তাফসীরে ইবনে কাসীর - ২৬ || সূরা বাকারা - ১৬ || পৃথিবী ও আখিরাতের জীবন যাপনের তুলনা || মুনাফিকের লক্ষণ ||





সূরা আল বাকারা ২৬-২৭নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর


 اِنَّ اللّٰهَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَهَا ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَیَقُوۡلُوۡنَ مَا ذَاۤ اَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا ۘ یُضِلُّ بِهٖ کَثِیۡرًا ۙ وَّ یَهۡدِیۡ بِهٖ کَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یُضِلُّ بِهٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿ۙ۲۶  الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِهٖ ۪ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۲۷

সূরা আল বাকারা ২৬-২৭নং আয়াতের অর্থ

   
২৬। নিশ্চয়ই আল্লাহ মশা অথবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্রতর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করতে লজ্জাবোধ করেননা। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা তো বিশ্বাস করবে যে, এ উপমা তাদের রবের পক্ষ হতে খুবই স্থানোপযোগী হয়েছে, আর যারা কাফির সর্বাবস্থায় তারা এটাই বলবে যে, এ সব নগণ্য বস্তুর উপমা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্যই বা কি? তিনি এর দ্বারা অনেককে বিপথগামী করে থাকেন এবং এর দ্বারা অনেককে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন, আর এর দ্বারা তিনি শুধু ফাসিকদেরকেই বিপথগামী করে থাকেন । ২৭। যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং ঐ সব সম্বন্ধ ছিন্ন করে যা অবিচ্ছিন্ন রাখতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন এবং যারা ভূপৃষ্ঠে বিবাদ সৃষ্টি করে তারাই পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। 


ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ), ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) এবং অন্য কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন উপরের তিনটি আয়াতে মুনাফিকদের দু'টি দৃষ্টান্ত বর্ণিত হল অর্থাৎ আগুন ও পানি, তখন তারা বলতে লাগল যে, এরকম ছোট ছোট দৃষ্টান্ত আল্লাহ তা'আলা কখনও বর্ণনা করেননা। তার প্রতিবাদে আল্লাহ তা'আলা এই আয়াত দু'টি অবতীর্ণ করেন। (তাবারী ১/৩৯৮) কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, যখন কুরআনুল হাকীমে মাকড়সা ও মাহির দৃষ্টান্ত বর্ণিত হয় তখন মুশরিকরা বলতে থাকে যে, কুরআনের মত আল্লাহর কিতাবে এরকম নিকৃষ্ট প্রাণীর বর্ণনা দেয়ার কি প্রয়োজন? তাদের এ কথার উত্তরে আয়াতগুলি অবতীর্ণ হয় এবং বলা হয় যে, সত্যের বর্ণনা দিতে আল্লাহ আদৌ লজ্জাবোধ করেননা, তা কমই হোক বা বেশীই হোক। (তাবারী ১/৩৯৯)

পৃথিবী ও আখিরাতের জীবন যাপনের তুলনা

রাবী ইব্‌ন আনাস (রহঃ) বলেন যে, এটা একটা মযবুত দৃষ্টান্ত যা দুনিয়ার দৃষ্টান্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মশা ক্ষুধার্ত থাকা পর্যন্ত জীবিত থাকে এবং মোটা তাজা হলেই মারা যায়। এ রকমই এ লোকেরাও যখন ইহলৌকিক সুখ সম্ভোগ প্রাণভরে ভোগ করে তখনই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে পাকড়াও করেন। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এক জায়গায় বলেনঃ

فَلَمَّا نَسُوۡا مَا ذُکِّرُوۡا بِهٖ فَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ اَبۡوَابَ کُلِّ شَیۡءٍ

অতঃপর তাদেরকে যা কিছু উপদেশ ও নাসীহাত করা হয়েছিল তা যখন তারা ভুলে গেল তখন আমি সুখ শান্তির জন্য প্রতিটি বস্তুর দরজা উন্মুক্ত করে দিলাম। (সূরা আন'আম, ৬ : ৪৪) (তাবারী ১/৩৯৮) ইন জারীর (রহঃ) এবং আদী ইব্‌ন আবী হাতিম (রহঃ) এইরূপ বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমে আছেঃ

যদি কোন মুসলিমের পায়ে কাঁটা ফুঁড়ে অথবা এর চেয়েও বেশি কিছু হয় তাহলে তার জন্যও তার মর্যাদা বেড়ে যায় এবং পাপ মোচন হয়। (মুসলিম ৪/১৯৯১) এ হাদীসেও শব্দটি আছে। ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, যেমন এ ছোট-বড় জিনিসগুলি সৃষ্টি করতে আল্লাহ তা'আলা লজ্জাবোধ করেননা, তেমনই ওগুলিকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ বর্ণনা করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ও সংকোচ নেই। কুরআনুল হাকীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এক জায়গায় বলেন : হে লোকসকল! একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হচ্ছে, তোমরা কান লাগিয়ে শোনঃ

 یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسۡتَمِعُوۡا لَهٗ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ لَنۡ یَّخۡلُقُوۡا ذُبَابًا وَّ لَوِ اجۡتَمَعُوۡا لَهٗ ؕ وَ اِنۡ یَّسۡلُبۡهُمُ الذُّبَابُ شَیۡئًا لَّا یَسۡتَنۡقِذُوۡهُ مِنۡهُ ؕ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَ الۡمَطۡلُوۡبُ ﴿۷۳

তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবেনা, এ উদ্দেশে তারা সবাই একত্রিত হলেও; এবং মাছি যদি তাদের নিকট হতে কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় ওটাও তারা ওর নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবেনা; পূজারী ও পূজিত কতই না দুর্বল! (সূরা হাজ্জ, ২২:৭৩) অন্য স্থানে মহান আল্লাহ বলেনঃ

مَثَلُ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اَوۡلِیَآءَ کَمَثَلِ الۡعَنۡکَبُوۡتِ ۖۚ اِتَّخَذَتۡ بَیۡتًا ؕ وَ اِنَّ اَوۡهَنَ الۡبُیُوۡتِ لَبَیۡتُ الۡعَنۡکَبُوۡتِ ۘ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۱
   
আল্লাহর পরিবর্তে যারা অপরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সা, যে নিজের জন্য ঘর তৈরী করে; এবং ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো দুর্বলতম, যদি তারা জানত। (সূরা আনকাবূত, ২৯ : ৪১) অন্যত্র তিনি বলেনঃ

 اَلَمۡ تَرَ کَیۡفَ ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا کَلِمَۃً طَیِّبَۃً کَشَجَرَۃٍ طَیِّبَۃٍ اَصۡلُهَا ثَابِتٌ وَّ فَرۡعُهَا فِی السَّمَآءِ ﴿ۙ۲۴  تُؤۡتِیۡۤ اُکُلَهَا کُلَّ حِیۡنٍۭ بِاِذۡنِ رَبِّهَا ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰهُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿۲۵  وَ مَثَلُ کَلِمَۃٍ خَبِیۡثَۃٍ کَشَجَرَۃٍ خَبِیۡثَۃِۣ اجۡتُثَّتۡ مِنۡ فَوۡقِ الۡاَرۡضِ مَا لَهَا مِنۡ قَرَارٍ ﴿۲۶ یُثَبِّتُ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِالۡقَوۡلِ الثَّابِتِ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ یُضِلُّ اللّٰهُ الظّٰلِمِیۡنَ ۟ۙ وَ یَفۡعَلُ اللّٰهُ مَا یَشَآءُ ﴿۲۷

তুমি কি লক্ষ্য করনা আল্লাহ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? সৎ বাক্যের তুলনা উৎকৃষ্ট বৃক্ষ যার মূল সুদৃঢ় এবং যার প্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত, যা প্রত্যেক মওসুমে ফল দান করে তার রবের অনুমতিক্রমে, এবং আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে। কু-বাক্যের তুলনা এক মন্দ বৃক্ষ যার মূল ভূ-পৃষ্ঠ হতে বিচ্ছিন্ন, যার কোন স্থায়িত্ব নেই। যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাদেরকে ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং যারা যালিম, আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন; আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন। (সূরা ইবরাহীম, ১৪ : ২৪-২৭) অন্য স্থানে আল্লাহ তা'আলা সেই ক্রীতদাসের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেনঃ

ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا عَبۡدًا مَّمۡلُوۡکًا لَّا یَقۡدِرُ عَلٰی شَیۡءٍ

আল্লাহ উপমা দিচ্ছেন অপরের অধিকারভুক্ত এক দাসের, যে কোন কিছুর উপর শক্তি রাখেনা। (সূরা নাহল, ১৬ : ৭৫) তিনি অন্যত্র বলেনঃ

وَ ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا رَّجُلَیۡنِ اَحَدُهُمَاۤ اَبۡکَمُ لَا یَقۡدِرُ عَلٰی شَیۡءٍ وَّ هُوَ کَلٌّ عَلٰی مَوۡلٰىهُ ۙ اَیۡنَمَا یُوَجِّهۡهُّ لَایَاۡتِ بِخَیۡرٍ ؕ هَلۡ یَسۡتَوِیۡ هُوَ ۙ وَ مَنۡ یَّاۡمُرُ بِالۡعَدۡلِ ۙ وَ هُوَ عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۷۶

আল্লাহ আরও উপমা দিচ্ছেন দু' ব্যক্তির; ওদের একজন মূক, কোন কিছুরই শক্তি রাখেনা এবং সে তার মালিকের জন্য বোঝা স্বরূপ; তাকে যেখানেই পাঠানো হোক না কেন সে ভাল কিছুই করে আসতে পারেনা; সে কি সমান হবে ঐ ব্যক্তির মত যে ন্যায়ের নির্দেশ দেয়? (সূরা নাহল, ১৬ : ৭৬) অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ

ضَرَبَ لَكُم مِّثَلاً مِّنْ أَنفُسِكُمْ هَل لَّكُم مِّن مَّا مَلَكَتْ أَيْمَتُكُم مِّن شُرَكَاءَ فِي مَا رَزَقْسَكُمْ

(আল্লাহ) তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেনঃ তোমাদেরকে আমি যে রিক দিয়েছি তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস- দাসীদের কেহ কি তাতে তোমাদের সমান অংশীদার? (সূরা রূম, ৩০: ২৮)

মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : মুমিনগণ এ কথায় বিশ্বাসী যে, তারা ছোট-বড় যে বিষয়েরই সম্মুখীন হয় তা আল্লাহর তরফ থেকেই হয়ে থাকে এবং আল্লাহ তা'আলা বিশ্বাসীদের সুপথ প্রদর্শন করেন। (ইবন আবী হাতিম ১/৯৩)

সুদ্দী (রহঃ) তার তাফসীরে বর্ণনা করেন, ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ), ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ (রাঃ) বলেছেন যে, 'এভাবে সে অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে' এর অর্থ হল মুনাফিক। আল্লাহ মু'মিনদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন এবং আয়াত অস্বীকারকারী পথভ্রষ্টদের পথভ্রষ্টতা আরও বাড়িয়ে দেন, যদিও তারা জানে যে, আল্লাহর আয়াত সত্য। ইহাই হল আল্লাহর বিপথে চালিত করা। (তাবারী ১/৪০৮)


اله এর .....টির ...... হচ্ছে ..... অর্থাৎ মু'মিন এ দৃষ্টান্তকে আল্লাহর পক্ষ হতে সত্য মনে করে, আর কাফিরেরা কথা বানিয়ে থাকে। যেমন সূরা মুদ্দাসসিরে আছে : 'এবং জাহান্নামের কর্মচারী আমি শুধু ফেরেস্তাদেরকেই শিযুক্ত ফয়েছি, আর আমি তাদের সংখ্যা শুধু এরূপ রেখেছি যা কাফিরদের বিভ্রান্তির উপকরণ হয়, এজন্য যে, কিতাবীগণ যেন বিশ্বস্ত হয় এবং ঈমানদারদের ঈমান আরও বর্ধিত হয়, আর কিতাবীগণ ও মু'মিনগণ সন্দেহ না করে, আর যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা এবং কাফিরেরা যেন বলে যে, এ বিস্ময়কর উপমা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য কি? এরূপেই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করে থাকেন, আর যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করে থাকেন; আর তোমার প্রভুর সৈন্যবাহিনীকে তিনি ছাড়া কেহই জানেনা, আর এটা শুধু মানুষের উপদেশের জন্য।' এখানেও হিদায়াত ও গুমরাহীর বর্ণনা রয়েছে। সাহাবীগণ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা মুনাফিক পথভ্রষ্ট হয় এবং মু'মিন সুপথ প্রাপ্ত হয়। মুনাফিকরা ভ্রান্তির মধ্যে বেড়েই চলে, কেননা এ দৃষ্টান্ত যে সত্য তা জানা সত্ত্বেও তারা একে অবিশ্বাস করে, আর মু'মিন এটা বিশ্বাস করে ঈমান আরও বাড়িয়ে নেয়।

ফাসিক এর ভাবার্থ হচ্ছে 'মুনাফিক'। কেহ কেহ এর অর্থ নিয়েছেন 'কাফির'- যারা জেনে শুনে অস্বীকার করে। সা'দ (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা খারেজীদেরকে বুঝান হয়েছে।

যে ব্যক্তি আনুগত্য হতে বেরিয়ে যায়, আরাবী পরিভাষায় তাকে ফাসিক বলা হয়। খোলস সরিয়ে খেজুরের শীষ বের হলে আরাবেরা এই বলে থাকে । ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে ক্ষতি সাধন করতে থাকে বলে ওকেও নই। বলা হয়। অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

'পাঁচটি প্রাণী 'ফাসিক'। কা'বা ঘরের মধ্যে এবং ওর বাইরে এদেরকে হত্যা করা হবে। এগুলো হচ্ছে : ১। কাক, ২। চিল, ৩। বিষ্ণু, ৪। ইঁদুর এবং ৫। কালো কুকুর। (ফাতহুল বারী ৬/৪০৮, মুসলিম ২/৮৫৬) সুতরাং কাফির এবং প্রত্যেক অবাধ্যই ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কাফিরদের ফাসিকী সবচেয়ে জঘন্য এবং সবচেয়ে খারাপ। আর এ আয়াতে ফাসিকের ভাবার্থ হচ্ছে কাফির। আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন।

এর বড় দলীল এই যে, পরে তাদের দোষ বর্ণনা করা হয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, তাঁর নির্দেশ অমান্য করা, যমীনে ঝগড়া-বিবাদ করা, আর কাফিরেরাই এসব দোষে জড়িত রয়েছে, মু'মিনদের বিশেষণতো এর সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে থাকে। যেমন বর্ণিত হয়েছেঃ

فَمَنۡ یَّعۡلَمُ اَنَّمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ الۡحَقُّ کَمَنۡ هُوَ اَعۡمٰی ؕ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ ﴿ۙ۱۹  الَّذِیۡنَ یُوۡفُوۡنَ بِعَهۡدِ اللّٰهِ وَ لَا یَنۡقُضُوۡنَ الۡمِیۡثَاقَ ﴿ۙ۲۰ وَ الَّذِیۡنَ یَصِلُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّهُمۡ وَ یَخَافُوۡنَ سُوۡٓءَ الۡحِسَابِ ﴿ؕ۲۱

তোমার রাব্ব হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যে ব্যক্তি সত্য বলে জানে সে, আর অন্ধ কি সমান? উপদেশ গ্রহণ করে শুধু বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরাই। যারা আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেনা, আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের রাব্বকে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে। (সূরা রা'দ, ১৩ : ১৯- ২১) একটু পরেই বলা হয়েছেঃ

وَ الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِهٖ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ۙ اُولٰٓئِکَ لَهُمُ اللَّعۡنَۃُ وَ لَهُمۡ سُوۡٓءُ الدَّارِ ﴿۲۵

যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্য আছে অভিসম্পাত এবং আছে মন্দ আবাস। (সূরা রা'দ, ১৩ : ২৫) অঙ্গীকার হচ্ছে ওটাই যা তাওরাতে তাদের কাছে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল যে, তারা ওর সমস্ত কথা মেনে চলবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য স্বীকার করবে, তাঁর নাবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস করবে এবং তিনি আল্লাহ তা'আলার নিকট হতে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য মনে করবে। আর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এই যে, জেনে-শুনে তারা তাঁর নাবুওয়াত ও আনুগত্য অস্বীকার করেছে এবং অঙ্গীকার সত্ত্বেও ওকে গোপন করেছে, আর পার্থিব স্বার্থের কারণে ওর উল্টা করেছে।
   
কেহ কেহ বলেন যে, এর ভাবার্থে কোন নির্দিষ্ট দলকে বুঝায়না, বরং সমস্ত কাফির, মুশরিক ও মুনাফিককে বুঝায়। অঙ্গীকারের ভাবার্থ এই যে, আল্লাহর একাত্মবাদ এবং তাঁর নাবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাবুওয়াতকে স্বীকার করা, যার প্রমাণে প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী ও বড় বড় মুজিযা বিদ্যমান রয়েছে। আর ওটা ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অস্বীকার করা। এই কথাটিই বেশি মযবুত ও যুক্তিসঙ্গত। ইমাম যামাখ্শারীর (রহঃ) মতামতও এদিকেই। তিনি বলেন যে, অঙ্গীকারের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর একাত্মবাদে বিশ্বাস করা, যা মানবীয় প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেছিলেন : 'আমি কি তোমাদের প্রভু নই?” তখন সবাই উত্তর দিয়েছিল ঃ 'হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের প্রভু। অতঃপর যেসব কিতাব দেয়া হয়েছে তাতেও অঙ্গীকার করানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন : 'তোমরা আমার অঙ্গীকার পূরা কর, আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরা করব। কেহ কেহ বলেন যে, অঙ্গীকারের ভাবার্থ হচ্ছে সেই অঙ্গীকার যা আত্মাসমূহের নিকট হতে নেয়া হয়েছিল, যখন তাদেরকে আদমের (আঃ) পৃষ্ঠদেশ হতে বের করা হয়েছিল। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন : 'তোমাদের প্রভু যখন আদমের (আঃ) সন্তানদের নিকট অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমিই তোমাদের প্রভু এবং তারা সবাই স্বীকার করেছিল।' আর একে ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ হচ্ছে একে ছেড়ে দেয়া। এ সমুদয় কথা তাফসীর ইবন জারীরে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

মুনাফিকের লক্ষণ

আবুল আলীয়া (রহঃ) বলেনঃ 'আল্লাহর অঙ্গীকার ভেঙ্গে দেয়া যা মুনাফিকদের কাজ ছিল, তা হচ্ছে এই ছয়টি অভ্যাসঃ (১) কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, (২) প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা, (৩) গচ্ছিত বস্তু আত্মসাৎ করা, (৪) আল্লাহর অঙ্গীকার দৃঢ় করণের পর তা ভঙ্গ করা (৫) যা অবিচ্ছিন্ন রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন করা এবং (৬) পৃথিবীতে বিবাদের সৃষ্টি করা। তাদের এই ছয়টি অভ্যাস তখনই প্রকাশ পায় যখন তারা জয়যুক্ত হয়। আর যখন তারা পরাজিত হয় তখন তারা প্রথম তিনটি কাজ করে থাকে।' সুদ্দী (রহঃ) বলেন যে, কুরআনের আদেশ ও নিষেধাবলী পড়া, সত্য বলে জানা, অতঃপর না মানাও ছিল অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। আল্লাহ যা মিলিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন-এর ভাবার্থ হচ্ছে আত্মীয়তার বন্ধন অবিচ্ছিন্ন রাখা এবং আত্মীয়দের হক আদায় করা ইত্যাদি । যেমন কুরআন মাজীদে এক জায়গায় আছেঃ

فَهَلۡ عَسَیۡتُمۡ اِنۡ تَوَلَّیۡتُمۡ اَنۡ تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ تُقَطِّعُوۡۤا اَرۡحَامَکُمۡ ﴿۲۲

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবতঃ তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। (সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭ ৪ ২২) (তাবারী ১/ 810 ) ইমাম ইবন জারীর (রহঃ) একেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, আয়াতটি সাধারণ। যা মিলিত রাখার ও আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা তারা ছিন্ন করেছিল এবং আদায় করেনি। ‘খছিরুন’ এর অর্থ হচ্ছে আখিরাতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেনঃ “তাদের উপর হবে লা'নত এবং তাদের পরিণাম হবে খারাপ।”

‘ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া’ কী

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, কুরআন মাজীদে মুসলিম ছাড়া অন্যদেরকে যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছে সেখানে ভাবার্থ হবে কাফির এবং যেখানে মুসলিমকে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছে সেখানে অর্থ হবে পাপী। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

اُولٰٓئِکَ لَهُمُ اللَّعۡنَۃُ وَ لَهُمۡ سُوۡٓءُ الدَّارِ 

তাদের জন্য আছে অভিসম্পাত এবং আছে মন্দ আবাস। (সূরা রা'দ, ১৩ : ২৫) ‘খছিরুন’ শব্দটি ‘খছির’ এর বহুবচন। জনগণ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে এবং দুনিয়ার মোহে পড়ে আল্লাহর রাহমাত হতে সরে গেছে বলে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছে। মুনাফিক ও কাফির ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মতই। যখন আল্লাহর দয়া/অনুগ্রহের খুবই প্রয়োজন হবে অর্থাৎ কিয়ামাতের দিন। সেই দিন এরা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত থাকবে।





*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url