Mohammadia Foundation
https://www.mohammadiafoundationbd.com/2022/11/Islami-songskriti8.html
ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা- ৮ || ইসলামে ঈমানের বিষয় || ইসলামে ঈমানের গুরুত্ব ||
ইসলামে ঈমানের বিষয়
কুরআন মজিদে ঈমানের বিষয় সম্বন্ধে এতো বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তার ভেতর কোন মতভেদের অবকাশ নেই। কিন্তু যারা কুরআনের বাকরীতি অনুধাবন করতে পারেনি, অথবা তার বক্তব্য বিষয় অনুসরণ করতে সক্ষম হয়নি, তাদের মধ্যে কিছুটা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কুরআনের বাকরীতি হচ্ছে এই যে, কোথাও সে গোটা প্রত্যয়কে একই সঙ্গে বিবৃত করেছে, আবার কোথাও সময় ও সুযোগ অনুযায়ী তার কোন কোন অংশ বিবৃত করে তারই ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছে। এর থেকে কোন কোন লোক এ ধারণা করে বসেছে যে, ইসলামের প্রত্যয়কে বিশিষ্ট ও বিভক্ত করা যেতে পারে। অর্থাৎ তার ভেতর থেকে কোন একটি কিংবা কোন কোনটির প্রতি ঈমান পোষণই যথেষ্ট আর কোন কোনটি অস্বীকার করেও মানুষ কল্যাণ লাভ করতে পারে। অথচ কুরআনের চূড়ান্ত ফায়সালা এই যে, প্রত্যয় হিসেবে যতগুলো বিষয়কে সে পেশ করেছে, তার সবকিছুই স্বীকার করা আবশ্যক। তার একটি থেকে অপরটিকে কিছুতেই পৃথক করা চলে না। তার সবগুলো মিলে একটি অখণ্ড ও অবিভক্ত সত্তায় পরিণত হয় এবং তাকে সামগ্রিকভাবে মেনে নেয়াই কৰ্তব্য। তার কোন একটিকেও যদি অস্বীকার করা হয় তাহলে সে অস্বীকৃতি বাকী সবগুলোর স্বীকৃতিকে নাকচ করে দেবে।
কুরআনের এক জায়গায় বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَئِكَةُ .
“নিশ্চয়ই যারা বলেঃ আমাদের রব আল্লাহ, অতপর দৃঢ়পদ থাকে তাদের প্রতি ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়।" -(সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৩০)
এ আয়াতে শুধু আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এরই ওপর দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য নির্ভরশীল বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় এক জায়গায় আল্লাহর সাথে শেষ দিবসের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে-
مَنْ أَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ ،
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের প্রভুর কাছে তাদের জন্যে রয়েছে পুরস্কার।” -(সূরা আল বাকারা : ৬২)
এ একই বিষয়বস্তু আলে ইমরান (১২) মায়েদা (১০) এবং রায়াদ (8) এও রয়েছে।
তৃতীয় এক স্থানে আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান পোষণের আহ্বান জানানো হয়েছেঃ
فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ، وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا فَلَكُمْ أَجْرُ عَظِيمُ
“তাই তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। যদি তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তাহলে তোমাদের জন্যে রয়েছে মহান পুরস্কার।" -(সূরা আলে ইমরান : ১৭৯)
এরূপ বক্তব্য বিষয় হাদীদ (৪)-এও রয়েছে।
অপর এক জায়গায়, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি ঈমান এনেছে, তাকেই বলা হয়েছে ঈমানদার-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ( النور : (٦٢)
“নিশ্চয়ই তারা ঈমানদার যারা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে।”-(সূরা আন নূর : ৬২)
মুহাম্মাদ (৪), জ্বিন (২) ও আল ফাতাহ (২)-এ এ বিষয়টিরই পুনরুক্তি করা হয়েছে।
এক জায়গায় আল্লাহ, মুহাম্মাদ (স), কুরআন --- এ তিনটি জিনিসের প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে
فَامِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنْزَلْنَا ، (التغابن : ۸)
“অতএব তোমরা আল্লাহ তাঁর রসূল এবং আমি যে নূর (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান আন।" -(সূরা আত তাগাবুন : ৮)
এক জায়গায় আল্লাহ, আল্লাহর কিতাব, কুরআন ও শেষ দিন – এ চারটি জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে :
وَالْمُؤْمِنُونَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ ... وَالْمُؤْمِنُونَ
بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ (النساء : ١٦٢)
“এবং ঈমানদারগণ ঈমান আনে যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ........... এবং বিশ্বাস করে আল্লাহ ও শেষ দিনকে ।”-(সুরা আন নিসা : ১৬২
অন্য এক জায়গায় আল্লাহ, ফেরেশতা, পয়গম্বর ও কুরআনের প্রতি অবিশ্বাসকে কুফরী ও ফাসেকী বলে ঘোষণা করা হয়েছে-
مَنْ كَانَ عَدُوا لِلَّهِ وَمَلَئِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيْكُل فَإِنَّ اللَّهَ
منو لِلْكَفِرِينَ وَلَقَدْ أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ أَيْتُ بَيِّنَتِ، وَمَا يَكْفُرُبِهَا إِلَّا
“যারা আল্লাহ, তার ফেরেশতামণ্ডলী, রসূলগণ, জিবরাঈল ও মিকাঈলের সাথে শত্রুতা করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই কাফেরদের শত্রু। আর নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেছি; এটাকে ফাসেক ছাড়া অন্য কেউ অবিশ্বাস করে না।” -(সূরা আল বাকারা : ১৮-৯৯
এক জায়গায় আল্লাহ, ফেরেশতা, আল্লাহর কিতাব, পয়গম্বর ও কুরআনের প্রতি ঈমান পোষণকারীকে মু'মিন বলা হয়েছে-
أمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ ، كُلُّ أُمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لـ (البقرة : ٢٨٥)
“রসুদের প্রতি তার প্রভুর কাছ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে সে তা বিশ্বাস করেছে এবং ঈমানদারগণও। সকলেই বিশ্বাস করেছে, আল্লাহ তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী, কিতাবসমূহ ও রসুলগণকে। ” -(সূরা বাকারা : ২৮৫)
অন্য এক জায়গায় ঈমানের পাঁচটি অংশ বিবৃত করা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি, শেষ দিনের প্রতি, ফেরেশতার প্রতি, আল্লাহর কিতাবের প্রতি ও পয়গম্বরদের প্রতি ঈমান ।
وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَئِكَةِ وَالْكِتُبِ وَالنَّبَيِّنَ .
.أولئك الذينَ صَدَقُوا ، وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ (البقرة : (۱۷۷)
“বরং প্রকৃত পুন্যের কাজ এই যে, মানুষ আল্লাহকে, পরকাল ও ফেরেশতাকে এবং আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ও তার নবীদিগকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে মান্য করবে। .......... বস্তুত এরাই প্রকৃত সত্যপন্থী এরাই মুত্তাকী।"-(সূরা আল বাকারা : ১৭৭)
সূরা নিসায়ে উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের সংগে মুহাম্মাদ (স) ও কুরআনের প্রতিও ঈমান আনার তাকীদ করা হয়েছে। এবং ঐসবের প্রতি অবিশ্বাস পোষণকারীকে কাফের ও গোমরাহ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
এক জায়গায় শুধু শেষ দিনের স্বীকৃতির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং তার প্রতি অস্বীকৃতিকে ব্যর্থতার কারণ বলে নির্দেশ করা হয়েছে।...... এরই পুনরাবৃত্তি রয়েছে আরাফ (১৭), ইউনুস (১), ফোরকান (২), নমল (১) ও সাফ্ফাত (১)-এ ।
অপর এক জায়গায় শেষ দিনের সঙ্গে আল্লাহর কিতাবের প্রতি অবিশ্বাসকেও কঠিনতম আযাবের কারণ নির্দেশ করা হয়েছে:
إِنَّهُمْ كَانُوا لايرجُونَ حِسَابًا وَكَذَّبُوا بِابْتِنَا كِذَّابًا (النبا : ۲۸۲۷)
“তারা তো কোনরূপ হিসাব-নিকাশ হওয়ার আশা পোশন করত না এবং আমাদের আয়াতসমূহকে তারা সম্পূর্ণ (মিথ্যা মনে করে) অবিশ্বাস করতো।”-(সূরা আন নাবা : ২৭)
তৃতীয় এক জায়গায় শেষ দিন ও আল্লাহর কিতাবের সঙ্গে কুরআনকেও ঈমানিয়াতের মধ্যে শামিল করা হয়েছে।
وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ ، وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ ، وَبِالْآخِرَةِ هُمْ
يُوقِنُونَ أُولَئِكَ عَلى هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ ، وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“সে কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার পূর্বে সেসব গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে, সেসবকেই বিশ্বাস করে এবং পরকালের প্রতি যাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। বস্তুত এ ধরনের লোকেরাই তাদের আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ জীবনব্যবস্থার অনুসারী এবং তারাই কল্যাণ পাওয়ার অধিকারী।" -(সূরা আল বাকারা : ৪-৫)
চতুর্থ এক স্থানে বলা হয়েছে যে, শেষ দিন, আল্লাহর কিতাব এবং পয়গাম্বরদের প্রতি অবিশ্বাসের ফলে সকল ক্রিয়াকলাপই পণ্ড হয়ে যায়। এরূপ অবিশ্বাসী ব্যক্তিই হচ্ছে জাহান্নামী এবং তার 'আমলের' কোনই মূল্য নেই।
উপরে আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান আনার কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর ভিতর তাওরাত, ইনজীল, জবুর ও হুহুফে ইবরাহীমের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু কুরআনের বিশটি জায়গায় একথাও স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে যে, শুধু ঐ কিতাবগুলো মানাই যথেষ্ট নয়, ঐগুলোর সাথে কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনও আবশ্যক। যদি কোন ব্যক্তি সমস্ত কিতাবের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করে আর কুরআনকে করে অবিশ্বাস, তবে সে সমস্ত কিতাবের প্রতি অবিশ্বাস পোষণকারীর মতোই কাফের। [দ্রষ্টব্য : বাকারা (১১, ১২, ১৪, ১৬ ), নিসা (৭) মায়েদা (২-১০), রাদ (৩), আনকাবুত (৫) ও জুমার (৪)] কেবল এটুকুই নয়, আল্লাহর প্রেরিত প্রতিটি কিতাবই পুরোপুরি মানা আবশ্যক। “যদি কোন ব্যক্তি তার কিছু অংশ মানে আর কিছু অংশ না মানে, তৰে সেও কাফের।” (সূরা আল বাকারা : ১০)
অনুরূপভাবে নবীদের সম্পর্কে স্পষ্টত বলে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সবার প্রতি ঈমান আনা প্রয়োজন। যাদের নামোল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি পৃথকভাবে আর যাঁদের নামোল্লেখ নেই, তাদের প্রতি মোটামুটিভাবে ঈমান আনতে হবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি সমস্ত নবীর প্রতি ঈমান রাখে আর শুধু মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াতকে অবিশ্বাস করে, তবে সে নিশ্চিতরূপে কাফের। কুরআনে শুধু এক জায়গায় নয়, বিশটি স্থানে একথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এবং সমস্ত নবীর সাথে মুহাম্মাদ (স)-এর রেসালাতের স্বীকৃতিকে ঈমানের আবশ্যিক শর্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য : বাকারা (১৪), নিসা (২৩), মায়েদা (৩-১১), আনআম (১৯), আরাফ (১৯-২০), আনফাল (৩), মু'মিনুন (৪), শুরা (৫), মুহাম্মাদ (১) ও তালাক (২)] এর ভেতরকার বেশীর ভাগ আয়াতেই হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ)-এর উম্মতদেরকে নবী করীম (স)-এর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যে পর্যন্ত তোমরা কুরআন ও মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি ঈমান না আনবে সে পর্যন্ত তোমরা হেদায়াত পেতে পারবে না ।
এ আলোচনা থেকে জানা গেল যে, ইসলামে ঈমানের বিষয় হচ্ছে পাঁচটিঃ যথা (১) আল্লাহ, (২) ফেরেশতা, (৩) আল্লাহর কিতাব (এর ভেতর কুরআনও অন্তর্ভুক্ত) (৪) নবী হযরত মুহাম্মদ (স) ও এঁদের অন্তর্ভুক্ত] ও (৫) শেষ দিন অর্থাৎ কেয়ামত।
এ হচ্ছে ঈমানের মোটামুটি পরিচয়। এর ভেতরকার প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে বিস্তৃত আকীদা কি, ঐগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক কি, কি কারণে ঐগুলোকে পৃথক করা চলে না এবং একটির প্রতি অস্বীকৃতির ফলে সবগুলোর অস্বীকৃতি অনিবার্য হয়ে পড়ে, পরন্তু ঐগুলোর প্রত্যেকটিকে ঈমানিয়াতের অন্তর্ভুক্ত করার ফায়দা কি – সামনে এগিয়ে এ সকল কথা বিবৃত করা হবে। ১. অবশ্য হাদীসে একটি ষষ্ঠ জিনিসের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তাহলো in whi JLS কিন্তু এটি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতি ঈমানের অংশ বিশেষ, কুরমানে এটি এ হিসেবেই বিবৃত হয়েছে, হাদীসে এটিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ এই যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের এ অংশটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রচ্ছন্নও, তাই মনের ভেতর একে জাগরুক রাখার জন্যে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে।
যুক্তিবাদী সমালোচনা
এ পাঁচটি প্রত্যয়ই অদৃশ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং এ জড়জগতের সম্পূর্ণ বাইরে অবস্থিত। এ জন্যে আমাদের শ্রেণী ভাগ অনুযায়ী এটা হচ্ছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রত্যয়। কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য এই যে, ইসলাম এর ওপর তার আধ্যাত্মিক ব্যবস্থাই শুধু নয়, বরং নৈতিক, রাজনৈতিক ও তামাদ্দুনিক ব্যবস্থারও ভিত্তি স্থাপন করেছে। সে দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের সমন্বয়ে এমন একটি ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করে যে, তার অধীনে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগই কাজ করতে থাকে । সে ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠা স্থিতিশীলতা ও ব্যবহারাদির জন্যে যতো শক্তির প্রয়োজন, তা সবই ঐ পাঁচটি প্রত্যয় থেকে অর্জিত হয়। এ হচ্ছে তার জন্যে শক্তির এক অফুরন্ত উৎস, এর উৎসারণ কখনো রুদ্ধ হয়ে যায় না। এবার আমরা দেখবো যে, যে ঈমানিয়াত দ্বারা এতোবড়ো কাজ সম্পাদন করা হয়েছে, বিচার বুদ্ধির দৃষ্টিতে তা কতখানি মর্যাদা লাভের অধিকারী এবং তার ভিতর এমন একটা ব্যাপক ও প্রগতিশীল ব্যবস্থার জন্যে ভিত্তি ও শক্তির উৎস হবার মতো কতোটা যোগ্যতা রয়েছে ?
এ প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানের পূর্বে আমাদের মনে একথা বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, ইসলাম এমন একটি সংস্কৃতির ভিত রচনা করতে চায়, যা যথার্থভাবেই মানবীয় সংস্কৃতি। অর্থাৎ তার সম্পর্ক কোন বিশেষ দেশ বা গোত্রের লোকদের সংগে নয়, না কোন বিশিষ্ট বর্ণধারী বা ভাষা ভাষী জাতির সংগে তার কোন বিশিষ্টতা রয়েছে বরং সমগ্র মানব জাতির কল্যাণই হচ্ছে তার লক্ষ্য। পরন্তু তার প্রভাবাধীনে এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা তার কাম্য যেখানে মানুষের পক্ষে কল্যাণ ও মংগলকর প্রতিটি জিনিসেরই লালন-পালন করা এবং তার পক্ষে ক্ষতি ও অনিষ্টকর জিনিস মাত্রই নিশ্চিহ্ন করা হবে। এমন একটা খালেছ মানবীর 'সংস্কৃতির ভিত্তি আদৌ জড়জগতের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানিয়াতের ওপর স্থাপন করা যেতে পারে না। কারণ জড় পদার্থ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুনিচয়ের দু'টি অবস্থাই বর্তমান : হয় ঐগুলোর সাথে সমস্ত মানুষের সম্পর্ক তুল্য রূপ – যেমন সূর্য, চন্দ্র, জমিন, হাওয়া, আলো ইত্যাদি। ... নতুবা সেগুলোর সাথে সমস্ত মানুষের সম্পর্ক সমান নয় – যেমন দেশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি এর প্রথম শ্রেণীর জিনিসগুলোর ভেতর তো ঈমানের বিষয় হবার যোগ্যতাই নেই, কারণ ঐগুলোর অস্তিত্বের প্রতি ঈমান আনা নিতান্তই অর্থহীন, আর মানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে ঐগুলোর কোন ইচ্ছা- মূলক প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করা তো জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধির দৃষ্টিতেই ভ্রান্ত । তাছাড়া কোন দিক থেকেই ঐগুলোর প্রতি ঈমান আনার কোন সুফল মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বাস্তব জীবনে প্রকাশ পায় না। এরপর থাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর জিনিস। স্পষ্টতই বোঝা যায়, ঐগুলো একটি বৃহত্তর মানবীয় সংস্কৃতীয় ভিত্তি হতে পারে না। কারণ ঐগুলো হচ্ছে বৈষম্য ও ভেদবুদ্ধি প্রসুত, ঐক্য বা একত্বমূলক নয়। সুতরাং এ ধরনের সংস্কৃতির ভিত্তি জড় পদার্থ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর থেকে স্বতন্ত্র ঈমানের বিষয়ের ওপর স্থাপন করা একান্তই অপরিহার্য।
কিন্তু ঐগুলোর শুধু জড় পদার্থ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে স্বতন্ত্র হওয়াই যথেষ্ট নয়, সেই সংগে ঐগুলোর ভেতর আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয় ।
একঃ সেগুলো কুসংস্কার বা অযৌক্তিক বিষয় হবে না, বরং সুস্থ বিচার- বুদ্ধি সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করতে আগ্রহশীল হবে।
দুইঃ সেগুলো দূরবর্তী জিনিস হবে না, বরং আমাদের জীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত হবে।
তিনঃ সেগুলোর ভেতরে এমন প্রচ্ছন্ন শক্তি নিহিত থাকবে যে, সংস্কৃতির ব্যবস্থাটি মানুষের চিন্তা ও কর্মশক্তির ওপর আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারে তার থেকে পুরোপুরি সাহায্য লাভ করতে পারে।
এ দৃষ্টিতে আমরা ইসলামের ঈমানের বিষয়গুলোর প্রতি দৃকপাত করলে জানতে পারি যে, এ তিনটি পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয় ।
প্রথমত ইসলাম আল্লাহ, ফেরেশতা, অহী, নবুওয়াত ও পরকাল সম্পর্কে যে ধারণা পেশ করেছে, তার ভেতরে অযৌক্তিক কিছুই নেই। তার কোন একটি জিনিসও নির্ভুল হওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয়। আর তার কোন কথা মানতে সুস্থ বিচার-বুদ্ধি কখনো অস্বীকৃতিও জানায় না। অবশ্য বুদ্ধি বৃত্তি ঐগুলোর কোন সীমা নির্ধারণ করতে পারে না, ঐগুলোর শেষ প্রান্ত অবধি পৌঁছতে পারে না এবং তার অন্তগূঢ় তাৎপর্যও পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে না, একথা নিসন্দেহ। কিন্তু আমাদের পণ্ডিত বিজ্ঞানীগণ আজ পর্যন্ত যতগুলো বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন, তার সবগুলোরই এ একই অবস্থা। শক্তি (Energy), জীবন, আকর্ষণ, বিবর্তন এবং এ জাতীয় অন্যান্য জিনিসগুলোর অস্তিত্ব আমরা এ হিসেবে স্বীকার করিনি যে, ঐগুলোর অন্তর্দৃঢ় তাৎপর্য আমরা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছি। বরং এ জন্যে স্বীকার করেছি যে, আমরা যে বিভিন্ন ধরনের বিশিষ্ট লক্ষ্যগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি সেগুলোর মূলগত কারণ ও নিমিত্ত বর্ণনার জন্যে আমাদের মতে ঐ জিনিসগুলোর বর্তমান থাকা আবশ্যক। আর দৃশ্যমান বন্ধুর অদৃশ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যেসব মতবাদ আমরা গড়ে নিয়েছি, তা ঐ জিনিসগুলোর বর্তমান থাকারই দাবী জানায়। সুতরাং ইসলাম যে অদৃশ্য বন্ধুগুলোর প্রতি ঈমান আনার দাবী করে, সেগুলোর সত্যতা স্বীকারের জন্যে ঐগুলোর গূঢ় তাৎপর্যকে আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তির দ্বারা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে এবং ঐগুলোর সীমা নির্ধারণ করে নিতে হবে – এর কোন প্রয়োজন নেই। বরং তার জন্যে যুক্তি হিসেবে শুধু এটুকু কথা বুঝে নেয়াই যথেষ্ট যে, বিশ্বপ্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে ইসলামের পেশকৃত মতাদর্শ মোটেই অযৌক্তিক নয়, তার নির্ভুল হওয়া সুনির্দিষ্ট এবং তা ইসলামের পেশকৃত ঈমানের পাঁচটি জিনিসেরই অস্তিত্ব দাবী করে।
ইসলামের মতাদর্শ হচ্ছে এই যে, এক ঃ বিশ্বপ্রকৃতির পোটা নিয়ম-শৃংখলা এক সার্বভৌম শক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তিনিই তা পরিচালনা করেছেন। দুইঃ সেই সার্বভৌম শক্তির অধীনে অন্য এক শ্রেণীর অসংখ্য শক্তি তাঁর নির্দেশানুসারে এ বিশ্বপ্রকৃতির তত্ত্বাবধান করছে। তিন ঃ মানুষের স্রষ্টা তার প্রকৃতিতে সৎ ও অসৎ এ দু'টি প্রবণতা দিয়ে রেখেছেন ; বুদ্ধিমত্তা ও নির্বুদ্ধিতা, জ্ঞানবত্তা ও অজ্ঞতা উভয়ই তার ভেতরে একত্রিত হয়েছে। ভ্রান্ত ও অভ্রান্ত উভয় পথেই সে চলতে পারে। এ পরস্পর বিরোধী শক্তি ও বিভিন্নধর্মী প্রবণতার মধ্যে যেটি প্রাধান্য লাভ করে, মানুষ তারই অনুসরণ করতে লেগে যায়। চার ঃ সৎ ও অসতের এ সংঘর্ষে সৎ প্রবণতাগুলোকে সহায়তা এবং মানুষকে সরল পথ প্রদর্শনের জন্যে তার স্রষ্টা মানব জাতির মধ্য থেকেই এক উত্তম ব্যক্তিকে মনোনীত করেন এবং তাঁকে নির্ভুল জ্ঞান দিয়ে লোকদেরকে সং পথ প্রদর্শনের কাজে নিযুক্ত করেন। পাঁচ ঃ মানুষ দায়িত্বহীন ও অজিজ্ঞাস্য সত্তা নয়। সে তার যাবতীয় স্বেচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ডের জন্যে আপন স্রষ্টার সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য। একদিন তাকে প্রতিটি অণু-পরমাণুর হিসেব দিতে হবে এবং নিজের কৃত-কর্মের ভালো বা মন্দ ফল ভোগ করতে হবে।
এ মতবাদ আল্লাহ, ফেরেশতা, অহী, নবুওয়াত ও শেষ বিচারের দিন পাঁচটি জিনিসেরই অস্তিত্ব দাবী করে। এর কোন কথাই বিচার-বুদ্ধির দৃষ্টিতে অবাস্তব নয়। এর কোন জিনিসকে কুসংস্কার বা অযৌক্তিক বিশ্বাস বলেও আখ্যা দেয়া যেতে পারে না। এবং এ সম্পর্কে আমরা যতই চিন্তা করি, এর সত্যতার প্রতি ততোই আমাদের আগ্রহ বেড়ে যায়।
আল্লাহর তাৎপর্য আমাদের বোধগম্য না হতে পারে, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই। এ এমন একটি প্রয়োজন যে, এছাড়া বিশ্বপ্রকৃতির জটিল তত্ত্বের মীমাংসা করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়।
ফেরেশতার অস্তিত্বের নিদর্শন আমরা নির্ণয় করতে পারি না, কিন্তু তাদের অস্তিত্বের ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। দুনিয়ার সকল পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী তাদেরকে কোন না কোনভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন। অবশ্য কুরআন তাদের যে নামে অভিহিত করে, সে নামে তাঁরা তাদের উল্লেখ করেননি।
কেয়ামতের আগমন এবং একদিন না একদিন পৃথিবীর গোটা ব্যবস্থাপনা চুরমার হয়ে যাবার ব্যাপারটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুমানের দৃষ্টিতে শুধু প্রবলতর নয়, প্রায় সুনিশ্চিত। স্বীয় আল্লাহর সামনে মানুষের দায়ী হওয়া এবং নিজ কৃতকর্মের জন্যে পুরস্কার বা শাস্তির যোগ্য হবার বিষয়টি সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত করা যায় না বটে ; কিন্তু মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী এবং মৃত্যুর অবস্থা সম্পর্কে যতো মতবাদ গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে ইসলামের পেশকৃত মতবাদটিই যে সবচেয়ে উত্তম, ফলপ্রসু এবং আন্দাজ-অনুমানের কাছাকাছি সুস্থ বিচার-বুদ্ধি অন্তত এটুকু স্বীকার করতে বাধ্য।
বাকী থাকে অহী ও নবুওয়াতের প্রশ্ন; একথা সুস্পষ্ট যে, এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পেশ করা যেতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর অহী হিসেবে পেশকৃত কিতাবাদির অর্থ এবং আল্লাহর রসূল বলে অভিহিত লোকদের জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, মানব জাতির চিন্তা ও কর্মধারার ওপর তাঁদের সমতুল্য গভীর, ব্যাপক, মযবুত ও কল্যাণপ্রদ প্রভাব অপর কোন গ্রন্থ বা নেতাই বিস্তার করতে পারেনি। এটা এ কথাটুকু বিশ্বাস করার জন্যে যথেষ্ট যে, তাদের ভেতরে এমন কোন অনন্য সাধারণ জিনিস অবশ্যই ছিলো, মানব রচিত গ্রন্থাবলী ও সাধারণ মানবীয় নেতৃবৃন্দ যার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত ।
এ আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইসলামে ঈমানের বিষয়গুলো যুক্তি-বিরুদ্ধ নয়। বুদ্ধির কাছে তাকে অস্বীকার করার মতো কোনই উপাদান নেই। বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তনের কোন পর্যায়ে পৌঁছে মানুষ তাকে নাকচ করতে বাধ্য হবে, তার ভেতরে এমন কোন জিনিসের অস্তিত্ব নেই। বরং বুদ্ধিবৃত্তি তার নিশ্চিততারই সাক্ষ্য দেয়। বাকী থাকে ঈমান ও প্রত্যয়ের প্রশ্ন। এর সম্পর্ক বুদ্ধির সাথে নয়, বরং মন ও বিবেকের সাথে। আমরা যতো অদৃশ্য ও অশরীরী বস্তুকে বিশ্বাস করি, তার সবগুলোরই অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে আমাদের বিবেকের ওপর নির্ভর করে। কোন অদৃশ্য বিষয়কে যদি আমরা না মানতে চাই অথবা সে সম্পর্কে আমাদের মন নিশ্চিন্ত না হয়, তবে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ দ্বারা তাকে সত্য বলে জ্ঞান করতে আমাদের বাধ্য করা যেতে পারে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, 'ইথারে'র (Ether) অস্তিত্ব সম্পর্কে যত দলীল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, তার কোনটিই তাকে নিশ্চিন্তরূপে সাব্যস্ত করতে এবং সন্দেহ ও সংশয় থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে পারে না। কারণ এ দলীল-প্রমাণগুলো দেখেই কোন কোন দার্শনিক তার প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে, আবার কোন কোন দার্শনিক ঐগুলোকে অপ্রতুল মনে করে বিশ্বাস স্থাপনে অস্বীকৃতি জানান। সুতরাং ঈমান ও সত্য জ্ঞানের বিষয়টি মূলত মনের নিশ্চিন্ততা ও বিবেকের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল। অবশ্য তাতে বুদ্ধিবৃত্তির এটুকু প্রভাব নিশ্চয়ই রয়েছে যে, যে বিষয়গুলোর সত্যজ্ঞান যুক্তি-বিরুদ্ধ বলে সাৰ্যাপ্ত হয়, সেগুলো সম্পর্কে বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে যায় এবং তার ফলে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। আর যে জিনিসগুলোর সত্যজ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্তের প্রতিকূল নয়, অথবা যেগুলোর সত্যজ্ঞানে বুদ্ধিবৃত্তিও খানিকটা সহায়তা করে, সেগুলো সম্পর্কে মানসিক নিশ্চিন্ততা বেড়ে যায় এবং তার ফলে ঈমান শক্তি অর্জন করে ।
দ্বিতীয়ত, অদৃশ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে বেশীর ভাগই হচ্ছে তত্ত্বমূলক বিষয় ; অর্থাৎ সেগুলোর সাথে আমাদের বাস্তব জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। উদাহরণত ইথার (Ether), পদার্থের প্রাথমিক রূপ ও সাধারণ রূপ, বস্তু, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক আইন, কার্যকারণ বিধি এবং এরূপ বহুবিধ তত্ত্বমূলক বিষয় বা অনুমান রয়েছে, যেগুলো মানা বা না মানার কোন প্রভাব আমাদের জীবনের ওপর পড়ে না। কিন্তু ইসলাম যে অদৃশ্য বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছে, সেগুলো এমন কোন তত্ত্বমূলক বিষয় নয়। বরং আমাদের নৈতিক ও বাস্তব জীবনের সাথে সেগুলো গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সেগুলোর স্বীকৃতিকে নীতির উৎস বলে অভিহিত করার কারণ এই যে, ঐগুলো শুধু তত্ত্বমূলক সত্যই নয়, বরং ঐগুলো সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান এবং সে সবের প্রতি পূর্ণাংগ ঈমান আমাদের নিজস্ব গুণাবলী ও স্বভাব-প্রকৃতি, ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড এবং আমাদের সামাজিক ও সামগ্রিক বিষয়াদির ওপর তীব্রভাবে প্রভাবশীল হয়ে থাকে।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শিক্ষাগত মর্যাদাসম্পন্ন বিশাল মানব সমাজের ওপর— তাদের জীবনের গুপ্ত এবং ক্ষুদ্রতম বিভাগে পর্যন্ত ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থার কর্তৃত্ব স্থাপন এবং তার বাঁধনকে সুদৃঢ় রাখার জন্যে যেরূপ শক্তির প্রয়োজন, তা শুধু ইসলামের পেশকৃত ঐ স্বীকৃতির দ্বারাই অর্জিত হতে পারে। এক সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা, প্রবল ও প্রতাপানিত, দয়াময় ও মেহেরবান আল্লাহ আমাদের ওপর কর্তৃত্বশীল, তাঁর অগণিত সৈন্য-সামন্ত সর্বত্র ও সর্বাবস্থায় বিরাজমান, তিনিই মানুষের জন্যে পয়গম্বর পাঠিয়েছেন এবং সে পয়গম্বর যে বিধি-বিধান আমাদেরকে দিয়েছেন, তা তাঁর নিজস্ব রচিত নয়, বরং সম্পূর্ণত আল্লাহরই কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং স্বীয় আনুগত্য বা অবাধ্যতার ভালো বা মন্দ ফল অবশ্যই আমাদের ভোগ করতে হবে – এ প্রত্যয়ের ভেতর এমন প্রচণ্ড ও ব্যাপকতর শক্তি নিহিত রয়েছে, যা এছাড়া আর অন্য কোন উপায়ই অর্জন করা যেতে পারে না। বন্ধুগত শক্তি কেবল দেহকে পরিবেষ্টন করতে পারে; শিক্ষা ও ট্রেনিং-এর নৈতিক প্রভাব শুধু মানব সমাজের উচ্চ 'শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। আইনের রক্ষকরা যেখানে পৌঁছতে সক্ষম, কেবল সেখানেই তা কার্যকরী হতে পারে। কিন্তু প্রত্যয়ের এ শক্তি মানুষের মন ও হৃদয়কেই অধিকার করে বসে। সাধারণ ও অসাধারণ, মূর্খ ও শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও নির্বোধ সবাকেই সে নিজের মধ্যে পরিবেষ্টিত করে নেয়। অরণ্যের নিঃসঙ্গতায় এবং রাতের অন্ধকারে সে নিজের কাজ সম্পাদন করে যায়। যেখানে অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত রাখার সে সম্পর্কে নিন্দা ও ভর্ৎসনা করার, এমন কি তাকে দেখার মতো কেউ থাকে না, সেখানে আল্লাহর হাযির- নাজির থাকার প্রত্যয়, পয়গম্বরের দেয়া শিক্ষাকে সত্য বলে বিশ্বাস এবং কেয়ামতের জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে প্রতীতি এমন কাজ আঞ্জাম দেয়, যা কোন পুলিশ কনেষ্টবল, আদালতের বিচারক কিংবা অধ্যাপকের শিক্ষার পক্ষে কিছুতেই সম্ভবপর নয়। পরন্তু এ প্রত্যয়টি যেভাবে দুনিয়ার বুকে বিস্তৃত ও বিক্ষিপ্ত অগণিত বিভিন্ন মুখী ও পরস্পর বিরোধী মানুষকে একত্রিত করেছে, তাদেরকে মিলিয়ে একটি সুবৃহৎ জাতি গঠন করেছে, তাদের চিন্তা-ভাবনা, ক্রিয়া-কাণ্ড ওরীতিনীতিতে চূড়ান্ত রকমের একমুখিনতার সৃষ্টি করেছে, তাদের ভেতর পারিপার্শ্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও এক সংস্কৃতির বিস্তৃতি সাধন করেছে, এক উচ্চতম লক্ষ্যের জন্যে তাদের ভেতরে আত্মোৎসর্গের যে প্রেরণা সঞ্চার করেছে, আর কোথাও তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
এ পর্যন্ত যা কিছু সাব্যস্ত করা হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, ইসলামী পরিভাষায় ঈমান বলতে বুঝায় আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রসূল এবং শেষ বিচারের দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। এ পাঁচটি প্রত্যয় মিলে একটি অখণ্ড ও অবিভাজ্য সত্তা গঠন করে। অর্থাৎ এগুলোর পরস্পরের মধ্যে এমন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান যে, এর কোন একটি অংশ অস্বীকার করলেই গোটা প্রত্যয়ের অস্বীকৃতি অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া যুক্তিবাদী পর্যালোচনার দ্বারা এটা প্রমাণ করা হয়েছে যে, ইসলাম যে ধরনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার জন্যে কেবল এ বিষয়গুলোই প্রত্যয়ের মর্যাদা পেতে পারে এবং এরূপ প্রত্যয় তার প্রয়োজন। পরন্তু বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির সাথে সহযোগিতা করতে অক্ষম, এমন কোন জিনিসও তার ভেতরে নেই।
এবার তৃতীয় প্রশ্নটির প্রতি আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। আর তাহচ্ছে এই যে, ঈমানের মর্যাদা কি এবং এ মর্যাদাই বা কেন ? এ প্রশ্নটি অনুধাবন করতে গিয়ে লোকেরা বহুল পরিমাণে ভুল করে এসেছে এবং কোন কোন প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি এ ব্যাপারে হোচট খেয়েছেন। এ কারণে বিষয়টি একটু খোলাসাভাবে বিবৃত করা দরকার।
ইসলামে ঈমানের গুরুত্ব
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, কুরআন মজীদের দাওয়াতের মূল প্রতিপাদ্য কি, তাহলে একটি মাত্র শব্দেই তার জবাব দেয়া যেতে পারে। আর তাহলো 'ঈমান'। কুরআন মজীদের অবতরণ এবং নবী (স)-এর আগমনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে লোকদেরকে ঈমানের দিকে আহ্বান জানানো। কুরআন তার ধারক ও বাহক সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় বলে যে, তিনি হচ্ছেন ঈমানের আহ্বায়ক ।
“হে আমাদের রব, নিশ্চয়ই আমরা এমন একজন আহ্বায়কের কথায় সাড়া দিয়েছি যিনি ঈমানের প্রতি আহ্বান জানান । ”
আর স্বয়ং নিজের সম্পর্কে ঘোষণা করে যে, সে কেবল এমন লোকদেরকেই সৎপথ (হেদায়াত) প্রদর্শন করবে যারা গায়েবী বিষয়ের (অর্থাৎ উল্লিখিত ঈমানিয়াতের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রস্তুত ।
هُدَى لِلْمُتَتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ (البقرة : ٢-٣)
*(কুরআন) হেদায়াত হচ্ছে সেই মুক্তাকীদের জন্যে যারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।"-(সূরা আল বাকারা : ২-৩)
সে ওয়াজ-নছিহত, সদুপদেশ, ওয়াদা-অঙ্গীকার, যুক্তি-প্রমাণ ও কিচ্ছা- কাহিনীর দ্বারা ঐ দিকেই লোকদের আহ্বান জানায়। মানুষের কাছে সে প্রথম দাবী জানায় ঈমান আনার। তারপর সে আত্মশুদ্ধি, নৈতিক সংশোধন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনের দিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তার কাছে ঈমানই হচ্ছে সত্য, সততা, জ্ঞান, হেদায়াত ও আলো। আর ঈমানের অনুপস্থিতি অর্থাৎ কুফরী হচ্ছে অজ্ঞতা, যুলুম, বাতিল, মিথ্যা ও ভ্রষ্টতার শামিল।
কুরআনে হাকীম এক স্পষ্ট সীমা-রেখা টেনে তামাম দুনিয়ার মানুষকে দু'টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে দেয়। একটি দল হচ্ছে ঈমান পোষণকারীদের, আর দ্বিতীয় দলটি হলো অবিশ্বাসীদের। প্রথম দলটি তার দৃষ্টিতে সত্যাশ্রয়ী — জ্ঞান ও নূরের সম্পদে সমৃদ্ধ; তার জন্যে হেদায়াতের পথ, তাকওয়া ও পরহেযগারীর দরা উক্ত ; কেবল সে-ই কল্যাণ লাভের অধিকারী। দ্বিতীয় দলটি হচ্ছে তার দৃষ্টিতে কাফের, যালেম, মূর্খ ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন; হেদায়াতের পথ তার জন্যে অবরুদ্ধ। তাকওয়া ও পরহেযগারীতে তার কোন অংশ নেই। তার জন্যে ক্ষতি, ধ্বংস ও ব্যর্থতার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে এ দু' দলের দৃষ্টান্ত এভাবে পেশ করে যে, তাদের একটি অন্ধ ও বধির, অপরটি দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন।
প্রদীপ, তার সাহায্যে সে সোজা পথে চলতে পারে। এ প্রদীপের বর্তমানে তার পক্ষে পথভ্রষ্ট হবার কোনই আশংকা নেই। সে সোজা পথকে বাঁকা পথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবেই দেখতে পাবে এবং নিরাপদ ও নির্ঝঞ্ঝাটে কল্যাণের মনজিলে মকসুদে পৌঁছে যাবে। পক্ষান্তরে যার কাছে ঈমানের দীপিকা নেই, তার কাছে কোন আলোই নেই। তার পক্ষে সোজা ও বাঁকা পথের পার্থক্য নির্ণয় করা সুকঠিন ব্যাপার। সে অন্ধের ন্যায় অন্ধকারের মধ্যে আন্দাজ-অনুমানে পা টিপে টিপে চলবে। হয়তো ঘটনাক্রমে তার কোন পদক্ষেপ সোজা পথে গিয়ে পড়তেও পারে; কিন্তু এটা সোজা পথে চলার কোন নিশ্চিত উপায় নয়। বরং তার সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হবার সম্ভাবনাই বেশী। কখনো হয়তো গর্তে গিয়ে পড়বে, আবার কখনো কাঁটার মধ্যে আটকে পড়বে।
প্রথম দলটি সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে-
فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَمَزْرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَالتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَةٌ أولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (الاعراف : ١٥٧)
“অতএব যারা রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে এবং যারা তার সাহায্য ও সহায়তা করেছে, আর আনুগত্য করেছে তার সাথে অবতীর্ণ নূরের, প্রকৃত পক্ষে তারাই হচ্ছে কল্যাণ লাভের অধিকারী।" -(সূরা আরাফ : ১৫০ )
অন্যত্র বলা হয়েছে :
اتقوا الله وَامِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمُ ُكفْلَييْنِ مِنْ رَّحْمَتِهِ وَيَجْعَل لَّكُمْ نُورًا
تمشونَ بِهِ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ، (الحديد : ۲۸)
“লোক সকল, আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনো, আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর রহমত থেকে দ্বিগুণ অংশ প্রদান করবেন আর তোমাদের জন্যে এমন আলোর ব্যবস্থা করবেন যে, তোমরা তার ভেতরে চলতে পারবে আর তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।” -(সূরা আল হাদীদ : ২৮)
আর দ্বিতীয় দলটি সম্পর্কে বলা হয়েছে :
وَمَا يَتَّبِعُ الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ شُرَكَاءَ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ
“যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য শরীকদারকে আহ্বান জানায়, তারা কার আনুগত্য করে জানো তারা শুধু অনুমানের পায়রুবী করে, আর নিছক আন্দাজের ভিত্তিতে পথ চলে।" -(সূরা ইউনুস : ৬৬)
ان يُتَّبِعُونَ إِلا الظن ، وإِن الظَّنَّ لا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا ن (النجم : ۲۸)
“তারা শুধু অনুমানের পায়রুবী করে, আর অনুমানের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তা হকের প্রয়োজন থেকে কিছুমাত্র বেনিয়াজ করে না । ” -(সূরা আন নজম : ২৮)
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ ، إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া হেদায়াত ছেড়ে আপন প্রবৃত্তির পায়রুবী করলো, তার চেয়ে অধিক গোমরাহ আর কে হবে । এরূপ যালেমদেরকে আল্লাহ কখনো সোজা পথ দেখান না।” -(সুরা আল কাসাস : ৫০)
وَمَنْ لَمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَالَهُ مِنْ نُّورِه (النور : ٤٠)
“যাকে আল্লাহ তায়ালা আলো দেননি, তার জন্যে আর কোন আলো নেই।”-(সূরা আন নূর : ৪০)
এ গোটা বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা সূরায়ে বাকারায় পাওয়া যায়। তার থেকে এ সত্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, ঈমান ও কুফরের এ পার্থক্যের ফলে মানব জাতির এ দু'টি দলের মধ্যে কতবড়ো পার্থক্য সূচিত হয়।
لا إكراه في الدِّينِ مَد قَدْ تَّبَيَّنَ الرَّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ، فَمَنْ يُكْفُرُ بِالطَّاغُوتِ ويُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى وَ لاَ انفِصَامَ لَهَا ، وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمُ اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمتِ إِلَى النُّورِ، وَالَّذِينَ كَفَرُوا أوليتهُمُ الطَّاغُوتُ ، يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظلمت أولئك أصحب النَّارِ هُم فِيهَا خَلِدُونَ (البقرة : ٢٥٦-٢٥٧)
“দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই, হেদায়াতের পথ থেকে গোমরাহীকে পৃথক করে দেখানো হয়েছে; অতপর যে ব্যক্তি 'তাগুত'কে (শয়তানী শক্তি) পরিত্যাগ করে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে, সে একটি অবিচ্ছেদ্য মযবুত রজ্জু আকড়ে ধরেছে আর আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন। আল্লাহ ঈমানদার লোকদের সাহায্যকারী ; তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে নিয়ে যান। আর কাফেরদের সাহায্যকারী হচ্ছে শয়তান ; সে তাদেরকে আলোক থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হচ্ছে দোযখের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।”
আমলের ওপর ঈমানের অগ্রাধিকার
পরন্তু এ ঈমান ও কুফরের পার্থক্য মানবীয় ক্রিয়া-কাণ্ডের মধ্যেও পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে। কুরআনের মতে ঈমানদার ব্যক্তিই পরহেযগার ও সৎকর্মশীল হতে পারে। ঈমান ব্যতিরেকে কোন আমলের ওপরই তাকওয়া ও সততার বিশেষণ প্রযোজ্য হতে পারে না, দুনিয়াবাসীর দৃষ্টিতে সে কাজটি যতোই সৎকর্ম বলে বিবেচিত হোক না কেন। কুরআন বলে-
وَالَّذِي جَاءَ بِالصَّدِقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ (الزمر : (٣٣)
“যে ব্যক্তি সত্য কথা নিয়ে এসেছে আর যে তার সত্যতা স্বীকার করেছে, কেবল তারাই হচ্ছে মুত্তাকী।" -(সূরা আয যুমার : ৩৩)
هدى للمتقين الذين يُؤْمِنُونَ بِالغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوة ومما رزَقْنهُمْ يُنْفِقُونَ وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ ،وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ (البقرة : ٢-٤)
“কুরআন হচ্ছে মুত্তাকী লোকদের জন্যে হেদায়াত স্বরূপ, যারা গায়েবী বিষয়ের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং আমাদের দেয়া রেযেক থেকে ব্যয় করে, আর যারা তোমার প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের ওপর ঈমান আনে এবং তোমার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের প্রতিও আর যারা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে।" -(সূরা আল বাকারা : ২-৪)
সুতরাং কুরআনের দৃষ্টিতে ঈমানই হচ্ছে তাকওয়া ও পরহেযগারীর মূল ভিত্তি। যে ব্যক্তি ঈমান পোষণ করে তার সৎকর্মসমূহ ঠিক সেভাবে ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়, যেমন করে ভালো জমিন ও ভালো আবহাওয়ায় বাগ-বাগানের রোপিত বৃক্ষ তরু-তাজা ও ফল-ফুলে পূর্ণ হয়ে উঠে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঈমান ছাড়াই আমল করতে থাকে, সে যেন এক অনুর্বর, প্রস্তরময় জমিন ও নিকৃষ্ট আবহাওয়ায় বাগিচা রোপণ করে। এ কারণেই কুরআন মজীদে সর্বত্র ঈমানকে সৎকাজের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এবং কোথাও ঈমান বিহীন সৎকাজকে মুক্তি ও কল্যাণের উপায় বলে ঘোষণা করা হয়নি। ২ বরং অভিনিবেশ সহকারে কুরআন পাঠ করলে আপনারা জানতে পারবেন যে, কুরআন মজীদ যা কিছু নৈতিক নির্দেশ ও আইনগত বিধান পেশ করেছে, তার সবকিছুরই লক্ষ্য হচ্ছে ঈমানদার লোকেরা। এ ধরনের আয়াতগুলো হয়---দ্বারা শুরু হয়েছে, অথবা বর্ণনাভংগির মাধ্যমেই একথা কোন না কোনভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, আহ্বান হচ্ছে শুধু মু'মিনদের প্রতি। বাকী থাকলো কাফের, তাদেরকে সৎকাজের নয়, বরং ঈমানের দিকে আহ্বান জানানো হয়েছে এবং স্পষ্টত বলে দেয়া হয়েছে যে, যারা মু'মিন নয়, তাদের আমলের কোনই মূল্য নেই, তাহচ্ছে অসার, অর্থহীন এবং সম্পূর্ণ বিলুপ্তির উপযোগী।
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٌ بِقِيْعَةٍ يُحْسَبُهُ الظَّقَانُ مَاءٌ ، حَتَّى إِذَا
“যারা কুফরী করেছে, তাদের আমলের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, যেন মরুভূমিতে মরীচিকা। পিপাসার্ত ব্যক্তি দূর থেকে দেখে মনে করে যে, তা পানি; কিন্তু সেখানে গিয়ে পৌঁছলে আর কিছুই পায় না।” - (সূরা আন নূর : ৩৯)
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالأخسرين أعْمَالاً الذينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنعا أولئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَيْتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيمَةِ وَزُنَانِ ذَلِكَ جَزَاؤُهُم
جَهَنَّمُ بِمَا كَفَرُوا وَاتَّخَذُوا أَيتِي وَرُسُلِي هُزُواه (الكهف : ١٠٦١٠٣)
“তাদেরকে বলোঃ আপন কৃত কর্মের দৃষ্টিতে কোন্ ধরনের লোক সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত, আমরা কি তোমাদেরকে বলবো? এ হচ্ছে তারাই, যাদের প্রয়াস-প্রচেষ্টা, পার্থিব জীবনে অযথা নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ তারা ভাবছিলো যে, আমরা খুব ভালো কাজ করছি। এসব লোকেরাই আপন প্রভুর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করেছে এবং তাদেরকে যে তাঁর দরবারে হাযির হতে হবে, এ সত্যটুকু পর্যন্ত স্বীকার করেনি। এর ফলে তাদের আমল বিনষ্ট হয়ে গেছে। কেয়ামতের দিন আমরা তাদের আমলের কোনই মূল্য দেব না এবং তারা দোযখে প্রবেশ করবে। তারা যে কুফরী করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলী ও আমার রসূলগণকে উপহাস করেছে এ হচ্ছে তারই প্রতিফল।" -(সূরা আল কাহাফ : ১০৩-১০৬)
এ একই বিষয় সূরায়ে মায়েদা (রুকু' ১), আনআম (১০), আরাফ (১৭), তওবাহ (৩), হুদ (২), জুমার (৭) ও মুহাম্মদ (১)-এ বিবৃত হয়েছে। আর সূরায়ে তওবায় সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, কাফের দৃশ্যত সৎকাজ করলেও সে কখনো মু'মিনের সমান হতে পারে না :
أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجَ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامَ كَمَنْ أَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَجْهَدَ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ لا يَستَونَ عِنْدَ اللهِ ، وَاللهُ لايَهْدِي الْقَوْمَ الظَّلِمِينَ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجْهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ ، وَأُولئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ (التوبة : ١٩-٢٠)
“তোমরা কি যারা হাজীদের পানি পান করায় এবং মসজিদে হারাম আবাদ রাখে তাদেরকে সেই ব্যক্তির সমান মনে করেছো, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে এবং যে আল্লাহর পথে জেহাদ করেছে ? এ উভয় ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কখনো সমান হতে পারে না । আর আল্লাহ যালেমদেরকে হেদায়াত করেন না। যারা ঈমান এনেছে আর যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জান ও মাল দ্বারা জেহাদ করেছে, তারা আল্লাহর কাছে অতীব সম্মানিত। আর এরাই হচ্ছে সফলকাম।” -(সূরা আত তওবাঃ ১৯-20)
সারসংক্ষেপঃ
এ আলোচনা এবং এর সমর্থনে পেশকৃত কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ থেকে কয়েকটি বিষয় নিসন্দেহভাবে প্রমাণিত হয়:
একঃ ঈমান হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর। এর ওপরই এ ব্যবস্থাটির গোটা ইমারত গড়ে উঠেছে। আর কুফর ও ইসলামের পার্থক্য শুধু ঈমান ও অ-ঈমানের মৌলিক পার্থক্যের ওপর স্থাপিত ।
দুইঃ মানুষের কাছে ইসলামের প্রথম দাবী হচ্ছে ঈমান স্থাপনের এ দাবীকে মেনে নেবার পরই এক ব্যক্তি ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশ করে । আর এরই জন্যে হচ্ছে ইসলামের সমস্ত নৈতিক বিধান ও সামাজিক আইন- কানুন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এ দাবীকে বর্জন করে, সে ইসলামের নির্দিষ্ট পরিধির বাইরে অবস্থিত, তার প্রতি না কোন নৈতিক বিধান প্রযোজ্য আর না কোন সামাজিক আইন কানুন ।
তিনঃ ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানই হচ্ছে আমলের ভিত্তিমূল। যে কাজটি ঈমানের ভিত্তিতে সম্পাদিত হবে, কেবল তা-ই হচ্ছে তার দৃষ্টিতে মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ। আর যেখানে আদতেই এ ভিত্তির কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে সকল আমলই হচ্ছে নিষ্ফল ও অর্থহীন।
একটি প্রশ্নঃ ঈমানের এ গুরুত্বটা কোন কোন লোক উপলব্ধি করতে পারে না। তারা বলে যে, কতিপয় বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ মেনে নেবার ভেতরে এমন কোন রহস্য নেই যে, তার ভিত্তিতে গোটা মানব জাতিকে দু'টি দলে বিভক্ত করা যেতে পারে ; আমাদের দৃষ্টিতে আসল জিনিস হচ্ছে নৈতিকতা ও স্বভাব-চরিত্র, এরই ওপর ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা এবং শুদ্ধ-অশুদ্ধের পার্থক্য নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি উন্নত নৈতিকতা, পবিত্র স্বভাব এবং সচ্চরিত্রের অধিকারী, সে ঐ মতবাদগুলো তথা ইসলামের প্রত্যয়সমূহ স্বীকার করুক আর না-ই করুক, তাকে আমরা সৎলোকই বলবো এবং সৎকর্মশীলদের দলে শামিল করে নেব। আর যার ভেতরে এ গুণাবলী নেই তার পক্ষে ঈমান ও কুফরের বিশ্বাসগত পার্থক্য সম্পূর্ণ অর্থহীন। সে যে কোন আকীদা-বিশ্বাসই পোষণ করুক না আমরা তাকে মন্দই বলবো। তাদের মতে এরপর আরও একটি জিনিস থেকে যায়। তাহলো এই যে, আমলের গুরুত্ব এবং তার মূল্যমান ঈমানের ওপর নির্ভরশীল এবং ঈমান ছাড়া কোন কাজই সৎকাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে সংকীর্ণতার পরিচায়ক। নিছক আল্লাহ, রসূল, কিতাব বা কেয়ামত সম্পর্কে ইসলাম থেকে ভিন্নমত পোষণকারীর নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ও সৎকার্যাবলী বিনষ্ট হয়ে যাবে - কোন যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ ছাড়া এটা স্বীকার করা যেতে পারে না। ইসলাম কোন আকীদা-বিশ্বাসকে সত্য বলে মনে করলে নিসন্দেহে তার প্রচার করতে পারে ; লোকদেরকে সেদিকে আহ্বান জানাতে পারে, তার প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিতে পারে ; কিন্তু বিশ্বাসের প্রশ্নকে নৈতিকতা ও আমলের সীমা পর্যন্ত প্রসারিত করা এবং নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব, চারিত্রিক পবিত্রতা ও কর্মগত উৎকর্ষকে ঈমানের ওপর নির্ভরশীল করা কতখানি সংগত হতে পারে ।
দৃশ্যত এ প্রশ্ন এতখানি গুরুত্বপূর্ণ যে, কোন কোন মুসলমান পর্যন্ত এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামের মূলনীতিকে সংশোধন করতে প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু ঈমানের তাৎপর্য এবং স্বভাব ও চরিত্রের সাথে তার সম্পর্ককে উপলব্ধি করার পর আপনা আপনিই এ আপত্তি নিরসন হয়ে যায়।
প্রশ্নের সত্যাসত্য নির্ণয়ঃ সর্বপ্রথম এ সত্যটি জেনে নেয়া দরকার যে, মানুষে মানুষে ভালো ও মন্দের পার্থক্য মূলত দু'টি পৃথক ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রথম হচ্ছে মানুষের জন্মগত স্বভাব-প্রকৃতি, এর উৎকর্ষ অপকর্ষ মানুষের নিজস্ব ইচ্ছা শক্তির অধীন নয়। দ্বিতীয় হচ্ছে উপার্জন, এর সৎ বা অসৎ হওয়া প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি এবং ইচ্ছা ও ক্ষমতার সুষ্ঠু বা নিকৃষ্ট ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। এ দু' জিনিসই মানব জীবনে আপন আপন প্রভাবের দিক দিয়ে এরূপ মিলেমিশে রয়েছে যে, আমরা এ দু'টি কিংবা এ দু'টির প্রভাব সীমাকে পরস্পর থেকে পৃথক করতে পারি না। কিন্তু মতবাদ হিসেবে এতটুকু অবশ্য জানি যে, মানুষের চিন্তা ও কর্মজীবনে উৎকর্য ও অপকর্ষের এ দু'টি ভিত্তি পৃথকভাবে বর্তমান। যে উৎকর্ষ-অপকর্ষ স্বভাব প্রকৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা নিজস্ব মৌলিকতার দিক থেকে বিচারের মানদণ্ডে কোন গুরুত্ব লাভ করতে পারে না। গুরুত্ব কেবল সেই উৎকর্ষ-অপকর্ষই লাভ করতে পারে, যা উপার্জনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষা, সদুপদেশ, সংস্কৃতি প্রভৃতির জন্যে যতো প্রচেষ্টাই চালান হয়, তার কোন কিছুই প্রথম ভিত্তিটির (অর্থাৎ জন্মগত স্বভাব প্রকৃতি) সাথে সম্পৃক্ত নয়, কেননা তার উৎকর্ষকে অপকর্ষ দ্বারা কিংবা অপকর্ষকে উৎকর্ষ দ্বারা পরিবর্তিত করা অসম্ভব। বরং ঐগুলো হচ্ছে দ্বিতীয় ভিত্তিটির (উপার্জনের) সাথে সম্পর্কযুক্ত। সঠিক শিক্ষা ও যথার্থ ট্রেনিং-এর মাধ্যমে অপকর্ষের দিকে আর গলদ শিক্ষা ও ভ্রান্ত ট্রেনিং-এর মাধ্যমে অপকর্ষের দিকে চালিত করা যেতে পারে।
এ নীতি অনুযায়ী যে ব্যক্তি মানুষের উপার্জিত শক্তিগুলোকে উৎকর্ষের দিকে চালিত করতে এবং তারই পথে বিকশিত করতে ইচ্ছুক, তার পক্ষে নির্ভুল কর্মপন্থা কী হতে পারে। তাহলো মানুষের নির্ভুল জ্ঞান লাভ করা এবং সেই জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে তার জন্যে এমন একটি ট্রেনিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করা, যা তার নৈতিকতা ও স্বভাব-চরিত্রকে (যতখানি তা উপার্জনের সাথে সংশ্লিষ্ট) একটি উত্তম ছাঁচে ঢালাই করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে ট্রেনিং-এর চেয়ে জ্ঞানের অগ্রগণ্য হওয়া একান্ত অপরিহার্য। এ অগ্রাধিকারকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই অস্বীকার করতে পারে না। কারণ জ্ঞান বা এলমই হচ্ছে আমলের বুনিয়াদ, নির্ভুল জ্ঞান ছাড়া কোন আমলেরই অভ্রান্ত হওয়া সম্ভব নয় ।
এবার জ্ঞানের কথা ধরা যাক। এক ধরনের জ্ঞান হচ্ছে আমাদের বাস্তব জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। এটি আমরা স্কুল-কলেজে শিখি বা শিখাই এবং বেশুমার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সমন্বয়ে এটি গঠিত। দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান, কুরআনের পরিভাষায় এটি একমাত্র জ্ঞান বলে অভিহিত। এটি আমাদের বাস্তব কাজ-কারবারের সাথে নয়, বরং 'আমাদের' সাথে সম্পৃক্ত। এর আলোচ্য বিষয় হলো, আমরা কে ? এই যে দুনিয়ায় আমরা বসবাস করি, এখানে আমাদের মর্যাদা কি ? আমাদের এবং এ দুনিয়াকে কে বানিয়েছেন ? সেই সৃষ্টিকর্তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কি ? আমাদের জন্যে জীবন যাপনের নির্ভুল পন্থা (হেদায়াত ও হিরাতাল মুস্তাকীম) কি হতে পারে এবং তা কিভাবে আমরা জানতে পারি ? আমাদের এ জীবন যাত্রার মঞ্জিলে মকছুদ কোনটি ? বস্তুত জ্ঞানের ঐ দু'টি প্রকারের মধ্যে এ দ্বিতীয় প্রকারটিই মৌলিকতার দাবী করতে পারে। আমাদের সকল খুঁটিনাটি জ্ঞানই এর শাখা-প্রশাখা মাত্র এবং এ জ্ঞানটির অভ্রান্তি বা ভ্রান্তির ওপরই আমাদের গোটা চিন্তাধারা ও কার্যাবলীর শুদ্ধি বা অশুদ্ধি নির্ভরশীল। কাজেই মানুষের শিক্ষা ও সংস্কৃতির জন্যে যে ব্যবস্থাই প্রণয়ন করা হবে, তার ভিত্তি এ প্রকৃত জ্ঞানের ওপরই স্থাপিত হবে। যদি মৌলিক জ্ঞান সঠিক ও নির্ভুল হয় তো শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যবস্থাও যথার্থ হবে। আর যদি সে জ্ঞানের ভেতর কোন বিকৃতি থাকে, তবে সে বিকৃতির ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির গোটা ব্যবস্থাই বিকৃত হয়ে যাবে ।
কুরআন মজীদে আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রসূল এবং শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে যে প্রত্যয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ মৌলিক জ্ঞানের সাথেই সম্পৃক্ত। ঐ প্রত্যয়গুলোর প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে এতো জোরালো ভাষায় দাবী জানানোর কারণ এই যে, ইসলামের গোটা সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা ঐ মৌলিক জ্ঞানের ওপরই একান্তভাবে নির্ভরশীল। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের উপার্জিত শক্তিগুলোর পরিশীলন এবং সংস্কৃতির যে ব্যবস্থাপনা একমাত্র নির্ভুল জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত, কেবল সেটিই হচ্ছে নির্ভুল ব্যবস্থাপনা। যে ব্যবস্থা প্রকৃত জ্ঞান ছাড়াই কায়েম করা হয়েছে অথবা যা নির্ভুল জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল নয়, তা মূলতই ভ্রান্ত। এর দ্বারা মানুষের অর্জিত শক্তিগুলোকে ভ্রান্ত পথে চালিত করা হয়েছে। এ সকল পথে মানুষের যে চেষ্টা সাধনা ব্যয়িত হয়, দৃশ্যত তা যতই নির্ভুল মনে হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তার ব্যবহারই ভ্রান্ত। তার গতি সঠিক মঞ্জিলে মকছুদের দিকে নিবন্ধ নয়। তা কখনো সাফল্যের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এ জন্যেই তা বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তার কোন ফায়দাই মানুষ লাভ করতে পারে না। এ কারণেই ইসলাম তা নিজস্ব পথকে “ছিরাতে মুস্তাকিম' বা সহজ-সরল পথ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং অজ্ঞানতা বা ভ্রান্ত জ্ঞানের ভিত্তিকে অনুসৃত সমস্ত পথকেই বর্জন করার দাবী জানিয়েছে
وأن هذا صِرَاطِي مُسْتَقِيمَا فَاتَّبِعُوهُ ، وَلا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ
আর এ জন্যেই ইসলাম ঘোষণা করে যে, যার ঈমান পরিশুদ্ধ নয়, তার যাবতীয় কৃতকর্মই নিষ্ফল এবং পরিশেষে সে অকৃতকার্যই থেকে যাবে। ইসলাম যে প্রত্যয়সমূহ পেশ করেছে, তার কাছে তাই হচ্ছে একমাত্র জ্ঞান, একমাত্র সত্য, একমাত্র হেদায়াত ও একমাত্র আলো। এ যখন তার স্বরূপ, তখন অবশ্যই তার বিরুদ্ধ প্রত্যয়গুলোর একমাত্র অজ্ঞানতা, একমাত্র মিথ্যা, একমাত্র গোমরাহী ও একমাত্র অন্ধকারই হওয়া উচিত। যদি ইসলাম ঐগুলোকে এতো জোরালোভাবে বর্জন করার দাবী না জানাতো এবং ঐ ভ্রান্ত প্রত্যয়সমূহের ধারকদেরকে নির্ভুল ঈমান পোষণকারীদের সমান মূল্য দিতো, তাহলে প্রকারান্তরে সে একথাই স্বীকার করে নিতো যে, তার প্রত্যয়গুলো একমাত্র সত্য নয় এবং সেগুলোর সত্য, হেদায়াত ও আলো হওয়া সম্পর্কে তার নিজেরই পূর্ণ বিশ্বাস নেই। এ অবস্থায় তার পক্ষে ঐ প্রত্যয়গুলোর পেশ করা, ঐগুলোর ভিত্তিতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা এবং সে পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হবার জন্যে লোকদেরকে আহ্বান জানানো সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে পড়ে। এ জন্যে যে, সে যদি এটা স্বীকার করে নেয় যে, এ পরম জ্ঞানের বিরোধী অন্যান্য জ্ঞানও তার মতোই বিশুদ্ধ অথবা আদৌ কোন পরম জ্ঞান না থাকলেও কোন ক্ষতি নেই, তাহলে তার এ পরম জ্ঞানকে পেশ করা এবং এর প্রতি ঈমান স্থাপনের আহ্বান জানানো সম্পূর্ণরূপেই নিরর্থক হয়ে যায়। এরূপ যদি সে এও মেনে নেয় যে, এ পরম জ্ঞানের বিরোধী অন্যান্য জ্ঞানের ভিত্তিতে অথবা কোন পরম জ্ঞান ছাড়াই শিক্ষা ও কৃষ্টির যে পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার মাধ্যমেও মানুষ কল্যাণ লাভ করতে পারে, তাহলে ইসলামী পদ্ধতির অনুসৃতির প্রতি আহ্বান জানানোও একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
পরন্তু ঈমানের তাৎপর্য সম্পর্কিত পূর্বেকার আলোচনা স্মরণ থাকলে ইসলাম কেন ঈমানের ওপর এতোটা গুরুত্ব আরোপ করেছে, তা সহজেই বোঝা যাবে। কল্পনার জগতের অধিবাসীরা বালু, পানি, এমনকি হাওয়ার ওপরও প্রাসাদ নির্মাণ করতে পারেন। কিন্তু ইসলাম একটি বিচক্ষণতাপূর্ণ ধর্ম। ঠুনকো ভিত্তির ওপর সে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাসাদ নির্মাণ করতে পারে না। বরং সবার আগে সে মানুষের আত্মা ও তার চিন্তাশক্তির গভীরে সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে ।
তার ওপর এমন এক ইমারত গড়ে তোলে যে, কারো হেলানোতে তা হেলে পড়ে না। সে সবার আগে মানুষের মনে এ সত্যটি বদ্ধমূল করে দেয় যে, তোমার ওপর এক আল্লাহ রয়েছেন; তিনি দুনিয়া ও আখেরাত সর্বত্রই তোমার বিচারক ও বিধায়ক, তাঁর রাজত্ব ও শাসনক্ষমতা থেকে তুমি কিছুতেই বেরিয়ে যেতে পারো না। তাঁর কাছে তোমার কোন কথাই লুকানো নয়। তোমার পথপ্রদর্শনের জন্যে তিনি রসূল পাঠিয়েছেন এবং রসূলের মাধ্যমে তোমায় কিতাব ও শরীয়াত প্রদান করেছেন। তা অনুসরণ করে তুমি সেই প্রকৃত শাসক, বিচারক ও বিধায়কের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারো। তুমি তাঁর বিরোধী কাজ করলে তোমার সে বিরুদ্ধাচরণ যতোই গোপন থাকুক, তিনি অবশ্যই তোমায় পাকড়াও করবেন এবং তার জন্যে শাস্তি প্রদান করতেও কসুর করবেন না। এ ছাপটি মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে এঁকে দেবার পর সে সৎ স্বভাব ও সচ্চরিত্রের শিক্ষাদান করে। ন্যায় ও অন্যায় সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ বাতলে দেয় এবং ঐ ঈমানী ছাপের বলেই সে লোকদের দ্বারা তার নিজস্ব শিক্ষার অনুসৃতি ও বিধি- নিষেধের আনুগত্য করিয়ে নেয়। এ ছাপটি যতো গভীরে হবে, লোকদের অনুবর্তিতা ততোই পূর্ণাংগ হবে, আনুগত্য সেই অনুপাতে মযবুত হবে, আর কৃষ্টি ও ট্রেনিং পদ্ধতিও হবে ততোখানিই শক্তিশালী। আর এ ছাপটি যদি দুর্বল ও অগভীর হয়, অথবা আদৌ বর্তমান না থাকে কিংবা এর পরিবর্তে অন্য কোন ছাপ মনের ওপর আঁকা না থাকে তাহলে নৈতিক শিক্ষার গোটা ব্যবস্থাই একেবারে অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে, ন্যায়-অন্যায়ের বিধি-নিষেধ সম্পূর্ণ দুর্বল ও শিথিল হয়ে পড়বে এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির সকল ব্যবস্থাপনাই শিশুদের খেলা ঘরে পরিণত হবে। কাজেই বাস্তবক্ষেত্রে এগুলোর প্রতিষ্ঠা বা স্থিতিশীলতার কোনই নিশ্চয়তা নেই। হতে পারে তা সুরম্য, প্রশস্ত ও সমুন্নত, কিন্তু তাতে দৃঢ়তা বা স্থিতিশীলতা কোথায় । এ জিনিসটিকেই কুরআন মজীদ একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিবৃত করেছেঃ
الم تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلاً كَلِمَةٌ طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتُ وفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ تُؤْتِي أَكُلَهَا كُلَّ حَيْنِ بِإِذْنِ رَبِّهَا ، وَيَضْرِبُ اللَّهُ الأمثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ، وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيئَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ نِ اجتلْتُ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَالَهَا مِنْ قَرَارِه يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثابِتِ فِي الْحَةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ ، وَيُضِلُ اللهُ الظَّلِمِينَ لا وَيَفْعَلُ
***********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.
0 Comments
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন