তাফসীরে ইবনে কাসীর - ৩১ || সূরা বাকারা - ২১ || আদম (আঃ)-এর জান্নাতে অবস্থান || হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টি






সূরা আল বাকারা ৩৫-৩৬নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর


 وَ قُلۡنَا یٰۤاٰدَمُ اسۡکُنۡ اَنۡتَ وَ زَوۡجُکَ الۡجَنَّۃَ وَ کُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَیۡثُ شِئۡتُمَا ۪ وَ لَا تَقۡرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَۃَ فَتَکُوۡنَا مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۳۵  فَاَزَلَّهُمَا الشَّیۡطٰنُ عَنۡهَا فَاَخۡرَجَهُمَا مِمَّا کَانَا فِیۡهِ ۪ وَ قُلۡنَا اهۡبِطُوۡا بَعۡضُکُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ ۚ وَ لَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ مُسۡتَقَرٌّ وَّ مَتَاعٌ اِلٰی حِیۡنٍ ﴿۳۶

সূরা আল বাকারা ৩৫-৩৬নং আয়াতের অর্থ

   
৩৫। এবং আমি বললামঃ হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান কর এবং তা হতে যা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার । কিন্তু ঐ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়োনা, তাহলে তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। ৩৬। অনন্তর শাইতান তাদের উভয়কে তথা হতে বিচ্যুত করল, অতঃপর তারা উভয়ে যেখানে ছিল তথা হতে তাদেরকে বর্হিগত করল; এবং আমি বললামঃ তোমরা নীচে নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু; এবং পৃথিবীতেই রয়েছে তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্ট কালের অবস্থিতি ও ভোগ সম্পদ।


আদমকে (আঃ) পুনরায় সম্মানিত করা
আদমের (আঃ) এটি অনন্য মর্যাদা ও সম্মানের বর্ণনা। মালাইকাকে দ্বারা সাজদাহ করানোর পর আল্লাহ তা'আলা তাঁদের স্বামী-স্ত্রীকে জান্নাতে স্থান দিলেন এবং সব জিনিসের উপর অধিকার দিয়ে দিলেন। তাফসীর ইব্‌ন মিরদুওয়াই এর হাদীসে রয়েছে যে, আবূ যার (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন : 'হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আদম (আঃ) কি নাবী ছিলেন?' তিনি বলেন : 'তিনি নাবীও ছিলেন এবং রাসূলও ছিলেন। এমন কি আল্লাহ তা'আলা তাঁর সামনে কথাবার্তা বলেছেন এবং তাঁকে বলেছেন, 'তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান কর।'

হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টি

কুরআনুল হাকীমের বাকরীতি দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, জান্নাতে অবস্থানের পূর্বে হাওয়াকে (আঃ) সৃষ্টি করা হয়েছিল। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (রহঃ) বলেন যে, আহলে কিতাব ইত্যাদি আলেমগণ হতে ইবন আব্বাসের (রাঃ) বর্ণনা অনুসারে জানা যাচ্ছে যে, ইবলীসকে ধমক ও ভীতি প্রদর্শনের পর আদমের (আঃ) জ্ঞান প্রকাশ করে তাঁর উপর তন্দ্রা চাপিয়ে দেন। অতঃপর তাঁর বাম পাঁজর হতে হাওয়াকে (আঃ) সৃষ্টি করেন। চোখ খোলামাত্র আদম (আঃ) তাঁকে দেখতে পান এবং রক্ত ও গোশতের কারণে অন্তরে তাঁর প্রতি প্রেম ও ভালবাসার সৃষ্টি হয়। অতঃপর বিশ্বপ্রভু উভয়কে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন এবং জান্নাতে বাস করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন : আমি বললাম : হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান কর এবং তা হতে যা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার কর; কিন্তু ঐ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়োনা, তাহলে তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (তাবারী ১/৫১৪)

আল্লাহ আদমকে (আঃ) পরীক্ষা করলেন

আল্লাহ তা'আলা আদমকে (আঃ) বলেন : 'হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতের মধ্যে সুখে স্বাচ্ছন্দে অবস্থান কর এবং মনে যা ইচ্ছা তা খাও ও পান কর, আর এই বৃক্ষের নিকট যেওনা।’
   
এই বিশেষ বৃক্ষ হতে নিষেধ করা একটা পরীক্ষা ছিল। কেহ কেহ বলেন যে, এটা আঙ্গুর গাছ ছিল। আবার কেহ বলেন যে, এটা ছিল গমের গাছ। কেহ বলেছেন শীষ, কেহ বলেছেন খেজুর এবং কেহ কেহ ডুমুরও বলেছেন। ঐ গাছের ফল খেয়ে মানবীয় প্রয়োজন (পায়খানা-প্রস্রাব ) দেখা দিত এবং ওটা জান্নাতের যোগ্য নয়। কেহ কেহ বলেন যে, ঐ গাছের ফল খেয়ে মালাইকা চিরজীবন লাভ করতেন। ইমাম ইব্‌ন জারীর (রহঃ) বলেন যে, ওটা কোন একটি গাছ ছিল যা থেকে খেতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা নিষেধ করেছিলেন। ওটা যে কোন নির্দিষ্ট গাছ ছিল তা কুরআন কারীম বা কোন সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয়না। তাছাড়া এ ব্যাপারে মুফাসিরগণের মধ্যে খুবই মতভেদ রয়েছে। এটা জানলেও আমাদের কোন লাভ নেই এবং না জানলেও কোন ক্ষতি নেই। সুতরাং এ জন্য মাথা ঘামানোর প্রয়োজনই বা কি? মহান আল্লাহই এটা খুব ভাল জানেন । (তাবারী ১/৫২০) ইমাম রাযীও (রহঃ) এই ফাইসালাই দিয়েছেন। এবং সঠিক কথাও এটাই বটে।

عَنۡهَا এর هَا সর্বনামটি কেহ কেহ جَنَّۃَ  এর দিকে ফিরিয়েছেন, আবার কেহ কেহ شَّجَرَ এর দিকে ফিরিয়েছেন। একটি কিরাআতে فَاَزَلَّهُمَا এরূপও রয়েছে। তবে অর্থ হবেঃ 'শাইতান তাদের দু'জনকে জান্নাত হতে পৃথক করে দেয়।' আর দ্বিতীয়টির অর্থ হবেঃ 'ঐ গাছের কারণেই শাইতান তাদের দু'জনকে ভুলিয়ে দেয়। ঐ অবাধ্যতার কারণে তাঁদের জান্নাতী পোশাক, সেই পবিত্র স্থান, ঐ উত্তম আহার্য ইত্যাদি সব কিছুই ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং তাদের বলা হয়ঃ এখন পৃথিবীতেই তোমাদের আহার্য ইত্যাদি রয়েছে। কিয়ামাত পর্যন্ত তোমরা সেখানেই পড়ে থাকবে এবং সেখানে উপকার লাভ করবে।'

আদম (আঃ) এর দৈহিক গঠন

ইবন আবী হাতিম (রহঃ) উবাই ইবন কা'ব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ তা'আলা আদমকে (আঃ) অনেক লম্বা করে সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর চুল ছিল ঝাকরা ঘন যেন খেজুর গাছের ছড়ানো শাখা। আদম (আঃ) যখন নিষিদ্ধ গাছ থেকে আহার করলেন তখন তাঁর শরীর বস্ত্রমুক্ত হয়ে যায় এবং শরীরের আবৃত অংশ দৃষ্টিগোচর হয়ে পড়ে। তিনি তা লক্ষ্য করে জান্নাতের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর চুল একটি গাছের সাথে আটকে যায়। তিনি তা থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করেন। তখন আল্লাহ আর-রাহমান তাঁকে ডাক দিয়ে বলেন : ওহে আদম! তুমি কি আমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছ? আর-রাহমানের (আল্লাহ) বাণী শুনে আদম (আঃ) বললেন ঃ হে আমার রাব্ব! তা নয়, বরং আমি লজ্জিত। (ইবন আবী হাতিম ১/১২৯)

আদম (আঃ)-এর জান্নাতে অবস্থান

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আদম (আঃ) আসরের পর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জান্নাতে ছিলেন। (হাকিম ২/৫৪২) ইবন আবী হাতিমও (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা'আলা আদমকে (আঃ) পৃথিবীতে প্রেরণ করেন মাক্কা এবং তায়েফের মধ্যবর্তী স্থান 'দাহনা' নামক জায়গায়। (ইব্‌ন আবী হাতিম ১/১৩১) হাসান বাসরী (রহঃ) বলেছেনঃ আদমকে (আঃ) প্রেরণ করা হয়েছিল ভারতে এবং তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে (আঃ) প্রেরণ করা হয়েছিল জিদ্দা নগরীতে। ইবলিসকে পাঠানো হয়েছিল 'দাস্তামিসান' নামক স্থানে যা বাসরা থেকে কয়েক মাইল দূরে। এ ছাড়া সাপকে পাঠানো হয়েছিল 'আসবাহানে' । (ইব্‌ন আবী হাতিম ১/১৩২)
   
সহীহ মুসলিম ও নাসাঈতে আছে যে, সমস্ত দিনের মধ্যে সর্বোত্তম দিন হচ্ছে শুক্রবার। ঐ দিনই আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করা হয়, ঐ দিনই জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং ঐ দিনই জান্নাত হতে বের করে দেয়া হয়। (মুসলিম ২/৫৮৫, নাসাঈ ৩/৯০)

জান্নাতে শাইতানের যাতায়াত, একটি সন্দেহের নিরসন

যদি কেহ প্রশ্ন করেন যে, আদম (আঃ) যখন আসমানী জান্নাতে ছিলেন, তখন শাইতান আল্লাহর দরবার হতে বিতাড়িত হয়েছিল। তাহলে আবার সেখানে কিভাবে পৌঁছল? এর প্রথম উত্তর তো এই হবে যে, ঐ জান্নাত যমীনে ছিলনা। এ ছাড়া অধিকাংশ আলেমের মতামত এই যে, সম্মানিত অবস্থায়ও শাইতানের জান্নাতে প্রবেশ করায় নিষেধ ছিল। কিন্তু কখনও কখনও সে চুরি করে জান্নাতে প্রবেশ করত, যেহেতু তাওরাতে আছে যে, সে সাপের মুখে আড়াল করে বসে জান্নাতে গিয়েছিল। এও একটি উত্তর যে, সে জান্নাতে যায়নি, বরং চলতি পথে জান্নাতের বাহির থেকেই কুমন্ত্রণা দিয়েছিল। আবার জামাখশারী (রহঃ) বলেন যে, যমীনে থেকেই সে তাঁর অন্তরে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল। কুরতুবী (রহঃ) এখানে সর্প সম্পর্কীয় এবং তাকে মেরে ফেলার হুকুমের হাদীসগুলিও এনেছেন, যা খুবই উত্তম ও উপকারী হয়েছে।






*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url