ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের ইতিহাস-১ || যুগে যুগে ইয়াহুদী-খৃষ্টচক্রের ষড়যন্ত্র





যুগে যুগে ইয়াহুদী-খৃষ্টচক্রের ষড়যন্ত্র 


আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ

ولَن تَرْضَى عَنكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حتى تتبع ملتهم قُلْ إِنْ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِن اتبعت أَهْوَاءَهُم بَعْدَ الَّذِي جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللهِ مِن وَلي وَلَا نَصِيرٍ ﴿١٢٠)

অর্থঃ (হে নবী!) ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা কখনোই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না (খোদা না করুন) আপনি তাদের ধর্মের (পরিপূর্ণ) অনুগত হয়ে যান। (অর্থাৎ আপনি ইয়াহুদী অথবা খৃষ্টান না হওয়া পর্যন্ত তারা আপনার কথা মানবে না।) আপনি বলে দিন আল্লাহু পাক যে পথ প্রদর্শন করেছেন তা প্রকৃত হিদায়াতের পথ। যদি আপনি তাদের আকাঙ্খাসমূহ পূরণে তৎপর হন ওহীর ঐ অকাট্য জ্ঞান লাভের পর-যা আপনার কাছে পৌঁছেছে তবে আল্লাহ থেকে (অর্থাৎ তাঁর হাত থেকে) আপনাকে উদ্ধারকারী ও সাহায্যকারী কেউ থাকবে না। (সূরাহ্ বাক্বারাঃ ১২০)
উল্লেখিত আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, মুসলমানরা যতদিন পর্যন্ত তাদের প্রভু প্রদত্ত দীন-ইসলামকে পরিত্যাগ করে ইয়াহুদী খৃষ্টানদের ধর্ম গ্রহণ না করবে ততদিন পর্যন্ত ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা মুসলমানদের প্রতি সদ্ভাব পোষণকারী হবে না। এমনকি আল্লাহুর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেলায়ও তাদের এ মানসিকতা প্রকটভাবে বিদ্যমান ছিল। তাদের আন্তরিক কামনা ও লক্ষ্য একটিই। আর তা হচ্ছে এই যে, সমগ্র মুসলিম জাতি ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করুক আর দুনিয়াতে ইসলামের নাম-নিশানা পর্যন্ত বাকী না থাকুক। এ কারণে ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শুধু ষড়যন্ত্র করেই ‘আসছে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদীনায় হিজরতের পূর্বে মদীনা প্রধানতঃ আওস ও খাযরাজ গোত্রীয় মুশরিক আর ইয়াহুদী ও নাসারাদের আবাসস্থল ছিল। নবীজীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমনের পূর্বেই আওস ও খাযরাজ গোত্রের কাফির মুশরিকদের মধ্য হতে অনেকে হজ্জের মওসুমে মক্কাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াত কবুল করে ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
   
পক্ষান্তরে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা শুধুমাত্র হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করা হতে কেবল বিরতই থাকেনি বরং ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে সর্বদাই তারা নানা ফন্দি ফিকির আটতে থাকে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আবির্ভাবের কিছুকাল পূর্বেও এই ইয়াহুদী খৃষ্টানরা আওস ও খাযরাজ গোত্রের হাতে বার বার প্রহৃত হওয়ার পরিণতিতে তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন ও নিজেদের আত্মতৃপ্তি লাভের উদ্দেশ্যে তাদের 'আসমানী কিতাবের ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকে এ কথাই বলতো যে অতিসত্বর এই ভূমিতে খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ আখিরী নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবির্ভাব ঘটবে। আমরা তখন তাঁর দীন কবুল করে তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে তোমাদের পরাজিত করবো। কারণ তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আবির্ভাবের সময় ও স্থানসহ তার পূর্ণ পরিচয় লিপিবদ্ধ ছিল।
   
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদীনায় আগমনের পর ইয়াহুদী খৃষ্টানদের ইসলাম কবুল না করা সত্ত্বেও শান্তি ও সহাবস্থানের লক্ষ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি স্থাপন করেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি স্থাপন করে ছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে তিনটি ইয়াহুদী গোত্র ছিল উল্লেখযোগ্য যথাক্রমে বুন ক্বাইনুক্বা, বনু নজীর ও বনু কুরাইজা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ রাযি. উল্লেখিত চুক্তির সকল শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন করতে থাকেন । কিন্তু ইয়াহুদী-খৃষ্টান জাতি তাদের গোঁয়ার্তুমি ও হঠকারিতার কলঙ্কিত ঐতিহ্য ও মজ্জাগত বদ স্বভাবের পরিচয় দিয়ে নানাভাবে চুক্তির বরখেলাপ করে জঘন্যতম কর্মকাণ্ড ঘটাতে থাকে। এক দিকে বিপুলসংখ্যক ইয়াহুদী প্রকাশ্যে ইসলাম কবুল করে ছদ্ম-বেশে মুনাফিকরূপে মুসলমানদের মাঝে অনুপ্রবেশ করতঃ ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করতে তৎপর হয়।

অপরদিকে প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধিতাকারী ইয়াহুদীরা মক্কার মূর্তিপূজক কাফির মুশরিকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের অপকর্মসমূহের কতিপয় দৃষ্টান্ত নিম্নরূপঃ

দৃষ্টান্ত -১: একবার এক আরব্য রমণী বনু কাইনুকার বাজারে গেলে এক দোকানদার দুষ্টামির ছলে তার কাপড় খুলে উলঙ্গ করে দেয় এবং তাকে নিয়ে খুব হাসি ঠাট্টা করে। সেই মহিলার চিৎকার শুনে এক আরব্য ব্যক্তি এগিয়ে আসে এবং দোকানদারকে হত্যা করে ফেলে। তখন অন্যান্য ইয়াহুদীরা জড়ো হয় এবং উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরব ও ইয়াহুদীদের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। ঘটনাটি অবহিত হয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাশরীফ আনেন এবং বিবাদকারীদের তিরষ্কার করেন। এতে বনু কাইনুকার লোকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে মুসলমানদের বলতে লাগলো যে তোমরা বদর যুদ্ধের বিজয়ে বেশী গর্ব করো না। কারণ তারা (কুরাইশরা) তোমাদের সমগোত্রীয় ছিল, তারা যুদ্ধ করতে শিখেনি। ফলে তোমাদের বিজয় সম্ভব হয়েছে। তবে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করলে বুঝতে পারবে যোদ্ধা কাকে বলে। এরূপ দম্ভোক্তি করে তারা ইতিপূর্বে তাদের সঙ্গে সম্পাদিত সন্ধি চুক্তি ভঙ্গের ঘোষণা দেয়। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রতিরোধ পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পনের দিন পর্যন্ত তাদের অবরোধ করে রাখা হয়। অতঃপর তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। অবশেষে তারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে কোন সিদ্ধান্তের প্রতি নিঃশর্ত সম্মতি জ্ঞাপনে বাধ্য হয়। সুতরাং উক্ত ইয়াহুদী গোত্রকে মদীনা হতে বহিষ্কার করা হয়।
   
দৃষ্টান্ত-২: ইয়াহুদী গোত্র বনু নজীরের সাথে অপর এক আরব্য গোত্রের বিরোধ হলে, এর মীমাংসা করতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক'জন শীর্ষস্থানীয় সাহাবীকে রাযি. সঙ্গে নিয়ে বনু নজীরের এলাকায় গমন করেন। বাহ্যতঃ তারা তখন আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার মনোভাব প্রদর্শন করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সসম্মানে একটি দেয়ালের নিকট বসতে দেয় কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা দেয়ালের উপর হতে বৃহৎ প্রস্তর খণ্ড নিক্ষেপ করতঃ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে শহীদ করে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাষণ্ড আমর বিন হাজ্জাশ এই জঘন্য কাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে দেয়ালের উপর অবস্থান নেয়। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে তাদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হয়ে নিঃশব্দে তথা হতে উঠে আসেন। এই ঘটনার পর তিনি বনু নজীরকে দশ দিনের মধ্যে মদীনা ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এ সময় সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর মদীনায় তাদের যে কোন ব্যক্তিকে পাওয়া গেলে তাকে হত্যা করা হবে বলে সাথে সাথে জানিয়ে দেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ পেয়ে বনু নজীর মদীনা ত্যাগের জন্য তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের প্ররোচনায় ও তার পক্ষ হতে সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে তারা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিক এই উত্তর পাঠায় যে, আমরা কোন ক্রমেই মদীনা ত্যাগ করবো না। আপনার যা ইচ্ছা করতে পারেন। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদেরকেও মদীনা ত্যাগে বাধ্য করেন। অতঃপর তারা দেশান্তরিত হয়ে খাইবার নামক স্থানে গিয়ে বসবাস শুরু করে।
   
দৃষ্টান্ত-৩: পঞ্চম হিজরীর ঘটনা। এবার ইয়াহুদীরা মুসলমানদেরকে সমূলে শেষ করে দিতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। নেতৃস্থানীয় ক'জন ইয়াহুদী আরবের অন্যান্য সকল কাফির গোত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে মক্কার কুরাইশ, বনু সালীম, বনু গাতফান, বনু আসাদ, আশজা, ফাযারাহ, বনু মুররাহ এ সকল গোত্রের কাফিরদের সমন্বয়ে বহুজাতিক বাহিনী গঠন করতঃ সকলে এক সঙ্গে মদীনা আক্রমণ করার পরিকল্পনা আটে। পরিকল্পনা মুতাবিক তাদের দশ হাজার সৈন্যর বিশাল বাহিনী মুসলমানদের উপর যুগপৎ আক্রমণ চালায়। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সকল সাহাবায়ে কিরাম রাযি. কে সঙ্গে নিয়ে কাফিরদের আক্রমণ প্রতিহত করতে মদীনার চতুর্পার্শ্বে পরিখা খননে লিপ্ত হন। মদীনায় তখন কেবল নারী ও শিশুরা ছিল। এরই মধ্যে মদীনায় অবস্থানকারী ইয়াহুদীদের তৃতীয় গোত্র বনু কুরাইজাহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গের ঘোষণা দিয়ে কাফিরদের সাথে সংঘটিত যুদ্ধের চরম মূহুর্তে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন এক দল সাহাবী রাযি. কে
মদীনায় নারী ও শিশুদের দেখা-শুনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতে নির্দেশ দেন। তথাপি খন্দক প্রান্তরে যুদ্ধরত মুসলমানগণ সর্বদাই নিজ নিজ পরিবার পরিজনের উপর বনু কুরাইজার ইয়াহুদীদের আক্রমণের আশংকার উদ্বিগ্ন ছিলেন। দীর্ঘ এক মাস পর্যন্ত কাফির বাহিনী মদীনা অবরোধ করে রাখে, কিন্তু সমর বিশেষজ্ঞ সাহাবী হযরত সালমান ফার্সী রাযি. এর পরামর্শ মুতাবিক খন্দক বা পরিখা খনন করে রাখায় কাফিরদের পক্ষে তা অতিক্রম করে মদীনায় প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে আল্লাহর গজবে পতিত হয়ে শত্রুদল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং কাফিররা মদীনা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। আল্লাহ তা'আলার বিশেষ রহমত ও সাহায্যে মুসলমানরা এই যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। ইসলামের ইতিহাসে তা খন্দক যুদ্ধ নামে পরিচিত। খন্দক যুদ্ধ হতে মদীনা প্রত্যাবর্তন করে কোনরূপ বিশ্রাম গ্রহণের পূর্বেই হযরত জিবরাইল আ. আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তির বিধান নিয়ে অবতীর্ণ হন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম রাযি. কে সেদিন ‘আসরের নামাযের পূর্বেই বনু কুরাইজার এলাকায় পৌছার নির্দেশ দেন। বনু কুরাইজাহ তখন তাদের নির্মিত দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। পঁচিশ দিন পর্যন্ত দুর্গ অবরোধ করে রাখা হয়। এই দীর্ঘ অবরোধে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে।
   
তখন তাদের নেতা কাব বিন আসাদ বললো এখন মুক্তির পথ এইটাই যে তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাও। কেননা, তোমাদের সকলেরই জানা আছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য নবী। যদি এ পথ তোমাদের নিকট পছন্দনীয় না হয় তাহলে সবাই স্বীয় স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করে জীবনের মায়া ত্যাগ করে চূড়ান্ত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে হয় বিজয় অর্জন কর নতুবা সকলেই আত্মাহুতি দাও। আর যদি তোমাদের পক্ষে তাও সম্ভব না হয় তাহলে তোমাদের ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করে পবিত্র শনিবারে অতর্কিত হামলা কর। কেননা এদিন মুসলমানগণ এ বিশ্বাসে অপ্রস্তুত থাকবে যে, আমরা শনিবারের পবিত্রতা রক্ষার্থে এদিন যুদ্ধ করবো না। বনু কুরাইজার লোকেরা কাব বিন আসাদের প্রস্তাবিত কোন পন্থাই গ্রহণ না করে হযরত আবু লুবাবা রাযি. এর সঙ্গে পরামর্শ করতঃ বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে। আওস গোত্রের সঙ্গে বনু কুরাইজার মিত্রতা থাকায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইজার ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আওসের লৌহ পুরুষ, বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সা'আদ বিন মু'আয রাযি. এর হাতে অর্পণ করলেন। বনু কুরাইজার কৃত অপরাধের উচিৎ শাস্তি স্বরূপ তিনি তাদের যুদ্ধক্ষম সকল পুরুষকে হত্যা এবং নারী ও শিশুদের বন্দী করার সিদ্ধান্ত দেন। তারই সিদ্ধান্ত মুতাবিক বনু কুরাইজার নেতা কাব বনু নজীর নেতা হুয়াই বিন আখতাবসহ ছয় শতাধিক যুদ্ধাপরাধী বন্দীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
দৃষ্টান্ত-৪: বনু নজীরকে খাইবারে বহিষ্কার করার পর খাইবার নতুন করে ষড়যন্ত্রকারীদের আখড়ায় পরিণত হয়। এখানে বসে বসে ইয়াহুদী ও ইসলাম বিদ্বেষীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করতো। বনু নজীর নেতা হুয়াই বিন আখতাব খন্দক যুদ্ধের সময় খাইবার হতে মদীনায় গিয়ে তথায় অবস্থানকারী বনু কুরাইজাকে বিশ্বাসঘাতকতায় প্ররোচিত করে। এ কারণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে সপ্তম হিজরীতে খাইবার অভিযান পরিচালনা করেন। অষ্ট দূর্গে পরিবেষ্টিত খাইবার ইয়াহুদীদের অত্যন্ত শক্তিশালী ঘাটি ছিল। এখানে শত্রু পক্ষের কিছু শক্তিশালী যোদ্ধারও অবস্থান ছিল। তাই এ যুদ্ধ জয় করতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামকে রাযি. কঠোর পরিশ্রম ও চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন পাঁচটি দুর্গ বিজিত হয় তখন ইয়াহুদীরা আত্মরক্ষার নিমিত্তে শেষ চেষ্টা স্বরূপ অবশিষ্ট তিন দুর্গে আশ্রয় নেয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম রাযি. কে নিয়ে সেগুলো অবরোধ করে রাখেন।
দীর্ঘ চৌদ্দ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন ইয়াহুদীরা রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হচ্ছিল না তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘মিনজানিক' নামক হস্তচালিত বৃহৎপ্রস্তর নিক্ষেপক কামান মোতায়েন করে দুর্গ ভাঙ্গার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহুদীরা আলোচনার অনুমতি প্রার্থনা করে দূত প্রেরণ করে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে সম্মত হন। অতঃপর আলোচনায় এ সিদ্ধান্ত হলো যে দুর্গে অবস্থানকারী সকলকে মুক্তি দেয়া হবে। তবে সঙ্গে কোন প্রকার সম্পদ ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে যেতে পারবে না। পরিহিত কাপড় ব্যতীত অন্য কোন ব্যবহার্য জিনিস পত্রও সাথে করে নিতে পারবে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে ঘোষণা করে দেয়া হয় কেউ কোন কিছু গোপন করলে তার জানের নিরাপত্তা বহাল থাকবে না। সে মুতাবিক সম্পদ লুকানোর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর দু'জনকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ দেয়া হয়।

দৃষ্টান্ত-৫: মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিষ প্রয়োগে হত্যার জঘন্য ষড়যন্ত্রঃ খাইবার যুদ্ধের পরের ঘটনা। যুদ্ধশেষে স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে আসার পর এক ইয়াহুদী মহিলা একটি ছাগল রান্না করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে তা হাদিয়া হিসেবে পেশ করল। তাতে সে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা হতে এক টুকরা গোস্ত উঠিয়ে মুখে দিলে গোশতের টুকরাটিই বলে দিল যে, তাতে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে, হযরত জিবরাঈল আ. এসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিষ প্রয়োগের কথা জানিয়ে ছিলেন তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোশতের টুকরাটি মুখ থেকে ফেলে দেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই একজন সাহাবী রাযি. বিষ প্রয়োগের কথা না জেনে ঐ বিশ মিশ্রিত গোস্ত ভক্ষণ করে ইন্তিকাল করেন। এ ঘটনার পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত মহিলাকে ডেকে বিষ প্রয়োগের কথা জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিল আমি এ জন্য বিষ মিশ্রিত করেছি যে, আপনি যদি সত্য নবী হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে। আর যদি আপনি মিথ্যা নবী হয়ে থাকেন তাহলে আমরা আপনার হাত থেকে মুক্তি পাবো।
   
ইমাম যুহুরী রহ. বর্ণনা করেন যে, উক্ত মহিলা মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মু'জিযা প্রত্যক্ষ করে মুসলমান হয়ে গেল। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা ও মুক্ত করে দেন। কিন্তু অন্য বর্ণনা মতে জানা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত সাহাবীর রাযি. ইন্তিকালের ঘটনার পর উক্ত মহিলাকে কিসাস স্বরূপ হত্যার নির্দেশ দেন। খাইবারের এই বিষ প্রয়োগের ঘটনার তিন বছর পর যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু যাতনায় ভুগছিলেন, তখন তিনি এই বলছিলেন যে, “খাইবারের বিষ ক্রিয়াই এখন আমার মধ্যে দেখা দিয়েছে।” এজন্য ইমাম যুহরী রহ. বলেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাহাদাতের মৃত্যু লাভ করেছেন।

দৃষ্টান্ত-৬: একবার লাবীদ ইবনে আসাম নামীয় এক ইয়াহুদী হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যাদু করল। ঘটনার বিবরণ এই যে, জনৈক বালক মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজ কর্ম করত। ইয়াহুদী তার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবহার করা চিরুনি হস্তগত করে একটি তাঁতের সুতোয় এগারটি গ্রন্থি লাগিয়ে প্রত্যেক গ্রন্থিতে একটি করে সুই সংযুক্ত করে উক্ত চিরনিসহ সেই গ্রন্থিযুক্ত সুতাটি খেজুরে আবরণীতে রেখে তা একটি পরিত্যক্ত কূপে প্রস্তর খণ্ডের নীচে চাপা দিয়ে রাখল। এই যাদুর প্রভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘ ছ'মাস দারুণ কষ্টে ভোগেন। হযরত আয়িশার রাযি. বর্ণনা মতে, এই যাদুর প্রভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং যে কাজটি করেননি, তাও করেছেন বলে অনুভব করতেন।
   
অতঃপর স্বপ্নে দু'জন ফেরেশতার কথোপকথন শুনে লাবীদের যাদু ও যাদুতে ব্যবহৃত বস্তু সমূহের গোপন কূপের সন্ধান অবগত হয়ে তিনি ঘুম হতে উঠে তথায় গমন করেন এবং কূপ হতে সেগুলো উঠিয়ে আনেন। আল্লাহ পাক সূরাহ ফালাক ও সূরাহ নাসের এগারটি আয়াত নাযিল করেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদুর সুতার এগারটি গ্রন্থির প্রত্যেকটিতে এক এক আয়াত পাঠ করে তা খুলতে লাগলেন। গ্রন্থিগুলো খোলা সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শয্যা ত্যাগ করে এবং অনুভব করলেন যেন নিজের উপর থেকে একটা বোঝা সরে গেল।

এই হচ্ছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদী-খৃষ্টান জাতি কর্তৃক পরিচালিত ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রসমূহের ক'টি সংক্ষিপ্ত উদাহরণ।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদী-খৃষ্টানরা এভাবে নানা রকম ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ঘটাতে থাকে। উদ্দেশ্যে ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করে নিজেদের ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। ইয়াহুদী খৃষ্টানদের সেই ষড়যন্ত্রের ধারা এখনো অব্যাহত আছে পুরোদমে আর তা থাকবে হয়তো আগামীতেও, কিন্তু এ ব্যাপারে এখন করণীয় কী তা আমাদের নির্ণয় করতে হবে।





*************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url