তাফসীরে ইবনে কাসীর - ২৮ || সূরা বাকারা - ১৮ || আদম-সন্তানের বংশ পরম্পরায় পৃথিবীতে বসবাস || খলীফা নিয়োগের বাধ্য-বাধকতা ||






وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡهَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡهَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۳۰

সূরা আল বাকারা ৩০নং আয়াতের অর্থ

   
৩০। এবং যখন তোমার রাব্ব মালাইকাকে বললেনঃ নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব; তারা বললঃ আপনি কি যমীনে এমন কেহকে সৃষ্টি করবেন যারা তন্মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে? এবং আমরাই তো আপনার গুণগান করছি এবং আপনারই পবিত্রতা বর্ণনা করে থাকি । তিনি বললেনঃ তোমরা যা অবগত নও নিশ্চয়ই আমি তা জ্ঞাত আছি।


আদম-সন্তানের বংশ পরম্পরায় পৃথিবীতে বসবাস

মহান আল্লাহর এই অনুগ্রহের কথা চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, তিনি আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করার পূর্বে মালাইকার মধ্যেও আলোচনা করেন, যার বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ যেন নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলছেন যে, হে মুহাম্মাদ! তুমি মানব সৃষ্টির ঘটনাটি স্মরণ কর এবং তোমার উম্মাতকে জানিয়ে দাও ।

خَلِيفَة শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে পরস্পর স্থলাভিষিক্ত হওয়া। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেনঃ

وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَبِفَ الْأَرْضِ

আর তিনি এমন, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি করেছেন। (সূরা আন'আম, ৬ : ১৬৫) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ

এবং তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন? (সূরা নামল, ২৭ : ৬২)

وَلَوْ نَشَاءُ لَجَعَلْنَا مِنكُم مُلْتَبِكَةُ فِي الْأَرْضِ خَلَقُونَ

আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের মধ্য হতে মালাইকা/ফেরেশতা সৃষ্টি করতে পারতাম, যারা পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী হত। (সূরা যুখরুফ, ৪৩ : ৬০) অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ

অতঃপর তাদের অযোগ্য উত্তরসুরীরা একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়। (সূরা আ'রাফ, ৭ : ১৬৯) একটি অপ্রচলিত পঠনে خَلِيفَة খালাইফাহও পড়া হয়েছে। কোন কোন মুফাসির বলেন যে, খালীফা শব্দ দ্বারা শুধুমাত্র আদমকে (আঃ) বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এটা বিবেচনার বিষয়। 'তাফসীর রাযী' প্রভৃতি কিতাবে এই মতভেদ বর্ণনা করা হয়েছে। বাহ্যতঃ জানা যাচ্ছে যে, ভাবার্থ এটা নয়। এর প্রমাণ তো মালাইকার নিম্নের উক্তিটিঃ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ আপনি কি যমীনে এমন কেহকে সৃষ্টি করবেন যারা তন্মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে। এটা স্পষ্ট কথা যে, তারা এটা আদমের (আঃ) সন্তানদের সম্পর্কে বলেছিলেন, খাস করে তাঁর সম্পর্কে নয়।
   
মালাইকা এটা কি করে জেনেছিলেন সেটা অন্য কথা। হয়ত মানব প্রকৃতির চাহিদা লক্ষ্য করেই তাঁরা এটা বলেছিলেন। কেননা এটা বলে দেয়া হয়েছিল যে, তাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হবে। কিংবা হয়ত 'খলীফা' শব্দের ভাবার্থ জেনেই তারা এটা বুঝেছিলেন যে, মানুষ হবে ন্যায় অন্যায়ের ফাইসালাকারী, অনাচারকে প্রতিহতকারী। এবং অবৈধ ও পাপের কাজে বাধাদানকারী। অথবা তারা যমীনের প্রথম সৃষ্টজীবকে দেখেছিলেন বলেই মানুষকেও তাদের মাপকাঠিতে ফেলেছিলেন। এটা মনে রাখা দরকার যে, মালাইকার এই আরয প্রতিবাদমূলক ছিলনা বা তাঁরা যে এটা বানী আদমের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে বলেছিলেন তাও নয়। মালাইকার মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনে ঘোষণা হয়েছে : 'যে কথা বলার তাদের অনুমতি নেই, তাতে তারা মুখ খুলেনা। (এটাও স্পষ্ট কথা যে, মালাইকার স্বভাব হিংসা হতে পবিত্র) বরং সঠিক ভাবার্থ এই যে তাদের এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র এর হিকমাত জানার ও এর রহস্য প্রকাশ করার, যা তাদের বোধশক্তির উর্ধ্বে ছিল। আল্লাহ তো জানতেনই যে, এ শ্রেষ্ঠ জীব বিবাদ ও ঝগড়াটে হবে। কাজেই ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন : 'এ রকম মাখলূক সৃষ্টি করার মধ্যে বিশ্বপ্রভুর কি নিপুণতা রয়েছে? যদি ইবাদাতেরই উদ্দেশে হয় তাহলে ইবাদাত তো আমরাই করছি। আমাদের মুখেই তো সদা তাঁর তাবীহ ও প্রশংসাগীত উচ্চারিত হচ্ছে এবং আমরা ঝগড়া বিবাদ ইত্যাদি হতেও পবিত্র। তথাপি এরূপ বিবাদী মাখলূক সৃষ্টি করার মধ্যে কি যৌক্তিকতা রয়েছে?”

মহান আল্লাহ তাদের এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, তারা দুনিয়ায় ঝগড়া- বিবাদ, কাটাকাটি, মারামারি ইত্যাদি করবে এই জ্ঞান তাঁর আছে। তথাপি তাদেরকে সৃষ্টি করার মধ্যে যে নিপুণতা ও দূরদর্শিতা রয়েছে তা একমাত্র তিনিই জানেন। তিনি জানেন যে, তাদের মধ্যে নাবী রাসূল; সত্যবাদী, শহীদ, সত্যের উপাসক, ওয়ালী, সৎ, আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী, আলেম, আল্লাহভীরু, প্রভৃতি মহা-মানবদের জন্ম লাভ ঘটবে, যারা তাঁর নির্দেশাবলী যথারীতি মান্য করবে এবং তারা তাঁর বার্তাবাহকদের ডাকে সাড়া দিবে।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আছে যে, দিনের মালাইকা সুবহি সাদিকের সময় আসেন এবং আসরের সময় চলে যান। সে সময় রাতের মালাইকা আগমন করেন, তারা আবার সকালে চলে যান। আগমনকারীগণ যখন আগমন করেন। তখন অন্যেরা চলে যান। অতএব তারা ফাজর ও আসরে জনগণকে পেয়ে থাকেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর প্রশ্নের উত্তরে দুই দলই এ কথা বলেন : 'আমরা যাবার সময় আপনার বান্দাদেরকে সালাতে পেয়ে ছিলাম এবং আসার সময়ও তাদেরকে সালাতে ছেড়ে এসেছি।' (ফাতহুল বারী ১৩/৪২৬) এটাই হল মানব সৃষ্টির যৌক্তিকতা যার সম্বন্ধে মহান আল্লাহ মালাইকাকে বলেছিলেন : "নিশ্চয় আমি যা জানি তোমরা তা জাননা।' ঐ মালাইকাকে তা দেখার জন্যও পাঠানো হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

"দিনের আমলগুলি রাতের পূর্বে এবং রাতের আমলগুলি দিনের পূর্বে আল্লাহর নিকট উঠে যায়।' (মুসলিম ১৭৯) মোট কথা, মানব সৃষ্টির মধ্যে যে ব্যাপক দূরদর্শিতা নিহিত ছিল সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন যে, এটা তাদের *আমরাই তো আপনার তাসবীহ পাঠ করি' এ কথার উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহই সব জানেন অর্থাৎ মালাইকা নিজেদের দলের সবাইকে সমান মনে করে থাকে, অথচ প্রকৃতপক্ষে তা নয়। কেননা তাদের মধ্যে ইবলিসও একজন।

খলীফা নিয়োগের বাধ্য-বাধকতা

ইমাম কুরতবী (রহঃ) প্রভৃতি মনীষীগণ এই আয়াত হতে দলীল গ্রহণ করেছেন যে, খলীফা নির্ধারণ করা ওয়াজিব। তিনি মতবিরোধের মীমাংসা করবেন, ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে দিবেন, অত্যাচারী হতে অত্যাচারিত ব্যক্তির প্রতিশোধ নিবেন, 'হুদুদ' কায়েম করবেন, অন্যায় ও পাপের কাজ হতে জনগণকে বিরত রাখবেন ইত্যাদি বড় বড় কাজগুলি যার সমাধান ইমাম ছাড়া হতে পারেনা । এসব কাজ ওয়াজিব এবং এগুলি ইমাম ছাড়া সম্পন্ন হতে পারেনা, আর যা ছাড়া কোন ওয়াজিব সম্পন্ন হয়না ওটাও ওয়াজিব। সুতরাং খালীফা নির্ধারণ করা ওয়াজিব সাব্যস্ত হল।
   
ইমামতি হয়ত বা কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট শব্দের দ্বারা লাভ করা যাবে। যেমন আহলে সুন্নাতের একটি জামা'আতের আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) সম্পর্কে ধারণা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম খিলাফাতের জন্য তাঁর নাম নিয়েছিলেন। কিংবা কুরআন ও হাদীসে ওর দিকে ইঙ্গিত আছে। যেমন আহলে সুন্নাতেরই অপর একটি দলের প্রথম খালীফার ব্যাপারে ধারণা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইঙ্গিতে খিলাফাতের জন্য তাঁর নাম উল্লেখ করেছিলেন। অথবা হয়ত একজন খলীফা তাঁর পরবর্তী খলীফার নাম বলে যাবেন। যেমন আবূ বাকর (রাঃ) উমারকে (রাঃ) তাঁর স্থলবর্তী করে গিয়েছিলেন। কিংবা তিনি হয়ত সৎলোকদের একটি কমিটি গঠন করে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্বভার তাদের উপর অর্পণ করে যাবেন যেমন উমার (রাঃ) এরূপ করেছিলেন। অথবা আহলে হিল্লওয়াল আদ (অর্থাৎ প্রভাবশালী সেনাপতিগণ, আলেমগণ, সৎলোকগণ ইত্যাদি) একত্রিতভাবে তার হাতে বাইআত করবেন, তাদের কেহ কেহ বাইআত করে নিলে অধিকাংশের মতে তাকে মেনে নেয়া ওয়াজিব হয়ে যাবে।

ইমাম হওয়ার জন্য পুরুষ লোক হওয়া, আযাদ হওয়া, বালিগ হওয়া, বিবেক সম্পন্ন হওয়া, মুসলিম হওয়া, সুবিচারক হওয়া, ধর্ম বিষয়ে অভিজ্ঞ হওয়া, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হওয়া, সাধারণ অভিমত সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়া এবং কুরাইশী হওয়া ওয়াজিব।

তবে হ্যাঁ, হাশিমী হওয়া ও দোষমুক্ত হওয়া শর্ত নয়। গালী রাফেযী এ শর্ত দু'টি আরোপ করে থাকে। ইমাম যদি ফাসিক হয়ে যায় তাহলে তাকে পদচ্যুত করা উচিত কিনা এ বিষয়ে মতভেদ আছে। সঠিক মত এই যে, তাকে পদচ্যুত করা হবেনা। কেননা হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন 

“যে পর্যন্ত না তোমরা এমন খোলাখুলি কুফরী লক্ষ্য কর যার কুফরী হওয়ার প্রকাশ্য দলীল আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের নিকট বিদ্যমান থাকে।” (বুখারী ৭০৫৬, তাবারী ১/৪৭৭) অনুরূপভাবে ইমাম নিজেই পদত্যাগ করতে পারে কিনা সে বিষয়েও মতবিরোধ রয়েছে। হাসান ইব্‌ন আলী (রাঃ) নিজে নিজেই পদত্যাগ করেছিলেন এবং ইমামের দায়িত্ব মু'আবিয়াকে (রাঃ) অর্পণ করেছিলেন। কিন্তু এটা ওজরের কারণে ছিল এবং যার জন্য তার প্রশংসা করা হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠে একাধিক ইমাম একই সময়ে হতে পারেনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'যখন তোমাদের মধ্যে কোন কাজ সম্মিলিতভাবে হতে যাচ্ছে এমন সময় কেহ যদি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে তাহলে তাকে হত্যা কর, সে যে কেহই হোক না কেন।' (মুসলিম ৩/১৪৭০) জমহুরের এটাই মাযহাব এবং বহু বিজ্ঞজনও এর উপর ইজমা নকল করেছেন, যাদের মধ্যে ইমামুল হারামাইন ও (রহঃ) একজন।





**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url