সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৭৩ || মুসলিম সেনাবাহিনীর বিন্যাস এবং উহুদ যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা ||





উহুদ যুদ্ধ

সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৭৩, উহুদ যুদ্ধ পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

মুসলিম সেনাবাহিনীর বিন্যাস এবং উহুদ যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুম’আর সালাতে ইমামত করেন। খুতবা দান কালে তিনি জনগণকে উপদেশ দেন, সংগ্রামের প্রতি উৎসাহিত করেন এবং বলেন যে, ‘ধৈর্য্য ও স্থিরতার মাধ্যমেই বিজয় লাভ সম্ভব হতে পারে। এছাড়া তিনি তাদেরকে এ নির্দেশও দান করেন যে, তারা যেন মোকাবালার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়।’ তাঁর এ নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে জনগণের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।

অতঃপর আসরের সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যক্ষ করেন যে, লোকেরা জমায়েত হয়েছে এবং আওয়ালীর অধিবাসীগণও এসে পড়েছে। অতঃপর তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন, তাঁর সাথে আবূ বাকর (রাঃ) এবং উমারও (রাঃ) ছিলেন। তাঁরা তাঁর মাথায় পাগড়ী বেঁধে দিলেন ও দেহে পোষাক পরিয়ে দিলেন। তিনি উপরে ও নীচে দুটি লৌহ বর্ম পরিধান করলেন, তরবারী ধারণ করলেন এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জনগণের সামনে আগমন করলেন।

জনগণ তাঁর আগমনের অপেক্ষায় তো ছিলেনই, কিন্তু তাঁর আগমনের পূর্বে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) এবং উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) জনগণকে বলেন, ‘আপনারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে জোর করে ময়দানে বের হতে উত্তেজিত করেছেন। সুতরাং এখন ব্যাপারটা তাঁর উপরই ন্যস্ত করুন।’ এ কথা শুনে জনগণ লজ্জিত হলেন এবং যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বের হয়ে আসলেন তখন তাঁরা তাঁর নিকট আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনার বিরোধিতা করা আমাদের মোটেই উচিত ছিল না। সুতরাং আপনি যা পছন্দ করেন তাই করুন। যদি মদীনার অভ্যন্তরে অবস্থান করাই আপনি পছন্দ করেন তবে সেখানেই অবস্থান করুন, আমরা কোন আপত্তি করব না।’ তাঁদের এ কথার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘কোন নাবী যখন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যান তখন তাঁর জন্যে অস্ত্রশস্ত্র খুলে ফেলা সমীচীন নয়, যে পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ও শত্রুদের মধ্যে ফায়সালা করে না দেন।’[১]
এরপর নাবী কারীম (ﷺ) সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন:

মুহাজিরদের বাহিনী। এর পতাকা মুসআব ইবনু উমায়ের আবদারী (রাঃ)-কে প্রদান করেন।
আউস (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা উসায়েদ ইবনু হুযাযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।
খাযরাজ (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা হাববাব ইবনু মুনযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।
মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার, যাদের মধ্যে একশ জন ছিলেন বর্ম পরিহিত এবং পঞ্চাশ জন ছিলেন ঘোড়সওয়ার।[২] আবার এ কথাও বলা হয়েছে যে, ঘোড়সওয়ার একজনও ছিল না।

যারা মদীনাতেই রয়ে গেছে সেসব লোকদেরকে সালাত পড়ানোর কাজে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দেন এবং মুসলিম বাহিনী উত্তর মুখে চলতে শুরু করে। সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) ও সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) বর্ম পরিহিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগে আগে চলছিলেন।

‘সানিয়্যাতুল বিদা’ হতে সম্মুখে অগ্রসর হলে তাঁরা এমন বাহিনী দেখতে পান, যারা অত্যন্ত উত্তম অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ছিল এবং পুরো সেনাবাহিনী হতে পৃথক ছিল। তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন যে, তারা খাযরাজের মিত্র ইহুদী[৩] যারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা মুসলিম হয়েছে কি?’ জনগণ উত্তরে বলেন, ‘না’। তখন তিনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানালেন।

মুসলিম বাহিনীর সৈন্য পর্যবেক্ষণ

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘শায়খান’ নামক স্থানে পৌঁছে সৈন্যবাহিনী পরিদর্শন করেন। যারা ছোট ও যুদ্ধের উপযুক্ত নয় বলে প্রতীয়মান হল তাদেরকে তিনি ফিরিয়ে দিলেন। তাদের নাম হচ্ছে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ), উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ), উসাইদ ইবনু যুহাইর (রাঃ), যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ), যায়দ ইবনু আরক্বাম (রাঃ), আরাবাহ ইবনু আউস (রাঃ), ‘আমর ইবনু হাযম (রাঃ), আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ), যায়দ ইবনু হারিসাহ আনসারী (রাঃ) এবং সা‘আদ ইবনু হাব্বাহ (রাঃ)।

এ তালিকাতেই বারা ইবনু আযিব (রাঃ)-এর নামও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সহীহুল বুখারীতে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তা দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি উহুদের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। অবশ্যই অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রাফি ইবনু খাদীজ (রাঃ) এবং সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রাঃ) যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি লাভ করেন। এর কারণ ছিল, রাফি ইবনু খাদীজ (রাঃ) বড়ই সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। যখন তাকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হলো তখন সামুরাহ ইবনু জুনদুর (রাঃ) বললেন, ‘আমি রাফি (রাঃ) অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী। আমি তাঁকে কুস্তিতে পরাস্ত করতে পারি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ সংবাদ দেয়া হলে তিনি তাদের দুজনকে কুস্তি লাগিয়ে দেন এবং সত্যি সত্যিই সামুরাহ (রাঃ) রাফি (রাঃ)-কে পরাস্ত করে দেন। সুতরাং তিনিও যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি পেয়ে যান।


উহুদ ও মদীনার মধ্যস্থলে রাত্রি যাপন

এ জায়গায় পৌঁছে সন্ধা হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ স্থানে মাগরিব ও এশার সালাত আদায় করেন এবং এখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পাহারার জন্যে পঞ্চাশ জন সাহাবী (রাঃ)-কে নির্বাচন করেন, যারা শিবিরের চার পাশে টহল দিতেন। তাদের পরিচালক ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা আনসারী (রাঃ)। এ ব্যক্তি হচ্ছেন সেই যিনি কা‘ব ইবনু আশরাফির হত্যাকারি দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাফওয়ান ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু ক্বায়স (রাঃ) নির্দিষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাশে পাহারা দিচ্ছিলেন।


আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সঙ্গীদের শঠতা

ফজর হওয়ার কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুনরায় চলতে শুরু করলেন এবং ‘শাওত’ নামক স্থানে পৌঁছে ফজরের সালাত আদায় করলেন। এখন তিনি শত্রুদের নিকটে ছিলেন এবং উভয় সেনাবাহিনী একে অপরকে দেখতে ছিল। এখানে মুনাফিক্ব আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সে এক তৃতীয়াংশ সৈন্য (তিনশ জন সৈন্য) নিয়ে এ কথা বলতে বলতে ফিরে গেল যে, অযথা কেন জীবন দিতে যাব? সে এ বিতর্কও উত্থাপন করল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার কথা না মেনে অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তার কথা মেনে নেন নি এটা তার মুসলিম বাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অবশ্যই কারণ ছিল না। কেননা এ অবস্থায় নাবী (ﷺ)-এর সেনাবাহিনীর সাথে এত দূর পর্যন্ত তার আসার কোন প্রশ্নই উঠত না। বরং সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু হওয়ার পূর্বেই তার পৃথক হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। সুতরাং প্রকৃত ব্যাপার তা নয় যা সে প্রকাশ করেছিল। বরং প্রকৃত ব্যাপার ছিল, ঐ সংকটময় মুহূর্তে পৃথক হয়ে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা যখন শত্রুরা তাদের প্রতিটি কাজ কর্ম লক্ষ্য করছিল। তখন মুসলিম বাহিনীর মধ্যে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল তার মূখ্য উদ্দেশ্য। যাতে একদিকে সাধারণ সৈন্যরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গ ত্যাগ করে এবং যারা বাকী থাকবে তাদেরও উদ্যম ও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে, পক্ষান্তরে এ দৃশ্য দেখে শত্রুদের সাহস বেড়ে যায়। সুতরাং তার এ ব্যবস্থাপনা ছিল নাবী কারীম (ﷺ) এবং তার সঙ্গীদেরকে শেষ করে দেয়ারই এক অপকৌশল। মূলত ঐ মুনাফিক্বের এ আশা ছিল যে, শেষ পর্যন্ত তার ও তার বন্ধুদের নেতৃত্বের জন্য ময়দান সাফ হয়ে যাবে।
এ মুনাফিক্বের কোন কোন উদ্দেশ্য সফল হবারও উপক্রম হয়েছিল। কেননা আরো দুটি দলের অর্থাৎ আউস গোত্রের মধ্যে বনু হারিসাহ এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বনু সালামাহরও পদস্খলন ঘটতে যাচ্ছিল এবং তারা ফিরে যাবার চিন্তা ভাবনা করছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের সহায়তা করেন। ফলে তাঁদের চিত্তচাঞ্চল্য দূর হয়ে যায় এবং তারা ফিরে যাবার সংকল্প ত্যাগ করে।

তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

‏(‏إِذْ هَمَّتْ طَّآئِفَتَانِ مِنكُمْ أَن تَفْشَلاَ وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ‏)‏ ‏[‏آل عمران‏ :‏ 122‏]

‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’দল ভীরুতা প্রকাশ করতে মনস্থ করেছিল, কিন্তু আল্লাহ উভয়ের বন্ধু ছিলেন, মু’মিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ১২২]

যাহোক, মুনাফিক্বরা ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ঐ সংকটময় সময়ে জাবির (রাঃ)-এর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনু হারাম (রাঃ) তাদেরকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেন। সুতরাং তিনি তাদেরকে ধমকের সুরে (যুদ্ধের জন্যে) ফিরে আসার উৎসাহ প্রদান করে তাদের পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন এবং বলতে থাকলেন, ‘এসো, আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর।’ কিন্তু তারা উত্তরে বলল, ‘আমরা যদি জানতাম যে, তোমরা যুদ্ধ করবে তবে আমরা ফিরে যেতাম না।’ এ উত্তর শুনে আব্দুল্লাহ ইবনু হারাম (রাঃ) এ কথা বলতে বলতে ফিরে আসলেন, ‘ওরে আল্লাহর শত্রুরা, তোদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হোক। মনে রেখ যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নাবী (ﷺ)-কে তোদের হতে বেপরোয়া করবেন।’ এ সব মুনাফিক্বের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‏(‏وَلْيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُوْا وَقِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أَوِ ادْفَعُوْا قَالُوْا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالاً لاَّتَّبَعْنَاكُمْ هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلإِيْمَانِ يَقُوْلُوْنَ بِأَفْوَاهِهِم مَّا لَيْسَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُوْنَ‏)‏ ‏[‏آل عمران‏ :‏ 167‏]

‘আর মুনাফিক্বদেরকেও জেনে নেয়া। তাদেরকে বলা হয়েছিল; এসো, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর, কিংবা (কমপক্ষে) নিজেদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা কর’। তখন তারা বলল, ‘যদি আমরা জানতাম যুদ্ধ হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের অনুসরণ করতাম’। তারা ঐ দিন ঈমানের চেয়ে কুফরীরই নিকটতম ছিল, তারা মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই, যা কিছু তারা গোপন করে আল্লাহ তা বিশেষরূপে জ্ঞাত আছেন।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ১৬৭]


উহুদ প্রান্তে অবশিষ্ট ইসলামী সেনাবাহিনী

মুনাফিক্বদের এ শঠতা ও প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবশিষ্ট সাতশ জন সৈন্য নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ধাবিত হলেন। শত্রুদের শিবির তাঁর মাঝে ও উহুদের মাঝে কয়েক দিক থেকে বাধা সৃষ্টি করছিল। তাই, তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘শত্রুদের পাশ দিয়ে গমন ছাড়াই ভিন্ন কোন পথ দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে এমন কেউ আছে কি?’ এ প্রশ্নের জবাবে আবূ খাইসামা (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এ খিদমতের জন্যে আমি হাযির আছি।’’ অতঃপর তিনি এক সংক্ষিপ্ত পথ অবলম্বন করলেন, যা মুশরিকদের সেনাবাহিনীকে পশ্চিম দিকে ছেড়ে দিয়ে বনু হারিসা গোত্রের শস্য ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল।

এ পথ ধরে যাবার সময় তাদেরকে মিরবা’ ইবনু ক্বাইযীর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ লোকটি মুনাফিক্ব ছিল এবং অন্ধও ছিল। সে সেনাবাহিনীর আগমন অনুধাবন করে মুসলিমগণের মুখমন্ডলে ধূলো নিক্ষেপ করল এবং বলতে লাগল, ‘আপনি যদি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) হন তবে জেনে রাখুন যে, আমার বাগানে আপনার প্রবেশের অনুমতি নেই।’’

তার এ কথা শোনা মাত্র মুসলিমরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে বললেন,

‏(‏لَا تَقْتُلُوْهُ، فَهٰذَا الْأعْمٰى أَعْمٰى الْقَلْبِ أَعْمٰى الْبَصَرِ‏)

‘তাকে হত্যা করো না, সে অন্তর ও চোখের অন্ধ।’’

তারপর নাবী কারীম (ﷺ) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উপত্যকার শেষ মাথায় অবস্থিত উহুদ পাহাড়ের ঘাটিতে অবতরণ করেন এবং সেখানে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্থাপন করিয়ে নেন। সামনে ছিল মদীনা ও পিছনে হল সুউচ্চ উহুদ পর্বত। এভাবে শত্রুদের বাহিনী মুসলিম ও মদীনার মাঝে পৃথককারী সীমানা হয়ে গেল।


উহুদে মুসলিম বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা

এখানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেনাবাহিনীর শ্রেণী-বিন্যাস করেন এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি সারিতে বিভক্ত করে নেন। সুনিপুণ তীরন্দাযদের একটি দলও নির্বাচন করা হয়। তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় পঞ্চাশ জন। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ইবনু নু’মান আনসারী দাওসী বাদরী (রাঃ) এ দলের অধিনায়ক পদে নিয়োজিত হন। তাঁর দলকে কানাত উপত্যকার দক্ষিণে ইসলামী সৈন্যদের শিবির থেকে পূর্ব-দক্ষিণে একশ পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে একটি ছোট পাহাড়ের ধারে অবস্থান গ্রহণের দির্দেশ দেয়া হয়। ঐ পাহাড়টি এখন ‘জবলে রুমাত’ নামে প্রসিদ্ধ। ঐ পর্বতমালার মধ্যে একটি গিরিপথ ছিল। শত্রু সৈন্যরা যাতে পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে এ জন্য এ পঞ্চাশ জন তীরন্দাযকে ঐ গিরিপথ রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করা হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এদের অধিনায়ককে সম্বোধন করে বলেন,

‏‏(‏اِنْضَحِ الْخَيْلَ عَنَّا بِالنَّبْلِ، لَا يَأْتُوْنَا مِنْ خَلْفِنَا، إِنْ كَانَتْ لَنَا أَوْ عَلَيْنَا فَاثْبُتْ مَكَانَكَ، لَا نُؤْتِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ‏)
‘ঘোড়সওয়ারদেরকে তীর মেরে আমাদের নিকট থেকে দূরে রাখবে। তারা যেন পিছন থেকে কোন ক্রমেই আমাদেরকে আক্রমণ করতে না পারে। সাবধান, আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমাদের দিক থেকে যেন আক্রমণ না হয়।’’[৪]

তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুনরায় অধিনায়ককে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা আমাদের পিছন দিক রক্ষা করবে। যদি তোমরা দেখ যে, আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে না। আর যদি দেখতে পাও যে, আমরা গণীমতের মাল একত্রিত করছি তবে তখনও তোমরা আমাদের সাথে শরীক হবে না।[৫] আর সহীহুল বুখারীর শব্দ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন,

‏‏(‏إِنْ رَأَيْتُمُوْنَا تَخْطَفْنَا الطَّيْرُ فَلَا تَبْرَحُوْا مَكَانَكُمْ هٰذَا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ، وَإِنْ رَأَيْتُمُوْنَا هَزَمَنَا الْقَوْمَ وَوَطَأْنَاهُمْ فَلَا تَبْرَحُوْا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ‏)

‘তোমরা যদি দেখ যে, পাখিগুলো আমাদেরকে ছোঁ মারছে, তবুও তোমরা নিজেদের জায়গা ছাড়বে না, যে পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ডেকে না পাঠাই।’

আর যদি তোমরা দেখতে পাও যে, আমরা শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেছি এবং তাদেরকে পদদলিত করেছি, তবুও তোমরা নিজেদের জায়গা হতে সরবে না, যে পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ডেকে না পাঠাই।[৬]

এ কঠিনতম সামরিক নির্দেশাবলী ও হিদায়াতসহ এ বাহিনীকে তিনি ঐ পাহাড়ের গিরিপথে মোতায়েন করে দেন, যে পথ দিয়ে মুশরিকবাহিনী পিছন দিক থেকে মুসলিমদেরকে আক্রমণ করার খুবই আশঙ্কা ছিল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবশিষ্ট সৈন্যের শ্রেণীবিন্যাস এভাবে করেন যে, দক্ষিণ বাহুর উপর মুনযির ইবনু ‘আমর (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন এবং বাম বাহুর উপর নিযুক্ত করেন, যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ)-কে আর মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (ﷺ)-কে তার সহকারীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যুবাইর (রাঃ)-এর উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয় যে, তিনি খালিদ ইবনু ওয়ালিদের (যিনি তখনও মুসলিম হন নি) ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে প্রতিরোধ করবেন। এ শ্রেণীবিন্যাস ছাড়াও সারির সম্মুখভাগে এমন বাছাইকৃত মুসলিম বীর মুজাহিদদেরকে নিযুক্ত করা হয় যাদের বীরত্বের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যাদের প্রত্যেককে হাজারের সমান মনে করা হতো।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর এ শ্রেণীবিন্যাস ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ও কৌশলপূর্ণ এবং এর দ্বারা তাঁর সামরিক দক্ষতা প্রমাণিত হয়। কোন কমান্ডার, সে যতই দক্ষ ও যোগ্য হোক না কেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অপেক্ষা অধিক সূক্ষ্ণ ও নিপুণ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে না। কেননা, দেখা যায় যে, তিনি যদিও শত্রুবাহিনীর পরে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, তথাপি তিনি স্বীয় সেনাবাহিনীর জন্যে এমন স্থান নির্বাচন করেছেন যা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে উত্তম স্থান ছিল। অর্থাৎ তিনি পাহাড়কে আড়াল করে নিয়ে পিছন ও দক্ষিণ বাহু রক্ষিত করে নেন এবং যে গিরি পথ দিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণের আশঙ্কা ছিল ওটা তিনি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। আর শিবির স্থাপনের জন্যে একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। কারণ, যদি আল্লাহ না করুন পরাজয় বরণ করতে হয় তবে যেন পলায়নের পরিবর্তে শিবিরের মধ্যেই আশ্রয় নিতে পারা যায়। যদি শত্রুরা শিবির দখল করার জন্যে এগিয়ে আসে তবে যেন তাদেরকে ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অপর পক্ষে তিনি শত্রুু বাহিনীকে তাদের শিবির স্থাপনের জন্যে এমন নীচু জায়গা গ্রহণ করতে বাধ্য করেন যে, তারা জয় লাভ করলেও যেন তেমন কোন সুবিধা লাভ করতে না পারে। আর যদি মুসলিমরা জয়যুক্ত হন তবে যেন তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের হাত থেকে তারা রক্ষা না পায়। এভাবে তিনি বাছাই করা বীর পুরুষদের একটি দল গঠন করে সামরিক সংখ্যার স্বল্পতা পুরণ করে দেন। এটাই ছিল নাবী কারীম (ﷺ)-এর সেনাবাহিনীর শ্রেণীবিন্যাস যা তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের ৭ তারিখের শনিবার কার্যকর হয়েছিল।


তথ্যসূত্রঃ
[১] মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী, হা’কিম ও ইবনু ইসহাক্ব।

[২] এ কথাটি ইবনু কাইয়্যেম যাদুল মা‘আদ, ২য় খন্ডের ৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। ইবনু হাজার বলেন, এটা ভুল কথা। মুসা ইবনু উক্ববা জোর দিয়ে বলেন, উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগণের সাথে কোন ঘোড়াই ছিল না। ওয়াক্বিদী বলেন, শুধু দু’টি ঘোড়া ছিল। একটি ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এবং আরেকটি ছিল আবূ বুরদাহ (রাঃ)-এর নিকট। (ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড ৩৫০ পৃ:)

[৩] এ ঘটনাটি ইবনু সা‘দ বর্ণনা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে যে, তারা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রের ইহুদী ছিল। (২য় খন্ড ৩৪ পৃঃ)। কিন্তু এটা সঠিক কথা নয়। কেননা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রকে বদর যুদ্ধের অল্প কিছু দিন পরেই নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।

[৪] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬৫৩ ও ৬৬ পৃঃ।

[৫] মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী ও হা’কিম, ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত , ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৫০ পৃঃ।

[৬] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড, কিতাবুল জিহাদ ৪২৬ পৃঃ।




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url