্রতিটি সৃষ্ট বন্ধুই নিজ নিজ কর্তব্যে নিয়ােজিত। মানুষের সামান্য খাদ্য, যা সে তার মুখে দেয় তাতে চিন্তা করলেই বােঝা যায় যে, এর উৎপাদনের জন্য আকাশ ও যমীনের সমস্ত শক্তি এবং কোটি কোটি মানুষ ও জীব-জন্তুর পরিশ্রম তাতে শামিল রয়েছে। সমগ্র জগতের শক্তি এই এক লােকমা বাদ্য প্রস্তুতে এমনিভাবে ব্যস্ত যে, মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেই তা দ্বারা যেন পরম জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়। সে যেন অনুধাবন করতে পারে যে, আল্লাহ তা'আলা আকাশ ও যমীনের সকল সৃষ্টিকে মানবের উপকারের জন্য নিয়ােজিত রেখেছেন। যার সেবায় এত কিছু নিয়ােজিত, তার জন্য অনর্থক নয়। বরং তারও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্যই রয়েছে।

আল-কোরআনের এ আয়াতটিতে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও মানব জীবনের মকসুদ বা লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে।

  وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ

অর্থাৎ জ্বিন ও মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। অন্য কোন কাজের জন্য নয়। | 

উপরিউক্ত আলােচনা দ্বারা পরিস্কারভাবে বােঝা যাচ্ছে যে, رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ۙ -এর নিখুঁত প্রতিপালন নীতিই পূর্বের বাক্য اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ -এর দলীল বা প্রমাণ। সমগ্র সৃষ্টির লালন-পালনের দায়িত্ব একই পবিত্র সত্তার ; তাই তারিফ-প্রশংসারও প্রকৃত প্রাপক তিনিই ; অন্য কেউ নয় । এজন্য প্রথম আয়াত  اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ -এ তারীফ-প্রশংসার সাথে ঈমানের প্রথম স্কন্তু আল্লাহ তা'আলার একত্ব বা তওহীদের কথা অতি সূক্ষ্মভাবে এসে গেছে।

দ্বিতীয় আয়াতে তার গুণ, দয়ার প্রসঙ্গ رَحما ও رَحِيم শব্দদ্বয়ের দ্বারা বর্ণনা করেছেন। উভয় শব্দই “ণের আধিক্যবােধক বিশেষ্য যাতে আল্লাহর দয়ার অসাধারণত্ব ও পূর্ণতার কথা বােঝায়। এ স্কুলে এ গুণের উল্লেখ সম্ভবত এজন্য যে, আল্লাহ তা'আলা যে সমগ্র সৃষ্টিজগতের লালন-পালন, ভরণ-পােষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং গ্রহণ করেছেন। এতে তার নিজস্ব কোন প্রয়ােজন নেই বা অন্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েও নয়; বরং তঁার রহমত বা দয়ার তাকীদেই তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যদি সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্বও না থাকে, তাতেও তার কোন লাভ-ক্ষতি নেই। আর যদি সমগ্র সৃষ্টি অবাধ্যও হয়ে যায় তবে তাতেও তার কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই।

مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ

‘মালিক’ শব্দ ‘মালিকুন’ ধাতু হতে গঠিত। এর অর্থ কোন বস্তুর উপর এমন অধিকার থাকা, যাকে ব্যবহার, রদবদল, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সব কিছু করার সকল অধিকার থাকবে। دِّیۡن অর্থ প্রতিদান দেয়া।مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ-এর শাব্দিক অর্থ প্রতিদান দিবসের মালিক বা অধিপতি। অর্থাৎ প্রতিদান-দিবসের অধিকার ও আধিপত্য কোন বস্তুর উপরে হবে, তার কোন বর্ণনা দেওয়া হয়নি। তফসীরে কাশাফে বলা হয়েছে যে, এতে ‘আম' বা অর্থের ব্যাপকতার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদান দিবসে সকল সৃষ্টিরাজি ও সকল বিষয়ই আল্লাহ তাআলার অধিকারে থাকবে। (কাশফি) 




*****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url