তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন - ৫ || সূরা আল ফাতেহার অর্থ ও তাফসীর
সূরা আল ফাতেহা
আয়াত ৭ রুকু ১
بِسۡمِ اللّٰهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ۙ﴿۲ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ ۙ﴿۳ مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ ؕ﴿۴ اِیَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ ؕ﴿۵ اِهۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ ۙ﴿۶ صِرَاطَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡهِمۡ ۬ۙ غَیۡرِ الۡمَغۡضُوۡبِ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا الضَّآلِّیۡنَ ﴿۷
সূরা আল ফাতেহার অর্থ
১. রহমান রহীম আল্লাহ তায়ালার নামে-
২. সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্যে তিনি সৃষ্টিকুলের মালিক, ৩. তিনি পরম দয়ালু, অতি মেহেরবান, ৪. তিনি বিচার দিনের মালিক। ৫. (হে মালিক) আমরা তোমারই বন্দেগী করি এবং তোমারই সাহায্য চাই। ৬. তুমি আমাদের (সরল ও) অবিচল পথটি দেখিয়ে দাও, ৭. তাদের পথ- যাদের ওপর তুমি অনুগ্রহ করেছো। তাদের (পথ) নয়, যাদের ওপর অভিশাপ দেয়া হয়েছে এবং (তাদের পথও নয়) যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে।
সূরা আল ফাতেহার তাফসীর
সাত আয়াত বিশিষ্ট এই ছোট সূরাটিকে প্রতিটি মুসলমান ব্যক্তি দৈনিক কমপক্ষে ১৭ বার | নামাযে তেলাওয়াত করেন। যদি এর সাথে কিছু সুন্নত ও নফল পড়া হয় তাহলে এই সংখ্যা | অবশ্য আরো বেশী হবে। এই সূরা তেলাওয়াত করা ছাড়া নামায শুদ্ধ হয় না। কেননা সহীহ বোখারী ও মুসলিম শরীফে উবাদা বিন সামেতের বর্ণনা রয়েছে, 'সূরা ফাতেহার তেলাওয়াত ছাড়া নামায শুদ্ধ নয়।'
এই সুরায় ইসলামী আকিদা ও ধ্যান ধারণার মৌলিক অংশগুলো বর্ণনা করা হয়েছে এবং ইসলামী আকিদার মাধ্যমে লালিত চিন্তা ও অনুষ্ঠানের রাস্তাসমূহকে পরিস্ফুটিত করা হয়েছে। এ থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই সূরার তেলাওয়াত প্রতিটি রাকায়াতেই জরুরী এবং এই বিষয়ের দিকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, এই সূরার তেলাওয়াত ছাড়া নামায কেন শুদ্ধ হয় না ।
"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' নিয়ে মতবিরোধ আছে। কেউ বলছেন এটি সুরা ফাতেহার অন্তর্ভুক্ত। আবার কেউ বলছেন সামগ্রিকভাবে এটি কোরআন শরীফের এমনি একটি আয়াত, প্রতিটি সূরাই এ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হচ্ছে এটি সূরা ফাতেহারই অন্তর্ভুক্ত। একে নিয়েই সূরা ফাতেহার আয়াত সংখ্যা ৭-এ দাঁড়ায়, কেননা কোরআনে পাকের এরশাদ-
'আমি অবশ্যই তোমাকে বার বার পঠিত (আয়াত) থেকে সাত (আয়াত) বিশিষ্ট একটি সূরা ও মহান গ্রন্থ কোরআন দান করেছি'। এ দিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সূরা ফাতেহাকেই বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার নামে সব কাজ শুরু করা ইসলামের সামাজিক ব্যবস্থা ও শিষ্টাচারের এমন একটি মৌলিক ভিত, যার শিক্ষা নবী করিম (সা.) তাঁর প্রথম ওহীতে (ইকরা বিসমে রাব্বেকা) প্রদান করা হয়েছে এবং আল্লাহর নামে শুরু করার বিষয়টি ইসলামের সেই মহান চিন্তা বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যশীল, যেখানে বলা হয়েছে আল্লাহই প্রথম, আল্লাহই শেষ। তিনিই যাহের তিনিই বাতেন । তাঁর নামেই সব কাজে সাহায্য চাইতে হবে। তাঁর নাম দিয়েই সব কাজ শুরু করতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ রাখতে হবে তার নামেই। প্রতিটি নড়াচড়াতে তাঁর নামই হবে মোমেনের একান্ত সাথী।’
'আর রাহমান' এবং 'আর রাহীম' এই দু'টি শব্দই এমন দু'টি ব্যাপক বিশেষণের নাম যা রহমতের সবক'টি অর্থের ওপর প্রযোজ্য এবং এর সব ক'টি অবস্থাই এতে শামিল হয়ে আছে। অবশ্য এই দুটি বিশেষণে এই বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য যে, 'রাহমান' শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্যেই নির্দিষ্ট। অপর দিকে 'রাহীম' কোনো মানুষের ব্যাপারেও ব্যবহার করা যায়। আল্লাহর নামে শুরু করা যেমনি ইসলামী সামাজিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিমূল তেমনি রাহমান ও রাহীমের মাঝে রহমতের সব ক'টি অর্থ ও এর সবক'টি অবস্থাকে শামিল করে নেয়াও ইসলামী ঐক্যের একটি মৌলিক নীতি । এ নিয়ে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর বান্দাহর মধ্যকার এই সম্পর্কটি নির্ণিত হয়ে যায় যে, আল্লাহ তায়ালা সর্বাবস্থায়ই দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন এবং বান্দাহ প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর দয়ার ভিখারী। আল্লাহ তায়ালাই যখন 'রহমান রাহীম' তখন মানুষের জন্যে এটা জরুরী যে, সদা সে তাঁর প্রশংসায় মগ্ন থাকবে এবং এ সত্যের সে প্রকাশ্য ঘোষণা দেবে,
“আল হামদু লিল্লাহে রাব্বিল আলামীন”
আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বচরাচরের মালিক এবং তিনিই এই বিশ্ব নিখিলের প্রতিপালক।
আল্লাহর প্রশংসা এমনি এক জীবনদায়ীনী অনুভূতি, যার শুধু স্মরণটুকুই মোমেনের হৃদয়ে তাঁর অনুগ্রহের বারিধারা বর্ষণ করতে থাকে। কেননা স্বয়ং মানুষের অস্তিত্ত্বটুকু তাঁর অনুগ্রহেরই একটি দান মাত্র। এরপর প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ ঝরতে থাকে তা জমা হতে থাকে এবং তা সমগ্র সৃষ্টিকূল বিশেষ করে মানুষকে ছেয়ে ফেলে। এ কারণেই ইসলামী শিক্ষার একে একটি মূলনীতি হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, সবকিছুর শুরুর প্রশংসা তাঁর সবকিছুর শেষ প্রশংসাও তাঁর।
"তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তাঁর জন্যেই সকল প্রশংসা, সব কিছুর আগে এবং সব কিছুর পরেও।
আল্লাহ তায়ালার এইসব বহুবিধ নেয়ামতর সত্তেও যখন কোনো বান্দা বলে 'আল হামদুলিল্লাহ' (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য) তখন তার নামে এমন একটি নেকী লিখে দেয়া হয়, যা হয় অন্যান্য নেকীর তুলনায় অনেক বেশী ওযনের। সুনানে ইবনে মাজায় হযরত ওমর (রা.)-এর বর্ণনা, রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন, এক বান্দা বললো, 'হে রব! সকল প্রশংসা তোমার, যতোটুকু প্রশংসা তোমার রাজাধিরাজ সত্ত্বার জন্যে শোভা পায় তার সবটুকুই । এ কথা কয়টি শুনে ফেরেশতারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো, কিভাবে একে লিপিবদ্ধ করা যায়? অবশেষে ফেরেশতারা আল্লাহর দরবারে হাযির হয়ে নিবেদন করলো, তোমার এক বান্দাহ এমনভাবে তোমার তারিফ করলো আমরা বুঝতে পাচ্ছি না কিভাবে একে লিপিবদ্ধ করবো। আল্লাহ তায়ালা এর ব্যাখ্যা চাইলেন, (অথচ তিনি ভালো করেই জানেন বান্দাহ কি বলেছে) আমার বান্দাহ কী বলেছে? ফেরেশতারা বললো, তোমার বান্দাহ বলেছে, 'হে রব সকল প্রশংসা তোমার, যতোটুকু প্রশংসা তোমার রাজাধিরাজ সত্তার পক্ষে উপযোগী।' আল্লাহ তায়ালা বললেন, 'আমার বান্দাহ যেভাবে বলেছে সেভাবেই লিখে দাও। যেদিন আমার সাথে তার দেখা হবে, সেদিন আমি নিজেই তাকে এর প্রতিদান দেবো।'
'রাব্বুল আলামীন' শব্দ ক'টি ইসলামী বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম বর্ণনা করছে এবং এটা বলছে যে, প্রতিপালনের যাবতীয় স্বীকৃতি ও ঘোষণা একক ও সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ তায়ালার জন্যে এবং এটার স্বীকৃতি ইসলামী আকীদা ও বিশ্বাসের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আরবী ভাষায় 'রব' বলতে এমন এক ক্ষমতাসম্পন্ন মালিককে বুঝায় যিনি তাঁর অধীনস্থ প্রতিটি জিনিসকে নিজেই লালন পালন করেন এর যাবতীয় দেখাশোনা ও তদারকী করা থেকে তার সংশোধন, পরিমার্জন ও রক্ষণাবেক্ষণের সব ধরণের ব্যবস্থা পাকাপাকি বন্দোবস্ত তিনিই করেন। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা সমগ্র সৃষ্টিকুলের এবং বিশ্ব চরাচরের প্রতিটি বস্তুর স্বয়ং স্রষ্টা ও মালিক, তিনি যেহেতু একাই সমগ্র জাহানকে সৃষ্টি করেন, লালন করেন, সার্বিক পরিচালনা করেন, তাই তিনিই হচ্ছেন 'রাব্বুল আলামীন' সৃষ্টিকুলের রব। তিনি সমগ্র কায়েনাতের প্রতিপালকও। এই হচ্ছে সেই অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, যা স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বাবস্থায়ই প্রতিষ্ঠিত থাকে।
আল্লাহ তাবারকা তায়ালার 'রবিয়াতের' এই স্বীকৃতি ও ঘোষণাই হচ্ছে তাওহীদ, যার দিকে ইসলাম আমাদের আহ্বান জানায় এবং এই ঘোষণা সেসব ধোঁকা ও প্রতারণার যাবতীয় মিথ্যা জাল ছিন্ন করে দেয় যা এই মৌলিক সত্যটি আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর মালিকানাকে অকাট্যভাবে না মানার কারণে সৃষ্টি হয়। সে সব ধোঁকা ও প্রতারণা হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ তায়ালাকে, এই বিশ্ব চরাচরের স্রষ্টাকে স্বীকার করার সাথে সাথে আবার বাতিল ও মিথ্যা মাবুদদের পূজাও করতে থাকে। এমনিভাবে ইসলামের আগমনকালে যেসব জাহেলিয়াত এই যমীনকে ছেয়ে রেখেছিলো তা এই বিশ্বাসই পোষণ করতো যে, তাদের এসব ছোট ছোট মাবুদ এক বড়ো মাবুদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই মিথ্যা ধারণা ও বিশ্বাসের দিকে ইশারা করার জন্যে কোরআন আরববাসীদের এই কথাটি উদ্ধৃত করেছে, 'আমরা তো মূর্তিগুলোর এ কারণেই পূজা করে থাকি যেন ওরা আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।' আরো বলছে, 'তারা তো তাদের আলেম ও দরবেশদেরকে আল্লাহর বদলে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে।'
সামগ্রিক ও এই একান্ত 'রবুবিয়াত' চিন্তার মধ্যে সামঞ্জস্য ও আকিদা বিশ্বাসের মধ্যে একমুখী আস্থা আনয়ন করে যাতে করে গোটা সৃষ্টিকূল একই মাবুদের দিকে নিবিষ্ট হতে পারে তার একচ্ছত্র মালিকানার স্বীকৃতি ও ঘোষণা দিয়ে নিজ মস্তক থেকে অগণিত মাবুদের বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং এভাবে গোটা সৃষ্টিকুলের মন-মস্তিষ্ক আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ 'রবুবিয়াত' তার দেখাশোনা ও তদারকিতে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। এটা এমন ধরনের বিশ্বাস নয় যা গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টটল পেশ করেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে 'মহাপ্রভু সবকিছুকে সৃষ্টি করে এখন আলাদা হয়ে গেছেন কেননা তাঁর পক্ষে তার চেয়ে নিকৃষ্ট লোকদের দিকে লক্ষ্য দেয়া মর্যাদার পরিপন্থী ব্যাপার। এখন তিনি শুধু নিজস্ব সত্তার ব্যাপারেই ভাবছেন।
এটা হচ্ছে এরিস্টটলের বিশ্বাস, অনেকের মতেই তিনি ছিলেন নাকি একজন বড়ো দার্শনিক। তার এ জ্ঞান তপস্যাটুকু বলতে গেলে সর্বযুগের সবকয়টি জাহেলিয়াতেই বিদ্যমান ছিলো।
যখন ইসলাম এলো, সারা দুনিয়া তখন মিথ্যা আকিদা বিশ্বাস, বাতিল ধ্যান ধারণা, পচে যাওয়া চিন্তাধারা ও অন্ধ পৌরাণিক বিশ্বাসে নিমজ্জিত ছিলো। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে কোন্টা ভুল কোন্টা নির্ভুল, কোন্টা হক কোটা বাতিল এর মধ্যে কোনো পার্থক্যকারীই ছিলো না। সঠিক দ্বীন এবং মিথ্যা ধ্যান-ধারণার পার্থক্যটুকু শেষ হয়ে গিয়েছিলো। দর্শন ও পৌরাণিক বিষয় একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছিলো, আর এই সমস্ত ভারি বোঝার নিচে পড়ে মানুষ অনিশ্চিত অবস্থায় অন্ধকারে ঠোকর খাচ্ছিলো।
মানুষ এই অনিশ্চিত সর্বগ্রাসী অন্ধকারে এ জন্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে যে, তার সাথে আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলীর সাথে কি সম্পর্ক রয়েছে সে বিশ্বাস তার বিনষ্ট হয়ে গেছে। যতোক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মনে মারুদের ব্যাপারে তার ধারণা বিশ্বাস পরিষ্কার না হবে এবং যতোক্ষণ পর্যন্ত সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে এক অটল বিশ্বাসে সুস্থির হয়ে না দাঁড়াবে ততোক্ষণ পর্যন্ত তার মন মগঘের পক্ষে সৃষ্টি জগত, স্বয়ং তার নিজস্ব অস্তিত্ব এবং স্বকীয় জীবন ব্যবস্থার ব্যাপারে শান্তি ও স্থায়িত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়। যতোদিন পর্যন্ত মানুষ আকিদা বিশ্বাসের এ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, চিন্তা বিশ্বাসে পৌরাণিক ক্রিয়াকান্ডের জটিলতার বোঝা অনুভব করতে পারবে না তার কাছে স্থায়িত্ব ও শান্তির প্রয়োজনীয়তাটুকু কোনোদিনই অনুভূত হবে না, যে স্থায়িত্ব ও শাস্তি একমাত্র কোরআনের চিন্তাধারাকে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে বাস্তবায়নের ফলেই হাসিল করা সম্ভব।
এই কারণেই ইসলাম সর্বাগ্রে এ বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে যে, মানুষের চিন্তাধারা যাবতীয় অন্ধ ও বাতিল বিষয়সমূহ থেকে মুক্ত হতে হবে, আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও গুণাবলী ও তাঁর সাথে সৃষ্টিকুলের সম্পর্ক ও যোগাযোগের ব্যাপারে সকল ধারণা হবে পরিষ্কার এবং অকাট্য যেন মানুষের মন মগয শান্তি ও স্থিরতা পেতে সক্ষম হয়।
এ কারণেই ইসলাম এমন এক পূতপবিত্র একনিষ্ঠ ও পূর্ণাংগ তাওহীদের আদেশ দিয়েছে, যার মধ্যে সামান্যতম কোনো শেরেকের সন্দেহও অবশিষ্ট থাকবে না। যা মানুষের মনমগযে শান্তি ও নিরাপত্তা দেবে, মানবীয় সত্তায় তা ভালোভাবেই নিজের স্থান করে নেবে এবং তা সেখানে ভালোভাবে অংকিত হয়ে যাবে।
ইসলাম আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী ও তাঁর 'রবুবিয়াতের' ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছে। কেননা ইসলাম-পূর্ব আকিদা দর্শনে আল্লাহর গুণাবলীর ব্যাপারে বহুবিধ জটিলতা এবং বাতিল চিন্তাধারা ও পৌরাণিক বিষয়সমূহের বহু দ্বিধা-সংকোচ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো, যা মানুষের মনমগয়কে নাপাক বিষয়সমূহে ডুবিয়ে দিয়ে তার চিন্তা ও কর্মধারাকে খারাপ করে রেখেছিলো। যদি চিন্তা-বিশ্বাস ও পৌরাণিক নীতিসমূহের সব ক'টি খারাপ জিনিসকে মানুষের সামনে দেখিয়ে না দেয়া যায়, যা ইসলাম আগমনের পূর্বে মানুষের জন্যে একটি বিরাট বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছিলো এবং যদি সেসব অন্ধকার ও অমানিশাকে গভীরভাবে না দেখে যার মধ্যে মানবতা ধুকে ধুকে ঠোকর খাচ্ছে, তাহলে আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা ও গুণাবলীকে কোনোক্রমেই প্রকাশ করা যাবে না। এছাড়া এ জন্যে ইসলামের ক্রমাগত ও একনিষ্ঠ সাধনা আল্লাহ ও তাঁর বান্দাহ মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণের ইসলামের দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও সাধনা এবং মানুষের মন মগজের সব কয়টি পদস্খলনকে দেখিয়ে দেবার ব্যাপারে ইসলামের প্রচেষ্টাসমূহের প্রয়োজনীয়তা কোনোক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে না। হ্যাঁ, যদি জাহেলিয়াতের খারাপ দিকগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে অনুভব করা যায়, তাহলে ইসলামের চিন্তার, বিপ্লবের সঠিক নকশাটুকু পরিষ্কার হয়ে যাবে যা ইসলাম মানুষদের বহু মাবুদ, অগণিত দেবদেবী, পচা দুর্গন্ধময় চিন্তাধারা, পৌরাণিক কেসসা কাহিনীর আনুগত্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করে শুধু একই মালিকের রহমতের ছায়া তাদের দান করেছে।
‘আর রাহমানির রাহীম' অসীম দয়াবান, অনেক দয়ালু, এই গুণাবলী যা রহমতের সবক'টি অর্থ ও দয়ার সবক'টি অবস্থার সমষ্টি, দ্বিতীয়বার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আয়াতরূপে পেশ করা হয়েছে। যেন এই গুণাবলীর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ও সৃষ্টিকর্তার পুরোপুরি একটি গুণ পরিষ্কার হওয়ার গুরুত্ব প্রদান করা যায়। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে স্থায়ী সম্পর্কটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন সম্পর্ক যা, রহমত ও অনুগ্রহের, যা প্রশংসা ও তারিফের যোগ্য। এমন সম্পর্ক যা প্রশান্তি ও ভালোবাসার ওপর স্থাপিত, কেননা অশেষ দয়া ও রহমতের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে 'হামদ' (আল্লাহর প্রশংসা করা)।
ইসলামের মাবুদ তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না, যেমন গ্রীক পুরাণে দেবতা তাদের বান্দাদের ধমক দেয় এবং প্রতিশোধমূলক প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে।
"তিনি প্রতিদান দিবসের মালিক।'
এই বাক্যটি আখেরাত বিশ্বাসের সেই মহান আকিদার কথা বলে দেয়। কেননা আখেরাত বিশ্বাস মানুষের জীবনে সুদূরপ্রসারী ফলাফল নির্ণয় করে। 'মালিক' পূর্ণ বিজয় ও মালিকানার অর্থে ব্যবহৃত হয়, ইয়াওমেদ্দীন' মানে প্রতিদানের দিন।
ইসলামের আগমনের পূর্বে এমন বহু লোক ছিলো যারা এক মাবুদের ওপর বিশ্বাস করতো এবং তিনি যে সমগ্র কায়েনাতের স্রষ্টা তাও তারা মানতো, কিন্তু তারা প্রতিদানের দিবসে বিশ্বাস করতো না। তাই কোরআন এদের ব্যাপারে বলছে, 'যদি তুমি এদের জিজ্ঞেস করো যে আসমান যমীন কে বানিয়েছেন, তাহলে তারা বলবে, আল্লাহ তায়ালা বানিয়েছেন।'
কোরআন এদের ব্যাপারে আরো বলছে, 'তারা এ ব্যাপারটিতে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেছে যে, তাদের কাছে তাদের মধ্যে থেকেই একজন লোক এসেছে, যে তাদের ভয় দেখাচ্ছে। অতএব কাফেররা বলছে, এতো ভারি অন্যায়ের কথা। যখন আমরা মরে যাবো মাটি হয়ে যাবো তখন আমরা আবার জীবিত হয়ে যাবো কিভাবে?' 'প্রতিদান দিবসে বিশ্বাস স্থাপন ইসলামী আকিদার এমন একটি মৌলিক বিশ্বাস যার মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আখেরাতের জগত পর্যন্ত বুলন্দ হয়ে যায়। তখন সে আর শুধু বৈষয়িক দুনিয়ার প্রয়োজনসমূহের গোলাম হয়েই বসে থাকে না, বরং সে নিজে এ প্রয়োজনসমূহের ওপর বিজয় লাভে সমর্থ হয় এবং এই দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনে নিজের চেষ্টা সাধনার বিনিময় ও ফলাফলের চিন্তায় লেগে থাকার বদলে আল্লাহ তায়ালার ওপর পুরোপুরি ভরসা ও বিশ্বাস স্থাপন করে যে, তিনি দুনিয়া ও আখেরাতের যেখানেই চাইবেন তার কর্মের ফলাফল দান করবেন। আর এই বিশ্বাস একবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথেই মানুষ নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং দুনিয়াবী পরিমাপক যন্ত্র ও চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মহান আসমানী মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে, যা সত্যিকার অর্থে একটি মহা মর্যাদার ব্যাপার।
যতক্ষণ পর্যন্ত এই প্রতিদান দিবসের ওপর মানুষের বিশ্বাস পূর্ণাঙ্গ ও অটুট না হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার অন্তরে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত না হবে যে দুনিয়াবী প্রতিফলের ওপর প্রতিদান কার্য সমাপ্ত হয়ে যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি ব্যক্তি এ কথাটি জেনে না নেবে যে, এই বৈষয়িক দুনিয়া ছাড়াও আরেকটি জীবন আছে যার জন্যে তার চেষ্টা সংগ্রাম করা দরকার এবং তাকে সত্য ও কল্যাণের জন্যে ত্যাগ ও স্বার্থপরতার উর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে যেন আখেরাতের কল্যাণ সে লাভ করতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানবতা আল্লাহ তায়ালা প্রদর্শিত 'সেরাতুল মোস্তাকিমের' পথে ধাবিত হতে পারে না।
আখেরাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপনকারী আর আখেরাতে অবিশ্বাসী ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে দু'টি স্বতন্ত্র সৃষ্টি। তাদের চিন্তাধারা, তাদের চরিত্র, তাদের কর্মধারা, তাদের জীবন প্রণালীতে কোনো অবস্থায়ই কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদের উভয়ের মাঝে দুনিয়াতেও কোনো সামঞ্জস্য নেই ও আখেরাতে এদের প্রতিদান একই ধরনের হবে না ।
“আমরা তোমারই এবাদাত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।'
এটি এক বিশ্বাসের অংশ যা এই সূরায় বর্ণিত আগের অংশসমূহের অপরিহার্য পরিণাম। এই বাক্যটি দুনিয়ার সব ধরনের গোলামী থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং মানুষের সার্বিক এবাদাতের রাস্তাসমূহকে আলাদা আলাদা করে মানবতার পরিপূর্ণ আযানীর ঘোষণা দেয় যে, আজ মানুষ আর কারো অধীন নয়। অন্ধ বিশ্বাস থেকে সে স্বাধীন, পচা দুর্গন্ধময় ব্যবস্থাপনার বন্দীদশা থেকে স্বাধীন, আজ সে স্বাধীন যাবতীয় তথাকথিত সামাজিক নিয়মনীতির বন্ধন থেকে। এখন সে শুধু আল্লাহরই গোলামী করে এবং শুধু আল্লাহরই সাহায্য চায়। এখন আর মানবতাকে মানুষের তৈরী বিধি-বিধান, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এবং ব্যক্তি বিশেষদের আনুগত্যের প্রয়োজন নেই। এখন মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের পূজা করারও কোনো দরকার নেই।
এ পর্যায়ে মানবীয় এবং প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ব্যাপারে একজন মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন। মানবীয় শক্তিসমূহ দু'ধরনের
১। হেদায়াতপ্রাপ্ত শক্তি- যা আল্লাহর ওপর ঈমান আনে এবং তারই নির্দেশিত পথে চলে। এই শক্তির সাথে একজন মোমেন সহযোগিতা করে সংশোধন ও কল্যাণের যাবতীয় কাজে তার সাহায্যের হাত প্রসারিত করে।
২। পথভ্রষ্ট শক্তি- যা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখে না, না তার প্রদর্শিত পথে চলে। এই শক্তির বিরুদ্ধে একজন মুসলমান মোকাবেলা করে এবং তার সাথে সংগ্রাম করে। মুসলমান কখনো পথভ্রষ্ট শক্তির আধিক্য ও প্রভাব দেখে ভয় পায় না। কারণ সে জানে প্রতিটি শক্তির উৎস ও মূল হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব সত্ত্বা। যখনি কোনো শক্তি তার মূল উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, দূরে সরে যায়, তখন আস্তে আস্তে তার শক্তি সামর্থ হারিয়ে ফেলে। যেমন একটি আলোকোজ্জ্বল গ্রহ থেকে তার বড়ো একটি টুকরো আলাদা হয় তাহলে আস্তে আস্তে তার আলো ও শক্তি নিষ্প্রভ হয়ে যায় এবং তাড়াতাড়িই তা ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু যদি তা সামান্যতমও মূল উৎসের সাথে জড়িত থাকে তাহলে তার মধ্যে শক্তি ও উত্তপ্ততা অবশিষ্ট থাকে, শক্তির আলোও বাকী থাকে।
এই ক্ষুদ্রতম দলটির বিজয়ের কারণ একটিই যে, এটা তার উৎসমূলের সাথে সম্পৃক্ত এবং এ থেকেই সে শক্তি অর্জন করে। প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ব্যাপারে মুসলমানদের নীতির ভিত্তি হচ্ছে একে মেনে নেয়া ও আপন করে নেয়া। ভয় এবং দুশমনী করে নয়, কেননা মানবীয় শক্তি ও প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের উভয়টিই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের অনুগত। উভয়বিধ শক্তির নড়াচড়া ও গতিবিধির লক্ষ্যকে অভিন্ন এবং একে অপরের পরিপূরক হতে হবে। মুসলমানদের বিশ্বাস তাকে একথা বলে দেয় যে, আল্লাহ তায়ালা সৌর মন্ডলের যাবতীয় শক্তিসমূহকে তার সাহায্যকারী ও সহায়তাদানকারী করে বানিয়েছেন। এই সাহায্য পাবার মূলনীতি হচ্ছে মানুষ এই শক্তিসমূহের ওপর চিন্তা-ভাবনা করবে এবং সহযোগিতার পাশাপাশি সে আল্লাহ তায়ালার দিকেও নিবিষ্ট হবে। যদি কখনো এসব জাগতিক শক্তিসমূহের কোনো কিছুকে দিয়ে মানুষের কিছু পরিমাণ কষ্টও হয়ে থাকে তাহলে তা এ জন্যে হয়েছে যে, মানুষ এ পর্যায়ে পর্যাপ্ত চিন্তা-ভাবনা করে এর প্রাকৃতিক বিধানের তথ্য অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রাচীন জাহেলিয়াতের উত্তরাধিকার এই পশ্চিমী সভ্যতা জাগতিক শক্তিসমূহের ব্যবহারকে এই ভূমন্ডলের ওপর বিজয় ধরে নিয়েছে। এই ব্যাখ্যাটি স্বয়ং আরেকটি জাহেলিয়াতের দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে, যা আল্লাহ তায়ালার চেয়ে অনেক দূরে এবং সৃষ্টি জগতের চেয়েও অনেক দূরে । তবে হ্যাঁ, মুসলমানের আল্লাহ তায়ালার সাথেও সম্পর্ক আছে এবং সৃষ্টি জগতের এই মূলতত্ত্বটিও অনুধাবন করে যে, সমগ্র পৃথিবীই আল্লাহর তসবীহ করে। সে মুসলমান এইটুকু বিশ্বাস রাখে যে এই সৃষ্টি-সৃষ্টি জগতের ওপর বিজয় লাভ করা ছাড়াও একটি সম্পর্ক আছে এবং তা হচ্ছে এই যে আল্লাহ তায়ালাই সমগ্র শক্তির স্রষ্টা এবং আল্লাহ তায়ালা এসব শক্তিকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের জন্যে পয়দা করেছেন, আর তা হচ্ছে একই লক্ষ্যের অধীনে থেকে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে একে অপরের সাথে সহযোগিতা করবে।
যাবতীয় জাগতিক শক্তিসমূহকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের অধীন করে দিয়েছেন এবং তার জন্যে এই সৃষ্টি জগতের ভেদ রহস্যের পরিচিতি প্রাকৃতিক নিয়মনীতি ও সব ধরনের জ্ঞানকে সহজ ও সরল করে দিয়েছেন। মানুষের উচিত যখনি সে এই বিশ্ব চরাচরের কোনো নতুন রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে তখন আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করে। কেননা আল্লাহ তায়ালা নিজেই এসব শক্তিকে তার অধীন করে দিয়েছেন, সে এগুলো নিজে জয় করে আনেনি ।
এ দুনিয়ার জাগতিক শক্তিসমূহের ব্যাপারে মুসলমানদের অনুভূতি অন্ধ বিশ্বাসের সাথে আটকানো থাকে না। না এ পর্যায়ে তার মনে কোনো ভীতিকর প্রভাব জমিয়ে রাখে। সে তো শুধু আল্লাহর ওপর ঈমান আনে এবং তাঁরই এবাদাত করে আর শুধু তাঁর কাছেই সাহায্য চায়। এই জাগতিক শক্তিসমূহ যেহেতু আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি তাই সে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে তার রহস্য উদঘাটন করে তার থেকে জ্ঞান হাসিল করে এবং তার সাথে একটা বন্ধুত্ব ও মায়ার বাধন সৃষ্টি করে ।
আল্লাহর নবী কতো সুন্দরভাবে এই মূল্যবান কথাটি বলেছেন। একদিন তিনি ওহুদ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এই পাহাড় আমাদের ভালোবাসে আর আমরা এই পাহাড়কে ভালোবাসি।' এই কথাটি দ্বারা আল্লাহর নবী ও প্রাকৃতিক সৃষ্টিরাজির এক মহান নিদর্শনের মাঝে ভালোবাসা ও মমত্ববোধের সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে যায়।
ইসলামী আদর্শের এই উপরোক্ত মৌলিক নিয়মগুলো আলোচনা এবং এটুকু প্রমাণ করে দেয়ার পর যে এবাদাতের প্রতিটি স্তরে এবং অটল অনড় থাকার প্রতিটি পর্যায়ে শুধু আল্লাহর দিকেই নিবিষ্ট হতে হবে। কোরআন এর ব্যবহারিক সামঞ্জস্যের পথ ধরে এবং সূরা ফাতেহার উদ্দেশ্যের কথা খেয়াল রেখে এবার তাকে দোয়ার দিকে ধাবিত করে।
'তুমি আমাদের (সরল ও) অবিচল পথটি দেখিয়ে দাও,
হে আল্লাহ তায়ালা, আমাদের সোজা রাস্তা চিনিয়ে দাও। হে আল্লাহ, এ পথ চিনিয়ে দেয়ার পর ভাতে অটল থাকারও শক্তি দাও। কেননা পথ চেনা এবং সে পথে টিকে থাকা এ দু'টোই আল্লাহ তায়ালার হেদায়াত ও রহমতের ফলশ্রুতি মাত্র। এ ব্যাপারে আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট হওয়া এই বিশ্বাসেরই অপরিহার্য পরিণাম যে, আল্লাহ তায়ালাই সাহায্যকারী এবং তিনিই মদদগার।
‘সেরাতুল মোস্তাকিম' সঠিক পথের দিশাই সেই মহান নেয়ামত যা পাওয়ার জন্যে মোমেন আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে। সেরাতুল মোস্তাকিমের দিকে পথনির্দেশই দুনিয়া আখেরাতের সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধানকারী জিনিস। কেননা সঠিক পথের হেদায়াত হচ্ছে সঠিক অর্থে মানবীয় প্রকৃতির সেই আল্লাহর অভীষ্টের নিকে ধাবিত হওয়া, যা মানুষ ও এই সৃষ্টি জগতের প্রতিটি চলন বলনকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে এককভাবে নিবিষ্ট রাখা ।
‘আমাদের সেসব লোকদের রাস্তা দেখাও যাদের ওপর তুমি তোমার অনুগ্রহ নাযিল করেছো। ওদের পথে নয়, যারা রাস্তাঘাট চেনার পরও তা থেকে সরে যাওয়ার অপরাধে তাদের ওপর গযব নাযিল হয়েছে। তাদের রাস্তায়ও নয়, যারা নীতিগতভাবেই কখনো সঠিক পথ পায়নি। শুধু সেসব হেদায়াতপ্রাপ্ত লোকদের রাস্তা, যারা সঠিক পথ পেয়েছে এবং এর ওপর চলা অব্যাহত রেখেছে।'
সূরা ফাতেহা যা নামাযে বারবার পড়া হয় এবং যা না পড়লে নামায শুদ্ধ হয় না, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্তেও ইসলামী ধ্যান-ধারণা, আকিদা বিশ্বাসের মৌলিক নীতিগুলো এতে বলে দেয়া হয়েছে। এই বিশ্বাসের ফলে যে বোধোদয়ের সৃষ্টি হয়েছে তাকেও এখানে খুলে বলা হয়েছে।
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রসূল (স.) বলেছেন, 'আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আমি নামাযকে আমার এবং আমার বান্দাহর মাঝে বন্টন করে নিয়েছি, অর্ধেক আমার অর্ধেক আমার বান্দার। আমার বান্দাহর এটুকু অধিকার আছে যে, তার যা ইচ্ছা চাইবে। যখন আমার বান্দাহ বলে 'আল হামদু লিল্লাহ' আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করলো। যখন বলে 'আর রাহমানির রাহীম' তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দাহ আমার গুণ বর্ণনা করলো। যখন বান্দাহ বলে 'মালেকে ইয়াওমেদ্দীন' তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার বান্দা আমার মাহাত্ম বর্ণনা করলো। যখন বলে “ইয়্যাকা না'বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তায়ীন' তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, এটি হচ্ছে আমার এবং আমার বান্দার মধ্যকার ব্যাপার। এখন আমার বান্দাহর অধিকার রয়েছে সে যা ইচ্ছে তা চাইবে এবং যখন আমার বান্দাহ বলে 'এহদিনাস সেরাতাল মোস্তাকীম, সেরাতাল্লাযিনা আনয়ামতা আলাইহিম, গাইরিল মাগদুবে আলাইহিম, ওয়ালাদ্দাললীন' তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, এটি আমার বান্দার জন্যে, তার যা ইচ্ছা তাই সে চাইতে পারে।
এই হাদীস থেকে একথার ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, দিনে রাতে কমপক্ষে ১৭ বার নামাযে পড়ার জন্যে কেন এই সূরাটিকে বাছাই করা হয়েছে এবং কেনই বা একথা বলা হয়েছে যে, যখনি নামাযে দাঁড়াও এই সুরাটি বারবার পড়ো।
************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url