সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৬৯ || বদর যুদ্ধ সম্পর্কে কুরআনের পর্যালোচনা || বদর যুদ্ধের বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী ||
সিরাতুন নবী (সাঃ) ৬৯-তম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ
বদর যুদ্ধে বন্দীদের সম্বন্ধে পরামর্শ
মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদের সঙ্গে বন্দীদের ব্যাপারে পরামর্শ করেন। আবূ বকর (রাঃ) নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এরা সবাই আমাদের চাচাত ভাই, বংশীয় লোক এবং আত্মীয়। আমার মতে মুক্তিপণ হিসেবে কিছু কিছু অর্থ নিয়ে এদেরকে মুক্তি দেয়া উচিত। এতে আমাদের সাধারণ তহবিল যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে অল্প দিনের মধ্যে এদের সবার পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করাও সম্ভব হবে। তখন তাদেরকে আমাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে আমরা ব্যবহার করতে পারব।
তারপর নবী করীম (ﷺ) খাত্তাবের পুত্রকে (উমার (রাঃ)) সম্বোধন করে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র, তোমার অভিমত কী? উত্তরে উমার (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এ ব্যাপারে আমি আবূ বকরের সঙ্গে একমত হতে পারছিনা। আমার মত হচ্ছে যে, অমুককে (যিনি উমারের আত্মীয় ছিলেন) আমার হাওয়ালা করে দেন, আমি তাকে হত্যা করি। আকীল বিন আবি তালেবকে আলীর হাওয়ালা করে দিন। তিনি তাকে হত্যা করবেন এবং অমুককে (যিনি হামযাহর ভাই ছিলেন) হামযাহর হালওয়ালা করে দিন, তিনি তাকে হত্যা করবেন। যাতে করে আল্লাহ এটা বোঝেন যে, আমাদের অন্তরে মুশরিকদের সম্পর্কে কোন প্রকার দুর্বলতা নেই। আর এরা ছিল মুশরিকদের সার্বক্ষণিক অগ্রণী নেতা। এরা ইসলামের চির শত্রু এবং মুসলিমদের প্রাণের বৈরী। আমাদেরকে নির্যাতিত করতে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করতে এবং আল্লাহর সত্য ধর্মকে জগতের পৃষ্ঠ হতে মুছে ফেলতে এরা সাধ্যপক্ষে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। এরা অন্যায়, অধর্ম ও অত্যাচারের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। এদেরকে অবিলম্বে হত্যা করে ফেলা হোক। প্রত্যেক মুসলিম উলঙ্গ তরবারী হাতে দন্ডায়মান হোক এবং নিজ হাতে নিজের আত্মীয়বর্গের মুন্ডপাত করুক, আমার এটাই মত।’
উমার (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বকর (রাঃ)-এর মতকেই পছন্দ করলেন, আমার মতকে পছন্দ করলেন না। সুতরাং বন্দীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ নেয়ার সিন্ধান্ত গৃহীত হলো। পরের দিন আমি সকাল সকাল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বকর (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির হলাম। দেখি যে, তাঁরা দুজনই ক্রন্দন করছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলুন, আপনারা কেন কাঁদছেন? যদি ক্রন্দনের কোন কারণ থাকে তাহলে আমিও ক্রন্দন করব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরে বললেন ‘মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে তোমার সঙ্গীদের উপর যে জিনিস পেশ করা হয়েছে সে কারণেই কাঁদছি।’ আর তিনি নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আমার সামনে তাদের শাস্তিকে এ গাছের চেয়েও বেশী নিকটবর্তীরূপে পেশ করা হয়েছে।’ তারপর আল্লাহ তা‘আলা নিম্নলিখিত আয়াত নাযিল করেন,
(مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتّٰى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ لَّوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ) [الأنفال:67، 68]
‘‘কোন নবীর জন্য এটা সঠিক কাজ নয় যে, দেশে (আল্লাহর দুশমনদেরকে) পুরোমাত্রায় পরাভূত না করা পর্যন্ত তার (হাতে) যুদ্ধ-বন্দী থাকবে। তোমরা দুনিয়ার স্বার্থ চাও আর আল্লাহ চান আখিরাত (এর সাফল্য), আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী। - আল্লাহর লেখন যদি পূর্বেই লেখা না হত তাহলে তোমরা যা (মুক্তিপণ হিসেবে) গ্রহণ করেছ তজ্জন্য তোমাদের উপর মহাশাস্তি পতিত হত।’ (আল-আনফাল ৮ : ৬৭-৬৮)
আল্লাহর পক্ষ থেকে আগেই যে নির্দেশ এসেছিল তা হল:
(فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء)
‘অতঃপর তখন হয় অনুকম্পা; নয় মুক্তিপণ’। (মুহাম্মাদ : ৪ আয়াত)
যেহেতু এ বিধানে বন্দীদের নিকট হতে মুক্তিপণ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেহেতু মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে সাহাবীগণ (রাঃ)-কে শাস্তি দেয়া হয়নি, বরং তাদেরকে শুধু তিরস্কার ও নিন্দা করা হয়েছে যে, ভালোভাবে কাফেরদেরকে উত্তম মাধ্যম দেয়ার আগেই বন্দী করে নিয়েছিলেন এবং এ জন্যও যে, তাঁরা এমন যুদ্ধ অপরাধীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করেছিলেন যারা বড় অপরাধী ছিল, যাদের উপর আধুনিক আইনও মুকদ্দমা না চালিয়ে ছাড়ত না, এদের মুকদ্দমার ফায়সালাও সাধারণত মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতো।
যা হোক, আবূ বকর (রাঃ)-এর অভিমত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল বলে মুশরিকদের নিকট হতে মুক্তিপণ গৃহীত হয়। মুক্তিপণের পরিমাণ চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত ছিল। মক্কাবাসীগণ লেখা পড়াও জানত, পক্ষান্তরে মদীনাবাসীগণ লেখাপড়া জানত না বললেই চলে। এ জন্যে এ সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছিল যে, যে মুক্তিপণ দিতে অসমর্থ হবে সে মদীনার দশজন ছেলেকে লেখাপড়া শিখাবে। যখন এ ছেলেগুলো উত্তমরূপে লেখাপড়া শিখে নিবে তখন এটাই তার মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কয়েকজন বন্দীর উপর অনুগ্রহও করেছেন এবং তাদেরকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্ত করে দিয়েছেন। এ তালিকায় মুত্তালিব ইবনু হানতাব, সাইফী ইবনু আবী রিফাআহ এবং আবূ ইযযাহ জুমাহীর নাম পাওয়া যায়। শেষের দুজনকে উহুদের যুদ্ধে বন্দী ও হত্যা করা হয়। (বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসছে)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় জামাতা আবুল আসকেও বিনা মুক্তিপণে এ শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে তার কন্যা যায়নাব (রাঃ)-এর পথ রোধ করবে না। এর কারণ এই ছিল যে, যায়নাব (রাঃ) আবুল আসের মুক্তিপণ হিসেবে কিছু মাল পাঠিয়েছিলেন যার মধ্যে একটি হারও ছিল। এ হারটি প্রকৃত পক্ষে খাদীজাহ (রাঃ)-এর ছিল। যায়নাব (রাঃ)-কে আবুল আসের নিকট বিদায় দেয়ার সময় তিনি তাকে এ হারটি প্রদান করেছিলেন। হারটি দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মধ্যে ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়। তাই, তিনি সাহাবীদের (রাঃ) নিকট অনুমতি চান যে, আবুল আসকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্ত করে দেয়া হোক। সাহাবীগণ সন্তুষ্টচিত্তে এটা মেনে নেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবুল আসকে এ শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে যায়নাব (রাঃ)-এর পথরোধ করতে পারবে না। এ শর্তানুসারে আবুল আস তাঁর পথ ছেড়ে দেয় এবং যায়নাব (রাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) এবং একজন আনসারী সাহাবী (রাঃ)-কে এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা বাতনে ইয়াজিজ নামক স্থানে অবস্থান করবেন, যায়নাব (রাঃ) তাদের পাশ দিয়ে গমনকালে তাঁরা তাঁর সাথী হয়ে যাবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এ নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা দুজন যায়নাব (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। যায়নাব (রাঃ)-এর হিজরতের ঘটনাটি খুবই দীর্ঘ ও হৃদয়বিদারক।
বন্দীদের মধ্যে সুহায়েল ইবনু ‘আমরও ছিল। সে ছিল বড় বাকপটু ভাল বক্তা। উমার (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সুহায়েল ইবনু আমরের সামনের দাঁত দুটি ভেঙ্গে দেয়া হোক, যাতে সে কোন জায়গায় বক্তা হয়ে আপনার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে না পারে।’ কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। কেননা এটা মুসলাহ (নাক, কান কর্তিত) এর অন্তর্ভুক্ত। যার কারণে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে পাকড়াও এর আশঙ্কা থাকবে।
সা‘দ ইবনু নু’মান (রাঃ) উমরাহ করার জন্যে বের হলে আবূ সুফইয়ান তাকে বন্দী করে ফেলেন। আবূ সুফইয়ানের পুত্র ‘আমরও বদরযুদ্ধে বন্দীদের একজন ছিল। ‘আমরকে আবূ সুফইয়ানের নিকট পাঠিয়ে দিলে তিনি সা‘দ (রাঃ)-কে ছেড়ে দেন।
বদর যুদ্ধ সম্পর্কে কুরআনের পর্যালোচনা
এ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরাহ আনফাল অবতীর্ণ হয়। প্রকৃতপক্ষে এ সূরাহটি এ যুদ্ধের উপর আল্লাহ প্রদত্ত এক বিশদ বর্ণনা। আর আল্লাহ তা‘আলার এ বর্ণনা বাদশাহ ও কমান্ডারদের বিজয় বর্ণনা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। এ বিশদ বর্ণনার কয়েকটি কথা হচ্ছে :
আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঐ অসতর্কতা ও চারিত্রিক দুর্বলতার প্রতি যা মোটের উপর তাদের মধ্যে বাকী রয়ে গিয়েছিল। আর যেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু এ যুদ্ধে প্রকাশও পেয়ে গিয়েছিল। তাদের এ মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্য ছিল তারা নিজেদেরকে এ সব দুর্বলতা হতে পবিত্র করে পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
এরপর মহান আল্লাহ এ বিজয়ে স্বীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও গায়েবী সাহায্যের অন্তভুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমরা নিজেদের সাহস ও বীরত্বের প্রতারণায় যেন না পড়ে। কেননা, এর ফলে স্বভাব ও প্রকৃতির মধ্যে গর্ব ও অহংকার সৃষ্টি হয়। বরং তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার উপরই নির্ভরশীল হয় এবং তাঁর ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য স্বীকার করে।
তারপর ঐ সব মহৎ উদ্দেশ্যের আলোচনা করা হয়েছে যার জন্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পা রেখেছিলেন এবং এর মধ্যে ঐ চরিত্র ও গুণাবলী চিহ্ণিত করা হয়েছে যা যুদ্ধসমূহে বিজয়ের কারণ হয়ে থাকে।
তারপর মুশরিক মুনাফিক্ব, ইহুদী এবং যুদ্ধবন্দীদেরকে এমন মর্মস্পর্শী উপদেশ দেয়া হয় যাতে তারা সত্যের সামনে ঝুঁকে পড়ে এবং ওর অনুসারী হয়ে যায়।
এরপর মুসলিমগণকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে সম্বোধন করে এ বিজয়ের সমুদয় বুনিয়াদী নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা বুঝানো হয় ও বলে দেয়া হয়।
তারপর এ স্থানে ইসলামী দাওয়াতের জন্যে যুদ্ধ ও সন্ধির যে নীতিমালার প্রয়োজন ছিল ও গুলোর বিশ্লেষণ ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। যাতে মুসলিমদের যু্দ্ধ এবং জাহেলিয়াত যুগের যুদ্ধের মধ্যে স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চরিত্র ও কর্মের ক্ষেত্রে মুসলিমদের উৎকৃষ্টতা লাভ হয়, আর দুনিয়ার মানুষ উত্তমরূপে জেনে নেয় যে, ইসলাম শুধু মাত্র একটা মতবাদ নয়, বরং সে যে নীতিমালা ও রীতিনীতির প্রতি আহবানকারী, স্বীয় অনুসারীদেরকে ওগুলো অনুযায়ী আমল করার শিক্ষাও দিয়ে থাকে।
তারপর ইসলামী হুকুমতের কয়েকটি দফা বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী হুকমতের গন্ডীর মধ্যে বসবাসকারী মুসলিম ও এর বাইরে বসবাসকারী মুসলিমদের মধ্যে কতই না পার্থক্য রয়েছে।
বদর যুদ্ধের বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী
হিজরী ২য় সনে রমাযানের রোযা এবং সাদকায়ে ফিতর ফরজ করা হয়, আর যাকাতের বিভিন্ন নিসাব ও ধনের পরিমাণ যা থাকলে যাকাত ফরজ হয়, নির্দিষ্ট করা হয়। সাদকায়ে ফিতর ফরজ ও যাকাতের নিসাব নির্দিষ্ট করণের ফলে ঐ বোঝা ও কষ্ট অনেকাংশ হালকা হয়ে গেল যা বহু সংখ্যক দরিদ্র মুহাজির বহণ করে আসছিলেন। কেননা, তাঁরা জীবিকার সন্ধানে ভূপৃষ্ঠে ঘুরেও জীবিকার ব্যবস্থা করতে অপারগ হচ্ছিলেন।
তারপর অত্যন্ত সুন্দর ও মোক্ষম ব্যবস্থা এই ছিল যে, মুসলিমরা তাদের জীবনে যে প্রথম ঈদ উদযাপন করেছিলেন তা ছিল ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ঈদ, যা বদর যুদ্ধের প্রকাশ্য বিজয়ের পর হাযির হয়েছিল। কতই না সুন্দর ছিল এ সৌভাগ্যের ঈদ, যে সৌভাগ্য আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের মস্তিষ্কে বিজয় ও সম্মানের মুকুট পরানোর পর দান করেছিলেন। আর কতই না ঈমানের ছিল এ ঈদের সালাতের দৃশ্য যা মুসলিমরা নিজেদের ঘর হতে বের হয়ে তকবীর তাওহীদ ধ্বনিতে গগণ পবন মুখরিত মাঠে গিয়ে আদায় করে থাকেন। ঐ সময় অবস্থা ছিল মুসলিমদের অন্তরে ছিল আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতরাশি ও তাঁর দেয়া সাহায্যের কারণে তাঁর করুণা ও সন্তুষ্টি লাভের আগ্রহে উচ্ছ্বসিত এবং বিজয়োন্মাদনার উল্লাসে পরিপূর্ণ। তাদের ললাটগুলো তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে ঝুঁকে পড়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ নিয়ামতের বর্ণনা নিম্নের আয়াতে দিয়েছেনঃ
(وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَن يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُم بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ) [الأنفال:26].
‘‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প, দুনিয়াতে তোমাদেরকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হত। তোমরা আশঙ্কা করতে যে, মানুষেরা তোমাদের কখন না হঠাৎ ধরে নিয়ে যায়। এমন অবস্থায় তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিলেন, তাঁর সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী করলেন, তোমাদের উত্তম জীবিকা দান করলেন যাতে তোমরা (তাঁর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (আল-আনফাল ৮ : ২৬)
বদর পরবর্তী সময়ের তৎপরতা
বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলিম এবং মুশরিকদের মধ্যে সর্ব প্রথম অস্ত্রের লড়াই এবং মীমাংসাসূচক সংঘর্ষ। এ সংঘর্ষে মুসলিমগণ প্রকাশ্য বিজয় লাভ করেন এবং সমগ্র আরব তা প্রত্যক্ষ করে। এ যুদ্ধের ফলে যারা সরাসরি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারাই মর্মাহত হয়েছিল সব চাইতে বেশী অর্থাৎ মক্কার মুশরিকেরা। তাছাড়া ঐ সকল লোকও যারা মুসলিমদের বিজয় ও সফলতাকে নিজেদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করেছিল, অর্থাৎ ইহুদীর। সুতরাং মুসলিমগণ যখন বদর যুদ্ধে কল্পনাতীতভাবে বিজয় লাভ করলেন তখন এ দুটি দল মুসলিমদের প্রতি ক্রোধ, ক্ষোভ ও মন পীড়ায় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল। কুরআনুল কারীমে যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ
(لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِّلَّذِيْنَ آمَنُوْا الْيَهُوْدَ وَالَّذِيْنَ أَشْرَكُوْا) [المائدة:82]
‘‘যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি মানুষের মধ্যে ইয়াহূদ ও মুশরিকদেরকে তুমি অবশ্য সবচেয়ে বেশি শত্রুতাপরায়ণ দেখতে পাবে।’ (আল-মায়িদা ৫ : ৮২)
মদীনায় কিছু লোক এ দুটি দলের সঙ্গী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তারা যখন দেখল যে, তাদের মান মর্যাদা সমুন্নত রাখার এখন আর কোন পথ রইল না তখন তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামে প্রবেশ করল।
এটা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার বন্ধু বান্ধবের দল। ইহুদী এবং মুশরিকদের তুলনায় মুসলিমদের প্রতি এরাও কম ক্ষোভ হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করত না।
এদের ছাড়া চতুর্থ একটি দলও ছিল। অর্থাৎ ঐ সব বেদুঈন যারা মদীনার চতুষ্পার্শে বসবাস করত। কুফর কিংবা ঈমান কোন কিছুর প্রতিই তাদের কোন আকর্ষণ কিংবা আবেগের প্রশ্ন জড়িত ছিল না। তারা ছিল লুণ্ঠনকারী দস্যু। এ কারণে বদর যুদ্ধে মুসলিমদের সাফল্যে তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল যে, মদীনায় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের লুণ্ঠন ও দস্যুবৃত্তির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে তাদের অন্তরেও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা দানা বেঁধে ওঠে। যার ফলে তারাও মুসলিমদের শত্রু দলভুক্ত হয়ে পড়ে।
মুসলিমগণ এভাবে চতুর্দিক থেকে বিপদের সম্মুখীন হন। কিন্তু মুসলিমদের ব্যাপারে প্রত্যেক দলের কর্ম পদ্ধতি ছিল অন্যান্য দলের কর্ম পদ্ধতি হতে পৃথক। প্রত্যেক দল নিজেদের অবস্থার প্রেক্ষাপটে এমন সব পন্থা অবলম্বন করেছিল যা তাদের ধারণায় তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ছিল সহায়ক। সুতরাং মদীনাবাসী মুনাফিক্বগণ বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে গোপনে গোপনে ষড়যন্ত্র করে পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার পথ অবলম্বন করল। ইহুদীদের একটি দল খোলাখুলিভাবে মুসলিমদের প্রতি ক্রোধ ও শত্রুতা শুরু করল এবং প্রতিশোধ গ্রহণের প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে থাকল। তাদের সামরিক তৎপরতা এবং প্রস্তুতি ছিল খোলাখুলি, তারা যেন তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে মুসলিমগণকে নিম্নরূপ পয়গাম দিচ্ছিলঃ
ولا بد من يوم أغرّ مُحَجَّل ** يطول استماعي بعده للنوادب
অর্থাৎ এমন এক উজ্জ্বল ও আলোকময় দিনের প্রয়োজন, যার পরে দীর্ঘকাল ধরে বিলাপকারিণীদের বিলাপ শুনতে থাকবো।
আর বছর কাল পরে তারা কার্যতঃ যুদ্ধ করার জন্যে মদীনার উপর চড়াও হল, যা ইতিহাসে উহুদের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মুসলিমদের খ্যাতি মর্যাদার উপর এর যথেষ্ট মন্দ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল।
এ বিপদের মোকাবেলা করার জন্যে মুসলিমগণ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যোগ্য নেতৃত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকাশ থাকে যে, মদীনার নেতা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চার পাশের এ সব বিপদের ব্যাপারে সদা সচেতন ও সতর্ক ছিলেন এবং এগুলো মোকাবেলা করার জন্য যে, ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এখানে তারই একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হল।
******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url