মা’আরেফুল কোরআন - ২৭ || সূরা আল-বাকারাহ ৬৫-৬৭নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৬৫-৬৭


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৬৫-৬৬

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ لَقَدۡ عَلِمۡتُمُ الَّذِیۡنَ اعۡتَدَوۡا مِنۡکُمۡ فِی السَّبۡتِ فَقُلۡنَا لَهُمۡ کُوۡنُوۡا قِرَدَۃً خٰسِئِیۡنَ ﴿ۚ۶۵
فَجَعَلۡنٰهَا نَکَالًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡهَا وَ مَا خَلۡفَهَا وَ مَوۡعِظَۃً لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۶۶

সূরা আল-বাকারাহ ৬৫-৬৬ নং আয়াতের অর্থ

(৬৫) তোমরা তাদেরকে ভালরূপে জেনেছ, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল। আমি বলেছিলাম ও তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও। (৬৬) অতঃপর আমি এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহ ভীরুদের জন্য উপদেশ গ্রহণের উপাদান করে দিয়েছি। (৬৬) অতঃপর আমি এ ঘটনাকে সেই কালের ও তার পরবর্তী কালের লোকদের জন্য দৃষ্টান্ত এবং যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশ গ্রহণের মাধ্যমে বানিয়ে দেই।

সূরা আল-বাকারাহ ৬৫-৬৬ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

আর তোমরা সে সম্প্রদায়ের অবস্থা সম্পর্কে অবগত রয়েছ, তোমাদের মধ্য থেকে যারা শনিবার সম্পর্কিত নির্দেশ অমান্য করে শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করেছিল। (তাদের জন্য শনিবারে মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল)। অতঃপর আমি তাদের (আদি ও অলঙ্ঘনীয় নির্দেশের মাধ্যমে বিকৃত করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে) বলে দিলামঃ তোমরা বানর হয়ে যাও (সেমতে তারা বানরের -আকৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল)। অতঃপর আমি একে একটি নিদর্শনমূলক ঘটনা করে দিলাম তাদের সমসাময়িকদের এবং পরবর্তীদের জন্য। আর (এ ঘটনাকে) উপদেশপ্রদ (করে দিলাম) আল্লাহভীরুদের জন্য।

জ্ঞাতব্যঃ বনী-ইসরাঈলের এ ঘটনাটিও হযরত দাউদ (আ)-এর আমলে সংঘটিত হয়। বনী-ইসরাঈলের জন্য শনিবার ছিল পবিত্র এবং সাপ্তাহিক উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট। এ দিন মৎস্য শিকার করা নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকূলের অধিবাসী ছিল বলে মৎস্য শিকার ছিল তাদের প্রিয় কাজ। ফলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা মৎস্য শিকার করে। এতে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে ’মসখ’ তথা আকৃতি রূপান্তরের শাস্তি নেমে আসে। তিনদিন পর এদের সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

এ ঘটনার দর্শক ও শ্রোতা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। অবাধ্য শ্রেণী ও অনুগত শ্রেণী। অবাধ্যদের জন্য এ ঘটনাটি ছিল অবাধ্যতা থেকে তওবা করার উপকরণ। এ কারণে একে نَكَالٌ এ (শিক্ষাপ্রদ দৃষ্টান্ত) বলা হয়েছে। অপরদিকে অনুগতদের জন্য এটা ছিল আনুগত্যে অটল থাকার কারণ। এজন্য একে مَوْعِظَةٌ (উপদেশপ্রদ) ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সূরা আল-বাকারাহ ৬৫-৬৬ নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

ধর্মীয় কাজে এমন কলাকৌশল অবলম্বন করা হারাম, যাতে শরীয়তের নির্দেশ বাতিল হয়ে যায়। বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, এ আয়াতে বনী-ইসরাঈলের যে শাস্তিযোগ্য সীমালঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে, তা শরীয়তের নির্দেশের পরিষ্কার বিরোধী ছিল না, বরং সেটা ছিল এমন এক অপকৌশল, যাতে শরীয়তের নির্দেশ আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যায়। উদাহরণত শনিবার দিন মাছের লেজে লম্বা সূতা বেঁধে দেওয়া এবং তার একটা মাথা ডাঙায় কোন কিছুর সাথে বেঁধে রাখা এবং রবিবার আসতেই সুতা টেনে মাছ শিকার করে নেওয়া। বলা বাহুল্য, এ অপকৌশলের মাধ্যমে শরীয়তের বিধান লঙ্ঘিত হয়ে যায়, বরং এটা এক রকম উপহাসও বটে। এহেন অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণকারীদের উদ্ধত নাফরমান সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তাদের উপর শান্তি নেমে এসেছে।

কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, ঐসব কলাকৌশলও হারাম যা স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে দিয়েছেন। উদাহরণত এক সের উৎকৃষ্ট খেজুরের বিনিময়ে দুই সের নিকৃষ্ট খেজুর ক্রয় করা সুদের অন্তর্ভুক্ত। এ সুদ থেকে বাঁচার জন্য স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি কৌশল বলে দিয়েছেন। তা হচ্ছে বস্তুর বিনিময়ে বস্তু না দিয়ে তার মূল্য দ্বারা ক্রয়-বিক্রয় করা। উদাহরণত দুই সের নিকৃষ্ট খেজুর দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় কর। অতঃপর দুই দিরহাম দ্বারা এক সের উৎকৃষ্ট খেজুর কিনে নাও। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় শরীয়তের নির্দেশে বাতিল হয় না এবং তা উদ্দেশ্যও নয়; বরং নির্দেশ পালন করাই লক্ষ্য। এমনি ধরনের আরও কতিপয় মাসআলায় ফিকাহবিদগণ হারাম থেকে আত্মরক্ষার জন্য বৈধ পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। সেগুলোকে বনী-ইসরাঈলদের কলাকৌশলের অনুরূপ বলা বা মনে করা নিতান্ত ভুল।

বানরে রূপান্তরের ঘটনা

তফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, ইহুদীরা প্রথম প্রথম কলাকৌশলের অন্তরালে এবং পরে সাধারণ পদ্ধতিতে ব্যাপকভাবে মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ছিল সৎ ও বিজ্ঞ লোকদের। তারা এ অপকর্মে বাধা দিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ বিরত হলো না। অবশেষে তারা এদের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে পৃথক হয়ে গেলেন। এমনকি বাসস্থানও দুই ভাগে ভাগ করে নিলেন। একভাগে অবাধ্যরা বসবাস করত আর অপরভাগে সৎ ও বিজ্ঞ জনেরা বাস করতেন। একদিন তারা অবাধ্যদের বস্তিতে অস্বাভাবিক নীরবতা লক্ষ্য করলেন। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখলেন যে, সবাই বানরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। হযরত কাতাদাহ (রা) বলেন, তাদের যুবকরা বানরে এবং বৃদ্ধরা শূকরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। রূপান্তরিত বানররা নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে চিনত এবং তাদের কাছে এসে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করত।

বানরে রূপান্তরিত সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি

এ সম্পর্কে স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি অভ্রান্ত উক্তি করেছেন। সহীহ্ মুসলিমে আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, কয়েকজন সাহাবী একবার রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেনঃ হুযূর! আমাদের যুগের বানর ও শূকরগুলোও কি সেই রূপান্তরিত ইহুদী সম্প্রদায় ? তিনি বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা যখন কোন সম্প্রদায়ের ওপর আকৃতি রূপান্তরের আযাব নাযিল করেন, তখন তারা ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিনি আরও বললেন, বানর ও শূকর পৃথিবীতে পূর্বেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। এদের সাথে রূপান্তরিত বানর ও শূকরদের সম্পর্ক নেই ।

এ প্রসঙ্গে কোন কোন টীকাকার সহীহ্ বুখারীর বরাত দিয়ে বানরদের মধ্যে ব্যভিচারের অপরাধে প্রস্তর বর্ষণে হত্যা করার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ঘটনাটি বুখারীর কোন নির্ভরযোগ্য সংকলনে নেই। রেওয়ায়েতের নীতি অনুযায়ীও তা অভ্রান্ত নয়। -(কুরতুবী)

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৬৭

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِقَوۡمِهٖۤ اِنَّ اللّٰهَ یَاۡمُرُکُمۡ اَنۡ تَذۡبَحُوۡا بَقَرَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَتَّخِذُنَا هُزُوًا ؕ قَالَ اَعُوۡذُ بِاللّٰهِ اَنۡ اَکُوۡنَ مِنَ الۡجٰهِلِیۡنَ ﴿۶۷

সূরা আল-বাকারাহ ৬৭ নং আয়াতের অর্থ

(৬৭) যখন মূসা (আ) স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেন : আল্লাহ্ তোমাদের একটি গরু জবাই করতে বলেছেন। তারা বলল, তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ ? মূসা (আ) বললেন, মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

সূরা আল-বাকারাহ ৬৭ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

( স্মরণ কর,) যখন (হযরত) মূসা (আ) স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেন, আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দেন যে, (যদি ঐ মৃতদেহের হত্যাকারীর সন্ধান পেতে চাও, তবে) একটি গরু জবাই কর। তারা বলতে লাগলঃ তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ? (কোথায় হত্যাকারীর সন্ধান, আর কোথায় গরু জবাই করা।) মূসা (আ) বললেন, (নাউযুবিল্লাহ্!) আমি কি আল্লাহর নির্দেশ নিয়ে ঠাট্টা করার মত মূর্খজনোচিত কাজ করতে পারি?

জ্ঞাতব্যঃ ঘটনার বিবরণ এই যে, বনী ইসরাঈলদের মধ্যে একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। মিশকাতের টীকা গ্রন্থ মিরকাতের বর্ণনা অনুযায়ী এর কারণ ছিল বিবাহজনিত । জনৈক ব্যক্তি নিহত ব্যক্তির কন্যার পাণিগ্রহণ করার প্রস্তাব করলে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং প্রস্তাবক কন্যার পিতাকে হত্যা করে গা-ঢাকা দেয়। ফলে হত্যাকারী কে, তা জানা কঠিন হয়ে পড়ে। 

মাআলী (রা) কালবী (রা)-এর বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তখন পর্যন্তও তওরাতে হত্যা সম্পর্কে কোন আইন বিদ্যমান ছিল না। এতে বোঝা যায়, ঘটনাটি তওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেকার।

মোটকথা, বনী ইসরাঈল মূসা (আ)-এর কাছে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তিনি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তাদের একটি গরু জবাই করার জন্য আদেশ দেন। তারা চিরাচরিত অভ্যাস ও প্রকৃতি অনুযায়ী এতে নানা প্রকার বাদানুবাদের অবতারণা করতে থাকে।

পরবর্তী আয়াতসমূহে এ বাদানুবাদেরই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।




****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url