সিরাতুন নবী (সাঃ) - ৮৮ || মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ’র অভিযান ও বনু লাহইয়ান যুদ্ধ ||





মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ’র অভিযান ও বনু লাহইয়ান যুদ্ধ


আহযাব ও বনু কুরাইযাহ সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার পর এটাই ছিল প্রথম অভিযান। ত্রিশ জন মর্দে মু’মিনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এ অভিযাত্রী দলটি। এ অভিযান পরিচালনার্থে অভিযাত্রী দলটি প্রেরিত হয়েছিলেন নাজদের অভ্যন্তর ভাগে বাকারাত অঞ্চলে যারিয়ার পার্শ্ববর্তী ‘ক্বারত্বা’ নামক স্থানে। যারিয়্যাহ এবং মদীনার অবস্থান ছিল সাত রাত্রি দূরত্বের ব্যবধানে। অভিযাত্রীগণের এ অভিযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর ১০ই মুহাররম। তাদের লক্ষ্যস্থলে ছিল বনু বাকর বিন কিলাব গোত্রের একটি শাখা।

মুসলিমগণ অতর্কিত শত্রুদের আক্রমণ করলে তারা হতকচিত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পলায়ন করে। তাদের পরিত্যক্ত ধন সম্পদ এবং গবাদি পশুসমূহ মুসলিমগণের হস্তগত হয়। সে সকল ধন সম্পদ এবং গবাদির পাল নিয়ে তাঁরা মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁরা যখন মদীনায় প্রত্যাগমন করেন তখন মুহাররম মাসের মাত্র একদিন অবশিষ্ট ছিল। প্রত্যাবর্তনের সময় তাঁরা বনু হানীফার সরদার সুমামাহ বিন আসাল হানাফীহকেও বন্দী করে নিয়ে আসেন। সে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের নির্দেশে নবী করীম (ﷺ)-কে হত্যা করার জন্য ছদ্মবেশে বাহির হয়েছিল।[১] কিন্তু অভিযানকারী সাহাবীগণ তাকে বন্দী করে নিয়ে আসেন এবং মসজিদে নববীর খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন।

এমতাবস্থায় নবী করীম (ﷺ) যখন সেখানে আগমন করলেন তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে সুমামাহ! তোমার নিকট কি আছে?’

প্রত্যুত্তরে সে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আমার নিকট (কল্যাণ) ধন-সম্পদ রয়েছে। যদি তুমি আমাকে হত্যা কর তবে প্রকৃতই একজন খুনী আসামীকে হত্যা করবে। আর যদি অনুগ্রহ কর তবে প্রকৃতই একজন গুণগ্রাহী ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করবে। পক্ষান্তরে যদি ধন-সম্পদ চাও তাহলে যা চাবে তাই পাবে।’ তার মুখ থেকে এ সব কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ঐ একই অবস্থার মধ্যে রেখে চলে গেলেন।

অতঃপর নবী করীম (ﷺ) যখন দ্বিতীয় বার সেখানে এসে উপস্থিত হলেন তখন উপরোক্ত প্রশ্নগুলোই তাকে জিজ্ঞেস করলেন। সে উত্তরও দিল ঠিক পূর্বের মতোই। এবারও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে একই অবস্থার মধ্যে রেখে চলে গেলেন। এরপর যখন তিনি তৃতীয় বার আগমন করলেন তখনো ঐ একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। সুমামাহ এবারও একই উত্তর প্রদান করলেন। তৃতীয় বার তার মুখ থেকে উত্তর শোনার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ প্রদান করলেন তাকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য।

তাঁরা তাকে মুক্ত করে দিলে সে মসজিদে নববীর নিকট একটি খেজুর বাগানে গেল। সেখানে গোসল করে পাক সাফ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর বলল, ‘আল্লাহর শপথ! পৃথিবীর বুকে কোন মুখমন্ডল আপনার মুখমন্ডলের চাইতে অধিক ঘৃণিত ছিল না, কিন্তু এ মুহূর্তে আমার নিকট আপনার মুখমন্ডলের চাইতে অধিক প্রিয় মুখমন্ডল আর পৃথিবীতে নেই। সে আরও বলল, ‘আল্লাহর শপথ! ইতোপূর্বে পৃথিবীর বুকে আপনার প্রচারিত দ্বীন ছিল আমার নিকট সব চাইতে ঘৃণিত, কিন্তু এ মুহূর্তে আপনার দ্বীন আমার নিকট সব চাইতে প্রিয় এবং পবিত্র বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ অভিযানে প্রেরিত অভিযাত্রীগণ আমাকে এমন সময় গ্রেফতার করেছিল যখন আমি উমরাহ পালনের জন্য মনস্থির করছিলাম।

রাসূলে করীম (ﷺ) তাকে উমরাহ পালনের নির্দেশ এবং শুভ সংবাদ প্রদান করলেন। উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যখন সে কুরাইশদের অঞ্চলে পৌঁছিল তখন তারা তাকে বলল, ‘হে সুমামা তুমিও বেদ্বীন হয়ে গিয়েছ?’

সুমামাহ বলল, ‘না, বরং আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হাতে বাই‘আত হয়ে মুসলিম হয়েছি।’ তিনি আরও বললেন, ‘জেনে রাখ, আল্লাহর কসম! ইয়ামামা হতে তোমাদের নিকট গমের একটি দানাও আসবে না, যে পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ব্যাপারে অনুমতি প্রদান না করবেন।’ ইয়ামামা মক্কাবাসীগণের শস্য ভূমির মর্যাদা রাখত।

সুমামাহ দেশে ফিরে গিয়ে মক্কা অভিমুখী খাদ্যদ্রব্যের চালান বন্ধ করে দিলেন। এর ফলে মক্কাবাসীগণ খাদ্য সংকটজনিত অসুবিধার মধ্যে নিপতিত হলেন। এ প্রেক্ষিতে আত্মীয়তার সূত্র উল্লেখ করে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ মর্মে পত্র লিখল যাতে তিনি সুমামাহকে খাদ্যদ্রব্য চালান বন্ধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। রাসূলে করীম (ﷺ) সুমামাহকে খাদ্যদ্রব্যের চালান বন্ধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন।[২]

[১] সিরাতে হালবিয়া ২য় খন্ড ২৯৭ পৃঃ।
[২] যা’দুল মাআদ, ২য় খন্ড ১১৯ পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ২৯২-২৯৩ পৃঃ।

বনু লাহইয়ান যুদ্ধ

বুন লাহইয়ান গোত্রের লোকজনেরা প্রতারণার মাধ্যমে রাজী নামক স্থানে ১০ জন সাহাবা (রাঃ)-কে আটক করার পর আটজনকে হত্যা করেছিল এবং অবশিষ্ট দু’ জনকে মক্কার মুশরিকগণের নিকট বিক্রয় করে দিয়েছিল যেখানে তাঁদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অঞ্চলটি হিজাযের অভ্যন্তরে মক্কা সীমানার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল এবং যেহেতু মুসলিমগণের সঙ্গে কুরাইশ ও বেদুঈনদের সম্পর্কের একটা কঠিন টানাপোড়নের অবস্থা বিরাজমান ছিল সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিজাযের গভীর অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করে বড় শত্রুদের নিকট যাওয়াকে সমীচীন মনে করেন নি।

কিন্তু কাফের মুশরিকগণ যখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল এবং দলে ভাঙ্গন ধরার ফলে তাদের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এটা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, রাজী নামক স্থানে লাহইয়ান গোত্রের লোকজনেরা সাহাবীগণকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তার প্রতিশোধ গ্রহণের উপযুক্ত সময় সমাগত। কাজেই ৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আওয়াল, মতান্তরে জুমাদালউলা মাসে দু’ শত সাহাবী সমভিব্যাহারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাযী অভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রার প্রাক্কালে মদীনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করেন ইবনু উম্মু মাকতুমের উপর এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি শাম রাজ্য অভিমুখে যাত্রা করেছেন।

অগ্রাভিযানের এক পর্যায়ে অভিযাত্রী দলসহ তিনি উমাজ এবং উসফান স্থান দ্বয়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত বাতনে গাররান নামক উপত্যকায় উপস্থিত হলেন। এখানেই বনু লাহইয়ান গোত্রের লোকেরা সাহাবীগণকে হত্যা করেছিল। সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি শহীদ সাহাবাগণের (রাঃ) জন্য আল্লাহ তা‘আলার সমীপে রহমতের প্রার্থনা করলেন। এদিকে বনু লাহইয়ান গোত্রের লোকেরা মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হয়ে পর্বতশীর্ষ অতিক্রম করে পলায়ন করল, ফলে তাদের কাউকেও গ্রেফতার করা সম্ভব হল না।

রাসূলে কারীম (ﷺ) তাঁর বাহিনীসহ বনু লাহইয়ান গোত্রের আবাসস্থানে দুই দিন অবস্থান করলেন, কিন্তু এ গোত্রের কোন লোকজনেরই খোঁজ খবর তিনি পান নি। দ্বিতীয় দিনের পর তিনি সেখান হতে উসফানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। সে স্থানে পৌঁছার পর তিনি দশ জন ঘোড়সওয়ারকে কোরাউলগমীমের দিকে প্রেরণ করেন। যাতে কুরাইশগণও নবী করীম (ﷺ)-এর অভিযান সম্পর্কে অবগত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নি। এভাবে মোট চৌদ্দ রাত মদীনার বাহিরে অতিবাহিত করার পর তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।






*********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url