মা’আরেফুল কোরআন - ৪৮ || সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৪৩ || মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৪৩

   

সূরা আল-বাকারাহ ১৪৩ নং আয়াতের দ্বিতীয় অংশ

وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنٰکُمۡ اُمَّۃً وَّسَطًا لِّتَکُوۡنُوۡا شُهَدَآءَ عَلَی النَّاسِ وَ یَکُوۡنَ الرَّسُوۡلُ عَلَیۡکُمۡ شَهِیۡدًا ؕ  ﴿۱۴۳

সূরা আল-বাকারাহ ১৪৩ নং আয়াতের অর্থ

(১৪৩) এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি- যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্য এবং যাতে রসুল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।

সূরা আল-বাকারাহ ১৪৩ নং আয়াতের তাফসীর

তফসীরের সার-সংক্ষেপ
(হে মুহাম্মদের অনুসারীবৃন্দ!) এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে (এমন এক) সম্প্রদায় করেছি, (যারা সর্বদিক দিয়ে একান্ত) মধ্যপন্থী যেন, (জাগতিক সম্মান ও স্বাতন্ত্র্য ছাড়াও আখেরাতে তোমাদের অশেষ সম্মান প্রকাশ পায় যে,) তোমরা (একটি বড় মোকদ্দমায়, যার এক পক্ষ হবেন পয়গম্বরগণ এবং অপর পক্ষ হবে তাঁদের বিরোধীদের) মানবমণ্ডলীর বিপক্ষে সাক্ষ্যদাতা (সাব্যস্ত) হও এবং (অধিকতর সম্মান এই যে,) তোমাদের (সাক্ষ্যদানের যোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে রসূল সাক্ষ্যদাতা হন। (এ সাক্ষ্য দ্বারা তোমাদের সাক্ষ্য যে নির্ভরযোগ্য তা প্রমাণিত হবে। তোমাদের সাক্ষ্যের ফলে মোকদ্দমার রায় পয়গম্বরগণের পক্ষে যাবে এবং বিরোধীদল অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি ভোগ করবে। এটা যে উচ্চস্তরের সম্মান, তা বলাই বাহুল্য)। 

সূরা আল-বাকারাহ ১৪৩ নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়


   


মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশেষ মধ্যপন্থা 

وسط শব্দের অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়। আবূ সায়ীদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মহানবী (সা) عدل শব্দ দ্বারা وسط -এর ব্যাখ্যা করেছেন। এর অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট। (কুরতুবী) আলোচ্য আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে যে, তাদেরকে মধ্যবর্তী উম্মত করা হয়েছে। এর ফলে তারা হাশরের ময়দানে -একটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে। সকল পয়গম্বরের উম্মতরা তাঁদের হেদায়েত ও প্রচারকার্য অস্বীকার করে বলতে থাকবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী গ্রন্থ পৌঁছেনি এবং কোন পয়গম্বরও আমাদের হেদায়েত করেন নি। তখন মুসলিম সম্প্রদায় পয়গম্বরগণের পক্ষে সাক্ষ্যদাতা হিসাবে উপস্থিত হবে এবং সাক্ষ্য দিবে যে, পয়গম্বরগণ সব যুগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আনীত হেদায়েত তাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন। তাদেরকে সঠিক পথে আনার জন্য তাঁরা সাধ্যমত চেষ্টাও করেছেন। বিবাদী উম্মতরা মুসলিম সম্প্রদায়ের সাক্ষ্যে প্রশ্ন তুলে বলবে, আমাদের আমলে এই সম্প্রদায়ের কোন অস্তিত্বই ছিল না। আমাদের ব্যাপারাদি তাদের জানার কথা নয়। কাজেই আমাদের বিপক্ষে তাদের সাক্ষ্য কেমন করে গ্রহণযোগ্য হতে পারে ?

মুসলিম সম্প্রদায় এ প্রশ্নের উত্তরে বলবে, নিঃসন্দেহে তখন আমাদের অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু আমাদের নিকট তাদের অবস্থা ও ঘটনাবলী সম্পর্কিত তথ্যাবলী একজন সত্যবাদী রসূল ও আল্লাহর গ্রন্থ কোরআন সরবরাহ করেছে। আমরাও সে গ্রন্থের ওপর ঈমান এনেছি এবং তাদের সরবরাহকৃত তথ্যাবলীকে চাক্ষুষ দেখার চাইতেও অধিক সত্য মনে করি, তাই আমাদের সাক্ষ্য সত্য। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ (সা) উপস্থিত হবেন এবং সাক্ষীদের সমর্থন করে বলবেন, তারা যা কিছু বলছে, সবই সত্য। আল্লাহর গ্রন্থ এবং আমার শিক্ষার মাধ্যমে তারা এসব তথ্য জানতে পেরেছে। হাশরের ময়দানে সংঘটিতব্য এ ঘটনার বিবরণ সহীহ বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী ও মসনদে আহমদের একাধিক হাদীসে সংক্ষেপে ও সবিস্তারে বর্ণিত রয়েছে।

মোটকথা, আলোচ্য আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করা হয়েছে। তাই এখানে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য ।

মধ্যপন্থার রূপরেখা, তার গুরুত্ব ও কিছু বিবরণ

(১) মধ্যপন্থার অর্থ ও তাৎপর্য কি? (২) মধ্যপন্থার এত গুরুত্বই বা কেন যে, এর ওপরই শ্রেষ্ঠত্বকে নির্ভরশীল করা হয়েছে? (৩) মুসলিম সম্প্রদায় যে মধ্যপন্থী, বাস্তবতার নিরিখে এর প্রমাণ কি ? ধারাবাহিকভাবে এ তিনটি প্রশ্নের উত্তরঃ

(১) اعتدال (ভারসাম্য)-এর শাব্দিক অর্থ সমান হওয়া عدل মূল ধাতু থেকে এর উৎপত্তি, আর عدل এর অর্থও সমান হওয়া।

(২) যে গুরুত্বের কারণে ভারসাম্যকে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি সাব্যস্ত করা হয়েছে, তা একটু ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। বিষয়টি প্রথমে একটি স্কুল উদাহরণ দ্বারা বুঝুন । ইউনানী, আয়ুর্বেদিক, এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ইত্যাদি যত নতুন ও পুরাতন চিকিৎসা-পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত রয়েছে, সে সবই এ বিষয়ে একমত যে, ‘মেযাজে’র বা স্বভাবের ভারসাম্যের উপরই মানবদেহের সুস্থতা নির্ভরশীল। ভারসাম্যের ত্রুটিই মানবদেহে রোগ বিকার সৃষ্টি করে। বিশেষত ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির মূলনীতিই মেযাজ পরিচয়ের উপর নির্ভরশীল। এ শাস্ত্র মতে মানবদেহ চারটি উপাদান—রক্ত, শ্লেষ্মা, অম্ল ও পিত্ত দ্বারা গঠিত। এ চারটি উপাদান থেকে উৎপন্ন চারটি অবস্থা শৈত্য, উষ্ণতা, আর্দ্রতা ও শুষ্কতা মানবদেহে বিদ্যমান থাকা জরুরী। এ চারটি উপাদানের ভারসাম্যই মানবদেহে প্রকৃত সুস্থতা নিশ্চিত করে। পক্ষান্তরে যে কোন একটি উপাদান মেয়াজের চাহিদা থেকে বেড়ে অথবা কমে গেলেই তা হবে রোগ-ব্যাধি। চিকিৎসা দ্বারা এর প্রতিকার না করলে এক পর্যায়ে পৌঁছে তাই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

   

এই স্থূল উদাহরণের পর এখন আধ্যাত্মিক সুস্থতা এবং ভারসাম্যহীনতার নাম আত্মিক ও চারিত্রিক অসুস্থতা। এ অসুস্থতার চিকিৎসা করে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা না হলে পরিণামে আত্মিক মৃত্যু ঘটে। চক্ষুষ্মান ব্যক্তি মাত্রই জানে যে, যে উৎকৃষ্টতার কারণে মানুষ সমগ্র সৃষ্টি জীবের সেরা, তা তার দেহ অথবা দেহের উপাদান অথবা সেগুলোর অবস্থা; তাপ-শৈত্য নয়। কারণ, এসব উপাদান ও অবস্থার ক্ষেত্রে দুনিয়ার অন্যান্য জীব-জন্তুও মানুষের সমপর্যায়ভুক্ত; বরং তাদের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষ এসব উপাদান মানুষের চাইতেও বেশি থাকে।

যে বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা বলে গণ্য হয়েছে, তা নিশ্চিতই তার রক্ত, মাংস, চর্ম এবং তাপ ও শৈত্যের ঊর্ধ্বে কোন বস্তু যা মানুষের মধ্যে পুরোপুরি বিদ্যমান রয়েছে—অন্যান্য সৃষ্ট জীবের মধ্যে ততটুকু নেই। এ বস্তুটি নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করাও কোন সূক্ষ্ম ও কঠিন কাজ নয়। বলা বাহুল্য, তা হচ্ছে মানুষের আত্মিক ও চারিত্রিক পরাকাষ্ঠা। মাওলানা রুমী বলেনঃ

أدميت لحم وشـحـم و پوست نیست
آدمیت جز رضائے دوست نیست 

অর্থাৎ- মেদ-মাংস কিংবা ত্বক মানবতা নয়; মানবতা একমাত্র খোদাপ্রেম ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ কারণেই যারা স্বীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মূল্য বোঝে না এবং তা নষ্ট করে দেয়, তাদের সম্বন্ধে বলেছেনঃ

اینکه می بینی خلاف آدم اند
نیستند آدم غلاف آدم اند

এসব যা দেখছ, তা মানবতা বিরোধী, এরা মানুষ নয়, শুধু মানুষের আবরণ মাত্র।

আত্মিক ও চারিত্রিক পরাকাষ্ঠাই যখন মানুষের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি, মানবদেহের মত মানবাত্মাও যখন ভারসাম্য ও ভারসাম্যহীনতার শিকার হয় এবং মানবদেহের সুস্থতা যখন মেযাজ ও উপাদানের ভারসাম্য আর মানবাত্মার সুস্থতা যখন আত্মা ও চরিত্রের ভারসাম্য, তখন কামেল মানব একমাত্র তিনিই হতে পারেন, যিনি দৈহিক ভারসাম্যের সাথে সাথে আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্যেরও অধিকারী হবেন। এ উভয়বিধ ভারসাম্য পয়গম্বরকে বিশেষভাবে দান করা হয়েছিল এবং আমাদের রসূল (সা) তা সর্বাধিক পরিমাণে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এ কারণে তিনিই সর্বপ্রধান কামেল মানব হওয়ার যোগ্য। শারীরিক চিকিৎসার জন্য যেমন আল্লাহ্ তা’আলা সর্বকালে ও সর্বত্র চিকিৎসক, ডাক্তার, ঔষধপত্র ও যন্ত্রপাতির একটা অটুট ব্যবস্থা স্থাপন করে রেখেছেন, তেমনি আত্মিক চিকিৎসা এবং মানুষের মধ্যে চারিত্রিক ভারসাম্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে যুগে যুগে পয়গম্বরগণ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁদের সাথে আসমানী গ্রন্থও পাঠানো হয়েছে এবং ভারসাম্য বিধানের লক্ষ্যে আইন প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্যও প্রদত্ত হয়েছে। কোরআনের সূরা হাদীদ-এ বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ

অর্থাৎ-আমি প্রমাণাদিসহ রসূল প্রেরণ করেছি, তাদের সাথে গ্রন্থ এবং মানদণ্ডও অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমি লৌহ নাযিল করেছি—এতে প্রবল শক্তি রয়েছে এবং নিহিত রয়েছে মানুষের জন্য অনেক উপকারিতা।

আয়াতে পয়গম্বর প্রেরণ ও গ্রন্থ অবতরণের রহস্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, এগুলোর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে চারিত্রিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা হবে এবং লেনদেন ও পারস্পরিক আদান-প্রদান বৈষয়িক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানদণ্ড নাযিল করা হয়েছে। মানদণ্ড অর্থ প্রত্যেক পয়গম্বরের শরীয়ত হতে পারে। শরীয়ত দ্বারা সত্যিকার ভারসাম্য জানা যায় এবং ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় ।

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, মানবমণ্ডলীকে আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্যের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করাই পয়গম্বর ও আসমানী গ্রন্থ প্রেরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য। বলা বাহুল্য, এটাই মানবমণ্ডলীর সুস্থতা।

মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সর্বপ্রকার ভারসাম্য নিহিত 

মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا

অর্থাৎ—‘আমি তোমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় করেছি।’ উপরোক্ত বর্ণনা থেকে আপনি অনুমান করতে পারেন যে, وَسَط শব্দটি উচ্চারণ ও লেখায় একটি সাধারণ শব্দ হলেও তাৎপর্যের দিক দিয়ে কোন সম্প্রদায় অথবা ব্যক্তির মধ্যে যত পরাকাষ্ঠা থাকা সম্ভব, সে সবগুলোকে পরিব্যাপ্ত করেছে।

আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী, ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে যে, মানবীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের উৎকৃষ্টতা তাদের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের যাবতীয় কর্মধারা অব্যাহত রয়েছে এবং পয়গম্বর ও আসমানী গ্রন্থসমূহ প্রেরিত হয়েছে, তাতে এ সম্প্রদায় অপরাপর সম্প্রদায় থেকে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ও শ্রেষ্ঠ।

কোরআন বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করেছে। সূরা আ’রাফের শেষভাগে এ সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ

অর্থাৎ, আমি যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় রয়েছে, যারা সৎপথ প্রদর্শন করে এবং তদনুযায়ী ন্যায়বিচার করে।

এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্য বিধৃত হয়েছে যে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আসমানী গ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী নিজেরাও চলে এবং অন্যদেরকেও চালাবার চেষ্টা করে। কোন ব্যাপারে কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয়ে গেলে, তার মীমাংসাও তারা গ্রন্থের সাহায্যেই করে, যাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের স্বার্থপরতার কোন আশংকা নেই।

সূরা আলে-ইমরানে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ভারসাম্য এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ

তোমরাই সেই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান রাখবে।

অর্থাৎ, তারা যেমন সব পয়গম্বরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর প্রাপ্ত হয়েছে, সব গ্রন্থের মধ্যে সর্বাধিক পরিব্যাপ্ত ও পূর্ণতর গ্রন্থ লাভ করেছে, তেমনি সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বাধিক সুস্থ মেযাজ এবং ভারসাম্যও সর্বাধিক প্রাপ্ত হয়েছে। ফলে তারা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় সাব্যস্ত হয়েছে। তাদের সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তত্ত্ব- রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ঈমান, আমল ও আল্লাহভীতির সমস্ত শাখা-প্রশাখা তাদের ত্যাগের দৌলতে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠবে। তারা কোন বিশেষ দেশ ও ভৌগোলিক সীমার বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে না। তাদের কর্মক্ষেত্র হবে সমগ্র বিশ্ব এবং জীবনের সকল শাখায় পরিব্যাপ্ত। তাদের অস্তিত্ব অন্যের হিতাকাঙ্ক্ষা ও তাদের বেহেশতের দ্বারে উপনীত করার কাজে নিবেদিত হবে। أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ বাক্যাংশে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়টি অন্যের হিতাকাঙ্ক্ষা ও উপকারের নিমিত্তেই সৃষ্ট। তাদের অভীষ্ট কর্তব্য ও জাতীয় পরিচয় এই যে, তারা মানুষকে সৎকাজের দিকে পথ দেখাবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে।

الدين النصيحة

রসূলুল্লাহ (সা)-এর এ উক্তির অর্থও তা-ই। অর্থাৎ, সকল মুসলমানের হিতাকাঙ্ক্ষা করাই হচ্ছে ধর্ম। কুফর, শিরক, বিদ্‌আত্, কুসংস্কার, পাপাচার, অসচ্চরিত্রতা, অন্যায় কথাবার্তা ইত্যাদি সবই মন্দ কাজ। এসব থেকে বিরত রাখার উপায়ও বিবিধ। কখনও বাহুবলে, কখনও কলমের জোরে এবং কখনও তরবারির সাহায্যে। মোটকথা, সবরকম জিহাদই এর অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম সম্প্রদায় যেমন ব্যাপকভাবে ও পরম নিষ্ঠার সাথে এসব কর্তব্য পালন করছে তার দৃষ্টান্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। 

(৩) বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় হওয়ার প্রমাণ কি ? এখন এ তৃতীয় প্রশ্নটি আলোচনাসাপেক্ষ। এর বিস্তারিত বিবরণ দিতে হলে বিশ্বের সকল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, কর্ম চরিত্র ও কীর্তিসমূহ যাচাই করা একান্ত প্রয়োজন। নিম্নে নমুনাস্বরূপ কতিপয় বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছেঃ

বিশ্বাসের ভারসাম্য

সর্বপ্রথম বিশ্বাসগত ভারসাম্য নিয়েই আলোচনা করা যাক । পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায় তারা পয়গম্বরগণকে আল্লাহর পুত্র মনে করে তাদের উপাসনা ও আরাধনা করতে শুরু করেছে। যেমন, এক আয়াতে রয়েছেঃ وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ (ইহুদীরা বলেছে, ওযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং খৃস্টানরা বলেছে, মসীহ আল্লাহর পুত্র) অপরদিকে এসব সম্প্রদায়েরই অপর ব্যক্তিরা পয়গম্বরের উপর্যুপরি মু’জিযা দেখা সত্ত্বেও তাদের পয়গম্বর যখন তাদেরকে কোন ন্যায়যুদ্ধে আহবান করেছেন, তখন পরিষ্কার বলে দিয়েছেঃ فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلَا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُونَ (অর্থাৎ, আপনি এবং আপনার পালনকর্তাই যান এবং শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব।) আবার কোথাও পয়গম্বরগণকে স্বয়ং তাদের অনুসারীদের হাতেই নির্যাতিত হতে দেখা গেছে।

পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা তা নয়। তারা একদিকে রসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি এমন ইশক ও মহব্বত পোষণ করে যে, এর সামনে জানমাল, সন্তান-সন্ততি, ইজ্জত-আবরু সবকিছু বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না।

سلام اسپر کہ جس کے نام لیوا ہر زمانے میں
بڑھا دیتے ہیں ٹکڑا سر فروشی کے نسانے میں

অপরদিকে রসূলকে রসূল এবং আল্লাহ্কে আল্লাহই মনে করে। এতসব পরাকাষ্ঠা ও শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তারা আল্লাহর বান্দা ও রসূল বলেই বিশ্বাস করে এবং মুখে প্রকাশ করে। তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতে গিয়েও তারা একটা সীমার ভেতরে থাকে। ‘কাছীদাহ-বুরদা’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ

دع ما ادعته النصارى في نبيهم
واحكم بما شئت مدحا فيه واحتكم

অর্থাৎ—খৃস্টানরা তাদের পয়গম্বর সম্পর্কে যা দাবি করে, সে কুফরী বাক্য পরিহার করে মহানবীর প্রশংসায় যা বলবে, তা-ই সত্য ও নির্ভুল।

এরই সারমর্ম পারস্য কবি হাফেয নিম্নের পংক্তিতে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ بعد از خدا بزرگ قصہ مختصر অর্থাৎ–সংক্ষেপে খোদার পরে আপনিই মহত্তর ।

কর্ম ও ইবাদতের ভারসাম্য 

বিশ্বাসের পরই শুরু হয় আমল ও ইবাদতের পালা। এক্ষত্রেও সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায় তারা শরীয়তের বিধি-বিধানকে কানাকড়িব বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, ঘুষ-উৎকোচ নিয়ে আসমানী গ্রন্থকে পরিবর্তন করে অথবা মিথ্যা ফতোয়া দেয়, বাহানা ও অপকৌশলের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পরিবর্তন করে এবং ইবাদত থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। অপরদিকে তাদের উপাসনালয়সমূহে এমন লোকও দেখা যায়, সংসারধর্ম ত্যাগ করে যারা বৈরাগ্য অবলম্বন করেছে। তারা আল্লাহপ্রদত্ত হালাল নিয়ামত থেকেও নিজেদের বঞ্চিত রাখে এবং কষ্ট সহ্য করাকেই সওয়াব ও ইবাদত বলে মনে করে।

পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায় একদিকে বৈরাগ্যকে মানবতার প্রতি জুলুম বলে মনে করে এবং অপরদিকে আল্লাহ্ ও রসূলের বিধি-বিধানের জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা রোম ও পারস্য সম্রাটের সিংহাসনের অধিপতি ও মালিক হয়েও বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ধর্মনীতি ও রাজনীতির মধ্যে কোন বৈরিতা নেই এবং ধর্ম মসজিদ ও খানকায় আবদ্ধ থাকার জন্য আসেনি; বরং হাট-ঘাট, মাঠ-ময়দান, অফিস-আদালত এবং মন্ত্রণালয়সমূহে এর সাম্রাজ্য অপ্রতিহত। তাঁরা বাদশাহীর মাঝে ফকিরী এবং ফকিরীর মাঝে বাদশাহী শিক্ষা দিয়েছে।

چو فقر اندر لباس شاهی آمد * زتدبیر عبید اللہی آمد 

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য

এরপর সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ্য করুন। পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা মানবাধিকারের প্রতি পরওয়া করেনি; ন্যায়-অন্যায়ের তো কোন কথাই নেই। নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাউকে যেতে দেখলে তাকে নিষ্পেষিত করা, হত্যা ও লুণ্ঠন করাকেই বড় কৃতিত্ব মনে করা হয়েছে। জনৈক বিত্তশালীর চারণভূমিতে অপরের উট প্রবেশ করে কিছু ক্ষতি সাধন করায় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে যায়। এতে কত মানুষ যে নিহত হয়, তার কোন ইয়ত্তা নেই। মহিলাদের মানবাধিকার দান করা তো দূরের কথা, তাদের জীবিত থাকারও অনুমতি দেওয়া হতো না। কোথাও প্রচলিত ছিল শৈশবেই তাদের জীবন্ত সমাহিত করার প্রথা এবং কোথাও মৃত স্বামীর সাথে দাহ করার প্রথা। অপরদিকে এমন নির্বোধ দয়ার্দ্রতার প্রচলন ছিল যে, পোকা-মাকড় হত্যা করাকে অবৈধ জ্ঞান করা হতো। জীব-হত্যাকে তো দস্তুরমত মহাপাপ বলে সাব্যস্ত করা হতো। আল্লাহর হালাল করা প্রাণীর গোশত ভক্ষণকে মনে করা হতো অন্যায়।

কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীয়ত এসব ভারসাম্যহীনতার অবসান ঘটিয়েছে। তারা একদিকে মানুষের সামনে মানবাধিকারকে তুলে ধরছে শুধু শান্তি ও সন্ধির সময়ই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রেও শত্রুর অধিকার সংরক্ষণে সচেতনতা শিক্ষা দিয়েছে। অপরদিকে প্রত্যেক কাজের একটা সীমা নির্ধারণ করেছে, যা লঙ্ঘন করাকে অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। নিজ অধিকারের ব্যাপারে ক্ষমা, মার্জনা ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং অপরের অধিকার প্রদানে যত্নবান হওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।

অর্থনৈতিক ভারসাম্য

এরপর অর্থনীতি বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রেও অপরাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তর ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এতে হালাল-হারাম এবং অপরের সুখ-শান্তি ও দুঃখ-দুরবস্থা থেকে চক্ষু বন্ধ করে অধিকতর ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকেই সর্ববৃহৎ মানবিক সাফল্য গণ্য করা হয়। অপরদিকে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এতে ব্যক্তিমালিকানাকে অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়। চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, উভয় অর্থব্যবস্থার সারমর্মই হচ্ছে ধন-সম্পদের উপাসনা, ধন-সম্পদকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান করা এবং এরই জন্য যাবতীয় চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করা।

মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীয়ত এক্ষেত্রেও একান্ত ভারসাম্যপূর্ণ অভিনব অর্থব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে। ইসলামী শরীয়ত একদিকে ধন-সম্পদকে জীবনের লক্ষ্য মনে করতে বারণ করেছে এবং সম্মান, ইজ্জত ও কোন পদমর্যাদা লাভকে এর উপর নির্ভরশীল রাখেনি; অপরদিকে সম্পদ বণ্টনের নিষ্কলুষ নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছে—যাতে কোন মানুষ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত না থাকে এবং কেউ সমগ্র সম্পদ কুক্ষিগত করে না বসে। এছাড়া সম্মিলিত মালিকানাভুক্ত বিষয়-সম্পত্তিকে যৌথ ও সাধারণ ওয়াকফের আওতায় রেখেছে। বিশেষ বস্তুর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। হালাল মালের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছে এবং তা রাখার ও ব্যবহার করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।

মোটকথা, এ আলোচনা অত্যন্ত দীর্ঘ। এখানে দৃষ্টান্ত হিসাবে ভারসাম্য ও ভারসাম্যহীনতার কয়েকটি নমুনা পেশ করাই ছিল উদ্দেশ্য। সুতরাং এতটুকুই যথেষ্ট। এতে আলোচ্য আয়াতের বিষয়বস্তু ফুটে উঠেছে যে, মুসলমান সম্প্রদায়কে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় করা হয়েছে।

সাক্ষ্যদানের জন্য ন্যায়ানুগ হওয়া শর্তঃ لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ এই মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারসাম্যপূর্ণ তথা ন্যায়ানুগ করা হয়েছে- যাতে তারা সাক্ষ্যদানের যোগ্য হয়। এতে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি আদেশ বা ন্যায়ানুগ নয়, সে সাক্ষ্যদানের যোগ্য নয়। আদেলের অর্থ সাধারণ ‘নির্ভরযোগ্য’ করা হয়। এর সম্পূর্ণ শর্ত ফিকাহ গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত রয়েছে।

ইজমা শরীয়তের দলীল

ইমাম কুরতুবী বলেন, ইজমা (মুসলিম ঐকমত্য) যে শরীয়তের একটি দলীল, আলোচ্য আয়াত তার প্রমাণ। কারণ, আল্লাহ তা’আলা এ সম্প্রদায়কে সাক্ষ্যদাতা সাব্যস্ত করে অপরাপর সম্প্রদায়ের বিপক্ষে তাদের বক্তব্যকে দলীল করে দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ সম্প্রদায়ের ইজমা বা ঐকমত্যও একটি দলীল এবং তা পালন করা ওয়াজিব। সাহাবীগণের ইজমা তাবেয়ীগণের জন্য এবং তাবেয়ীগণের ইজমা তাঁদের পরবর্তীদের জন্য দলীলস্বরূপ।

তফসীরে মাযহারীতে বর্ণিত আছেঃ এ আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ সম্প্রদায়ের যেসব ক্রিয়াকর্ম সর্বসম্মত, তা আল্লাহর কাছে প্রশংসনীয় ও গ্রহণীয়। কারণ, যদি মনে করা হয় যে, তারা ভ্রান্ত বিষয়ে একমত হয়েছে, তবে তাদের নির্ভরযোগ্য সম্প্রদায় বলার কোন অর্থ থাকে না।

ইমাম জাসসাস বলেনঃ এই আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক যুগের মুসলমানদের ইজমাই আল্লাহর কাছে গ্রহণীয়। ’ইজমা শরীয়তের দলীল’—এ কথাটি প্রথম শতাব্দী অথবা বিশেষ কোন যুগের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয়। কারণ আয়াতে সমগ্র সম্প্রদায়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। যারা আয়াত নাযিলের সময়ে বিদ্যমান ছিলেন, তাঁরাই শুধু মুসলিম সম্প্রদায় নন; বরং কিয়ামত পর্যন্ত যত মুসলমান আসবে, তারা সবই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। সুতরাং প্রতি যুগের মুসলমানই ‘আল্লাহর সাক্ষ্যদাতা’। তাদের উক্তি দলীল। তারা কোন ভুল বিষয়ে একমত হতে পারে না।

সূরা আল-বাকারাহ ১৪৩ নং আয়াতের দ্বিতীয় অংশ

وَ مَا جَعَلۡنَا الۡقِبۡلَۃَ الَّتِیۡ کُنۡتَ عَلَیۡهَاۤ اِلَّا لِنَعۡلَمَ مَنۡ یَّتَّبِعُ الرَّسُوۡلَ مِمَّنۡ یَّنۡقَلِبُ عَلٰی عَقِبَیۡهِ ؕ وَ اِنۡ کَانَتۡ لَکَبِیۡرَۃً اِلَّا عَلَی الَّذِیۡنَ هَدَی اللّٰهُ ؕ وَ مَا کَانَ اللّٰهُ لِیُضِیۡعَ اِیۡمَانَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۴۳

(১৪৩) আপনি যে কেবলার উপর ছিলেন, তাকে আমি এজন্যই কেবলা করেছিলাম, যাতে একথা প্রতীয়মান হয় যে, কে রসূলের অনুসারী থাকে আর কে পিঠটান দেয় । নিশ্চিতই এটা কঠোরতম বিষয়, কিন্তু তাদের জন্য নয়, যাদের আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ্ এমন নন যে, তোমাদের ঈমান নষ্ট করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল করুণাময়।

তফসীরের সার-সংক্ষেপ
(আমি মুহাম্মদী শরীয়তের জন্য প্রকৃতপক্ষে কা'বাকেই কেবলা মনোনীত করে রেখেছিলাম)। আপনি যে কেবলার উপর (কিছুদিন কায়েম) ছিলেন, (অর্থাৎ বায়তুল মোকাদ্দাস) তা শুধু এ কারণেই ছিল যে, আমি (বাহ্যতও) জেনে নেই যে, (এ কেবলা সাব্যস্ত হওয়ায় অথবা পরিবর্তন হওয়ায় ইহুদী ও অ-ইহুদীদের মধ্য থেকে কে রসুলুল্লাহ (সা)-এর অনুসরণ করে এবং কে আতংকে পিঠটান দেয়। এবং ঘৃণা ও বিরোধিতা করে। এ পরীক্ষার জন্য এই সাময়িক কেবলা নির্দিষ্ট করেছিলাম। পরে প্রকৃত কেবলার মাধ্যমে এ কেবলা রহিত করে দিয়েছি। কেবলার এ পরিবর্তন (অবাধ্য লোকদের জন্য কঠোরতর বিষয়। (তবে) যাদেরকে আল্লাহ্ তা'আলা পথ প্রদর্শন করেছেন আল্লাহর নির্দেশাবলী বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হয়নি। তারা আগেও যেমন একে আল্লাহর নির্দেশ মনে করত, এখনও তা-ই মনে করে। 'বায়তুল মোকাদ্দাস প্রকৃত কেবলা ছিল না আমার এ উক্তি থেকে কেউ যেন মনে না করে যে, যেসব নামায বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে পড়া হয়েছে, তাতে সওয়াব কম হবে। কারণ, সেগুলো প্রকৃত কেবলার দিকে মুখ করে পড়া হয়নি। যাক এ কুমন্ত্রণাকে মনে স্থান দিও না। কারণ, আল্লাহ তা'আলা এমন নন যে, তোমাদের ঈমান সম্পর্কিত কাজকর্ম যেমন, নামাযের সওয়াব নষ্ট (ও হ্রাস) করে দিবেন। বাস্তবিক, আল্লাহ্ তা'আলা (এমন যে,) মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল (৩) করুণাময়। (অতএব এমন স্নেহশীল ও করুণাময় সত্তা সম্পর্কে এরূপ কু-ধারণা সঙ্গত নয়। কারণ, কেবলা আসল হওয়া না হওয়া প্রসঙ্গে আমিই জানি। তোমরা উভয়টিকে আমার নির্দেশ মনে করে কবুল করেছ, কাজেই সওয়াব হ্রাসপ্রাপ্ত হবে না)।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

কা'বা শরীফ সর্বপ্রথম কখন নামাযের কেবলা হয়

হিজরতের পূর্বে মক্কা মোকাররমায় যখন নামায ফরয হয়, তখন কা'বাগৃহই নামাযের জন্য কেবলা ছিল, না বায়তুল মোকাদ্দাস ছিল- এ প্রশ্নে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতভেদ রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ শুরু থেকেই কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস। হিজরতের পরও ষোল-সতের মাস পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাসই কেবলা ছিল। এরপর কা'বাকে কেবলা করার নির্দেশ আসে তবে রসূলুল্লাহ (সা) সভায় অবস্থানকালে হাজরে আসওয়াদ ও রোকনে ইয়ামানীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন যাতে কা'বা ও বায়তুল মোকাদ্দাস উভয়টিই সামনে থাকে । মদীনায় পৌছার পর এরূপ করা সম্ভবপর ছিল না। তাই তাঁর মনে কেবলা পরিবর্তনের বাসনা দানা বাঁধতে থাকে।--(ইবনে কাসীর)

অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণ বলেনঃ মক্কায় নামায ফরয হওয়ার সময় কা'বাগৃহই ছিল মুসলমানদের প্রাথমিক কেবলা। কেননা, হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর কেবলাও তা-ই ছিল। মহানবী (সা) মক্কায় অবস্থানকালে কা'বাগৃহের দিকে মুখ করেই নামায পড়তেন। মদীনায় হিজরতের পর তাঁর কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস সাব্যস্ত হয়। তিনি মদীনায় ষোল-সতের মাস পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়েন। এরপর প্রথম কেবলা অর্থাৎ “কা'বাগৃহের দিকে মুখ করার নির্দেশ অবতীর্ণ হয়। তফসীরে কুরতুবীতে আবূ আমরের বরাত দিয়ে এ শেষোক্ত উক্তিকেই অধিকতর বিশুদ্ধ বলা হয়েছে। এর রহস্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয় যে; মদীনায় আগমনের পর যখন ইহুদীদের সাথে মেলামেশা শুরু হয়, তখন মহানবী (সা) তাদের আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর নির্দেশে তাদের কেবলাকেই কেবলা হিসাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু পরে যখন অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইহুদীরা হঠকারিতা ত্যাগ করবে না, তখন হুযুর (সাঃ)-কে সাবেক কেবলার দিকে মুখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কারণ, পিতৃপুরুষ হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের কেবলা হওয়ার কারণে তিনি স্বভাবতই তাকে পছন্দ করতেন। "কুরতবী আবুল আলিয়া 'রিয়াহী থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত সালেহ (আঃ)-এর মসজিদের কেবলাও কা'বাগৃহের দিকে ছিল। এরপর আবুল-আলিয়া বলেন যে, জনৈক ইহুদীর সাথে একবার তিনি বিতর্কে প্রবৃত্ত হন। ইহুদী বললঃ মূসা (আঃ)-এর কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাসের 'সাখরা'। আবুল আলিয়া বলেন না, মূসা (আঃ) বায়তুল মোকাদ্দাসের সাখরার নিকটেই নামায পড়তেন, কিন্তু তাঁর মুখমণ্ডল কা'বাগৃহের দিকে থাকত। ইহুদী অস্বীকার করলে আবুল-আলিয়া বললেনঃ আচ্ছা, তোমার আমার বিতর্কের মীমাংসা সালেহ (আঃ)-এর মসজিদই করে দেবে। মসজিদটি বায়তুল মোকাদ্দাসের পাদদেশে একটি পাহাড়ে অবস্থিত। এরপর উভয়ে সেখানে গিয়ে দেখলেন, মসজিদটির কেবলা কা'বাগৃহের দিকেই রয়েছে।

যারা প্রথমোক্ত উক্তি গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মতে তাৎপর্য এই যে, মুসলমানদের মক্কা মোকাররমায় মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণ ও নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করা ছিল লক্ষ্য। এজন্য তাদের কেবলা ছেড়ে বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে হিজরতের পর মদীনায় ইহুদী ও খৃষ্টানদের বিরুদ্ধাচরণ ফুটিয়ে তোলা উদ্দেশ্য ছিল। এ কারণে তাদের কেবলার পরিবর্তে কা'বাকে কেবলা করা হয়েছিল। উপরোক্ত মতভেদের ফলে আলোচ্য আয়াতের তফসীরেও মতভেদ দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ আয়াতে উল্লিখিত কেবলার অর্থ প্রথমোক্ত উক্তি অনুযায়ী বায়তুল মোকাদ্দাস এবং শেষোক্ত উক্তি অনুযায়ী কা'বাগৃহ হতে পারে। কেননা এটাই ছিল মহানবী (সাঃ)-এর কেবলা।

উভয় উক্তি অনুযায়ী আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আমি কেবলা পরিবর্তনের ঘটনাকে আপনার অনুসারী মুসলমানদের জন্য একটি পরীক্ষা সাব্যস্ত করেছি- যাতে প্রকাশ্যভাবেও জানা যায় যে, কে আপনার খাঁটি অনুসারী এবং কে নিজ মতামতের অনুসরণ করে। বস্তুত কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ নাযিল হওয়ার পর কতিপয় দুর্বল বিশ্বাসী মুসলমান অথবা কপট বিশ্বাসী মুনাফিক ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে এবং রসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দোষারোপ করে বলে যে, তিনি স্বজাতির ধর্মের দিকেই ফিরে গেছেন।

কতিপয় মাসআলা

সুন্নাহকে কখনও কোরআনের দ্বারাও রহিত করা হয়

জাস্সাস 'আহকামুল কোরআন'- গ্রন্থে বলেনঃ কোরআন মজীদে কোথাও একথা উল্লেখ নেই যে, রসূলুল্লাহ (সা)-কে হিজরতের পূর্বে অথবা পরে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল; বরং একথার প্রমাণ শুধু হাদীস ও সুন্নাহ থেকে পাওয়া যায়। অতএব, যে বিষয়টি সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল, কোরআনের আয়াত সেটি রহিত করে কা'বাকে কেবলা করে দিয়েছে।

এতে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে, হাদীসও একদিক দিয়ে কোরআন এবং কিছু বিধি-বিধান 'এমনও আছে, যা কোরআনে উল্লিখিত নেই--শুধু হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত। কোরআন ঐসব "বিধি-বিধানের শরীয়তপত মর্যাদা স্বীকার করে। কেননা আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে একটাও বলা হয়েছে যে, যেসব নামায রসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে পড়া হয়েছে, তার আল্লাহর কাছে গ্রহণীয়।

'খবরে ওয়াহিদ' 'কারীনা' দ্বারা জোরদার হলে তদ্দারা কোরআনী নির্দেশ রহিত মনে করা যায়


বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থে একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আসার পর মহানবী (সা) প্রথম কা'বাগৃহের দিকে মুখ করে আসরের নামায পড়েন (কোন কোন রেওয়ায়েতে আসরের পরিবর্তে যোহরের নামাযেরও উল্লেখ রয়েছে)। জনৈক সাহাবী নামাযের পর এখান থেকে বাইরে গিয়ে দেখতে পান যে, বনী সালামা গোত্রের মুসলমানরা নিজেদের মসজিদে পূর্বের ন্যায় বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করেই নামায পড়ছেন। তিনি সজোরে বললেন, এখন কেবলা কা'বার দিকে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে কা'বার দিকে মুখ করে নামায পড়ে এসেছি। একথা শুনে তাঁরা নামাযের মধ্যেই বায়তুল মোকাদ্দাসের দিক থেকে কা'বার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নোয়ায়লা বিনতে মুসলিম বর্ণিত রেওয়াতে আছে, তখন মহিলারা পেছনের কাতার থেকে সামনে এসে যায় এবং পুরুষরা সামনের কাতার থেকে পেছনে চলে যায়। যখন কা'বার দিকে মুখ ফেরানো হলো, তখন পুরুষদের কাতার ছিল সামনে, আর মহিলাদের কাতার ছিল পেছনে। (ইবনে কাসীর)

বনু সালমার মুসলমানরা যোহর অথবা আসরের নামায থেকেই কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ কার্যকর করে নেয়। কিন্তু কোবার মসজিদে এ সংবাদ পরদিন ফজরের নামাযে পৌঁছায় তারাও নামাযের মধ্যেই বায়তুল মোকাদ্দাসের দিক থেকে কা'বার দিকে মুখ করে নেন। (ইবনে কাসীর, জাসাস)

ইমাম জাসসাস এসব হাদীস উদ্ধৃত করার পর বলেনঃ

هذا خبر صحيح مستفيض فى ايدى أهل العلم قد تلقوه بالقبول فصار خبر التواتر الموجب للعلم.

অর্থাৎ- এ হাদীসটি প্রকৃতপক্ষে খবরে ওয়াহিদ হলেও শক্তিশালী কারীনার কারণে তাওয়াত্তুরের তথা ধারাবাহিক রেওয়ায়েতের পর্যায়ে পৌঁছে যা নিশ্চিত জ্ঞান দান করে।

কিন্তু হানাফী মযহাবের ফিকহবিদগণের নীতি এই যে, খবরে ওয়াহিদ দ্বারা কোন অকাট্য কোরআনী নির্দেশ রহিত হতে পারে না। এমতাবস্থায়, হানাফী আলিমগণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন থেকে যায় যে, তাঁরা এ হাদীস গ্রহণ করে কিভাবে কোরআনের নির্দেশ রহিত স্বীকার করলেন? হাদীসটি তাওয়াত্তুরের পর্যায়ে পৌঁছলেও পৌঁছেছে পরবর্তীকালেঃ সংবাদটি প্রথম বনু সালমা গোত্রের লোকদের একজনেই দিয়েছিল। জাসাস বলেন, আসল ব্যাপার এই যে, বনু সালমাসহ সাহাবীগণ আগেই জানতেন যে, রসূলুল্লাহ্ (সা) কা'বাকে কেবলা করার বাসনা পোষণ করেন। তিনি এজন্য দোয়াও করতেন। এই বাসনা ও দোয়ার কারণে সাহাবীগণের দৃষ্টিতে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করার নির্দেশটি ভবিষ্যতে বলবৎ না থাকার আশংকা প্রকট হয়ে উঠেছিল। এ সম্ভাবনার কারণে বায়তুল মোকাদ্দাসে কেবলা থাকার বিষয়টি ধারণাভিত্তিক হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং তা রহিত করার জন্য খবরে ওয়াহিদই যথেষ্ট হয়েছে। অন্যথায় শুধু খবরে ওয়াহিদ দ্বারা কোরআনী নির্দেশ রহিত হওয়া অযৌক্তিক।

লাউডস্পীকারের শব্দে নামাযে উঠা-বসা করলে নামায নষ্ট না হওয়ার প্রমাণ

সহীহ বুখারীর 'কেবলা' অধ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণিত হাদীসে কোরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার পর কেবলা পরিবর্তনের সংবাদ পৌছা ও নামাযের মধ্যেই মুসল্লীদের কা'বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে আল্লামা আইনী হানাফী বলেনঃ........ অর্থাৎ এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি নামাযে শরীক নয়, সে নামাযে শরীক ব্যক্তিকে শিক্ষা দিতে পারে। (উমদাতুল ক্বারী, ৪র্থ খণ্ড, ১৪৮ পৃ.)

'আল্লামা আইনী এ হাদীস প্রসঙ্গে অন্যত্র লিখেনঃ........ অর্থাৎ এ হাদীসেই প্রমাণ রয়েছে যে, মুসল্লী নামাযরত অবস্থায় নামাযের বাইরের লোকের কথা শুনতে পারে এবং তদনুযায়ী আমল করতে পারে। এতে তার নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। -- (উমদাতুল কারী, ১ম খণ্ড, ২৪২ পৃঃ)

সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফী ফিকহবিদ আলিমগণ বলেন, নামাযরত অবস্থায় নামাযের বাইরের লোকের কথায় সাড়া দিলে নামায নষ্ট হয়ে যায়। এর উদ্দেশ্য এই যে, নামাযে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নির্দেশ অনুসরণ করলে নামায নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কেউ যদি কোন মানুষের মধ্যস্থতায় আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণ করে, তবে নামায ফাসেদ হবে না।

ফিকহবিদগণ আরও একটি মাসআলা লিখেছেন। তা এই যে, যদি কেউ নামাযের জামা'আতে শরীক হওয়ার জন্য এমন সময় আসে, যখন প্রথম কাতার পূর্ণ হয়ে যায় এবং তাকে একাকী পেছনের কাতারে দাঁড়াতে হয়, তবে সে প্রথম কাতার থেকে একজনকে পেছনে টেনে নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নেবে। এখানেও প্রশ্ন আসে যে, তার কথায় যে ব্যক্তি প্রথম কাতার থেকে পেছনে সরে আসবে, সে আল্লাহ ছাড়া অন্যের আদেশ অনুসরণ করল। সুতরাং তার নামায নষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু দুররে মুখতার গ্রন্থের 'ইমামত' অধ্যায়ে এ মাস'আলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ

ثم نقل تصحيح عدم الفساد في مسئلة من جزب من الصف فتاخر

এর উপর আল্লামা তাহতাতী লেখেনঃ ........... অর্থাৎ এ অবস্থায় নামায নষ্ট না হওয়ার কারণ এই যে, প্রকৃতপক্ষে সে আগন্তুকের আদেশ পালন করেনি; বরং আল্লাহর সে আদেশই পালন করেছে যা রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছেছে যে, এরূপ অবস্থা দেখা দিলে সামনের কাতার থেকে পেছনে সরে আসা উচিত।

'শরহে ওয়াবানীয়া' গ্রন্থে শরণবলালী (র) এ মাসআলা উল্লেখ করে নামায নষ্ট হওয়া `সম্পর্কিত অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। এরপর নিজের ভাষায় এভাবে তা খণ্ডন করেছেন ৪

اذا قيل لمصل تقدم فتقدم (الى) فسدت صلوته . لانه امتثل امر غير
الله في المحلوة ، لان امتثاله إنما هو لامر رسول الله صلى اله عليه وسلم فلا يضر

উল্লিখিত সব রেওয়ায়েত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোন ব্যক্তি নামাযরত অবস্থার নামাযের বাইরের কোন লোকের কথায় সাড়া দিলে তা দুই কারণে হতে পারে। প্রথমত, বাইরের ব্যক্তির সন্তুষ্টির জন্য সাড়া দেওয়া। এ অবস্থায় নামায নষ্ট হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, সে ব্যক্তি যদি কোন মাসআলা 'বলে এবং নামাধী তা অনুসরণ করে, তবে তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আদেশেরই অনুসরণ। এজন্য তার নামায নষ্ট হবে না। আল্লামা তাহতাতীর মীমাংসাও তা-ই।

اقول لو قيل بالتفصيل بين كونه امتثل أمر الشارع فلا تفسد وبين كونه امتثل امر الداخل مراعاة لخاطره من غير نظر إلى أمر الشارع فتفسد لكان حسنا (طحطاوي على الدررص ٢٤٧ ج ٢).

এভাবে লাউডস্পীকারের মাসআলাটির মীমাংসাও সহজ হয়ে যাচ্ছে। এখানে লাউডস্পীকারের অনুসরণ করার কোন সম্ভাবনাই নেই। বরং এক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ নির্দেশেরই অনুসরণ করা হয় যে, ইমাম যখন রুকু করে, তখন তোমরাও রুকু কর, ইমাম যখন সিজদা করে, তখন তোমরাও সিজদা কর। লাউডস্পীকার দ্বারা শুধু এতটুকু জানা যায় যে, এখন ইমাম রুকূ অথবা সিজদায় যাচ্ছেন। এটা জানার পর মুসল্লী ইমামেরই অনুসরণ করে, লাউডস্পীকারের নয়। বস্তুত ইমামের অনুসরণ হলো আল্লাহর নির্দেশ।

উপরোক্ত আলোচনা এ ভিত্তিতে করা হলো যে, কারো কারো মতে লাউডস্পীকারের আওয়াজ হুবহু ইমামের আওয়াজ নয়; বরং ইমামের আওয়াজের উদ্ধৃতি ও বর্ণনা। কিন্তু এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই যে, লাউডস্পীকারের আওয়াজ হুবহু ইমামেরই আওয়াজ (লাউডস্পীকারের নিজস্ব কোন আওয়াজ নেই)। এমতাবস্থায় নামায জায়েয হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এখানে 'ঈমান' শব্দ দ্বারা ঈমানের প্রচলিত অর্থ নেওয়া হলে আয়াতের মর্ম হবে এই যে, কেবলা পরিবর্তনের ফলে নির্বোধেরা মনে করতে থাকে যে, এরা ধর্ম ত্যাগ করেছে কিংবা এদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের ঈমান নষ্ট করবেন না। কাজেই তোমরা নির্বোধদের কথায় কর্ণপাত করো
কোন কোন হাদীসে এবং মনীষীদের উক্তিতে এখানে ঈমানের অর্থ করা হয়েছে নামায। মর্মার্থ এই যে, সাবেক কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে যে সব নামায পড়া হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা সেগুলো নষ্ট করবেন না; বরং তা শুদ্ধ ও মকবুল হয়েছে।
সহীহ বুখারীতে ইবনে- 'আযেব (রা) এবং তিরমিযীতে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, কা'বাকে কেবলা করার পর অনেকেই প্রশ্ন করে যে, যে সব মুসলমান ইতিমধ্যেই ইন্তিকাল করেছেন, তাঁরা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে নামায পড়ে গেছেন-- কা'বার দিকে নামায পড়ার সুযোগ পাননি, তাঁদের কি হবে? এ প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। এতে নামাযকে 'ঈমান' শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের সব নামাযই শুদ্ধ ও গ্রহণীয়। তাদের ব্যাপারে কেবলা পরিবর্তনের কোন প্রতিক্রিয়া হবে না।



**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url