মা’আরেফুল কোরআন-১২ || সূরা আল-বাকারাহ, আয়াতঃ ২১-২২ || বাকারাহ ২১-২২ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ২১-২২

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿ۙ۲۱  الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۲

সূরা বাকারাহ, আয়াতঃ২১-২২ এর অর্থ

(২১) হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে। (২২) যে পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাকেও সমকক্ষ করো না। বস্তুত এসব তোমরা জান ।

সূরা বাকারাহ, আয়াতঃ২১-২২ তফসীরের সার-সংক্ষেপ

হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। এর দ্বারা হয়ত তোমরা দোযখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পাবে। (খোদায়ী ফরমানের ভাষায় 'হয়ত' শব্দ আশ্বাস বা অঙ্গীকারার্থে ব্যবহৃত হয়) যে পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্য জমিকে বিছানারূপে সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশকে ছাদরূপে তৈরি করেছেন; আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তদ্দ্বারা তোমাদের জন্য খাদ্যরূপে ফলমূল সৃষ্টি করেছেন। অতএব, অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করো না। তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার করো না ।

বস্তুত, তোমরা জান (যে, প্রকৃতিতে যেসব পরিবর্তন সাধিত হয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং তাতে যমীন যে ফসল উৎপাদন করে, তা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ করতে পারে না। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাসনার যোগ্য কিভাবে মনে করা যেতে পারে)।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

সূরা বাকারাহ, ২১-২২ আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক

 সূরা ফাতিহার  اِهۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ এ যে দোয়া ও দরখান্ত করা হয়েছে, তারই উত্তর দেওয়া হয়েছে সূরা আল-বাক্বারাহর দ্বিতীয় আয়াতে। এর অর্থ, যে সরল পথ তোমরা চাও, তা-ই এ কোরআনে রয়েছে। কোরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সিরাতে মুস্তাকীমেরই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অতঃপর কোরআনের হেদায়েত গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানকারী মানব-সমাজকে তিনটি দলে বিভক্ত করে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম তিন আয়াতে সেসব মুমিন-মুত্তাকীদের কথা উল্লেখিত হয়েছে, যাঁরা কোরআনের হেদায়েতকে জীবন-সাধনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করেছেন। পরবর্তী দু'টি আয়াতে আলোচিত হয়েছে সে দলের কথা, যারা এ হেদায়েতকে প্রকাশ্যে অস্বীকার এবং বিরুদ্ধাচরণ করেছে। পরবর্তী তেরটি আয়াতে সে মারাত্মক দলের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে, যারা প্রকাশ্যে না হলেও কার্যত এ হেদায়েতের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যারা দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য স্বীয় কুফর ও ইসলাম-বিরোধী ভাবধারাকে গোপন রেখে এবং মুসলমানদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের দলে মিশেছে এবং নিজেদেরকে মুসলমান বলে প্রকাশ করেছে।

এমনিভাবে সূরা বাক্বারাহর প্রথম বিশটি আয়াতেও এ হেদায়েতকে গ্রহণ করা ও বর্জন করার ব্যাপারে মানবজাতিকে তিনটি দলে বিভক্ত করা হয়েছে। এতে এ কথার প্রতিও ইশারা করা হয়েছে যে, বিশ্ব-মানবকে বংশ, বর্ণ, ভাষা ও সম্প্রদায়ের নিরিখে বিভক্ত করা চলে না। বরং এর সঠিক বিভক্তি একমাত্র ধর্মের ভিত্তিতেই করা যেতে পারে। আল্লাহ্ ও তাঁর হেদায়েত গ্রহণকারীকে এক জাতি, পক্ষান্তরে অমান্যকারীদেরকে অন্য জাতি হিসাবে ভাগ করা হয়। এ দু'টি ভাগকেই সূরা-হাশরে হিযবুল্লাহ্ ও হিযবুশ্ শয়তান - এ দু'টি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মোটকথা, সূরা আল-বাক্বারাহর প্রথম বিশটি আয়াতে আল্লাহ্র হেদায়েতকে মানা না মানার ভিত্তিতে মান।জাতিকে তিনটি দলে বিভক্ত করে প্রত্যেকের কিছু কিছু অবস্থা বর্ণনা করা
হয়েছে।

অতঃপর একুশ ও বাইশতম আয়াতে তিনটি দলকেই সমগ্র কোরআনের মৌল শিক্ষার প্রতি আহবান করা হয়েছে। এতে সৃষ্টিজগতের সবকিছুর আরাধনা থেকে বিরত থেকে এক আল্লাহ্র ইবাদতের প্রতি এমন পদ্ধতিতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, যাতে সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিও একটু চিন্তা করলেই তওহীদের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়।

প্রথম আয়াতঃ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ  দ্বারা আহবানের সূচনা হয়েছে। (নাস) আরবী ভাষায় সাধারণভাবে মানুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফলে পূর্বে আলোচিত মানব সমাজের তিন শ্রেণীই এ আহবানের অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ ইবাদত শব্দের অর্থ নিজের অন্তরে মাহাত্ম্য ও ভীতি জাগ্রত রেখে সকল শক্তি আনুগত্য ও তাঁবেদারীতে নিয়োজিত করা এবং সকল অবাধ্যতা ও নাফরমানী থেকে দূরে থাকা। (রুহুল বয়ান, খ. ১, পৃ. ৭৪) 'রব' শব্দের অর্থ পালনকর্তা। ইতিপূর্বে এর বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তদনুসারে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়— স্বীয় পালনকর্তার ইবাদত কর।

এ ক্ষেত্রে 'রব' শব্দের পরিবর্তে 'আল্লাহ' বা তাঁর গুণবাচক নামসমূহের মধ্য থেকে অন্য যে কোন একটা ব্যবহার করা যেতে পারতেন, কিন্তু তা না করে 'রব' শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে যে, এখানে দাবীর সাথে দলীলও পেশ করা হয়েছে। কেননা, ইবাদতের যোগ্য একমাত্র সে সত্তাই হতে পারে, যে সত্তা তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যিনি বিশেষ এক পালননীতির মাধ্যমে সকল গুণে গুণান্বিত করে মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করেছেন এবং দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক সকল ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন ।

মানুষ যত মূর্খই হোক এবং নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তি যতই হারিয়ে থাকুক না কেন, একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে, লালন-পালনের সকল দায়িত্ব নেওয়া আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আর মানুষকে এ অগণিত নেয়ামত না পাথর নির্মিত কোন মূর্তি দান করেছে, না অন্য কোন শক্তি। আর তারা করবেই বা কিরূপে। তারা তো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার বা বেঁচে থাকার জন্য নিজেরাই সে মহাশক্তি ও সত্তার মুখাপেক্ষী। যে নিজেই অন্যের মুখাপেক্ষী সে অন্যের অভাব কি করে দূর করবে ? যদি কেউ বাহ্যিক অর্থে কারো প্রতিপালন করেও, তবে তাও প্রকৃত প্রস্তাবে সে সত্তার ব্যবস্থাপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয় ।

এর সারমর্ম এই যে, যে সত্তার ইবাদতের জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্তা ইবাদতের উপযুক্ত নয়।

এ বাক্যে মানুষের তিনটি দলই অন্তর্ভুক্ত। তবে উল্লেখিত তিন দলের প্রত্যেকের বেলায় এ বাক্যের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হবে। কাজেই যখন কাফিরদেরকে বলা হয় যে, তোমরা স্বীয় পালনকর্তার ইবাদত কর, তখন এর অর্থ হয়, সকল সৃষ্টবস্তুর পূজা-অর্চনা ত্যাগ করে তওহীদ বা একত্ববাদ গ্রহণ কর। মুনাফিকদের বেলায় এ বাক্যের অর্থ হবে—কপটতা ত্যাগ করে আন্তরিকতা ও সরলতা গ্রহণ কর। মুসলমান পাপীদের বেলায় অর্থ হবে—পাপ পরিহার করে পরিপূর্ণ আনুগত্য অবলম্বন কর। আর মু'মিন-মুত্তাকীদের বেলায় এর অর্থ হবে—–ইবাদত ও আনুগত্যে দৃঢ় থাক এবং এতে উন্নতির চেষ্টা কর।”- (রূহুল বয়ান)

অতঃপর 'রব' বা পালনকর্তার কয়েকটি বিশেষ গুণের কথা বর্ণনা করে এ বিষয়টি আরো একটু স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ

অর্থাৎ—তোমাদের সে পালনকর্তা যিনি তোমাদেরকে এবং তোমার পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এতে 'রব'-এর অস্তিত্ব আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তাতে থাকার কোন ধারণাও কেউ করতে পারে না। তা হচ্ছে, অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্বে আনয়ন করা। তাছাড়া মাতৃগর্ভের অন্ধকার ও সঙ্কীর্ণ পরিবেশে এত সুন্দর ও এত পবিত্র মানুষ তৈরী করা, যার পবিত্রতা দেখে ফেরেশতাদেরও ঈর্ষা হয়। তা সে একক সত্তা ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা হতে পারে না; যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন; বরং সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী।

এ স্থলে خَلَقَکُمۡ এর সাথে الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ  যুক্ত করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তোমাদেরকে ও তোমাদের বাপ-দাদা, অর্থাৎ গোটা মানবজাতির স্রষ্টা সেই 'রব'। অতঃপর مِنۡ قَبۡلِکُمۡ বলেছেন, কিন্তু  مِنۡۢ بَعۡدِکُمۡ না বলে এ দিকে ইশারা করা হয়েছে যে, উম্মতে- মুহাম্মাদীর পর আর কোন উম্মত বা মিল্লাত হবে না। কেননা, খতমে নবৃগুতের পর আর কোন নবী রাসূলের আগমন হবে না এবং কোন নতুন উম্মতও হবে না। অতঃপর এ আয়াতের শেষ বাকা لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ অর্থাৎ দুনিয়াতে গোমরাহী এবং আখেরাতে শান্তি থেকে মুক্তির পথ তোমাদের জন্য একমাত্র এই যে, তওহীদকে গ্রহণ কর এবং শিরক থেকে বিরত থাক। অতঃপর দ্বিতীয় আয়াতে 'রব'-এর দ্বিতীয় গুণ বর্ণিত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاء بِنَاء وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً
فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ .

অর্থাৎ-“সে সত্তাই তোমাদের পালনকর্তা, যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদরূপে সৃষ্টি করেছেন। আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তদ্বারা ফলমূল আহার্যরূপে সৃষ্টি করেছেন।" পূর্বের আয়াতে ঐ সমস্ত নেয়ামতের উল্লেখ ছিল, যেগুলো মানুষের সত্তার সাথে মিশে রয়েছে। অতঃপর এ আয়াতে সে সমস্ত নেয়ামতের উল্লেখ করা হয়েছে, যা মানুষের চারদিকের বস্তুসমূহের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ প্রথম আয়াতে মানবসৃষ্টি এবং দ্বিতীয় আয়াতে প্রকৃতির ভাণ্ডারে ছড়িয়ে থাকা নেয়ামতসমূহের বর্ণনা করে সৃষ্টিকর্তার যাবতীয় নেয়ামতকেই এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। নেয়ামতের মধ্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন যাবতীয় ফসলের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, যমীনকে পানির মত এমন নরম করা হয়নি, যাতে স্থির হয়ে এর উপর দাঁড়ানো যাবে না ; আবার লৌহ বা পাথরের মত এত শক্তও করা হয়নি যে, প্রয়োজনে সহজে ব্যবহার করা যাবে না। বরং নরম ও শক্ত--এ দুয়ের মধ্যবর্তী সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে মানুষ সহজে ভূমি কর্ষণ করে তা থেকে জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারে।

 فِرَاشًا শব্দের দ্বারা একথা বোঝায় না যে, পৃথিবীর আকৃতি গোল নয়। বরং ভূখণ্ডে গোল হওয়া সত্ত্বেও দেখতে বিছানার মত বিস্তৃত দেখায়।

কোরআন বিভিন্ন বস্তুর বর্ণনাদান উপলক্ষে এমন এক বর্ণনাভঙ্গি গ্রহণ করেছে যাতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও সরল-বিচক্ষণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোকই তা অতি সহজে বুঝতে পারে। দ্বিতীয় নেয়ামত হচ্ছে আকাশকে অতি মনোরম শোভায় শোভিত করে একটি ছাদের ন্যায় উপরে বিস্তৃত করে রাখা। তৃতীয় নেয়ামত হচ্ছে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ। 'আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন' বাক্যের দ্বারা এরূপ বুঝবার কারণ নেই যে, মেঘমালার মাধ্যম ব্যতীতই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের কথা বলা হচ্ছে। বরং সাধারণ পরিভাষায় উপর থেকে আগত যাবতীয় বন্ধুকেই যেহেতু 'আকাশ থেকে অবতীর্ণ' বলে উল্লেখ করা হয়, সে জন্যই এরূপ বলা হয়েছে।

অধিকন্তু কোরআনের বহু স্থানে মেঘ থেকে পানি বর্ষণের কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন :

ا أَنْتُمْ أَنْزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُونَ .

অর্থাৎ—শ্বেত-শুভ্র মেঘমালা থেকে বৃষ্টির পানি কি তোমরা বর্ষণ করেছ, না আমি বর্ষণকারী? আরো এরশাদ হয়েছে :

وَأَنْزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَات مَاءً تَجاجاً .

অর্থাৎ--আমি পরিপূর্ণ মেঘ থেকে প্রবাহিত পানি বর্ষণ করছি।

চতুর্থ নেয়ামত হচ্ছে, পানি বর্ষণ করে ফলমূল উৎপন্ন করা এবং সেগুলোকে মানুষের আহার্যে পরিণত করা ।

আল্লাহর উপরিউক্ত চারটি গুণের মধ্যে প্রথম তিনটি এমন, যেগুলোতে মানুষের চেষ্টা ও কর্ম তো দূরের কথা, তার উপস্থিতিরও দখল নেই। যে সময় যমীন ও আসমান সৃষ্টি হয়েছিল এবং সৃষ্টিকর্তা তাঁর কাজ করছিলেন, সে যুগে তো মানুষের অস্তিত্বও ছিল না। এ সম্পর্কে কোন নির্বোধও এমন কল্পনা বা সন্দেহ পোষণ করতে পারে না যে, এ বিশাল জগত আল্লাহ্ তা'আলা ব্যতীত অন্য কোন মানুষ, মূর্তি বা দেবতা অথবা অন্য কেউ সৃষ্টি করেছে।

তবে যমীন থেকে ফল-ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের চেষ্টা-তদবীর সম্পর্কে আপাত দৃষ্টিতে এমন ধারণা জন্মাতে পারে যে, মাটিকে নরম করে বা তাতে হালচাষ করে, বীজ বুনে ফসল উৎপাদনের জন্য তৈরি করা হয়তো মানুষের শ্রমেই সম্ভব হয়ে থাকে ।

কিন্তু কোরআনের অন্য এক আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, বৃক্ষ সৃষ্টি ও তাতে ফলমূল উৎপাদনে মানুষের চেষ্টা তদবীরের আদৌ কোন ভূমিকা নেই। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের যে পরিশ্রম স্বীকার করে, তা প্রকৃতপক্ষে অঙ্কুর উদ্‌গমের পর্যায় থেকে শুরু করে ফসল পাকার সময় পর্যন্ত যেসব বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হয়, শুধু সেগুলো অপসারণ ছাড়া আর কিছুই নয় ।

চিন্তা করুন--জমি চাষ করা, গর্ত খনন করা, আগাছা দূর করা, সার প্রয়োগের মাধ্যমে জমিকে নরম করা প্রভৃতি কৃষকের প্রাথমিক কাজগুলো তো শুধু বীজ ও অঙ্কুর উদ্‌গমের পথে যাতে করে কোন বাধার সৃষ্টি না হয়, সেজন্যই করা হয়ে থাকে। কিন্তু বীজ থেকে অঙ্কুর বের করে আনা এবং এগুলোকে ফলমূল ও পত্র-পল্লবে সজ্জিত করায় কৃষকের পরিশ্রমের কোন দখল বা ভূমিকা আছে কি ?

অনুরূপ ভাবে কৃষকের দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে জমিতে বীজ বপন, এর রক্ষণাবেক্ষণ, চারা-গাছকে শীত-তাপ ও জীব-জন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। তার অর্থ, আল্লাহর কুদরতে সৃষ্ট গাছকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা এবং চারা বেড়ে ওঠার পথে বাধা দূরীকরণ পর্যন্তই কৃষকের কাজ। বলা যেতে পারে যে, পানি সেচের মাধ্যমে বীজ, অঙ্কুর ও বৃক্ষের খাদ্য সরবরাহ করা কৃষকের কাজ বটে, কিন্তু পানি তো তাদের সৃষ্ট নয়। কৃষকের অবদান শুধু এতটুকুই যে, আল্লাহর সৃষ্ট পানিকে আল্লাহ্ই আর এক সৃষ্টি ফসলের গোড়ায় একটি উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োগ করবে।

এ আলোচনায় দেখা যাচ্ছে--ফসলের গাছ সৃষ্টি, এর প্রবৃদ্ধি ও ফল-ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আগাগোড়া মানুষের যে চেষ্টা তদবীর নিয়োজিত হয়, সেসব একান্তভাবেই উৎপাদনের পথে বাধা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো দূর করা বা একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। কিছু বৃক্ষ সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি, তাকে ফলে-ফুলে পত্র-পল্লবে সজ্জিত করার ব্যাপারে আল্লাহর কুদরত ছাড়া অন্য কারো কোন কর্তৃত্ব নেই। আল-কোরআন এ সম্পর্কে এরশাদ করেছে:

أفَرَأَيْتُمْ ما تَحْرُثُونَ أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونَ .

অর্থাৎ- “বল তো, তোমরা যা বপন কর, সেগুলো কি তোমরা উৎপাদন কর, না আমি উৎপাদন করি ?”

কোরআনের এ প্রশ্নের উত্তরে মানুষ এক বাক্যে একথাই বলতে বাধ্য হয় যে, এ সবের উৎপাদনকারী একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলা, অন্য কেউ নয় ।

এ আলোচনায় বোঝা যাচ্ছে, আসমান ও যমীন সৃষ্টি করা এবং বৃষ্টি বিদ্যুৎ বর্ষণ করার যে নিয়মিত বিধান আছে তাতে মানুষের চেষ্টা তদবীরের কোন দখল নেই। অনুরূপভাবে বীজ থেকে ফসল ও বৃক্ষ উৎপন্ন করা, একে ফলে-ফুলে, পত্র-পল্লবে সজ্জিত-রক্ষিত করায় এবং তদ্দ্বারা মানুষের আহার্য প্রস্তুত করায় মানুষের শ্রম নামেমাত্রই ব্যবহার হয়ে থাকে। বস্তুতপক্ষে এসব কাজ আল্লাহরই কুদরত ও হেকমতের ফলশ্রুতি।

মোটকথা, পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার এমন চারটি গুণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো মধ্যে পাওয়া যায় না। এ দু'টি আয়াত দ্বারাও বোঝা যায় যে, মানুষকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্বে আনা এবং বেঁচে থাকার জন্য আসমান, যমীন, ফল-ফসল ইত্যাদি দ্বারা রিযিক তৈরি করা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাজ নয়। এজন্য সামান্য বুদ্ধিমান ব্যক্তিও একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইবাদত ও উপাসনা পাওয়ার যোগ্যও একমাত্র তিনিই। কিন্তু এ সত্ত্বেও যদি মানুষ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও সামনে মাথা নত করে, তবে তার চাইতে বড় অন্যায় আর কি হতে পারে।

نعمتت را خورده عصیان میکنم. نعمت از تو من بغیرے می تنم

অর্থাৎ- “তোমার নেয়ামত খেয়েই পাপ করি। তোমরা নেয়ামত আমি ছাড়া আর কে খায়?” আল্লাহ্ তা'আলা মানুষকে সমস্ত সৃষ্টির সেরা বা সরদার বানিয়েছেন এবং এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যেন যাবতীয় সৃষ্টি তাদের খেদমত করবে, আর তারা শুধু বিশ্বপালকের এবাদত ও খেদমত করবে। কিন্তু আত্মভোলা মানুষ স্বয়ং আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে তাদের শত শত দেবতার গোলামিতে আত্মনিয়োগ করতে হচ্ছে।

ایک در چهوڑ کے هم هوگئے لا کھوں کے غلام
هم نے آزادی عرفی کانه سوچا انجام
১২৫
অর্থাৎ—এক দরজা ছেড়ে দিয়ে আমরা লক্ষ লক্ষ বন্ধুর গোলামে পরিণত হয়েছি। যত্রতত্র বিচরণের এই যে স্বাধীনতা, এর পরিণাম চিন্তা করিনি।

মানুষকে অন্যের গোলামি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই আল্লাহ্ তা'আলা এ আয়াতের শেষাংশে এরশাদ করেছেন:

فَلَا تَجْعَلُوا الله أنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ .

অর্থাৎ কাউকে আল্লাহ্র সমতুল্য ও সমকক্ষ সাব্যস্ত করো না, আর তোমরা তো জানই। অর্থাৎ, যখন তোমরা জান যে, তোমাদের জন্ম, তোমাদের লালন-পালন ও বর্ধন, জ্ঞান-বুদ্ধি দান এবং বসবাসের জন্য জমি, অন্যান্য প্রয়োজন মেটাবার জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ, পানি দ্বারা ফল-ফসল উৎপাদন, তা দিয়ে আহার্য তৈরি প্রভৃতি যখনই আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাজও নয়, অন্য কেউ তা করতেও পারে না, তখন ইবাদত-বন্দেগীর যোগ্য তিনি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। এতদসত্ত্বেও তাঁর সাথে অন্যকে অংশীদার করা নিতান্ত অন্যায় ।

সারকথা, এ দু'টি আয়াতে তওহীদের সে দাওয়াতই দেওয়া হয়েছে, যে দাওয়াত প্রচারের জন্য সমস্ত আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে, আর সমস্ত নবী ও রসূলকে প্রেরণ করা হয়েছে। পরন্তু এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার নামই তওহীদ।

এটা সেই যুগান্তকারী পরিকল্পনা, যা মানুষের যাবতীয় কাজে, যথা 'আমল-আখলাক' আচার-ব্যবহার সবকিছুর উপরই অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করে। কেননা, যখন কোন মানুষ বিশ্বাস করে যে, সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা ও মালিক, সকল পরিচালনা এবং সকল বস্তুর উপর একক ক্ষমতার অধিকারী একটি মাত্র সত্তা, তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কারো নড়াচড়া করারও ক্ষমতা নেই, কেউ কারো উপকার বা অপকার করতে পারে না, তখন বিপদে-আপদে, সুখ-দুঃখ, অভাব-অনটনে সর্বাবস্থায় সে মহাসত্তার প্রতি তার সকল মনোযোগ ও আকর্ষণ নিয়োজিত হবে, ফলে তার সে যোগ্যতা অর্জিত হবে যাতে সে বাহ্যিক বস্তুর হাকীকত চিনতে পারবে এবং অনুভব করতে পারবে যে, এ সবকিছুর পেছনেই এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে।

বিজলী বা বাষ্পের উপাসক পাশ্চাত্যের জ্ঞানী ব্যক্তিগণ যদি এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারত, তবে তারা বুঝত যে, এ বিজলী ও বাষ্পের ঊর্ধ্বে আরও কোন শক্তি রয়েছে এবং প্রকৃত শক্তি বিজলীতেও নেই, বাষ্পেও নেই; বরং যিনি এ বিদ্যুৎ ও বাষ্প সৃষ্টি করেছেন, সে মহাসত্তাই সমস্ত শক্তির উৎস। অবশ্য একথা বোঝার জন্য গভীর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রয়োজন। আর যারা এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারেনি, তারা এ দুনিয়াতে যত বড় দার্শনিক ও জ্ঞানীই হোক, সেই সরল লোকটিরই মত যে রেল স্টেশনে এসে গার্ডের হাতে লাল ও সবুজ নিশান দেখতে পেলো। সবুজ নিশান দেখালে গাড়ি চলতে থাকে, আর লাল নিশান দেখালে থামে । তা দেখে সে চিন্তা করে বুঝে নিল যে, এ নিশানগুলিই এতবড় দ্রুতগামী গাড়ী চালানো ও থামানোর মালিক এবং প্রকৃত শক্তির উৎস। এই লোকটির বুদ্ধি দেখে মানুষ তাকে উপহাস করে। কারণ সে এটা বুঝে না যে, নিশান হলো একটি নিদর্শন মাত্র, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাজ

হচ্ছে চালকের, যে লোকটি ইঞ্জিনের গোড়ায় বসে আছে। আসলে এ কাজটি চালকেরও নয় । বরং এটি ইঞ্জিনের সকল কল-কব্জার সম্মিলিত কাজ। আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়--এ কাজটি চালকেরও নয়; ইঞ্জিনেরও নয়; বরং ইঞ্জিনের ভেতরে যে উত্তাপের উৎপত্তি হয়, সেই উত্তাপের। এমনিভাবে একজন তাওহীদ-বিশ্বাসী লোক বস্তুবাদী তথাকথিত বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের প্রতি এই বলে উপহাস করে যে, প্রকৃত হাকীকত তোমরাও বুঝ না; চিন্তার স্থান আরও দূরে। দৃষ্টিশক্তি আরও প্রখর কর, আরও গভীরভাবে লক্ষ্য কর, তখন বুঝতে পারবে, বাষ্প বা এ আগুন এবং এ পানিও কিছুই নয়। এ শক্তি সে সত্তার, যিনি আগুন-পানি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ইচ্ছা ও আদেশে এগুলো নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে মাত্র।

خاك وباد و آب و آتش بنده اند
بامن وتو مرده با حق زنده اند

অর্থাৎ- মাটি, বায়ু, পানি ও আগুন যা মানুষের মাঝে রয়েছে, তা আমার তোমার কাছে মৃত, কিন্তু আল্লাহর কাছে সজীব ।

আমল নাজাত ও বেহেশত পাওয়ার নিশ্চিত উপায় নয়

لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ বাক্যটিতে لَعَلَّ শব্দ 'আশা' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি এমন ক্ষেত্রে বলা হয়, যেখানে কোন কাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ঈমান তাওহীদের পরিণাম নাজাত সম্বন্ধে আল্লাহ্র ওয়াদা নিশ্চিত, কিন্তু সে বস্তুকে উম্মিদ বা আশারূপে বর্ণনা করার তাৎপর্য এই যে, মানুষের কোন কাজই মুক্তি ও বেহেশতের মূল্য বা বিনিময় হতে পারে না। বরং একমাত্র আল্লাহ্র মেহেরবানীতেই মুক্তি সম্ভব। ঈমান আনা ও আমল করার তৌফীক হওয়া আল্লাহ্ মেহেরবানীর নমুনা, কারণ নয় ।

তাওহীদের বিশ্বাসই দুনিয়াতে শান্তি ও নিরাপত্তার জামিন

ইসলামের মৌলিক আকীদা তাওহীদে বিশ্বাস শুধু একটি ধারণা বা মতবাদ মাত্রই নয়; বরং মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষরূপে গঠন করার একমাত্র উপায়ও বটে। যা মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেয়, সকল সংকটে আশ্রয় দান করে এবং তার সকল দুঃখ-দুর্বিপাকের মর্মসাথী। কেননা, তাওহীদে বিশ্বাসের সারমর্ম হচ্ছে এই যে, সকল বস্তুর পরিবর্তন-পরিবর্ধন একমাত্র একক সত্তার ইচ্ছাশক্তির অনুগত এবং তাঁর কুদূতের প্রকাশ মাত্র।

هر تغیر هے غیب کی آواز * هر تجدد میں هیں هزاروں راز

অর্থাৎ- প্রতিটি পরিবর্তনের মাঝে রয়েছে অদৃশ্যের সাড়া এবং প্রতিটি নতুনে রয়েছে অসংখ্য রহস্য।

স্বাভাবিকভাবেই এরূপ বিশ্বাস এবং প্রত্যয় যদি কারো অন্তরে সত্যিকার অর্থেই বন্ধমূল হয়ে যায় এবং সে ব্যক্তি যদি তাওহীদের উপর যথার্থ দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল হতে পারে, তবে তার জন্য এ বিশ্বজগতই বেহেশতে রূপান্তরিত হয়। যেসব কারণে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানির সৃষ্টি হয়, সেসবের মূলই উৎপাটিত হয়ে যাবে, তার সামনে তখন এ শিক্ষাই শুধু প্রকাশমান থাকবে যে-

از خدادان خلاف دشمن و دوست که دل هر دو در تصرف اوست

অর্থাৎ শত্রুমিত্রের বিরুদ্ধাচরণ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, কেননা উভয়ের অন্তরের পরিবর্তন তাঁরই হাতে সাধিত হয়। এ আকীদায় বিশ্বাসীরা সারাবিশ্ব হতে বেপরোয়া ও সকল ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে জীবন যাপন করে। তার অবস্থা হয় নিম্নোক্ত কবিতাটির মত-

موحد چه بر پائی ریزی زرش* چه فولاد هندی نهی بر سرش
اميد و هراسش نباشد زکس * همین است بنیاد توحيد وبس

কলেমা لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ যাকে কালেমা-এ-তাওহীদ বলা হয়, উদ্ধৃত কবিতাটির অর্থ এবং মর্মও তাই। কিন্তু তাওহীদের এ মন্ত্রে মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং সঠিক অন্তরে এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং সার্বক্ষণিকভাবে এ বিশ্বাসের প্রেরণা অন্তরে জাগ্রত রাখাও আবশ্যক। কেননা, এক আল্লাহ্র সার্বক্ষণিক উপস্থিতি দৃষ্টির সম্মুখে জাগ্রত থাকাকেই তাওহীদ বলে; মৌখিক স্বীকৃতিকে নয়। لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ পাঠ করার মত কোটি কোটি লোক এ যমানায় রয়েছে। এদের সংখ্যা এত বেশি যে, ইতিপূর্বে কখনও এত ছিল না। কিন্তু সাধারণ বিচারেই এ বিপুল জনসংখ্যাকে মৌখিক স্বীকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ দেখতে পাওয়া যায়। অন্তর তাওহীদের বিপ্লবী রঙে রঞ্জিত বড় একটা দেখা যায় না নতুবা অবস্থাও পূর্বেকার বুযুর্গের মতই হতো। বৃহৎ হতে বৃহত্তর কোন শক্তিও তাদেরকে অবনত করতে পারত না। কোন জাতির অগণিত লোকসংখ্যা তাদের উপর কোন প্রভাবও বিস্তার করতে পারত না। যে কোন জাতির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কিংবা পার্থিব সম্পদ তাদের অন্তরকে আল্লাহ্-বিরোধী কোন কাজে আকৃষ্ট করতেও সমর্থ হতো না। আল্লাহর নবী একা দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা আমার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আমার নীতিতে কোন পরিবর্তন আনার সাধ্য কারো নেই। আমার কোন ক্ষতি করার সামর্থ্যও হবে না কারো।

নবী করীম (সা)-এর পর সাহাবী ও তাবেয়ীগণ অল্প দিনের মধ্যে সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছেন । তাঁদের শক্তি প্রকৃত তাওহীদের মধ্যেই নিহিত ছিল। আমি-আপনি এবং সারা বিশ্বের মুসলমানকে আল্লাহ্ যেন এ সম্পদ দান করেন।





********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url