ঈদ ও রোযা সারা বিশ্বে একই দিনে হবে নাকি ভিন্ন ভিন্ন দিনে হবে?







ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার শর’ই নীতিমালা

   
শরীআতের বিধান মতে চাঁদের উদয়স্থল মেঘলা থাকলে রমযানের এবং অন্যান্য মাসের জন্য মাত্র ১ জন আর ঈদুল ফিতরের জন্য মাত্র ২ জন বালেগ মুসলমানের স্বচক্ষে চাঁদ দেখার বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আর চাঁদের উদয়স্থল সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকলে সব মাসে জন্মেগাফীর তথা এমন সংখ্যক লোকের চাঁদ দেখা জরুরী যাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দাতা আশ্বস্ত হতে পারেন যে, এতগুলো লোক মিথ্যার উপর একমত হতে পারে না। এদের সংখ্যা নির্ভরযোগ্য মত অনুযায়ী নির্দিষ্ট নয় এ পরিমাণ হতে হবে যে, সিদ্ধান্ত দাতা সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পারেন।

চাঁদ দেখা সংশয় নিরসন

ক. কেউ কেউ মনে করেন, চাঁদের ফয়সালা দিতে হলে কাজী হওয়া জরুরী। বর্তমান সরকারী হেলাল কমিটি হল কাজীর হুকুমে। কাজেই অন্য কেউ এ ঘোষণা দেয়ার অধিকার রাখেন না। তাদের এ দাবী ভিত্তিহীন। এ ব্যাপারে শর’ই ফতওয়া হল, ইসলামী হুকুমতের অবর্তমানে ঈদ জুম'আ এজাতীয় মাসায়েলের ক্ষেত্রে দেশের প্রখ্যাত ও বিশ্বস্ত সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম উলামাদের পঞ্চায়েতই কাজীর স্থলাভিষিক্ত সাব্যস্ত হবেন। সুতরাং তারা শর'ই নীতিমালার ভিত্তিতে রমযান ও ঈদের ফয়সালা দিতে পারবেন, যা ঐ দেশের সকলের জন্য (যদি তাদের নিকট সে সংবাদ পৌঁছে যায়) মান্য করা জরুরী। (আসানুল ফাতাওয়া ৪র্থ খণ্ড ৪৫৬ পৃষ্ঠা, রুইয়াদে হেলাল পৃ. ৬০/৬১, ইসলাম আওর জাদীদ দাওর কে মাসাইল ১২৬/১২৭ পৃষ্ঠা)

খ. আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেন যে, সরকারী চাঁদ দেখা কমিটিতেও তো আলেম আছেন। অপর দিকে বেসরকারী উলামা মাশাইখগণ তার বিপরীত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন- এখন আমরা কোন আলেমদের সিদ্ধান্তের উপর আমল করব। এর উত্তর হলো- যারা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিবেন তাদেরটা মান্য করা জরুরী, আর যারা বলবে আমাদের নিকট কোন প্রমাণ আসেনি, বা পাইনি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ যোগ্য নয়। (বুখারী শরীফ ১: ৩৬০, বাবু ইযা শাহিদা শাহিদুন, কাওয়ায়ে ফী উলুমিল হাদীস, পৃষ্ঠা ২৯০)
   

যেমন মক্কা বিজয়ের সময় হযরত মহানবী (সাঃ) কাবা শরীফের মধ্যে নামায পড়ে ছিলেন কিনা এ বিষয়ে সাহাবাদের (রাঃ) থেকে দু ধরনের বর্ণনা আছে। পড়ার এবং না পড়ার। কিন্তু রাসূলের (সাঃ) নামায পড়ার পক্ষে যারা প্রমাণ দিয়েছেন সমস্ত উলামাগণ তাদের কথা গ্রহণ করেছেন। আর যারা নামায পড়েননি বলেছেন তাদের কথা কেউ গ্রহণ করেননি। বরং তাদের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে তাঁরা যেহেতু ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন না এবং তাঁরা নামায পড়তে দেখেননি, তাই তারা নিজেদের ইলম অনুযায়ী বলেছেন, যা দলীল প্রমাণের বিপরীত হওয়ায় গ্রহণ যোগ্য নয়। (ফাতহুলবারী,৫৯৭-৮ পৃষ্ঠা, ৩য় খণ্ড, হাদীস নং ১৬০১, উমদাতুলকারী,৩৭০ পৃষ্ঠা, ৩য় খণ্ড, হাদীস নং-৩৯৭)

(গ) অনেকে প্রশ্ন করেন জাম্মেগাফীর হতে হলে ৫০ জন লোক হতে হবে এবং তাদের সকলের একই এলাকা হতে হবে। এর উত্তর হলো যে নির্ভরযোগ্য মত অনুযায়ী কোন সংখ্যা নির্ধারিত নেই এবং এক এলাকা থেকে হতে হবে এরও কোন দলীল নেই বরং জাম্মেগাফীর এর মূল কথা হল যে, বিভিন্ন এলাকা হতে এ পরিমাণ লোক বর্ণনা দিতে হবে যে, চাঁদ দেখার ব্যাপারে সিদ্ধান্তদাতা পুরাপুরি আশ্বস্ত হয়ে যায়। (মুফতি শফী রহ. সংকলিত রুইয়াতে হেলাল, ৬৪ পৃষ্ঠা)

মজার ব্যাপার হল, এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ) থেকে আরেকটি বর্ণনা আছে যে, বর্তমান যমানায় জাম্মেগাফীর থেকে দুজন বিশ্বস্ত সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত দেয়া বেশী যুক্তিযুক্ত এবং এর দ্বারাও উদয়স্থল পরিষ্কার থাকার ক্ষেত্রে রোযা ও ঈদ প্রমাণিত হবে। এর কারণ বলা হয়েছে যে, চাঁদ তালাশ করার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে চরম অনীহা রয়েছে। অপর দিকে কেউ চাঁদ দেখার খবর দিলে তার উপর নানা রকম হয়রানী ও অত্যাচার করা হয়। যে কারণে যারা চাঁদ দেখে তারাও বলতে সাহস করে না। এমতাবস্থায় জাম্মেগাফীর তথা অনেক লোকের দেখার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে, অনেক লোক জোগাড় করতে করতে রোযা বা ঈদ দু তিন দিন পরে করতে হবে, যা শরীআতে কোন অবস্থায় কাম্য নয়। (দেখুন ফাতাওয়া শামী, ২য় খণ্ড, ৬৮ পৃষ্ঠা)

চাঁদ দেখা কমিটি কেমন হওয়া উচিত

(ক) বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদ দেখা কমিটিতে কিছু আলেম থাকলেও কোন বিজ্ঞ মুফতী (যিনি কোন নির্ভরযোগ্য ফাতাওয়া বিভাগ পরিচালনা করেন) আছেন বলে আমাদের জানা নেই। আর দু'একজন যারা আছেন, তাদের কথাও অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় না। সুতরাং এ ধরণের হেলাল কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ যোগ্য নয়। সরকারের যদি জটিলতা এড়ানোর সদিচ্ছা থাকে তাহলে এক বা একাধিক এ ধরনের মুফতীকে চাঁদ দেখা কমিটির শুধু সদস্যই নয় বরং তাকেই আমীরে ফয়সালা নিযুক্ত করতে হবে। (ফাতাওয়ায়ে মাহমূদিয়া, পৃষ্ঠা ১৪৮, খণ্ড ১৭)
   
(খ) শুধু ডিসিদের উপর ভিত্তি না রেখে প্রত্যেক জেলার বড় মাদরাসার দায়িত্বশীলকে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার খবর দেয়ার জন্য দায়িত্ব দিতে হবে।

(গ) চাঁদ দেখা কমিটি বর্তমানে যেভাবে চাঁদ দেখার প্রচার করেন তা শরী'আত সম্মত হয় না এবং শরী'আতের দৃষ্টিতে তা মান্য করাও দেশবাসীর জন্য জরুরী হয় না। সুতরাং কোন্ কোন্ এলাকা থেকে কে কে চাঁদ দেখেছেন কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে রোযা বা ঈদের ফয়সালা করেছেন তা উল্লেখ করে চাঁদ দেখার ঘোষণা দিতে হবে।

(ঘ) সর্বোপরি চাঁদ দেখা না গেলে সম্ভাব্য সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত দেয়া বন্ধ করতে হবে। বলতে হবে এখনো শরী'আত সম্মভাবে চাঁদ দেখার সংবাদ পাওয়া যায়নি। আপনারা অপেক্ষা করুন । কারণ সারা দেশ থেকে এত অল্প সময়ে শরী'আত সম্মত ভাবে খবর সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।

(৫) যারা চাঁদ দেখার সংবাদ দেয় তাদের খবর গুরুত্ব সহকারে শুনতে হবে। বিবেচনা করতে হবে ।

শাউয়াল মাসের করণীয় বর্জনীয়
আরবী বছর বা হিজরী বছর অনুযায়ী রমযান মাসের পরের মাস হলো শাউয়াল মাস। এই মাসকে “শাউয়ালুল মুকাররম” বলা হয়। এই মাসে আমলের সাথে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। নিম্নে এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হলোঃ

ঈদুল ফিতর পালন ও ঈদের রাত্রের ফযীলত

নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদতে নিমগ্ন থাকবে তার অন্তর সেই দিনও মৃত্যু বরণ করবে না যে দিন সকলের অন্তর মৃতপ্রায় হয়ে যাবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ্ হাদীস নং-১৭৮২)

ঈদ উদযাপন নিয়ে আমাদের মাঝে একটি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তা নিরশনে নিম্নে কিছু আলোচনা করা হলোঃ

সারা বিশ্বে একইদিনে রোযা ও ঈদ শরী'আত কী বলে?

সম্প্রতি কিছু লোক সারা বিশ্বে একইদিনে রোযা শুরু ও একই দিনে ঈদ উদযাপন নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি করছে। আমাদের দেশের কিছু এলাকায় সৌদি আরবকে মডেল বানিয়ে সৌদিআরবের সাথে মিলিয়ে রোযা ও ঈদ পালনও শুরু করেছে। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হলো, 'হানাফী মাযহাবেই সারা বিশ্বে এই দিনে রোযা ও ঈদ পালন করতে বলা হয়েছে”। অথচ কুরআন- সুন্নাহ্, ইজমা ও হানাফী মাযহাবের আলোকে এ কথা প্রমাণিত যে, সারা বিশ্বে একদিনে রোযা ও ঈদ শুরু করা শরীয়াতের চাহিদা নয়। বরং প্রত্যেক দূরবর্তী এলাকার লোকজন নিজের এলাকার চাঁদ দেখা অনুযায়ী রোযা ও ঈদ শুরু করাই শরীয়াতের হুকুম। নিম্নে এ ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ফিকহে হানাফীর উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো যাতে বিভ্রান্তির নিরসন হয় এবং সত্য প্রেমিরা পথ খুঁজে পায়।

এ ব্যাপারে আল কুরআনের ভাষ্যঃ

فَمَنۡ شَهِدَ مِنۡکُمُ الشَّهۡرَ فَلۡیَصُمۡهُ

“সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই রমযান মাস পাবে সে যেন এ সময় অবশ্যই রোযা রাখে।' (সূরা বাকারা: ১৮৫)
   
এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, যে অঞ্চলের লোকেরা যখন চাঁদ দেখবে তখন তারা রোযা শুরু করবে। এখানে সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু করতে বলা হয়নি ।

সূরা বাকারার ১৮৯ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ  یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡاَهِلَّۃِ  'লোকেরা আপনার কাছে নতুন মাসের চাঁদসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে...” এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর আবুল আলিয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে, সাহাবায়ে কেরাম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নতুন চাঁদের রহস্য কী? তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা রোযা শুরু করা ও রোযা শেষ করার সময় নির্ধারণী হিসেবে নতুন চাঁদ সৃষ্টি করেছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৪৮৮)

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো এই আয়াতে চাঁদ বুঝানোর জন্য ھلال শব্দের বহুবচন الاھلة শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ নতুন চাঁদসমূহ। এখানে বহুবচন ব্যবহার করাই হয়েছে এ কথা বুঝানোর জন্য যে, মাতলা বা উদয়স্থলের ভিন্নতার ভিত্তিতে রোযা ফরয হওয়ার বিধান জারী হবে। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন হেলাল তথা নতুন চাঁদের ভিত্তিতে ভিন্নভিন্ন উদয় স্থলের লোকদের উপর রোযা ফরয হবে। আর কুরআনের যেখানে শব্দের মধ্যে ব্যাপকতা থাকে তা শানে নুযূল তথা অবতীর্ণের উৎস মূলের মধ্যে সীমা থাকে না। (বিস্তারিত জানতে দেখুন মাবাহেস ফী উলূমিল কুরআন পৃ.৭৮- শায়েখ মান্না কাত্তা )


চাঁদ দেখে রোযা ও ঈদ পালনের ব্যাপারে সুন্নাহ

১. হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু কর, আবার চাঁদ দেখে ইফতার (ঈদুল ফিতর) করো, যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শাবান মাস ত্রিশদিন পূর্ণ করো।' (সহীহ বুখারী হা. নং১০৯০, মুসলিম হা. নং ২৫৬৭)

এই হাদীস দ্বারা শুধু এতটুকু বুঝে আসে যে, চাঁদ দেখে রোযা রাখতে হবে, আবার চাঁদ দেখেই রোযা ছাড়তে হবে। কাছের এলাকা বা শহর থেকে যদি চাঁদ দেখার সংবাদ আসে তা গ্রহণ করা যাবে কিনা? এ ব্যাপারে এই হাদীসে কোনো নির্দেশনা নেই। কিন্তু অপর এক হাদীল দ্বারা বুঝা যায় যদি নিকটবর্তী কোনো এলাকা থেকে চাঁদ দেখার সংবাদ আসে তাহলে নিজেরা চাঁদ না দেখলেও তা গ্রহণ করা হবে।

যেমন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, গ্রামে বসবাসকারী জনৈক ব্যক্তি নবীজী (সাঃ) -এর নিকট এসে বললেন, আমি গত রাতে রমযানের নতুন চাঁদ দেখেছি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সাক্ষ্যপ্রদান কর যে, আল্লাহ্ তা'আলা ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই। লোকটি বলল হ্যাঁ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সাক্ষ্য প্রদান কর যে, ' আমি আল্লাহর রাসূল। লোকটি উত্তর দিল হ্যাঁ। অতঃপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেলাল (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বললেন, হে বেলাল। তুমি লোকদেরকে জানিয়ে দাও তারা যেন আগামী দিন থেকে রোযা রাখা শুরু করে। (আবূ দাউদ হা.নং ৬৯১, নাসায়ী হা. নং ২১১২)

বর্ণিত হাদীসে আগত ব্যক্তি শহরের বাহির থেকে এসে চাঁদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা গ্রহণও করেছেন। এর দ্বারা এ কথা স্পষ্ট বুঝে আসে যে, নিজেরা চাঁদ না দেখলেও কাছের এলাকার বা শহরের কারো দ্বারা চাঁদ দেখা প্রামাণিত হলেও রোযা রাখা ফরয হয়ে যাবে। কিন্তু দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখার সংবাদ এলে বা সেখানের আমীর কর্তৃক চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালার খবর এলে তা গ্রহণ করা হবে কিনা? সে ব্যাপারে অপর একটি হাদীসে নির্দেশনা পাওয়া যায় ।
   
'কুরাইব (রহ) থেকে বর্ণিত, উম্মুল ফযল বিনতে হারেস তাকে সিরিয়ায় হযরত মুআবিয়া (রা) এর কাছে পাঠালেন (কুরাই বলেন) আমি সিরিয়ায় পৌঁছলাম এবং প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করলাম। আমি সিরিয়ায় থাকা অবস্থায় জুমআর রাতে রমযানের নতুন চাঁদ দেখেছি। এরপর রমযানের শেষভাগে আমি মদীনায় ফিরে এলাম। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস আমার নিকট কিছু প্রশ্ন করলেন এবং নতুন চাঁদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। এরপর তিনি বললেন, তোমরা কোন দিন নতুন চাঁদ দেখেছ। আমি বললাম জুমআর রাতে চাঁদ দেখেছি। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি কি নিজে দেখেছ। আমি বললাম হ্যাঁ, আর লোকেরাও দেখেছে এবং তারা রোযাও রেখেছে, মুআবিয়া (রাঃ)ও রোযা রেখেছেন। তখন ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, আমরা কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখেছি এবং সেই হিসাবেই আমরা শেষ পর্যন্ত রোযা থাকবো, অর্থাৎ চাঁদ না দেখা গেলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করব অথবা ২৯ তারিখে নিজেরাই চাঁদ দেখব। আমি বললাম, মুআবিয়া (রাঃ) এর চাঁদ দেখা ও রোযা রাখা কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি বললেন, না। কেননা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম হা. নং ১০৮৭, মুসনাদে আহমাদ হা.নং২৭৮৯, আবূ দাউদ হা. নং২৩৩২, তিরমিযী হা. নং ৬৯৩)

এই হাদীল থেকে পরিষ্কার বুঝে আসছে যে, যদি চাঁদ দেখার স্থান দূরবর্তী হয়, তাহলে সেখানের চাঁদ দেখা অন্যদের জন্য যথেষ্ট হবে না। কারণ কুরাইব বিন আবী মুসলিম (মৃত: ৯৮ছি) একজন তাবেঈ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এবং ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর অতি ঘনিষ্ট জন। আর ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর নিকট রমযান সম্পর্কে এক ব্যক্তির সংবাদই যথেষ্ট। তিনি নিজেই এ সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। আর কুরাইব শুধু নিজের চাঁদ দেখার সংবাদ দেননি বরং তখনকার আমীরুল মুমিনীন হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এর কাছে চাঁদ দেখা প্রামাণিত ও কার্যকর হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং তার সংবাদের ভিত্তিতে ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর কাছে চাঁদ দেখার এই সংবাদ গ্রহণ করতে কোনো বাধা ছিল না। এতদসত্ত্বেও ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর নিকট সিরিয়া দূরবর্তী এলাকা গণ্য হওয়ায় তিনি সে সংবাদ গ্রহণ করলেন না বরং বলে দিলেনঃ ھكذاامرنارسولﷲصلىﷲعلیھوسلم ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওল্গা সাল্লাম আমাদেরকে এমনই আদেশ করেছেন’

এ কথা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর মাযহাব এটাই ছিল যে, দূরবর্তী এলাকায় চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোযা ফরয হবে না। হতে পারে ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী ‘চাঁদ দেখে রোযা রাখো ও চাঁদ দেখে রোযা ছাড়ো' এর উপর তার মাযহাবের ভিত্তি রেখেছেন। অথবা সরাসরি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন আদেশে আদিষ্ট হয়ে এ কথা বলেছেন।

চাঁদ দেখে রোযা ও ঈদ পালনে উম্মতের ইজমা

দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার ব্যাপারে ইজমা তথা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইমাম আবূ বকর আল-জাসসাস আহকামুল কুরআনে লিখেন:
"আর এ ব্যাপারে সকলেই ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, দূরবর্তী অঞ্চলের প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা ধর্তব্য হবে অন্যের দেখার অপেক্ষা করা ছাড়াই।'(আকামুল কুরআন: ১/৩০৫)

ইমাম জাসসাস (রহ) এখানে ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন যে, দূরবর্তী অঞ্চলের জন্য তাদের নিজেদের চাঁদ দেখা ধৰ্ত্তব্য। যদিও এর ব্যাখ্যায় তিনি ভিন্ন ক্ষেত্রের কথা বলেছেন। কিন্তু মূল বিষয়টির ব্যাপারে ইজমার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ) মুআত্তা মালেকের ভাষ্য গ্রন্থ 'আল ইসতিযকার - এ লিখেছেন: ‘এ ব্যাপারে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, দূরবর্তী শহর যেমন খোরাসান থেকে স্পেন, এমন ক্ষেত্রে এক স্থানের চাঁদ দেখা অন্য স্থানের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না। তদ্রূপ প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য তাদের চাঁদ দেখা ধৰ্ত্তব্য, তবে বড় শহর হলে বা চাঁদের উদয়স্থল কাছাকাছি হলে এমন শহরের কথা ভিন্ন। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী এলাকার চাঁদ দেখা ধর্তব্য হবে। (ইসতিযকার:৩/২৩)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) ইমাম ইবনে আব্দুল বারের পূর্বোক্ত ইজমার কথা উল্লেখ করে দ্বিমত পোষণ করেননি। তিনি লিখেছেন: ‘ইবনে আব্দুল বার উল্লেখ করেছেন, এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য গ্রহণযোগ্য হবে কিনা। এই মতানৈক্য ঐ সব এলাকার ক্ষেত্রে যেসব এলাকার চাঁদের উদয়স্থল এক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যেসব এলাকা দূরবর্তী যেমন খোরাসান ও স্পেন এসব এলাকার ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই যে, এমন দূরবর্তী এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য ধর্তব্য নয়।” এ কথা উল্লেখ করার কিছু পরেই তিনি এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মাযহাব বর্ণনা করে লিখেছেন: ‘দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা ধর্তব্য না হওয়ার যে ইজমা ইবনে আব্দুল বার বর্ণনা করেছেন তা ইমাম আহমাদ (রহ) এর দলীলের খেলাফ না। (মাজমূআতুল ফাতাওয়া : ২৫/১০৩, ১৩/৬২)

হাফেজ ইবনে হাজার (রহ) ফাতহুল বারীতে লিখেছেন: 'ইবনে আব্দুল বার (রহ) দূরবর্তী এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না মর্মে ইজমা নকল করেছেন। তিনি বলেছেন, উলামায়ে উন্মত এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, দূরবর্তী এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য যথেষ্ট নয়।” (ফাতহুল বারী: ৪/১৫৫)

ইমাম ইবনে রুশদ বেদায়াতুল মুজতাহিদ কিতাবে লিখেছেন: 'এ ব্যাপারে এক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, দূর দেশের ক্ষেত্রে এক স্থানের চাঁদ দেখা অন্য স্থানের জন্য ধর্তব্য হবে না। যেমন: স্পেন ও হেজাজ।” (বেদায়াতুল মুজতাহিদ নেহায়াতুল মুকতাসিদ : ২/৫0)

আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী মাআরেফুস সুনানে লিখেছেনঃ "শাইখ আনওয়ার শাহ্ কাশ্মীরী (রহ) বলেন, ইমাম যায়লায়ীর কথার উপর আমার সিদ্ধান্ত স্থির ছিল। পরে কাওয়ায়েদে ইবনে রুশদ কিতাবে এ ব্যাপারে ইজমার বর্ণনা পেয়েছি যে, দূরবর্তী স্থান হলে উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হবে। আর কতটুকু দূরকে দূর বলে ধরা হবে তা অবস্থার শিকার ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিবে, তার নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারিত নেই।' (মাআরিফুস সুনান: ৫/৩৪০)

তবে এ ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য মত হলো, যে দুই দেশে বা এলাকার চাঁদ দেখা তারিখ সব সময় একই হয় সে দুই দেশকে নিকটবর্তী এলাকা পণ্য করা হবে। যে সব এলাকার মধ্যে চাঁদ দেখার ব্যাপারে সাধারণত একদিন বা ততোধিক দিনের পার্থক্য থাকে সেসব এলাকাকে দূরবর্তী শহর বা এলাকা গণ্য করা হবে । (ফাতহুল মুলহিম: ৩/১১৩, কিতাবুল মাজমূ : ৬/১৮৩)
   
আরব বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলেম ড. ওয়াহবা আয্যুহায়লী 'আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লতুহু' তেও ইবনে রুশদের অনুরূপ ইজমা নকল করেছেন। (আল ফিকহুল ইসলামী : ৩/১৬৫৮)

পূর্বের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হলো যে, দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য নয়, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ইজমার কথা যখন বর্ণনা হয়েছে এবং ইবনে তাইমিয়া, ইবনে হাজার ও ইমাম কাশ্মীরীর মত বিদগ্ধ উলামায়ে কেরামও ঐ ইজমাকে অস্বীকার করেননি বরং ইবনে তাইমিয়া তো বিভিন্ন স্থানে বারবার এ কথা বলেছেন যে, এটা ইবনে আব্দুল বারের বর্ণনা করা ইজমার খেলাফ না । সুতরাং বর্ণিত ইজমাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া প্রথম যুগের ইমামদের থেকে বর্ণিত মতামত হয়তো একাধিক রয়েছে অথবা মুজমাল (ব্যাখ্যা সাপেক্ষ)। সুতরাং সে মতের কারণে ইজমার উপর কোনো প্রভাব পড়বে না। (মাআরেফুস সুনান : ৫/৩৪৩ )

যদিও মাসআলাটি মূলত মুজতাহিদ ফীহ হওয়ায় পরবর্তী উলামায়ে কেরাম মতানৈক্য ও ভিন্নভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।

হানাফী মাযহাব: উদয়লের বিভিন্নতার সূরতে চাঁদ প্রমাণিত হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে আসহাবে মাযহাব অর্থাৎ ইমাম আবূ হানিফা, আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রহ) থেকে কোনো মতামত আমরা পাইনি। আর পরবর্তীদের মধ্যে দুই ধরনের মতামত পাওয়া যায়।

ক. ইসতিলাফে মাতালে গ্রহণযোগ্য৷ অর্থাৎ চন্দ্রের উদয়লের পার্থক্য ধর্তব্য হবে। সুতরাং এক দূরবর্তী দেশের চাঁদ দেখা অন্য দূরবর্তী দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না। হ্যাঁ, নিকটবর্তী দেশ হলে এক দেশের চাঁদ দেখা অন্য দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে।
   
খ. ইসখতিলাফে মাতালে গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ চন্দ্রের উদয়স্থলের পার্থক্য ধর্তব্য নয়। সুতরাং এক অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলে অন্য অঞ্চলের জন্য তা গ্রহণযোগ্য হবে। এ মতটির প্রয়োগস্থল নিকটবর্তী এলাকা না দূরবর্তী এলাকা তা অস্পষ্ট এবং ব্যাখ্যাহীন।




****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url