তওবার ফযীলত গুরুত্ব ও তাৎপর্য




ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ আল-গাযযালী (রহঃ) ছিলেন একজন যুগস্রেষ্ট সাধক ও আলেম। ইসলামের খেদমতে তাঁর বয়ান এবং তাঁর লেখা কিতাবগুলোর মাঝে এমন একটি যাদুকরী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যা অন্য কারো লেখায় বা বয়ানে এতটা প্রভাব সৃষ্টি করে না। তাঁর লেখা কিতাবগুলো পড়ে অতি সহজেই প্রতিটি পাঠকের হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠে। “দোযখ ও দোযখের ভয়াবহ শাস্তির বয়ান” শীর্ষক এই প্রবন্ধখানা ইমাম গাযযালীর লেখা “মুকাশাফাতুল কুলূব” বা “আত্মার আলোকমণি” কিতাবের অনুস্মরণে লেখা হয়েছে।



তওবার ফযীলত গুরুত্ব ও তাৎপর্য

তওবার ফযীলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত উল্লেখিত হয়েছে।
আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন:

وتوبوا إلى اللهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

"হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর সমীপে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার।" (নূর : ৩১ )
তিনি আরও ইরশাদ করেন ।

 وَ الَّذِیۡنَ لَا یَدۡعُوۡنَ مَعَ اللّٰهِ اِلٰـهًا اٰخَرَ وَ لَا یَقۡتُلُوۡنَ النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰهُ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ لَا یَزۡنُوۡنَ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ یَلۡقَ اَثَامًا ﴿ۙ۶۸ یُّضٰعَفۡ لَهُ الۡعَذَابُ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ یَخۡلُدۡ فِیۡهٖ مُهَانًا ﴿٭ۖ۶۹ اِلَّا مَنۡ تَابَ وَ اٰمَنَ وَ عَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَاُولٰٓئِکَ یُبَدِّلُ اللّٰهُ سَیِّاٰتِهِمۡ حَسَنٰتٍ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۷۰وَ مَنۡ تَابَ وَ عَمِلَ صَالِحًا فَاِنَّهٗ یَتُوۡبُ اِلَی اللّٰهِ مَتَابًا ﴿۷۱

"আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন মাবূদের উপাসনা করে না এবং আল্লাহ্ যাকে (হত্যা করা) হারাম করে দিয়েছেন তাকে হত্যা করে না শরীয়তসম্মত কারণ ব্যতীত এবং তারা ব্যভিচার করে না, আর যে ব্যক্তি এরূপ কাজ করবে, তাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ক্বিয়ামত দিবসে তার শাস্তি বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং সে এতে অনন্তকাল লাঞ্ছিত অবস্থায় থাকবে। কিন্তু যারা তওবা করে নেয় এবং ঈমান আনয়ন করে এবং নেক কাজ করতে থাকে, এরূপ লোকদেরকে আল্লাহ্ তাদের পাপসমূহের পরিবর্তে পুন্যসমূহ দান করবেন। আর আল্লাহ্ বড়ই ক্ষমাশীল, করুণাময়। আর যে ব্যক্তি তওবা করে ও নেক কাজ করে, সে ব্যক্তি আল্লাহ্র প্রতি বিশেষভাবে প্রত্যাবর্তন করছে। (ফুরক্বান : ৬৮-৭১)

তওবা প্রসঙ্গে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম শরীফে আছে, আল্লাহ্ তা'আলা দিবসে পাপকার্যে লিপ্ত লোকদের গুনাহমাফী ও তওবা কবূলের জন্য রাত্রিতে তাঁর দয়ার হস্ত প্রসারিত করেন এবং রাত্রিকালে পাপাচারে লিপ্ত লোকদের গুনাহমাফী ও তওবা কবুলের জন্য দিবসে হাত প্রসারিত করেন। পশ্চিম দিকে হতে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত এভাবে আল্লাহ্ তা'আলা তওবা কবুলের জন্য ডাকতে থাকবেন।

তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, পশ্চিম দিকে একটি দরজা খোলা হয়েছে, তা সত্তর বৎসরের মতান্তরে চল্লিশ বৎসরের রাস্তার দূরত্ব পরিমাণ বিস্তৃত। আসমান-যমীন সৃষ্টি হওয়ার দিন থেকে আজ পর্যন্ত সেই দরজা তওবা কবুলের জন্য খোলা রয়েছে এবং পশ্চিম দিক হতে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত খোলা থাকবে, কখনও বন্ধ হবে না।
হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, তওবাকারীদের জন্য পশ্চিম দিকে সত্তর বছরের পথ পরিমাণ দূরত্বের প্রস্থ সম্বলিত একটি দরজা আছে, সেদিক থেকে সূর্যোদয় না-হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ হবে না। এদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেছেন :

يومَ يَأْتِي بَعضُ ايَاتِ رَبِّكَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا

“যেদিন আপনার প্রতিপালকের বড় নিদর্শন এসে পৌঁছবে, (সেদিন) কোন এইরূপ ব্যক্তির ঈমান তার কাজে আসবে না।” (আনআম : ১৫৮)

ত্ববরানী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, বেহেশতের আটটি দরজার মধ্যে শুধুমাত্র তওবার একটি দরজা ছাড়া আর সবকয়টি বন্ধ রাখা হয়েছে। পশ্চিম দিক হতে সূর্যোদয় পর্যন্ত তওবার দরজাটি খোলাই থাকবে।'

হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, তোমরা যদি এত অধিক পরিমাণে গুনাহ্ কর, যার স্তূপ আকাশের কিনারায় গিয়ে ঠেকে; কিন্তু পরক্ষণে যদি স্বচ্ছ- পবিত্র মন নিয়ে আন্তরিকভাবে তওবা কর, তবে আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের তওবা কবুল করে নিবেন।

হাদীস শরীফে আছে, মানুষের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় হলো, আল্লাহ্র প্রতি প্রত্যাবর্তন ও অনুরাগ সহকারে আয়ু দীর্ঘ হওয়া।

হাদীস শরীফে আছে-

كل ابن ادم خطاء وخيرُ الخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ

'বনী আদম মাত্রই গুনাহ্গার; কিন্তু উত্তম গুনাগার সে-ই, যে তওবাকারী হয়।'

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, একদা এক বান্দা গুনাহ্ করার পর অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে আল্লাহ্র দরবারে আরজ করলো, ইয়া আল্লাহ্ । আমি গুনাহ্ করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দিন। আল্লাহ্ তা'আলা বললেনঃ আমার বান্দার আমার প্রতি ঈমান রয়েছে- সে বিশ্বাস করে যে, আমি গুনাহ্ মাফ করে থাকি বা শাস্তি প্রদান করি। অতঃপর তাকে মাফ করে দিলেন। সেই বান্দা কিছুকাল গুনাহ্ থেকে বিরত থাকার পর পুনরায় পাপে লিপ্ত হয়। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সে আবার আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাইল। আল্লাহ্ তা'আলা বললেন : আমার বান্দা বিশ্বাস করে যে, আমি গুনাহ্ মাফ করি বা শাস্তি প্রদান করি। অতঃপর তাকে পুনরায় মাফ করে দিলেন। এভাবে কিছুকাল গুনাহ্ থেকে বিরত থাকার পর সে পুনরায় গুনাহে লিপ্ত হয়ে গেল এবং বললো : ওগো মাওলা। আমি আবার গুনাহ্ করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দিন। আল্লাহ্ তা'আলা বললেন ঃ আমার বান্দা বিশ্বাস করে যে, তার একজন রব্ব আছে, যিনি গুনাহ্ মাফ করেন বা শাস্তি প্রদান করেন। অতঃপর তাকে পুনরায় মাফ করে দিলেন, - এখন যা ইচ্ছা সে করুক।
ইমাম মুনযির (রহঃ) বলেন : 'এখন যা ইচ্ছা সে করুক কথাটির মর্ম হলো, বান্দার দ্বারা গুনাহ্ হয়ে যাওয়ার পর স্বচ্ছ মন ও পুনঃ গুনাহে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আন্তরিকভাবে তওবা ও এস্তেগফার করলে এই তওবা ও এস্তেগফার তার অতীতের গুনাহের জন্য কাফ্ফারাহ্ (প্রায়শ্চিত্য, ক্ষমা) হবে। অর্থাৎ সত্যিকার তওবা ও এস্তেগফারের জন্য আন্তরিক অনুশোচনা ও পুনরায় লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প থাকা চাই। অন্যথায় তা হবে মিথ্যুক ও কপট লোকদের তওবা, যা আল্লাহ্র কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, গুনাহ্ করার পর মুমিনের অন্তরে একটি কালো দাগ উদ্ভূত হয়। তওবার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা'আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পর যদি কৃতপাপ পরিহার করে, তবে সেই দাগ মিটিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি উত্তরোত্তর গুনাহে লিপ্ত হতে থাকে, তবে সেই দাগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে তার অন্তর মোহরযুক্ত করে দেয়। একেই বলা হয় (মরিচা)। পবিত্র কুরআনে তা এভাবে উল্লিখিত হয়েছে :

كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُونَ

“কখনও এরূপ নয়, বরং তাদের অন্তরসমূহে তাদের (গর্হিত) কার্য- কলাপের মরিচা ধরেছে।" (মুতাফ্ফিফীন : ১৪)

তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দার প্রাণবায়ু নির্গত হওয়ার কাছাকাছি হয়ে যায়, আল্লাহ্ তা'আলা তার কৃত তওবা কবুল করেন।

হযরত মু'আয (রাযিঃ) বলেন : একদা রাসূলল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে হাত ধরে এক মাইল পর্যন্ত চললেন, অতঃপর বললেনঃ ওহে মুআয! তোমাকে আমি নছীহত করি : আল্লাহকে ভয় কর, সত্য বল, ওয়াদা পূরণ কর, আমানত রক্ষা কর, খিয়ানত পরিত্যাগ কর, এতীমের প্রতি রহম কর, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার কর, গোস্বা হজম কর, নম্র কথা বল, সালামের ব্যাপক প্রচলন কর, ন্যায়পরায়ণ শাসকের অনুগত থাক, কুরআনের মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা কর, আখেরাতের প্রতি অনুরাগী হও, কেয়ামতের দিন হিসাব-নিকাশের ভয় কর, পার্থিব আশা-আকাংখা কম কর, সর্বদা নেক আমলে মশগুল থাক। হে মুআয! আমি তোমাকে আরও নছীহত করি : কোন মুসলমানকে কটু বাক্য বলো না, মিথ্যাকে সত্য, সত্যকে মিথ্যা বলো না, ন্যায়পরায়ণ শাসকের অবাধ্যতা করো না, আল্লাহর যমীনে ফেৎনা-ফাসাদ ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করো না। হে মুআয! তুমি যেখানেই থাক না কেন, সেখানে বৃক্ষতরুলতাই হোক আর জড়পদার্থই হোক তুমি সর্বত্র সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ কর, গুনাহ্ হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ তওবা কর—গোপন গুনাহের জন্য গোপন তওবা আর প্রকাশ্য গোনাহের জন্য প্রকাশ্য তওবা।'

অপর এক হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'অনুতাপকারী ব্যক্তি আল্লাহর রহমতের আশা করতে পারে, কিন্তু হঠকারী ব্যক্তি যেন তার গজবের প্রতীক্ষায় থাকে। ওহে আল্লাহর বান্দারা। একদিন না একদিন আমলনামা অবশ্যই তোমাদের হাতে আসবে এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে প্রত্যেকেই তার ভাল-মন্দ প্রত্যক্ষ করে নিবে। কিন্তু পরিণাম তারই ভাল হবে, যার শেষাবস্থা ভাল হবে। দিবা-রাত্রির প্রতিটি মুহূর্ত আপন গতিতে দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে, অতএব শীঘ্র আখেরাতের প্রস্তুতি নাও, আমলের দিকে বেগবান হও, টালবাহানা ও গাফলতিকে মোটেও প্রশ্রয় দিও না। কারণ, মৃত্যু এমন এক বস্তু, যা অকস্মাৎ এসে হাজির হয়ে যাবে, তখন তোমার করার কিছু থাকবে না। খবরদার! আল্লাহ্ পাকের অনন্ত ধৈর্য ও বাহ্যিক অবকাশ প্রদানে ধোকায় পড়ো না, আত্মবিস্মৃত হয়ো না। কারণ, দোযখের আগুন তোমা থেকে খুব বেশী দুরে নয়। অতঃপর হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন-

فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ ، وَمَنْ يَعْمَلُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًا يره

"যে ব্যক্তি রেণু পরিমাণ নেক কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে : আর যে ব্যক্তি রেণু পরিমাণ বদ্ কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে।” ( যিলযাল : ৭,৮ ) ত্বরানী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :

التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ كَمَنْ لا ذَنْبَ لَهُ.

“গুনাহ্ থেকে তওবাকারী ব্যক্তি ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যার মোটেই কোন গুনাহ্ নাই।”
বায়হাকী শরীফে আছে, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার পর পুনরায় গুনাহে লিপ্ত হলো, সে যেন আল্লাহর সাথে ঠাট্টা করলো।'

ইবনে হাব্বান ও হাকেম রেওয়ায়াত করেন, ‘তওবার মূল, বিষয়ই হচ্ছে অন্তরের অনুতাপ ও অনুশোচনা।' অর্থাৎ হজ্জের জন্য আরাফার ময়দানে অবস্থান করা যেমন রুকন বা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয়, তওবার জন্যে অনুতাপ-অনুশোচনা ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্তরে এরূপ প্রতিক্রিয়ার অর্থ হলো স্বীয় পাপ ও কৃতকর্মের উপর আল্লাহ্র আযাব ও শাস্তির ভয় অন্তরে জাগরুক হওয়া। ধন-সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি বা মান-সম্মানের ঘাটতি হতে বাঁচার স্বার্থে অনুশোচনা করলে, তওবার মূল বিষয়ের অবিদ্যমানতার দরুন তা হবে সম্পূর্ণ অন্তসারশূন্য ও নিষ্ফল প্রয়াস; তওবা হিসাবে তা আল্লাহর কাছে মোটেও গণ্য হবে না। হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে:

ما عَلِمَ اللهُ مِنْ عَبْدٍ نَدَامَةٌ عَلَى ذَنْبِ إِلَّا غَفَرَ لَهُ قَبْلَ ان يستغفِرَهُ مِنْهُ.

“যে বান্দা কৃতপাপের দরুন লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়, - যা প্রকৃত পক্ষে একমাত্র আল্লাহ্ পাকই জানতে পারেন- সেই বান্দা ক্ষমা প্রার্থনা করার পূর্বেই আল্লাহ্ পাক তাকে ক্ষমা করে দেন।”

মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : ঐ পবিত্র সত্তার কসম, যার কুদরতের মুঠোয় আমার প্রাণ, তোমরা গুনাহ্ করবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে- এরূপ যদি না হয়, তবে আল্লাহ্ তা'আলা এমন জাতি সৃষ্টি করবেন যারা গুনাহে লিপ্ত হবে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করবে, অতঃপর তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন।

হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, 'আল্লাহর চাইতে অধিক গুণ- কীর্তন ও প্রশংসা পছন্দকারী আর কেউ নয়, অতএব, তিনি নিজেই নিজের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহর চাইতে অধিক আত্মমর্যাদাবান কেউ নয়, তাই তিনি অশ্লীল কার্যকলাপ হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহর চাইতে অধিক উযর আপত্তি ও অক্ষমতা কবুলকারী আর কেউ নয়, তাই তিনি কুরআন নাযিল করেছেন এবং রাসূল পাঠিয়েছেন।'

মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হয়। সে অশ্লীল অপকর্মে (ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ায় তার অবৈধ গর্ভের সঞ্চার হয়েছিল। সে আরজ করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি হদের (শরয়ী দণ্ডের) উপযুক্ত অপরাধ করেছি; আমার উপর হদ্দ প্রয়োগ করুন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিভাবককে ডেকে উপস্থিত করে বললেন, তাকে যত্ন সহকারে তোমাদের তত্ত্বাবধানে রাখ, সন্তান খালাস হওয়ার পর আমার কাছে নিয়ে এসো। যথাসময়ে তাকে পুনরায় নিয়ে আসার পর রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুমে তার উপর হদ্দ প্রয়োগ করা হলো। অতঃপর হুযুর (সাঃ) নিজে জানাযা পড়লেন। হযরত উমর (রাযিঃ) আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্। আপনি তার জানাযা পড়লেন, অথচ সে ব্যভিচার করেছে? হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেনঃ ওহে উমর। মহিলাটি এমন তওবা করেছে, যদি তা মদীনার প্রচুর সংখ্যক লোকদের মাঝে বন্টন করে দেওয়া হয়, তাহলে সকলের জন্য তা যথেষ্ট হবে; তুমি কি এরূপ তওবাকারী কখনও দেখেছ যে আল্লাহ্র জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দিয়েছে?
তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার নয় দু'বার নয়—এভাবে তিনি বলতে বলতে বললেন, সাতবারও নয় বরং আরও অধিকবার বলতে শুনেছি যে, বনী ইসরাঈল গোত্রের জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি অশ্লীল অপকর্মে অভ্যস্থ ছিল। একদা জনৈকা মহিলা তার নিকট হাজির হওয়ার পর তাকে ষাট দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) প্রদানাস্তে ব্যভিচারের জন্য বাধ্য করলো। এভাবে লোকটি যখন স্বীয় মনোস্কামনা পূরণের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি ও উত্তেজনার আসনে বসলো, তখন স্ত্রীলোকটির সর্বশরীর থর থর করে কাঁপতে আরম্ভ করলো এবং সে কাঁদতে লাগলো। লোকটি জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কাঁদছ কেন, তবে কি আমাকে তোমার অপছন্দ হচ্ছে। স্ত্রীলোকটি বললোঃ না, বরং আমি জীবনে কোনদিন এহেন অশ্লীল কার্যে লিপ্ত হয় নাই, আজকে শুধুমাত্র ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এ কাজের জন্য বাধ্য হচ্ছি, এজন্যেই আমি বিচলিত, উৎকণ্ঠিত। লোকটি বললো, তোমার এহেন ভূখা-ফাকা ও দারিদ্রাবস্থায়ও তুমি এ থেকে বিরাগী আর এ কাজে তুমি জীবনেও কনর্যক্ত হও নাই; এ দীনারগুলো তোমারই জন্য, আর আল্লাহর কসম, ভবিষ্যতে আমিও এ কাজে কোনদিন লিপ্ত হবো না। আল্লাহ্র মর্জী সেই রাত্রেই তার মৃত্যু হয়। লোকজন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বাড়ীর দরজায় লেখা: 'আল্লাহ্ তা'আলা এ লোকটিকে মাফ করে দিয়েছেন।

হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত অতীতের এক সময়ে দু'টি জনপদ ছিল, একটি পুণ্যবান লোকদের, আরেকটি পাপী লোকদের। পাপী লোকদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি স্বীয় জন্মভূমি ত্যাগ করে সৎলোকদের এলাকায় যাত্রা করলো। উদ্দেশ্য ছিল সৎভাবে জীবন-যাপন করবে। কিন্তু খোদার মর্জী পথিমধ্যে এক জায়গায় লোকটি মারা গেল। এখন তাকে কেন্দ্র করে রহমতের ফেরেশ্তা ও শয়তানের মধ্যে ঝগড়া শুরু হলো। শয়তান বললো: খোদার কসম, সে কোনদিন আমার কথা অমান্য করে নাই। ফেরেশতা বললেনঃ লোকটি বাড়ী হতে তওবা করে বের হয়েছে। করুণাময় আল্লাহ্ তা'আলা উভয়ের মধ্যে ফয়সালা করে দিলেনঃ তোমরা লোকটির মৃতদেহকে কেন্দ্র করে জরীপ করে দেখ দুই জনপদের মধ্যে সে কোটির অধিক নিকটবর্তী। দেখা গেল সে সৎলোদের এলাকার দিকে এক বিঘত পরিমাণ স্থান অধিক অতিক্রম করেছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা'আলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন। আবার একথাও রয়েছে যে, আল্লাহ্ তা'আলা আপন রহমতে সৎলোকদের এলাকাটিকে নিকটতম করে দিয়েছিলেন।

একশ খুন করেও ক্ষমা লাভ

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, পূর্বেকার যুগে এক ব্যক্তি ঘোর পাপী ছিল। বিনা অপরাধে সে নিরানব্বই জন লোককে হত্যা করেছে। পরিশেষে নিজের কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করার ইচ্ছা করলো। সে জানতো না যে, আল্লাহর দরবারে তার তওবা কবূল হবে কিনা। অতএব, সে একজন বুযুর্গ লোকের অনুসন্ধান করছিল। ইতিমধ্যে লোকমুখে একজন প্রসিদ্ধ আবেদ লোকের সন্ধান পেয়ে তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলো: আমি একজন ঘোর পাপী, বিনা দোষে নিরানব্বই জন নিরপরাধ লোককে আমি হত্যা করেছি, বলুন আমার তওবা কবুল হবে কিনা? দরবেশ লোকটি উত্তর করলোঃ তোমার তওবা কবুল হবে না। এ কথা শুনে পাপী লোকটি হতাশ হয়ে এ আবেদ লোকটিকেও হত্যা করে নরহত্যার সংখ্যা একশত পূর্ণ করে নিলো। অতঃপর সে আরেকজন বিখ্যাত আলেমের সন্ধান জানতে পেরে তার খেদমতে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো: আমি একজন ঘোর পাপী, আমার তওবা কবুল হবে কিনা? আলেম লোকটি উত্তর করলো 'তোমার তওবা কবুল হবে, কিন্তু তোমার আবাসভূমিই সর্ববিধ পাপের কারণ, তুমি অন্যত্র অমুক স্থানে চলে যাও, সেখানে বহু আবেদ লোক বাস করেন, তুমিও তাদের সাথে ইবাদতে মগ্ন হয়ে যাও।' সে ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ উক্ত স্থানের উদ্দেশে রওনা হলো। কিন্তু গন্তব্যস্থানে পৌঁছার পূর্বেই মধ্যপথে সে প্রাণ ত্যাগ করলো। এখন তাকে বেহেশতে নিয়ে যাওয়া হবে কি দোযখে নিক্ষেপ করা হবে, এ নিয়ে রহমতের ফেরেশতা ও আযাবের ফেরেশতার মধ্যে মতভেদ হতে লাগলো। প্রত্যেকে বলতে লাগলোঃ এই লোক আমার আওতার মধ্যে। এ সময় আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে নির্দেশ আসলো, তোমরা পাপীর বাসগৃহ ও দরবেশদের আশ্রমের দূরত্ব জরীপ করে দেখ, মৃতদেহ থেকে কোন দিকের দূরত্ব অধিক। দেখা গেল, দরবেশদের আশ্রমের দিকে সে এক বিঘত পরিমাণ স্থান অধিক অতিক্রম করেছিল। নির্দেশ হলো তাকে বেহেশতে নিয়ে যাও। তৎক্ষণাৎ রহমতের ফেরেশতা তাকে বেহেশতে নিয়ে গেল। অপর এক রেওয়ায়াতে প্রকাশ, আল্লাহ্ তা'আলা একদিকের যমীনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, দূরবর্তী হয়ে যাও এবং অপর দিকের যমীনকে নির্দেশ দিয়েছেন নিকটবর্তী হয়ে যাও। তারপর জরীপ করতে হুকুম করেছেন। ফলে, লোকটি দরবেশদের আশ্রমের দিকে নিকটবর্তী হয় এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।'



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url