মা’আরেফুল কোরআন-১৩ || সূরা আল-বাকারাহ, আয়াতঃ ২৩-২৪ || বাকারাহ ২৩-২৪ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ২৩-২৪

কোরআনের অকাট্যতায় রিসালতের প্রমাণ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُهَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ﴿۲۳
فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُهَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۲۴

সূরা আল-বাকারাহ, ২৩-২৪ নং আয়াতের অর্থ

(২৩) এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। তোমাদের সেসব সাহায্যকারীকেও সঙ্গে নাও—এক আল্লাহকে ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। (২৪) আর যদি তা না পার অবশ্য তা তোমরা কখনও পারবে না- তাহলে সে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা কর, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। তা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য ।

সূরা আল-বাকারাহ, ২৩-২৪ আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

আমি আমার (এ বিশেষ) বান্দার প্রতি (যে গ্রন্থ) অবতীর্ণ করেছি, তাতে যদি তোমাদের কোনরূপ সন্দেহ থাকে, তবে এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে এসো। (কেননা তোমরাও আরবী ভাষা জান, আর এ ভাষার গদ্য-পদ্য সকল রীতিও তোমাদের জানা, তোমরা পদ্য ও কবিতা রচনায় অভ্যন্ত। অথচ মুহাম্মদ (সা) এ বিষয়ে অভ্যস্ত নন। এতদসত্ত্বেও তোমরা যখন কোরআনের কোন একটি সূরার সমপর্যায়ের কোন সূরা রচনা করতে পারলে না, তখন ন্যায়নীতির ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, কোরআনরূপী এ মু'জিযা আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ এবং ইনি আল্লাহ্ই পয়গাম্বর)। তোমাদের সেসব সাহায্যকারীকেও সঙ্গে নাও এক আল্লাহকে ছেড়ে (যাদেরকে তোমরা সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করে রেখেছ,) যদি তোমরা সত্যবাদী হও। কিন্তু যদি তোমরা না পার, আর কিয়ামত পর্যন্ত পারবেও না, তবে দোযখের আগুন, যে আগুনের জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর, তা হতে বাঁচতে চেষ্টা কর, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে (কৃতঘ্ন) কাফেরদের জন্য।

সূরা আল-বাকারাহ, ২৩-২৪ আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক ও বিষয়বস্তুর সার-সংক্ষেপ: এ দু'টি সূরা আল-বাক্বারাহর তেইশ ও চব্বিশতম আয়াত । এর পূববর্তী দু'টি আয়াতে তাওহীদ প্রমাণ করা হয়েছে। এ দু'টি আয়াতে রিসালতে-মুহাম্মদীর প্রমাণ দেওয়া হচ্ছে। আল-কোরআন যে হেদায়েত নিয়ে আগমন করেছে, তার দু'টি স্তম্ভের একটি তাওহীদ ও অন্যটি রিসালাত। প্রথম দু'আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার কয়েকটি বিশেষ কাজের উল্লেখ করে তাওহীদ প্রমাণ করা হয়েছে। এ দু'টি আয়াতে আল্লাহ্র কালাম পেশ করে হুযূর (সা)-এর রিসালাত প্রমাণ করা হচ্ছে। উভয় বিষয়ের প্রমাণ পদ্ধতি একই। প্রথম দু'টি আয়াতে এমন কয়েকটি কাজের উল্লেখ করা হয়েছে, যা আল্লাহ্, ব্যতীত অন্য কেউ আদৌ করতে পারে না। যথা, যমীন ও আসমান সৃষ্টি করা, আকাশ হতে পানি বর্ষণ করা, পানি দ্বারা ফল-ফসল উৎপাদন করা ইত্যাদি। এ দলীলের সারকথা এই যে, যখন এসব কাজ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ইবাদতও তাঁকে ছাড়া অন্য কেউ পেতে পারে না।

এ দু'টি আয়াতে এমন এক কালাম পেশ করা হচ্ছে, যা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো হতে পারে না। ব্যক্তিগত মেধা কিংবা দলগত উদ্যোগের দ্বারাও এ কালামের অনুরূপ রচনা পেশ করা সম্ভব নয়। সমগ্র মানবজাতির এ অপারকতার আলোকেই এ সত্য সপ্রমাণিত যে, এ কালাম আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নয়। এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা সমগ্র বিশ্বের মানুষকে উদ্দেশ্য করে চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, যদি তোমরা এ কালামকে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মানুষের কালাম বলে মনে কর, তবে যেহেতু তোমরাও মানুষ, তোমাদেরও অনুরূপ কালাম রচনা করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা থাকা উচিত। কাজেই সমগ্র কোরআন নয়, বরং এর ক্ষুদ্রতম একটি সূরাই রচনা করে দেখাও। এতে তোমাদিগকে আরও সুযোগ দেওয়া যাবে যে, একা না পারলে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ মিলে, যারা তোমাদের সাহায্য-সহায়তা করতে পারে এমন সব লোক নিয়েই ছোট একটি সূরা রচনা করে দেখাও।

এজন্য তোমরা বিশ্ব-সম্মেলন ডাক, চেষ্টা কর। কিন্তু না, তা পারবে না। অতঃপর অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের সে ক্ষমতা ও যোগ্যতাই নেই। তারপর বলা হয়েছে, যখন কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করেও পারবে না, তখন দোযখের আগুন ও শান্তিকে ভয় কর। কেননা এতে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এটা মানব রচিত কালাম নয়, বরং এমন অসীম শক্তিশালী সত্তার কালাম যা মানুষের ধরাছোঁয়া ও নাগালের ঊর্ধ্বে। যাঁর শক্তি সকলের ঊর্ধ্বে এমন এক মহা সত্তা ও শক্তির কালাম। সুতরাং তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থেকে দোযখের কঠোর শাস্তি হতে আত্মরক্ষা কর।

মোটকথা, এ দু'টি আয়াতে কোরআনুল করীমকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সর্বাপেক্ষা বড় মু'জিযা হিসাবে অভিহিত করে তাঁর রিসালাত ও সত্যবাদিতার দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে। রাসূল (সা)-এর মু'জিযার তো কোন শেষ নেই এবং প্রতিটিই অত্যন্ত বিস্ময়কর। কিন্তু তা সত্ত্বেও এন্থলে তাঁর জ্ঞন ও বিদ্যার মু'জিযা অর্থাৎ কোরআনের বর্ণনায় সীমাবদ্ধ রেখে ইশারা করা হয়েছে যে, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মু'জিযা হচ্ছে কোরআন এবং এ মু'জিযা অন্যান্য নবী-রাসূলের সাধারণ মু'জিযা হতে স্বতন্ত্র। কেননা আলাহ্ তা'আলা তাঁর অপার কুদরতে রাসূল প্রেরণের সাথে সাথে কিছু মু'জিযাও প্রকাশ করেন। আর এসব মু'জিযা যে সমস্ত রাসুলের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো তাঁদের জীবৎকাল পর্যন্তই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কোরআনই এমন এক বিচিত্র মু'জিযা যা কিয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে।

وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رِيب.

 رَیۡبٍ শব্দের অর্থ সন্দেহ, সংশয়। কিন্তু ইমাম রাগিব ইসফাহানীর মতে  رَیۡبٍ এমন সন্দেহ ও ধারণাকে বলা হয়, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সামান্য একটু চিন্তা করলেই সে সন্দেহ দূরীভূত হয়ে যায়। এজন্য কোরআনে অমুসলিম জ্ঞানী সমাজের পক্ষেও رَیۡبٍ-এ পতিত হওয়া স্বাভাবিক নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে; যথা, এরশাদ হয়েছে-

وَلَا يَرْتَابَ الَّذِينَ أوتُوا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُونَ .

একই কারণে কোরআনের প্রথম সূরা আল-বাক্বারায় কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে, لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡهِ "এতে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই।” আলোচ্য এ আয়াতে وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ অর্থাৎ 'যদি তোমাদের কোন সন্দেহ হয়' বাক্যটির অর্থ হচ্ছে যে, যদিও সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ এবং অলৌকিক প্রমাণাদি সমৃদ্ধ কোরআনে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশই থাকতে পারে না, তবু শোন! فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ সুরা শব্দের অর্থ সীমিত টুকরা। আর কোরআনের সূরা কোরআনের সেই অংশকে বলা হয়, যা ওহীর নির্দেশ দ্বারাই অন্য অংশ হতে পৃথক করা হয়েছে।

সমগ্র কোরআনে ছোট-বড় মোট একশ' চৌদ্দটি সূরা রয়েছে। আর এ স্থলে سُوۡرَۃٍ শব্দটিকে 'আলিফ-লাম' বর্জিতভাবে ব্যবহার করে এ কথা বোঝানো হয়েছে যে, কোরআন আল্লাহর কালাম হওয়া সম্পর্কে তোমাদের অন্তরে যদি কোন প্রকার সন্দেহের উদ্রেক হয়ে থাকে অথবা যদি এরূপ মনে কর যে, এটি নবী করীম (সা) নিজে কিংবা অন্য কোন মানুষ রচনা করেছেন, তবে এর মীমাংসা অতি সহজে এভাবে হতে পারে যে, তোমরাও কোরআনের ক্ষুদ্রতম যে কোন সূরার মত একটি সূরা রচনা কর। তাতে যদি কৃতকার্য হতে পার, তবে তোমাদের দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হবে এবং তোমরা একথা বলতে পারবে যে, কোরআন মানব রচিত একটি পুস্তক ব্যতীত অন্য কিছু নয়। পক্ষান্তরে যদি তা না পার, তবে মনে করতে হবে যে, এটি সত্যিই মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে, আল্লাহ্র রচিত কালাম ।

এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, আমরা পারিনি বলে অন্য কোন লোক বা দল তা করতে পারবে না, একথা তো বলা চলে না। এজন্য এরশাদ হয়েছে-

وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِّنْ دُونِ اللَّهِ

شُهَدَ - شُهَدَاء শব্দের বহুবচন, অর্থ- উপস্থিত। সকল সাক্ষীকে শাহেদ এজন্যই বলা হয় যে, তাদেরকেও আদালতে বিচারকের সামনে উপস্থিত হতে হয়। এখানে ব্যাপক অর্থে বলা হয়েছে যে, সমগ্র বিশ্বের যার যার কাছ থেকে তোমরা এ কাজে সাহায্য পাওয়া সম্ভব বলে মনে কর, তাদেরও সাহায্য গ্রহণ কর। অথবা এতে উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের দেবতা, যাদের সম্পর্কে তাদের ধারণা রয়েছে যে, শেষ বিচারের দিনে এ সব দেবতা তাদের পক্ষে সাক্ষী দেবে।

দ্বিতীয় আয়াতে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, যদি তোমরা তা করতে না পার, তবে জাহান্নামের সে আগুন থেকে বাঁচতে চেষ্টা কর, যে আগুনের জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। সে আগুন তোমাদের মত অস্বীকারকারী ও অবিশ্বাসীদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। তাদের প্রচেষ্টার ফলাফল কি হবে তাও তিনি। وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡ বলে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে যতই প্রচেষ্টা চালাও না কেন তোমরা অনুরূপ আয়াত রচনা করতে পারবে না। কারণ, তা তোমাদের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, যে জাতি ইসলাম ও কোরআনের বিরুদ্ধাচরণে এবং এর মূল উৎপাটন করার জন্যে জানামাল, ইজ্জত প্রভৃতি সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিল, তাদেরকে এত সহজ একটা পথ - দেখানো হলো এবং এমন সুলভ সুযোগ দেওয়া হলো যে, তোমরা কোরআনের যে কোন ছোট সূরার মত একটি সূরা রচনা কর; তবেই তোমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে। তাদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আরও বলা হয়েছে যে, তোমরা আদৌ তা করতে পারবে না। এমন একটা চ্যালেঞ্জের পরও সে জাতির মধ্যে এমন একটা লোকও কেন এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে এলো না। তাদের সে অপারকতাই কি কোরআন যে আল্লাহর কালাম তার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। এতেই বোঝা যাচ্ছে যে, কোরআন হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন এক জ্বলন্ত মু'জিযা যে, এর সামনে সকল বিরোধী শক্তি মস্তক অবনত করতে বাধ্য হয়েছে।

কোরআন একটি গতিশীল ও কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী মু'জিযা

অন্য সমস্ত নবী ও রাসূলের মু'জিযাসমূহ তাঁদের জীবন পর্যন্তই মু'জিযা ছিল। কিন্তু কোরআনের মু'জিযা হুযূর (সা)-এর তিরোধানের পরও পূর্বের মত মু'জিযাসুলভ বৈশিষ্ট্যসহই বিদ্যমান রয়েছে। আজ পর্যন্ত একজন সাধারণ মুসলমানও দুনিয়ার যে কোন জ্ঞানী-গুণীকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারে যে, কোরআনের সমতুল্য কোন আয়াত ইতিপূর্বেও কেউ তৈরি করতে পারেনি, এখনও কেউ পারবে না--আর যদি সাহস থাকে তবে তৈরি করে দেখাও। তফসীরে জালালাইন প্রণেতা শায়খ জালালুদ্দীন সুয়ুতী (র) স্বীয় 'খাসায়েসে কুবরা' গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দু'টি মু'জিযা হাদীসের উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করেছেন। তার একটি কোরআন এবং অপরটি হচ্ছে এই যে, হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, হুযুর! হজ্জের সময় তিনটি প্রতীককে লক্ষ লক্ষ হাজী তিনদিন পর্যন্ত প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করে। এ সব পাথর টুকরা তো কেউ অন্যত্র উঠিয়েও নিয়ে যায় না, এতে তো এ স্থানে প্রতি বছর পাথরের এমন স্তূপ হওয়ার কথা, যাতে প্রতীকগুলো নিমজ্জিত হয়ে যায়। একবার নিক্ষিপ্ত পাথর দ্বিতীয়বার নিক্ষেপ করাও নিষেধ। তাই হাজীগণ মুযদালিফা থেকে যে পাথর নিয়ে আসেন, এতে তো দু-এক বছরে পাহাড় হওয়ার কথা, কিন্তু তা তো হয় না? হুযূর (সা) জবাব দিলেন ঃ এজন্য আল্লাহ্ তা'আলা ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন যেন যে সব হাজীর হজ্জ কবুল হয়, তাদের নিক্ষিপ্ত প্রস্তর টুকরাগুলো উঠিয়ে নিয়ে যায়, আর যে সমস্ত হতভাগার হজ্জ কবুল হয় না, তাদের কংকরগুলো এখানেই থেকে যায় । এ জন্যই এখানে কংকরের সংখ্যা কমই দেখা যায়। তা না হলে এখানে পাথরের পাহাড় হয়ে যেতো। (সুনানে বায়হাকীতে এ বর্ণনা উল্লেখিত হয়েছে)।

এটি এমন একটি হাদীস যদ্বারা প্রতিবছর রাসূল (সা)-এর সত্যতা প্রতীয়মান হয় এবং এমন একটি বাস্তব সত্য যে, প্রতি বছর হজ্জের মওসুমে হাজার হাজার হাজী একত্রিত হয় এবং প্রত্যেক হাজী প্রতিদিন তিনটি ফলক লক্ষ্য করে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করে । কোন কোন অতি উৎসাহী লোক বড় বড় পাথর পর্যন্ত নিক্ষেপ করে থাকে এবং একথাও সত্য যে, এসব পাথরকণা পরিষ্কার করার জন্য না সরকার কোন ব্যবস্থা করে, না কোন বেসরকারী দল নিযুক্ত থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই এ প্রথা চলে আসছে যে, সেখান থেকে কেউ কংকর পরিষ্কার করে না। তাই পরের বছর দ্বিগুণ, তৃতীয় বছর ত্রিগুণ জমা হবে। এতে এ এলাকা প্রতীক চিহ্নিটিসহ পাথরে ঢাকা পড়বে, এমনকি দিনে দিনে এখানে একটা কৃত্রিম পাহাড় সৃষ্টি হয়ে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু বাস্তবে তো তা হয় না! এ আশ্চর্যজনক বাস্তব বিষয়টি যুগে যুগে রাসূল (সা)-কে বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট।

অনুরূপভাবে কোরআনের রচনাশৈলী, যার নমুনা আর কোনকালেই কোন জাতি পেশ করতে পারেনি, সেটাও একটি গতিশীল দীর্ঘস্থায়ী মু'জিযা। হুযুরের যুগে যেমন এর নযীর পেশ করা যায়নি, অনুরূপভাবে আজও তা কেউ পেশ করতে পারেনি; ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না। 

অনন্য কোরআন

উপরোক্ত সাধারণ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়ার প্রয়োজন যে, কিসের ভিত্তিতে কোরআনকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সর্বাপেক্ষা বড় মু'জিযা বলা হয় আর কি কারণে কোরআন শরীফ সর্বযুগে অনন্য ও অপরাজেয় এবং সারা বিশ্ববাসী কেন এর নবীর পেশ করতে অপারক হলো?

দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের এ দাবি যে, চৌদ্দশ' বছরের এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোরআনের এ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কেউ কোরআনের বা এর একটি সূরার অনুরূপ কোন রচনাও পেশ করতে পারেনি, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দাবির যথার্থতা কতটুকু—এ দু'টি বিষয়ই দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ।

কোরআনের মু'জিযা হওয়ার কারণসমূহ

প্রথম কথা হচ্ছে যে, কোরআনকে মু'জিযা বলে অভিহিত করা হলো কেন, আর কি কি কারণে সারা বিশ্ব এর নবীর পেশ করতে অপারক হয়েছে। এ বিষয়ে প্রাচীনকাল থেকেই আলেমগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। আর প্রত্যেক মুফাসসিরই স্ব-স্ব বর্ণনাভঙ্গিতে এর বিবরণ দিয়েছেন। আমি অতি সংক্ষেপে কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয় বর্ণনা করছি।

এখানে সর্বপ্রথম লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, এ আশ্চর্য এবং সর্ববিধ জ্ঞানের আধার, মহান গ্রন্থটি কোন্ পরিবেশে এবং কার উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। আরো লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে যে, সে যুগের সমাজ পরিবেশে কি এমন কিছু জ্ঞানের উপকরণ বিদ্যমান ছিল, যার দ্বারা এমন পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ রচিত হতে পারে, যাতে সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সর্ববিধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যাবতীয় উপকরণ সন্নিবেশিত করা স্বাভাবিক হতে পারে? সমগ্র মানব সমাজের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক সম্বলিত নির্ভুল পথনির্দেশ এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করার মত কোন সূত্রের সন্ধান কি সে যুগের জ্ঞান ভাণ্ডারে বিদ্যমান ছিল, যদ্বারা মানুষের দৈহিক ও আত্মিক উভয় দিকেরই সুষ্ঠু বিকাশের বিধানাবলী থেকে শুরু করে পারিবারিক নিয়ম-শৃঙ্খলা, সমাজ সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তথা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও সর্বোত্তম ও সর্বযুগে সমভাবে প্রযোজ্য আইন-কানুন বিদ্যমান থাকতে পারে ? যে ভূখণ্ডে এবং যে মহান ব্যক্তির প্রতি এ গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে এর ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা জানতে গেলে সাক্ষাৎ ঘটবে এমন একটা উষর শুষ্ক মরুময় এলাকার সাথে, যা ছিল 'বাহা' বা মক্কা নামে পরিচিত। এই এলাকার ভূমি কৃষিকাজের উপযোগী ছিল না। এখানে কোন কারিগরি শিল্প ছিল না। আবহাওয়াও এমন স্বাস্থ্যকর ছিল না, যা কোন বিদেশী পর্যটককে আকৃষ্ট করতে পারে। রাস্তাঘাটও এমন ছিল না, যেখানে সহজে যাতায়াত করা যায়। সেটি ছিল অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, এমন একটি মরুময় উপদ্বীপ, যেখানে শুষ্ক পাহাড়-পর্বত এবং ধু-ধু বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ত না । কোন জনবসতি বা বৃক্ষলতার অস্তিত্বও বড় একটা দেখা যেতো না ।

এ বিরাট ভূ-ভাগটির মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য শহরেরও অস্তিত্ব ছিল না। মাঝে-মধ্যে ছোট ছোট গ্রাম এবং তার মধ্যে উট-ছাগল প্রতিপালন করে জীবনধারণকারী কিছু মানুষ বসবাস করত। ছোট ছোট গ্রামগুলো তো দূরের কথা, নামেমাত্র যে কয়টি শহর ছিল, সেগুলোতেও লেখাপড়ার কোন চর্চাই ছিল না। না ছিল কোন স্কুল-কলেজ, না ছিল কোন বিশ্ববিদ্যালয়। শুধুমাত্র ঐতিহ্যগতভাবে আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে এমন একটা সুসমৃদ্ধ ভাষাসম্পদ দান করেছিলেন, যে ভাষা গদ্য ও পদ্য বাক-রীতিতে ছিল অনন্য। আকাশের মেঘ-গর্জনের মতো সে ভাষার মাধুরী অপূর্ব সাহিত্যরসে সিক্ত হয়ে তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসত। অপূর্ব রসময় কাব্যসত্তার বৃষ্টিধারার মত আবৃত হতো পথে-প্রান্তরে। এ সম্পদ ছিল এমনি এক আশ্চর্য বিস্ময়, আজ পর্যন্তও যার রসাস্বাদন করতে গিয়ে যে কোন সাহিত্য প্রতিভা হতবাক হয়ে যায়। কিন্তু এটি ছিল তাদের স্বভাবজাত এক সাধারণ উত্তরাধিকার। কোন মক্তব-মাদরাসার মাধ্যমে এ ভাষাজ্ঞান অর্জন করার রীতি ছিল না। অধিবাসীদের মধ্যে এ ধরনের কোন আগ্রহও পরিলক্ষিত হতো না। যারা শহরে বাস করত, তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। পণ্যসামগ্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আমদানী-রপ্তানীই ছিল তাদের একমাত্র পেশা।

সে দেশেই সর্বপ্রাচীন শহর মক্কার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সে মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব, যাঁর প্রতি আল্লাহর পবিত্রতম কিতাব কোরআন নাযিল করা হয়। প্রসঙ্গত সেই মহামানবের অবস্থা সম্পর্কেও কিছুটা আলোচনা করা যাক ।

ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তিনি পিতৃহারা হন, জন্মগ্রহণ করেন অসহায় এতীম হয়ে। মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে। মাতার স্নেহ-মমতার কোলে লালিত-পালিত হওয়ার সুযোগ তিনি পাননি। পিতৃ-পিতামহগণ ছিলেন এমন দরাজ দিল যার ফলে পারিবারিক সূত্র থেকে উত্তরাধিকাররূপে সামান্য সম্পদও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি, যার দ্বারা এ অসহায় এতীমের যোগ্য লালন-পালন হতে পারত। পিতৃ-মাতৃহীন অবস্থায় নিতান্ত কঠোর দারিদ্র্যের মাঝে লালিত-পালিত হন। যদি তখনকার মক্কায় লেখাপড়ার চর্চা থাকতও তবুও এ কঠোর দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনে লেখাপড়া করার কোন সুযোগ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে কোন অবস্থাতেই সম্ভবপর হতো না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তদানীন্তন আরবে লেখাপড়ার কোন চর্চাই ছিল না, যে জন্য আরব জাতিকে ‘উম্মী' জাতি বলা হতো। কোরআন পাকেও এ জাতিকে উম্মী জাতি নামেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই সে মহান ব্যক্তি বাল্যকাল অবধি যে কোন ধরনের লেখাপড়া থেকে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন রয়ে যান। সে দেশে তখন এমন কোন জ্ঞানী ব্যক্তিরও অস্তিত্ব ছিল না, যাঁর সাহচর্যে থেকে এমন কোন জ্ঞানসূত্রের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হতো, যে জ্ঞান কোরআন পাকে পরিবেশন করা হয়েছে। যেহেতু একটা অনন্যসাধারণ মু'জিযা প্রদর্শনই ছিল আল্লাহ্ তা'আলার উদ্দেশ্য, তাই মামুলী অক্ষরজ্ঞান যা দুনিয়ার যে কোন এলাকার লোকই কোন-না-কোন উপায়ে আয়ত্ত করতে পারে তাও আয়ত্ত করার কোন সুযোগ তাঁর জীবনে হয়ে ওঠেনি। অদৃশ্য শক্তির বিশেষ ব্যবস্থাতেই তিনি এমন নিরক্ষর রয়ে গেলেন যে, নিজের নামটুকু পর্যন্ত দস্তখত করতেও তিনি শেখেন নি।

তদানীন্তন আরবের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বিষয় ছিল কাব্যচর্চা। স্থানে স্থানে কবিদের জলসা- মজলিস বসত। এসব মজলিসে অংশগ্রহণকারী চারণ ও স্বভাব-কবিগণের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা হতো। প্রত্যেকে অন্যের তুলনায় উত্তম কাব্য রচনা করে প্রাধান্য অর্জন করার চেষ্টা করত। কিন্তু তাঁকে আল্লাহ্ তা'আলা এমন রুচিবান করেছিলেন যে, কোনদিন তিনি এ ধরনের কবি জলসায় শরীক হননি। জীবনে কখনও এক ছত্র কবিতা রচনা করারও চেষ্টা করেন নি ।

উম্মী হওয়া সত্ত্বেও অদ্ৰতা-নম্রতা, চারিত্রিক মাধুর্য ও অত্যন্ত প্রখর ধীশক্তি এবং সত্যবাদিতা ও আমানতদারীর অসাধারণ গুণ বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হতো, ফলে আরবের ক্ষমতাদর্পী বড়লোকগুলোও তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখত; সমগ্র মক্কা নগরীতে তাঁকে 'আল-আমীন' বলে অভিহিত করা হতো।

এই নিরক্ষর ব্যক্তিটি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মক্কা নগরীতে অবস্থান করেছেন। ভিন্ন কোন দেশে ভ্রমণেও যাননি। যদি এমন ভ্রমণও করতেন তবুও ধরে নেওয়া যেত যে, তিনি সেসব সফরে অভিজ্ঞতা ও বিদ্যার্জন করেছেন। মাত্র সিরিয়ায় দু'টি বাণিজ্যিক সফর করেছেন, যাতে তাঁর কোন কর্তৃত্ব ছিল না। তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত মক্কায় এমনভাবে জীবনযাপন করেছেন যে, কোন পুস্তক বা লেখনী স্পর্শ করেছেন বলেও জানা যায় না, কোন মক্তবেও যাননি, কোন কবিতা বা ছড়াও রচনা করেন নি। ঠিক চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর মুখ থেকেই সেই বাণী নিঃসৃত হতে লাগল, যাকে কোরআন বলা হয়। যা শাব্দিক ও অর্থের গুণগত দিক দিয়ে মানুষকে স্তম্ভিত করত। সুস্থ বিবেকবান লোকদের জন্য কোরআনের এ গুণগত মানই মু'জিযা হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তাতেই তো শেষ নয়। বরং এ কোরআন সারা বিশ্ববাসীকে বারংবার চ্যালেঞ্জ সহকারে আহবান করেছে যে, যদি একে আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, তবে এর নযীর পেশ করে দেখাও।

একদিকে কোরআনের আহ্বান অপরদিকে সমগ্র বিশ্বের বিরোধী শক্তি যা ইসলাম ও ইসলামের নবীকে ধ্বংস করার জন্য স্বীয় জানমাল, শক্তি-সামর্থ্য ও মান-ইজ্জত তথা সবকিছু নিয়োজিত করে দিনরাত চেষ্টা করছিল। কিন্তু এ সামান্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে কেউ সাহস করেনি। ধরে নেওয়া যাক, এ গ্রন্থ যদি অদ্বিতীয় ও অনন্যসাধারণ নাও হতো, তবু একজন উম্মী লোকের মুখে এর প্রকাশই কোরআনকে অপরাজেয় বলে বিবেচনা করতে যে কোন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন লোকই বাধ্য হতো। কেননা, একজন উম্মী লোকের পক্ষে এমন একটা গ্রন্থ রচনা করতে পারা কোন সাধারণ ঘটনা বলে চিন্তা করা যায় না।

দ্বিতীয় কারণঃ পবিত্র কোরআন ও কোরআনের নির্দেশাবলী সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে। কিন্তু এর প্রথম সম্বোধন ছিল প্রত্যক্ষভাবে আরব জনগণের প্রতি। যাদের অন্য কোন জ্ঞান না থাকলেও ভাষাশৈলীর উপর ছিল অসাধারণ দক্ষতা। এদিক দিয়ে আরবরা সারা বিশ্বে এক শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল। কোরআন তাদেরকে লক্ষ্য করেই চ্যালেঞ্জ করেছে যে, “কোরআন যে আল্লাহ্র কালাম ভাতে যদি তোমরা সন্দিহান হয়ে থাক, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সাধারণ সূরা রচনা করে দেখাও। যদি আল-কোরআনের চ্যালেঞ্জ শুধু এর অন্তর্গত গুণ, নীতি, শিক্ষাগত তথ্য এবং নিগূঢ় তত্ত্ব পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হতো, তবে হয়তো এ উম্মী জাতির পক্ষে কোন অজুহাত পেশ করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারত, কিন্তু ব্যাপার তা নয়, বরং রচনাশৈলীর আঙ্গিক সম্পর্কেও এতে বিশ্ববাসীকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য অন্যান্য জাতির চাইতে আরববাসীরাই ছিল বেশি উপযুক্ত। যদি এ কালাম মানব ক্ষমতার ঊর্ধ্বে কোন অলৌকিক শক্তির রচনা না হতো, তবে অসাধারণ ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন আরবদের পক্ষে এর মোকাবিলা কোনমতেই অসম্ভবই হতো না, বরং এর চাইতেও উন্নতমানের কালাম তৈরি করা তাদের পক্ষে সহজ ছিল। দু'-একজনের পক্ষে তা সম্ভব না হলে, কোরআন তাদেরকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এমনটি রচনা করারও সুযোগ দিয়েছিল। এমন সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও সমগ্র আরববাসী একেবারে নিশ্চুপ রয়ে গেল; কয়েকটি বাক্যও তৈরি করতে পারল না।

আরবের নেতৃস্থানীয় লোকগুলো কোরআন ও ইসলামকে সম্পূর্ণ উৎখাত এবং রাসূল (সা)-কে পরাজিত করার জন্য যেভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, তা শিক্ষিত লোকমাত্রই অবগত। প্রাথমিক অবস্থায় হযরত রাসূলে করীম (সা) এবং তাঁর স্বল্প সংখ্যক অনুসারীকে নানা উৎপীড়নের মাধ্যমে ইসলাম থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এতে ব্যর্থ হয়ে তারা তোষামোদের পথ ধরল। আরবের বড় সরদার ওৎবা ইবনে রাবীয়া সকলের প্রতিনিধিরূপে হুযূর (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করল, “আপনি ইসলাম প্রচার থেকে বিরত থাকুন। আপনাকে সমগ্র আরবের ধন-সম্পদ, রাজত্ব এবং সুন্দরী মেয়ে দান করা হবে।" তিনি এর উত্তরে কোরআনের কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন। এ প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। হিজরতের পূর্বে ও পরে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। কিন্তু কেউই কোরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে অগ্রসর হলো না; তারা কোরআনের অনুরূপ একটি সূরা এমনকি কয়েকটি ছত্রও তৈরি করতে পারল না। ভাষাশৈলী ও পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে কোরআনের মোকাবিলা করার ব্যাপারে আরবদের এহেন নীরবতাই প্রমাণ করে যে, কোরআন মানবরচিত গ্রন্থ নয়; বরং তা আল্লাহরই রচিত কালাম। মানুষ তো দূরের কথা, সমগ্র সৃষ্টিজগত মিলেও এ কালামের মোকাবিলা করতে পারে না ।

আরববাসীরা যে এ ব্যাপারে শুধু নির্বাকই রয়েছে তাই নয়, তাদের একান্ত আলোচনায় এরূপ মন্তব্য করতেও তারা কুণ্ঠিত হয়নি যে, এ কিতাব কোন মানুষের রচনা হতে পারে না। আরবদের মধ্যে যাদের কিছুটা সুস্থ-বিবেক ছিল তারা শুধু মুখেই একথা প্রকাশ করেনি, এরূপ স্বীকৃতির সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই ইসলাম গ্রহণও করেছে। আবার কেউ কেউ পৈতৃক ধর্মের প্রতি অন্ধ আবেগের কারণে অথবা বনী আবদে মনাফের প্রতি বিদ্বেষবশত কোরআনকে আল্লাহর কালাম বলে স্বীকার করেও ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে।

কোরআনের অসাধারণত্ব নিয়ে কিছু ঘটনা

কুরাইশদের ইতিহাসই সে সমস্ত ঘটনার সাক্ষী। তারই মধ্য থেকে এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে অতি সহজে বোঝা যাবে যে, সমগ্র আরববাসী কোরআনকে অদ্বিতীয় ও নযীরবিহীন কালাম বলে স্বীকার করেছে এবং এর নযীর পেশ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নিতে সচেতনভাবে বিরত রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং কোরআন নাযিলের কথা মক্কার গণ্ডি ছাড়িয়ে হেজাযের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর বিরুদ্ধবাদীদের অন্তরে এরূপ সংশয়ের সৃষ্টি হলো যে, আসন্ন হজ্জের মওসুমে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজীগণ মক্কায় আগমন করবে। তারা রাসূল (সা)-এর কথাবার্তা শুনে প্রভাবান্বিত না হয়ে পারবে না। এমতাবস্থায় এরূপ সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করার পন্থা নিরূপণ করার উদ্দেশ্যে মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরায়েশরা একটা বিশেষ পরামর্শ সভার আয়োজন করল। এ বৈঠকে আরবের বিশিষ্ট সরদারগণও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ওলীদ ইবনে মুগীরা বয়সে ও বিচক্ষণতায় ছিলেন সবার মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। সবাই তাঁর নিকট এ সমস্যার কথা উত্থাপন করল। তারা বলল, এখন চতুর্দিক থেকে মানুষ আসবে এবং মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করবে। তাদের সেসব প্রশ্নের জবাবে আমরা কি বলব ? আপনি আমাদেরকে এমন একটি উত্তর বলে দিন, যেন আমরা সবাই একই কথা বলতে পারি। ওলীদ বললেন, তোমরাই বল, কি বলা যায়। তারা উত্তর দিল যে, আমরা তাঁকে পাগল বলে পরিচয় দিয়ে বলব, তাঁর কথাবার্তা পাগলামিতে পরিপূর্ণ। ওলীদ তাদেরকে এরূপ বলতে বারণ করে বলে দিলেন, ওরা মানুষ মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে গিয়ে তাঁর পরিচয় পেয়ে তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করবে।

অপর একদল প্রস্তাব করলো, আমরা তাঁকে কবি বলে পরিচয় দেব। তিনি তাও বলতে নিষেধ করলেন। কেননা, আরবের প্রায় সবাই ছিল কবিতায় পারদর্শী। তাই তারা মুহাম্মদের কথা শুনে ভালভাবেই বুঝতে পারবে যে, বিষয়টি সত্য নয়, তিনি কবি নন। ফলে তারা সবাই তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করবে। কেউ কেউ মন্তব্য করলো, তবে আমরা তাকে যাদুকর বলে পরিচয় দিয়ে বলবো যে, সে শয়তান ও জ্বিনদের কাছ থেকে শুনে গায়েবের সংবাদ বলে বেড়ায়।

ওলীদ বললেন, একথাও সাধারণ লোককে বিশ্বাস করানো যাবে না; বরং শেষ পর্যন্ত লোকেরা তোমাদেরকেই মিথ্যাবাদী মনে করবে। কেননা, তারা যখন তাঁর কথা-বার্তা ও কালাম শুনবে, তখন তারা বুঝতে পারবে যে, এসব কথা কোন যাদুকরের নয়। শেষ পর্যন্ত কোরআন সম্পর্কে ওলীদ ইবনে মুগীরা নিজের মতামত বর্ণনা করেছিলেন: আল্লাহর কসম! কবিতার ক্ষেত্রে আমার চাইতে বেশি অভিজ্ঞতা তোমাদের কারো নাই। সত্যি বলতে কি, এ কালামে অবর্ণনীয় একটা আকর্ষণ রয়েছে। এতে এমন এক সৌন্দর্য বিদ্যমান, যা আমি কোন কাব্য বা অসাধারণ কোন পণ্ডিতের বাক্যে কখনও পাইনি। তখন তারা জিজ্ঞেস করলো, তবে আপনি বলুন, আমরা কি বলবো? ওলীদ বললেন, আমি চিন্তা করে বলব। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর তিনি উত্তর দিলেন, যদি তোমাদের কিছু বলতেই হয়, তবে তাঁকে যাদুকর বলতে পার। লোকদেরকে বলো যে, এ লোক যাদুবলে পিতা-পুত্র ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। সমবেত লোকেরা তখনকার মত এ কথায় একমত ও নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। তখন থেকেই তারা আগন্তুকদের নিকট একথা বলতে আরম্ভ করলো, কিন্তু আল্লাহর জ্বালানো প্রদীপ কারো ফুঁৎকারে নির্বাপিত হবার নয়। আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ লোকদের অনেকেই কোরআনের অমিয় বাণী শুনে মুসলমান হয়ে গেল। ফলে মক্কার বাইরেও ইসলামের বিস্তার সূচিত হলো। (খাসায়েসে-কুব্রা)

এমনিভাবে বিশিষ্ট কুরাইশ সরদার নযর ইবনে হারেস তার স্বজাতিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, - আজ তোমরা এমন এক বিপদের সম্মুখীন হয়েছ, যা ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি। মুহাম্মদ (সা) তোমাদেরই মধ্যে যৌবন অতিবাহিত করেছেন, তোমরা তাঁর চরিত্র মাধুর্যে বিমুগ্ধ ছিলে, তাঁকে তোমরা সবার চাইতে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করতে, আমানতদার বলে অভিহিত করতে। কিন্তু যখন তাঁর মাথার চুল সাদা হতে আরম্ভ করেছে, আর তিনি আল্লাহর কালাম তোমাদেরকে শোনাতে শুরু করেছেন, তখন তোমরা তাঁকে যাদুকর বলে অভিহিত করছ। আল্লাহর কসম! তিনি যাদুকর নন। আমি বহু যাদুকর দেখেছি, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি, কিন্তু মুহাম্মদ (সা) কোন অবস্থাতেই তাদের মত নন। তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। আরও জেনে রেখ! আমি অনেক যাদুকরের কথাবার্তা শুনেছি, কিন্তু তাঁর কথাবার্তা যাদুকরের কথাবার্তার সাথে কোন বিচারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তোমরা তাঁকে কবি বল, অথচ আমি অনেক কবি দেখেছি, এ বিদ্যা আয়ত্ত করেছি, অনেক বড় বড় কবির কবিতা শুনেছি, অনেক কবিতা আমার মুখস্থও আছে, কিন্তু তাঁর কালামের সাথে কবিদের কবিতার কোন সাদৃশ্য আমি খুঁজে পাইনি। কখনও কখনও তোমরা তাঁকে পাগল বল, তিনি পাগলও নন। আমি অনেক পাগল দেখেছি, তাদের পাগলামিপূর্ণ কথাবার্তাও শুনেছি, কিন্তু তাঁর মধ্যে তাদের মত কোন লক্ষণই পাওয়া যায় না। হে আমার জাতি! তোমরা ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এ ব্যাপারে চিন্তা কর, সহজে এড়িয়ে যাওয়ার মত ব্যক্তিত্ব তিনি নন ।

হযরত আবূ যর (রা) বলেছেন, আমার ভাই উনাইস একবার মক্কায় গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন যে, মক্কায় এক ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর রসূল বলে দাবি করেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেখানকার মানুষ এ সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করে। তিনি উত্তর দিলেন, তাঁকে কেউ কবি, কেউ পাগল, কেউবা যাদুকর বলে। আমার ভাই উনাইস একজন বিশিষ্ট কবি এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞ লোক ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমি যতটুকু লক্ষ্য করেছি, মানুষের এসব কথা ভুল ও মিথ্যা। তাঁর কালাম কবিতাও নয়, যাদুও নয়, আমার ধারণায় সে কালাম সত্য।

আবূ যর (রা) বলেন যে, ভাইয়ের কথা শুনে আমি মক্কায় চলে এলাম। মসজিদে হারামে অবস্থান করলাম এবং ত্রিশ দিন শুধু অপেক্ষা করেই অতিবাহিত করলাম। এ সময় যমযম কূপের পানি ছাড়া আমি অন্য কিছুই খাইনি। কিন্তু এতে আমার ক্ষুধার কষ্ট অনুভব হয়নি! দুর্বলতাও উপলব্ধি করিনি। শেষ পর্যন্ত কা'বা প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে এসে লোকদের বললাম—আমি রোম ও পারস্যের বড় বড় জ্ঞানী-গুণী লোকদের অনেক কথা শুনেছি, অনেক যাদুকর দেখেছি, কিন্তু মুহাম্মদ (সা)-এর বাণীর মত কোন বাণী আজও পর্যন্ত কোথাও শুনিনি। কাজেই সবাই আমার কথা শোন এবং তাঁর অনুসরণ কর। আবূ যরের এ প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়েই মক্কা বিজয়ের বছর তাঁর কওমের প্রায় এক হাজার লোক মক্কায় গমন করে ইসলাম গ্রহণ করেন ।

ইসলাম ও হযরতের সবচাইতে বড় বড় শত্রু আবূ জাহল এবং আখনাস ইবনে সোরাইকও লোকচক্ষুর অগোচরে কোরআন শুনত, কোরআনের অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি এবং অনন্য রচনারীতির প্রভাবে প্রভাবান্বিত হতো। কিন্তু গোত্রের লোকেরা যখন তাদেরকে বলত যে, তোমরা যখন এ কালামের গুণ সম্পর্কে এতই অবগত এবং একে অদ্বিতীয় কালামরূপে বিশ্বাস কর, তখন কেন তা গ্রহণ করছ না? প্রত্যুত্তরে আবূ জাহল বলতো তোমরা জান যে, বনি আবদে মনাফ এবং আমাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই বিরামহীন শত্রুতা চলে আসছে, তারা যখন কোন কাজে অগ্রসর হতে চায়, তখন আমরা তার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে বাধা দিই। উভয় গোত্রই সমপর্যায়ের। এমতাবস্থায় তারা যখন বলছে যে, আমাদের মধ্যে এমন এক নবীর আবির্ভাব হয়েছে, যাঁর কাছে আল্লাহ্ বাণী আসে, তখন আমরা কিভাবে তাদের মোকাবিলা করবো, তা-ই আমার চিন্তা। আমি কখনও তাদের একথা মেনে নিতে পারি না ।

মোটকথা, কোরআনের এ দাবি ও চ্যালেঞ্জ সারা আরববাসী যে পরাজয় বরণ করেই ক্ষান্ত হয়েছে তাই নয়; বরং একে অদ্বিতীয় ও অনন্য বলে প্রকাশ্যভাবে স্বীকারও করেছে। যদি কোরআন মানব রচিত কালাম হতো, তবে সমগ্র আরববাসী তথা সমগ্র বিশ্ববাসী অনুরূপ কোন না কোন একটি ছোট সূরা রচনা করতে অপারক হতো না এবং এ কিতাবের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা স্বীকারও করতো না। কোরআনে ও কোরআনের বাহক পয়গম্বরের বিরুদ্ধে জানমাল, ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত সবকিছু ব্যয় করার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল কিন্তু কোরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দু'টি শব্দও রচনা করতে কেউ সাহসী হয়নি।

এর কারণ এই যে, সমস্ত মানুষ তাদের মূর্খতাজনিত কার্যকলাপ ও আমল সত্ত্বেও কিছুটা বিবেকসম্পন্ন ছিল, মিথ্যার প্রতি তাদের একটা সহজাত ঘৃণাবোধ ছিল। কোরআন শুনে তারা যখন বুঝতে পারলো যে, এমন কালাম রচনা আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়, তখন তারা কেবল একগুঁয়েমির মাধ্যমে কোন বাক্য রচনা করে তা জনসমক্ষে তুলে ধরা নিজেদের জন্য লজ্জার ব্যাপার বলে মনে করতো। কেননা, তারা জানতো যে, আমরা যদিও কোন বাক্য পেশ করি, সমগ্র আরবের শুদ্ধভাষী লোকেরা তুলনামূলক পরীক্ষায় আমাদেরকে অকৃতকাৰ্যই ঘোষণা করবে এবং এজন্য অনর্থক লজ্জিত হতে হবে। এজন্য সমগ্র জাতি চুপ করেছিল। আর যারা কিছুটা ন্যায়পথে চিন্তা করেছে, তারা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নিতেও কুণ্ঠিত হয়নি যে, এটা আল্লাহর কালাম ।

এসব ঘটনার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, আরবের একজন সরদার আস'আদ ইবনে যেরারা হযরতের চাচা আব্বাস (রা)-এর কাছে স্বীকার করেছেন যে, তোমরা অনর্থক মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদের ক্ষতি করছ এবং পারস্পরিক সম্পর্কছেদ করছ। আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে, নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি যে কালাম পেশ করেছেন তা আল্লাহর কালাম, এতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।

বনী সোলায়েম গোত্রের কায়স বিন নাসীরা নামক এক লোক রাসূল (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে কোরআন শুনে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। হুযূর (সা) তার জবাব দেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করে স্বীয় গোত্রে ফিরে গিয়ে বলেন যে, আমি রোম ও পারস্যের অনেক বিজ্ঞ পণ্ডিতের কালাম শুনেছি, অনেক যাদুকরের কথাবার্তাও শুনেছি, তাতে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু মুহাম্মদ (সা)-এর কালামের অনুরূপ কালাম আজ পর্যন্ত কোথাও শুনিনি । তোমরা আমার কথা শোন এবং তাঁর অনুসরণ কর। এসব স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকারোক্তি এমন লোকদের নয়, যারা হুযূর (সা)-এর কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। বরং যারা সর্বদা সবদিক দিয়ে রাসুল (সা)-এর বিরুদ্ধাচরণে ব্যস্ত ছিল তাদেরই এ স্বীকারোক্তি। কিন্তু তারা নিজেদের একগুঁয়েমির দরুন মানুষের নিকট তা প্রকাশ করতো না ।

আল্লামা সুয়ূতী (র) বায়হাকীর উদ্ধৃতি দিয়ে ‘খাসায়েসে-কুবরা' নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, একবার আবূ জাহল, আবু সুফিয়ান ও আখনাস ইবনে সোরাইক রাতের অন্ধকারে গোপনে আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর যবানে কোরআন শোনার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং আল্লাহ্র রাসূল (সা) যেখানে কোরআন তেলাওয়াত করতেন, একে একে সবাই সে বাড়ির আশেপাশে সমবেত হয়ে আত্মগোপন করে তেলাওয়াত শুনতে থাকে। এতে তারা এমন অভিভূত হয়ে পড়ে যে, এ অবস্থাতেই রাত শেষ হয়ে যায়। ভোরে বাড়ি ফেরার পথে দৈবাৎ রাস্তায় পরস্পরের মধ্যে সাক্ষাৎ হয় এবং সবাই সবার ব্যাপারে অবগত হয়ে একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে যে, তুমি খুবই অন্যায় করেছ। ভবিষ্যতে আর যেন কেউ এমন কাজ করে না। কেননা, আরবের সাধারণ লোক এ ব্যাপারে জানতে পারলে সবাই মুসলমান হয়ে যাবে। পরস্পর এমন কথা বলাবলি করে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল। পরের রাতে পুনরায় তাদের কোরআন শোনার আগ্রহ জাগে এবং গোপনে প্রত্যেকেই এসে একই স্থানে সমবেত হয়। রাতশেষে প্রত্যাবর্তনকালে সাক্ষাৎ হলে আবার একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে। তারপর থেকে তা বন্ধ করতে সবাই একমত প্রকাশ করে। কিন্তু তৃতীয় রাতেও তারা কোরআন শোনার আগ্রহে পূর্বের মতই চলে যায়। রাতশেষে পুনরায় তাদের সাক্ষাৎ হয়। এবার তাঁরা সবাই বলে যে, চল এবার আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, আর কখনো এ কাজ করবো না। এভাবেই তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ফিরে আসে। পরদিন সকালে আখনাস ইবনে সোৱাইক লাঠি হাতে নিয়ে প্রথমে আবূ সুফিয়ানের কাছে গিয়ে বলে যে, বল, মুহাম্মদ (সা)-এর কালাম সম্পর্কে তোমরা কি অভিমত? আবূ সুফিয়ান কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করে শেষ পর্যন্ত কোরআনের সত্যতা স্বীকার করে নেয়। অতঃপর আখনাস আবূ জাহলের বাড়ি গিয়ে তাকেও অনুরূপ প্রশ্ন করে। আবূ জাহল উত্তর দিল, পরিষ্কার কথা হচ্ছে এই যে, পূর্ব থেকেই আবদে মনাফ গোত্রের সাথে আমাদের গোত্রের শত্রুতা চলে আসছে। তারা কোন ব্যাপারে অগ্রসর হলে আমরা তাতে বাধা দিই। তারা বদান্যতার ক্ষেত্রে জনসাধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। আমরা তাদের চাইতে অধিক দান-খয়রাত করে এর মোকাবিলা করেছি। তারা সমগ্র জাতির অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিল, এ ক্ষেত্রেও আমরা তাদের পেছনে থাকিনি। সমগ্র আরববাসী জানে, আমাদের এ দু'টি গোত্র সমমর্যাদাসম্পন্ন। এমতাবস্থায় তাদের গোত্র থেকে এ ঘোষণা করা হলো যে, আমাদের বংশে একজন নবী জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর কাছে আল্লাহ্র কালাম আসে। সুতরাং আমাদের পক্ষে এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এর মোকাবিলা আমরা কিভাবে করবো। এজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, কোনদিনও আমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবো না ।

এই হচ্ছে কোরআনের প্রকাশ্য মু'জিযা, যা শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। (খাসায়েসে-কুৱা)

তৃতীয় কারণঃ তৃতীয় কারণ হচ্ছে এই যে, কোরআন কিছু গায়েবী সংবাদ এবং ভবিষ্যতে ঘটবে এমন অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছে, যা হুবহু সংঘটিত হয়েছে। যথা—কোরআন ঘোষণা করেছে যে, রোম ও পারস্যের যুদ্ধে প্রথমত পারস্যবাসী জয়লাভ করবে এবং দশ বছর যেতে না যেতেই পুনরায় রোম পারস্যকে পরাজিত করবে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মক্কার সরদারগণ হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর সাথে এ ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা সম্পর্কে বাজি ধরল। শেষ পর্যন্ত কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রোম জয়লাভ করলো এবং বাজির শর্তানুযায়ী যে মাল দেওয়ার কথা ছিল, তা তাদের দিতে হলো। রাসূলুল্লাহ (সা) অবশ্য এ মাল গ্রহণও করেন নি। কেননা, এরূপ বাজি ধরা শরীয়ত অনুমোদন করে না। এমন আরো অনেক ঘটনা কোরআনে উল্লেখিত রয়েছে, যা গায়েবের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং নিকট অতীতে হুবহু ঘটেছেও।

চতুর্থ কারণঃ চতুর্থ কারণ এই যে, কোরআন শরীফে পূর্ববর্তী উম্মত, সেকালের শরীয়ত ও তাদের ইতিহাসে এমন পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে যুগের ইহুদী-খৃষ্টানদের আলেমগণ, যাদেরকে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের বিজ্ঞ লোক মনে করা হতো, তারাও এতটা অবগত ছিল না। রাসুল (সা)-এর কোন প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না। কোন শিক্ষিত লোকের সাহায্যও তিনি গ্রহণ করেন নি। কোন কিতাব কোনদিন স্পর্শও করেন নি। এতদসত্ত্বেও দুনিয়ার প্রথম থেকে তাঁর যুগ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ববাসীর ঐতিহাসিক অবস্থা এবং তাদের সম্পর্কে অতি নিখুঁতভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা আল্লাহর কালাম ছাড়া কিছুতেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা'আলাই যে তাঁকে এ সংবাদ দিয়েছেন এতে সন্দেহের অবকাশ নেই ।

পঞ্চম কারণঃ পঞ্চম কারণ হচ্ছে এই যে, কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি সম্পর্কিত যেসব সংবাদ দেওয়া হয়েছে পরে সংশ্লিষ্ট লোকদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এসব কথাই সত্য। একাজও আল্লাহ্ তা'আলারই কাজ, তা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরশাদ হয়েছে-

از همتْ طَائِفَتَانِ مِنْكُمْ أنْ تَفْشَلاً .

. অর্থাৎ- “যখন তোমাদের দু'দল মনে মনে ইচ্ছা করল যে, পশ্চাদপসরণ করবে” আরো ইরশাদ হচ্ছে -

يَقُولُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ لَوْ لَا يُعَذِّبُنَا الله بما نقول .

অর্থাৎ-তারা মনে মনে বলে যে, আমাদের অস্বীকৃতির দরুন আল্লাহ্ কেন আমাদেরকে শান্তি দিবেন না। এসব এমন কথা যা সংশ্লিষ্ট লোকেরা কারো কাছে প্রকাশ করেনি, বরং কোরআন তা প্রকাশ করে দিয়েছে।

ষষ্ঠ কারণঃ ষষ্ঠ কারণ হচ্ছে যে, কোরআনে এমন সব আয়াত রয়েছে যাতে কোন সম্প্রদায় বা কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, তাদের দ্বারা অমুক কাজ হবে না; তারা তা করতে পারবে না। ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি তারা নিজেদেরকে আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা বলেই মনে করে, তবে তারা নিশ্চয়ই তাঁর নিকট যেতে পছন্দ করবে; সুতরাং এমতাবস্থায় তাদের পক্ষে মৃত্যু কামনা করা অপছন্দনীয় হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছেঃ وَلَنْ يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا -তারা কখনও তা চাইবে না ।

মৃত্যু কামনা করা তাদের পক্ষে কঠিন ছিল না। বিশেষ করে ঐ সমস্ত লোকদের জন্য, যারা কোরানকে মিথ্যা বলে অভিহিত করতো। কোরআনের এরশাদ মোতাবেক তাদের মৃত্যু কামনা করার ব্যাপারে ভয় পাওয়ার কোন কারণ ছিল না। ইহুদীদের পক্ষে মৃত্যু কামনার (মোবাহালা) এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মুসলমানদেরকে পরাজিত করার অত্যন্ত সুবর্ণ সুযোগ ছিল। কোরআনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গে সঙ্গেই তাতে সম্মত হওয়া তাদের পক্ষে উচিত ছিল। কিন্তু ইহুদী ও মুশরিকরা মুখে কোরআনকে যতই মিথ্যা বলুক না কেন, তাদের মন জানতো যে, কোরআন সত্য, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং মৃত্যু কামনার চ্যালেঞ্জে সাড়া দিলে সত্য সত্যই তা ঘটবে। এজন্যই তারা কোরআনের এ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সাহস পায়নি এবং একটি বারের জন্যও মুখ দিয়ে মৃত্যুর কথা বলেনি ।

সপ্তম কারণঃ কোরআন শরীফ প্রবণ করলে মু'মিন, কাফের, সাধারণ-অসাধারণ নির্বিশেষে সবার উপর দু'ধরনের প্রভাব সৃষ্টি হতে দেখা যায়। যেমন, হযরত জুবাইর ইবনে মোতইম (রা) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একদিন হুযুর (সা)-কে মাগরিবের নামাযে সূরা তুর পড়তে শোনেন। হুযূর (সা) যখন শেষ আয়াতে পৌঁছলেন, তখন হযরত জুবাইর (রা) বলেন যে, মনে হলো, যেন আমার অন্তর উড়ে যাচ্ছে। তাঁর কোরআন পাঠ শোনার এটাই ছিল প্রথম ঘটনা। তিনি বলেন, সেদিনই কোরআন আমার উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছিল। আয়াতটি হচ্ছে-

ام خَلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْرُامْ هُمُ الخَالِقُونَ أَمْ خَلَقُوا السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ
بَلْ لَا يُوقِنُونَ أمْ عِنْدَهُمْ خَزَائِنُ رَبِّكَ أَمْ هُمُ الْمُصَيْطِرُونَ.

অর্থাৎ-তারা কি নিজেরাই সৃষ্ট হয়েছে, না তারাই আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করেছে ? কোন কিছুতেই ওরা ইয়াকীন করছে না। তাদের নিকট কি তোমার পালনকর্তার ভাণ্ডারসমূহ গচ্ছিত রয়েছে, না তারাই রক্ষক?

অষ্টম কারণঃ অষ্টম কারণ হচ্ছে, কোরআনকে বারংবার পাঠ করলেও মনে বিরক্তি আসে না। বরং যতই বেশি পাঠ করা হয়, ততই তাতে আগ্রহ বাড়তে থাকে। দুনিয়ার যত ভাল ও আকর্ষণীয় পুস্তক হোক না কেন, বড়জোর দু-চার বার পাঠ করার পর তা আর পড়তে মন চায় না, অন্যে পাঠ করলেও তা শুনতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু কোরআনের এ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, যত বেশি পাঠ করা হয়, ততই মনের আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। অন্যের পাঠ শুনতেও মনে আগ্রহ জন্যে। কোরআন আল্লাহর কালাম বলেই এরূপ হয়ে থাকে।

নবম কারণঃ নবম কারণ হচ্ছে, কোরআন ঘোষণা করেছে যে, কোরআনের সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ্ গ্রহণ করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এর মধ্যে বিন্দুবিসর্গ পরিমাণ পরিবর্তন- পরিবর্ধন না হয়ে তা সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তা'আলা এ ওয়াদা এভাবে পূরণ করেছেন যে, প্রত্যেক যুগে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছিলেন এবং রয়েছেন, যারা কোরআনকে এমনভাবে স্বীয় স্মৃতিপটে ধারণ করেছেন যে, এর প্রতিটি যের-যবর অবিকৃত রয়েছে। নাযিলের সময় থেকে চৌদ্দ শতাধিক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও এ কিভাবে কোন পরিবর্তন- পরিবর্ধন পরিলক্ষিত হয়নি। প্রতি যুগেই স্ত্রী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কোরআনের হাফেজ
ছিলেন ও রয়েছেন। বড় বড় আলেমও যদি একটি যের-যবর বেশ কম করেন, তবে ছোট বাচ্চারাও তাঁর ভুল ধরে ফেলে। পৃথিবীর কোন ধর্মীয় কিতাবের এমন সংরক্ষণ ব্যবস্থা সে ধর্মের লোকেরা এক-দশমাংশও পেশ করতে পারবে না। আর কোরআনের মত নির্ভুল দৃষ্টান্ত বা নবীর স্থাপন করা তো অন্য কোন গ্রন্থ সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। অনেক ধর্মীয় গ্রন্থ সম্বন্ধে এটা স্থির করাও মুশকিল যে, এ কিতাব কোন্ ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তাতে কয়টি অধ্যায় ছিল।

গ্রন্থাকারে প্রতি যুগে কোরআনের যত প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অথচ ইতিহাস সাক্ষী যে, প্রতি যুগেই মুসলমানদের সংখ্যা কাফের-মুশরিকদের তুলনায় কম ছিল এবং প্রচার মাধ্যমও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদের তুলনায় কম ছিল। এতদসত্ত্বেও কোরআনের প্রচার ও প্রকাশের তুলনায় অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের প্রচার ও প্রকাশনা সম্ভব হয়নি। তারপরেও কোরআনের সংরক্ষণ আল্লাহ্ তা'আলা শুধু গ্রন্থ ও পুস্তকেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি, যা জ্বলে গেলে বা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেলে আর সংগ্রহ করার সম্ভাবনা থাকে না। তাই স্বীয় বান্দাগণের স্মৃতিপটেও সংরক্ষিত করে দিয়েছেন। খোদা-নাখান্তা সমগ্র বিশ্বের কোরআনও যদি কোন কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, তবু এ গ্রন্থ পূর্বের ন্যায়ই সংরক্ষিত থাকবে। কয়েকজন হাফেজ একত্রে বসে কয়েক ঘণ্টায় তা লিখে দিতে পারবেন। এ অদ্ভুত সংরক্ষণও আল-কোরআনেরই বিশেষত্ব এবং এ যে আল্লাহরই কালাম তার অন্যতম উজ্জ্বল প্রমাণ। যেভাবে আল্লাহ্র সত্তা সর্বযুগে বিদ্যমান থাকবে, তাতে কোন সৃষ্টির হস্তক্ষেপের কোন ক্ষমতা নেই, অনুরূপভাবে তাঁর কালাম সকল সৃষ্টির রদবদলের ঊর্ধ্বে এবং সর্বযুগে বিদ্যমান থাকবে। কোরআনের এই ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা বিগত চৌদ্দশ' বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এ প্রকাশ্য মু'জিযার পর কোরআন আল্লাহ্র কালাম হওয়াতে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় থাকতে পারে না ৷

দশম কারণঃ কোরআনে এলম ও জ্ঞানের যে সাগর পুঞ্জীভূত করা হয়েছে, অন্য কোন কিভাবে আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই সংক্ষিপ্ত ও সীমিত শব্দসম্ভারের মধ্যে এত জ্ঞান ও বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটেছে যে, তাতে সমগ্র সৃষ্টির সর্বকালের প্রয়োজন এবং মানবজীবনের প্রত্যেক দিক সম্পূর্ণভাবে আলোচিত হয়েছে। আর বিশ্ব পরিচালনার সুন্দরতম নিয়ম এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নির্ভুল বিধান বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া মাথার উপরে ও নিচে যত সম্পদ রয়েছে সে সবের প্রসঙ্গ ছাড়াও জীব-বিজ্ঞান, উদ্ভিদ-বিজ্ঞান এমনকি রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির সকল দিকের পথনির্দেশ সম্বলিত এমন সমাহার বিশ্বের অন্য কোন আসমানী কিতাবে দেখা যায় না ।

শুধু আপাতদৃষ্টিতে পথনির্দেশই নয়, এর নমুনা পাওয়া এবং সে সব নির্দেশ একটা জাতির বাস্তব জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়ে তাদের জীবনধারা এমনকি ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস এবং রুচিরও এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন দুনিয়ার অন্য কোন গ্রন্থের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে এমন নযীর আর একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা নিরক্ষর উম্মী জাতিকে জ্ঞানে, রুচিতে, সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে এত অল্পকালের মধ্যে এমন পরিবর্তন করে দেওয়ার নযীরও আর দ্বিতীয়টি নেই।

সংক্ষেপে এই হচ্ছে কোরআনের সেই বিস্ময় সৃষ্টিকারী প্রভাব, যাতে কোরআনকে আল্লাহর কালাম বলে প্রতিটি মানুষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। যাদের বুদ্ধি-বিবেচনা বিদ্বেষের কালিমায় সম্পূর্ণ কলুষিত হয়ে যায়নি, এমন লোকই কোরআনের এ অনন্যসাধারণ মু'জিযা সম্পর্কে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি প্রদান করতে কার্পণ্য করেনি। যারা কোরআনকে জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণ করেনি এমন অনেক অমুসলিম লোকও কোরআনের এ নযীরবিহীন মু'জিযার কথা স্বীকার করেছেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত মনীষী ডঃ মারড্রেসকে ফরাসী সরকারের পক্ষ থেকে কোরআনের বাষট্টিটি সূরা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর স্বীকারোক্তিও এ ব্যাপারে প্রণিধানযোগ্য । তিনি লিখেছেন, “নিশ্চয়ই কোরআনের বর্ণনাভঙ্গি সৃষ্টিকর্তার বর্ণনা- ভঙ্গিরই স্বাক্ষর। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোরআনে যেসব তথ্য বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্র বাণী ব্যতীত অন্য কোন বাণীতে তা থাকতে পারে না।”

এতে সন্দেহ পোষণকারীরাও যখন এর অনন্যসাধারণ প্রভাব লক্ষ্য করে, তখন তারাও এ কিতাবের সত্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। বিশ্বের সর্বত্র শতাধিক কোটি মুসলমান ছড়িয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে কোরআনের বিশেষ প্রভাব দেখে খ্রিস্টান মিশনগুলোতে কর্মরত সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, যেসব মুসলমান কোরআন বুঝে পড়ার সুযোগ লাভ করেছে, তাদের মধ্যে একটি লোকও ধর্মত্যাগী-মুরতাদ হয়নি।

যে যুগে মুসলমান কোরআনের সাথে অপরিচিত, এর শিক্ষা থেকে দূরে এবং এর তেলাওয়াত থেকে সম্পূর্ণভাবে গাফেল ছিল মুসলমানদের ওপর কোরআনের প্রভাবের কথা তারা সে যুগে স্বীকার করেছে। আফসোস, এ ভদ্রলোক যদি সে যুগটি দেখতেন, যাতে মুসলমানগণ জীবনের প্রতি পদক্ষেপে কোরআনের নির্দেশের প্রতি আমল করেছেন এবং মুখে মুখে কোরআন তিলাওয়াত করেছেন ।

অনুরূপভাবে অন্য একজন প্রসিদ্ধ লেখকও একই ধরনের স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। মিঃ উইলিয়াম ম্যুর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'লাইফ অব মুহাম্মদ'-এ পরিষ্কারভাবে তা স্বীকার করেছেন। আর ডক্টর শিবলী শামীল এ সম্বন্ধে একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধই রচনা করেছেন।

তাতে কোরআন আল্লাহর কালাম ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের জীবন্ত মু'জিযা হওয়া সম্পর্কে দশটি কারণ পেশ করা হয়েছে। সবশেষে আলোকপাত করা হয়েছে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন জন্মগত ইয়াতীম। সারা জীবনে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারেন নি। কোন বই-পুস্তক ও কাগজ-কলম তিনি হাতে নেন নি। এমনকি নিজের নামটুকু পর্যন্ত লিখতে পারতেন না। তাঁর স্বভাব এত শান্তিপ্রিয় ছিল যে, খেলাধুলা, রং-তামাশা, ঝগড়া-বিবাদে কোন দিনও যেতেন না। কবিতা বা কোন সাহিত্য সভায়ও তিনি যোগ দেন নি । কোন সভা-সমিতিতে কোন ভাষণও দেন নি। এমতাবস্থায় চল্লিশ বছর বয়সে যখন তিনি বয়সের শেষার্ধে উপনীত, যে সময় শিক্ষা লাভ করার বয়স শেষ হয়ে যায়, সে সময় তাঁর মুখ থেকে এমন সব কথা প্রকাশ পেতে থাকে যা অনন্য জ্ঞান-গরিমা এবং অসাধারণ ভাষা-শৈলীতে পরিপূর্ণ। যা কোন যুগপ্রবর্তক, কোন জ্ঞানী কিংবা অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভাসম্পন্ন লোকের পক্ষেও সম্ভব নয়। এসব কালাম দ্বারা তিনি আরবের বিশুদ্ধভাষী পণ্ডিতবর্গকেও চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যে, এটা আল্লাহ্র কালাম নয়, তবে এর একটি ছোট সূরার মত একটি সূরা রচনা করে দেখাও। কিন্তু তাঁর এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার ব্যাপারে আরব সমাজ বাস্তবিকপক্ষেই অপারগ ছিল।

সমগ্র জাতির যারা তাঁকে আল-আমীন উপাধিতে ভূষিত করেছিল এবং তাঁকে সম্মান করতো, এ কালামের প্রচারে অবতীর্ণ হবার পর সে সমস্ত লোকই তাঁর বিরোধী হয়ে যায়। এ কালামের প্রচার থেকে বিরত রাখার জন্য ধন-দৌলত, রাজত্ব এবং জাগতিক জীবনের যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ করারও ওয়াদা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি এর কোন একটিও গ্রহণ করেন নি সমগ্র জাতি তাকে এবং তাঁর সাহাবীগণকে অত্যাচার-উৎপীড়ন করতে উদ্যত হয়, আর তিনি তা অম্লান বদনে সহ্য করে নেন, কিন্তু এ কালামের তবলীগ ছাড়েন নি। জাতি তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছে, অবশেষে তাঁকে দেশ ত্যাগ করে মদীনায় চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তারা তাঁকে সেখানেও শান্তিতে থাকতে দেয়নি। সমগ্র আরববাসী মুশরিক ও আহলে-কিতাব তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে, পরবর্তী পর্যায়ে মদীনার উপর আক্রমণ করেছে। তাঁর শত্রুরা সব কিছুই করেছে, কিন্তু কোরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কোরআনের অনুরূপ ছোট একটি সূরা রচনা করে দেখানোর চেষ্টা করেনি। বরং যে পবিত্র ব্যক্তিত্বের প্রতি এ কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তিনিও এর নযীর নিজের পক্ষ থেকে পেশ করতে পারেন নি। তাঁর সমস্ত হাদীসই কোরআন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এরশাদ হয়েছে -

قَالَ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا إِنتِ بِقُرْآن غَيْرِ هَذَا أَوْبَدِّلَهُ قُلْ مَا يَكُونُ لي أَنْ أَبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاء نَفْسِي .

অর্থাৎ-যারা পরকালে আমার সাক্ষাৎ লাভের ব্যাপারে আগ্রহী নয়, তারা বলে-এরূপ অন্য আর একটি কোরআন রচনা করুন অথবা এর পরিবর্তন করুন। আপনি বলুন, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয় ।

একদিকে কোরআনের এ প্রকাশ্য মু'জিযা, যা এর আল্লাহর কালাম হওয়াই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, অপরদিকে এর বিষয়বস্তু, তথ্যাদি ও রহস্যসমূহের প্রতি লক্ষ্য করলে আরো আশ্চর্য হতে হয়।

কোরআন অবতরণের প্রথম যুগ তো এমনভাবে অতিবাহিত হয় যে, প্রকাশ্যে এ সব বাক্য পেশ করাও সম্ভব হয়নি। রসূলুল্লাহ্ (সা) গোপনে মানুষকে এর প্রতি আহবান জানাতে থাকেন। অতঃপর সীমাহীন গঞ্জনা ও বিরুদ্ধাচরণের মধ্যেও কিছুটা প্রকাশ্য প্রচার আরম্ভ করেন। তখন কোরআনের নির্ধারিত আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।

মদীনায় হিজরত করার পর মাত্র দশটি বছর তিনি সময় পান; যাকে মুসলমানদের জন্য স্বাধীন যুগ বলা চলে। এর ফলে কোরআনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা এবং আইন-কানুন প্রয়োগ করার চেষ্টা ও গঠনমূলক কিছু কাজ করার সুযোগ উপস্থিত হয়।

কিন্তু এ দশ বছরের ইতিহাস লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, প্রথম ছয় বছর শত্রুদের বিরামহীন হামলা, মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র এবং মদীনার ইহুদীদের চক্রান্ত প্রভৃতির মধ্যে যতটুকু সুযোগ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কোরআনের নির্দেশে এমন একটা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, যা আজও দুনিয়ায় কোন মুক্তিকামী মানব সমাজের জন্য সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য আদর্শ হয়ে আছে।

মুসলমানদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহ এ ছয় বছরে সংঘটিত হয়েছে। বদর, ওহুদ, আহযাব ইত্যাদি যুদ্ধ সবই এ ছয় বছরের মধ্যে সংঘটিত হয়। হিজরতের ষষ্ঠ বর্ষে দশ বছরের জন্য হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি লেখা হয়। আর মাত্র এক বছর আরবের কুজাইশগণ এ চুক্তির শর্তাদি পালন করে। এক বছর পরই তারা এ সন্ধিও ভঙ্গ করে ফেলে এবং পুনরায় যুদ্ধ-বিগ্রহ আরম্ভ করে।

প্রকৃতপক্ষে কোরআনকে বাস্তবায়ন করার পরিপূর্ণ সুযোগ রাসূল (সা) মাত্র দু'-এক বছরই পেয়েছিলেন। এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আশপাশের বড় বড় রাজা-বাদশাহের নিকট পত্র প্রেরণ করে তাদেরকে কোরআনের দাওয়াত দেন এবং কোরআনী জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। আর হুযূর (সা) তাঁর জীবনকাল পর্যন্ত এ স্বাধীনতার সুযোগ পান মাত্র চার বছর। এর মধ্যে মক্কা বিজয়ের জিহাদ উপস্থিত হয় এবং মক্কা জয় হয়।

এখন চার বছরের স্বল্প সময়কে সামনে রেখে কোরআনের প্রয়োগ ও প্রভাবের প্রতি লক্ষ্য করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন যে, সে সময় সমগ্র আরব উপদ্বীপের সর্বত্র কোরআনী আইন-কানুনের শাসন পরিচালিত হয়েছিল। একদিকে রোম এবং অপরদিকে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত এ কোরআনী শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উম্মী নিরক্ষর ছিলেন। তাঁর জাতি ছিল এমনই এক জনগোষ্ঠী, যারা কোনদিন কোন কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থা কিংবা কোন রাজা-বাদশাহর শাসন মেনে চলেনি। তাছাড়া সমগ্র দুনিয়া ছিল বিরুদ্ধাচরণে কৃতসংকল্প। আরবের মুশরিক এবং ইহুদী-নাসারাগণ তাঁর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। এসব কথা বাদ দিয়ে ধরা যাক যে, যদি কোন প্রকার বিরুদ্ধাচরণ নাও হতো, যদি সমস্ত লোক বিনা বাক্যব্যয়ে কোরআন ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের শিক্ষাকে সর্বান্তকরণে মেনে নিতো, তবুও একটা নতুন দর্শন, নতুন জীবন বিধান, আইন-কানূন, নিয়ম-পদ্ধতি প্রথমে সংকলন করা, এর প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে জনগণকে ওয়াকেফহাল করা এবং তৎপর সে নিয়ম-নীতির আলোকে একটি আদর্শনিষ্ঠ নতুন জাতির গোড়াপত্তন করা আর সে জাতিকে একটা পরিপূর্ণ আদর্শবাদী জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করার জন্য কত সময়, জনবল, অর্থ ও আনুষঙ্গিক উপাদানাদির প্রয়োজন হতো। সেরূপ সুযোগ-সুবিধা কিংবা উপায়-উপকরণ কি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরামের আয়ত্তাধীন ছিল? সম্পূর্ণ উচ্ছৃঙ্খল এবং আইনের শাসন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ একটা জাতিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ একটা সভ্য জনসমাজে রূপান্তরিত করা এবং পরিপূর্ণভাবে সে বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে সুসংহত করার মত কোনরূপ জাগতিক উপকরণের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাতে নযীরবিহীন সাফল্য একথাই প্রমাণ করে যে, একমাত্র আল্লাহ্র অপার অনুগ্রহের দ্বারাই এমনটি সম্ভবপর হয়েছিল। আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ বিধান কোরআনের এই দাওয়াত আল্লাহরই বিশেষ কুদরতে এমন অবিশ্বাস্যভাবে আরব সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল।

কোরআনের অনন্যসাধারণ মু'জিযা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। যুগে যুগে বিভিন্ন ভাষায় এ বিষয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

সর্বপ্রথম হিজরী তৃতীয় শতকে আল্লামা জাহিব এ বিষয়ের উপর 'নমুল কোরআন' নামে একটি বিস্তারিত গ্রন্থ রচনা করেন। অতঃপর হিজরী চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে আবদুল্লাহ্
ওয়াসেতী 'এ'জাযুল-কোরআন' নামে আর একটি অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন। একই শতাব্দীতে ইবনে ঈসা রাব্বানী 'এ'জাযুল-কোরআন' নামে আর একটা ছোট পুস্তিকা রচনা করেন। কাজী আবূ বকর বাকিরানী হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে 'এ'জাযুল-কোরআন' নামে একটি বিস্তারিত গ্রন্থ রচনা করেন।

এতদ্ব্যতীত আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র) 'আল-এতকান' এবং 'খাসায়েসে-কুবরা' নামে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী তফসীরে কবীরে এবং কার্যী আয়ায 'শেফা' নামক গ্রন্থে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন ।

আধুনিককালে মুস্তফা সাদেক রাফেয়ীর 'এ'জাযুল-কোরআন' এবং আল্লামা রশীদ রেযা মিসরীর 'আল্ওয়াহুয়্যাল মুহাম্মদী' এ বিষয়ের ওপর রচিত অত্যন্ত মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ । উর্দু ভাষায় আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রচিত 'এ'জাযুল কোরআন' নামক পুস্তিকাটিও এ বিষয়ে একটা অনবদ্য সংযোজন।

এটাও কোরআনের আর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য যে, এর এক একটি বিষয় সম্পর্কে তফসীর গ্রন্থ ছাড়াও এত বেশি কিতাব রচিত হয়েছে, যার নবীর অন্য কোন কিতাবের বেলায় খুঁজে পাওয়া যায় না ।

মোটকথা, কোরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথাযোগ্য বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব না হলেও সংক্ষিপ্তভাবে যতটুকু বলা হলো, এতেই সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, কোরআন আল্লাহ্রই কালাম এবং রাসূল মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের একটি সর্বশ্ৰেষ্ঠ মু'জিযা।

কোরআন নিয়ে কিছু সন্দেহ ও তার জবাব

কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন, এমনও তো হতে পারে যে, কোরআনের মোকাবিলায় সে যুগে কিছু কিছু গ্রন্থ কিংবা অনুরূপ কোন গ্রন্থের অংশবিশেষ রচিত হয়েছিল, কিন্তু কালের ব্যবধানে সেগুলো আর শেষ পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকতে পারেনি ! কিন্তু, যদি সামান্য ন্যায়-নীতির প্রতি আস্থা রেখেও চিন্তা করা যায়, তবে এ ধরনের কোন সন্দেহেরও অবকাশ থাকে না। কেননা, সকলেই জানেন যে, কোরআন যখন নাযিল হয়, তখন কোরআনকে মান্য করার মত লোকের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। অপরদিকে যারা কোরআনকে স্বীকার করতো না, অধিকন্তু সর্বশক্তি নিয়োগ করে এর বিরুদ্ধাচরণ করাই তাদের সর্বাপেক্ষা বড় জাতীয় এবং ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করতো, তাদের সংখ্যার কোন অভাব ছিল না। এতদ্ব্যতীত সূচনাকাল থেকেই কোরআনের অনুসারিগণের হাতে প্রচারমাধ্যম এবং মুদ্রণ-প্রকাশনার সুযোগ- সুবিধা ছিল নিতান্তই কম। এ অবস্থায়ও যখন কোরআনের চ্যালেঞ্জের কথা উচ্চারিত হতে থাকলো, তখন কোরআনের দৃশমনরা এ আওয়াজকে বাধা দেওয়ার জন্য বিরুদ্ধবাদী সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে, রক্ত দিয়েছে, জান-মালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এমতাবস্থায় কোরআনের চ্যালেঞ্জের জবাবে যদি কেউ কোন গ্রন্থ বা তার সূরার অনুরূপ কোন রচনা পেশ করতে সমর্থ হতো, তবে বিরুদ্ধবাদীরা যে কতটুকু আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে তা গ্রহণ করতো এবং সর্বতোভাবে তা প্রচার করতে সচেষ্ট হতো, তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, অনুরূপ কোন গ্রন্থের সন্ধান আজ পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। অধিকন্তু কোন যুগে যদি কোরআনের অনন্য মর্যাদাকে খাটো করে এর মোকাবিলায় কোন রচনা পেশ করা হতো, তবে সে গ্রন্থ রচনার অসারতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে মুসলিম আলিমগণও অনেক জবাবী কিতাব অবশ্যই রচনা করতেন। কিন্তু এ শ্রেণীর কোন কিতাবের সন্ধানও কোথাও পাওয়া যায়নি।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইয়ামান-এর মুসায়লামাতুল কায্যাবের ঘটনা ইতিহাসে উল্লিখিত রয়েছে। তাতে জানা যায়, কোরআনের মোকাবিলা করার ব্যর্থ চেষ্টায় অবতীর্ণ হয়ে গদ্য-পদ্যের সংমিশ্রণে সে কিছু বাক্য অবশ্য রচনা করেছিল। কিন্তু সেগুলোর পরিণতি কি হয়েছিল, তা কারো অজানা নয়। তার কওমের লোকেরাই সেগুলো তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছিল। অধিকন্তু তার রচিত সেই বাক্যগুলো ছিল এতই অশ্লীল, যা কোন রুচিবান মানুষের সামনে উদ্ধৃতও করা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসায়লামাহ্ কায্যাব রচিত সেসব বাক্য বিভিন্ন কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে। আজো পর্যন্ত তার প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সেগুলো উদ্ধৃত করা হয়। সুতরাং যদি কোরআনের মোকাবিলায় মহৎ কোন রচনার অস্তিত্ব থাকতো, তবে তাও নিশ্চয়ই ইতিহাসে কিংবা আরবী সাহিত্যের ধারা বর্ণনায় সংরক্ষিত হতো। অন্তত কোরআন বিরোধীদের প্রচেষ্টায় সেসব কালামের প্রচার ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা অবশ্যই হতো।
যেসব লোক কোরআনের বিরুদ্ধাচরণ করার ব্যাপারে সর্বক্ষণ নিয়োজিত থাকতো, তাদের অনেক সন্দেহ-সংশয়ের কথা খোদ কোরআনেই উল্লিখিত হয়েছে এবং সাথে সাথে জবাবও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমন একটা ঘটনারও সন্ধান পাওয়া যায় না, যাতে কোন কালাম কোরআনের মোকাবিলায় কেউ পেশ করেছে।

রোম দেশীয় একজন ক্রীতদাস মদীনায় কামারের কাজ করতো। তওরাত এবং ইনজীল সম্পর্কে তার কিছু কিছু জ্ঞান ছিল। সে মাঝে মাঝে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দরবারে যাতায়াত করতো। এ সূত্র ধরেই বিরুদ্ধবাদীরা প্রচার করে দিল যে, রসূলুল্লাহ্ (সা) এ গোলামের মুখে তওরাত-ইনজীলের কথা শুনে নিয়ে তাই কোরআনের নামে প্রচার করেছেন। খোদ কোরআন শরীফেই এ অপপ্রচারের কথা উল্লেখ করে জবাব দেওয়া হয়েছে-“যে ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে তোমরা এমন অমূলক প্রচারণায় অবতীর্ণ হয়েছ, সে তো একজন অনারব; সে ব্যক্তির পক্ষে কি কোরআনের অনুরূপ ভাষাশৈলী আয়ত্ত করা এবং প্রকাশ করা সম্ভব ?” সূরায়ে নাহলের ১০৩ আয়াত দ্রষ্টব্য।

لسان الذي يلحدون اليهِ أَعْجَمِي وهذا لسان عربي مبين .

অর্থাৎ - ইসলামের দুশমনেরা যা বলে তাদের সে বক্তব্য আমাদের জানা আছে-“এ কোরআন আপনাকে এক ব্যক্তি শিখিয়ে দেয়, অথচ যে লোকের প্রতি এ বিষয়টিকে জড়িত করে, সে হচ্ছে অনারব-আজমী। আর কোরআন হলো একটা একান্ত অলঙ্কারপূর্ণ ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষার কালাম।”

অনেকে কোরআন সম্পর্কে বলেছে- وَلَنْ يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا অর্থাৎ -আমরাও ইচ্ছা করলে কোরআনের অনুরূপ কালাম বলতে পারতাম ।

কিন্তু তাদের কাছে জিজ্ঞাসা যে, তাহলে ইচ্ছাটা করই না কেন ? কোরআনের মোকাবিলায় গোটা শক্তি তো নিয়োগ করলেই- জানমাল পর্যন্ত বিসর্জন দিলে। যদি কোরআনের মত কোন কালাম লেখার বা বলার সামর্থ্য তোমাদের থাকে, তাহলে কোরআনের চ্যালেঞ্জের উত্তরে এর মত একটা কালাম তৈরি করে বিজয়ের শিরোপাটা নিয়েই নাও না কেন ?

সারকথা, কোরআনের এ দাবির বিরোধীরা যে একান্ত ভদ্রজনোচিত নীরবতা অবলম্বন করেছেন তাই নয়, বরং তার মোকাবিলায় যা কিছু তাদের মুখ থেকে বেরিয়েছে তাই বলেছে। কিন্তু তথাপি একথা কেউ বলেনি যে, আমাদের মধ্যে অমুক ব্যক্তি কোরআনের মত অমুক কালামটি রচনা করেছে-কাজেই কোরআনের এ স্বাতন্ত্র্যের দাবিটি (নাউযুবিল্লাহ্) ভুল।

“হুযূর আকরাম (সা) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে সামান্য কয়েক দিনের জন্য শাম দেশে তশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন পথে পাদ্রী বুহায়রার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। বুহায়রা ছিলেন তাওরাতের বিজ্ঞ পণ্ডিত। কোন কোন বিদ্বেষবাদীর এমন দুর্মতিও হয়েছে যে, তাদের মতে তিনি নাকি --তারই কাছে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাদের কাছে জিজ্ঞাসা যে, একদিনে এবং একবারের সাক্ষাতে তার কাছ থেকে এ সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান, ভাষার অলঙ্কার শৈলী, অকাট্যতা, চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, বৈষয়িক ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেমন করে শিখে নিতে পারলেন ?

ইদানীংকালে কোন কোন লোক প্রশ্ন তুলেছে যে, কোন কালামের অনুরূপ কালাম তৈরি করতে না পারাটাই তার আল্লাহর কালাম বা মু'জিযা হওয়ার প্রমাণ হতে পারে না। এমনও তো হতে পারে যে, কোন বিজ্ঞ অলঙ্কারশাস্ত্রবিদ গদ্য কিংবা পদ্য লিখবেন, যার অনুরূপ রচনা অপর কারো পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।

সা'দী শীরাযীর 'গুলেস্তা', ফয়যীর 'নোক্তাবিহীন তফসীর' প্রভৃতিকে অদ্বিতীয় গ্রন্থ বলা হয়। তাই বলে এগুলো কি কোন মু'জিযা ?

কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, সা'দী এবং ফয়যীর কাছে জ্ঞানার্জন ও রচনার কত বিপুল উপকরণ উপস্থিত ছিল, কত সময় ধরে তাঁরা জ্ঞানার্জন করেছিলেন। বছরের পর বছর তাঁরা মাদ্রাসা বা শিক্ষায়তনে পড়ে রয়েছেন, রাতের পর রাত জেগেছেন, যুগের পর যুগ পরিশ্রম করেছেন, বড় বড় আলিম-উলামার দরবারে হাঁটু গেড়ে বসে কাটিয়েছেন। বছরের পর বছর পরিশ্রম আর মাথাকুটার পর যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, ফরবী ফারসী ভাষায় এবং মিল্টন ইংরেজী ভাষায় কিংবা হোমার গ্রীক ভাষায় অথবা কালীদাস সংস্কৃতে এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে, তাদের রচনা অন্যদের রচনা অপেক্ষা বহু উন্নত, তথাপি তা আশ্চর্যের বিষয় মোটেই নয়।

মু'জিযার সংজ্ঞা হলো এই যে, তার প্রচলিত নিয়ম-রীতি ও উপায়-উপকরণের মাধ্যম ব্যতিরেকে অস্তিত্ব লাভ করবে। কিন্তু উল্লিখিত মনীষীবৃন্দের যথারীতি জ্ঞানার্জন, উস্তাদ-শিক্ষকদের সাথে সুদীর্ঘকালের সম্পর্ক, বিস্তৃত অধ্যয়ন, দীর্ঘকালের অনুশীলন কি তাদের জ্ঞানের পরিপক্বতা কিংবা অভিজ্ঞতার প্রকৃষ্ট উপকরণ ছিল না। তাদের কালাম যদি অন্যদের তুলনায় অনন্য হয়ে থাকে, তাহলে তাতে বিস্ময়ের কি থাকতে পারে? অবশ্যই যে লোক কোন দিন কাগজ-কলম, বই-পুস্তক স্পর্শ করেও দেখেন নি, কোন মক্তব-মাদ্রাসার ধারে-কাছেও যান নি, তিনি যদি পৃথিবীর সামনে এমন কোন কালাম তুলে ধরেন, হাজারো সা'দী আর লাখো ফয়েবী যাতে আত্মবিসর্জন দেওয়াকে গর্ব বলে মনে করে এবং নিজেদের জ্ঞান-গরিমাকে তারই অবদান বলে মেনে নেয়, তবে বিস্ময়ের বিষয় সেটাই। তাছাড়া সা'দী কিংবা ফয়েযীর কালামের মত কালাম উপস্থাপন করার প্রয়োজন বা কি থাকতে পারে? তাঁরা কি নবূয়তের দাবি করেছেন । তাঁরা কি নিজেদের কালামের বৈশিষ্ট্যকে নিজেদের মু'জিযা বলে দাবি করেছেন ? কিংবা গোটা বিশ্বকে কি তারা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে, আমাদের কালামের সমতুল্য কোন কালাম উপস্থাপন করা কারো পক্ষে সম্ভব হতে পারে না, যার ফলে মানুষ সেগুলোর মোকাবিলা কিংবা সামঞ্জস্যপূর্ণ কালাম উপস্থাপনে বাধ্য ছিল।

তদুপরি কোরআনের ভাষা ও অলঙ্কার; বাকশৈলী আর বিন্যাস ও গ্রন্থনাই যে অনন্য তাই নয়, বরং মানুষের মন-মস্তিষ্কে এর যে প্রভাব তা আরও বিস্ময়কর নযীরবিহীন। যার ফলে সমকালীন জাতি ও সম্প্রদায়গুলোর মন-মস্তিষ্কই বদলে গেছে। মানব চরিত্রের মূল কাঠামোই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আরবের অমার্জিত বেদুঈনরা তারই দৌলতে চরিত্র ও নৈতিকতা এবং জ্ঞান-অভিজ্ঞতায় বিদগ্ধ হয়ে উঠেছিল।

কোরআন সম্পর্কে অমুসলিম মনীষীদের মন্তব্য

তার এই বিস্ময়কর বৈপ্লবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বীকৃতি শুধু মুসলিমরাই দেননি, বরং বর্তমান বিশ্বের অসংখ্য অমুসলিম মনীষীও দিয়েছেন। এ সম্পর্কিত ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের নিবন্ধসমূহ একত্র করলে একটা বিরাট গ্রন্থ সংকলিত হতে পারে। আর হাকীমুল উম্মত হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানভী (র) এ প্রসঙ্গে 'শাহাদাতুল আওয়াম আলা সিদ্‌কিল ইসলাম' নামে একখানি গ্রন্থও রচনা করেছেন। এখানে তারই কয়টি উদ্ধৃতি তুলে দেওয়া হচ্ছেঃ

ডঃ গোস্তাগুলি তাঁর 'আরব সংস্কৃতি' নামক গ্রন্থে এ বিষয়ের স্বীকৃতি নিম্নরূপ বক্তব্যের মাধ্যামে দিয়েছেনঃ
“ইসলামের সে পয়গম্বর নবীয়ে উম্মীরও একটি উপাখ্যান রয়েছে যার আহবান গোটা একটি মূর্খ জাতিকে, যারা তখন পর্যন্তও কোন রাষ্ট্রের আওতায় আসেনি, জয় করে নিয়েছিল এবং এমন এক পর্যায়ে তাদের উঠিয়ে দিয়েছিল, যাতে তারাই বিশ্বের বিরাট বিরাট সাম্রাজ্যকে তছনছ করে দেয়। এখনও সেই নবীয়ে উম্মীই আপন সমাধির ভেতর থেকে লাখো আদম-সন্তানকে ইসলামের বাণীতে বদ্ধমূল করে রেখেছেন।”

মিঃ গুডওয়েল যিনি নিজ ভাষায় কোরআনের অনুবাদও করেছেন, লিখেছেনঃ
“আমরা যতই এ গ্রন্থকে (অর্থাৎ কোরআনকে) উল্টে-পাল্টে দেখি, প্রথম অধ্যয়নে তার প্রতি যে অনীহা থাকে, সেগুলোর উপর নব নব প্রক্রিয়ার প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু সহসাই সেগুলো আমাদের বিস্মিত করে, আকৃষ্ট করে নেয় এবং আমাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায় করে ছাড়ে। এর বর্ণনাভঙ্গি, এর বক্তব্য ও উদ্দেশ্যের তুলনায় অনেক স্বচ্ছ, মার্জিত, মহৎ ও দীক্ষাপূর্ণ । তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এর বক্তব্য সুউচ্চ শীর্ষে দিয়ে আরোহণ করে। সারকথা, এ গ্রন্থ সর্বযুগে নিজের শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে।” (শাহাদাতুল আকওয়াম, পৃ. ১৩)

মিসরের প্রখ্যাত লেখক আহমদ ফাতহী বেক্ যাগলুল ১৮৯৮ খৃস্টাব্দে মিঃ কাউন্ট হেজভীর গ্রন্থ 'দি ইসলাম'-এর অনুবাদ আরবী ভাষায় প্রকাশ করেন। মূল গ্রন্থটি ছিল ফরাসী ভাষায়। এতে মিঃ কাউন্ট কোরআন সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন :
“বিশ্বয়ের বিষয় এই যে, এ ধরনের কালাম এমন একজন লোকের মুখ দিয়ে কেমন করে বেরুতে পারে, যিনি ছিলেন একান্তই নিরক্ষর। সমগ্র প্রাচ্য স্বীকার করে নিয়েছে যে, গোটা মানবজাতি শব্দগত ও মর্মগত উভয় দিক দিয়েই এর সামঞ্জস্য উপস্থাপনে সম্পূর্ণ অক্ষম। এটা সে কালাম, যার রচনাশৈলী উমর ইবনে খাত্তাবকে অভিভূত করে দিয়েছিল, যাতে তিনি আল্লাহ্র অস্তিত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটা সেই বাণী যখন ইয়াহ্ইয়া (আ)-এর জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে এতে বর্ণিত বাক্যগুলো হযরত জাফর ইবনে আবী তালিব আবিসিনিয়ার সম্রাটের দরবারে আবৃত্তি করেন, তখন তাঁর চোখগুলো একান্ত অজান্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে এবং তাঁর দরবারে উপস্থিত বিশপও এই বলে চিৎকার করে ওঠেন, 'এ বাণী সেই উৎসমূল থেকেই নিঃসৃত, যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল ঈসা (আ)-এর বাণীসমূহ।” (শাহাদাতুল আওয়াম, পৃ. ১৪)

এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটেনিকার ১৬তম খণ্ডের ৫৯৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছেঃ “কোরআনের বিভিন্ন অংশের মর্ম অপর অংশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অনেক আয়াত ধর্মীয় ও নৈতিক ধারণাসম্বলিত, অলৌকিক নিদর্শনাবলী, ইতিহাস, নবীদের প্রতি আগত আল্লাহ্র বাণী প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহর মহত্ত্ব, অনুগ্রহ ও সভ্যতার স্মারক হিসেবে পেশ করা হয়েছে। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে আল্লাহকে এক ও সর্বশক্তিমান বলে প্রকাশ করা হয়েছে। পৌত্তলিকতা ও ব্যক্তি উপাসনাকে স্বার্থহীনভাবে না-জায়েয বা অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। কোরআন সম্পর্কে একথা একান্তই যথার্থ যে, তা সমগ্র বিশ্বে বর্তমান গ্রন্থরাজির মধ্যে সর্বাধিক পঠিত হয়।”

ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মিঃ গীবন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "রোম সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন'-এর ৫ম খণ্ড, ৫০তম পরিচ্ছেদে লেখেনঃ
“আটলান্টিক মহাসাগর থেকে শুরু করে গঙ্গা অববাহিকা পর্যন্ত এলাকায় একথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, কোরআন সংসদ বা পার্লামেন্টের প্রাণ ও মৌলিক বিধান। তাছাড়া শুধু ধর্মীয় নীতিমালাই নয় বরং সে সমস্ত শাস্তিমূলক বিধান ও সাধারণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে 'তারই উপর নির্ভর করা হয়, যার সাথে মানব জীবন একান্তভাবে জড়িত এবং যা মানুষের প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। প্রকৃতপক্ষে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শরীয়ত সর্বক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। এ শরীয়ত এমন সুবিবেচিত রীতি-নীতি এবং এমনই সাংবিধানিক ধারায় বিন্যস্ত যে, সমগ্র বিশ্বে তার কোন তুলনা পাওয়া যাবে না।”

এখানে ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের বক্তব্য ও স্বীকৃতিসমূহের সমালোচনা উদ্দেশ্য নয়, বরং উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি উদ্ধৃতি দেওয়াই উদ্দেশ্য, যাতে প্রমাণিত হয় যে, ভাষার অলঙ্কার এবং বাকশৈলীর দিক দিয়ে উদ্দেশ্য ও বক্তব্য হিসাবে অথবা জ্ঞান ও অভিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোরআনের অনন্যতা ও অনুপমতার স্বীকৃতি শুধু মুসলমানরাই নয়, বরং সর্বযুগের অমুসলমান লেখকরাও দিয়েছেন।

কোরআন সমগ্র বিশ্বকে নিজের মত কোন কালাম উপস্থাপন করার জন্য চ্যালেঞ্জ করেছিল, কিন্তু তা কারও পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। আজও মুসলমানরা সমগ্র বিশ্বের জ্ঞানী-বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারে যে, গোটা বিশ্বের ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা দেখিয়ে দিন, যাতে একজন মহা-দার্শনিকের উদ্ভব হয়েছে এবং তিনি সমগ্র বিশ্বের বিশ্বাস ও চিন্তাধারা এবং প্রচলিত রীতি-নীতির বিরুদ্ধে কোন নতুন ব্যবস্থা উপস্থাপন করেছেন আর তাঁর সম্প্রদায়ও ছিল তেমনি গেঁয়ো অর্বাচীন, অথচ তিনি এত অল্প সময়ে তাঁর শিক্ষাকে এ হেন ব্যাপকতা দান করতে পেরেছেন এবং তার কার্যকারিতাকেও এতটা বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছেন যে, তার কোন উদাহরণ আজকের সুদৃঢ়' ও 'সুসংহত' ব্যবস্থাসমূহে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

পৃথিবীর তৎকালীন ইতিহাসে যদি তার কোন নবীর না-ও থেকে থাকে, কিন্তু সমকালের আলোকোজ্জ্বল, উন্নত ও প্রগতিসম্পন্ন জগতেরই না হয় কেউ তেমনটি উপস্থাপন করে দেখাক একা সম্ভব না হলে স্বীয় জাতি, সম্প্রদায়, তথা সমগ্র বিশ্ব-সম্প্রদায়কে নিয়ে হলেও এমন একটি উদাহরণ পেশ করুন।

فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ والحجارة أعدت للكفرين .

অর্থাৎ “তোমরা যদি তার উদাহরণ পেশ করতে না পার, আর তোমরা তা কস্মিনকালেও পারবে না, তাহলে সে দোযখের আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর। যা তৈরি করা হয়েছে অস্বীকারকারী কাফিরদের জন্য। "





*******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url