তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন - ৪ || তাফসীর ফী যিলালিল কোরআনের ভূমিকা || কোরআনের ছায়াতলে ||







তাফসীর ফী যিলালিল কোরআনের ভূমিকা

কোরআনের ছায়াতলে

সাইয়েদ কুতুব শহীদ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আমার জীবনের কতিপয় পবিত্র দিবারাত্রি, যা কোরআনের অধ্যয়নে অতিবাহিত হয়েছে-
'কোরআনের ছায়াতলে' জীবন অতিবাহিত করা, তার অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা এবং আল্লাহ তায়ালার এই শেষ কেতাব অনুধাবনের চেষ্টায় লেগে থাকা এমন মহামূল্যবান সৌভাগ্যের ব্যাপার, যার অনুধাবন শুধু তিনিই করতে পারেন, যিনি তার সময়গুলোকে কোরআন বোঝার কাজে লাগিয়ে রেখেছেন এবং কোরআনের পথে চলে নিজের জীবনকে পুত ও পবিত্র করে নিতে পেরেছেন।'

আমি আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃতজ্ঞতা আদায় করছি, যিনি আমাকে এই মহান কাজের তওফীক দান করেছেন। আমি এই কোরআন অধ্যয়নে নিজের সময় ব্যয় করে এমন একটি মূল্যবান সম্পদ হাসিল করতে পেরেছি, যার মূল্য ও মর্যাদার কোনো ধারণা ও পরিমাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আমার মতো অধম ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তায়ালার এ ছিলো এক বিরাট অনুগ্রহ। আমি যখন কোরআনের ওপর চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছি তখন তিনি আমার জন্যে রহমতের সব কয়টি দরজাই খুলে দিয়েছেন এবং আমাকে কোরআনের 'রূহের' এতো নিকটবর্তী করে দিয়েছেন, মনে হয় যেন কোরআন নিজেই বুঝি আমার ওপর তার সত্যসমূহ খুলে খুলে বর্ণনা করছে।
       
কোরআনুল কারীম অধ্যয়নের সময় আমার মনে হয়েছে যেন আমি মর্ত্যলোক থেকে অনেক ওপরে উঠে গেছি, আর এই ওপর থেকে আমি নিচের পৃথিবীর দিকে আমার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছি, আর অবলোকন করছি জাহেলিয়াত যেন এক প্রলয়ংকরী ও সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে সমগ্র দুনিয়ার ওপর ছেয়ে আছে। আর এই জাহেলিয়াতে মাতোয়ারা মানুষগুলো যেন নিজ নিজ অন্ধকার আবেষ্টনীতে আটকা পড়ে আছে এবং এমন এক গভীর খাদের ভেতর চাপা পড়ে আছে যে, তাদের কর্ণকুহরে এই আসমানী ডাক পৌঁছুতে পারছে না। সমগ্র মানবতা যেন পাগলের ন্যায় নেশাগ্রস্ত হয়ে জাহেলিয়াতে ডুবে আছে এবং জাহেলিয়াতের কর্মতৎপরতায় তারা সবাই আনন্দে আত্মহারা, যেমন এক শিশু তার খেলনাসমূহ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

এই দৃশ্য থেকে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি এবং ভাবতে থাকি, কোরআনের উপস্থাপিত পূর্ণাংগ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন জীবনাদর্শকে দেখেও মানবতা কেন জাহেলিয়াতের এই দুর্গন্ধময় স্থানের দিকে ধাবিত হচ্ছে? এই অধপতনের দিকে তারা কেন নিমজ্জিত হচ্ছে এবং অন্ধকারের আবেষ্টনীতে তারা কেন ঘুরপাক খাচ্ছে, যেখানে কোরআন তাদের পরিচ্ছন্ন জীবনের দাওয়াত দিচ্ছে, জীবনের উচ্চতর স্থানের দিকে বারবার ডাক দিচ্ছে, চীৎকার দিয়ে তাদের ডাকছে, ‘এসো, হে মানুষরা, আমি তোমাদের অন্ধকারের অতল থেকে বের করে আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে নিয়ে আসি।'

কোরআন অধ্যয়নকালে আমি একথা অনুধাবন করেছি যে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে যে জীবন কাঠামো ও জীবন বিধান নির্ধারণ করেছেন তার সাথে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট-এই কায়েনাতের একটা গভীর মিল রয়েছে এবং এর সর্বত্র একটা সামঞ্জস্য বিরাজ করছে।

অতপর এটা আমি অনুধাবন করেছি যে, মানবতার বিপর্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে সামঞ্জশীল এই প্রাকৃতিক নিয়মনীতির বিরুদ্ধাচরণ করা, অপর কথায় এই নীতিমালার সাথে সংঘর্ষ বাঁধানো । মূলত শয়তান মানব জাতিকে এমন এক জাহান্নামের দিকে ঠেলে নিয়েছে যেখানে 'আফসোস' ছাড়া আর কোনো উপায়ই তার জন্যে বাকী থাকেনি। কোরআন অধ্যয়নের সময় আমি এ কথাটা খুব ভাল করে জেনে নিয়েছি যে, এই বিশ্বজগতের ব্যাপকতা অসীম এবং অদৃশ্যমান বিশ্ব এই দৃশ্যমান বিশ্বের চেয়ে অনেক ব্যাপক ।
       
মানবীয় জীবন এই বৈষয়িক দুনিয়ার রাস্তা ধরে আখেরাতের অসীম ব্যাপকতার দিকে ধাবিত হয়। মৃত্যু কোনো শুরুর শেষ নয় বরং তা হচ্ছে এক অন্তিম যাত্রার সূচনা মাত্র। দুনিয়া ও আখেরাতের দীর্ঘ দূরত্বের ওপর বিস্তৃত হয়ে আছে মানুষের এই জীবন। এই জীবনে মানুষ যা কিছুই অর্জন করুক না কেন, শুধু সেটুকুই নয় আরো অনেক কিছুই তার জন্যে রয়েছে। কোনো মানুষ এই দুনিয়ায় স্বীয় কর্মকান্ডের দন্ড থেকে বাঁচতে পারলেও ওখানে তার মুক্তি নেই । কারণ সেখানে কোনো যুলুম নেই, কিছুর অভাব নেই, কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি নেই। এই দুনিয়ায় একজন মোমেনের জীবন বিশ্ব চরাচরের সবকিছুর সাথেই সামঞ্জস্যশীল। মোমেন ব্যক্তি নিজেও আল্লাহ তায়ালার দিকে নিবিষ্ট এবং সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতিও আল্লাহ তায়ালার হুকুমের দিকে নিবিষ্ট, তাঁর হুকুমের সামনে সেজদারত।

'আসমানসমূহ ও যমীনের মাঝে যতো কিছু রয়েছে ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় সবকিছুই তাঁর সামনে মাথানত করছে এবং তাঁরই আশ্রয়তলে সবাই সকাল সন্ধ্যা অবনত মস্তকে নিমগ্ন | আছে।' (সূরা আর রা'দ-১৫)

এই সাত আসমান ও যমীনে এবং তার মধ্যে যতো সৃষ্ট জীব রয়েছে সবাই তাঁর গুণ গায়। এই সমগ্র সৃষ্টিকূলের মাঝে এমন একটি বস্তুও নেই, যা প্রশংসার সাথে তার তাসবীহ আদায় করছে না।' (সূরা বনি ইসরাঈল-88)

আমি কোরআন অধ্যয়নকালে একথা অনুধাবন করেছি যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এমন এক সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন, যার সাথে তারা ইতিপূর্বে কখনো পরিচিত হতে সক্ষম হয়নি। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, অতপর তাতে 'রহ' দান করে জীবন দিয়েছেন।
'যখন আমি তাকে (মানব আকৃতিতে) ঠিক করে নেবো এবং তাতে আমার 'রূহ' দান করবো | তখন তোমরা তার সামনে সেজদাবনত হয়ে পড়বে।' (সূরা আল হেজর-২৯)
       
এরপর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এই পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি নিয়োগ করলেন। "যখন তোমার মালিক বললেন, আমি যমীনের বুকে আমার একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করতে যাচ্ছি এবং যা কিছুই এই বিশ্বজগতে রয়েছে তার সবটুকুকেই আমি তোমার অধীনস্থ করে- রেখেছি।' (সূরা আল বাকারা-৩০)

আল্লাহ তায়ালা যেহেতু মানব জাতিকে মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত করেছেন এবং নিজস্ব রূহ দিয়ে তার মধ্যে জীবন দান করেছেন তাই এই আল্লাহকেন্দ্রিক বিশ্বাসই মানব জাতিকে একত্রিত করে রাখার মাধ্যম হিসেবে নির্ধারিত হবে। এই বিশ্বাসই হচ্ছে মোমেনের দেশ, মোমেনের জাতি ও মোমেনের খান্দান। এই কারণেই এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে মোমেন যে কোনো সময়ই একই প্লাটফরমে একত্রিত হতে পারে। মানুষ কোনো জন্তু-জানোয়ারের দল নয় যে, তাদের এক স্থানে একত্রিত করার জন্যে ঘাস কিংবা চারণভূমির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশ, জাতি ও তাদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকান্ডের স্থান তো সত্যিকার অর্থে মানবতার আসন থেকে অনেক অনেক নিচে ।

ইতিহাসের প্রতি স্তরে মোমেনদের খান্দান ছিলো একটাই। সর্বাবস্থায় সে ঈমানী কাফেলায় শামিল থাকবে। যে কাফেলার সর্দার ছিলেন- নূহ (আ.), ইবরাহীম (আ.), ইসমাইল (আ.), ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.), ইউসুফ (আ), মূসা (আ.), ঈসা (আ.), ও মোহাম্মদ (স.)।

'এই যে তোমাদের দল, মূলত তা একই দল এবং আমিই তোমাদের মালিক, অতএব তোমরা, আমাকেই ভয় করো।' (সূরা আল মোমেনুন- ৫৩ )

যখন থেকে মানুষ এই যমীনে পা রেখেছে তখন থেকেই ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে, যুগের প্রতিটি বিবর্তনে ঈমানদারদের একটা কাফেলা এখানে সতত মওজুদ ছিলো, আর ঈমানদারের এই কাফেলাকে ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি অধ্যায়ে একই ধরনের অবস্থা, একই ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাদের সংগ্রাম ছিলো জাহেলিয়াতের সাথে। গোমরাহীর বিরুদ্ধে তারা সর্বনাই আল্লাহদ্রোহিতাকে উচ্ছেদ কাজে তৎপর ছিলেন। তারা সর্বদাই অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। এই কাফেলা কঠিন থেকে কঠিনতর মুহূর্তেও সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথে হামেশা এগিয়ে গেছে, সব সময়ই তারা আল্লাহ তায়ালার সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কুফর ও ইসলামের প্রতিটি রণক্ষেত্রে তারা আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকেই সাহায্য প্রার্থনা করেছে।
       
এবং যারা কাফের, আল্লাহ তায়ালার প্রতি অবিশ্বাসী ছিলো, তারা তাদের নবীদের বললো, আমরা হয় তোমাদের এই জনপদ থেকে বের করে দেবো অথবা তোমাদেরকে আমাদের দলে শামিল হতে হবে। অতপর আল্লাহ তায়ালা তাদের কাছে ওহী পাঠিয়ে বললেন যে, আমি যালেমদের ধ্বংস করে দেবো এবং অতপর এই যমীনের ওপর তোমাদের আমি 'আবাদ' করাবো। একথা তাদের বেলায় প্রযোজ্য যারা কেয়ামতের দিন আমার সামনে দাঁড়ানোকে এবং আমার আযাবকে ভয় করে।' (সূরা ইবরাহীম- ১৩, ১৪)

কোরআন অধ্যয়নের বিভিন্ন স্তরে আমার অন্তরে এ কথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এই বিশ্ব চরাচরের সৃষ্টি কোনো ঘটনাচক্র নয় এবং এমনি এমনি তা সৃষ্টি করা হয়নি বরং আল্লাহ তায়ালা একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই তা তৈরী করেছেন ।

আমি প্রতিটি জিনিসকে সঠিক পরিমাণের ভিত্তিতে বানিয়েছি।' (সূরা আল কামার- ৪৯)

*এবং তিনিই প্রতিটি জিনিসকে তৈরী করেছেন এবং অতপর তার একটি পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন।' (সূরা আল ফোরকান- ২)

কিন্তু এসত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালার হেকমতসমূহ মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়নি। "এতে ব্যথিত হবার কিছু নেই যে, তোমরা কোনো জিনিসকে হয়তো পছন্দ করছো না, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাতে অনেক কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।' (সূরা আন নেসা- ১৯)

এতেও আশ্চর্যান্বিত হবার কিছু নেই যে, কোনো বিষয় তোমাদের ভালো লাগে না, অথচ আল্লাহ তায়ালা তাতে তোমাদের জন্যে মংগল নিহিত রেখেছেন, আবার অন্য একটি জিনিস যা তোমাদের ভালো লাগে অথচ তা তোমাদের জন্যে ক্ষতিকর। এ বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন এবং তোমরা কিছুই জানো না। (সূরা আল বাকারা- ২১৬)

উপায়-উপকরণের ওপর কখনো ফলাফল নির্ভর করে, আবার কখনো করেও না। উপকরণ কখনো কার্যকর হয়, আবার কখনো তা ব্যর্থও হয়ে যায়, আর উপায়-উপকরণ সবকিছুই আল্লাহ তায়ালার হাতে।

তোমার তো জানা নেই, হয়তো আল্লাহ তায়ালা অতপর এর কোনো রাস্তা বের করে দেবেন।' (সূরা আত্‌ তালাক-১০)

'তোমরা কিছুই আশা করতে পারো না-হ্যা আল্লাহ তায়ালার যা মঞ্জুর আছে তা ছাড়া।' (সূরা আত্‌ তাকওয়ীর ২৯)
       
মোমেন ব্যক্তি উপায়-উপকরণ এ জন্যেই ব্যবহার করে যে তাকে তা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার বিশ্বাস থাকে যে, এসব কিছুর কাংখিত ফলাফল আল্লাহ তায়ালার হাতেই। মোমেন তাঁর সমস্ত মনোনিবেশ আল্লাহ তায়ালার প্রতিই নিবন্ধ রাখে। তাঁর হেকমত, জ্ঞান ও ক্ষমতার প্রতি সে সদা সজাগ থাকে, আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের ওপর তার প্রগাঢ় আস্থা থাকে। এ কারণেই মোমেন ব্যক্তি সব রকমের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অন্ধ বিশ্বাস থেকে দূরে থাকতে পারে।

শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদের অশ্লীল কাজ করতে বলে, (অপর দিকে) আল্লাহ তায়ালা তোমাদের তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন, আল্লাহ তায়ালা বিশাল | ব্যাপক ও অনেক প্রজ্ঞাময়।' (সূরা আল বাকারা-২৬৮)

কোরআনের ছায়াতলে আমি গভীর প্রশান্তিময়, নিশ্চিত ও পবিত্র জীবন কাটিয়েছি। আমি প্রতিটি দিগন্তে আল্লাহ তায়ালার লীলা পর্যবেক্ষণ করেছি এবং জীবনের প্রত্যেকটি ব্যাপারে আমি তার বহু ধরনের গুণাবলীর বিকাশ পর্যবেক্ষণ করেছি।

যখন সে তাঁর কাছে দোয়ার হাত ওঠায় তখন, এমন কে আছেন যিনি অস্থির হৃদয়ের আকুতি শ্রবণ করেন, আবার কে এমন আছেন যিনি তাঁর কষ্টসমূহ দূরীভূত করেন।' (সূরা আন নামল ৬২) "তিনি স্বীয় বান্দাদের ওপর বিপুল ক্ষমতাবান।' (সূরা আল আনয়াম -৬১)

"তিনি প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও সম্যক অবগত।' (সূরা আল আনয়াম-৭৪)

আল্লাহ তায়ালা নিজ কার্যকলাপের ওপর অসীম ক্ষমতাবান, যদিও অধিকাংশ লোক তা জানে না।' (সূরা ইউসুফ-২১)

"জেনে রাখো, আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও তার মনের মাঝে প্রাচীরু হয়ে থাকেন।' (সূরা আল আনফাল-২৪)

"যা তিনি চান তাই তিনি করেন।' (সূরা আল বুরুজ-১৬)

'যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে কোনো না কোনো 'পথ' বের করে আনেন এবং তাকে এমন সব স্থান থেকে রেযেক সরবরাহ করেন, যার কোনো ধারণাও সে করতে পারে না। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করবে, তিনি নিজেই তার জন্যে যথেষ্ট হবেন এবং তিনি যা করতে চান তা সহজেই সম্পন্ন করে দেন। (সূরা আত্‌ তালাক ৩) 'এই ভূখন্ডে বিচরণশীল প্রতিটি প্রাণীকেই তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রণে ধরে রেখেছেন।' (সূরা হুম-৫৬)

'আল্লাহ তায়ালা কি তাঁর বান্দাদের জন্যে যথেষ্ট নন? এবং তাঁকে ছাড়া তারা তোমাদের অন্য লোকদের দিয়ে ভয় দেখায়।' (সূরা আঝ ঘুমার-৩৬)

আল্লাহ তায়ালা যাকে অপদস্থ করেন তাকে সম্মান দান করার কেউ নেই।' (সূরা আল হজ্জ্ব-১৮)

'আল্লাহ তায়ালা যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে পথ দেখাবার কেউ নেই।'(সূরা আঝ ঝুমার ২৩) 

আল্লাহ তায়ালা এই দুনিয়া জোড়া সবকিছু বানিয়ে একে অন্ধ প্রাকৃতিক নিয়মনীতির ওপর ছেড়ে দিয়ে রাখেননি বরং এখানে সর্বদাই প্রতিটি ক্রিয়া ও তার প্রতিক্রিয়ার পেছনে আল্লাহ তায়ালার নিজ ইচ্ছা ও এরাদাই কার্যকর থাকে।

মানুষের চলার জন্যে আল্লাহ তায়ালা যে জীবন বিধান রচনা করেছেন, তা মানবীয় উৎকর্ষের প্রতিটি ধাপে এবং উন্নতির প্রতিটি যুগে সমভাবে উপকারী, মুক্তি ও কল্যাণের ক্ষেত্রে একই ধরনের নিশ্চয়তা বিধানকারী প্রমাণিত হয়েছে। এই জীবন বিধান এমন সব মানুষদের জন্যে যারা এই দুনিয়ায় বসবাস করে, এ কারণেই তাতে তার প্রকৃতি, যোগ্যতা ও ক্ষমতার পরিপূর্ণ লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

ইসলাম এই ভূখন্ডে মানুষকে এবং তার ক্রিয়াকান্ডকে কখনো হীন করে দেখে না । ব্যক্তিগত, সামষ্টিক কিংবা কোনোক্ষেত্রেই তার গুরুত্বকে খাটো করে তাকে জন্তু-জানোয়ারের স্তরে নামিয়ে দেয় না। আবার তার ওপর তার যোগ্যতা, প্রতিভা ও ক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত কোনো দায়িত্বও চাপিয়ে দেয় না। ইসলামের মতে মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এতো ঠুনকো নয় যে, মনগড়া কতিপয় দর্শন তৈরী করে তাকে পালটে ফেলা যাবে। মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালার প্রদর্শিত 'সেরাতুল মোস্তাকীমে' কদম রাখে তখন মূলত সে তার প্রতিভা ও যোগ্যতা অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালার বিধি-নিষেধের ওপর চলতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে আল্লাহ তায়ালার পথে সে অগ্রসর হতে থাকে।

তবে ইসলামের এই পথ দীর্ঘ সহজ ও সরল। আল্লাহ তায়ালা এটা চান না যে, মানবীয় প্রকৃতিকে পদদলিত করে তার ওপর আধ্যাত্মিক কর্মের বোঝা চাপিয়ে ইসলামের উদ্দেশ্যসমূহ সিদ্ধ হোক। মানুষের তৈরী নতুন মতবাদগুলো মানুষকে যন্ত্রের মধ্যে ফেলে দিয়ে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আদর্শের বাস্তবায়ন দেখে নিতে চায়। এতে যদি দুনিয়ায় রক্তের নদী বয়ে যায়, মানুষের সামাজিক জীবন কাঠামো তছনছ হয়ে যায়, কিংবা তার অতীত ইতিহাসের অর্জিত পাওনাগুলো সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তাতেও কিছু আসে যায় না।

ইসলাম তো মানুষের প্রকৃতির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে মিলে মিশে উন্নতির পথে কদম রাখতে চায়। দরকার মতো তাকে পথ প্রদর্শন করে অগ্রসর হতে চায়। এই প্রকৃতি যখন কল্যাণের দিকে পা বাড়ায় তখন ইসলাম তাকে আশ্রয় দেয়। আবার যখন অকল্যাণের দিকে ধাবিত হয় তখন এই প্রবণতা থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখে। ইসলাম প্রকৃতিকে পদদলিত করে অগ্রসর হতে চায় না বরং বুদ্ধিমত্তা ও হেকমতের সাথে প্রয়োজনে তাকে চলার পথ দেখায় এবং তাকে সাথে নিয়েই চলতে চায়। এই উন্নতির শীর্ষে পৌঁছানোর জন্যে এক যুগ, দু'যুগ সময়ও লাগতে পারে, আবার এই উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্যে বহু শতাব্দীরও প্রয়োজন হতে পারে।
       
ইসলামের উদাহরণ হচ্ছে একটি ছোট চারা গাছের মতো। একটি ছোট বীজ থেকে যার উদ্ভব, আস্তে আস্তে তা বড়ো হয় আবহাওয়ার বিবর্তনে ঝড়ঝঞ্জা ও দমকা হাওয়ার মোকাবেলা করে এক দীর্ঘ সময় পরে তা শক্ত বৃক্ষে পরিণত হয়। এই গাছ যিনি লাগিয়েছেন তিনি অধিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন, জ্ঞানী ও সর্বদ্রষ্টা। তিনি ভালো করেই জানেন একদিন না একদিন এই চারাগাছ বৃক্ষে পরিণত হবে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে তাকে তার আহার পরিবেশন করা হবে এবং আস্তে আস্তে তা বড়ো হবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন ও ঝড় তুফানে তা দাঁড়িয়ে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা যে প্রাকৃতিক নিয়মনীতির ওপর মানুষকে তৈরী করেছেন তাকে পদদলিত করে জোর করে চাপিয়ে দেয়া একটা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করলে তার ফলাফল হয়তো তাড়াতাড়িই দেখতে পাওয়া যাবে, কিন্তু তেমন কিছু করার আল্লাহ তায়ালার কোনোই প্রয়োজন নেই ।

'এবং তোমরা আল্লাহ তায়ালার নিয়মনীতিতে কখনো কোনো রদবদল দেখতে পাবে না।' (সূরা আল আহযাব-৬2)
আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে যে জীবন বিধান ও বিশ্বচরাচরের জন্যে যে নিয়ম নীতি নির্ধারণ করেছেন তার মূল ও একমাত্র বুনিয়াদ হচ্ছে 'হক'। কেননা প্রতিটি জিনিসই আপন অস্তিত্বের জন্যে আল্লাহ তায়ালার কাছে ঋণী এবং আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন 'হক'।
'এটি এ কারণে যে, আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব সত্য ও সঠিক, আল্লাহকে বাদ দিয়ে এরা যাদের | ডাকে তারা মিথ্যা এবং আল্লাহ তায়ালা মহান, মর্যাদাবান ও সর্বশ্রেষ্ঠ।' (সূরা লোকমান-৩০) 'আল্লাহ তায়ালা একে 'হক' ছাড়া আর কিছু দিয়েই তৈরী করেননি।'
“হে পরোয়ারদেগার, তুমি এই সৃষ্টিকূলকে নিরর্থক তৈরী করোনি, তুমি পবিত্র।' (সূরা আলে ইমরান-১৯১)
মোটকথা, এই বিশ্বজগতের মূল কথা হচ্ছে এই 'হক'। যখনি সৃষ্টি এই মৌলিক 'হক' থেকে | বিচ্যুত হয়ে পড়বে তখনই তার মেরুদন্ড ভেংগে পড়বে।
যদি 'হক' তাদের ইচ্ছাসমূহের আনুগত্য করে তাহলে আসমানসমূহ ও যমীনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে যাবে। এই কারণেই 'হক'কে ফলে ফুলে সুশোভিত হতে হবে এবং বাতিলকে মিটিয়ে যেতে হবে।
'আমি বরং সত্যকে মিথ্যার ওপর নিক্ষেপ করি সত্য তখন মিথ্যার মাথা কেটে ফেলে এবং মিথ্যা মিটে যায়।' (সূরা আল আম্বিয়া-১৮)


তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি নাযিল করেছেন, তারপর তা থেকে নদী-নালাসমূহ নিজেদের পাত্র মোতাবেক পানি গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছে। এরপর এই নদী-নালায় প্লাবন এলো, ফলে পানির উপরিভাগে কিছু ফেনাও সৃষ্টি হলো। অলংকারাদি বানাবার কালে মূল ধাতু আগুনে গলাবার সময়ও একই ধরনের ফেনা তাতে জেগে ওঠে। এই উপমা পেশ করে আল্লাহ তায়ালা হক ও বাতিলের ব্যাপারটাকে স্পষ্ট করে তোলেন।' (সূরা আর রাদ-১৭)
       
(নদীনালা ও গলিত ধাতুর বেলায় যা সত্য) তেমনি যা ফেনা হয়ে উড়ে যায় আর যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর তাই শুধু যমীনে অবশিষ্ট থেকে যায়।

'তোমরা কি দেখোনি যে, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামসমূহের কি ধরনের উপমা পেশ করেছেন। তা যেন একটি মূল্যবান ও পবিত্র বৃক্ষ, যার ভিত্তি অভ্যন্ত মযবুত ও শাখা প্রশাখা আসমানসমূহে বিস্তৃত। নিজ মালিকের আদেশে তা সর্বদাই ফলমূল সরবরাহ করে যাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে উদাহরণ পেশ করেন। যেন তারা তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। অপবিত্র কথাসমূহের উদাহরণ হচ্ছে একটি বৃক্ষের মতো যাকে যমীনের উপরিভাগ থেকে উপড়ে ফেলা হয়। যমীনের ওপর তার কোনোই স্থায়িত্ব নেই। আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের সঠিক ও পরিশুদ্ধ কথাসমূহের দ্বারা দুনিয়ার জীবনেও তাদের দৃঢ়ভাবে রাখেন এবং আখেরাতের জীবনেও তাদের তিনি সেভাবেই রাখবেন। আল্লাহ তায়ালা না ইনসাফ লোকদের পথভ্রষ্ট করে দেন এবং তিনি যা চান তা-ই করেন। (সূরা ইবরাহীম ৩৪-৩৭)

মোটকথা, ইসলামী জীবনাদর্শ মানুষকে যেমনি প্রশান্তি, স্থিরতা ও সত্যনিষ্ঠ আস্থা প্রদান করে তা অন্য কোনো জীবনাদর্শের মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়।

আমি কোরআন অধ্যয়ন কালে এ বিষয়টি গভীরভাবে বুঝতে পেরেছি এবং এ বিষয়ের ওপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, দুনিয়ার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, মানবতা কোনোরকম শান্তি পেতেই পারে না, তার ভাগ্যে কোনোরকম মানসিক শান্তিই জুটতে পারে না, কোনো ব্যক্তিই উচ্চতা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পেতে পারে না, সর্বোপরি মানব জাতি কখনো বিশ্বচরাচরের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ও আসমানী নীতিমালা ও বিধি-নিষেধের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না-যতক্ষণ পর্যন্ত সে মানুষ আল্লাহ তায়ালার দিকে ধাবিত না হবে। আল্লাহ তায়ালার দিকে ধাবিত হবার একমাত্র পন্থা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত জীবন ব্যবস্থাকে মানুষ সর্বাংশে গ্রহণ করবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার কেতাব ও তাঁর রসুল (স.)-এর সুন্নতের কাছ থেকে পথের দিশা নেবে, এই পন্থা ছাড়া আর সবকিছুই এক একটা ভাংগন-বিপর্যয়, অপবিত্রতা তথা জাহেলিয়াত।

'অতপর যদি এরা তোমার কথা না মেনে নেয়, তাহলে জেনে রাখো যে, এরা শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির দাসত্বই করে বেড়ায়। তার চেয়ে গোমরাহ্ ব্যক্তি কে আছে যে আল্লাহ তায়ালার হেদায়াতকে উপেক্ষা করে নিজস্ব মনোবৃত্তির আনুগত্য করে। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা যালেম লোকদের পথ দেখান না।' (সূরা আল কাসাস-৫০)
       
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার কেতাবকে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী বানানো এমন কোনো কথা নয় যে, মন চাইলো তা মানলাম আবার মনে চাইলো-না বলে তা উপেক্ষা করলাম বরং এর ওপরই ঈমানের সমগ্র ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠিত।

'কোনো মোমেন পুরুষ কিংবা নারীর এ অধিকার নেই যে, যখন আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল (স.) কোনো ব্যাপারে ফায়সালা করে দেন, তা গ্রহণ না করে তাতে নিজেদের কোনোরকম অধিকার খাটাবে।' (সূরা আল আহযাব-৩৬)

"অতপর আমি তোমাদের দ্বীনের সঠিক পথে বসিয়ে দিয়েছি, তোমরা এই পথই অনুসরণ করো। অজ্ঞ ও জাহেল ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর চলো না। এরা সেদিন আল্লাহ তায়ালার সামনে তোমাদের কোনো কাজেই আসবে না। যালেমরা একে অন্যের বন্ধুই হয়ে থাকে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই শুধু পরহেযগারদের একমাত্র বন্ধু।' (সূরা আল জাসিয়া-১৮-১৯)

এ ব্যাপারটা খুব সামান্য ও সহজ কিছু নয়, গোটা মানবজাতির সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সাথে রয়েছে এর সম্পর্ক। আল্লাহ তায়ালা ইসলামী জীবন পদ্ধতির মাঝেই মানুষের সব ধরনের দুঃখ মুসীবত ও জ্বালা যন্ত্রণার সমাধান পেশ করেন।

“আমি কোরআনের মাধ্যমে সেসব কিছু নাযিল করি যা মোমেনদের জন্যে শেফা ও রহমত।' (সূরা বনী ইসরাঈল-৮৩)

'এই কোরআন সে রাস্তাই দেখায় যা সবচেয়ে সহজ।' (সূরা বনি ইসরাইল-৯০)

আজ মানব জাতির দুর্ভাগ্য ও বদনসীবীর মূল কারণ হচ্ছে, তারা আজ তাদের জীবনের সব কার্যকলাপ বিশ্ব স্রষ্টার দিকে ধাবিত হয় না। যতোদিন পর্যন্ত তারা আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট না হবে ততোদিন পর্যন্ত তারা এভাবেই দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবে এবং এভাবেই তারা দুর্ভাগ্যের শিকার হতে থাকবে। ইসলামকে উপেক্ষা করা, তার বিরুদ্ধাচরণ করা, মানব জাতির ইতিহাসের এমন ভয়াবহতম দুর্ঘটনা, যা গোটা মানব ইতিহাসে দ্বিতীয়বার ঘটেনি।

ইসলাম এমন এক সময় এসেছে যখন সমগ্র মানবজাতি জাহেলিয়াতের অন্ধকারে ঠোকর খাচ্ছিলো। গোটা জনপদ দুর্নীতি ও কদাচারে ভরে উঠেছিলো, পাপে সমগ্র দুনিয়া হেয়ে গিয়েছিলো। এমন সময় ইসলাম এসে মানুষদের এক নতুন জীবন দান করলো। সর্বোপরি মানুষকে পেশ করলো আল্লাহর আখেরী কেতাব আল কোরআন- যা মানুষকে তার জীবন ও চারদিকের বিশ্ব সম্পর্কে নতুন এক মূল্যবোধের শিক্ষা দিলো ।

জীবন ধারণের এই নতুন পদ্ধতিকে সমাজে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করে সে দেখিয়ে দিলো। যখন এই নতুন ব্যবস্থা তার সঠিকরূপ নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলো তখন তাতে এমন ধরনের পবিত্রতা, এমন ধরনে সহজ সরলতা, এমন ধরনের জ্ঞানের ব্যাপকতা, এমন ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও সাম | স্যতার বিকাশ ঘটলো, যা সমাজে প্রতিষ্ঠা করে দেখানো তো দূরের কথা মানুষের জ্ঞান প্রতিভা এমন কিছুর কল্পনাও করতে পারেনি।
       
অতপর মানুষের দুর্ভাগ্য তাকে আস্তে আস্তে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলো। জাহেলিয়াত বারবার তার লেবাস বদল করে মানুষের ওপর সওয়ার হয়ে পড়লো। তাই ধোঁকা ও প্রতারণায় অভ্যস্ত এই নব্য জাহেলিয়াতের লোকেরা বললো, বৈষয়িক উন্নতি ও ইসলাম' এর যে কোনো একটাকে বেছে নিতে হবে। কারণ, এদের উভয়ের রাস্তা নাকি আলাদা ও পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। এটা এতো বড়ো ধোঁকা যে, তার তুলনা সম্ভবত মানব জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাস্তব কথা হচ্ছে, ইসলাম বৈষয়িক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনার শত্রু নয়, বরং ইসলাম মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভার উৎকর্ষ সাধন করেছে এবং তাকে পূর্ণাংগ পথ প্রদর্শন করেছে। ইসলাম তো মানুষকে দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠিয়েছে। এই বিশ্ব চরাচরের সমস্ত গুপ্ত শক্তিসমূহকে তাঁর হাতে ন্যস্ত করে এদের তাঁর অনুগত বানিয়ে দিয়েছে। অবশ্য একটাই শর্ত তাতে জুড়ে দেয়া হয়েছে এবং তা হচ্ছে মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর প্রদর্শিত 'সেরাতুল মোস্তাকীম' অনুযায়ী কাটাতে হবে, আর তার জীবনের সমগ্র কর্মসূচী আল্লাহ তায়ালার নির্বাচিত হেদায়াতের সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে। যদি এমন হয় তাহলে মানুষের প্রতিটি কাজই আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর এবাদাতের শামিল।

সমাজে এমন কিছু সরল প্রকৃতির লোক আছে যাদের নিয়তে কোনো খুঁত না থাকলেও তাদের | জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব থাকে। এরা মনে করেন মানুষের ঈমানী মূল্যবোধ আলাদা বস্তু এবং তাদের বৈয়ধিক উন্নতি উৎকর্ষ ও প্রাকৃতিক নিয়ম নীতি আলাদা বস্তু। 'প্রাকৃতিক নিয়মনীতি আমাদের ওপর সব সময়ই তার প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তার প্রভাব সৃষ্টিতে ঈমান থাকা না থাকায় তেমন কোনো তারতম্য সৃষ্টি হয় না'- এমন মনে করা মোটেই ঠিক নয়। এরা আল্লাহর বিধি-বিধান ও আইন-কানুনের দু'টি বিভাগকে আলাদা আলাদা ভেবে নিয়েছে। মূলত ব্যাপারটা তা নয়, প্রাকৃতিক বিধি-বিধান যেমনি আল্লাহর আইনমালার অংশ তেমনি ঈমানী মূল্যবোধও তাঁর কানুনের একটি অংশ। এই উভয়বিধ আইনের ফলাফল পরস্পর সম্পৃক্ত ও একক। এটাই হচ্ছে সঠিক ধারণা। আল্লাহ তায়ালা একথাই কোরআনে পেশ করেছেন-
'যদি আহলে কেতাবের লোকেরা ঈমান আনতো এবং পরহেযগার হতো, তাহলে আমি তাদের গুনাহ-খাতা মিটিয়ে দিতাম এবং তাদের জান্নাতের সুন্দরতম বাগানসমূহে প্রবেশ করিয়ে দিতাম। যদি তাওরাত, ইঞ্জিল ও তাদের ওপর নাযিল করা অন্যান্য কেতাবের ওপর তারা ঈমান আনতো তাহলে তাদের ওপর আল্লাহর করুণা এভাবে বর্ধিত হতো যেন তারা ওপর থেকেও খেতে পারতো আবার নিচ থেকেও ভোগ করতে পারতো।' (সুরা আল মায়েদা- ৬৫-৬৬)

'আমি অতপর তাদের বললাম, আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা ভিক্ষা চাও, তিনি মহান ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর থেকে পানি বর্ষণ করবেন এবং সম্পদ ও সন্তানাদি দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের তিনি বিভিন্ন ধরনের বাগান দান করবেন, সেখানে আবার তোমাদের জন্যে ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করবেন।' (সুরা নূহ)
       
"আল্লাহ তায়ালা কোনো জাতির ওপর অর্পিত নেয়ামতকে কখনো বদলে দেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করে।' (সূরা আর রা'দ – ১১)

আল্লাহর ওপর ঈমান, তাঁর এবাদাত ও তার যমীনে তাঁরই আইনের প্রতিষ্ঠা মূলত তাঁর নীতিমালার চূড়ান্ত পূর্ণতার নাম। এরই এক অংশের নাম ইচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়ম নীতি। এমন অনেক উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় যে, মানুষ ঈমানী মূল্যবোধের কোনো পারোয়া না করে শুধু প্রাকৃতিক আইনেরই গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং তাতে সফলকামও হয়ে যায়। ঈমানী মূল্যবোধকে উপেক্ষা করার বাহ্যিক পরিণাম তেমন একটা দেখা যায় না। যদিও শুরুর দিকে এই পরিণামের বহিপ্রকাশ অনুভূত হয় না কিন্তু পরবর্তী কোনো যুগে কিংবা কোনো পর্যায়ে এসে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম দেখা যাবেই।

ইসলামী সমাজ তখনি উন্নতির শিখরে উপনীত হতে পেরেছে যখন মুসলমানরা একই সময় ইসলামী মূল্যবোধ ও মানবীয় গুণাবলীতে নিজেদের সাজাতে পেরেছে, যতোই এই উভয়ের মাঝে দূরত্ব বিস্তৃত হতে থাকলো ততোই তাদের অধপতন বাড়তে লাগলো, আর যখন তারা এই উভয়টাকেই তুলে গেলো তখন তারা অধপতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নেমে গেলো ।

ইসলামী সমাজের পাশাপাশি আধুনিক সভ্যতার কথা চিন্তা করা যায়। এর উদাহরণ হচ্ছে, এমন একটি পাখীর ন্যায় যার একটি পাখা কেটে দেয়া হয়েছে। একটি পাখার ওপর ভিত্তি করেই সে এখন শূন্যে ঝুলে আছে, ঠিক এভাবেই আজ আধুনিক সভ্যতা যে পরিমাণ বৈষয়িক উন্নতি অর্জন করতে পারলো সেই পরিমাণ নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত হলো। যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহর দিকে ধাবিত না হবে ততেক্ষণ পর্যন্ত তারা এই ধ্বংস থেকে মুক্তির কোন উপায় খুঁজে পাবে না।

আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে যে আইন নির্ধারণ করেছেন তা সেই সামগ্রিক আইনেরই অংশ বিশেষ যা তিনি সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য বানিয়েছেন। এই শরীয়তের অনুসরণই মানব প্রকৃতিকে গোটা বিশ্বের নিয়মনীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল করে দেয়, আর এই শরীয়ত তথা আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য ঈমানের উপস্থিতি এবং একটি ইসলামী সমাজের উপস্থিতি একান্ত জরুরী। এর সাথে সাথে শরীয়াতে এলাহীর পূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্যে জরুরী হলো তাকওয়া, পরহেযগারী ও দৃঢ়তার সাথে কাজ চালিয়ে রাখা। এটাই হচ্ছে একমাত্র পন্থা যার মাধ্যমে মানবীয় গুণাবলী ও ইসলামী মূল্যবোধের সামঞ্জস্য সৃষ্টি হতে পারে। এই দু'টো বিষয়ই আল্লাহর অমোঘ বিধানের অধীন, যার ভিত্তিতে সমগ্র দুনিয়ার নিয়ম নীতি চলছে।
       
মানুষ যেহেতু নিজেও বিশ্বজগতের এক অংশ তাই তার সৃষ্টি ও অস্তিত্ব, তার কাজ ও ইচ্ছা, তার নেকী ও ঈমান, তার এবাদাত এবং নিষ্ঠা এর সব কিছুই এই বিশ্ব চরাচরের একটা 'হ্যাঁ' বোধক জবাব মাত্র। এর সব কিছুই আল্লাহ তায়ালার ব্যাপক ও সাধারণ নীতিমালার সাথে সম্পৃক্ত, তার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তার জন্ম হয়। এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েই সে ফলাফল সৃষ্টি করে, আর মানুষের জীবন যখন এই নিয়ম নীতির বিরুদ্ধাচরণ করে তা থেকে দূরে সরে পড়ে তখনি তাতে বিশৃঙ্খলা ও পেরেশানি দেখা দিতে শুরু করে। জীবনের কাঠামো ভেংগে পড়ে এবং দুর্ভাগ্য ও বদনসীবির ছায়া তাদের ওপর আস্তে আস্তে বড়ো ও বিস্তৃত হতে থাকে।
'এটি এ কারণে যে, আল্লাহ তায়ালা কোনো জাতিকে যখন এই নেয়ামত দান করেন যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষরা নিজেদের মনের অবস্থা পরিবর্তন না করে ততক্ষণ আল্লাহ তায়ালা তাকে পরিবর্তন করেন না।' (সূরা আল আনফাল-৫৩)

মোটকথা, মানুষের বোধশক্তি ও তার কার্যকলাপের সাথে আল্লাহর নিয়ম নীতির অধীনে পৃথিবীতে সংঘটিত ঘটনাসমূহের এক গভীর সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য রয়েছে। এই সম্পর্ককে সে ব্যক্তিই বিনষ্ট করতে পারে, সে-ই এই সামঞ্জস্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, সে-ই এই নিয়মনীতি ও মানুষের মাঝে ক্ষতির কারণ হতে পারে যে ব্যক্তি মানবতার দুশমন, যে ব্যক্তি হেদায়াতকে উপেক্ষা করে দ্বারে দ্বারে ঠোকর খাচ্ছে। সর্বোপরি এইভাবে ঘুরে বেড়ানোই মূলত যার ভাগ্যের লিখন হয়ে গেছে। আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়া পর্যন্ত সে এভাবেই ঠোকর খেতে থাকবে।
আমি যখন আমার জীবনের মূল্যবান সময়গুলো 'কোরআনের ছায়াতলে' অতিবাহিত করছিলাম তখন এই কয়টি চিন্তা ও ভাবনা আমার মনে বারবার দানা বেঁধে উঠেছে। এই কথাগুলোকেই আমি 'ফী যিলালিল কোরআন'-এর ভূমিকাস্বরূপ এখানে পেশ করলাম। হতে পারে এই কথাগুলোকে আল্লাহ তায়ালা কারো জন্যে হেদায়াতের উৎস বানিয়ে দেবেন। আল্লাহ তায়ালার ভাষায়, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তোমরা কিছুই করতে পারো না।”





**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url