মা’আরেফুল কোরআন-১৯ || সূরা আল-বাকারাহ, আয়াতঃ ৩৭-৩৯ || বাকারাহ ৩৭-৩৯ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৩৭-৩৯


بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

فَتَلَقّٰۤی اٰدَمُ مِنۡ رَّبِّهٖ کَلِمٰتٍ فَتَابَ عَلَیۡهِ ؕ اِنَّهٗ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ ﴿۳۷
 قُلۡنَا اهۡبِطُوۡا مِنۡهَا جَمِیۡعًا ۚ فَاِمَّا یَاۡتِیَنَّکُمۡ مِّنِّیۡ هُدًی فَمَنۡ تَبِعَ هُدَایَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ﴿۳۸
 وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۳۹

সূরা আল-বাকারাহ ৩৭-৩৯নং আয়াতের অর্থ

(৩৭) অতঃপর হযরত আদম (আ) স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি (করুণাভরে) লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু। (৩৮) আমি হুকুম করলাম, তোমরা সবাই নীচে নেমে যাও। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন হেদায়েত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হেদায়েত অনুসারে চলবে, তার উপর না কোন ভয় আসবে, না (কোন কারণে) তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্তপ্ত হবে। (৩৯) আর যে লোক তা অস্বীকার করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী, অনন্তকাল সেখানে থাকবে।

সূরা আল-বাকারাহ ৩৭-৩৯নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

অতঃপর হযরত আদম (আ) তাঁর পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, (অর্থাৎ বিনয় ও অক্ষমতা প্রকাশক বাক্য যা আল্লাহ পাকের নিকট থেকেই লাভ করেছিলেন। হযরত আদম (আ)-এর অনুশোচনার কারণে আল্লাহ পাকের রহমত ও কৃপাদৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলো এবং তিনি নিজেই বিনয় ও প্রার্থনারীতি সম্বলিত বাক্যাবলী তাঁকে শিখিয়ে দিলেন।) তখন আল্লাহ পাক তাঁর দিকে করুণার সাথে লক্ষ্য করলেন। আল্লাহ পাক নিঃসন্দেহে তওবা কবূলকারী এবং অতি মেহেরবান। (হযরত হাওয়া [আ]-এর তওবার বিবরণ সূরা আ'রাফে বর্ণিত রয়েছে।  قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا اَنْفُسَنَا (তাঁরা উভয়ে বললেন, হে মহান পরওয়ারদেগার, আমরা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি)-এর দ্বারা বোঝা গেল যে, তিনিও তওবা ও তওবা কবুলের ক্ষেত্রে হযরত আদমের সাথে শরীক ছিলেন। কিন্তু ক্ষমা করার পরেও পৃথিবীতে নেমে যাওয়ার নির্দেশ রহিত হলো না, তাতে বহু রহস্য ও মঙ্গল নিহিত ছিল । অবশ্য এর রূপ পাল্টে গেল। কেননা প্রথমবারে পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশ ছিল শাসকোচিত -শাস্তিরূপে। আর এবারকার নির্দেশ ছিল অসীম তত্ত্ব ও রহস্যবিদ ও মহাজ্ঞানীসুলভ পদ্ধতিতে। তাই এরশাদ হলো, 'আমি তাঁদের সবাইকে জান্নাত থেকে নিচে নেমে যেতে বললাম। পরে যদি তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে কোন হেদায়েত (অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে কোন শরীয়তী বিধানমালা) পৌঁছে, তখন যে ব্যক্তি আমার এ হেদায়েতের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয়ের কারণ নেই এবং পরিণামে এরা সত্তাগ্রস্ত হবে না।' (অর্থাৎ তারা কোন ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হবে না। অবশ্য কিয়ামতের বিভীষিকাময় ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ভীত ও সন্ত্রস্ত হওয়া এর পরিপন্থী নয়। যেমন, সহীহ হাদীসে আছে যে, কিয়ামতের ভয় ও ত্রাস সাধারণভাবে সবার উপরই নিপতিত হবে। কোন বিপদাপদে আক্রান্ত হলে মনের যে অবস্থা হয়, তাকে حزن [হুযন) বলা হয়। আর حزن (ভয়) সর্বদা বিপদে নিপতিত হওয়ার পূর্বে সঞ্চারিত হয়। এখানে আল্লাহ পাক ভয় ও সন্তাপ উভয়ই নিষেধ করে দিয়েছেন। কেননা, তাদের উপর এমন কোন বিপদাপদ বা দুঃখ-কষ্ট আপতিত হবে না, যার কারণে তারা ভীত বা শংকাগ্রস্ত হতে পারে)। আর যারা কুফরী করবে এবং আমার বিধানমালাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে প্রয়াস পাবে তারা জাহান্নামবাসী হবে এবং অনন্তকাল সেখানে অবস্থান করবে। 

সূরা আল - বাকারাহ ৩৭-৩৯নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

আয়াতসমূহের পূর্বাপর সম্পর্ক: পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে শয়তানের প্রবঞ্চনা, হযরত আদম (আ)-এর পদস্খলন এবং পরিণতিস্বরূপ জান্নাত থেকে বের হয়ে পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশের বিবরণ ছিল । হযরত আদম (আ) ইতিপূর্বে কখনও এ ধরনের শাসন ও কোপদৃষ্টির সম্মুখীন হননি। তিনি এমন পাষাণচিত্তও ছিলেন না যে, বেমালুম তা সয়ে যেতে পারেন। তাই চরমভাবে বিচলিত হয়ে মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। কিন্তু নবীসুলভ প্রজ্ঞাদৃষ্টি এবং সে কারণে চরমভাবে সঞ্চারিত ভীতির দরুন মুখ থেকে কোন কথাই বের হচ্ছিল না। ক্ষমা ভিক্ষা মর্যাদার পরিপন্থী বিবেচিত হয়ে অধিক শান্তি ও কোপানলের কারণরূপে পরিগণিত হতে পারে এমন আশংকায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও হতবাক হয়ে বসে থাকেন। মহান আল্লাহ্ অন্তর্যামী এবং অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাময়। এ করুণ অবস্থা দেখে স্বতঃপ্রণো হয়ে আল্লাহ্ পাক ক্ষমা প্রার্থনা রীতিসম্বলিত কয়েকটি বচন তাঁদেরকে শিখিয়ে দিলেন। তারই বর্ণনা এ আয়াতসমূহে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, হযরত আদম (আ) স্বীয় প্রভুর কাছ থেকে কয়েকটি শব্দ লাভ করলেন। অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁদের প্রতি করুণাভরে লক্ষ্য করলেন। (অর্থাৎ তাঁদের তওবা গ্রহণ করে নিলেন, নিঃসন্দেহে তিনি মহা ক্ষমাশীল এবং অতি মেহেরবান।) কিন্তু যেহেতু পৃথিবীতে আগমনের মধ্যে আরও অনেক রহস্য ও কল্যাণ নিহিত ছিল যেমন, তাঁদের বংশধরদের মধ্য থেকে ফেরেশতা ও জ্বিন জাতির মাঝে এক নতুন জাতি-'মানব' জাতির আবির্ভাব ঘটা, তাদেরকে এক ধরনের কর্ম স্বাধীনতা দিয়ে তাদের প্রতি শরীয়তী বিধান প্রয়োগের যোগ্য করে গড়ে তোলা, বিশ্বে আল্লাহ্র খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীর শান্তি বিধান, শরীয়তী আইন ও নির্দেশাবলী প্রবর্তন। এই নতুন জাতি উন্নতি সাধন করে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়ে এমন এক স্তরে পৌঁছবে, যা ফেরেশতাদের সম্পূর্ণ নাগালের বাইরে। এসব উদ্দেশ্য সম্পর্কে আদম সৃষ্টির পূর্বে বর্ণনা করে দেওয়া হয়েছিল।

এজন্য অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়ার পরও পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশ রহিত করা হয়নি, অবশ্য তার রূপ পাল্টে দেওয়া হয়েছে। আর এখানকার এ নির্দেশ মহাজ্ঞানী ও রহস্যবিদসুলভ এবং পৃথিবীতে আগমন আল্লাহর খেলাফতের সম্মানসূচক। পরবর্তী আয়াতসমূহে উক্ত পদ-সংশ্লিষ্ট সেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহ্ পাকের একজন খলীফা হিসাবে তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল। এজন্য পৃথিবীতে অবতণের নির্দেশ পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে, আমি তাদের সবাইকে নিচে নেমে যেতে নির্দেশ দিলাম। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন পথ নির্দেশ বা হেদায়েত (অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে শরীয়তী বিধান) আসে, তখন যেসব লোক আমার সে হেদায়েতের অনুসরণ করবে, তাদের না থাকবে কোন ভয়, না তারা সন্তপ্ত হবে। (অর্থাৎ কোন অতীত বস্তু হারাবার গ্লানি থাকবে না এবং ভবিষ্যতে কোন কষ্টের আশংকা থাকবে না।)

تَلَقّٰۤی  শব্দের অর্থ আগ্রহ ও উৎসাহসহ কাউকে সংবর্ধনা জানানো এবং তাকে গ্রহণ করা । এর মর্ম এই যে, আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে যখন তাঁদেরকে তওবার বাক্যগুলো শিখিয়ে দেওয়া হলো, তখন হযরত আদম (আ) যথোচিত মর্যাদা ও গুরুত্বসহ তা গ্রহণ করলেন।

كَلِمَاتِ তথা যে সব বাক্য হযরত আদমকে তওবার উদ্দেশ্যে বলে দেওয়া হয়েছিল, তা কি ছিল। এ সম্পর্কে মুফাসির সাহাবীদের কয়েক ধরনের রেওয়ায়েত রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাসের অভিমতই এক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, যা কোরআন মজীদের অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে- رَبِّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخُسِرِينَ অর্থাৎ হে আমাদের পরওয়ারদেগার! আমরা আমাদের নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পরিগণিত হয়ে যাব।
تَوْبَةٌ  - تَابَ  (তওবা)-এর প্রকৃত অর্থ, ফিরে আসা। যখন তওবার সম্বন্ধ মানুষের সঙ্গে হয়, তখন তার অর্থ হবে তিনটি বস্তুর সমষ্টিঃ

১. কৃত পাপকে পাপ মনে করে সেজন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া।
২. পাপ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা ।
৩. ভবিষ্যতে আবার এরূপ না করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা ।

এ তিনটি বিষয়ের যে কোন একটির অভাব থাকলে তওবা হবে না। সুতরাং বোঝা গেল যে, মৌখিকভাবে আল্লাহ্ তওবা' বা অনুরূপ শব্দ উচ্চারণ করা নাজাত লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। অতীতের পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, বর্তমানে তা পরিহার করা এবং ভবিষ্যতে না করার সংকল্প গ্রহণ-এই তিনটি বিষয়ের সমাবেশ না ঘটা পর্যন্ত তওবা হবে না। تَابَ عَلَيْهِ মধ্যে তওবার সম্বন্ধ আল্লাহর সাথে। এর অর্থ তওবা গ্রহণ করা।

প্রথম যুগের কোন কোন মনীষীর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কারো দ্বারা পাপ সংঘটিত হলে সে কি করবে? উত্তরে বলা হয়েছিল যে, তাই করবে যা আদি পিতামাতা হযরত আদম ও হাওয়া (আ) করেছিলেন। অনুরূপভাবে হযরত মূসা (আ) নিবেদন করেছিলেন- رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي (হে আমার পরওয়াদিগার, আমি আমার নফসের উপর অত্যাচার করেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন) হযরত ইউনুস (আ) পদস্খলনের পর নিবেদন করেন ? لّا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ অর্থাৎ হে আল্লাহ, তুমি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। তুমি অতি পবিত্র। আমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছি। 

জ্ঞাতব্যঃ হযরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর দ্বারা যে ইজতেহাদগত বিচ্যুতি বা ত্রুটি সাধিত হয়েছিল, প্রথমত কোরআন করীম তার সম্বন্ধ উভয়ের সাথে করেেেছ। বলা হয়েছে, فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيْطَٰنُ عَنْهَا فَأَخْرَجَهُمَا  (অতঃপর শয়তান উভয়কে পদস্খলিত করে দেয়)।

পৃথিবীতে অবতরণের হুকুমকেও হযরত হাওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়েছে, اهْبِطُو (তোমরা নেমে যাও)। কিন্তু পরে তওবা ও তা কবুলের ক্ষেত্রে একবচন ব্যবহার করে শুধু হযরত আদম (আ)-এর উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত হাওয়ার উল্লেখ নেই। এছাড়া অন্যত্রও এ পদস্খলন প্রসঙ্গে শুধু হযরত আদম (আ)-এর উল্লেখ করা হয়েছে- عَصَى أَدَمُ অর্থাৎ আদম (আ) স্বীয় পালনকর্তার হুকুম লঙ্ঘন করলেন।

এর কারণ হয়তো আল্লাহ্ তা'আলা নারী জাতির প্রতি বিশেষ রেয়াত প্রদর্শন করে হযরত হাওয়ার বিষয়টি গোপন রেখেছেন এবং পাপ ও ভর্ৎসনার ক্ষেত্রে সরাসরি তাঁর উল্লেখ করেন নি। এক জায়গায় উভয়ের তওবার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

..... رَبَّنَا ظَلَمْنَا (হে আমাদের প্রভু, আমরা আমাদের নফসের উপর জুলুম করেছি)। এ ব্যাপারে কারো সংশয় থাকা উচিত নয় যে, হযরত হাওয়ার অপরাধও ক্ষমা হয়েছে। এছাড়া স্ত্রী যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের অধীন, সুতরাং স্বতন্ত্রভাবে তাঁর (হাওয়ার) উল্লেখের প্রয়োজনবোধ করা হয় নি। (কুরতুবী)

'তওয়াব' ও 'তায়েবের পার্থক্য

ইমাম কুরতুবীর মতে تَوَّابٌ (তাওয়ার) শব্দের সম্বন্ধ মানুষের সাথেও হতে পারে, إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ যেমন, هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ (নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক তওবাকারীদের পছন্দ করেন)।  যখন শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয়, পাপ থেকে পুণ্য ও আনুগত্যের প্রতি প্রত্যাবর্তন করা। আর যখন আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তখন অর্থ হয় তওবা কবুল করা। সমার্থবোধক অপর শব্দ تَائبُ-এর ব্যবহার আল্লাহ্ পাকের ক্ষেত্রে জায়েয নয়। যদিও আভিধানিক অর্থে ভুল নয়, কিন্তু আল্লাহ্ পাক সম্পর্কে শুধু সে সমস্ত গুণবাচক শব্দ ও উপাধির ব্যবহাই বৈধ, যেগুলো কোরআন ও হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। অন্যান্য শব্দ যদিও অর্থগতভাবে ঠিক, কিন্তু আল্লাহ্ পাকের জন্য তার ব্যবহার বৈধ নয় ।

তওবা গ্রহণের অধিকার আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নেই

এ আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তওবা গ্রহণের অধিকারী আল্লাহ্ পাক ব্যতীত অন্য কেউ নয়। খ্রীস্টান ও ইহুদীরা এক্ষেত্রে মারাত্মক ভুলের শিকার হয়ে পড়েছে। তারা পাদ্রী পুরোহিতদের কাছে গিয়ে কিছু হাদিয়া উপঢৌকনের বিনিময়ে পাপ মোচন করিয়ে নেয় এবং মনে করে যে, তারা মাফ করে দিলেই আল্লাহ্র কাছেও মাফ হয়ে যায়। বর্তমানে বহু মুসলমানও এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ করে। অথচ কোন পীর বা আলেম কারো পাপ মোচন করিয়ে দিতে পারেন না : তাঁরা বড়জোর দোয়া করতে পারেন।

হযরত আদম (আ)-এর পৃথিবীতে অবতরণ শাস্তিস্বরূপ নয়, বরং এক বিশেষ উদ্দেশ্যের পূর্ণতা সাধনের জন্যঃ
قُلۡنَا اهۡبِطُوۡا مِنۡهَا جَمِیۡعًا (তোমরা জান্নাত থেকে নেমে যাও)-এর পূর্ববর্তী আয়াতেও জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশ ছিল। এখানে পুনরায় এর উল্লেখ করার মাঝে সম্ভবত এ উদ্দেশ্যই নিহিত রয়েছে যে, প্রথম আয়াতে পৃথিবীতে অবতরণের হুকুম ছিল শান্তিমূলক। সেই জন্যই তার সাথে সাথে মানবের পারস্পরিক শত্রুতারও বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এখানে পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশে বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। আর তা হলো বিশ্বে আল্লাহর খেলাফতের পূর্ণতাসাধন। এজন্য এর সাথে হেদায়েত প্রেরণার উল্লেখও রয়েছে, যা আল্লাহর খেলাফতের পদগত কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এতে বোঝা গেল যে, পৃথিবীতে অবতরণের প্রথম নির্দেশটি যদিও শাস্তিমূলক ছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হলো, তখন অন্যান্য মঙ্গল ও হেকমতসমূহের বিবেচনায় পৃথিবীতে প্রেরণের হুকুমের রূপ পরিবর্তন করে মূল হুকুম বহাল রাখা হলো এবং তাদের অবতরণ হলো বিশ্বের শাসক ও খলীফা হিসাবে। এটা সে হিকমত ও রহস্য, আদম সৃষ্টির পূর্বেই ফেরেশতাদের সাথে যার আলোচনা করা হয়েছিল অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে তাঁর খলীফা পাঠাতে হবে।

শোক-সন্তাপ থেকে শুধু তারাই মুক্তি পেতে পারে যারা আল্লাহ্র বাধ্য ও অনুগত

فَمَنْ تَبِعَ هُدَى فَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ .

(যারা আমার হেদায়েতের অনুসরণ করবে, তাদের আশংকা নেই এবং কোন চিন্তাও করতে হবে না।) এ আয়াতে আসমানী হেদায়েতের অনুসারিগণের জন্য দু'ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমত তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং দ্বিতীয়ত তারা চিন্তাগ্রস্ত হবে না।

خَوْفٌ আগত দুঃখ-কষ্টজনিত আশংকার নাম। আর حُزْنٌ বলা হয় কোন উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার কারণে সৃষ্ট গ্লানি ও দুশ্চিন্তাকে। লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, এ দু'টি শব্দে যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে এমনভাবে কেন্দ্রীভূত করে দেয়া হয়েছে যে, স্বাচ্ছন্দের এক বিন্দুও এর বাইরে নেই । অতঃপর এ দু'টি শব্দের মধ্যে তত্ত্বগত ব্যবধানও রয়েছে। এখানে لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ-এর ন্যায় لَاحُزْنٌ عَلَيْهِمْ না বলে ক্রিয়াবাচক শব্দ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ এর ব্যবহারের মধ্যে এ ইঙ্গিতই রয়েছে যে, কোন উদ্দেশ্য সফল না হওয়াজনিত গ্লানি ও দুশ্চিন্তা থেকে শুধু তাঁরাই মুক্ত থাকতে পারেন, যাঁরা আল্লাহর ওলীর স্তরে পৌঁছতে পেরেছেন। যাঁরা আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়েতসমূহের পূর্ণ অনুসরণকারী, তাঁরা ছাড়া অন্য কোন মানুষ এ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। তা সে সারা বিশ্বের রাজাধিরাজই হোন বা সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তিই হোন। কেননা এদের মধ্যে কেউই এমন নন, যাঁর স্বভাব এ ইচ্ছাবিরুদ্ধ কোন অবস্থার সম্মুখীন হবেন না এবং সেজন্য দুশ্চিন্তায় লিপ্ত হবেন না। অপরপক্ষে আল্লাহর ওলীগণ নিজের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে আল্লাহ্র ইচ্ছার মাঝে বিলীন করে দেন। এজন্য কোন ব্যাপারে তাঁরা সফলকাম না হলে মোটেও বিচলিত হন না । কোরআন মজীদের অন্যত্র একথা প্রকাশ করা হয়েছে যে, বিশিষ্ট জান্নাতবাসীদের অবস্থা হবে এই যে, তাঁরা জান্নাতে পৌঁছার পর আল্লাহর সেসব নেয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায় করবেন, যার দ্বারা তিনি তাঁদের সন্তাপ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছেন। الحَمْدُ للهِ الَّذِي اذْهَبَ عَنَّا الْحَزْنَ (সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ্ পাকের জন্য, যিনি আমাদেরকে দুশ্চিন্তামুক্ত করেছেন।) এতে বোঝা গেল যে, এ দুনিয়ায় কোন না কোন চিন্তা থাকা মানুষের জন্য অবশ্যাম্ভাবী। শুধু তাঁরাই এর ব্যতিক্রম, যাঁরা আল্লাহ্ পাকের সাথে নিজেদের সম্পর্ক পরিপূর্ণ ও সুদৃঢ় করে নিয়েছেন।
এই আয়াতে আল্লাহওয়ালাদের যাবতীয় ভয়ভীতি ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার অর্থ, পার্থিব কোন কষ্ট বা আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের মনে কোন ভয় বা দুশ্চিন্তার উদ্রেক হবে না। পরকালের চিন্তাভাবনা ও আল্লাহর ভয় তো অন্যদের চাইতে তাঁদের আরো বেশি হয়ে থাকে। এজন্য হুযুরে পাক (সা) সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি অধিকাংশ সময় চিন্তাগ্রস্ত ও বিচলিত থাকতেন। তাঁর এই চিন্তা-ভাবনা পার্থিব বস্তু হারাবার কারণে বা কোন বিপদের আশংকায় ছিল না, বরং তা ছিল আল্লাহর ভয় ও উম্মতের কারণে।

এতে একথা বোঝা যায় না যে, দুনিয়াতে যেসব জিনিসের ভয়ংকর বলে মনে করা হয়, সেগুলো মানবিক রীতি অনুসারে নবী ও ওলীগণের স্বাভাবিক ভয়ের উদ্রেক করবে না। কেননা যখন মূসা (আ)-এর সামনে লাঠি সাপের রূপ ধারণ করল, যখন তাঁর ভয় পাওয়ার কথা কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خَيْفَةً موى (হযরত মূসার মনে ভয়ের সঞ্চার করল) কেননা স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত এ ভয় মূসা (আ)-এর মধ্যে প্রথম অবস্থাতেই ছিল । যখন আল্লাহ পাক বলেন, لا تَخَفْ (ভয় পেও না), তখন সে ভয় সম্পূর্ণভাবে চলে গেল ।

অবশ্য এ ব্যাখ্যাও দেওয়া যেতে পারে যে, হযরত মুসা (আ)-এর এ ভয় সাধারণ মানুষের ভয়ের এ কারণে ছিল না যে, সাপ কোন কষ্ট দিতে পারে, বরং এ কারণে ছিল যে, না জানি বনী ইসরাঈল এর দ্বারা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং এ ভয়ও পরকাল সংক্রান্তই ছিল। শেষ আয়াত وَالَّذِينَ كَفَرُو (এবং যারা কুফরী করেছে)-এর দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে যে, যারা আল্লাহ্ প্রেরিত হেদায়েতের অনুসরণ করবে না। অনন্তকালের জন্য তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। এর উদ্দেশ্য সে সব লোক, যারা এ হেদায়েতকে হেদায়েত মনে করতে বা তার অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে অর্থাৎ-কাফিরগণ। কেননা মু'মিনগণ যারা হেদায়েতকে হেদায়েত বলে মনে করে তারা কার্যত যত পাপীই হোক, নিজের পাপের শান্তি ভোগ করে অবশেষে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে।




**********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url