মা’আরেফুল কোরআন-২০ || সূরা আল-বাকারাহ, আয়াতঃ ৪০-৪২ || বাকারাহ ৪০-৪২ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৪০-৪২

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
 یٰبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتِیَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ وَ اَوۡفُوۡا بِعَهۡدِیۡۤ اُوۡفِ بِعَهۡدِکُمۡ ۚ وَ اِیَّایَ فَارۡهَبُوۡنِ ﴿۴۰
وَ اٰمِنُوۡا بِمَاۤ اَنۡزَلۡتُ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَکُمۡ وَ لَا تَکُوۡنُوۡۤا اَوَّلَ کَافِرٍۭ بِهٖ ۪ وَ لَا تَشۡتَرُوۡا بِاٰیٰتِیۡ ثَمَنًا قَلِیۡلًا ۫ وَّ اِیَّایَ فَاتَّقُوۡنِ ﴿۴۱
 وَ لَا تَلۡبِسُوا الۡحَقَّ بِالۡبَاطِلِ وَ تَکۡتُمُوا الۡحَقَّ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۲

সূরা আল-বাকারাহ ৪০-৪২নং আয়াতের অর্থ

(৪০) হে বনী-ইসরাঈলগণ, তোমরা স্মরণ কর আমার সে অনুগ্রহ, যা আমি তোমাদের প্রতি করেছি এবং তোমরা পূরণ কর আমার সাথে কৃত প্রতিজ্ঞা, তাহলে আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করব। আর ভয় কর আমাকেই। (৪১) আর তোমরা সে গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, যা আমি অবতীর্ণ করেছি সত্য বক্তা হিসাবে তোমাদের কাছে। বস্তুত তোমরা তার প্রাথমিক অস্বীকারকারী হয়ো না আর আমার আয়াতের অল্প মূল্য দিও না। এবং আমার (আযাব থেকে বাঁচ। (৪২) তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিলিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে তোমরা গোপন করো না ।

সূরা আল-বাকারাহ ৪০-৪২নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

হে বনী-ইসরাঈল (অর্থাৎ হযরত ইয়াকুবের সন্তানগণ) ! তোমরা আমার অনুকম্পাসমূহের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদের প্রতি প্রদর্শন করেছি, (যাতে নেয়ামতের হক অনুধাবন করে ঈমান গ্রহণ করা তোমাদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়। এ স্মরণ করার মর্ম বর্ণনা করা হচ্ছে :) এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পূরণ কর (অর্থাৎ তওরাত গ্রন্থে তোমরা আমার সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলে, যার বর্ণনা কোরআনের এ আয়াতে রয়েছে-
وَلَقَدْ أَخَذَ الله ميثاق بني إسراءيل وبعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَى عَشَرَ نَقِيباً .

এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ পার্ক বনী-ইসরাঈল থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। আর আমি তাদের মধ্য থেকে বারঞ্জন দলপতি মনোনীত করে প্রেরণ করলাম। আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করব। (অর্থাৎ ঈমান গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে আমি তোমাদের সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলাম-যেমন উল্লিখিত আয়াতের শেষাংশে আছে- لَا كَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيَأْتِكُمْ [তোমাদের পাপসমূহ মুছে দেবো] এবং শুধু আমাকেই ভয় কর। এ কথা ভেবে (সাধারণ ভক্তদেরকে ভয় করো না যে, তাদের ভক্তি না থাকলে আমদানী বন্ধ হয়ে যাবে।) এবং আমি যে গ্রন্থ নাযিল করেছি (অর্থাৎ কোরআন) তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। এ গ্রন্থ তোমাদের উপর নাযিলকৃত গ্রন্থের সত্যতা বর্ণনাকারী (অর্থাৎ তওরাত যে আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত গ্রন্থ তা সমর্থন করে এবং সত্যতা প্রমাণ করে । অবশ্য এতে পরবর্তীকালে পরিবর্তন সাধন করে যে কৃত্রিম ও অলীক তথ্য সংযোজন করা হয়েছে সেগুলো মূল তওরাত ও ইঞ্জীলের অন্তর্ভুক্তই নয়। সুতরাং এ দ্বারা সেগুলোর [পরিবর্তন করার পর) সংযোজিত অংশের সমর্থন করা বোঝায় না) এবং কোরআনের প্রথম অস্বীকারকারী বলে পরিগণিত হয়ো না। (অর্থাৎ পরবর্তীকালে তোমাদেরকে দেখে যত লোক অস্বীকারকারী হতে থাকবে, তাদের মধ্যে তোমরাই হবে কৃষ্ণ ও অস্বীকারপ্রসূত পাপের প্রথম ভিত্তি স্থাপনকারী। ফলত কিয়ামত পর্যন্ত সবার কুফর ও অবিশ্বাসজনিত পাপের বোঝা তোমাদের আমলনামাভুক্ত হতে থাকবে।) আর আমার শরীয়তের নির্দেশনাবলীর বিনিময়ে তোমরা কোন নগণ্য বন্ধু গ্রহণ করো না এবং বিশেষভাবে শুধু আমাকেই ভয় কর। (অর্থাৎ আমার নির্দেশাবলী পরিত্যাগ করে বা পরিবর্তন করে অথবা গোপন করে সাধারণ জনমণ্ডলীর কাছ থেকে এর বিনিময়ে নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ দুনিয়া গ্রহণ করো না-যেমন তাদের অভ্যাস ছিল যার বিশদ বিবরণ সামনে দেয়া হচ্ছে।) আর সত্যকে অসত্যের সাথে মিশ্রিত করে দিও না এবং জেনে শুনে সত্যকে গোপনও করো না (কেননা সত্য গোপন করা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ)।

সূরা আল-বাকারাহ ৪০-৪২নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

আয়াতসমূহের পূর্বাপর সম্পর্কঃ সূরা বাকারাহ্ কোরআন সংক্রান্ত আলোচনা দিয়ে আরম্ভ করা হয়েছে এবং তাতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, কোরআনের হেদায়েত যদিও গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য ব্যাপক, কিন্তু এর দ্বারা শুধু মু'মিনগণই উপকৃত হবেন। এর পরে যারা এর প্রতি ঈমান আনেনি, তাদের জন্য নির্ধারিত কঠিন শান্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে এক শ্রেণী ছিল সরাসরি কাফির ও অবিশ্বাসীদের। অপর একটা শ্রেণী ছিল মুনাফিক ও কপটদের। উভয় শ্রেণীর যাবতীয় অবস্থা ও কুকীর্তির তালিকাসহ বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অতঃপর মু'মিন, মুশরিক ও মুনাফিক-এই তিন শ্রেণীকে সম্বোধন করেই সবাইকে আল্লাহ্ পাকের ইবাদত ও আরাধনার তাকীদ দেওয়া হয়েছে এবং কোরআন মজীদের অলৌকিক শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে ঈমানের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অতঃপর হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টির ঘটনা বর্ণনা করে তাদের সন্মুখে নিজেদের মূল ভিত্তি ও প্রকৃত স্বরূপ এবং আল্লাহ্ পাকের অনন্য ও পরিপূর্ণ ক্ষমতাসমূহ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করা হয়েছে, যাতে আল্লাহ্ পাকের ইবাদত ও আরাধনার প্রতি আগ্রহ এবং নাফরমানির ব্যাপারে চিন্তার উদ্রেক করে।

অতঃপর প্রকাশ্যে কাফির ও মুনাফিকদের যে দু'টি শ্রেণীর কথা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে-তাদের মধ্যে আবার দু'শ্রেণীর লোক ছিল। এক শ্রেণী পৌত্তলিক মুশরিকদের যারা কেবল পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির অনুসরণ করতো। তারা প্রাচীন ও আধুনিক কোন জ্ঞানেরই অধিকারী ছিল না। সাধারণত ওরা ছিল নিরক্ষর। যেমন, সাধারণ মক্কাবাসী। এজন্য কোরআন পাক এদেরকে 'উম্বিয়ীন' (নিরক্ষর) বলে আখ্যায়িত করেছে।
দ্বিতীয় শ্রেণীটি ছিল তাদের, নবীগণের উপর যারা ঈমান এনেছিল এবং পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহ ; যথা-তওরাত, ইঞ্জীল প্রভৃতির জ্ঞানও তাদের ছিল। ফলে তারা শিক্ষিত ও জ্ঞানী হিসাবে পরিচিত ছিল। এদের মধ্যে কতক হযরত ঈসা (আ)-এর প্রতি ঈমান না এনে মূসা (আ)-এর উপর ঈমান এনেছিল। এদেরকে বলা হতো ইহুদী। আবার কতক হযরত ঈসা (আ)-এর প্রতি ঈমান রাখতো, কিন্তু হযরত মূসা (আ)-কে নবী হিসেবে নিষ্পাপ বলে মনে করতো না। এদেরকে বলা হত 'নাসারা'। এরা আসমানী কিতাব তওরাত বা ইঞ্জীলের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করতো বলে কোরআন এদের উভয়কে আহলে কিতাব (গ্রন্থধারী) বলে আখ্যায়িত করেছে। এরা জ্ঞানী ও শিক্ষিত ছিল বলে সবাই তাদেরকে অত্যন্ত সম্মান করত ও আস্থার নজরে দেখত। এদের কথা সাধারণ মানুষের উপর বিশেষ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত। এরা সার্বিকভাবে পথে এসে গেলে অন্যরাও মুসলমান হয়ে যাবে-এমন একটা আশাবাদ পোষণ করা হতো। মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এদের সংখ্যাই ছিল গরিষ্ঠ।

সূরা বাকারাহ যেহেতু মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে, সুতরাং এতে মুশরিক ও মুনাফিকদের বিবরণের পর যে কোন আসমানী গ্রন্থে বিশ্বাসী আহলে-কিতাবদেরকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে সম্বোধন করা হয়েছে। এ সূরার চল্লিশতম আয়াত থেকে আরম্ভ করে একশত তেইশতম আয়াত পর্যন্ত শুধু এদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। সেখানে তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রথমে তাদের বংশগত কৌলীন্য, বিশ্বের বুকে তাদের যশ-খ্যাতি, মান-মর্যাদা এবং তাদের প্রতি আল্লাহ পাকের অগণিত অনুকম্পাধারার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের পদচ্যুতি ও দুষ্কৃতির জন্য সাবধান করে দেওয়া হয়েছে এবং সঠিক পথের দিকে আহবান করা হয়েছে। প্রথম সাত আয়াতে এসব বিষয়েরই আলোচনা করা হয়েছে। সংক্ষেপে প্রথম তিন আয়াতে ঈমানের দাওয়াত এবং চার আয়াতে সৎকাজের শিক্ষা ও প্রেরণা রয়েছে। তৎপর অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। বিস্তারিত সম্বোধনের সূচনা সমাপ্তিপর্বে গুরুত্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে يَٰبَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ (হে ইসরাঈলের বংশধর!) শব্দসমষ্টি দ্বারা সংক্ষিপ্ত সম্বোধনের সূচনা হয়েছিল, সেগুলোই পুনরুল্লেখ করা হয়েছে।

يَٰبَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ এখানে ইসরাঈল اسرائيل হিব্রু ভাষার শব্দ। এর অর্থ 'আবদুল্লাহ' (আল্লাহ্র দাস)। ইয়াকূব (আ)-এর অপর নাম। কতিপয় উলামায়ে কিরামের মতানুসারে হুযূরে পাক (সা) ব্যতীত অন্য কোন নবীর একাধিক নাম নেই। কেবল- হযরত ইয়াকুব (আ)-এর দু'টি নাম রয়েছে-ইয়াকুব ও ইসরাঈল। কোরআন পাক এক্ষেত্রে তাদেরকে বনী-ইয়াকুব يُبَنيعُقُوبَ বলে সম্বোধন না করে বনী-ইসরাঈল নাম ব্যবহার করেছে। এর তাৎপর্য এই যে, স্বয়ং নিজেদের নাম ও উপাধি থেকেই যেন তারা বুঝতে পারে যে, তারা 'আবদুল্লাহ্' অর্থাৎ আল্লাহর আরাধনাকারী দাসের বংশধর এবং তাঁরই পদাংক অনুসরণ করে চলতে হবে। আয়াতে বনী-ইসরাঈলকে সম্বোধন করে এরশাদ হয়েছে-
“এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পূরণ কর।' অর্থাৎ তোমরা আমার সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলে, তা পূরণ কর। হযরত কাতাদাহ্ (রা)-এর মতে তওরাতে বর্ণিত সে অঙ্গীকারের কথাই কোরআনের এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে-

وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَى عَشَرَ نَقِيباً .

অর্থাৎ-নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক বনী-ইসরাঈল থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন এবং আমি তাদের মাঝ থেকে ১২ জনকে দলপতি নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলাম (সূরা মায়েদাহ, ৩য় রুকূ)। সমস্ত রসূলের উপর ঈমান আনার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার এর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাঁদের মধ্যে আমাদের হুযূর পাক (সা)-ও বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। এছাড়া নামায, যাকাত এবং অন্যান্য সাদকা-খয়রাতও এ অঙ্গীকারভুক্ত, যার মূল মর্ম হল রসূলে করীম (সা)-এর উপর ঈমান ও তাঁর পুরোপুরি অনুসরণ। এজন্যই হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন যে, অঙ্গীকারের মূল অর্থ মুহাম্মদ (সা)- এর পূর্ণ অনুসরণ।

“আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করব।' অর্থাৎ উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ্ এ ওয়াদা করেছেন যে, যারা এ অঙ্গীকার পালন করবে, আল্লাহ্ পাক তাদের যাবতীয় পাপ মোচন করে দেবেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদেরকে জান্নাতের সুখ-সম্পদের দ্বারা গৌরবান্বিত করা হবে।

মূল বক্তব্য এই যে, হে বনী-ইসরাঈল, তোমরা মুহাম্মদ (সা)-এর অনুসরণ করার ব্যাপারে আমার সাথে যে অঙ্গীকার করেছ, তা পূরণ কর। তবে আমিও তোমাদের সাথে কৃত ক্ষমা ও জান্নাত বিষয়ক অঙ্গীকার পূরণ করবো। আর শুধু আমাকেই ভয় কর। একথা ভেবে সাধারণ ভক্তদেরকে ভয় করো না যে, সত্য কথা বললে তারা আর বিশ্বাসী থাকবে না, ফলে আমদানী বন্ধ হয়ে যাবে।

মুহাম্মদ (সা)-এর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা

তফসীরে কুরতুবীতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ পাক বনী-ইসরাঈলকে প্রদত্ত সুখ-সম্পদ ও অনুগ্রহরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর যিক্র ও অনুসরণের আহ্বান করেছেন এবং উম্মতে মুহাম্মদিয়াকে তাঁর দয়া ও করুণার উদ্ধৃতি না দিয়েই একই কাজের উদ্দেশ্যে আহবান করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে- فَاذْكُرُونِي اذْكُرْكُمْ (তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব)। এখানে উন্মতে- মুহাম্মদীর এক বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, দাতা ও করুণাময়ের সাথে তাদের সম্পর্ক মাধ্যমহীন একেবারে সরাসরি। এরা দাতাকে চেনে ।


অঙ্গীকার পালন করা ওয়াজিব এবং তা লঙ্ঘন করা হারাম
এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, অঙ্গীকার ও চুক্তির শর্তাবলী পালন করা অবশ্য কর্তব্য আর তা লঙ্ঘন করা হারাম। সূরা মায়েদা-তে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, أَوْفُوا بِالْعُقُودِ (তোমরা কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি পালন কর।)
রসূলে করীম (সা) এরশাদ করেছেন যে, অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে নির্ধারিত শান্তিপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে এই শাস্তি দেওয়া হবে যে, হাশরের ময়দানে যখন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমগ্র মানব সমবেত হবে, তখন অঙ্গীকার লঙ্ঘনকারীদের মাথার উপর নিদর্শনস্বরূপ একটি পতাকা উত্তোলন করে দেওয়া হবে এবং যত বড় অঙ্গীকার করবে, পতাকাও তত উঁচু ও বড় হবে। এভাবে তাদেরকে হাশরের ময়দানে লজ্জিত ও অপমানিত করা হবে।

পাপ বা পুণ্যের প্রবর্তকের আমলনামায় তার সম্পাদনকারীর সমান পাপ-পুণ্য লেখা হয়

أَوَّلَ كَافِرٍ بِهِ যে কোন পর্যায়ে কাফির হওয়া চরম অপরাধ ও জুলুম। কিন্তু এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, প্রথম কাফিরে পরিণত হয়ো না। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, যে ব্যক্তি প্রথম কুফরী গ্রহণ করবে, তার অনুসরণে পরবর্তীকালে যত লোক এ পাপে লিপ্ত হবে, তাদের সবার কুফরী ও অবিশ্বাসজনিত পাপের বোঝার সমতুল্য বোঝা তাকে একাই বহন করতে হবে। কারণ সে-ই কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিতব্য এ অবিশ্বাসপ্রসূত পাপের মূল কারণ ও উৎস। সুতরাং তার শাস্তি বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে।

জ্ঞাতব্য: এতদ্বারা বোঝা গেল যে, কোন ব্যক্তি যদি অন্য কারও পাপের কারণে পরিণত হয় তবে কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তার কারণে এ পাপে জড়িত হবে, তাদের সবার সমতুল্য পাপ তার একারই হবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি অন্য কারও পুণ্যের কারণ হয়, তাকে অনুসরণ করে কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক সৎকাজ সাধন করে যে পরিমাণ পুণ্য লাভ করবে, তাদের সবার সমতুল্য পুণ্য সে ব্যক্তির আমলনামায় লিপিবদ্ধ করে দেওয়া হবে। এ মর্মে কোরআন পাকের অসংখ্য আয়াত এবং রসূল (সা)-এর অগণিত হাদীস রয়েছে।

وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلاً (এবং তোমরা আমার আয়াতসমূহ কোন নগণ্য বস্তুর বিনিময়ে বিক্রয় করো না।) আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার আয়াতসমূহের বিনিময়ে মূল্য গ্রহণ নিষিদ্ধ হওয়ার অর্থ হলো মানুষের মর্জি ও স্বার্থের তাগিদে আয়াতসমূহের মর্ম বিকৃত বা ভুলভাবে প্রকাশ করে কিংবা তা গোপন রেখে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করা-এ কাজটি উম্মতের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।

কোরআন শিখিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয

এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহ তা'আলার আয়াতসমূহ ঠিক ঠিকভাবে শিক্ষা দিয়ে বা ব্যক্ত করে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা সঙ্গত কি না। এই প্রশ্নটির সম্পর্ক উল্লিখিত আয়াতের সঙ্গে নয়। স্বয়ং এ মাসআলাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য ও পর্যালোচনাসাপেক্ষ। কোরআন শিক্ষা দিয়ে বিনিময় বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয কিনা-এ সম্পর্কে ফিকাহশাস্ত্রবিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আহমদ ইবনে হাম্বল (র) জায়েয বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইমাম আজম আবু হানীফা (র) প্রমূখ কয়েকজন ইমাম তা নিষেধ করেছেন। কেননা রসূলে করীম (সা) কোরআনকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যমে পরিণত করতে বারণ করেছেন।
অবশ্য পরবর্তী হানাফী ইমামগণ বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে, পূর্বে কোরআনের শিক্ষকমণ্ডলীর জীবন যাপনের ব্যয়ভার ইসলামী বায়তুলমাল (ইসলামী ধনভাণ্ডার) বহন করত, কিন্তু বর্তমানে ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে এ শিক্ষকমণ্ডলী কিছুই লাভ করেন না । ফলে যদি তাঁরা জীবিকার অন্বেষণে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করেন, তবে ছেলেমেয়েদের কোরআন শিক্ষার ধারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য কোরআন শিক্ষার বিনিময়ে প্রয়োজনানুপাতে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ইমামতি, আযান, হাদীস ও ফিকাহ্ শিক্ষা দান প্রভৃতি যে সব কাজের উপর দীন ও শরীয়তের স্থায়ীত্ব ও অস্তিত্ব নির্ভর করে সেগুলোকেও কোরআন শিক্ষাদানের সাথে সংযুক্ত করে প্রয়োজনমত এগুলোর বিনিময়েও বেতন বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। (দুররে মুখতার, শামী)

ইসালে সওয়াব উপলক্ষে খতমে কোরআনের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা সর্বসম্মতভাবে না-জায়েয

আল্লামা শামী 'দুররে মুখতারের শারহে' এবং 'শিফাউল-'আলীল' নামক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে এবং অকাট্য দলীলাদিসহ একথা প্রমাণ করেছেন যে, কোরআন শিক্ষাদান বা অনুরূপ অন্যান্য কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের যে অনুমতি পরবর্তীকালের ফকীহগণ দিয়েছেন, তার কারণ এমন এক ধর্মীয় প্রয়োজন যে, তাতে বিচ্যুতি দেখা দিলে গোটা শরীয়তের বিধান ব্যবস্থার মূলে আঘাত আসবে। সুতরাং এ অনুমতি এ সব বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখা একান্ত আবশ্যক। এজন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মৃতদের ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরআন খতম করানো বা অন্য কোন দোয়া-কালাম ও অজিফা পড়ানো হারাম। কারণ এর উপর কোন ধর্মীয় মৌলিক প্রয়োজন নির্ভরশীল নয়। এখন যেহেতু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পড়া হারাম, সুতরাং যে পড়বে এবং যে পড়াবে, তারা উভয়ই গোনাহগার হবে। বস্তুত যে পড়েছে সে-ই যখন কোন সওয়াব পাচ্ছে না, তখন মৃত আত্মার প্রতি সে কি পৌঁছাবে ? কবরের পাশে কোরআন পড়ানো বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোরআন খতম করানোর রীতি সাহাবী, তাবেয়ীন এবং প্রথম যুগের উম্মতগণের দ্বারা কোথাও বর্ণিত বা প্রমাণিত নেই। সুতরাং এগুলো নিঃসন্দেহে বিদ'আত ।

সত্য গোপন করা এবং তাতে সংযোজন ও সংমিশ্রণ হারাম

وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بالباطل (সত্যকে অসত্যের সাথে মিশ্রিত করো না )-এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শ্রোতাও সম্বোধিত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে উপস্থাপন করা সম্পূর্ণ না-জায়েয। অনুরূপভাবে কোন ভয় বা লোভের বশবর্তী হয়ে সত্য গোপন করাও হারাম।


খলীফা সুলায়মানের দরবারে হযরত আবূ হাযেম (র)-এর উপস্থিতি

'মসনাদে দারেমী'-তে সনদসহ বর্ণিত আছে যে, একবার খলীফা সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক মদীনায় গিয়ে কয়েকদিন অবস্থানের পর লোকদের জিজ্ঞেসা করলেন যে, মদীনায় এমন কোন লোক বর্তমানে আছেন কি, যিনি কোন সাহাবীর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। লোকেরা বলল: আবূ হাযেম (র) এমন ব্যক্তি। খলীফা লোক মারফত তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তশরীফ আনার পর খলীফা বললেন, হে আবূ হাযেম, এ কোন্ ধরনের অসৌজন্যমূলক ও অভদ্রজনোচিত কাজ। হযরত আবূ হাযেম বললেন, আপনি আমার মাঝে এমন কি অসৌজন্য ও অভদ্রতা দেখতে পেলেন? সুলায়মান বললেন, মদীনার প্রত্যেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, কিন্তু আপনি আসেননি। আবূ হাযেম বললেন, আমীরুল মু'মিনীন ! বাস্তবতার বিরোধী কোন কথা বলা থেকে আমি আপনাকে আল্লাহর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। ইতিপূর্বে আপনি আমাকে চিনতেন না। আমিও আপনাকে কখনো দেখিনি। এমতাবস্থায় আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং অসৌজন্য কেমন করে হলো ?

সুলায়মান উত্তর শুনে ইবনে শিহাব যুহরী ও অন্যান্য উপস্থিত সুধীর প্রতি তাকালে পর ইমাম যুহরী (র) বললেন, আবূ হাযেম তো ঠিকই বলেছেন; আপনি ভুল বলেছেন ।
অতঃপর সুলায়মান কথাবার্তার ধরন পাল্টিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলেন । বললেন, যে, আবু হাযেম ! আমি মৃত্যুভয়ে ভীত ও বিচলিত হয়ে পড়ি কেন? তিনি বললেন, কারণ আপনি পরকালকে বিরান এবং ইহকালকে আবাদ করেছেন। সুতরাং আবাদী ছেড়ে বিরান জায়গায় যেতে মন চায় না ।

সুলায়মান এ বক্তব্য সমর্থন করে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, পরকালে আল্লাহর দরবারে কিভাবে উপস্থিত হতে হবে? বললেন, পুণ্যবানগণ তো আল্লাহর দরবারে এমনভাবে হাযির হবেন, যেমন কোন মুসাফির সফর থেকে ফিরে নিজ বাড়ীতে পরিবার-পরিজনের মাঝে ফিরে যায়। আর পাপীরা এমনভাবে উপস্থিত হবে, যেমন কোন পলাতক গোলামকে ধরে নিয়ে মনিবের সামনে উপস্থিত করা হয়।

সুলায়মান কথা শুনে কেঁদে উঠলেন এবং বলতে লাগলেন, আল্লাহ্ পাক আমার জন্য কি ব্যবস্থা করে রেখেছেন, যদি তা আমি জানতে পারতাম ! আবূ হাযেম (র) এরশাদ করলেন, নিজের আমলসমূহ কোরআন পাকের কষ্টিপাথরে যাচাই করলেই তা জানতে পারবেন।

সুলায়মান জিজ্ঞেস করলেন, কোরআনের কোন আয়াতে এর সন্ধান পাওয়া যাবে? বললেন,
এ আয়াত দ্বারা- إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ وَإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ (নিশ্চয়ই সৎ লোকপণ জান্নাতে সুখ-সম্পদে অবস্থান করবেন এবং অসৎ ও অবাধ্যজন নরকে!)

সুলায়মান বলেন, আল্লাহর রহমত ও করুণা তো অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত এবং তা অবাধ্যদেরও পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। বললেন- إِنَّ رَحْمَةَ اللهِ قَريبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِينَ . (নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাকের দয়া ও করুণা সৎকর্মশীলদের সন্নিকটে রয়েছে।)

সুলায়মান জিজ্ঞেস করলেন, হে আবূ হাযেম ! আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি শালীনতা ও মানবতাবোধ এবং বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন জ্ঞান ও বিবেকের অধিকারী।

অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, সর্বোত্তম কাজ কি ? বললেন, হারাম বস্তুসমূহ পরিহার করে যাবতীয় ওয়াজিব পালন করা।

সুলায়মান আবার জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর নিকট সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য দোয়া কোনটি ? এরশাদ করলেন, দাতার প্রতি দানগ্রহীতার দোয়া। আবার জিজ্ঞেস করলেন, সর্বোৎকৃষ্ট দান কোনটি ? এরশাদ করলেন: কোন প্রসঙ্গে নিজ কৃত দানের উদ্ধৃতি না দিয়ে বা কোন রকম কষ্ট না দিয়ে নিজের প্রয়োজন ও অভাব সত্ত্বেও কোন বিপদগ্রস্ত সায়েলকে (যাচনাকারীকে) দান করা।

অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, সর্বোত্তম কথা কোনটি ? বললেন, যার ভয়ে তুমি ভীত বা তোমার কোন প্রয়োজন বা আশা-আকাঙ্ক্ষা যার সাথে জড়িত তাঁর সম্মুখে নিঃসংকোচে ও নির্বিবাদে সত্য কথা প্রকাশ করা।

জিজ্ঞেস করলেন, সর্বাধিক জ্ঞানী ও দূরদর্শী মুসলমান কে ? এরশাদ হল, যে সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি অনুগত থেকে কাজ করে এবং অনুরূপভাবে অপরকেও করতে আহ্বান করে।

জিজ্ঞেস করলেন, মুসলমানদের মধ্যে সর্বাধিক নির্বোধ কে? বললেন, যে ব্যক্তি তার কোন ভাইয়ের অত্যাচারে সহযোগিতা করে। তার অর্থ হল এই যে, সে নিজের ধর্ম বিক্রি করে অপরের পার্থিব স্বার্থ উদ্ধার করে। সুলায়মান বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।

অতঃপর সুলায়মান স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের সম্পর্কে আপনার কি অভিমত ? আবূ হাযেম বললেন, আপনার এ প্রশ্ন থেকে যদি আমাকে অব্যাহতি দেন তবে অতি উত্তম।

সুলায়মান বললেন, মেহেরবানী করে আপনি আমাদেরকে কিছু উপদেশ বাক্য শোনান।
আবূ হাযেম বললেন, আপনার পিতৃপুরুষ তরবারির দৌলতে ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন এবং জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তাদের উপর রাজত্ব করেছেন। আর এতোসব কীর্তির পরও তাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আফসোস! আপনি যদি জানতেন যে, তাঁরা মৃত্যুর পর কি বলেন এবং প্রতি-উত্তরে তাঁদেরকে কি বলা হচ্ছে !

অনুচরদের একজন খলীফার মেজাজবিরুদ্ধ আবু হাযেমের স্পষ্টোক্তি শুনে বলল, আবূ হাযেম, তুমি অতি জঘন্য উক্তি করলে। আবূ হাযেম (র) বললেন, আপনি ভুল বলছেন। কোন ন্যক্কারজনক কথা বলিনি, বরং আমাদের প্রতি যেরূপ নির্দেশ রয়েছে তদনুসারেই কথা বলেছি। কারণ আল্লাহ পাক উলামাদের নিকট থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, তারা মানুষকে সত্য কথা বলবে, কখনো তা গোপন করবে না।  لَتُبَيِّنُنَّهُۥ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُۥ (যেন তোমরা যা সত্য, মানুষের নিকট তা প্রকাশ কর এবং তা গোপন না কর)।

ইমাম কুরতুবী এই সুদীর্ঘ ঘটনা উল্লিখিত আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন। সুলায়মান আবার জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের সংশোধনের পথ কি ? এরশাদ হল, গর্ব ও অহংকার পরিহার করুন। নম্রতা ও শালীনতা গ্রহণ করুন এবং হকদারদের প্রাপ্য ন্যায়সঙ্গতভাবে বণ্টন করে দিন।

সুলায়মান বললেন, আপনি কি মেহেরবানী করে আমাদের সাথে থাকতে পারেন ? আপত্তি করে আবু হাযেম বললেন, আল্লাহ রক্ষা করুন। সুলায়মান জিজ্ঞেস করলেন, কেন? তিনি বললেন, এ আশংকায় যে, পরে আপনাদের ধন-সম্পদ ও মান-মর্যাদার প্রতি না আকৃষ্ট হয়ে পড়ি-পরিণামে যে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
অতঃপর খলীফা বলেন, আপনার যদি কোন অভাব থাকে, তবে মেহেরবানী করে বলুন-তা পূরণ করে দেব। এরশাদ হল, একটি প্রয়োজন আছে, দোযখ থেকে অব্যাহতি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন। খলীফা বললেন, এটা তো আমার ক্ষমতাধীন নয়। বললেন, তাহলে আপনার কাছে কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নেই।

পরিশেষে সুলায়মান বললেন, আমার জন্য মেহেরবানী করে দোয়া করুন । তখন আবূ হাযেম (র) দোয়া করলেন, আল্লাহ্ সুলায়মান যদি আপনার পছন্দনীয় ব্যক্তি হয়ে থাকে, তবে তার জন্য ইহকাল ও পরকালের সকল মঙ্গল ও কল্যাণ সহজতর করে দিন। আর যদি সে আপনার শত্রু হয়ে থাকে, তবে তার মাথা ধরে আপনার সন্তুষ্টি বিধান ও অনুমোদিত কার্যাবলীর দিকে নিয়ে আসুন ।

খলীফা বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। বললেন, সারকথা এই যে, আপন পালনকর্তাকে এত বড় ও প্রতাপশালী মনে করুন যে, তিনি যেন আপনাকে এমন স্থানে বা অবস্থায় না পান, যা থেকে বারণ করেছেন এবং যেদিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে যেন অনুপস্থিত না দেখেন ।

এ মজলিস থেকে প্রস্থানের পর খলীফা আবূ হাযেম (র)-এর খেদমতে উপঢৌকনস্বরূপ এক'শ গিনি পাঠিয়ে দিলেন। আবূ হাযেম (র) একখানা চিঠিসহ তা ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। তাতে লেখা ছিল, “এই একশ' গিনি যদি আমার উপদেশাবলী ও উপস্থাপিত বক্তব্যের বিনিময়ে প্রদান করা হয়ে থাকে, তবে আমার নিকট এগুলোর চাইতে রক্ত ও শূকরের মাংসও প্রিয়। আর যদি সরকারী ধনভাণ্ডারে আমার অধিকার ও প্রাপ্য আছে বলে দেওয়া হয়ে থাকে, তবে আমার ন্যায় দীনী খেদমতে ব্রতী হাজার হাজার উলামায়ে কিরাম রয়েছেন। যদি তাঁদের সবাইকে সমসংখ্যক গিনি প্রদান করে থাকেন, তবে আমিও গ্রহণ করতে পারি। অন্যথায় আমার এগুলোর প্রয়োজন নেই ।”

আবূ হাযেম (র) উপদেশ বাক্যের বিনিময় গ্রহণকে রক্ত ও শূকরের সমতুল্য বলে মন্তব্য করার ফলে এ মাসআলার উপরও আলোকপাত হয়েছে যে, কোন ইবাদত বা উপাসনার বিনিময় গ্রহণ করা তাঁদের মতে জায়েয নয়।





*******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url