মা’আরেফুল কোরআন - ৫৩ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৫৩ || ধৈর্য ও নামাযের মধ্যেই যাবতীয় সংকটের প্রতিকার রয়েছে






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৫৩


 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿۱۵۳

সূরা আল-বাকারাহ ১৫৩ নং আয়াতের অর্থ

(১৫৩) হে মু'মিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।

   

সূরা আল-বাকারাহ ১৫৩ নং আয়াতের সাথে পূর্বাপর যুগসূত্র

কেবলা পরিবর্তনের ব্যাপারে বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনা চলছিল। ফলে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। প্রথমত, নানা রকম জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করে ইসলামের সত্যতার উপর আঘাত এবং মুসলমানদের মনে নানা প্রকার সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছিল। পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে সেসব কূট-প্রশ্নের জবাব দিয়ে সেগুলোকে প্রতিহত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ওদের তরফ থেকে উত্থাপিত বিভিন্ন যুক্তিপূর্ণ জওয়াব দেওয়ার পরও যেহেতু আরো নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপন এবং তর্কের পর তর্কের অবতারণা করে মুসলমানদের মন-মস্তিষ্ককে বিষাক্ত করে তোলার ষড়যন্ত্র চলছিল, সেহেতু এ আয়াতে ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে আত্মিক শক্তি অর্জন করে সে সব আঘাতের মোকাবেলা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

সূরা আল-বাকারাহ ১৫৩ নং আয়াতের তাফসীর

তফসীরের সার-সংক্ষেপ
হে ঈমানদারগণ! (মানসিক আঘাত ও দুশ্চিন্তার বোঝা হালকা করার লক্ষ্যে) ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা (সর্ব বিষয়েই) ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন, বিশেষত নামাযীগণের সাথে তো তিনি অবশ্যই থাকেন। কেননা নামায হলো সর্বোত্তম ইবাদত। ধৈর্যধারণের ফলেই যদি আল্লাহ্ তা’আলা সঙ্গী হন, তবে নামাযের মধ্যে তো এ সুসংবাদ আরো প্রবলতর হওয়াই স্বাভাবিক।


 ধৈর্য ও নামায যাবতীয় সংকটের প্রতিকার

وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ “ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর”—এ আর্য়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, যাবতীয় প্রয়োজন ও সমস্ত সংকটের নিশ্চিত প্রতিকার দু’টি বিষয়ের মধ্যে নিহিত। একটি ’সবর’ বা ধৈর্য এবং অন্যটি ’নামায’। বর্ণনা-রীতির মধ্যে وَاسْتَعِينُوا শব্দটিকে বিশেষ কোন বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট না করে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার ফলে এখানে যে মর্মার্থ দাঁড়ায়, তার মর্ম হচ্ছে এই যে, মানব জাতির যে কোন সংকট বা সমস্যার নিশ্চিত প্রতিকার হচ্ছে ধৈর্য ও নামায। যে কোন প্রয়োজনেই এ দু’টি বিষয়ের দ্বারা মানুষ সাহায্য লাভ করতে পারে। তফসীরে মাযহারীতে শব্দ দু’টির ব্যাপক অর্থে ব্যবহারের তাৎপর্য এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গত স্বতন্ত্রভাবে দু’টি বিষয়েরই তাৎপর্য অনুধাবন করা যেতে পারে।

সবর-এর তাৎপর্য

’সবর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সংযম অবলম্বন ও নফস-এর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করা।

কোরআন ও হাদীসের পরিভাষায় ’সবর’-এর তিনটি শাখা রয়েছেঃ (ক) নফসকে হারাম ও না-জায়েয বিষয়াদি থেকে বিরত রাখা, (দুই) ইবাদত ও আনুগত্যে বাধ্য করা এবং (তিন) যে কোন বিপদ ও সংকটে ধৈর্যধারণ করা অর্থাৎ যে সব বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হয় সেগুলোকে আল্লাহর বিধান বলে মেনে নেওয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা। অবশ্য কষ্টে পড়ে যদি মুখ থেকে কোন কাতর শব্দ উচ্চারিত হয়ে যায় কিংবা অন্যের কাছে তা প্রকাশ করা হয়, তবে তা ’সবর’-এর পরিপন্থী হবে না--(ইবনে কাসীর, সায়ীদ ইবনে জুবায়ের থেকে)

’সবর’-এর উপরিউক্ত তিনটি শাখাই প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য পালনীয় তিনটি কর্তব্য। সাধারণ মানুষের ধারণায় সাধারণত তৃতীয় শাখাকেই সবর হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রথম দু’টি শাখা যে এক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে মোটেও লক্ষ্য করা হয় না। এমনকি এ দু’টি বিষয়ও যে ’সবর’-এর অন্তর্ভুক্ত এ ধারণাও যেন অনেকের নেই।

কোরআন-হাদীসের পরিভাষায় ধৈর্য ধারণকারী বা ’সবর’ সে সমস্ত লোককেই বলা হয়, যারা উপরিউক্ত তিন প্রকারেই ‘সবর’ অবলম্বন করে থাকেন। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, হাশরের ময়দানে ঘোষণা করা হবে, “ধৈর্য ধারণকারীরা কোথায় ?” এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেসব লোক উঠে দাঁড়াবে, যারা তিন প্রকারেই সবর করে জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। এসব লোককে প্রথমেই বিনা হিসাবে বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে। ইবনে কাসীর এ বর্ণনা উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন যে, কোরআনের অন্যত্রঃ

إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ

অর্থাৎ—’সবরকারী বান্দাগণকে তাদের পুরস্কার বিনা হিসাবে প্রদান করা হবে।’ এ আয়াতে সেদিকেই ইশারা করা হয়েছে।

সমস্যা ও সংকট দূর করার উত্তম পন্থা নামায

মানুষের যাবতীয় সমস্যা ও সংকট দূর করা এবং যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে কোরআন-উল্লিখিত দ্বিতীয় পন্থাটি হচ্ছে নামায।

‘সবর’-এর তফসীর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সর্বপ্রকার ইবাদতই সবরের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এরপরও নামাযকে পৃথকভাবে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে যে, নামায এমনই একটি ইবাদত, যাতে ’সবর’ তথা ধৈর্যের পরিপূর্ণ নমুনা বিদ্যমান। কেননা নামাযের মধ্যে একাধারে যেমন নফ্স তথা রিপুকে আনুগত্যে বাধ্য রাখা হয়, তেমনি যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ, নিষিদ্ধ চিন্তা, এমনকি অনেক হালাল ও মোবাহ বিষয় থেকেও সরিয়ে রাখা হয়। সেমতে নিজের ’নফস’-এর উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে সর্বপ্রকার গোনাহ ও অশোভন আচার-আচরণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও নিজেকে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমে ’সবর’-এর যে অনুশীলন করতে হয়, নামাযের মধ্যেই তার একটা পরিপূর্ণ নমুনা ফুটে উঠে।

যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করা এবং সর্বপ্রকার বিপদাপদ থেকে মুক্তি লাভ করার ব্যাপারে নামাযের একটা বিশেষ ’তাছীর’ বা প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ বিশেষ রোগে কোন কোন ওষধী গুল্ম-লতা ও ডাল-শিকড় গলায় ধারণ করায় বা মুখে রাখায় যেমন বিশেষ ফল লক্ষ্য করা যায়, লোহার প্রতি চুম্বকের বিশেষ আকর্ষণ যেমন স্বাভাবিক, কিন্তু কেন এরূপ হয়, তা যেমন সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বলা যায় না, তেমনি বিপদ-মুক্তি এবং যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে নামাযের তাছীরও ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এটা পরীক্ষিত সত্য যে, যথাযথ আন্তরিকতা ও মনোযোগ সহকারে নামায আদায় করলে যেমন বিপদমুক্তি অবধারিত, তেমনি যে কোন প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারেও এতে সুনিশ্চিত ফল লাভ হয় ।

হুযূর (সা)-এর পবিত্র অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন, তখনই তিনি নামায আরম্ভ করতেন। আর আল্লাহ্ তা’আলা সে নামাযের বরকতেই তাঁর যাবতীয় বিপদ দূর করে দিতেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

إذا حزبه أمر فَزِعَ إلى الصلاة

অর্থাৎ—মহানবী (সা)-কে যখনই কোন বিষয় চিন্তিত করে তুলত, তখনই তিনি নামায পড়তে শুরু করতেন।

নামায ও সবরের মধ্যেই আল্লাহর সান্নিধ্য

নামায ও ‘সবর’-এর মাধ্যমে যাবতীয় সংকটের প্রতিকার হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, এ দু’ পন্থায়ই আল্লাহ তা’আলার প্রকৃত সান্নিধ্য লাভ হয়।

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

বাক্যের দ্বারা এদিকে ইশারা করা হয়েছে যে, নামাযী এবং সবরকারিগণের সাথে আল্লাহর সান্নিধ্য তথা তাঁর শক্তির সমাবেশ ঘটে। যেখানে বা যে অবস্থায় বান্দার সাথে আল্লাহর শক্তির সমাবেশ ঘটে, সেখানে দুনিয়ার কোন শক্তি কিংবা কোন সংকটই যে টিকতে পারে না, তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন করে না। বান্দা যখন আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান হয়, তখন তার গতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়। তার অগ্রগমন ব্যাহত করার মত শক্তি কারও থাকে না। বলা বাহুল্য, মকসুদ হাসিল করা এবং সংকট উত্তরণের নিশ্চিত উপায় একমাত্র আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান হওয়াই হতে পারে।





********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url