সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৭৪ || রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সেনাবাহিনীর মধ্যে বীরত্বের প্রেরণাদান ||



উহুদ যুদ্ধ শুরু, যুদ্ধোন্মাদোনা ও উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য কুরাইশ মহিলাদের কর্ম তৎপরতা


সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৭৪, উহুদ যুদ্ধ পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সেনাবাহিনীর মধ্যে বীরত্বের প্রেরণাদান

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করেন যে, তিনি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করে। তিনি নীচে ও উপরে দুটি লৌহ বর্ম পরিহিত ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-কে যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে জোর দিয়ে বলেন যে, তারা যেন শত্রুদের সাথে মোকাবেলার সময় অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে বীরত্বের প্রেরণা দিয়ে তিনি একখানা অত্যন্ত ধারাল তরবারী হাতে নিয়ে বললেন,

‘কে এটা গ্রহণ করবে? কে এর মর্যাদা রক্ষা করবে?’’

‏‏(‏مَنْ يَّأْخُذُ هٰذَا السَّيْفَ بِحَقِّهِ‏؟‏‏)

বলা বাহুল্য যে, ঐ তরবারী খানা গ্রহণের জন্য চারদিক থেকে কয়েক শ’ বাহু উর্ধ্বে উত্থিত হয়েছিল যার মধ্যে আলী ইবনু আবূ ত্বালিব, জোবায়ের ইবনু ‘আউওয়াম এবং উমার ইবনু খাত্তাবও ছিলেন। উপস্থিতদের মধ্যে অনেকে ওটা গ্রহণ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু তা গ্রহণের জন্য আবূ দুজানাহ সিমাক ইবনু খারশা (রাঃ) সবার আগে অগ্রসর হলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ তরবারীর হক কী?’’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

(‏أَنْ تَضْرِبَ بِهِ وُجُوْهَ الْعَدُوَّ حَتّٰى يَنْحَنِيَ‏)‏

‘এর দ্বারা তুমি শত্রুদের মুখমন্ডলে এমন ভাবে মারবে যেন তা বেঁকে যায়।’

তখন তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল আমি এর হক আদায় করব।’’ তখন তলোয়ারটি তাঁর হাতে দিয়ে দেয়া হল।

আবূ দুজানাহ (রাঃ) অত্যন্ত বীর পুরুষ ছিলেন, যুদ্ধের সময় গর্ব ভরে চলাফেরা করতেন। তাঁর নিকট একটি লাল পাগড়ী ছিল যখন তিনি সেটা মাথায় বাঁধতেন তখন উপস্থিত জনতা অনুভব করতেন যে, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করবেন।

কাজেই তলোয়ারটি হাতে পেয়ে আবূ দুজানাহর গর্ব দেখে কে? তিনি মাথায় লাল রুমালের খুব সুন্দর পাগড়ি বেঁধে নিয়ে হেলতে দুলতে ও নর্তন কুর্দনের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে করতে গিয়ে কুরাইশ বাহিনীর উপর আপতিত হলেন। এ দৃশ্য দেখে করে নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,
(‏إِنَّهَا لَمَشِيَّةٌ يَبْغُضُهَا اللهُ إِلَّا فِيْ مِثْلِ هٰذَا الْمَوْطِنِ‏)

‘এরূপ চাল- চলন আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না বটে, কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে নয়।’’


উহুদে মুশরিক বাহিনীর বিন্যাস

মুশরিকগণও কাতারবন্দী নীতির অনুসরণে নিজেদের সেনা বাহিনীর বিন্যাস সাধন করেছিল। তাদের সেনাপতি ছিল আবূ সুফইয়ান। সে নিজের কেন্দ্র তৈরি করেছিল সেনা বাহিনীর মধ্যস্থলে। দক্ষিণ বাহুর উপর ছিল খালিদ ইবনু ওয়ালীদ, যিনি তখন পর্যন্ত মুশরিক ছিলেন। বাম বাহুর উপর ছিল ইকরামা ইবনু আবূ জাহল। পদাতিক সৈন্যের সেনাপতি ছিল সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া আর তীরনন্দাজদের নেতা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী’আহ।

তাদের পতাকা ছিল বনু আবদিদ্দারের ছোট একটি দলের হাতে। এ পদ তারা ঐ সময় হতে লাভ করেছিল যখন বনু আবদি মানাফ কুসাই হতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পদসমূহকে পরস্পর বন্টন করে নিয়েছিল। তারপর পূর্বপুরুষ হতে যে প্রথা চলে আসছিল ওটাকে সামনে রেখে কেউ এ পদের ব্যাপারে তাদের সাথে বিতর্কেও লিপ্ত হতে পারত না। কিন্তু সেনাপতি আবূ সুফইয়ান তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, বদরের যুদ্ধে তাদের পতাকা বাহক নযর ইবনু হারিস বন্দী হলে কুরাইশকে বড়ই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। এটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই তাদের ক্রোধ বৃদ্ধি করার জন্য বলেন, ‘হে বনী আবদিদ্দার গোত্র! বদরের যুদ্ধের দিন আমাদের পতাকা তোমরা নিয়ে রেখেছিলে। ঐ দিন আমাদেরকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল তা তোমরা অবগত আছ। প্রকৃত পক্ষে সেনাবাহিনীর উপর পতাকার দিক থেকেই বিপদ নেমে আসে। যখন পতাকা পতিত হয় তখন তাদের পা আলগা হয়ে যায়। সুতরাং এবার তোমরা আমাদের পতাকা সঠিকভাবে ধারণ করে থাকবে অথবা আমাদের পতাকা আমাদেরকেই দিয়ে দিবে। আমরা নিজেরাই এর ব্যবস্থা করব।’’ এ কথায় আবূ সুফইয়ানের যে উদ্দেশ্য ছিল তাতে সে সফলকাম হয়। কেননা, এ কথা শুনে বনু আবদিদ্দার ভীষণ চটে যায় এবং ক্রোধে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়। তারা বলে ওঠে, ‘আমরা আমাদের পতাকা তোমাদেরকে দেব? কারও মোকাবেলা হলে আমরা কী করি তা দেখতে পাবে।’’ আর বাস্তবিকই যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন তারা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত এক এক করে সবাই মৃত্যুর কবলে পতিত হল।


উহুদে কুরাইশদের রাজনৈতিক চাল

যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু পূর্বে কুরাইশরা মুসলিমগণের সারিতে বিচ্ছিন্নতা ও বিবাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এ উদ্দেশ্যে আবূ সুফইয়ান আনসারদের নিকট পয়গাম পাঠায়, ‘তোমরা আমাদের স্বগোত্রের লোকগুলোকে পরিত্যাগ করে সরে দাঁড়াও, আমরা তোমাদেরকে কিছুই বলব না, তোমাদের নগর আক্রমণ করব না এবং এখান থেকেই ফিরে যাব।’’ আবূ সুফইয়ানের এ জঘন্য প্রস্তাব শ্রবণ করা মাত্রই আনসারগণ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন এবং তাকে প্রচন্ডভাবে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করতে লাগলেন।

উভয় সেনাবাহিনী একে অপরের নিকটবর্তী হলে কুরাইশরা তাদের পূর্বোক্ত উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে অন্য এক চেষ্টা করল এবং তা হচ্ছে, মদীনার আউস বংশে আবূ ‘আমর নামক একজন যাজক বাস করত, তার নাম ছিল আবদি ‘আমর ইবনু সুফী। ইসলামের পূর্বে সে রাহিব’ (বনবাসী) আখ্যায় আখ্যায়িত ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নাম রেখেছিলেন ‘ফাসিক’ (লম্পট)। অজ্ঞতার যুগে সে আউস গোত্রের সর্দার ছিল। কিন্তু, ইসলামের আবির্ভাব ঘটলে ওটা তার গলার ফাঁস হয়ে যায় এবং প্রকাশ্যভাবে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শত্রুতায় লেগে পড়ে।

আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা দলে দলে মুসলিম হয়ে যাচ্ছে দেখে সে কতগুলো লোককে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় পালিয়ে যায় এবং সেখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। মদীনার এ প্রবীণ পুরোহিত কতিপয় দুর্ধর্ষ সৈন্য কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে সর্বপ্রথমে ময়দানে উপস্থিত হলো এবং আনসারদেরকে সম্বোধন করে উচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘হে মদীনার অধিবাসীরা। আমাকে চিনতে পারছ কি? আমি তোমাদের পুরোহিত আবূ আমির। তোমরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে ত্যাগ করে আমার সাথে যোগদান কর, তোমাদের কল্যাণ হবে।’ কিন্তু আনসারগণ এখন পুরোহিতদের প্রবঞ্চনার অতীত, তারা সমবেত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘দুর হ প্রবঞ্চক, তোর পৌরহিত্যের কোন ধার আমরা ধারি না, তোর অভিসন্ধি সিদ্ধ হবে না।’’ আবূ আমির কুরাইশদেরকে আশা দিয়ে বলেছিল, ‘আমি মদীনার পুরোহিত, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে আমি একবার আহবান করলে মদীনাবাসীগণ সবাই আমার দলে যোগদান করবে।’’ কিন্তুু আনসারদের উত্তর শুনে সে বলতে লাগল, ‘দেখছি, আমার অবর্তমানে হতভাগারা একেবারে বিগড়ে গেছে। অতঃপর তার পৌরহিত্যের ক্ষুব্ধ অভিমান পুরাতন প্রতিহিংসার সাথে যোগ দিয়ে প্রচন্ড হয়ে উঠল এবং এ হতভাগাই সর্বপ্রথমে সদলবলে প্রস্তর ও বাণ বর্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধের সূত্রপাত করে দিল এবং শেষে আক্রমণের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর পেয়ে সরে দাঁড়াল। এভাবে কুরাইশদের পক্ষ হতে মুসলিমগণের কাতারে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করার দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল। সংখ্যার আধিক্য ও সাজ-সরঞ্জামের প্রাচুর্য সত্ত্বেও মুশরিকগণ মুসলিমগণের ভয়ে কিরূপ ভীত হয়েছিল উপরের ঘটনা দ্বারা তা সহজেই অনুমান করা যায়।


যুদ্ধোন্মাদোনা ও উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য কুরাইশ মহিলাদের কর্ম তৎপরতা

এদিকে কুরাইশ মহিলারাও যুদ্ধে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তৎপর হয়ে উঠল। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আবূ সুফইয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ। এ মহিলারা সারিসমূহে ঘুরে ঘুরে ও দফ্ বাজিয়ে বাজিয়ে লোকদেরকে উত্তেজিত করল। কখনো কখনো তারা পতাকা বাহকদেরকে সম্বোধন করে বলত,

وَيْها بني عبد الــدار ** বনু আবদিদ্দার শুনে মোদের বাণী

ويـها حُمَاة الأدبـــار ** শুন পশ্চাদ ভাগের রক্ষিবাহিনী

ضـرباً بكـل بتـــــار ** খুব জোরে চালাবে শামশীর খাণি

অর্থাৎ ‘দেখ, হে বনু আবদিদ্দার! দেখ, হে পশ্চাদ্ভাগের রক্ষকবৃন্দ। তরবারী দ্বারা খুব আঘাত কর।

উত্তেজিত করতে গিয়ে কখনো কখনো তারা বলত,

إن تُـقْبلُـوا نُعَانـِـق **

ونَفــْرِشُ النمــارق **

أو تُـدْبِـرُوا نُـفـَارِق **

فــراق غيـر وَامـِق **

অর্থ: ‘যদি তোমরা অগ্রসর হতে পার তবে আমরাতোমাদেরকে আলিঙ্গন করব ও তোমাদের জন্যেশয্যা রচনা করব। আর যদি তোমরা পশ্চাদপদহও তবে আমরা রুখে দাঁড়াব এবং তোমাদের হতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।’


উহুদ যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন

এরপর উভয় দল সম্পূর্ণ মুখোমুখী হয়ে যায় এবং একে অপরের নিকটবর্তী হয় ও যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুশরিকদের পতাকাবাহী ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ আবদারী যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন হয়। এ লোকটি ছিল কুরাইশের বড় বীর পুরুষ এবং ঘোড়সওয়ার। মুসলিমরা তাকে ‘কাবশুল কুতায়বা’ (সৈন্যদের ভেড়া) বলতেন। সে উষ্ট্রের উপর আরোহণ করে বেরিয়ে পড়ল এবং মোকাবালার জন্য আহবান করল। তার অত্যধিক বীরত্বের কারণে সাধারণ সাহাবীগণ তার সাথে মোকাবালা করার সাহস করলেন না। কিন্তু যুবাইর (রাঃ) অগ্রসর হন এবং এক মুহূর্তের অবকাশ না দিয়ে সিংহের মতো লম্ফ দিয়ে উটের উপর চড়ে বসেন এবং তাকে নিজের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে নেন। অতঃপর ভূমিতে লাফিয়ে পড়ে তাকে তরবারী দ্বারা দু’টুকরো করে দেন।

নাবী (ﷺ) এ আশাজনক দৃশ্য দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং উচ্চৈঃস্বরে তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তাঁর দেখাদেখি সাহাবীগণও তকবীর পাঠ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুবাইর (রাঃ)-এর প্রশংসা করে বলেন,

‏(‏إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوَارِياً، وَحَوَارِيْ الزُّبَيْرُ‏)‏

‘প্রত্যেক নাবীরই একজন সহচর থাকেন আর আমার সহচর হলেন যুবাইর (রাঃ)।’[1]

[1] সা’হিরে সীরাত হালাবিয়াহ এটা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাদীসে সমূহে এ বাক্যটি অন্য স্থলে উল্লেখিত আছে।


উহুদ যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল এবং পতাকাবাহকদের প্রাণনাশ

এরপর চতর্দিক হতে যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে এবং সারাটা ময়দানে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুশরিকদের পতাকা প্রতিষ্ঠিত ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে। বনু আবদিদ্দার নিজেদের কমান্ডার ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহর হত্যার পর একের পর এক পতাকাধারণ করতে থাকে। কিন্তু তারা সবাই নিহত হয়। সর্বপ্রথম ত্বালহাহর ভাই উসমান ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উঠিয়ে নেন এবং নিম্নের ছন্দ পাঠ করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হয় :

إنَّ عَلٰى أهْل اللوَاء حقــاً ** أن تُخْضَبَ الصَّعْدَة أو تَنْدَقَّا

অর্থ : ‘পতাকাধারীদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, তাদের পতাকা রক্তে রঞ্জিত হবে অথবা ছিঁড়ে যাবে।’

এ ব্যক্তিকে হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) আক্রমণ করেন এবং তাঁর কাঁধে এমন জোরে তরবারীর আঘাত করেন যে, ওটা তার হাতসহ কাঁধ কেটে দেয় এবং দেহ ভেদ করে নাভি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এমন কি ফুসফুসও দেখতে পাওয়া যায়।

এরপর আবূ সা‘দ ইবনু আবী ত্বালহাহ ঝান্ডা উঠিয়ে নেয়। তার উপর সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) তীর চালিয়ে দেন এবং ওটা ঠিক তার গলায় লেগে যায়, ফলে তার জিহবা বেরিয়ে আসে এবং তৎক্ষণাৎ সে মৃত্যুবরণ করে।

কিন্তু কোন কোন জীবনী লেখকের উক্তি হল, আবূ সা‘দ বাইরে বেরিয়ে এসে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ডাক দেয় এবং আলী (রাঃ) অগ্রসর হয়ে তার মোকাবালা করেন। উভয়ে একে অপরের উপর তরবারীর আঘাত করে। কিন্তুু আলী (রাঃ)-এর তরবারীর আঘাতে আবূ সা‘দ নিহত হয়।

এরপর মুসাফে‘ ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উঠিয়ে ধরে। কিন্তু আ’সিম ইবনু সা’বিত ইবনু আবী আফলাহ (রাঃ) তাঁকে তীর মেরে হত্যা করেন। তারপর তার ভাই কিলাব ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ ঝান্ডা তুলে ধরে। কিন্তু যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ) তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার প্রাণ নাশ করেন। অতঃপর ঐ দুজনের ভাই জিলাস ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উত্তোলন করে। কিন্তু ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) তীর মেরে তার জীবন শেষ করে দেন। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, আ’সিম ইবনু সাবিত ইবনু আবী আফলাহ (রাঃ) তীর মেরে তাকে খতম করে দেন।
এরা একই পরিবারের ছয় ব্যক্তি ছিল। অর্থাৎ সবাই আবূ ত্বালহাহ আব্দুল্লাহ ইবনু উসমান ইবনু আবদিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র ছিল, যারা মুশরিকদের ঝান্ডার হিফাযত করতে গিয়ে মারা পড়ল। এরপর বনু আবদিদ্দার গোত্রের আরতাত ইবনু শুরাহবীল নামক আর একটি লোক পতাকা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) এবং মতান্তরে হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। অতঃপর শুরাইহ ইবনু ক্বারিয পতাকা তুলে ধরে। কিন্তু কুযমান তাতে হত্যা করে। কুযমান মুনাফিক্ব ছিল এবং ইসলামের পরিবর্তে গোত্রীয় মর্যাদা রক্ষার উত্তেজনায় যুদ্ধ করতে এসেছিল।

শুরাইহর পর আবূ যায়দ ‘আমর ইবনু আবদি মানাফ আবদারী পতাকা সামলিয়ে নেয়। কিন্তু তাকেও কুযমান হত্যা করে ফেলে। তারপর শুরাহবীল ইবনু হাশিম আবদারীর এক পুত্র ঝান্ডা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু কুযমানের হাতে সেও মারা পড়ে।

বনু আবদিদ্দার গোত্রের এ দশ ব্যক্তি, যারা মুশরিকদের পতাকা উঠিয়েছিল, সবাই মারা গেল। এরপর গোত্রের কোন লোকই জীবিত থাকল না যে পতাকা উঠাতে পারে। কিন্তু ঐ সময় ‘সওয়াব’ নামক তাদের এক হাবসী গোলাম লাফিয়ে গিয়ে পতাকা উঠিয়ে নেয় এবং তার পূর্ববর্তী পতাকাবাহী মনিবদের চেয়েও বেশী বল বিক্রমে যুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত এক এক করে তার হাত দ’ুটি কর্তিত হয়। কিন্তু এর পরেও সে পতাকা পড়তে দেয় নি। বরং নিজের হাঁটুর ভরে বসে বক্ষ ও কাঁধের সাহায্য পতাকা খাড়া করে রাখে। অবশেষে সে কুযমানের হাতে নিহত হয়। ঐ সময়েও সে বলছিল, ‘হে আল্লাহ! এখন তো আমি কোন ওযর বাকী রাখি নি!’ ঐ গোলাম অর্থাৎ সওয়াব নিহত হওয়ার পর পতাকা ভূমির উপর পড়ে যায় এবং ওটা উঠাতে পারে এমন কেউই বেঁচে রইল না। এ কারণে ওটা পড়েই রইল।

উহুদ যুদ্ধের সার্বিক অবস্থা

একদিকে মুশরিকদের পতাকা যুদ্ধের কেন্দ্রস্থলে প্রতিষ্ঠিত ছিল, অন্য দিকে যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যান্য অংশসমূহেও কঠিন যুদ্ধ চলছিল। মুসলিমগণের সারিসমূহের উপর ঈমানের রূহ ছেয়ে ছিল। এ কারণে তারা মুশরিক ও কাফির সৈন্যদের উপর ঐ জলপ্লাবনের মতো ভেঙ্গে পড়ছিলেন যার সামনে কোন বাঁধ টিকে থাকে না। এ সময় মুসলিমরা ‘আমিত’, ‘আমিত’ (মেরে ফেল, মেরে ফেল) বলছিলেন এবং এ যুদ্ধে এটাই তাঁদের নিদর্শনের রীতি ছিল।

এদিকে আবূ দুজানাহ (রাঃ) তার লাল পাগড়ী বেঁধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তরবারী উঠিয়ে নেন এবং ওর হক আদায় করার দূঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন ও যুদ্ধ করতে করতে বহু দূর পর্যন্ত ঢুকে পড়েন। যে মুশরিকের সাথেই তাঁর মোকাবালা হতো তাঁকেই তিনি হত্যা করে ফেলতেন। তিনি মুশরিকদের সারিগুলো উলট-পালট করে দেন।

যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘যখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তরবারী চাই এবং তিনি আমাকে তা না দেন তখন আমার অন্তরে চোট লাগে। আমি মনে মনে চিন্তা করি যে, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ফুফু সাফিয়্যাহর পুত্র এবং একজন কুরাইশ। আমি তাঁর নিকট গিয়ে আবূ দুজানার (রাঃ) পূর্বেই তরবারী চাই।’

কিন্তু তিনি আমাকে তা না দিয়ে আবূ দুজানা (রাঃ)-কে দিয়ে দেন। এ জন্য আমি আল্লাহর নামে শপথ করি যে, আবূ দুজানা (রাঃ) তরবারী দ্বারা কী করেন তা আমি অবশ্যই দেখব। সুতরাং আমি তাঁর পিছনে পিছনে থাকতে লাগলাম। দেখি যে, তিনি তার লাল পাগড়ীটি বের করে মাথায় বেঁধে নিলেন। তাঁর এ কাজ দেখে আনসারগণ মন্তব্য করলেন, ‘আবূ দুজানা (রাঃ) মৃত্যুর পাগড়ী বেঁধেছেন।’ অতঃপর তিনি নিম্নের কবিতা বলতে বলতে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলেন:

أنا الذي عاهـدني خليلي ** ونحـن بالسَّفْح لدى النَّخِيل

ألا أقوم الدَّهْرَ في الكَيول ** أضْرِبْ بسَيف الله والرسول

অর্থাৎ ‘আমি খেজুর বাগান প্রান্তে আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ অঙ্গীকার করেছি যে, কখনই আমি সারির পিছনে থাকব না, (বরং সামনে অগ্রসর হয়ে) আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-এর তরবারী চালনা করব।’
এরপর তিনি যাকেই সামনে পেতেন তাকে হত্যা করে ফেলতেন। এ দিকে মুশরিকদের মধ্যেও একজন লোক ছিল যে আমাদের কোন আহতকে পেলেই তাকে শেষ করে ফেলত। এ দুজন ক্রমে ক্রমে নিকটবর্তী হতে যাচ্ছিল। আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করলাম যে, যেন তাদের দুজনের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়। ঘটনা ক্রমে হলোও তাই। উভয়ে একে অপরের উপর আঘাত হানল। কিন্তু আবূ দুজানা (রাঃ) এ আক্রমণ ঢাল দ্বারা প্রতিরোধ করলেন এবং মুশরিকের তরবারী ঢালে আটকে থেকে গেল। এরপর তিনি ঐ মুশরিকের উপর তরবারীর আক্রমণ চালালেন এবং সেখানেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।[১]

এরপর আবূ দুজানাহ (রাঃ) মুশরিকদের সারিগুলো ছিন্ন-ভিন্ন করতে করতে সামনে এগিয়ে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত কুরাইশী নারীদের নেত্রী পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। কিন্তু সে যে নারী এটা তাঁর জানা ছিল না। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেছেন, ‘আমি একটি লোককে দেখলাম যে, সে খুব জোরে শোরে মুশরিক সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করছে। সুতরাং আমি তাকে আমার নিশানার মধ্যে নিয়ে ফেললাম। কিন্তু যখন আমি তাঁকে তরবারী দ্বারা আক্রমণ করার ইচ্ছা করলাম তখন সে হায়! হায়! চিৎকার করে উঠল। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, সে একজন মহিলা। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তরবারী দ্বারা একজন মহিলাকে হত্যা করে তা কলংকিত করলাম না।’

এ মহিলাটি ছিল হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ। আমি আবূ দুজানা (রাঃ)-কে দেখলাম যে, তিনি হিন্দা বিনতু ‘উতবাহর মাথার মধ্যভাগে তরবারী উঁচু করে ধরলেন এবং পরক্ষণেই সরিয়ে নিলেন। আমি বললাম আল্লাহ এবং তার রাসূলই (ﷺ) ভাল জানেন।[২]

এদিকে হামযাহও (রাঃ) সিংহের ন্যায় বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন এবং মধ্যভাগের সেনাবাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়ছিলেন। তাঁর সামনে মুশরিকদের বড় বড় বীর বাহাদুরেরা টিকতে পারছিল না। কিন্তু বড়ই আফসোসের কথা, এ ক্ষেত্রে তিনিও শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু তাঁকে সামনা সামনি বীর পুরুষের মতো শহীদ করা হয় নি বরং কাপুরুষের মতো গুপ্তভাবে শহীদ করা হয়েছিল।

তথ্যসূত্রঃ
[১] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬৮-৬৯ পৃঃ।
[২] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৬৯ পৃঃ।





******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url