রমজানের বিশেষ প্রবন্ধঃ কুরআনমুখী জীবন গড়াই হচ্ছে রমজানের মূল শিক্ষা






রমজানের শিক্ষা কুরআনমুখী জীবন গড়া


 اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰهُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ ۚ﴿ۖ۱  وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ؕ﴿۲  لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَهۡرٍ ؕ﴿ؔ۳  لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَهۡرٍ ؕ﴿ؔ۳  سَلٰمٌ ۟ۛ هِیَ حَتّٰی مَطۡلَعِ الۡفَجۡرِ ﴿۵

নিশ্চয়ই আমি এটা (অর্থাৎ কুরআন) শবে কদরে নাজিল করেছি। আপনি কি জানেন শবে কদর কী? শবে কদর এক হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফিরেশতাগণ ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। সে রাত (আদ্যোপান্ত) শান্তি—ফজরের উদয় পর্যন্ত। [সুরা ক্বাদর। ১-৫)

   

আল্লাহ তাআলা আপন ফজল ও করমে, দয়া ও অনুগ্রহে আমাদের জন্য এই সময়ে, এই রাতে অনেক অনেক সাআদাত ও সৌভাগ্য একত্র করেছেন। এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যতই শোকর আদায় করা হোক, কম হবে। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদিসে ইরশাদ করেছেন, কখনো কখনো বান্দাদের ওপর আল্লাহ পাকের রহমতের বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে।

এক রাতের বরকত ও কল্যাণের কার্যকারণ

একে তো বরকতপূর্ণ রমজান মাস; যার প্রতিটি মুহূর্তই অতি মূল্যবান, প্রতিটি ক্ষণই আল্লাহর রহমতে সিক্ত। অধিকন্তু রমজানের শেষ দশক, যা পুরো রমজানের নির্যাস। শেষ দশকের মধ্যেও রাতের সময়, যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ রহমতের সময়। রাতের মধ্যেও বেজোড় রাত, যাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বেজোড় রাতের মধ্যেও হচ্ছে সাতাশতম রাত। যদিও শেষ দশকের প্রত্যেক বেজোড় রাতে শবে কদরের সম্ভাবনা থাকে; আর অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতও হচ্ছে শবে কদরের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই; বরং একেক বছর একেক তারিখে হয়; কোনো বছর একুশ তারিখে, কোনো বছর তেইশ তারিখে, কোনো বছর পঁচিশে; কিন্তু সকল বেজোড় রাতের মধ্যে সাতাশতম রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। এর কারণ এই যে, অনেক সাহাবায়ে কেরাম নির্দিষ্ট করে সাতাশ তারিখের রাতকেই শবে কদর বলে ব্যক্ত করেছেন। বরং বিশিষ্ট সাহাবি হজরত উবাই বিন কাব রাযি. তো কসম করে সাতাশ তারিখকেই শবে কদর বলেছেন। আলহামদুলিল্লাহ! এতগুলো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক রজনীতে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। অধিকন্তু এ রাতেই আল্লাহ পাক আমাদেরকে তারাবির ন্যায় অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমলের তাওফিক দান করেছেন। তারাবির ফজিলত সম্পর্কে নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

যে ব্যক্তি ঈমানের কারণে এবং শুধু আল্লাহর কাছে আজর লাভের প্রত্যাশায় রমজানের রজনীতে ইবাদত করবে (তারাবি ইত্যাদি পড়বে), তার পূর্বে কৃত সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে । (৩৪)

উপরন্তু তারাবিতে কুরআন শরিফ খতম করার মুহূর্ত! আল্লাহ পাক তারাবিতে কুরআন পড়ার তাওফিক দিয়েছেন এবং খতম পূর্ণ করার তাওফিকও দিয়েছেন। আর সাহাবাযুগ হতে পরম্পরায় চলে আসা অভিজ্ঞতা হলো- কুরআন খতমের মজলিসে যে দোয়া করা হয়, আল্লাহ তা কবুল করে নেন ।

রহমত ও বরকতের এতগুলো কার্যকারণ আল্লাহ তাআলা এই সময়ে একত্র করেছেন। এ কারণেই আমি শুরুতে এ কথা আরজ করেছি যে, মনে হচ্ছে—আজকের রাতও নবীজির মোবারক জবানে বর্ণিত রহমতের বায়ুবিশিষ্ট রজনীসমূহের অন্তর্ভুক্ত।

বরকতের রজনীগুলো কাটাতে হবে ভেবে-চিন্তে

সুতরাং এ রাতের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান। প্রতিটি মুহূর্ত ভেবে-চিন্তে সঠিক কাজে ব্যয় করা উচিত। আমার মুহতারাম আব্বাজান মুফতিয়ে আজম হজরত মুফতি শফি সাহেব রহ. বলতেন, ‘এসব বরকতময় রজনী দীর্ঘ বয়ান-আলোচনা বা জলসা করার রাত নয়। এসব রাত মূলত আপন পরওয়ারদিগারের সঙ্গে বান্দার নির্জনে সম্পর্ক তৈরি করার রাত। বান্দা আল্লাহর সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্ক কায়েম করবে যে, শুধু সে থাকবে আর আল্লাহ থাকবেন। আল্লাহ পাকের সামনে অনুনয়-বিনয় করে দোয়া করবে, ইবাদত করবে, নামাজ পড়বে, কুরআন তিলাওয়াত করবে, জিকির- তাসবিহ করবে।

   

সুতরাং আমার এখন আলোচনা দীর্ঘ করার কোনো ইচ্ছা নেই। বরং আজকের রাতের বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে সংক্ষিপ্ত কিছু নিবেদন পেশ করেই আলোচনা শেষ করব, ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ তাআলা আপন দয়া ও অনুগ্রহে আমাদের সবাইকে এসব কথার ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আলোচনা শেষে আমরা সকলে মিলে দোয়া করব, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর তাআলার অসীম রহমতের প্রতি আশা এই যে, তিনি আমাদের অবস্থার প্রতি দয়া করে আমাদের দোয়া কবুল করে নেবেন।

বিপদ-আপদ আমাদেরই কর্মফল

প্রথম নিবেদন এই যে, মাহে রমজানের যে দৌলত আল্লাহ আমাদের দান করলেন, তা থেকে আমাদের আগামী জিন্দেগির জন্য কিছু শিক্ষা অর্জন করা প্রয়োজন।

দেখুন, পৃথিবীর প্রতিটি ভূখণ্ডে মুসলমানরা আজ নির্যাতিত-নিপীড়িত! দুর্যোগ-দুর্বিপাক যেন মুসলিম ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ! অগণিত মুসলিম ভাই-বোন এই মুহূর্তে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। মাথা গোঁজার এতটুকু ঠাঁইও তাদের নেই। কত মুসলমান ভাইয়ের দু-বেলা মুখে দেওয়ার খাবারের ব্যবস্থাও নেই! আল্লাহর কুদরতের কারিশমা দেখুন, কত মানুষ বন্যার পানিতে বন্দি, চারিদিকে অথই পানি; অথচ পান করার সুপেয় পানির জন্য হাহাকার! বিপদ ও কষ্ট পানি বৃদ্ধির কারণে, অথচ পিপাসা দূর করার পানি নেই!

এই যে নানামুখী বিপদে আমরা আক্রান্ত- এর কারণ আমরা যা কিছুই বলি না কেন, কুরআনের দৃষ্টিতে এর কার্যকারণ হচ্ছে-

ظَهَرَ الۡفَسَادُ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ بِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِی النَّاسِ

মানুষ নিজ হাতে যা উপার্জন করে, তার ফলে জলে-স্থলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। [সুরা রূম: ৪১]

 وَ مَاۤ اَصَابَکُمۡ مِّنۡ مُّصِیۡبَۃٍ فَبِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِیۡکُمۡ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ کَثِیۡرٍ ﴿ؕ۳۰

যেসব বিপদ ও দুর্বিপাকের মুখোমুখি তোমরা হও, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মের কারণে। আর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের অনেক অপরাধ তো ক্ষমাই করে দেন।
[সুরা শূরা: ৩০]

কুরআনের এই ঘোষণা শতভাগ সত্য; এতে মিথ্যার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং পুরো মুসলিম উম্মাহর পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আমরা নিজেদের আমলি হালতের পর্যালোচনা করি এবং রমজানের এই মোবারক মুহূর্তে আল্লাহ-অভিমুখী হওয়ার প্রতিজ্ঞা করি। পূর্বের তুলনায় রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার চেষ্টা করি।

কুরআন মুসলমানের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ

আজ আল্লাহ পাক আমাদের তারাবিতে কুরআন খতমের তাওফিক দান করলেন। কিন্তু দেখুন, সুরা নাস তিলাওয়াত করে খতম শেষ করার পর আজকের তারাবিতেই পুনরায় সুরা বাকারা শুরু করে প্রথম তিন আয়াত তিলাওয়াত করা হয়েছে। এটি একটি মুতাওয়ারিস ও যুগ পরম্পরায় চলে আসা আমল। এক হাদিসে কুরআন তিলাওয়াতকারীকে এই আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। একবার জনৈক সাহাবি নবীজিকে প্রশ্ন করলেন, 'আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ পাকের নিকট সর্বোত্তম আমল কোনটি?' নবীজি উত্তর দিলেন-

الحالُ الْمُرْتَجل

প্রত্যাবর্তন করা ও পুনরায় রওনা করা।

সাহাবি এবার জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যাবর্তন করা ও পুনরায় রওনা করার অর্থ কী? নবীজি উত্তর দিলেন-

الَّذِي يَضْرِبُ مِنْ أَوَّلِ الْقُرْآنِ إِلَى آخِرِهِ كُلَّمَا حَلَّ ارْتَحَلَ

যে ব্যক্তি কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করে। যখনই শেষ করে, পুনরায় শুরু করে। (৩৫)

অর্থাৎ এমনভাবে কুরআন তিলাওয়াত করো যেমন কোনো ব্যক্তি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন ঘোড়া থেকে অবতরণ করল; এরপর সঙ্গে সঙ্গেই অন্য সফরের জন্য প্রস্তুত হয়ে রওনা হয়ে গেল।

কুরআন শরিফ খতম করে রেখে দেওয়ার বস্তু নয়। কুরআন তো সেই মহাগ্রন্থ, যার পেছনে জিন্দেগি শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু তিলাওয়াত শেষ হবে না।

সুতরাং আজকের এই মজলিস থেকে আমরা এই শিক্ষা অর্জন করব যে, আমাদের কুরআন তিলাওয়াত দ্বিতীয়বার শুরু হয়ে গেছে। এখন তা জারি রাখতে হবে। প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি পবিত্র কুরআনের এই হক রয়েছে যে, সে প্রতিদিন ভোরে কুরআনের কিছু অংশ তিলাওয়াত না করে অন্য কোনো কাজ শুরু করবে না। একসময় তো মুসলিম উম্মাহর অবস্থা এমন ছিল যে, কোনো মুসলিম বসতি অতিক্রম করলে প্রতিটি ঘর হতে কুরআন তিলাওয়াতের ধ্বনি ভেসে আসত। আফসোস! আজ তেমন পরিবেশ কোথাও দৃষ্টিগোচর হয় না। আল্লাহর ওয়াস্তে সেই পরিবেশ জিন্দা করতে চেষ্টা করুন ।

মুসলিম উম্মাহর দুর্গতির কারণ

শাইখুল হিন্দের দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর দুর্গতির কারণ-
আজ মুসলিম উম্মাহর এই যে দুর্গতি ও অবনতি, দুর্যোগ ও দুর্বিপাক এর বুনিয়াদি ও মৌলিক কারণ কী? আব্বাজান রহ.-এর মুখে শুনেছি, হজরত শাইখুল হিন্দ রহ.-এর মতে এর মৌলিক কারণ দুটি। এক. মুসলমানদের কুরআন হতে দূরে সরে যাওয়া। দুই. নিজেদের পারস্পরিক বিবাদ- বিসংবাদ, বিভেদ ও বিভক্তি ।

এ দুটি মুসলমানদের পতন ও অধঃপতনের মূল কার্যকারণ। শাইখুল হিন্দ রহ. জীবনসায়াহ্নে যখন বন্দি ছিলেন মাল্টার জিন্দানখানায়, তখন নির্জনে দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।

আশি বছরের বয়োবৃদ্ধ এক মনীষী তার অভিজ্ঞতার নির্যাস আমাদের সামনে পেশ করেছেন যে, মুসলমানদের দুরবস্থার মৌলিক কারণ দুটি। মুসলমানদের কুরআন ছেড়ে দেওয়া এবং পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদ, বিভেদ ও বিভক্তি, একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, জাতিগত গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ। এসবের কারণেই আমাদের ওপর বিভিন্ন দুর্যোগ আপতিত হয়েছে।

সুতরাং আপনাদের উদ্দেশে প্রথম নিবেদন এই যে, আসুন, আজকের এই মজলিস থেকেই সকলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, পবিত্র কুরআনকে আমরা আমাদের দৈনন্দিন সূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নেব।

মুসলমানের প্রতি আল-কুরআনের তিনটি দাবি

প্রতিটি মুসলমানের প্রতি কুরআন মাজিদের তিনটি হক ও দাবি রয়েছে। 
এক. কুরআন তিলাওয়াত। তিলাওয়াত একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, স্বতন্ত্র নেকি ও সাওয়াবের মাধ্যম এবং স্বতন্ত্র বরকতের উসিলা। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য, প্রতিদিন সকালে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে এরপর দৈনন্দিন কাজ শুরু করা। প্রতিদিন সামান্য হলেও তিলাওয়াত করা—এক পারা, আধা পারা, সোয়া পারা যতটুকু তাওফিক হয় তিলাওয়াতের মামুল ও নিয়ম বানিয়ে নিন।

খ. কুরআনুল কারিমের দ্বিতীয় হক হচ্ছে কুরআন বোঝার চেষ্টা করা। আলহামদুলিল্লাহ, নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে কুরআনের বিভিন্ন তরজমা ও তাফসির গ্রন্থ ইতিমধ্যে ছেপে প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভব হলে কোনো নির্ভরযোগ্য আলিমের কাছে পড়ুন। সম্ভব না হলে নির্ভরযোগ্য কোনো তাফসিরগ্রন্থ ঘরে রেখে প্রতিদিন কিছু কিছু অধ্যয়ন করুন। আল্লাহ শোকর, আমার মুহতারাম আব্বাজানের হাতে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের অত্যন্ত সহজবোধ্য তাফসির 'তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন' সংকলন করিয়েছেন। বেশ দীর্ঘ কলেবরের তাফসিরগ্রন্থ। অন্যান্য নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কেরামেরও বিভিন্ন কিতাব প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিদিন এসব তাফসিরগ্রন্থ হতে কিছু কিছু অধ্যয়ন করুন।

এমন যেন না হয় যে, একটি কুরআন তরজমা কিনে বইয়ের তাকে রেখে দিলাম কিংবা মাঝে মধ্যে বিশেষ কোনো বিষয় জানার জন্য তা খুলে দেখলাম। বরং আমরা প্রতিদিন কিছু অংশ অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তুলব, ইনশাআল্লাহ ।

গ. কুরআনুল কারিমের তৃতীয় হক হলো কুরআনের বিধান অনুযায়ী আমল করা। নিজে আমল সংশোধনের জন্য চেষ্টা করা, আল্লাহর কাছে তাওফিকও প্রার্থনা করা। এই হলো মুসলমানের প্রতি কুরআনের তিনটি হক।

প্রতিটি বিপদ একটি সতর্কবাণী

প্রতিটি বিপদ এক একটি গায়বি সতর্কবাণী
ভাই, প্রতিটি দুর্যোগ ও বিপদ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে গায়বি সতর্কবাণী। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

 وَ هُمۡ یَصۡطَرِخُوۡنَ فِیۡهَا ۚ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا نَعۡمَلۡ صَالِحًا غَیۡرَ الَّذِیۡ کُنَّا نَعۡمَلُ ؕ اَوَ لَمۡ نُعَمِّرۡکُمۡ مَّا یَتَذَکَّرُ فِیۡهِ مَنۡ تَذَکَّرَ وَ جَآءَکُمُ النَّذِیۡرُ ؕ فَذُوۡقُوۡا فَمَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ نَّصِیۡرٍ ﴿۳۷

তারা তাতে (কেয়ামতের দিন) আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে মুক্তি দান করুন, আমরা পূর্বে যে কাজ করতাম তা ছেড়ে ভালো কাজ করব। (উত্তরে তাদেরকে বলা হবে) আমি কী তোমাদেরকে এমন দীর্ঘ আয়ু দান করিনি যে, তখন কেউ সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারতে? এবং তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল। সুতরাং এখন মজা ভোগ করো! কেননা, জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। [সুরা ফাতির: ৩৭] 

নবীগণ আগমন করেছিলেন, নবীদের ওয়ারিসগণ এসেছিলেন। বুজুর্গানে দ্বীন ও দ্বীনের প্রচারকগণ তোমাদের কাছে এসে তোমাদের বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা সতর্ক হওনি। গাফলতের মাঝেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছ। এখন সতর্ক হওয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন ভোগ করো জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি ।

এভাবে আল্লাহ তাআলা পূর্ব থেকেই আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। সুতরাং আমরা সবক গ্রহণ করি এবং কুরআনকে আপন করে নিই । 

রমজানের আলোকেই গড়ে তুলি আগামীর জীবন

দ্বিতীয় নিবেদন এই যে, আসুন প্রতিজ্ঞা করি আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধি-বিধানের আলোকে গড়ে তুলব। আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহে রমজান মাসে প্রত্যেকেরই কিছু ইবাদত করার তাওফিক হয়, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক হয়। এখন আরেকটু অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ মাফ করুন, এমন যেন না হয় যে, রমজানও শেষ হলো, ঈমানও বিদায় নিল। এমন যেন না হয় যে, রমজানও শেষ হলো, নেক আমলের জজবা ও স্পৃহাও বিদায় নিল। রমজানের পরও যেন নেক আমলের এই স্পৃহা, গুনাহ পরিত্যাগের এই জজবা বাকি থাকে এই প্রতিজ্ঞা করে আমরা এ মজলিস ত্যাগ করব।

অধঃপতনের বড় কারণ

আজ আমরা মুসলমানরা যে বিপদ ও দুর্যোগে আক্রান্ত, আমার দৃষ্টিতে তার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে হারাম সম্পদ ভক্ষণ। ঘুষ, সুদ, অন্যায় পন্থায় অর্জিত সম্পদ, ধোঁকার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ। যে যেভাবে পারছে, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করছে। এই হারাম ভক্ষণের শাস্তি আল্লাহ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আজ শবে কদরের এই মোবারক ক্ষণে আসুন সকলে প্রতিজ্ঞা করি, কখনো কোনো হারাম লোকমা মুখে দেবো না। সততার সঙ্গে হালাল পন্থায় যা অর্জিত হয়, তাতেই তুষ্ট ও সন্তুষ্ট থাকব। হারামের পথ যতই আকর্ষণীয় হোক, সম্পদ যত অধিকই হোক, নির্দ্বিধায় তা প্রত্যাখ্যান করব। আজ রাতে আল্লাহর কাছে তাওফিকও চাইব, তিনি যেন আমাদেরকে হারাম থেকে বেঁচে থাকার এবং হালালে তুষ্ট থাকার শক্তি দান করেন।

যদি আমরা এ কাজগুলো করতে পারি, তাহলে আমরা রমজানের ফায়েদা ও কল্যাণ, বরকত ও ফয়জান এবং নুর ও আলোকচ্ছটা লাভ করতে পারব, ইনশাআল্লাহ। আর যদি এভাবেই রমজান কেটে যায়, সাতাশ রমজান চলে গেল, কুরআন খতম হলো, দোয়া হলো, এরপর জীবনের সেই পূর্বের গতিধারা, আগের মতো হারাম কামাই, আগের মতো দ্বীনি বিষয়ে গাফলত, তাহলে তা হবে আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা। আল্লাহ মাফ করুন, এমন ভুল করবেন না। আসুন, আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে নিষ্ঠাপূর্ণ অন্তরে তাওবা করি এবং ভবিষ্যৎ জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার প্রতিজ্ঞা করে এ মজলিস থেকে উঠি। তাহলে ইনশাআল্লাহ, বাস্তবেই এ রাত কল্যাণ, রহমত ও বরকতের রাতে পরিণত হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।


দোয়া করার আদবও দোয়ার মাধ্যমেই চাইতে হবে

এখন আমরা দোয়া করব। দোয়ার আদব হচ্ছে আল্লাহ অবশ্যই কবুল করবেন—এই বিশ্বাস নিয়ে দোয়া করা। দোয়া কবুল হওয়ার অনেকগুলো কার্যকারণ আজকের রাতে একত্র হয়েছে। তাই আমরা বড় আশাবাদী যে, আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করবেন ।

বাস্তবতা তো এই যে, আমাদের দোয়া করার যোগ্যতাও নেই। আল্লাহ আপন দয়া ও রহমতে তাওফিক দিলেই কেবল দোয়া সম্ভব। দোয়া কীভাবে করব, আল্লাহর কাছে কী প্রার্থনা করব-তাও আমরা জানি না। স্বয়ং নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছেন-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَ المَسْأَلَةِ، وَخَيْرَ الدُّعَاءِ، وَخَيْرَ النَّجَاحِ، وَخَيْرَ الْعَمَلِ،وَخَيْرَ القَوَابِ، وَخَيْرَ الحَيَاةِ، وَخَيْرَ الْمَمَاتِ

হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে সর্বোত্তম প্রার্থনা, সর্বোত্তম দোয়া, সর্বোত্তম সফলতা, সর্বোত্তম আমল সর্বোত্তম সাওয়াব, সর্বোত্তম জীবন ও সর্বোত্তম মরণের (তাওফিক) চাচ্ছি।(৩৬)

   

হাকিমুল উম্মত হজরত থানবি রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা হজরত খাজা আজিজুল হাসান মজযুব রহ.-এর ঘটনা। তিনি বলেন, একদিন হজরত থানবি রহ. বয়ানে বললেন, আল্লাহর মুহাব্বত ও ভালোবাসা সকল সৎ- কর্মের ভিত্তি। সুতরাং সবকিছু তার কাছেই চাও। আল্লাহ তাআলার দিতে কোনো কার্পণ্য নেই; কিন্তু চাইতে তো হবে। আল্লাহর দরবারে ঝুলি তো পাততে হবে।

খাজা আজিজুল হাসান মজযুব রহ. বলেন, এ কথা শোনার পর আমি হাকিমুল উম্মত রহ.-কে প্রশ্ন করলাম, 'হজরত, কোনো ব্যক্তির কাছে যদি পাতার ঝুলিই না থাকে, তাহলে সে কী করবে?!' অর্থাৎ কীভাবে চাইতে হবে, তাই যদি জানা না থাকে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার ভাবই যদি সৃষ্টি না হয়, তাহলে কী করবে? উত্তরে হজরত থানবি রহ. বললেন, 'ঝুলিও তার কাছ থেকেই চাইতে হবে। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে, হে আল্লাহ, আমি অভাগা কীভাবে আপনার কাছে চাইতে হয়, কীভাবে দোয়া করতে হয়, তাও জানি না। আপনি দয়া করে আপনার রহমত দ্বারা আমাকে দোয়া করার তাওফিক দিয়ে দিন।' সুতরাং দোয়ার শুরুতেই আমরা নবীজির শিক্ষা দেওয়া এই দোয়া করব-

اللهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَ الْمَسْأَلَةِ، وَخَيْرَ الدُّعَاءِ

এরপর প্রথমে আমরা মাছুর (কুরআন-হাদিসে বর্ণিত) দোয়াসমূহ করব। তারপর নিজের প্রয়োজনের জন্য দোয়া করব। সবশেষে পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করব। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তথ্যসূত্রঃ
৩৪.  ইমাম বুখারি, সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৩৭ ও ইমাম মুসলিম, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৭৩।
৩৫.  ইমাম তিরমিজি, সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২৯৪৮।
ইবনুল জাযারি রহ., ইমাম নববি রহ. ও ইমাম সুয়ুতি রহ.-সহ অনেকেই আমলটিকে মুতাওয়ারিস ও মুসতাহাব আমল বলেছেন।
৩৬. হাকিম, আল-মুসতাদরাক আলাস সহিহাইন, ১/৫২০, তাবারানি, আল-মুজামুল কাবির, হাদিস নং ৭১৭ ও আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস নং ৬২১৮ ।

*** (মুফতি তাকি উসমানি (দামাত বারাকাতুহু) এর রমজান বিষয়ক বিশেষ বয়ান সংকলন ‘আল্লাহুম্মা বাল্লিগনা রামাযান’ থেকে সংকলিত)


*** ইবন রজব আল-হাম্বলী রহ. এর ‘লাতায়িফুলমা ‘আয়রফ’ অবলম্বনে ‘রমযানের দায়িত্ব-কর্তব্য’ থেকে সংকলিত




****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url