সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৬৮ || বদর যুদ্ধে উভয় দলের নিহত ব্যক্তিবর্গ || বদর বিজয়ী মুসলিম সেনাবাহিনী মদীনার পথে ||





সিরাতুন নবী (সাঃ) ৬৮-তম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

বদর যুদ্ধে উভয় দলের নিহত ব্যক্তিবর্গ

এ যুদ্ধ মুশরিকদের প্রকাশ্য পরাজয় এবং মুসলিমদের সুস্পষ্ট বিজয়ের উপর সমাপ্ত হয়। এতে চৌদ্দজন মুসলিম শহীদ হন, ছয় জন মুহাজির এবং আট জন আনসার। কিন্তু মুশরিকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সত্তর জন নিহত এবং সত্তর জন বন্দী হয়। এদের অধিকাংশই ছিল নেতৃস্থানীয় লোক।

যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিহতদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের নাবী (ﷺ)-এর কতই না নিকৃষ্ট গোষ্ঠী ও গোত্র ছিলে। তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ। তোমরা আমাকে বন্ধুহীন ও সহায়কহীনরূপে ছেড়ে দিয়েছো যখন অন্যরা আমার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। তোমরা আমাকে বের করে দিয়েছ, যখন অন্যরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।’ এরপর তাঁর নির্দেশক্রমে তাদের টেনে হেঁচড়ে বদরের একটি কূপে নিক্ষেপ করা হয়।
আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নাবী (ﷺ)-এর আদেশক্রমে বদরের দিন কুরাইশদের চবিবশ জন বড় বড় নেতার মৃত দেহ বদরের একটি নোংরা কূপে নিক্ষেপ করা হয়।

তাঁর নিয়ম ছিল যখন তিনি কোন কাওমের উপর বিজয় লাভ করতেন তখন তিন দিন পর্যন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রেই অবস্থান করতেন। সুতরাং যখন বদরে তৃতীয় দিবস সূচিত হল তখন তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর সওয়ারীর উপর হাওদা উঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর তিনি পদব্রজে চলতে থাকলেন এবং তাঁর পিছনে পিছনে তাঁর সাহাবীগণও চললেন। অবশেষে তিনি কূপের ধারে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাদেরকে তাদের নাম ধরে ও তাদের পিতাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। (তিনি বললেন) হে অমুকের পুত্র অমুক, হে অমুকের পুত্র অমুক! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করতে এটা কি তোমাদের জন্য খুশীর বিষয় হতো না। কেননা, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমরা তো তা সত্য পেয়েছি। আর তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যা কিছু বলেছিলেন তা তোমরা সত্যরূপে পেয়েছ কি?’ উমার (রাঃ) তখন আরয করলেন ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি এমন দেহসমূহের সঙ্গে কথা বলছেন যে গুলোর আত্মা নেই, ব্যাপার কী?’ নাবী (ﷺ) উত্তরে বললেন, ‘যে সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আমি যা কিছু বলছি তা এদের চেয়ে বেশী তোমরা শুনতে পাওনা।’ রেওয়াইয়াতে রয়েছে যে, নাবী (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা এদের চেয়ে বেশী শুনতে পাওনা। কিন্তু এরা উত্তর দিতে পারে না।[১]
[১] সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিম। মিশকাত, ২য় খন্ড ৩৪৫ পৃঃ।


মক্কায় বদর যুদ্ধে পরাজয়ের খবর

মুশরিকরা বদর প্রান্তর হতে বিশৃঙ্খল, ছত্রভঙ্গ ও ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় মক্কামুখী হয়। শরম ও সংকোচের কারণে তাদের ধারণায় আসছিল না যে, কিভাবে তারা মক্কায় প্রবেশ লাভ করবে।

ইবনু ইসহাক্ব বলেন যে, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম কুরাইশদের পরাজয়ের সংবাদ বহন করে মক্কায় পৌঁছেছিল, সে হলো হাইসামান ইবনু আব্দুল্লাহ কুযায়ী। জনগণ তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘যুদ্ধের খবর কী?’ সে উত্তরে বলল, ‘‘উতবাহ ইবনু রাবীআহ, শায়বাহ ইবনু রাবীআহ, আবুল হাকাম ইবনু হিশাম, উমাইয়া ইবনু খালফসহ আরো কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে যারা সবাই নিহত হয়েছে। সে যখন নিহতদের তালিকায় সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের নাম উল্লেখ করতে শুরু করল তখন হাতীমের উপর উপবিষ্ট সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বলল, ‘আল্লাহর কসম! যদি তার স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে থাকে তবে তাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর?’ জনগণ তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বলত সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার কী হয়েছে?’ সে উত্তরে বলল ‘ঐ দেখ, সে হাতীমে উপবিষ্ট রয়েছে। আল্লাহর কসম! তার পিতা ও ভ্রাতাকে নিহত হতে স্বয়ং আমিই দেখেছি।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র আযাদকৃত দাস আবূ রাফি (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ ‘আমি ঐ সময় আব্বাস (রাঃ)-এর গোলাম ছিলাম। আমাদের বাড়িতে ইসলাম প্রবেশ করেছিল। আব্বাস (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন, উম্মুল ফযল (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন এবং আমিও মুসলিম হয়েছিলাম। তবে অবশ্যই আব্বাস (রাঃ) তার ইসলাম গোপন রেখেছিলেন। এদিকে আবূ লাহাব বদর যুদ্ধে হাযির হয়নি। যখন কুরাইশদের পরাজয়ের খবর তার কানে পৌঁছল তখন লজ্জায় ও অপমানে তার মুখ কালো হয়ে গেল। পক্ষান্তরে আমরা নিজেদের মধ্যে শক্তি ও সম্মান অনুভব করলাম। আমি দুর্বল মানুষ ছিলাম, তীর বানাতাম এবং যমযম কক্ষে বসে তীরের হাতল ছিলতাম। আল্লাহর কসম! ঐ সময় আমি কক্ষে বসে তীর ছিলছিলাম। উম্মুল ফযল (রাঃ) আমার পাশেই বসেছিলেন এবং যে খবর এসেছিল তাতে আমরা খুশী ও আনন্দিত ছিলাম। ইতোমধ্যে আবূ লাহাব জঘন্যভাবে তার পদদ্বয় টেনে টেনে আমাদের কাছে এসে কক্ষপ্রান্তে বসে পড়লো। তার পৃষ্ঠ আমার পৃষ্ঠের দিকে ছিল। হঠাৎ গোলমাল শোনা গেল, ‘আবূ সুফইয়ান ইবনু হারিস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব এসে গেছে।’ আবূ লাহাব তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র। আমার কাছে এসো। আমার জীবনের শপথ! তোমার নিকট হতে খবর পাওয়া যাবে।’ তিনি আবূ লাহাবের কাছে বসে পড়লেন। জনগণ দাঁড়িয়ে ছিল। আবূ লাহাব বলল, লোকদের কী অবস্থা? ‘বল ভাতিজা, যুদ্ধের খবর কী?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘কিছুই নয়, এটুকুই বলা যথেষ্ট যে, লোকদের মুসলিমদের সাথে মোকাবেলা হয়েছে এবং আমরা আমাদের কাঁধগুলো তাদেরকে সোপর্দ করেছি। তারা আমাদের ইচ্ছামত হত্যা করেছে এবং বন্দী করেছে। তা সত্ত্বেও আমি আমাদের লোকদেরকে তিরষ্কার করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মোকাবালা এমন কতিপয় লোকের সঙ্গে হয়েছিল যারা আসমান ও জমিনের মধ্যস্থানে সাদাকালো মিশ্রিত ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল। আল্লাহর শপথ! না তারা কোন কিছু ছেড়ে দিচ্ছিল, না কোন জিনিস তাদের মোকাবালায় টিকতে পারছিল।’

আবূ রাফি (রাঃ) বলেন, আমি স্বীয় হাত দ্বারা তাঁবুর প্রান্ত উঠালাম, তারপর বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! তারা ছিলেন ফিরিশতা’। আমার এ কথা শুনে আবূ লাহাব তার হাত উঠিয়ে ভীষণ জোরে আমার গালে এক চড় লাগিয়ে দিল। আমি তখন তার সাথে লড়ে গেলাম। কিন্তু সে আমাকে উঠিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আমার উপর হাঁটুর ভরে বসে আমাকে প্রহার করতে লাগল। আমি দুর্বল প্রমাণিত হলাম। কিন্তু ইতোমধ্যে উম্মুল ফযল উঠে তাঁবুর একটি খুঁটি নিয়ে তাকে এমনভাবে মারলেন যে, তার মাথায় ভীষণভাবে আঘাত লাগল। আর সাথে সাথে উম্মুল ফযল (রাঃ) বলে উঠলেন, ‘তার মনিব নেই বলে তাকে দুর্বল মনে করছো। আবূ লাহাব তখন লজ্জিত হয়ে উঠে চলে গেল। এরপর আল্লাহর কসম! মাত্র সাত দিন অতিবাহিত হয়েছে এরই মধ্যে আল্লাহর হুকুমে সে আদাস নামক কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলো এবং এতেই তার জীবনলীলা শেষ হয়ে গেল। আদাসার ফোড়াকে আরবরা বড়ই কুলক্ষণ মনে করত। তাই, তার মৃত্যুর পর তার পুত্ররা তার গোর-কাফন না করে তিন দিন পর্যন্ত তাকে উপরেই রেখে দেয়। কেউই তার নিকটে গেল না এবং তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থাও করলনা। অবশেষে যখন তার পুত্ররা আশঙ্কা করল যে, তাকে এভাবে রেখে দিলে জনগণ তাদেরকে তিরস্কার করবে তখন তারা একটি গর্ত খনন করে ঐ গর্তের মধ্যে তার মৃত দেহকে কাঠ দ্বারা ঢেকে ফেলে দিল এবং দূর থেকেই ঐ গর্তের মধ্যে পাথর নিক্ষেপ করে তাকে ঢেকে ফেললো।

মোট কথা, এভাবে মক্কাবাসীগণ তাদের লোকদের সুস্পষ্ট পরাজয়ের খবর পেলো এবং তাদের স্বভাবের উপর এর অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া হলো। এমনকি তারা নিহতদের উপর বিলাপ করতে নিষেধ করে দিল যাতে মুসলিমরা তাদের দুঃখে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ না পায়।

এ ব্যাপারে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা রয়েছে। তা হচ্ছে বদরের যুদ্ধে আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের তিনটি পুত্র মারা যায়। তাদের জন্য সে কাঁদতে চাচ্ছিল। সে ছিল অন্ধ লোক। একদা রাত্রে সে এক বিলাপকারিণী মহিলার বিলাপের শব্দ শুনতে পেল। তৎক্ষণাৎ সে তার গোলামকে বলল ‘তুমি গিয়ে দেখ তো, বিলাপ করার কি অনুমতি পাওয়া গেছে? কুরাইশরা কি নিহতদের জন্য ক্রন্দন করছে? তাহলে আমিও আমার পুত্র আবূ হাকিমের জন্য ক্রন্দন করব। কেননা, আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে।’ গোলাম ফিরে এসে খবর দিল ‘মহিলাটি তো তার এক হারানো উটের জন্য ক্রন্দন করছে।’ এ কথা শুনে আসওয়াদ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। আবেগে সে নিম্নের বিলাপ পূর্ণ কবিতাটি বলে ফেললোঃ

أتبكي أن يضل لها بـعـير ** ويمنعها من النوم السهود

فلا تبكي على بكر ولكـن ** على بدر تقاصرت الجدود

على بدر سراة بني هصيص ** ومخزوم ورهط أبي الوليد

وبكى إن بكيت على عقيل ** وبكى حارثا أسد الأسود

وبكيهم ولا تسمى جميعـا ** وما لأبي حكيمة من نديد

ألا قد ساد بعدهـم رجال ** ولولا يوم بدر لم يسودوا

অর্থঃ ‘তার উট হারিয়ে গেছে এজন্যে কি সে কাঁদছে? আর ওর জন্যে অনিদ্রা কি তার নিদ্রাকে হারাম করে দিয়েছে। (হে মহিলা) তুমি উটের জন্যে ক্রন্দন করো না, বরং বদরের (নিহতদের) জন্যে ক্রন্দন করো, যেখানে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে গেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বদরের (বেদনাদায়ক ঘটনার) জন্যে ক্রন্দন করো যেখানে বনু হাসীস, বনু মাখযূম, আবুল ওয়ালীদ প্রভৃতি গোত্রের অসাধারণ ব্যক্তিবর্গ (সমাধিস্থ) রয়েছে। যদি ক্রন্দন করতেই হয় তবে আকীলের জন্যে ক্রন্দন করো এবং হারিসের জন্যে ক্রন্দন করো যারা ছিল সিংহদের সিংহ। তুমি ঐ লোকদের জন্যে ক্রন্দন করো এবং সবার নাম নিও না। আর আবূ হাকীমার তো কোন সমকক্ষই ছিল না। দেখ ওদের পরে এমন লোকেরা নেতা হয়ে গেছে যে, ওরা থাকলে এরা নেতা হতে পারত না।’


মদীনায় বদরের বিজয়ের শুভ সংবাদ

এদিকে মুসলিমদের বিজয় পূর্ণতায় পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনাবাসীকে অতি শীঘ্র শুভ সংবাদ দেয়ার জন্যে দুজন দূতকে প্রেরণ করেন। একজন আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) যাকে মদীনার উচ্চ ভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট প্রেরণ করা হয় এবং অপর জন যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) যাকে মদীনার নিম্নভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট পাঠানো হয়।

ঐ সময়ে ইয়াহুদী ও মুনফিকরা এ গুজব রটিয়ে দিয়েছিল। যে মুসলিমরা পরাজিত হয়েছে। এমন কি এ গুজবও তারা রটিয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং একজন মুনাফিক্ব যখন যায়দ ইবনু হারিস (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উষ্ট্র কাসওয়ার উপর সাওয়ার হয়ে আসতে দেখলো তখন বলে উঠল ‘সত্যিই মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন। দেখ, এটা তো তারই উট। আমরা এটাকে চিনি। আর এ ব্যক্তি যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে এবং সে এত ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছে যে, কী বলবে তা বুঝতে পারছে না।’ মোট কথা, যখন দুজন দূত মদীনায় পৌঁছলেন তখন মুসলিমরা তাদেরকে ঘিরে নেন এবং তাদের মুখে বিস্তারিত খবর শুনতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, মুসলিমরা বিজয় লাভ করেছেন। এরপর চতুর্দিকে আনন্দের ঢেউ উথলে ওঠে এবং মদীনার আকাশ-বাতাস তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকে। যে সব মর্যাদাসম্পন্ন নেতৃস্থানীয় সাহাবী মদীনাতেই রয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ প্রকাশ্য বিজয়ের মুবারকবাদ জানাবার জন্যে বদরের রাস্তার উপর বেরিয়ে পড়েন।

উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমাদের নিকট এ সুসংবাদ ঐ সময় পৌঁছে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা ও উসমান (রাঃ)-এর সহধর্মিনী রুকাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি বরাবর করা হয়েছিল। তাঁর শুশ্রূষার জন্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে উসমান (রাঃ)-এর সাথে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন।


বদর বিজয়ী মুসলিম সেনাবাহিনী মদীনার পথে

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ শেষে তিন দিন বদরে অবস্থান করেন এবং তখনও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র হতে যাত্রা শুরু করেন নি এর মধ্যেই গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং এ মতভেদ চরম সীমায় পৌঁছে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্দেশ দেন যে, যার কাছে যা আছে তা যেন সে তাঁর কাছে জমা দেয়। সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁর এ নির্দেশ পালন করেন এবং এরপর আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে দেন।

উবাদাহ ইবনু সামিত (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মদীনা হতে যাত্রা শুরু করে বদর প্রান্তরে উপনীত হলাম। লোকদের (মুশরিকদের) সাথে আমাদের যুদ্ধ হলো এবং আল্লাহ তা‘আলা শত্রুদেরকে পরাজিত করলেন। তারপর আমাদের মধ্যে একটি দল তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল এবং তাদেরকে ধরতে ও হত্যা করতে লাগল। আর একটি দল গণীমতের মাল লুট করতে ও জমা করতে থাকল। অন্য একটি দল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে চতুর্দিকে থেকে পরিবেষ্টন করে থাকলেন যাতে শত্রুরা প্রতারণা করে তাকে কোন কষ্ট দিতে না পারে। যখন রাত্রি হলো এবং প্রতিটি দল একে অপরের সাথে মিলিত হলো তখন গণীমত একত্রিতকারীরা বলল, ‘আমরা এগুলো জমা করেছি। সতুরাং এতে অন্য কারো কোন অংশ নেই।’ শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবনকারীরা বলল, ‘তোমরা আমাদের চেয়ে বেশী এর হকদার নও। কেননা, আমরা এ মাল হতে শত্রুদের তাড়ানো ও দূর করানোর কাজ করেছি।’ আর যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হিফাযতের কাজ করেছিল তারা বলল ‘আমরা এ আশঙ্কা করেছিলাম যে, আমাদের অবহেলার কারণে শত্রুরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে। এ জন্যে আমরা তার হিফাযতের কাজে নিয়োজিত থেকেছি। সুতরাং আমরা এর বেশী হকদার।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

(‏يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الأَنفَالِ قُلِ الأَنفَالُ لِلهِ وَالرَّسُوْلِ فَاتَّقُوْا اللهَ وَأَصْلِحُوْا ذَاتَ بِيْنِكُمْ وَأَطِيْعُوْا اللهَ وَرَسُوْلَهُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِيْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏1‏]‏‏

‘‘তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। বল, ‘যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের; কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত কর। তোমরা যদি মু’মিন হয়ে থাক তবে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর।’ (আল-আনফাল ৮ : ১)

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ গনীমতের মাল মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেন।[১]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিন দিন বদরে অবস্থানের পর মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর সাথে মুশরিক বন্দীরাও ছিল এবং মুশরিকদের নিকট হতে প্রাপ্ত গণীমতের মালও ছিল। তিনি তাদের পাহারার দায়িত্ব আব্দুল্লাহ ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর উপর অর্পণ করেন। যখন তিনি সাফরা উপত্যকায় গিরিপথ হতে বের হয়ে একটি টিলার উপর বিশ্রাম গ্রহণ করেন তখন তিনি সেখানে গণীমাতের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল মুসলিমদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করে দেন। আর সাফরা উপত্যকাতেই তিনি নাযর ইবনু হারিসের হত্যার নির্দেশ দেন। এ ব্যক্তি বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের পতাকা ধরে রেখেছিল এবং সে কুরাইশদের বড় বড় অপরাধীদের একজন ছিল। ইসলামের শত্রুতায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট প্রদানে সে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশক্রমে আলী (রাঃ) তাকে হত্যা করেন।

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরকুয যুবয়্যাহ নামক স্থানে পৌঁছে উকবাহ ইবনু আবী মুআইত্বকে হত্যা করার আদেশ জারী করেন। এ লোকটি যেভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দিয়েছিল তার কিছু আলোচনা ইতোপূর্বে করা হয়েছে। এ সেই ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সালাতের অবস্থায় তাঁর পিঠের উপর উটের ভূঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল এবং সে তার গলায় চাদর জড়িয়ে দিয়ে তাঁকে মেরে ফেলার ইচ্ছা করেছিল এবং আবূ বাকর (রাঃ) সেখানে সময়মত এসে না পড়লে সে তো তাকে গলা টিপে মেরেই ফেলত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন তখন সে বলে ওঠে ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ) আমার সন্তানদের জন্য কে আছে?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আগুন’’। তারপর আসিম ইবনু সাবিত (রাঃ) এবং মতান্তরে আলী (রাঃ) তার গর্দান উড়িয়ে দেন।[২]

সামরিক নীতি অনুযায়ী এ দুরাচার ব্যক্তিদ্বয়ের হত্যা অপরিহার্য ছিল। কেননা, তারা শুধু বন্দী ছিল না, বরং আধুনিক পরিভাষার দিক থেকে যুদ্ধ অপরাধীও ছিল।

[১] মুসনাদে আহমাদ ৫ম খন্ড ৩২৩ ও ৩২৪ পৃঃ এবং হাকিম ২য় খন্ড ৩২৮ পৃঃ।
[২] এ হাদীসটি সহীহুল গ্রন্থসমূহে বর্ণিত যথা সুনানে আবূ দাউদ , আওনুল মা’বুদে ৩য় খন্ড ১২ পৃঃ।


বদর বিজয়ীদের অভ্যর্থনাকারী প্রতিনিধিদল

এরপর যখন মুসলিম সেনাবাহিনী রাওহা নামক স্থানে পৌঁছেন তখন ঐ মুসলিম প্রতিনিধি দলের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয় যারা দূতদ্বয় মারফত বিজয়ের শুভ সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অভ্যর্থনার জন্যে এবং তাকে বিজয়ের মুবারকবাদ জানাবার জন্যে মদীনা হতে বের হয়ে এসেছিলেন। যখন তারা মুবারকবাদ পেশ করলেন তখন সালামাহহ ইবনু সালামাহ্ (রাঃ) বললেন, ‘আপনারা আমাদেরকে মুবারকবাদ দিচ্ছেন কেন? আল্লাহর শপথ! আমাদের মোকাবেলা তো টেকো মাথাবিশিষ্ট বুড়োদের সাথে হয়েছিল, যারা ছিল উটের মত।’ তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুচকি হেসে বললেন, ‘ভ্রাতুষ্পুত্র, এরাই ছিল কওমের নেতৃস্থানীয় লোক বা নেতা।’

তারপর উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যে, তিনি আপনাকে সফলতা দান করেছেন এবং আপনার চক্ষুদ্বয় শীতল করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি একথা মনে করে বদরে গমন হতে পিছনে থাকি নি যে, আপনার মোকাবেলা শত্রুদের সাথে হবে। আমি তো ধারণা করেছিলাম যে, এটা শুধু কাফেলার ব্যাপার। আমি যদি বুঝতাম যে, শত্রুদের মুখোমুখী হতে হবে তবে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন তাকে বললেন? তুমি সত্য কথাই বলেছ।

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা মুনাওওরায় বিজয়ীর বেশে এমনভাবে প্রবেশ করলেন যে, মদীনা শহর এবং তাঁর আশপাশের শত্রুদের উপর তাঁর চরম প্রভাব প্রতিফলিত হল। এ বিজয়ের ফলে মদীনার বহু লোক দলে দলে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এ সময়েই আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই এবং তার সঙ্গীরা শুধু লোক দেখানো ইসলাম গ্রহণ করে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মদীনায় আগমনের এক দিন পর বন্দীদের আগমন ঘটে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে সাহাবীগণের (রাঃ) মধ্যে বন্টন করে দেন এবং তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করেন। এ পরামর্শের কারণে সাহাবীগণ (রাঃ) নিজেরা খেজুর খেতেন এবং বন্দীদেরকে রুটি খাওয়াতেন। কেননা মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল বিশেষ মূল্যবান খাদ্য।




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url