ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের ইতিহাস-২ || মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ও রাসুল (সাঃ) -এর ভূমিকা







ইসলাম বিদ্বেষী মোনাফেকদের ষড়যন্ত্র

আমাদেরকে বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল ষড়যন্ত্রের মুখে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাল ছেড়ে বসে থাকেননি এবং নীরবে নিশ্চুপ থেকে তা হজম করেও নেননি। বরং তাদের প্রতিটি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যথাসময়ে কঠোর ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের সকল ষড়যন্ত্র ও কু-মতলবকে গুড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শাস্তিও প্রদান করেছেন। তাই মুসলিম বিশ্বের বর্তমান বিপদ সংকুল মুহূর্তে আজ আমাদেরও উজ্জীবিত হতে হবে মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই জিহাদি প্রেরণায়। রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নতী পথ ধরে চলতে হবে ইয়াহুদী, খৃষ্টান, কাফির, নাস্তিক ও বেদীনের মুকাবিলায় । তাহলেই আমরা সক্ষম হবো ইয়াহুদী-খৃষ্টানচক্র ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল ষড়যন্ত্রের ভিত উপড়ে ফেলতে।
   

ইতিপূর্বে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের ষড়যন্ত্রসমূহের কতিপয় দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। এখন মুসলমানের ছদ্মবেশী মুনাফিকরূপী ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে সব কূটকৌশল অবলম্বন করতো, তার কতিপয় দৃষ্টান্ত পেশ করা হচ্ছে।

মুনাফিক হচ্ছে যারা বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু আন্তরিকভাবে তারা মুমিন ছিল না। বরং তাদের অন্তর ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এরা মুসলমানদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করার পাশাপাশি কাফির ও শত্রুদের নিকট মুসলমানদের সব রকম গোপন তথ্য পাচারের চেষ্টায় লিপ্ত থাকতো। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এদের সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

 وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ وَ بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ مَا هُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ۘ﴿۸   یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰهَ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۚ وَ مَا یَخۡدَعُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡفُسَهُمۡ وَ مَا یَشۡعُرُوۡنَ ؕ﴿۹   فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ مَّرَضٌ ۙ فَزَادَهُمُ اللّٰهُ مَرَضًا ۚ وَ لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌۢ ۬ۙ بِمَا کَانُوۡا یَکۡذِبُوۡنَ ﴿١٠  وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُوۡنَ ﴿۱۱   اَلَاۤ اِنَّهُمۡ هُمُ الۡمُفۡسِدُوۡنَ وَ لٰکِنۡ لَّا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۱۲   وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ اٰمِنُوۡا کَمَاۤ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوۡۤا اَنُؤۡمِنُ کَمَاۤ اٰمَنَ السُّفَهَآءُ ؕ اَلَاۤ اِنَّهُمۡ هُمُ السُّفَهَآءُ وَ لٰکِنۡ لَّا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۳   وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قَالُوۡۤا اٰمَنَّا ۚۖ وَ اِذَا خَلَوۡا اِلٰی شَیٰطِیۡنِهِمۡ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا مَعَکُمۡ ۙ اِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَهۡزِءُوۡنَ ﴿۱۴   اَللّٰهُ یَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَ یَمُدُّهُمۡ فِیۡ طُغۡیَانِهِمۡ یَعۡمَهُوۡنَ ﴿۱۵

অর্থঃ মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা বলে-আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়। মূলতঃ তারা (এরূপ কথা বলে) আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ এতে তারা নিজেরাই শুধু ধোঁকা খাচ্ছে। কিন্তু তারা তা উপলব্ধিও করতে পারছে না। তাদের অন্তঃকরণ ব্যাধিগ্রস্ত। আর আল্লাহপাক তাদের ব্যাধি আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের এ মিথ্যাচারের দরুন তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব। আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না তখন তারা বলে আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি। মনে রেখো তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী । কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না। আর যখন তাদেরকে বলা হয় সাহাবীগণ রাযি. যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন তখন তারা বলে আমরা কি ঈমান আনবো বোকাদের মত ? মনে রেখো প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা। কিন্তু তারা তা বোঝে না। আর তারা যখন ইমানদারদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদেরই সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র। আল্লাহ পাক তাদের এ উপহাসের সমুচিত শাস্তি দিবেন। তবে (দুনিয়াতে) তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের অহংকার ও কুমতলবে আরো মাতোয়ারা ও হয়রান পেরেশান হতে থাকে। (সূরাহ বাকারাহ-৮-১৫)

অন্যত্র আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

 اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰهَ وَ هُوَ خَادِعُهُمۡ ۚ وَ اِذَا قَامُوۡۤا اِلَی الصَّلٰوۃِ قَامُوۡا کُسَالٰی ۙ یُرَآءُوۡنَ النَّاسَ وَ لَا یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰهَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۱۴۲  مُّذَبۡذَبِیۡنَ بَیۡنَ ذٰلِکَ ٭ۖ لَاۤ اِلٰی هٰۤؤُلَآءِ وَ لَاۤ اِلٰی هٰۤؤُلَآءِ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰهُ فَلَنۡ تَجِدَ لَهٗ سَبِیۡلًا ﴿۱۴۳

অর্থঃ অবশ্যই মুনাফিকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ আল্লাহই তাদের প্রতারণার শাস্তি দিবেন। আর যখন তারা নামাযে দাঁড়ায় তখন একান্ত অলসতার সাথে দাড়ায়। উদ্দেশ্যও আবার শুধু লোক দেখানো। আর তারা আল্লাহকে সামান্যই স্মরণ করে। এরা দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত। এদিকেও নয়, ওদিকেও নয়। বস্তুতঃ যাকে আল্লাহ গোমরাহ করে দেন, তুমি তাদের জন্য কোথাও কোন পথ পাবে না। (সুরাহ নিসা, ১৪২-১৪৩)

   

দৃষ্টান্ত-১ঃ 

উহুদ যুদ্ধে মুনাফেকদের কৌশল

উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে মুসলমানগণ যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ করছিলেন যে, মদীনা হতে বের হয়ে কাফিরদের মোকাবিলা করা হবে, নাকি মদীনার অভ্যন্তরে থেকেই শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা হবে ? স্বভাবগতভাবে মুসলিম ছদ্মবেশী মুনাফিকরাও পরামর্শ সভার অংশীদার ছিল। আর তাদের অভিপ্রায় ছিল- সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে মদীনায় বসে কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ পরিচালনা করা হোক। কিন্তু অন্যান্য বরেণ্য মুজাহিদ সাহাবায়ে কিরামের সাহসিকতাপূর্ণ আগ্রহে শেষ পর্যন্ত যখন মদীনা হতে বের হয়ে কাফিরদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তাবই গৃহীত হলো তখন যুদ্ধে রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর তিন হাজার কাফির সৈন্য বাহিনীর মোকাবেলায় মাত্র এক হাজার মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীকে আরো ক্ষুদ্র করে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে তাদেরকে নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন করার এক গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই এই বলে তার তিনশত মুনাফিক অনুসারীসহ মধ্য পথ হতে ফিরে এলো যে, যখন আমাদের পরামর্শের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হলো না বরং অন্যদের পরামর্শই গ্রহণ করা হল তখন আমাদের আর যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। আমরা এই বিশাল শত্রু বাহিনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার পরিবর্তে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়ে নিজেদেরকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করতে পারি না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কি পূর্ব মুহূর্তে তার এই ধরনের প্ররোচনা মুসলিম সৈন্য বাহিনীতে এতই ক্ষতিকর প্রভাব ফেললো যে, কতিপয় দুর্বল ও নতুন মুসলমানও তার সাথে পশ্চাদপসরণ করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করল। সেই সাথে দু'একটি গোত্রও তাদের সাথে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার ইচ্ছা করেছিল কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানীতে তারা রক্ষা পেল।

দৃষ্টান্ত-২ঃ

মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর ঘটনা

পঞ্চম হিজরীর ঘটনা । মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরাম রাযি. গণ বনু মুস্তালিক যুদ্ধে বিজয়ের পর রণাঙ্গন থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন, পথিমধ্যে কুপ হতে পানি উঠানোকে কেন্দ্র করে এক মুহাজির সাহাবীর রাযি. সাথে খাযরাজ গোত্রের অপর এক আনসারী সাহাবীর রাযি. সামান্য ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হস্তক্ষেপে ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। তদন্তের পর উক্ত মুহাজির সাহাবীরই রাযি. অপরাধ প্রমাণিত হয়। সেই প্রেক্ষিতে সাহাবীগণ রাযি. উক্ত আনসারী সাহাবীকে রাযি. বুঝিয়ে শুনিয়ে মাফও করিয়ে নিয়ে ছিলেন। মুনাফিকদের যে দলটি যুদ্ধ লব্ধ সম্পদের লালসায় মুসলমানদের সাথে একত্রিত হয়েছিল তাদের নেতা মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এই ঘটনা অবহিত হয়ে আনসার ও মুহাজির সাহাবীগণের রাযি. ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নষ্ট করার লক্ষ্যে তাদের মাঝে বিরোধ ও বিবাদ সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস চালায়। তখন সে আনসার সাহাবীদের রাযি. উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বলল- এই ভিনদেশী মুহাজির তোমাদের খেয়ে তোমাদের পরে মোটা তাজা হয়ে এখন তোমাদেরই খেয়ে ফেলতে চায় দেখছি। খোদার কসম! এবার মদীনা প্রত্যাবর্তন করে আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মদীনা হতে বিতাড়িত করবো। (নাউজুবিল্লাহ)।

হযরত উমর রাযি. এই ঘটনা শ্রবণ করলেন এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে হযরত উমর রাযি. কে নিবৃত্ত করলেন যে, “লোকেরা এই বলে আমার সম্পর্কে ভীতি ছড়াবে যে, মুহাম্মদ স্বীয় লোকদের হত্যা করে।” এক সাহাবীর প্রশ্নের জবাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন- “তুমি কি জানো না, আব্দুল্লাহ বিন উবাই কি জঘন্য কথা বলেছেন? তখন তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তার কথা তাকে বলতে দিন, সে মনে করে যে, আপনি তার হাত থেকে সমগ্র মদিনাবাসীর নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন, আপনি না এলে সেই মদিনার একক নেতৃত্বের অধিকারী হতো। এ কারণে প্রতিনিয়ত আপনার ও মুসলমানদের প্রতি হিংসার আগুনে জ্বলছে সে।”

অতঃপর মদিনা প্রত্যাবর্তনের পথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে ডেকে তার অশোভন উক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে সরাসরি তা অস্বীকার করে। এবং দ্বিধাহীনচিত্তে তার উপর মিথ্যা কসম খায়। তখনই সূরা মুনাফিকুন অবতীর্ণ করে আল্লাহ তা'আলা তাদের মুখোশ উম্মোচন করে দিলে মদিনার সর্বত্র সে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হতে থাকে। সবার ধারনা ছিল যে, এবার তাকে মৃত্যুদণ্ডই দেয়া হবে। তখন আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের পুত্র আব্দুল্লাহ যিনি খাটি মুসলমান ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন- তিনি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি আমার পিতাকে হত্যা করতে মনস্থ করে থাকলে আমাকে হুকুম করুন, আমি তার মাথা কেটে আপনার দরবারে হাজির করব।” তিনি আরও বললেন, “সমগ্র খাযরাজ গোত্রে আমি মাতা-পিতার সবচেয়ে অনুগত সন্তান বলে পরিচিত। তথাপি পিতৃহত্যার ব্যাপারে আপনার আদেশই শিরোধার্য। কিন্তু আপনি যদি অন্য কাউকে হত্যার আদেশ দেন, তাহলে আমি হয়তোবা পিতৃহত্যাকে চোখের সামনে দৃশ্যমান হতে দেখে আত্মসংবরণ করতে পারবা না।” মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তুমি নিশ্চিত থাক, আমি তার ব্যাপারে সেই ধরনের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব না।

দৃষ্টান্ত-৩ঃ

হযরত আয়িশা রাযি.-এর প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনা

বনু মুস্তালিক যুদ্ধে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সফর সঙ্গিনী ছিলেন হযরত আয়িশা রাযি। যুদ্ধ সমাপ্তির পর মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে এক মনযিলে কাফেলা অবস্থান করার পর শেষ রাতে প্রস্থানের ঘোষণা করা হলো যে, কাফেলা কিছুক্ষণের মধ্যে এখান থেকে রওয়ানা হয়ে যাবে। তাই সবাই যেন নিজ নিজ প্রয়োজন সেরে প্রস্তুত হয়ে যায়। হযরত আয়িশা রাযি. ইস্তিঞ্জা (প্রাকৃতিক কার্জ) সম্পাদনের প্রয়োজনে জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন। সেখানে ঘটনাক্রমে তার গলার হার ছিঁড়ে হারিয়ে গেল, সেখানে তিনি তা তালাশ করতে লাগলেন। এতে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেল। মনযিলে এসে কাফেলাকে না দেখে তিনি সেখানে কাপড় দ্বারা শরীর আবৃত করে বসে পড়লেন এবং সেখানে কিছুক্ষণের মধ্যে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন। সময় ছিল শেষরাত্রি, হযরত আয়িশা রাযি. ছুটাছুটি না করে তাঁকে খুঁজে বের করার সুবিধার্থে পূর্বের স্থানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন।



এদিকে সাফওয়ান বিন মুআত্তাল রাযি. কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ব থেকেই কাফেলার পশ্চাতে থেকে কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর ভুলবশতঃ কোন কিছু ফেলে গেলে বা রেখে গেলে তা কুড়িয়ে আনার দায়িত্বে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন। সে মতে তিনি পূর্বের মনজিল হতে সকাল নাগাদ উল্লেখিত মনজিলে এসে পৌঁছলেন। তখন পর্যন্ত প্রভাতরশ্মি ততটুকু উজ্জ্বল হয়ে উঠেনি। তিনি একজন মানুষকে নিদ্রামগ্ন দেখে কাছে এসে চিনতে পারলেন। তার মুখ থেকে বিচলিত কণ্ঠে “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” বেরিয়ে এল। তাঁর আওয়াজ শুনা মাত্র হযরত আয়িশা রাযি. জাগ্রত হয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে পড়লেন। অতঃপর হযরত সাফওয়ান রাযি. নিজের উট কাছে এনে বসিয়ে দিলে হযরত আয়িশা রাযি. তাতে সওয়ার হয়ে বসে যান। আর উক্ত সাহাবী রাযি. নিজে পায়ে হেটে হেটে উটের রশি ধরে আগে আগে চলতে লাগলেন। অবশেষে তিনি কাফেলার সাথে মিলিত হয়ে গেলেন।

এ ঘটনাটি নিয়ে মুনাফিকরা এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে দিল। আব্দুল্লাহ বিন উবাই মুনাফিক হওয়া ছাড়াও সে ছিল অত্যন্ত অসৎ চরিত্রের। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ব্যক্তিগতভাবেও তার ছিল প্রচণ্ড আক্রোশ ও চরম বিদ্বেষ। তাই সে নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণপ্রিয় স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশার রাযি. পবিত্র চরিত্রে কালিমা লেপন করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে চরম লাঞ্ছনা ও মানসিক যাতনায় ফেলার চেষ্টা চালাল। এই হতভাগা ও তার সঙ্গীরা তখন হযরত আয়িশা রাযি. ও সাহাবী সাফওয়ানের রাযি. ব্যাপারে কুৎসা রটনা করতে লাগলো এবং এই মিথ্যা অপবাদের খুব প্রসার ঘটাতে লাগলো। যখন মানুষের মাঝে এই মুনাফিক রটিত অপবাদ চর্চা হতে লাগলো তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে খুবই দুঃখিত হলেন। হযরত আয়িশার রাযি. তো দুঃখের কোন অন্তই ছিল না। সাধারণ মুসলমানরাও এতে দারুণভাবে বেদনাহত হলেন। এক মাস পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকলো। অবশেষে আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআন মাজীদের সূরাহ নূরে ষোল আয়াত বিশিষ্ট দীর্ঘ দুই রুকু অবতীর্ণ করে তাতে হযরত আয়িশার রাযি. পবিত্রতা বর্ণনা ও অপবাদ রটনাকারীদের নিন্দাবাদ করেন। অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপবাদ রটনাকারীদের হতে সাক্ষ্য তলব করেন। তারা এই ভিত্তিহীন অপবাদের সাক্ষ্য কোথা থেকে আনবে ? ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরী'আতের বিধান অনুযায়ী কোন মুসলমানের চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ আরোপের শাস্তি সরূপ প্রত্যেকের উপর আশি দোররা করে হদ্দে কযফ প্রয়োগের নির্দেশ দেন।

দৃষ্টান্ত-৪ঃ

তাবুক যুদ্ধে মুনাফিকদের জঘন্য কার্যাবলী

তাবুক যুদ্ধে ও যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থার মুনাফিকদের জঘন্য কার্যাবলীঃ এক দিকে প্রচণ্ড গরম, অপর দিকে মৌসুমের ফসল - খেজুর কাটার সময় অতি সন্নিকটে, এমনি প্রতিকূল মুহূর্তে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ রাযি. রোমীয় সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে তাবুক যুদ্ধের দীর্ঘ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন, তখন মুনাফিকরা সাধারণ লোকদেরকে অত্যাধিক গরম দীর্ঘ সফরের কষ্ট ক্লেশ ও প্রতিপক্ষের প্রবল শক্তিশালী হওয়া ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে যুদ্ধে না যাওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা এক ইয়াহুদীর বাড়ীতে একত্রিত হয়ে শলা-পরামর্শও করল। সংবাদ পেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত ইয়াহুদীর বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়ার আদেশ দেন। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই প্রথমে তার অনুসারী বিরাট দল নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি দেখিয়েও রওয়ানা হওয়ার মূহুর্তে পিছু টান দেয়।

তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাযি.কে আহলে বাইতের দেখা শুনা করার জন্য মদীনায় রেখে গিয়ে ছিলেন। তখন মুনাফিকরা বলাবলি করতে লাগলো যে, আলীর রাযি. প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট তাই তাকে যুদ্ধে নিয়ে যাননি। শেরে খোদা হযরত আলী রাযি. একথা শুনে তক্ষুনি যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে জরুফ নামক স্থানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনযিলে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন যে, মুনাফিকরা এমন বলাবলি করছে। আপনি কি সত্যিই এজন্য আমাকে মদীনায় রেখে এসেছেন? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তারা মিথ্যা বলছে আমি আমার পরিবার পরিজনের জন্য তোমাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করে এসেছি। হে আলী! তুমি কি আমার জন্য এরূপ হতে সন্তুষ্ট নও যেরূপ ছিলেন হযরত হারুন আ., হযরত মুসা আ. এর জন্য। অবশ্য আমার পর আর কোন নবী নেই। তখন হযরত আলী রাযি. মদীনায় ফিরে এলেন।

তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে একবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উট হারিয়ে গেলে এক মুনাফিক বলতে লাগলো মুহাম্মদ নবী হওয়ার দাবী করে এবং লোকদেরকে ‘আসমানের সংবাদ শোনায়। অথচ স্বীয় উটের সংবাদ তার জানা নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এক ব্যক্তি এরূপ বলছে আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি আমার মাওলা আমাকে যা জানান তা ছাড়া আমার কিছুই জানা নেই। আর উটের সংবাদ আমাকে আল্লাহ তা'আলা জানিয়ে দিয়েছেন। উপত্যকার একটি ঘাটিতে গাছের সাথে তার দড়ি পেঁচিয়ে যাওয়ায় সে আটকে রয়েছে কেউ গিয়ে নিয়ে এস।

এক দল মুনাফিক পথিমধ্যে মুসলমানদের হীনবল করার উদ্দেশ্যে তাদের এই বলে ভয় দেখাচ্ছিল যে, তোমরা কি রোমীয় সৈন্যদের বীরদের আরব যোদ্ধাদের ন্যায় অপরিপক্ক ভেবেছ? মাথা দেখে নিও। সবাইকে রশি দিয়ে বেধে রেখে দেবে। তাদের মধ্যে হতে একজন মুনাফিক বলল তোমরা সাবধানে কথা বলো তোমাদের উপর না জানি একশ করে চাবুক মারার আদেশ হয় এবং আমাদের সম্পর্কে কুরআন নাযিল হয় যে তাতে আমাদের এই কথোপকথন প্রকাশ করে দেয়া হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আম্মার রাযি. কে তাদের নিকট জিজ্ঞাসা করার জন্য পাঠালেন তারা সবাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলো যে, আমরা ঠাট্টা বশতঃ পরস্পর এরূপ বলছিলাম।

মহানবী (সাঃ) কে হত্যার লোমহর্ষক ষড়যন্ত্র

তাবুক হতে প্রত্যাবর্তনের পর কতিপয় মুনাফিক গোপনে পরামর্শ করলো যে, যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের উঁচু সরু পথে আরোহণ করবেন, তখন ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে তাকে হত্যা করা হবে। এ উদ্দেশ্যে উল্লেখিত ষড়যন্ত্রকারীরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলো। ওহীর মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি পাহাড়ের সুরু রাস্তার নিকট পৌঁছে বললেন- যার ইচ্ছে হয় সে এই পর্বত উপত্যকার প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে যেতে পারে- অথবা পাহাড়ের উপর সরুপথ দিয়ে যেতে পারে, এই বলে নিজে পাহাড়ের উপর সরু রাস্তা দিয়ে যেতে লাগলেন। ষড়যন্ত্রকারী দল মোক্ষম সুযোগ বুঝে রাত্রির অন্ধকারে মুখোশ পরিধান করে এই সরুপথ দিয়ে ‘আসতে লাগল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে তখন ছিলেন শুধু হযরত হুযাইফা রাযি. ও হযরত আম্মার রাযি. হযরত হুযাইফা রাযি. পিছনে ছিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত সুরু পথে আরোহণ করলে পিছন হতে উল্লেখিত অভিশপ্ত দলের আগমনের আওয়াজ শোনা গেল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারায় তখন ক্রোধের লেলিহান শিখা জ্বলছিল। তিনি তাদেরকে পেছনে বিতাড়িত করার আদেশ করলেন। হযরত হুযাইফা রাযি. পিছন ফিরে তাদের উটের মুখে তীর নিক্ষেপ করলেন।

যখন তারা হযরত হুযাইফার রাযি. সম্মুখে উপস্থিত হল তখন তারা ঘটনা জানাজানি হয়ে গেছে ভেবে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত গতিতে পিছনে ফিরে কাফেলার সাথে মিলিত হয়ে গেল। হযরত হুযাইফা রাযি. তাদের বিতাড়িত করে ফিরে এলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত উট চালানোর আদেশ করেন। অতঃপর সরু রাস্তা অতিক্রম করে উপত্যকা ঘুরে আসা কাফেলার অপেক্ষায় রইলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হুযাইফা রাযি. কে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি ঐ দলটিকে চিনেছ? তিনি আরজ করলেন সওয়ারী কার কার ছিল তা তো চিনেছি। কিন্তু আরোহণকারীদের চিনতে পারিনি। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি তাদের উদ্দেশ্য বুঝেছ? তিনি আরজ করলেন, না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে পাহাড়ের উপর হতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা। আর বললেন যে, ঘটনা এখন কারো নিকট প্রকাশ করো না। আল্লাহ তা'আলা আমাকে তাদের উদ্দেশ্য ও সকলের নাম জানিয়ে দিয়েছেন। ইনশাল্লাহ সকালে প্রকাশ করে দেবো।

   

ইবনে ইসহাক রহ. বর্ণনা করেন যে, সকালে উঠে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাম উল্লেখ পূর্বক তাদের বক্তব্য তুলে ধরলেন। তাদের মধ্যে হতে ‘জুল্লাস' নামক মুনাফিক বলেছিল- “আজকের রাতে আমরা মুহাম্মাদকে পাহাড়ের উপর হতে নিক্ষেপ করেই ছাড়ব। যদিও মুহাম্মদ ও তার সাহাবীরা রাখি, আমাদের চেয়ে উত্তম হোক না কেন। আমরা ছাগলের পাল আর তারা আমাদের চেয়ে উত্তম হোক না কেন। আমরা ছাগলের পাল আর তারা আমাদের রাখাল। আমরা তো নির্বোধ আর তারা বুঝি খুব বুদ্ধিমান।”

আব্দুল্লাহ বিন উয়াইনা তার সঙ্গীদের বলেছিল- “আজকের রাতটি জাগ্রত থাকতে পারলে তোমরা চিরদিন শান্তিতে থাকতে পারবে। আজ তোমাদের শুধু একটিই কাজ এই ব্যক্তিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যা করে ফেল।” হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- “আমি নিহত হলে তোমার কি লাভ হতো?” সে তখন কাকুতি-মিনতি শুরু করলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ছেড়ে দেন। মুররা বিন রাবী বলেছিল আমরা একটি মানুষকে (অর্থাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যা করতে পারলে সবাই পরিত্রাণ পেয়ে যাবো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার জনের প্রত্যেকের কথোপকথন ও তাদের অন্তরের কুমতলব বলে দেন। হিসন বিন নামীরকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন যে তুমি এরূপ কেন করেছিলে ? সে উত্তর দিল আমার বিশ্বাস ছিল না যে আপনি এই ষড়যন্ত্র অবগত হবেন। এখন বুঝতে পারছি যে, আপনি সত্যিই আল্লাহর নবী। এত দিন আমি আন্তরিকভাবে মুসলমান ছিলাম না। এখন অন্তর হতে ঈমান এনেছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাউকে হত্যার আদেশ করেননি। কারণ দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারে কখনো কারো নিকট হতে কোনরূপ প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি।

তাছাড়া কাফিরদের নিকট মুসলমান বলে পরিচিত মুনাফিকদের হত্যা না করার কতগুলো রাজনৈতিক কারণও ছিল। যথাঃ

১. যুদ্ধ ক্ষেত্রে মুসলমানদের দল ভারী দেখিয়ে কাফিরদের ভীতি প্রদর্শন করা।

২. শত্রুরা যাতে এই বলে বদনাম রটাতে না পারে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় লোকদেরকে হত্যা করে।

৩. তাছাড়া মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় মুনাফিকরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করলেও তাতে ইসলামের তেমন ক্ষতি করতে পারত না। কেননা তাদের সব ষড়যন্ত্রই আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অবগত করে দিতেন। তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় মুনাফিকদের হত্যা করা হতো না।

এরূপ আরো কতগুলো দীনী ও রাজনৈতিক বিশেষ হিকমতের কারণে তাদের সম্পূর্ণ পরিচয় জানা থাকা স্বত্বেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বাহ্যিক ঈমানের উপর ভিত্তি করেই কিছু বলতেন না বরং তাদের সাথে মুসলমানদের মত আচরণ করতেন। দলীয় প্রমাণাদি দিয়ে তাদেরকে সত্য বুঝাতে চেষ্টা করতেন। তবে তাদের সাথে এতটা আন্তরিকতা প্রদর্শন করতেন না, যা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বভাব ছিল। বরং কিছুটা কর্কশ ও বিমাতা সুলভ আচরণই করতেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের শাসাতেন। কোন ধরনের পরামর্শ সভায় তাদের উপস্থিতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অত্যন্ত অপ্রিয় ছিল।

দৃষ্টান্ত -৫ঃ

মসজিদের নামে ষড়যন্ত্রের আখড়া নির্মাণ

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে একদল মুনাফিক মসজিদে কুবা'র সন্নিকটে আর একটি মসজিদ বানিয়ে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে আবেদন করলো যে, আমাদের দুর্বল ও অসুস্থ ব্যক্তি যারা মসজিদে কুবায় যেতে পারে না তাদের জন্য একটি মসজিদ বানিয়েছি। অনুগ্রহপূর্বক আপনি নামায পড়িয়ে মসজিদটি বরকতময় করে দিয়ে ‘আসবেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- এখনতো আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। ফিরে এসে ইনশাআল্লাহ তোমাদের মসজিদে নামায পড়তে যাব।

এর দীর্ঘ প্রায় এক মাস পর যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক হতে ফিরার পথে “যী আওয়ান” নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে ওহীর মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত মসজিদ নির্মাতাদের কু- উদ্দেশ্যে সম্পর্কে অবগত হয়ে দু'জন বিশিষ্ট সাহাবী রাযি. কে ডেকে জালিমদের তথাকথিত মসজিদটি জ্বালিয়ে গুড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন তারা দ্রুত গতিতে গিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। তার ভিতর অবস্থানকারী মুনাফিকরা সবাই এদিক সেদিক পালিয়ে জান বাঁচালো। কুরআনে কারীমে আল্লাহপাক মুনাফিকদের এই মসজিদকে মসজিদে জিরার বা ক্ষতিকর মসজিদ এবং আল্লাহ ও রাসূলের শত্রুদের ঘাটি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন বর্ণনায় জানা যায় যে, মসজিদে জিরার বানিয়ে ছিল বার জন মুনাফিক তাদের নেতা আবু আমের একদিন তাদের বললো তোমরা মসজিদের নামে একটি ঘর তৈরী কর এবং তাতে সম্ভাব্য সব ধরনের অস্ত্র শস্ত্রের মজুত গড়ে তোল। আমি রোম সম্রাটের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে তার বাহিনী নিয়ে ‘আসব এবং মদীনা হতে মুহাম্মদ ও তার অনুসারীদের বিতাড়িত করব। তখন তার নির্দেশানুসারে তার অনুসারীরা মসজিদে জিরার নির্মাণ করে।

এই ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদী খৃষ্টান ও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রসমূহের কতিপয় উদাহরণ।





****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url