গোনাহ বা পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকার ফযীলত




ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ আল-গাযযালী (রহঃ) ছিলেন একজন যুগস্রেষ্ট সাধক ও আলেম। ইসলামের খেদমতে তাঁর বয়ান এবং তাঁর লেখা কিতাবগুলোর মাঝে এমন একটি যাদুকরী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যা অন্য কারো লেখায় বা বয়ানে এতটা প্রভাব সৃষ্টি করে না। তাঁর লেখা কিতাবগুলো পড়ে অতি সহজেই প্রতিটি পাঠকের হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠে। “দোযখ ও দোযখের ভয়াবহ শাস্তির বয়ান” শীর্ষক এই প্রবন্ধখানা ইমাম গাযযালীর লেখা “মুকাশাফাতুল কুলূব” বা “আত্মার আলোকমণি” কিতাবের অনুস্মরণে লেখা হয়েছে।



গোনাহ বা পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকার ফযীলত

আল্লাহ্ তা'আলার অবাধ্যতা ও পাপকার্যে লিপ্ত হওয়া থেকে বাচার জন্য সবচেয়ে বেশী সহায়ক বিষয় হলো খওফে খোদা, অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলার ভয় অন্তরে জাগরুক রাখা, তাঁর শাস্তির কথা স্মরণ করা, তাঁর অসন্তুষ্টি ও পাকড়াওয়ের কথা মনে করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

فَلۡیَحۡذَرِ الَّذِیۡنَ یُخَالِفُوۡنَ عَنۡ اَمۡرِهٖۤ اَنۡ تُصِیۡبَهُمۡ فِتۡنَۃٌ اَوۡ یُصِیۡبَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ 

যারা আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে, তাদের ভয় হওয়া উচিত যে, তাদের উপর কোন বিপদ এসে পড়ে, কিংবা তাদের উপর কোন যন্ত্রণাময় আযাব নাযিল হয়।" (সুরা নূর, আয়াতঃ 63)

রহমতের আশা ও শাস্তির ভয়

বর্ণিত আছে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মুমূর্ষু নওজওয়ানের নিকট তশরীফ নিয়ে গেলেন, তখন তার মৃত্যু একেবারেই সন্নিকটবর্তী ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ মুহূর্তে তোমার ভিতরের অনুভুতি কি? সে বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমার মনে আশার সঞ্চার হয় এবং গুনাহের কারণে বড় ভয়ও অনুভব করি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেনঃ এরূপ অবস্থায় কোন বান্দার অন্তরে এ দু'টি (আশা ও ভয়) বিষয় একত্রিত হলে, আল্লাহ্ পাক তাকে অবশ্যই আশানুরূপ দান করেন এবং যে বিষয় থেকে সে ভয় করেছে, তা থেকে মুক্তি দেন।”
হযরত ওয়াহ্ ইবনে ওয়ারদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত- হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, “জান্নাতের মহব্বত ও দোযখের ভয় মানুষকে ধৈর্য ধারণ, পার্থিব ভোগ-বিলাস বর্জন, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ ও পাপাচার পরিহারে অভ্যস্থ করে তোলে।” হযরত হাসান (রাযিঃ) বলেন, তোমাদের পূর্বে যেসব মনীষী (সাহাবায়ে কেরাম) কবরে গিয়েছেন, তারা গোটা পৃথিবীর অসংখ্য কংকরের সমপরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় দান করলেও পাপের ভয় ও আশংকায় শঙ্কিত থাকতেন; পারলৌকিক মুক্তি ও পরিত্রাণের আশা পোষণ করতেন না।

রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি যা শুনতে পাই তোমরা কি তা শুনতে পাও? আমি শুনছি আকাশমণ্ডলী কড় কড় আওয়াজ করছে।

ওই পবিত্র সত্তার কসম, যার কুদরতের মুঠোয় আমার জীবন, আসমানে চার অঙ্গুলি পরিমাণ জায়গাও এমন নাই, যেখানে কোন ফেরেশতা আল্লাহর সামনে সেজদা অথবা দাঁড়ানো অথবা রুকুর হালতে মগ্ন না রয়েছে। আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহলে অবশ্যই তোমরা বেশী কাঁদতে এবং কম হাসি-রসিকতা করতে এবং তোমরা জনপদ ছেড়ে পাহাড়-পর্বতের দিকে ছুটে যেতে। সেখানে তোমরা আল্লাহর ভয়াবহ ও কঠিনতম শাস্তি থেকে পানাহ চাইতে।

এক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে- "তোমরা কেউ বলতে পার না, আল্লাহর কাছে তোমরা পরিত্রাণ পাবে কি পাবে না।" বকর ইবনে আব্দুল্লাহ্ মুযানী (রহঃ) বলেন, “মানুষ হাস্য-উল্লাসে পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে, কিন্তু তাদের কাঁদতে কাঁদতে দোযখে যেতে হবে।”

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মানুষ যদি জানতো, আল্লাহর কাছে কি কি আযাব রয়েছে, তাহলে তারা দোযখের শাস্তি থেকে শঙ্কামুক্ত হতে পারতো না।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যখন হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আয়াত নাযিল হলো:

وَانْذِر عشيرتك الاقربين
এবং আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে ভয় প্রদর্শন করুন।” (শুআরা : ২১৪) তখন তিনি বলেছেন : হে কুরাইশ গোত্রের লোকজন! তোমাদের চিন্তা তোমরা নিজেরাই কর; আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কিছুই করতে পারবো না। হে বনী আবদে মনাফ ! আল্লার শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য আমি তোমাদের কোনই কাজে আসবো না। হে আব্বাস! আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্যে কিছুই করতে পারবো না। হে ছফিয়্যাহ্ (নবীজীর ফুফু)! আল্লাহর কাছে আপনার জন্যে আমি কিছুই করতে পারবো না। হে ফাতেমা! আমার সম্পদ থেকে তুমি যে পরিমাণ ইচ্ছা কর নিয়ে যাও; কিন্তু আখেরাতে আল্লাহর কাছে আমি তোমার কোন সাহায্য করতে পারবো না। হযরত আয়েশা (রাযিঃ) আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কুরআনের এ আয়াতেঃ

 وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡتُوۡنَ مَاۤ اٰتَوۡا وَّ قُلُوۡبُهُمۡ وَجِلَۃٌ اَنَّهُمۡ اِلٰی رَبِّهِمۡ رٰجِعُوۡنَ 

“আর যারা আল্লাহর রাস্তায় দান করে- যা কিছু দান করে থাকে এবং তাদের অন্তরসমূহ ভীত থাকে এ কথার জন্য যে, তাদেরকে স্বীয় রব্বের নিকট ফিরে যেতে হবে।” মুমিনূন : ৬০, যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারা যদি চুরি করে, ব্যভিচার করে, শরাব পান করে, কিন্তু আল্লাহকে ভয় করে থাকে, তবে এরাও কি এ আয়াতের প্রশংসার অন্তর্ভুক্ত? হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জওয়াব দিলেন, হে আবূ বকরের কন্যা, হে সিদ্দীকের কন্যা। এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত ওই সকল লোক, যারা নামায পড়ে, রোযা রাখে, দান-খয়রাত করে এবং সর্বদা শঙ্কিত থাকে যে, জানিনা আমার আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হবে কি-না। (আহমদ)

হযরত হাসান বসরী (রহঃ)- কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিল, হে সাঈদের পিতা! বলুন তো, আমরা অনেক সময় লোকদের সাহচর্যে বসি, তারা আমাদেরকে আখেরাতের ব্যাপারে কেবল আশাপ্রদ কথাই বলেন এবং তাতে আমরা এতো আনন্দিত হই, যেন আকাশে উড়তে থাকি। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, যাদের সংশ্রবে আশাপ্রদ কথা শুনছ, পরে আখেরাতে ক্ষতি ও ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়- এতোদপেক্ষা উত্তম হলো, এমন লোকদের সংশ্রব অবলম্বন কর, যারা দুনিয়াতে তোমাদেরকে আল্লাহর ও আখেরাতের ভীতি প্রদর্শন করে এবং পরিশেষে (আখেরাতে) সুখ ও শাস্তিপ্রাপ্ত হও।

হযরত উমর (রাযিঃ) জীবনের শেষভাগে যখন আঘাতপ্রাপ্ত হলেন এবং মৃত্যু অতি সন্নিকটবর্তী হলো, তখন তিনি স্বীয় পুত্রকে বললেন, ওহে! আমার গণ্ড মাটির সাথে মিশিয়ে রাখ, জানিনা আখেরাতে আমার কি পরিণতি হবে। আল্লাহ্ পাক যদি আমার উপর রহম না করেন, তবে আমার কোন উপায় নাই। হযরত উমর (রাযিঃ)-এর এই ভীতিগ্রস্ততা দেখে হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) তাকে বললেন, হে আমীরুল মুমেনীন, আপনি ভীত-সন্ত্রস্ত হচ্ছেন, অথচ আল্লাহ্ তাআলা আপনার দ্বারা প্রচুর এলাকা মুসলমানদের হাতে এনে দিয়েছেন, বহু শহর আপনার দ্বারা আবাদ করিয়েছেন। এ ছাড়াও ইসলাম ও মুসলমানদের আরও অনেক উপকার ও কল্যাণ আপনার দ্বারা সাধিত হয়েছে। হযরত উমর (রাযিঃ) বললেন, “আমি শুধু নাজাতটুকু পেয়ে যেতে চাই—অপরাধে ধরা না পড়ি।”
হযরত যয়নুল আবেদীন ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (রাযিঃ) যখন উযূ করতেন এবং উযূ সম্পন্ন করে দাড়াতেন, তখন তিনি রীতিমত কাঁপতে থাকতেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, ওহে! তোমরা কি জানোনা, আমি কত বড় মহান সত্তার দরবারে দণ্ডায়মান হবো এবং তাঁর কাছে অতি একান্তে আরব-নিয়ায করবো ?

হযরত আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) বলেন, আল্লাহর ভয় আমাকে পানাহার থেকেও ফিরিয়ে রেখেছে, এমনকি খাদ্যের প্রতি আমার মনে কোনরূপ আগ্রহই সৃষ্টি হয় না ।

ক্বিয়ামতের ভয়াবহ দিনে আরসের ছায়ায় আশ্রয়

বুখারী মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাত শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ করেছেন, যাদেরকে আল্লাহ্ তা'আলা ক্বিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনেও আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন আরশের এই ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক হচ্ছে, যারা একাকীত্বে আল্লাহ্ তা'আলাকে স্মরণ করে। অর্থাৎ আল্লাহর সতর্কবাণী ও শাস্তির কথা স্মরণ করে, নিজের অবাধ্যতা ও গুনাহের কারণে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়, ফলে তওবা ও অনুশোচনার অশ্রু প্রবাহিত হয়ে গণ্ডদেশ সিক্ত করে।

দোযখের আগুন যে চক্ষুকে স্পর্শ করবে না

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ)-সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ

عِينَانِ لَا تَمْتُهُمَا النَّارُ عَينُ بَكَتْ فِي جَوفِ اللَّيْلِ مِن خَشْيَةِ اللَّهِ وَعَينَ بَاتَتْ تَحْرُسُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ تَعَالَى.

দোযখের আগুন সেই চক্ষুকে কোনদিন স্পর্শ করবে না, যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে। এমনিভাবে যে চক্ষু আল্লাহর পথে প্রহরায় জাগ্রত রয়েছে, তাকেও আগুন স্পর্শ করবে না।”
হযরত আবু হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

عين باكية يوم القيامةِ إِلَّا عَيْنًا غَضَتْ عَنْ مَحَارِمِ اللَّهِ وَعَيْنًا سَهِرَت فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَعَدِنَا يَخْرُجُ مِنْهَا مِثْلُرأس الدُّبَابِ مِن خَشْيَةِ اللَّهِ تَعَالَى

“সকল চোখই কেয়ামতের দিন রোদন করবে—কেবলমাত্র ঐ চোখগুলো ছাড়া, যেগুলো আল্লাহর নিষেধ করা বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত রয়েছে, কিংবা আল্লাহর পথে জেহাদ ও মুজাহাদায় মগ্ন থাকার দরুন রাতে জাগ্রত রয়েছে অথবা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে মক্ষিকার মস্তক হলেও পরিমাণ অশ্রুপাত করেছে।”
হযরত আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) থেকে আরও বর্ণিত, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সে ব্যক্তি দোযখে প্রবেশ করবে না, যে আল্লাহর ভয়ে রোদন করেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না স্তন থেকে নির্গত দুধ পুনরায় স্তনে প্রবেশ করবে (অর্থাৎ অনুরূপভাবে আল্লাহর ভয়ে রোদনকারী ব্যক্তিরও দোযখে প্রবেশ করা অসম্ভব)। আল্লাহর পথের ধূলা ও দোযখাগ্নির ধোঁয়া কখনও একত্রিত হবে না।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস্ (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহর ভয়ে এক ফোঁটা অশ্রুপাত করা আমার নিকট এক হাজার দীনার সদকা করা অপেক্ষা প্রিয়।

হযরত আউন ইবনে আব্দুল্লাহ্ (রহঃ) বলেন, আমার কাছে এ হাদীস পৌঁছেছে যে, আল্লাহর ভয়ে প্রবাহিত অশ্রু শরীরের যে অংশে পতিত হবে, সে অংশটুকু দোযখের জন্য হারাম হয়ে যাবে।

হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আল্লাহর ভয়ে রোদন করতেন তাঁর সীনা মুবারকের অভ্যন্তর থেকে এমন আওয়াজ শ্রুত হতো, যেমন উত্তপ্ত ডেকচির ভিতর থেকে আওয়াজ বের হয়।

হযরত কিন্দী (রহঃ) বলেন, আল্লাহর ভয়ে রোদনকারীর অশ্রু কয়েক সাগর পরিমাণ অগ্নি নিভিয়ে দিতে পারে।

হযরত ইবনে সিমাক (রহঃ) নিজেই নিজকে শাসন করে বলতেন, ওহে! তুমি খোদাভক্ত ও ধর্মনিষ্ঠ লোকের ন্যায় কথা বল কিন্তু কাজ কর মুনাফেকের মত- সে সঙ্গে আবার জান্নাতে প্রবেশের আশাও পোষণ কর । না না; জান্নাতে প্রবেশকারী লোকজন এরূপ নয়, তাদের আমল-আখলাকই ভিন্ন, যা তোমার মধ্যে নাই।

ইমাম জাফর সাদেকের (রহঃ) উপদেশ

হযরত সুফিয়ান সওরী (রহঃ) বলেন, আমি হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলাম, হে রাসুলের বংশধর ! আমাকে কিছু উপদেশ প্রদান করুন। তিনি বললেন, হে সুফিয়ান। মিথ্যাবাদী কোনদিন মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে না, হিংসুক কোনদিন শান্তি পেতে পারে না, সর্বক্ষণ বিষণ্ণ ব্যক্তি কোনদিন কল্যাণ পেতে পারে না, রুক্ষ স্বভাবের লোক কোনদিন নেতৃত্ব লাভ করতে পারে না। আমি আরজ করলাম, হে নবীর বংশধর! আমাকে আরও নসীহত করুন। তিনি বললেন, হে সুফিয়ান। আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ থেকে বেঁচে চল, তাহলে তুমি আবেদ (ইবাদতকারী) হতে পারবে, আল্লাহ্ তা'আলা তোমার ভাগ্যে যা রেখেছেন, তাতে তুমি সন্তুষ্ট থাক, তাহলে তুমি মুসলিম হতে পারবে, লোকজনের সাথে তুমি এমন ব্যবহার কর যেমন তুমি তাদের কাছে পেতে চাও, তাহলে তুমি মুমিন হতে পারবে, দুশ্চরিত্র লোকের সাহচর্য গ্রহণ করো না, তারা তোমাকে মন্দ চরিত্রই শিক্ষা দিবে। কেননা, হাদীস শরীফে আছে, “বন্ধুর অনুকরণ মানুষের সহজাত বৃত্তি, কাজেই তোমাদের কেউ কারও সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইলে সে যেন পূর্বেই দেখে নেয় যে বন্ধুরূপে কাকে গ্রহণ করছে।” নিজের ব্যাপারে এমন লোকের নিকট থেকে পরামর্শ গ্রহণ কর, যে আল্লাহকে ভয় করে। আমি আরজ করলাম, হে আওলাদে রাসূল! আমাকে আরও নসীহত করুন। তিনি বললেন, হে সুফিয়ান। যে ব্যক্তি গোত্র ও জনবল ব্যতীত ইয্যত সম্মান ও বিজয় হাসিল করতে চায়, কিংবা রাজত্ব ও সাম্রাজ্য ব্যতীত মর্যাদা ও প্রভাব অর্জন করতে চায়, তার উচিত, সে যেন আল্লাহ্র অবাধ্যতার লাঞ্ছনা হতে বের হয়ে তাঁর আনুগত্যের প্রতি আগুয়ান হয়। আমি আরজ করলাম, হে আওলাদে রাসুল! আমাকে আরও উপদেশ প্রদান করুন। তিনি বললেন, আমার পিতা আমাকে তিনটি আদব। শিখিয়েছেনঃ এক, যে ব্যক্তি অসৎ লোককে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে, সে তার অনিষ্ট হতে বাঁচতে পারবে না। দুই, যে ব্যক্তি অসৎ পরিবেশে যাবে, সে অপবাদ থেকে বাচতে পারবে না। তিন, 'যে ব্যক্তি নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, সে লজ্জিত ও অপমানিত হবে।

হযরত ইবনে মুবারক (রহঃ) বলেন, আমি ওয়াহ্ ইবনে ওয়ারদ (রহঃ)কে জিজ্ঞাসা করেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর না-ফরমানী করে সে কি ইবাদত- বন্দেগীর স্বাদ আস্বাদন করতে পারে? তিনি বলেছেন, কস্মিনকালেও না; এমনকি যে আল্লাহর না-ফরমানীর ইচ্ছাও অন্তরে পোষণ করে, সে-ও ইবাদতে স্বাদ পেতে পারে না।

আল্লাহর ভয় অন্তরে পোষণ

ইমাম আবুল ফরজ ইবনে জাওযী (রহঃ) বলেন, আল্লাহর ভয়ই একমাত্র আগুন, যা কুপ্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে জ্বালিয়ে দিতে পারে। এ খোদা-ভীতির মাহাত্ম্য ও ফযীলত ঠিক সেই পরিমাণ যে পরিমাণ সে কামনা- বাসনাকে জ্বালাতে পারে, যে পরিমাণ সে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বাঁচাতে পারে এবং যে পরিমাণ সে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে।

আল্লাহর খওফ ও ভয়ের প্রচুর ফযীলত ও মাহাত্ম্য এজন্যেই যে, এরই ওসীলায় মানব-চরিত্রে তাকওয়া-পরহেযগারী, সততা ও সাধুতা, মুজাহাদা ও কৃচ্ছতা সাধনা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের যাবতীয় গুণ-বৈশিষ্ট্য পয়দা হয়। কুরআনের আয়াত ও বহু হাদীসে এ কথার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। আল্লাহ্ তা'আলা বলেন :

هُدًی وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلَّذِیۡنَ هُمۡ لِرَبِّهِمۡ یَرۡهَبُوۡنَ

হেদায়াত ও রহমত সে সমস্ত লোকের জন্য, যারা নিজেদের প্রতিপালককে ভয় করে।” (আ'রাফ : ১৫৪ )

আল্লাহ্ পাক আরও ইরশাদ করেন:

 رَضِیَ اللّٰهُ عَنۡهُمۡ وَ رَضُوۡا عَنۡهُ ؕ ذٰلِکَ لِمَنۡ خَشِیَ رَبَّهٗ 

"আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এ (সন্তুষ্টি) তাদের জন্য যারা স্বীয় প্রতিপালককে ভয় করে।” (বাইয়্যিনাহ্ঃ ৮)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :

 وَ لِمَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ جَنَّتٰنِ

"এবং যারা আপন প্রতিপালককের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়ার বিষয় ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে বেহেশতে দু'টি উদ্যান।" (আর-রহমান : ৪৬)

আরও ইরশাদ হয়েছে :

 سَیَذَّکَّرُ مَنۡ یَّخۡشٰی

উপদেশ সে ব্যক্তিই গ্রহণ করে, যে ভয় করে।" (আ'লাঃ ১০ ) 

আল্লাহ্ পাক আরও বলেন:

اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰهَ مِنۡ عِبَادِهِ الۡعُلَمٰٓؤُا

নিশ্চয়ই আল্লাহকে ভয় করে তার বান্দাদের মধ্যে আলেমগণই।” (ফাতির: ২৮)

এছাড়া আরও অনেক আয়াত উপরোক্ত বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ রয়েছে।

ইলমের ফযীলত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসসমূহও আল্লাহ্-ভীতির ফযীলত ও মাহাত্ম্যকেই বুঝায়। কেননা, আল্লাহ্-ভীতি প্রকৃতপক্ষে ইলমেরই ফলস্বরূপ।

ইবনে আবিদ্দুনয়া (রহঃ) রেওয়ায়াত করেন যে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “বান্দার অন্তর যখন আল্লাহের ভয়ে কেঁপে উঠে, তখন তার গুনাহ্ এমনভাবে ঝরে পড়ে যেমন শুকনা বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে।

হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, “আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন, আমি আমার বান্দার মধ্যে দু'টি ভয় এক করি না, এমনিভাবে তাকে দু'টি নিরাপত্তা বা শাস্তি একসাথে প্রদান করি না- দুনিয়াতে সে যদি আমা হতে নির্ভীক থাকে, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি তাকে ভীত রাখবো। আর যদি দুনিয়াতে সে আমাকে ভয় করে, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি তাকে নির্ভয় প্রদান করবো।”
হযরত আবূ সুলাইমান দাররানী (রহঃ) বলেন, যে অন্তরে আল্লাহর ভয় নাই, সে অন্তর উজাড় বা বিধ্বস্ত অন্তর।

আল্লাহ্ পাক বলেনঃ

إِنَّهُ لَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ

বস্তুতঃ আল্লাহর পাকড়াও হতে কেউ নিশ্চিত হয় না কেবল ঐ সকল লোক ব্যতীত যাদের দুর্গতিই উপস্থিত হয়েছে।” (আ'রাফ : ৯৯)



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url