কুরআনের গল্পঃ আদ সম্প্রদায়কে কিভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল?






আদ সম্প্রদায়ের ধ্বংসের বর্ণনা


এর পরও তাদের আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ এমন চরমে পৌঁছল যে, আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি আযাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিন বছর পর্যন্ত বৃষ্টি বন্ধ করে দিলেন । ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। আর দুর্ভিক্ষ এমন চরম আকার ধারণ করল যে, তাদের নাকের ডগায় রূহ এসে পড়ল। তখনকার যুগে প্রথা ছিল তারা কোন বিপদাপদে পতিত হলে সকলে মিলে মক্কা শরীফে আল্লাহর ঘরের সামনে সমবেত হয়ে বিপদ দূর করার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করত। প্রথা অনুসারে তারা নিজেদের মধ্য হতে কিছু লোককে মক্কায় পাঠাল যাতে তারা সেখানে গিয়ে আল্লাহ্ পাকের কাছে দোয়া করে, তিনি যেন তাদের উপর থেকে বিপদ দূর করে দেন। আর বৃষ্টি বর্ষণ করেন।

   

তৎকালে মক্কায় আমালিকা বংশের কিছুলোক বসবাস করত। তখন আমালিকা সম্প্রদায়ের প্রধান ছিল মুয়াবিয়া বিন বকর। ভিনদেশী যে সব লোক মক্কায় আসত তাদের মেহেমানদারী আমালিকা বংশের লোকেরা করত। এ হিসাবে আদ জাতির প্রতিনিধি দলও মুয়াবিয়া বিন বকরের মেহেমান হল। দুর্ভিক্ষের কারণে তারা এক দীর্ঘ সময় ধরে ভুখা-নাঙ্গা ছিল। মক্কায় পৌঁছে ভাল ভাল খাদ্য আর পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় তারা স্বীয় সম্প্রদায়ের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে উদ্দেশ্যে তাদেরকে পাঠিয়েছে তা তারা ভুলে গিয়েছিল। মুয়াবিয়া বিন বকর লজ্জার কারণে নিজে কিছু বলতে পারলেন না। তাই তিনি গায়িকাদেরকে কিছু কবিতা শিখিয়ে দিলেন। কবিতাগুলোর অর্থ ছিল “হে লোকেরা তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য দোয়া কর। যাতে তাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেন। তোমরা তো এখানে ভোগবিলাসে মত্ত কিন্তু তাদের অবস্থা খুব খারাপ ও নাজুক। গায়িকাদের মুখে এ কবিতা শুনে তারা সতর্ক হয়ে গেল এবং দোয়া করার জন্য কাবাঘরের সামনে উপস্থিত হল। সেখানে গিয়ে দোয়া করল। দোয়ার পর সাদা, কাল ও লাল বর্ণের তিন খণ্ড মেঘ আকাশে দেখা গেল। আর তখন আসমান হতে এক আওয়াজ এল যে, তোমরা মেঘ খণ্ডত্রয় হতে যে কোন একটি স্বীয় সম্প্রদায়ের জন্য বেছে নাও। তারা মেঘ খণ্ডত্রয় হতে কাল বর্ণের মেঘখন্ডটি বেছে নিল। তাদের ধারণা ছিল যে, কাল মেঘে অধিক পানি থাকবে। তাই অধিক পানি লাভের উদ্দেশ্যেই কাল মেঘ খণ্ড নিজেদের জন্য পছন্দ করেছিল। অতঃপর কাল মেঘ খণ্ড তাদের সাথে তাদের সম্প্রদায়ের দিকে উড়ে চলল। মেঘ খণ্ড নিকটবর্তী হলে তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা তা দেখতে পেয়ে খুব আনন্দিত হল। কুরআনে পাকে ইরশাদ হয়েছে-

فَلَمَّا رَاَوۡهُ عَارِضًا مُّسۡتَقۡبِلَ اَوۡدِیَتِهِمۡ ۙ قَالُوۡا هٰذَا عَارِضٌ مُّمۡطِرُنَا

উচ্চারণ : ফালাম্মা-রাআওহু 'আ-রিদ্বোয়াম্ মুসতাকবিলা আও দিয়াতিহিম্, কা-লু হা-যা আ-রিদ্বুম মুমতিরুিনা- 

অর্থ : অতঃপর এ মেঘ খণ্ডটি তাদের জনপদের দিকে আসছে দেখে তারা বলল, এ দিকে আগত মেঘ খণ্ডটি আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করবে। (আল আহকাফ, ২৪) 

কিন্তু আদজাতির এক মহিলা মেঘ খণ্ডটি দেখে বুঝতে পেরেছিল যে, এ মেঘ রহমতের মেঘ নয় এবং এটা আযাব হিসাবেই জনপদের দিকে আসছে। আল্লামা আলুসী (রঃ) এক বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, যার সারকথা হল, এ মেঘখণ্ড যে আযার নিয়ে এসেছিল এক মহিলা সর্বপ্রথম বুঝতে পেরেছিল যে, মেঘখণ্ডটি পানির পরিবর্তে অগ্নি বহন করে জনপদের দিকে এগিয়ে আসছে। পরবর্তীকালে আযাব অবতীর্ণ হওয়ার পর অন্যান্যরা বুঝল যে প্রকৃতপক্ষে এটা বৃষ্টি বহনকারী মেঘ নয়।

আল্লাহপাক ইরশাদ করেন-

بَلۡ هُوَ مَا اسۡتَعۡجَلۡتُمۡ بِهٖ ؕ رِیۡحٌ فِیۡهَا عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

উচ্চারণ : বাল হুয়া মাসতা' জালতুম বিহী রীহুন ফীহা-'আযা-বুন আলীমুন । 

অর্থ : “বরং এটা এমন জিনিষ যার তড়িৎ আগমন তোমরা চেয়েছিলে। এটা প্রবল তুফান যাতে মর্মন্তুদ আযাব রয়েছে। (আল আহকাফ, ২৪)

মেঘখণ্ড আদ জাতির জন্য শান্তিদায়ক বৃষ্টির বদলে আল্লাহর আযাব হয়ে আগমন করেছে। ক্রমাগত সাতরাত আটদিন পর্যন্ত ঝড় বইতে থাকে। ঝড় এত প্রবলবেগে প্রবাহিত হচ্ছিল যে, আদ জাতির সুদৃঢ় অট্টালিকাসমূহ ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। বড় বড় বৃক্ষসমূহ চর্বিত ঘাসের ন্যায় শিকড়সহ তুলে নিক্ষেপ করছিল। শক্তির দাবীদার আদ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে একজন একজন করে উপরে তুলে সেখান থেকে মাথা নীচের দিকে করে নিক্ষেপ করে সকলকে ধ্বংস করে দিল। মাত্র চার হাজার লোক যারা হযরত হুদ (আ)-এর অনুগত ছিল তারাই বেঁচেছিল।

অন্য বর্ণনায় হযরত হুদ (আ) যখন বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে আযাব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, তখনই তিনি যেখানে ছিলেন তার চুতম্পার্শ্বে একটি বৃত্ত আঁকেন তদ্রূপ মুমিনদের চতুস্পার্শ্বে আর একটি বৃত্ত এঁকে দিলেন। মু'মিনদের কাছে উক্ত বায়ু ছিল সুশীতল বাতাসের ন্যায়। তারা এ বাতাসের সাহায্যে আরও অধিক আরাম ও সুখ ভোগ করছিল। অথচ এ বায়ুই আদ জাতিকে তাদের ঘরবাড়ী ও গাছপালাসহ তাদেরকে উপরে তুলে দূরে দূরে নিক্ষেপ করছিল । দেখে মনে হচ্ছে যে পাথরের বৃষ্টি হচ্ছে। (রুহুল মানী) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের ধ্বংসের কথা বর্ণনা করেছেন-

 وَ اذۡکُرۡ اَخَا عَادٍ ؕ اِذۡ اَنۡذَرَ قَوۡمَهٗ بِالۡاَحۡقَافِ وَ قَدۡ خَلَتِ النُّذُرُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡهِ وَ مِنۡ خَلۡفِهٖۤ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّا اللّٰهَ ؕ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۲۱   قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا لِتَاۡفِکَنَا عَنۡ اٰلِهَتِنَا ۚ فَاۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَاۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۲۲  قَالَ اِنَّمَا الۡعِلۡمُ عِنۡدَ اللّٰهِ ۫ۖ وَ اُبَلِّغُکُمۡ مَّاۤ اُرۡسِلۡتُ بِهٖ وَ لٰکِنِّیۡۤ اَرٰىکُمۡ قَوۡمًا تَجۡهَلُوۡنَ ﴿۲۳ فَلَمَّا رَاَوۡهُ عَارِضًا مُّسۡتَقۡبِلَ اَوۡدِیَتِهِمۡ ۙ قَالُوۡا هٰذَا عَارِضٌ مُّمۡطِرُنَا ؕ بَلۡ هُوَ مَا اسۡتَعۡجَلۡتُمۡ بِهٖ ؕ رِیۡحٌ فِیۡهَا عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿ۙ۲۴  تُدَمِّرُ کُلَّ شَیۡءٍۭ بِاَمۡرِ رَبِّهَا فَاَصۡبَحُوۡا لَا یُرٰۤی اِلَّا مَسٰکِنُهُمۡ ؕ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡقَوۡمَ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۲۵


অর্থ : আর স্মরণ কর ‘আ’দ সম্প্রদায়ের ভাইয়ের কথা, যখন সে আহকাফের স্বীয় সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিল। আর এমন সতর্ককারীরা তার পূর্বে এবং তার পরেও গত হয়েছে যে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করো না। নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর এক ভয়াবহ দিনের আযাবের আশঙ্কা করছি’। তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্যদের থেকে নিবৃত্ত করতে আমাদের নিকট এসেছ? তুমি যদি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও, তাহলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো’। সে বলল, ‘এ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে। আর যা দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে, আমি তোমাদের কাছে তা-ই প্রচার করি, কিন্তু আমি দেখছি, তোমরা এক মূর্খ সম্প্রদায়’। অতঃপর যখন তারা তাদের উপত্যকার দিকে মেঘমালা দেখল তখন তারা বলল, ‘এ মেঘমালা আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে’। (হূদ বলল,) বরং এটি তা-ই যা তোমরা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে। এ এক ঝড়, যাতে যন্ত্রণাদায়ক আযাব রয়েছে’। এটা তার রবের নির্দেশে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে’। ফলে তারা এমন (ধ্বংস) হয়ে গেল যে, তাদের আবাসস্থল ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এভাবেই আমি অপরাধী কওমকে প্রতিফল দিয়ে থাকি।  (সুরা আহকাফ, ২১-২৫)

আদ সম্প্রদায়ের প্রতি নাযিলকৃত আযাব যে কত প্রবল ছিল তা রাসূলুল্লাহ (স)-এর আমলের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়। নবী করীম (স) যখনই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখতেন তখনই আদ জাতির আযাবের কথা স্মরণ করে অস্থির হয়ে পড়তেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, যখনই বায়ু জোরে প্রবাহিত হতে শুরু হয় তখনই রসূলুল্লাহ (স) নিম্নের দোয়া পড়তেন- 

উচ্চারণ : আল্লাহ-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা খাইরাহা-অখাইরাহা- মা- ফীহা অখাইরা মা আরসালতা বিহী অ আউযুবিকা মিন শাররিহা অশাররিমা ফীহা অশাররি মা আরসালতা বিহী।

অর্থ “হে আল্লাহ্! নিশ্চয়ই আমি আপনার দরবারে বায়ুর কল্যাণ, বায়ুর ভিতরে যা কিছু আছে তার কল্যাণকর অংশ এবং যা সহ এ বায়ু চালিত করেছেন তার ভিতরে যা কল্যাণকর তা কামনা করছি। আর এ বায়ুর মধ্যে যাকিছু আছে তার অনিষ্টকর অংশ এবং যা সহ আপনি এ বায়ু চালিত করেছেন তার মাঝে যা অনিষ্টকর তা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখলেই রাসূলুল্লাহ (স)-এর পবিত্র চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। একবার ঘরের বাইরে আসতেন আবার ঘরের ভিতরে যেতেন। কখনো হাঁটাহাঁটি করতেন আবার কখন বা বসে পড়তেন। বৃষ্টি হওয়া শুরু হলে চিন্তাভাবনা দূরীভূত হয়ে মুখমণ্ডলের বর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসত। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখলে আপনার এ অবস্থা কেন হয়? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাবে বলেন, “হে আয়েশা। আকাশে মেঘ দেখা দিলে আমি তো জানিনা যে, এটা কেমন মেঘ? না জানি এটা ঐ সম্প্রদায়ের মেঘের ন্যায় হয়ে যায় যে সম্প্রদায়ের লোকজন আকাশে মেঘ খণ্ড দেখে খুব আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন, এটা আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করবে। যাতে আমরা প্রশান্তি লাভ করব।" (মুসলিম)







*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url