রমজানের বিশেষ প্রবন্ধঃ মহিমান্বিত রজনী শবে কদরে কী করার কথা, কী করছি!






মহিমান্বিত রজনী শবে কদরে কী করছি? কী করব?

   

আল্লাহ তাআলার ফজল ও করমে রমজানের শেষ দশক শুরু হয়ে গেছে। রমজানের এই শেষ দশক পুরো মাসের নির্যাসের মতো। যদিও পুরো রমজানই আল্লাহ পাকের রহমত ও বরকত নাজিল হওয়ার মাস এবং এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তই অতি মূল্যবান; কিন্তু বিশেষ করে এই শেষ দশক আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হওয়ার বিশেষ সময়। অধিকন্তু এ শেষ দশকের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা শবে কদরের মতো অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ রজনী রেখেছেন, যা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে—

 اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰهُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ ۚ﴿ۖ۱   وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ؕ﴿۲  لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَهۡرٍ ؕ﴿ؔ۳   تَنَزَّلُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ الرُّوۡحُ فِیۡهَا بِاِذۡنِ رَبِّهِمۡ ۚ مِنۡ کُلِّ اَمۡرٍ ۙ﴿ۛ۴   سَلٰمٌ ۟ۛ هِیَ حَتّٰی مَطۡلَعِ الۡفَجۡرِ ﴿۵

নিশ্চয়ই আমি এটা (অর্থাৎ কুরআন) শবে কদরে নাজিল করেছি। আপনি কি জানেন, শবে কদর কী? শবে কদর এক হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফিরেশতাগণ ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। সে রাত (আদ্যোপান্ত) শান্তি – ফজরের উদয় পর্যন্ত। [সুরা কদর: ১-৫)

এর অর্থ হলো, যদি কোনো ব্যক্তি এক হাজার রাত নয়; বরং এক হাজার মাস একটানা ইবাদত করে, তাহলে সে যে পরিমাণ আজর ও সাওয়াব লাভ করবে, লাইলাতুল কদরে ইবাদতকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তারচেয়েও বেশি আজর ও সাওয়াব দান করবেন!

শবে কদর উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য আল্লাহর বিশেষ দান

কোনো কোনো রেওয়ায়েতে এর কারণ এই বর্ণিত হয়েছে যে, একবার জনৈক সাহাবি নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, কুরআনুল কারিমে পূর্ববর্তী জাতিবর্গ সম্পর্কে এসেছে যে, তারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করত। 

যেমন হজরত নুহ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে—

وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِهٖ فَلَبِثَ فِیۡهِمۡ اَلۡفَ سَنَۃٍ اِلَّا خَمۡسِیۡنَ عَامًا ؕ

আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি তাদের মাঝে পঞ্চাশ কম-একহাজার বছর অবস্থান করেছিলেন। [সুরা আনকাবুত: ১৪]

উক্ত সাহাবি প্রশ্ন করলেন, তারা তো অনেক দীর্ঘ জীবন লাভ করত। ফলে তাদের ইবাদতের পরিমাণও অনেক বেশি হতো। আমাদের হায়াত তো তাদের তুলনায় অনেক কম। আমরা কীভাবে ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারব?

সাহাবির এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই সুরা কদর অবতীর্ণ হয়। এ সুরার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মাদিকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমাদের হায়াত ও জীবনকাল যদিও তাদের ন্যায় দীর্ঘ নয়; কিন্তু আমি তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করে এমন একটি রাত দান করেছি, যে রাতের ইবাদত হাজার রাতের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আর সে রজনী হলো লাইলাতুল কদর।

শবে কদরের শিক্ষা কলহ-বিবাদ পরিহার

   

শুরুতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ওহির মাধ্যমে নির্দিষ্ট করেই জানানো হয়েছিল যে, রমজানের অমুক রাত লাইলাতুল কদর। কিন্তু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বিষয়টি সাহাবিদের জানানোর উদ্দেশ্যে বের হলেন, পথিমধ্যে দুজন ব্যক্তিকে বাদানুবাদে লিপ্ত দেখতে পেলেন। তাদের এই বিবাদের বে-বরকতির কারণে নবীজি সেই নির্দিষ্ট তারিখের কথা ভুলে গেলেন।

প্রকৃতপক্ষে তো আল্লাহর ইলমে পূর্ব থেকেই এরূপ নির্ধারিত ছিল যে, শবে কদর অনির্ধারিত রাখা হবে, যেন বান্দা একে অন্বেষণ করতে গিয়ে কিছু চেষ্টা ও সাধনা করে, কিছু বেশি ইবাদত করে। কিন্তু প্রথমে রাসুলকে অবগত করা, এরপর ভুলিয়ে দেওয়ার পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ হিকমত ও রহস্য নিহিত আছে। এর উদ্দেশ্য, মুসলমানগণ যেন উপলব্ধি করতে পারে যে, পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ, কলহ- বাদানুবাদ অত্যন্ত গর্হিত বিষয়। বিবাদ-বিসংবাদ এত মন্দ যে, এর বে-বরকতির কারণে নবীজিকে শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখ ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং মুসলমানদের কর্তব্য হলো ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কারও সঙ্গে যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হয়, যুক্তিতে মননে সামঞ্জস্য না হয়, তার সঙ্গে মেলা-মেশা, ওঠা-বসা করা তো জরুরি কিছু নয়। দেখা হলে সালাম দেবেন, সালাম দিলে উত্তর দেবেন, অসুস্থ হলে ইসলামি শিষ্টাচারের দাবি অনুযায়ী শুশ্রূষার জন্য যাবেন। এতটুকু হক যদি আদায় করেন, এরপর তার সঙ্গে অতিরিক্ত সম্পর্ক না রাখেন, কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু এর পরিবর্তে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি-হানাহানি, তর্ক-বিতর্ক করা মোটেই সমীচীন নয়; বরং এগুলো মানুষের মনকে বিরাগ ও বিমুখ করে দেয়। সুতরাং আগত শবে কদর হতে এই শিক্ষাও গ্রহণ করুন যে, আমরা ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি-হানাহানি, তর্ক-বিতর্ক যথাসম্ভব পরিহার করব এবং এগুলোর মন্দ পরিণতি থেকে বেঁচে থাকব।

অনির্দিষ্ট শবে কদরেও আছে বান্দার প্রতি করুণা-দান

যাই হোক, এ কথা আরজ করছিলাম যে, বিশেষ হিকমতের কারণে আল্লাহ পাক শবে কদরের তারিখ নির্দিষ্ট রাখেননি। প্রথমে নবীজিকে জানানোর পর তা আবার বিস্মৃত করে দিয়েছেন। এখন রমজানের শেষ দশকের যেকোনো বেজোড়(৩২) রাতে শবে কদর হতে পারে। কোনো রাত তা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া হয়নি। হতে পারে একুশতম রাতে, হতে পারে তেইশতম রাতে, হতে পারে পঁচিশ, সাতাশ কিংবা উনত্রিশতম রাতে। এ পাঁচ রজনীর যেকোনো একটিতেই শবে কদর হতে পারে। এভাবে অনির্ধারিত রাখার একটি হিকমত হলো বান্দা যেন শবে কদর প্রাপ্তির আশায় বেজোড় পাঁচ রাতেই কিছু কিছু ইবাদত করে এবং পাঁচ রাতেই শবে কদর তালাশ করে।

   

এমনকি আজ একুশ তারিখের রাতও শবে কদর হতে পারে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একবার জানিয়ে দেওয়া হলো, যে রাত শবে কদর হবে, সে রাতে আপনি কাদা-পানিতে সিজদা করবেন। অর্থাৎ বৃষ্টির পানি জমে যাবে।

দেখা গেল, বিশ তারিখ দিনে খুব বৃষ্টি হলো। মসজিদে নববির ভেতর কাদা হয়ে গেল, পানি জমে গেল। ফলে নবীজি সে রাতে কাদাপানির মাঝেই সিজদা করলেন। আলামত দ্বারা বোঝা গেল, সে রাতই শবে কদর ছিল।

সুতরাং শবে কদর অনির্ধারিতভাবে শেষ দশকের যেকোনো বেজোড় রাতেই হতে পারে। শবে কদরের দাবি হলো বেজোড় রাতগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত করা; ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়া।

শবে কদর রুসমের রাত নয়

কিন্তু এর পরিবর্তে এ রাতে জলসার আয়োজন?! ডেকচি ভরে খাবার রান্না?! মিষ্টি-জিলাপি বিতরণ?! বয়ান ও বক্তৃতার দীর্ঘ আসর জমানো?! না, এ রাত এসব কাজের জন্য নয়। এ রাতে তো অবস্থা এই হবে যে, বান্দা আছে আর তার সঙ্গে কেবল তার রব আছেন। এ রাত রাব্বে কারিমের সঙ্গে নির্জনে একান্তে কাটানোর রাত। এ রাত আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক গড়ার রাত। আমরা এ রাতে লম্বা বয়ান, খানা-পিনা আর মিষ্টি-জিলাপি বিলানোর যে আয়োজনে মেতে থাকি, তা মোটেই ঠিক নয়। আমাদের সমাজের বড় নিন্দনীয় এক রীতি হলো প্রত্যেক ভালো কাজের মাঝেই এমন কিছু রুসম-রেওয়াজের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়, যা উক্ত কাজের মূল রূহানিয়াত ও প্রাণশক্তিকেই নিঃশেষ করে দেয়।

ফজিলতপূর্ণ এ রাত আমাদের কেটে যায় জলসা ও বয়ানের মাহফিল আয়োজনে, ডেকচি-দস্তর, মিষ্টি-জিলাপির ব্যবস্থাপনায়। শবে কদরের ইবাদতের তাওফিক আর হয় না। এটা শবে কদরের বে-কদরি, এ মহিমান্বিত রজনীর অবমূল্যায়ন। এ রাতে কর্তব্য হলো আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে যত বেশি সম্ভব ইবাদত করা।

শবে কদরে করণীয় আমল

কী ইবাদত করব? কিছু নফল নামাজ পড়ি। যেকোনো নফল নামাজেই উত্তম হলো একটু দীর্ঘ কেরাত পড়া, দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু ও দীর্ঘ সিজদা করা। কিয়াম অবস্থায় দীর্ঘ কেরাত পড়ুন, কিয়াম দীর্ঘ হয়ে যাবে। রুকু- সিজদায় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত (মাসুর) দোয়াসমূহ পাঠ করুন। এ হাদিস তো আপনারা পূর্বেও শুনেছেন যে, বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করে সিজদার হালতে। সুতরাং সিজদার হালতে খুব দোয়া করুন। আর কী দোয়া করবেন, তাও নবীজি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, কুরআন আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে। কুরআনের যে সমস্ত দোয়া মুখস্থ আছে, সিজদার মধ্যে সেগুলো আল্লাহর দরবারে পেশ করুন ।

 رَبَّنَا ظَلَمۡنَاۤ اَنۡفُسَنَا ٜ وَ اِنۡ لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَ تَرۡحَمۡنَا لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۲۳

হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা আপন সত্তার ওপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন, তাহলে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। [সুরা আ'রাফ: ২৩]

رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ حَسَنَۃً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ 

হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে দান করুন দুনিয়ায় কল্যাণ এবং আখিরাতেও কল্যাণ এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন । [সুরা বাকারা: ২০১]

কুরআন মাজিদের যত দোয়া মুখস্থ আছে, হাদিস শরিফের যত দোয়া মুখস্থ আছে, সিজদার মধ্যে সব করুন।

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রুকু অবস্থায় বান্দা আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবিহ বেশি করবে। রুকুর নির্ধারিত তাসবিহ 'সুবহানা রাব্বিয়াল আযিম' তিনবার, পাঁচবার, সাতবার যতবার ইচ্ছা পড়ুন। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হামদ ও প্রশংসাবাক্য যা জানা আছে, তা পড়ুন।
যেমন:

سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ، سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيْمِ 
سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ
سُبُّوحٌ قُدُّوسُ رَبُّنَا وَرَبُّ الْمَلَائِكَةِ وَالرُّوْحِ
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ

সুতরাং রুকু অবস্থায় উত্তম হলো আল্লাহর হামদ ও ছানা বেশি বেশি করা। আর সিজদার হালতে সর্বোত্তম আমল হলো আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করা। সিজদার মাসনুন জিকির 'সুবহানা রাব্বিয়াল আলা' তিনবার, পাঁচবার, সাতবার যতবার মনে চায় করে নিন; এরপর খুব দোয়া করুন। নবীজি সাধারণত আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন। কখনো কম পড়তেন, কখনো বেশিও পড়তেন; কিন্তু সাধারণত নবীজি আট রাকাত তাহাজ্জুদই পড়তেন। তাই এ রাতগুলোতে তাহাজ্জুদের নিয়তে আট রাকাত নফল পড়তে পারেন। আট রাকাতে যত দীর্ঘ কেরাত পড়তে পারেন, পড়ুন। রুকু-সিজদা দীর্ঘ করুন।

হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী কুরআন তিলাওয়াত সর্বোত্তম জিকির। আট রাকাত নামাজ পড়ার আগে-পরে কিছু কুরআন তিলাওয়াত করুন।

তৃতীয় আমল হলো জিকির। চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ—বেশি বেশি পড়ুন। সবসময় জিকির দ্বারা জবান তাজা রাখুন। এক মুহূর্ত সময়ও যেন নষ্ট না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন। 

দোয়া কেবল প্রয়োজন পূরণে সহায়ক নয়, স্বতন্ত্র ইবাদত

আর সমস্ত ইবাদতের সারনির্যাস হচ্ছে দোয়া। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, দোয়া সকল ইবাদতের সার। সুতরাং এ রাতগুলোতে নিজের প্রয়োজনের কথা আল্লাহর দরবারে পেশ করুন। দোয়া করলে আল্লাহ বড় খুশি হন। আল্লাহ তাআলা কত মহান! বান্দা নিজের প্রয়োজনে দোয়া করে, সে দোয়াকেও তিনি ইবাদতের মধ্যে গণ্য করেন। আমরা দোয়া করি নিজেদের পার্থিব প্রয়োজনে, জীবিকা ও সুস্থতা, শান্তি ও নিরাপত্তা, পরীক্ষায় সফলতা, ঘরে বা ক্ষেত-খামারে বরকত ইত্যাদি দরকারে; কিন্তু প্রতিটি দোয়াকে আমাদের আমলনামায় ইবাদত হিসেবে লেখা হয় এবং বিনিময়ে সাওয়াব দান করা হয়!

মুমিনের কোনো দোয়াই নিষ্ফল নয়

সুতরাং মুমিনের কোনো দোয়াই নিষ্ফল বা বেকার যায় না। অনেক সময় বাহ্যিকভাবে মনে হয়, দোয়া তো কবুল হলো না; কিন্তু বাস্তবতা হলো, দোয়ার প্রতিদানে আল্লাহ তাআলা বান্দার কাম্য বস্তু হতেও উত্তম কোনো বস্তু তাকে দান করেন। নির্বোধ বান্দা হয়তো চেয়েছে তার জন্য ক্ষতিক্ষর কোনো জিনিস কিংবা তুচ্ছ কোনো বস্তু; কিন্তু আল্লাহ তাআলা সেই ক্ষতিক্ষর বা তুচ্ছ জিনিসের পরিবর্তে তার জন্য কল্যাণকর বস্তু দান করে দেন। অবুঝ বান্দা মনে করে, তার দোয়া কবুল হয়নি; শুরু হয় অভিযোগ- অনুযোগ! সে বোঝেই না, আল্লাহ কত দয়া ও অনুগ্রহ করে তার দোয়া উত্তম পন্থায় কবুল করেছেন।

অনেক সময় অবুঝ শিশু ছুরি, ধারালো বস্তু বা এ জাতীয় ক্ষতিকারক বস্তু সুন্দর মনে করে ধরতে চায়, কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরে; কিন্তু স্নেহশীল পিতা জানেন, এ জিনিস বাচ্চার হাতে দিলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তখন তিনি বাচ্চার কাঙ্ক্ষিত বস্ত্র কিনে না দিয়ে ভালো কিছু কিনে দেন। তদ্রূপ আমরা অনেক সময় দোয়ার মধ্যে এমন বিষয় কামনা করি, যা পরিণামগত দিক থেকে আমাদের জন্য কল্যাণকর নয়। তখন দয়াময় আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমাদের কাম্য বিষয় দান না করে তার পরিবর্তে আমাদের জন্য কল্যাণকর কোনো বিষয় দান করেন। আমরা ভাবতে থাকি, আমাদের দোয়া কবুল হয়নি। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমাদের প্রতিটি দোয়াই কবুল হয়।

কবুল হওয়ার একটি দিক তো এও যে, প্রতিটি দোয়াকেই আমলনামায় ইবাদত হিসেবে লেখা হয় এবং দোয়া করার সঙ্গে সঙ্গে তার সাওয়াব আমলনামায় যুক্ত হয়। কত দয়াময় সত্তা আল্লাহ তাআলা। চাইলে তিনি খুশি হন! দোয়া করলেও তিনি সাওয়াব দান করেন! প্রার্থনা করলেও তিনি ইবাদত গণ্য করেন! কী কারিমানা শান! অফুরান তার দান!

দোয়া কবুল হওয়ার এই প্রথম দিকটি তো অবশ্যম্ভাবী, অবশ্যই হবে। দোয়া কবুলের দ্বিতীয় দিক হলো প্রার্থিত বিষয়টি যদি প্রকৃত অর্থেই প্রার্থীর জন্য কল্যাণকর হয়, তাহলে আল্লাহ পাক সঙ্গে সঙ্গে তা দান করেন; আর কল্যাণকর না হলে আল্লাহ পাক তাকে এর পরিবর্তে কল্যাণকর কোনো বিষয় দান করেন। এই যে প্রার্থিত বিষয়ের পরিবর্তে কল্যাণকর বিষয় প্রদান, বিষয়টি আমরা কখনো সুস্পষ্টভাবে অনুভব করি, কখনো করি না। সুতরাং খুব বেশি দোয়ার ইহতেমাম করুন। দয়াময় আল্লাহ তো দোয়ার এমন দরজা খুলে দিয়েছেন যে, দোয়া করার জন্য বাধা-ধরা কোনো শর্ত আরোপ করেননি।

সুন্দরভাবে দোয়া করার কিছু আদব আছে। যেমন কেবলামুখী হয়ে বসা, হৃদয় ও মনকে সম্পূর্ণ ফারিগ ও মুক্ত করে বসা, হাত উঠিয়ে দোয়া করা । কিন্তু মাওলায়ে কারিম দোয়া কবুল হওয়ার জন্য বিশেষ কোনো পদ্ধতিকে আবশ্যক করেননি। বরং আল্লাহ পাকের নির্দেশ হলো, বান্দা! যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থায় আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেবো। দাঁড়িয়ে ডাকো কিংবা বসে, বিছানায় আরাম করে আমার কাছে দোয়া করো কিংবা ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে, চলার পথে আমাকে স্মরণ করো কিংবা একান্তে বসে; আমি সবসময় তোমার ডাকে সাড়া দেবো, তোমার দোয়া কবুল করব, তোমাকে স্মরণ করব। সুতরাং যে অবস্থাতেই থাকো, সর্বদা আমাকে ডাকো, আমার কাছে প্রার্থনা করো, আমাকে স্মরণ করো। কুরআনের ভাষায়-

الَّذِیۡنَ یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰهَ قِیٰمًا وَّ قُعُوۡدًا وَّ عَلٰی جُنُوۡبِهِمۡ

(বুদ্ধিমান তো তারা,) যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে। [সুরা আলে-ইমরান: ১৯১

দুনিয়ার রীতি দেখুন। বড় কারও কাছে কিছু চাইতে হলে কিছু নিয়ম- কানুন, শর্ত-মূলনীতি মেনে চলতে হয়। মধ্যরাতে বারোটা এক মিনিটে আপনি কারও দরজায় করাঘাত করে যদি সাহায্যপ্রার্থনা করেন, সে আপনাকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেবে; বিরক্তির স্বরে বলবে, তোমার কি সময়জ্ঞান, বিবেচনাবোধ কিছুই নেই?! কিন্তু আল্লাহ পাক কত দয়ালু! কত মহান দাতা! আমাদের সম্বোধন করে বলছেন, বান্দা! আমার দরবারে কোনো সময়সূচি নেই, কোনো নিয়ম-কানুন, শর্ত-মূলনীতি নেই। দিনে- রাতে, সকাল-সন্ধ্যায় যখন ইচ্ছা এসে যাও; শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে যে অবস্থায় থাক, আমার কাছে চাইতে থাক, আমার দরজা কখনোই তোমার জন্য বন্ধ নয়, উন্মুক্ত সবসময়। আমার দুয়ার হতে কেউ ফেরে না শূন্য হাতে! রমজানের রাতে তো আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করতে থাকে-

يا باغي الخير أَقْبِلُ، يَا بَاغِيَ الشَّرًا أَقْصِرُه

ওহে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও।
ওহে অকল্যাণ কামনাকারী! নিবৃত্ত হও।
আছ কোনো ক্ষমার ভিখারি? আমি ক্ষমা করে দেবো।
আছ কোনো রিজিক ও জীবিকার ভিখারি? আমি রিজিক দান করব। কী আজব গাফলত আমাদের! কী আশ্চর্য উদাসীন আমরা! দাতা করুণাভরে ডাকছেন, 'এসো, নিয়ে যাও'; আর আমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলছি, 'না, প্রয়োজন নেই'। দয়াময় আল্লাহ বলছেন, বরকতময় এ রজনীগুলোতে আমার কাছে চাও, আমি তোমার আঁজলা উপচে দেবো আর আমরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ব্যস্ত জলসা-মজমার অনুষ্ঠানে, মিষ্টি- জিলাপি বিতরণে আর ডেকচি-দস্তরখানের আয়োজনে! আল্লাহ ডেকে ডেকে বলছেন, ‘আমার কাছ থেকে দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ চেয়ে নাও'; আর আমরা বলে দিচ্ছি, 'সময় কোথায়! কত ব্যস্ততা ঈদ মার্কেটিংয়ে’!

তো ভাইয়েরা! রমজানের এই সব রজনী ইবাদত করার জন্য; নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়ায় নিমগ্ন থাকার জন্য।

দোয়ার বিভিন্ন কিতাব তো উম্মাহর বিভিন্ন যুগের উলামায়ে কেরাম সংকলন করেছেন। বিভিন্ন কিতাব ছাপার অক্ষরে প্রকাশিতও হয়েছে। সেগুলো সংগ্রহ করুন। মোল্লা আলী কারি রহ.-এর 'আল-হিজবুল আজম', হাকিমুল উম্মত থানবি রহ.-এর 'মুনাজাতে মকবুল' ইত্যাদি কিতাব সংগ্রহ করতে পারেন। আমার ছোট্ট একটি রিসালা ‘পুর নুর দোয়ায়ে নামে ছাপা হয়েছে; তাতেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত অনেক দোয়া একত্র করা হয়েছে।

আমরা আল্লাহর কাছে কী চাইব, কীভাবে চাইব তাও তো জানি না। আল্লাহর কাছে কী চাইতে হয়, কীভাবে চাইতে হয় তা উপলব্ধি করার মতো সমঝ ও আকল, বিবেক ও বুদ্ধি, তমিজ ও বিবেচনাবোধ কিছুই তো আমাদের নেই। কী চাইতে হবে, কীভাবে চাইতে হবে তা সবকিছুই নবীজি আমাদের শিখিয়ে গেছেন। সুতরাং নবীজির শিক্ষা ও নির্দেশনা সামনে রেখে আমরা দোয়া করব, আল্লাহর কাছে চাইব ।

যদি আমরা এভাবে রমজানকে কাজে লাগাই, নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়ার মাধ্যমে বরকতময় এই রজনীসমূহ অতিবাহিত করি, তাহলে এই আশা করতে পারি যে, অসীম দয়াময় আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এসব রজনীর রহমত ও বরকতে সিক্ত করবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের বরকত ও কল্যাণসমূহ নসিব করুন। রমজানের অবশিষ্ট প্রতিটি ভগ্নাংশকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।





****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url