সাহাবাগণের জীবনকথা-৫৫ || আবু মূসা আল-আশয়ারী (রাঃ) এর জীবনী





আবু মূসা আল-আশয়ারী (রাঃ)


আবদুল্লাহ নাম, আবু মুসা কুনিয়াত । কুনিয়াত দ্বারাই তিনি অধিক পরিচিত। পিতা কায়েস, মাতা “তাইয়্যেবা । তাঁর ইসলামপূর্ব জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না । এতটুকু জানা যায় যে, তিনি ইয়ামনের অধিবাসী ছিলেন। তথাকার 'আল-আশয়ার গোত্রের সন্তান হওয়ায় তিনি 'আল-আশয়ারী' হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

আবু মূসার (রাঃ) প্রারম্ভিক জীবন

হযরত আবু মুসা ইসলামের পরিচয় লাভ করে ইয়ামন থেকে মক্কায় আসেন এবং রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাতে বাইয়াত হন । মক্কার 'আবদু শামস' গোত্রের সাথে বন্ধু সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিছুদিন সভায় অবস্থানের পর স্বদেশবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়ামন ফিরে যান।

হযরত আবু মূসা ছিলেন তাঁর খান্দানের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। খান্দানের লোকেরা খুব দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। প্রায় পঞ্চাশজন মুসলমানের একটি দলকে সংগে নিয়ে রসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে যাওয়ার জন্য ইয়ামন থেকে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন। সমুদ্রের প্রতিকূল আবহাওয়া এ দলটিকে হিজাযের পরিবর্তে হাবশায় ঠেলে নিয়ে যায়। এদিকে হযরত জাফর বিন আবী তালিব ও তাঁর সংগী সাথীরা- যারা তখনও হাবশায় অবস্থান করছিলেন, মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। আবু মুসা তাঁর দলটিসহ এই কাফিলার সাথে মদীনার পথ ধরলেন। তাঁরা ফদীনায় পৌঁছলেন, আর এদিকে রাসুলুল্লাহর (সাঃ) নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী খাইবার বিজয় শেষ করে মদীনায় ফিরেন। রাসুল (সাঃ) আবু মুসা ও তার সংগী সকলকে খাইবারের গনীমতের অংশ দান।

   

জিহাদের ময়দানে আবু মূসা (রাঃ)

হযরত আবু মুসা মক্কা বিজয় ও হুনাইন যুদ্ধে শরিক ছিলেন। হুনাইনের ময়দান থেকে পালিয়ে বনু হাওয়াবিন 'আওতাস উপত্যকায় সমবেত হয়। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে সমূলে উৎখাতের জন্য হযরত আবু আমেরের নেতৃত্বে একটি দল পাঠান। তারা আওতাস পৌঁছে হাওয়াযিন সরদার দুরাইদ ইউস সাম্মাকে হত্যা করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে হাশামী নামক এক মুশরিকের নিক্ষিপ্ত তীরে হযরত আবু আমের মারাত্মকভাবে আহত হন। আবু মুসা আশয়ারী পিছু ধাওয়া করে ওই মুশরিককে হত্যা করেন।

হযরত আবু আমের মৃত্যুর পূর্বে আবু মুসাকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন এবং আবু মূসার কাছে এই বলে অনুরোধ করেন যে, 'ভাই, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) খেদমতে আমার সালাম পৌঁছে দেবেন এবং আমার মাগফিরাতের জন্য দুআ করতে বলবেন।' আবু আমের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন । আবু মুসা তার বাহিনীসহ মদীনায় ফিরে এসে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট আবু আমেরের অন্তিম অসীয়াতের কথা বর্ণনা করলেন। রাসূল (সাঃ) সাথে সাথে পানি আনিয়ে অযু করলেন এবং আবু আমেরের মাগফিরাত কামনা করে দুআ করলেন। আবু মুসা আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জন্যও একটু দুয়া করুন।' রাসূল (সাঃ) দুআ করলেন, “হে আল্লাহ, আবদুল্লাহ ইবন কায়েসের পাপসমূহ মাফ করে দিন। কিয়ামতের দিন সম্মানের সাথে তাকে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ দিন।

হিজরী নবম সনে তাবুক অভিযানের তোড়জোড় চলছে। আবু মুসার সংগী-সাথীরা তাকে পাঠালেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে তাদের জন্য সওয়ারী চেয়ে আনার জন্য। ঘটনাক্রমে আবু মূসা যখন পৌঁছলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন যে কোন কারণেই হোক একটু উত্তেজিত ছিলেন। আবু মুসা আর না বুঝে আরজ করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার সাথীরা আমাকে পাঠিয়েছে, আপনি যেন তাদেরকে, সওয়ারী-দান করেন। 'রাসূল (সা) বসে ছিলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন আল্লাহর কসম, তোমাদের কোন সওয়ারী আমি দেবনা। আবু মুসা ভীত হয়ে পড়লেন, না জানি কোন বেয়াদবী হয়ে গেল। অত্যন্ত দুঃখিত মনে ফিরে এসে সংগী-সাথীদের তিনি এ দুঃসংবাদ দিলেন। কিন্তু তখনও তিনি স্থির হয়ে দাড়াতে পারেননি, এর মধ্যে হযরত বিলাল দৌড়ে এলেন আবদুল্লাহ ইবন কায়েস, কোথায় তুমি চলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তোমাকে ডাকছেন । তিনি বিলালের সাথে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) দরবারে হাজির হলেন।


রাসুল (সাঃ) নিকটেই বাঁধা দু'টি উটের দিকে ইঙ্গিত করে বললেনঃ 'এ দুটিকে তোমার সাথীদের কাছে নিয়ে যাও। হযরত আবু মূসা উট দু'টি নিয়ে গোত্রীয় লোকদের কাছে ফিরে এসে বললেনঃ “রাসূল (সাঃ) এ দু'টি উট তোমাদের সওয়ারী রূপে দান করেছেন, তবে তোমাদের কিছু লোককে আমার সাথে এমন একজন লোকের কাছে যেতে হবে যে রাসূলুল্লাহর পূর্বের কথা শুনেছিল। যাতে তোমাদের এ ধারণা না হয় যে, আমি আগে যা বলেছিলাম তা আমার মনগড়া কথা ছিল।” লোকেরা বললোঃ আল্লাহর কসম, আমরা আপনাকে সত্যবাদী বলেই বিশ্বাস করি। তবে আপনি যখন বলছেন, চলুন এভাবে কিছু লোককে সংগে নিয়ে তিনি তাঁর পূর্বের কথার সত্যতা প্রমাণ করেন।

ইয়ামনের ওয়ালী আবু মূসা (রাঃ)

তাবুক থেকে ফেরার পর একদিন আশয়ারী-গোত্রের দু'জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হযরত আবু মুসা আশয়ারীকে সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে গেল। তারা রাসূলুল্লাহর কাছে যে কোন একটি পদ লাভের আকাঙ্খা ব্যক্ত করলো। রাসূল (সাঃ) মিসওয়াক করছিলেন। তাদের কথা শুনে তার মিসওয়াক করা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আবু মুসার দিকে ফিরে বললেনঃ 'আবু মুসা, আবু মূসা, আবু মুসা আরজ করলেনঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ্, আমি তাদের অন্তরের কথা জানতাম না। আমি জানতাম না এ ভাবে তারা কোন পদ লাভের আকাঙ্খা ব্যক্ত করবে।” রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “যদি কেউ নিজেই কোন পদের আকাঙ্খী হয়, আমি কক্ষনো তাকে সেই পদে নিয়োগ করবো না। তবে, আবু মুসা তুমি ইয়ামন যাও। আমি তোমাকে সেখানকার ওয়ালী নিয়োগ করলাম।”

সেই প্রাচীনকাল থেকে ইয়ামন দু'ভাগে বিভক্ত ছিলঃ ইয়ামন আকসা ও ইয়ামন আদনা। হযরত মুয়াজ বিন জাবালকে ইয়ামন আকসার এবং আবু মূসাকে ইয়ামন আদনার ওয়ালী নিয়োগ করা হয় । দু'জনকে বিদায় দেওয়ার সময় রাসূল (সাঃ) তাদেরকে এই বলে উপদেশ দেনঃ “ইয়ামনবাসীর সাথে নরম ব্যবহার করবে, কোন প্রকার কঠোরতা করবে না । মানুষকে খুশী রাখবে, ক্ষেপিয়ে তুলবে না । পরস্পর মিলে মিশে বসবাস করবে।"

নিজ দেশ হওয়ার কারণে ইয়ামন বাসীর ওপর হযরত আবু মুসার যথেষ্ট প্রভাব পূর্ব থেকেই ছিল। তাই সুষ্ঠু ভাবেই তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন। পার্শবর্তী ওয়ালী হযরত মুয়াজ বিন জাবালের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। মাঝে মাঝে সীমান্তে গিয়ে তারা মিলিত হতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পর মত বিনিময় করতেন।

বিদায় হজ্জে আবু মূসা (রাঃ)

হিজরী দশম সনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শেষ হজ্জ আদায় করেন। হযরত আবু মূসা ইয়ামন থেকে এসে হজ্জে অংশ গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ 'আবদুল্লাহ ইবন কায়েস, তুমি কি হজ্জের উদ্দেশ্যে এসেছ? জবাব দিলেনঃ হাঁ ইয়া রাসুলাল্লাহ। প্রশ্ন করলেনঃ 'তোমার নিয়ত কি ছিল ? বললেনঃ আমি বলেছিলাম, রাসূল্লাহর (সাঃ) যে নিয়াত আমারও সেই নিয়াত।' আবার প্রশ্ন করলেন : কুরবানীর পশু সংগে এনেছো কি? বললেনঃ না। রাসূল (সাঃ) নির্দেশ দিলে. তাওয়াফ ও সায়ী করার পর ইহরাম ভেঙ্গে ফেল। (সহীহুল বুখারী) উল্লেখ্য যে, রাসুল (সাঃ) হজ্জে “কিরান” আদায় করেছিলেন। আর হজ্জে কিরানের জন্য কুরবানীর পশু সংগে নেওয়া জরুরী।

ভন্ড নবীর বিরুদ্ধে জিহাদে  আবু মূসা (রাঃ)

হজ্জ্ব শেষে আবু মূসা ইয়ামন ফিরে আসেন । এদিকে আসওয়াদ আনাসী নামক এক ভণ্ড নবী নবুওয়াত দাবী করে, বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে। এমনকি হযরত মুয়াজ বিন জাবাল আবু মূসার রাজধানী- ‘মারেব’ চলে আসতে বাধ্য হন। এখানেও তারা বেশী দিন থাকতে পারলেন না । অবশেষে তারা হাদরামাউতে আশ্রয় নেন। যদিও ইবন মাকতূহ মুরাদী আসওয়াদ আনাসীকে হত্যা করেন, তবুও রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইনতিকালে আবার বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অতঃপর প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) মদীনা থেকে একটি বাহিনী পাঠিয়ে এই বিদ্রোহ নির্মূল করেন । ইয়ামনের দুই ওয়ালী নিজেদের স্থানে আপন আপন দায়িত্বে ফিরে গেলেন। হযরত আবু মুসা হাদরামাউত থেকে স্বীয় কর্মস্থল মারেব ফিরে আসেন এবং দ্বিতীয় খলীফার খিলাফত কালের প্রথমপর্যায় পর্যন্ত অত্যন্ত সফলভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

নতুন নতুন ভূখন্ড জয়ে আবু মূসা (রাঃ)

হযরত উমারের (রাঃ) খিলাফতকালে বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা শুরু হলে আবু মূসা (রাঃ) জিহাদে শরিক হওয়ার প্রবল আকাঙ্খায় ওয়ালীর দায়িত্ব ত্যাগ করে হযরত সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাসের বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। হিজরী ১৭ সনে সেনাপতি সা'দের নির্দেশে তিনি 'নাসিবীন' জয় করেন। এ বছরই বসরার ওয়ালী মুগীরা ইবন শু'বাকে (রাঃ) অপসারণ করে তাঁর স্থলে আবু মুসাকে (রা) নিয়োগ করা হয় ।

খুযিস্তান হচ্ছে বসরার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা । ঐ এলাকাটি তখনও ইরানীদের দখলে ছিল। হিজরী ১৬ সনে খুযিস্তান দখলের উদ্দেশ্যে হযরত মুগীরা (রাঃ) আহওয়াযে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন । আহওয়াযের সর্দার অল্প কিছু অর্থ বার্ষিক কর দানের বিনিময়ে মুর্গীরার (রাঃ) সাথে সন্ধি করে । মুগীরা ফিরে যান। হিজরী ১৭ সনে মুগীরার স্থলে আবু মুসা দায়িত্ব গ্রহণ করলে আহওয়াযবাসী কর প্রদান বন্ধ করে দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বাধ্য হয়ে আবু মূসা সৈন্য পাঠিয়ে আহওয়ায দখল করেন এবং মানাযির পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত রাখেন । বিশিষ্ট সেনা অফিসার হযরত মুহাজির ইবন যিয়াদ (রাঃ) এই মানাযির অভিযানের এক পর্যায়ে শাহাদাত বরণ করেন । শত্রু বাহিনী তাঁর দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে কিল্লার গম্বুজে ঝুলিয়ে রাখে। আবু মূসা হযরত মুহাজিরের ভাই হযরত রাবীকে মানাযির দখলের দায়িত্ব দেন। রাবী মানাযির দখলে সফল হন ।

এদিকে হযরত আবু মূসা 'সোস' অবরোধ করেন। শহরবাসী কিল্লায় আশ্রয় নেয়। অবশেষে তাদের নেতা এই শর্তে আবু মূসার সাথে সমঝোতায় পৌঁছে যে, তাঁর খান্দানের এক শ' ব্যক্তিকে জীবিত রাখা হবে । নেতা এক এক করে এক শ' ব্যক্তিকে হাজির করলো এবং আবু মুসা তাদের মুক্তি দিলেন । দুর্ভাগ্যক্রমে নেতা নিজের নামটি পেশ করতে ভুলে গেল এবং সন্ধির শর্তানুযায়ী তাকে হত্যা করা হলো । 'সোস' অবরোধের পর আবু মূসা 'রামহরম' অবরোধ করেন এবং বার্ষিক আট লাখ দিরহাম কর আদায়ের শর্তে তাদের সাথে সন্ধি হয়।

চারদিক থেকে তাড়া খেয়ে শাহানশাহে ইরানের সেনাপতি 'হরমুযানশোশতার-এর মজবুত - কিল্লায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। আবু মূসা শহরটি অবরোধ করে বসে আছেন । শহরটির পতনের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে এক ব্যক্তি গোপনে শহর থেকে বেরিয়ে আবু মূসার ছাউনীতে চলে এলো। সে প্রস্তাব দেয়, যদি তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, সে শহরের পতন ঘটিয়ে দেবে। লোকটির শর্ত মনজুর হলো। সে 'আশরাস' নামক এক আরবকে সংগে নিল । আশরাস চাদর দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে চাকরের মত লোকটির পিছে পিছে চললো। তারা নদী ও গোপন সুড়ঙ্গ পথে শহরে প্রবেশ করে এবং নালা অলি-গলি পেরিয়ে হরমুযানের খাস মহলে গিয়ে হাজির হয়। এভাবে আশরাস শহরের সব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গোপনে আবার আবু মূসার কাছে ফিরে আসে এবং বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে । অতঃপর আবু মুসার নির্দেশে আশরাস দু'শো জানবাজ সিপাহী সংগে করে হঠাৎ আক্রমণ করে দ্বার রক্ষীদের হত্যা করে দরযা খুলে দেয়। এদিকে আবু মুসা ও তাঁর সকল সৈন্যসহ দরজার মুখেই উপস্থিত ছিলেন । দরযা খোলার সাথে সাথে সকল সৈনিক একযোগে নগর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। শহরে হৈ চৈ পড়ে যায়। হরমুযান দৌড়ে কিল্লায় আশ্রয় নেয় । মুসলিম বাহিনী কিল্লার পাশে পৌঁছলে হরমুযান কিল্লার গম্বুজে উঠে ঘোষণা করে যে, "যদি আত্মসমর্পণের পর মদীনায় 'উমারের কাছে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আমি আত্মসমর্পণে রাজী। তাঁর শর্ত মনজুর করা হয় এবং তাকে হযরত আনাসের (রাঃ) সাথে দারুল খিলাফাত মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

শোশতার’ বিজয়ের পর আবু মূসার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী 'জুনদিসাবুর' অবরোধ করেন। এ অবরোধ বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল। একদিন শহরবাসী হঠাৎ শহরের ফটক উন্মুক্ত করে দেয় । তারা অত্যন্ত শান্তভাবে আপন আপন কাজে ব্যস্ত । মুসলিম বাহিনী শহরে প্রবেশ করে তাদের এমন নিঃশঙ্কভাব দেখে অবাক হয়ে যায় । জিজ্ঞেস করলে তারা জানালো, কেন আমাদের তো জিযিয়ার শর্তে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল, মুসলিম বাহিনীর এক দাস সকলের অগোচরে একাই এ নিরাপত্তার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেনাপতি আবু মুসা দাসের এ চুক্তি মানতে অস্বীকার করলেন। শহরবাসী বললো, কে দাস, কে স্বাধীন তা আমরা জানিনে। শেষে বিষয়টি মদীনায় খলিফার দরবারে উত্থাপিত হলো। খলীফা জানালেন, 'মুসলমানদের দাসও মুসলমান। যাদেরকে সে আমান বা নিরাপত্তা দিয়েছে, সকল মুসলমানই যেন তাদের আমান দিয়েছে। এভাবে আবু মূসার নেতৃত্বে গোটা খুযিস্তানে ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ় হয় এবং সেই সাথে তাঁর অবস্থান স্থল বসরা শত্রুর হুমকি থেকে মুক্ত হয়ে যায়।

খুযিস্তানের পতনের পর হিজরী ২১ সনে ইরানীরা নিহাওয়ান্দে এক চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় । খলীফা উমার (রাঃ) নু'মান ইবনে মুকরিনকে বিরাট এক বাহিনীসহ নিহাওয়ান্দে পাঠান এবং আবু মুসাকে তাঁকে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। খলীফার নির্দেশ পেয়ে বিরাট এক বাহিনীসহ তিনি নিহাওয়ান্দে পৌঁছেন । এ যুদ্ধেও ইরানী বাহিনী মারাত্মকভাবে পরাজয় বরণ করে।

খুযিস্তান জয়ের পর বিজিত এলাকা বসরার সাথে একীভূত করার জন্য আবু মুসা আবেদন জানালেন খলীফার কাছে । এদিকে কুফাবাসীরাও কুফার সাথে একীভূত করার দাবী জানালো তাদের ওয়ালী আম্মার বিন ইয়াসিরের (রাঃ) নিকট । খলীফা আবু মূসার দাবী সমর্থন করে বিজিত এলাকা বসরার সাথে একীভূত করলেন। এ দিকে কুফাবাসী তাদের দাবী পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় হযরত আম্মারের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। অবশেষে খলীফা কুফাবাসীদের দাবী অনুযায়ী আম্মারকে সরিয়ে হিজরী ২২ সনে আবু মুসাকে কুফার ওয়ালী নিযুক্ত করেন । কিন্তু একবছর পর হিজরী ২৩ সনে আবার বসরায় বদলী হন।

আবু মূসার (রাঃ) বিরুদ্ধে অভিযোগ

এ বছরই [ হিঃ ২৩ ] 'দাব্বা' নামক এক ব্যক্তি খলীফার কাছে আবু মূসার বিরুদ্ধে নিম্নের অভিযোগগুলি উত্থাপন করেঃ

১. আবু মূসা যুদ্ধবন্দীদের থেকে ষাটজন সর্দার পুত্রকে নিজেই নিয়ে নিয়েছেন ।
২. তিনি শাসন কার্যের যাবতীয় দায়িত্ব যিয়াদ ইবন সুমাইয়্যার ওপর ন্যস্ত করেছেন এবং প্রকৃতপক্ষে যিয়াদই এখন সকল দণ্ডমুণ্ডের মালিক।
৩. তিনি কবি হুতাইয়্যাকে এক হাজার দিরহাম ইনয়াম দিয়েছেন।
৪: ‘আকলিয়্যা নান্মী তার এক দাসীকে দু'বেলা উত্তম খাবার দেওয়া হয়, অথচ তেমন খাবার সাধারণ মানুষ খেতে পায় না ।

হযরত ‘উমার নিজহাতে অভিযোগগুলি লিখলেন। আবু মূসাকে মদীনায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন । অভিযোগগুলির সত্য মিথ্যা নিরুপনের জন্য যথারীতি অনুসন্ধান চালালেন। প্রথম অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হলো। দ্বিতীয় অভিযোগের জবাব দিলেন যে, যিয়াদ: একজন তুখোড় রাজনীতিক ও দক্ষ প্রশাসক। তাকে আমি উপদেষ্টা নিয়োগ করেছি। খলীফা যিয়াদকে ডেকে পরীক্ষা নিলেন এবং তাঁকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পেলেন । যিয়াদকে তাঁর পদে বহাল রাখার নির্দেশ দিলেন । তৃতীয় অভিযোগের জবাবে বললেন, হুতাইয়্যা যাতে আমার হিজু (নিন্দা) না করে এ জন্য আমি তাকে আমার নিজস্ব অর্থ থেকে উপঢৌকন দিয়েছি। কিন্তু চতুর্থ অভিযোগের কোন জবাব তিনি দিতে পারলেন না। হযরত উমার (রাঃ) একটু বকাবকি করে তাকে ছেড়ে দিলেন । (তাবারী)

আবু মুসা এ বছরই (হিঃ ২৩) ইস্পাহানে অভিযান চালিয়ে অঞ্চলটি ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। ইস্পাহান বিজয় শেষ করে ফিরে এলে সেই বছরই তাঁকে বসরা থেকে কুফায় বদলী করা হয়।

নহরে আবী মুসা

বসরাবাসীদের ভীষণ পানি-কষ্ট ছিল। বিষয়টি খলিফার দরবারে পৌঁছানো হলো । দিজলা নদী থেকে খাল কেটে বসরা শহর পর্যন্ত নেওয়ার জন্য খলীফা নির্দেশ দিলেন। আবু মূসার নেতৃত্বে দশ মাইল দীর্ঘ একটি খাল খনন করে বসরাবাসীর পানি-কষ্ট দূর করা হয় । ইতিহাসে এ খাল 'নহরে আবী মুসা নামে প্রসিদ্ধ ।

হিজরী ২৩ সনে জিলহজ্জ মাসে দ্বিতীয় খলীফা উমার (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন। হযরত “উসমান খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণের পর প্রশাসনের কাঠামোতে অনেক রদবদল করেন। কিন্তু হিজরী ২৯ সন পর্যন্ত আবু মুসা বসরার ওয়ালীর পদে বহাল থাকেন ।

কুর্দী বিদ্রোহ দমনে আবু মূসা (রাঃ)

হিজরী ২৯ সনে কুর্দীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আবু মূসা মসজিদে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ সম্পর্কে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দান করেন। ভাষণে আল্লাহর রাস্তায় পায়ে হেঁটে চলার ফজীলাত বর্ণনা করেন । তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিছু মুজাহিদ তাদের নিকট ঘোড়া থাকা সত্বেও পায়ে হেঁটে চলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু আবু মুসার কিছু সমালোচক তাদেরকে বললোঃ “আমাদের এত তাড়াতাড়ি করা উচিত হবে না। দেখা যাক আমাদের আমীর আবু মুসা কি ভাবে চলেন।” আবু মুসাও ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে বের হয়ে এলেন। মুজাহিদরা তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রতিবাদ করে বসলো।

আসলে আবু মূসার ভাষণের অর্থ এমন ছিলনা যে, যাদের ঘোড়া আছে তারা তাদের কাজে তা ব্যবহার করবে না । বস্তুতঃ তখন সময়টি ছিল ফিতনা ও ষড়যন্ত্রের। হাঙ্গামাবাজরা এই সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে মদীনায় চলে গেল এবং তাঁর অপসারণ দাবী করলো। খলীফা উসমান তাঁকে সরিয়ে নিলেন।

হিজরী ৩৪ সনে কুফাবাসীদের অনুরোধে সাঈদ ইবনুল 'আসের স্থলে খলীফা 'উসমান আবু মূসাকে আবার কুফার ওয়ালী নিয়োগ করেন। খিলাফতের সর্বত্র তখন চলছে দারুণ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র । রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী আবু মুসার স্মরণে ছিল। তাই তিনি তার বক্তৃতা-ভাষণে সর্বদা কুফাবাসীদের এ ভবিষদ্বাণীর কথা শোনাতেন। তাদেরকে সব ফিতনা থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিতেন। হিজরী ৩৫ সনে হযরত উসমানের (রাঃ) শাহাদাত ও হযরত আলীর (রাঃ) খলীফা হওয়ার পর সেই ফিতনা আত্মপ্রকাশ করে।

সিফফিন যুদ্ধে নিরপেক্ষ থেকেও প্রতারিত আবু মূসা (রাঃ)

তৃতীয় খলীফা হযরত 'উসমানের (রাঃ) রক্তের কিসাসের দাবীতে সোচ্চার হয়ে হযরত আয়িশা, তালহা ও যুবাইর (রাঃ) মক্কা থেকে বসরার দিকে রওয়ানা হলেন। এদিকে তাঁদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে খলীফা হযরত আলী (রাঃ) উপস্থিত হলেন যি'কার নামক স্থানে। অন্যদিকে তিনি আম্মার বিন ইয়াসিরের সাথে হযরত হাসানকে (রাঃ) পাঁঠালেন কুফায়। হযরত হাসান যখন কুফা পৌঁছলেন, আবু মুসা আশয়ারী তখন কুফার মসজিদে এক বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। ভাষণে তিনি জনগণকে এই ফিতনা থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। হযরত হাসান সেখানে উপস্থিত হলেন এবং মূসার (রাঃ) সাথে তার কিছু বাক বিতণ্ডা হয়। আবু মুসা নীরবে মসজিদের মিম্বর থেকে নেমে আসেন এবং কোন রকম প্রতিবাদ না করে সোজা সিরিয়ার এক অজ্ঞাত গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। এভাবে তিনি এ গৃহযুদ্ধে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। "সিফফিনে হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলেন এই শর্তে যে, উভয় পক্ষে একজন করে দু'জন নিরপেক্ষ বিচারকের ওপর বিষয়টি নিষ্পত্তির ভার দেওয়া হবে। তাদের মিলিত সিদ্ধান্ত উভয় পক্ষ মেনে নেবে। আলীর (রাঃ) পক্ষ আবু মুসাকে এবং মুয়াবিয়ার (রাঃ) পক্ষ ‘আমর ইবনুল 'আসকে (রা) বিচারক নিযুক্ত করেন।

উভয় পক্ষ ‘দুমাতুল জান্দাল' নামক স্থানে একত্র হলেন। বিষয়টি নিয়ে দু'জনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হলো। অবশেষে তারা উভয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, উম্মাতের স্বার্থে আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে খিলাফতের পদ থেকে অপসারণ করতে হবে এবং মজলিসে শূরা তৃতীয় কাউকে খলীফা নির্বাচন করবে। তারা উভয়ে জনগণের সামনে হাজির হলেন তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য। ‘আমর ইবনুল আসের অনুরোধে আবু মুসা প্রথমে উঠে তাঁর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন; কিন্তু ‘আমর তার পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হযরত মুয়াবিয়াকে খলীফা ঘোষণা করে বসলেন । আবু মুসা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ।

আবু মূসার (রাঃ) ইনতিকাল

আসলে আবু মুসা (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে প্রকৃতির। ধোকা ও কূটনীতি কি জিনিস তা তিনি জানতেন না। এ কারণে তাঁকে বিচারক নিযুক্ত করার ব্যাপারে হযরত আলী (রাঃ) দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পক্ষের লোকদের চাপাচাপিতে তিনিও মেনে নেন। 'আমর ইবনুল আসের কূটনৈতিক চালে পরাজিত হয়ে আবু মুসা অনুশোচনায় এত দগ্নিভূত হলেন যে, সেই মুহূর্তে তিনি মক্কার পথ ধরলেন। জীবনে আর কোন ব্যাপারে তিনি অংশ গ্রহণ করেননি। তাঁর মৃত্যু সন ও স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। কারো মতে মক্কায় আবার কারো মতে তিনি কুফায় মৃত্যু বরণ করেন। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে তিনি মক্কায় ইনতিকাল করেন। অনুরূপভাবে তাঁর মৃত্যু সন হিঃ ৪২, ৪৪ ও ৫২ সন বলে একাধিক মত রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ মতে হিঃ ৪৪ তার মৃত্যু সন। (তাজকিরাতুল হুফ্‌ফাজ)

ধর্মীয় জ্ঞানের পন্ডিত ছিলেন আবু মূসা (রাঃ)

হযরত আবু মূসা (রাঃ) জীবনের শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আদেশ নিষেধ পালনে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন । এমন কি যখন তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ে এবং তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন, তখন মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সেই মারাত্মক মুহূর্তেও ক্ষণিকের জন্য চেতনা ফিরে পেয়ে বলে ওঠেনঃ যে জিনিস থেকে রাসূল (সাঃ) স্বীয় দায়িত্বমুক্তির কথা ঘোষণা করেছেন আমিও তা থেকে দায়িত্বমুক্ত। রাসূল (সাঃ) এমন বিলাপকারিনীদের থেকে দায়িত্ব মুক্তির কথা বলেছেন।'

প্রথম জীবনে দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। কিন্তু পরবর্তী জীবন সচ্ছলতায় কেটেছে । হযরত 'উমার (রাঃ) তাঁর ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বিশেষ নৈকট্য লাভের সৌভাগ্য যাদের হয়েছিল হযরত আবু মূসা (রাঃ) সেই সব বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন । রাসুলুল্লাহর (সাঃ) জীবদ্দশায় যে ছয় ব্যক্তি ফাতওয়া দানের অনুমতি পেয়েছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম (তাজকিরাতুল হুফ্‌ফাজ)। আসওয়াদ নামক একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী বলেন, আমি কুফায় হযরত আলী ও হযরত আবু মুসা (রাঃ) অপেক্ষা অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি আর দেখিনি । হযরত আলী (রাঃ) বলতেনঃ 'মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবু মুসা ইলমের রঙে রঞ্জিত।' তিনি সব সময় জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের সাহচর্যে থাকতেন এবং তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। এ আলোচনা কখনও কখনও বাহাস-মুনাজিরা পর্যন্ত পৌঁছে যেত। বিশেষতঃ আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ ও মুয়াজ বিন জাবালের (রাঃ) সাথে তাঁর বিশেষ তর্ক-বাহাস হতো। একবার তায়াম্মুমের মাসয়ালার ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ ও আবু মূসার (রা) মধ্যে বিতর্ক হয় । ইমাম বুখারী-‘তায়াম্মুম' অধ্যায়ে এ বিতর্ক বর্ণনা করেছেন ।

তিনি যে শুধু জ্ঞান পিপাসু ছিলেন তাইনা, জ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের জন্যও আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। তিনি মনে করতেন, যতটুকু তিনি জানবেন অন্যকে তা জানানো ফরয। একবার এক ভাষণে বলেনঃ ‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ইলম দান করেছেন, তার উচিত অন্য ভাইদের তা জানানো তবে যে বিষয়ে তার কোন জ্ঞান নেই সে সম্পর্কে একটি শব্দও মুখ থেকে বের করবে না।' তাঁর দারসের পদ্ধতিও ছিল বিভিন্ন ধরনের। যথারীতি হালকায়ে দারস ছাড়াও কখনও কখনও লোকজন জড়ো করে তাদের সামনে ভাষন দিতেন। পথে-ঘাটে কোথাও এক স্থানে কিছু লোকের দেখা পেলে তাদের কাছে রাসুলুল্লাহর (সাঃ) দু' একটি বাণী পৌঁছে দিতেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি খুব কোমল আচরণ করতেন। কেউ অজ্ঞতা বশতঃ বোকার মত যদি কোন প্রশ্ন করে বসতো, তিনি উত্তেজিত হতেন না। অত্যন্ত নরম সুরে তাকে বুঝিয়ে দিতেন ।

সুমধুর কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আবু মূসা (রাঃ)

পবিত্র কুরআনের সাথে আবু মূসার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। রাত-দিনের প্রায় প্রতিটি মহুর্ত কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআন শিক্ষাদানের মাধ্যমে ব্যয় করতেন। ইয়ামনের ওয়ালী থাকাকালে একবার মুয়াজ বিন জাবাল জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কিভাবে কুরআন তিলাওয়াত করেন? বললেনঃ রাত্র দিনে যখনই সুযোগ পাই একটু করে তিলাওয়াত করে নিই। তিনি সুমধুর কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। রাসূল (সাঃ) বলতেনঃ 'আবু মূসা দাউদের (আঃ) লাহানের কিছু অংশ. লাভ করেছে।' তাঁর তিলাওয়াত রাসূলের (সা) খুবই পছন্দ ছিল।

তার কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেলেই রাসূল (সাঃ) দাঁড়িয়ে যেতেন। একবার হযরত আশিয়াকে (রাঃ) সংগে করে রাসূল (সাঃ) কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আবু মূসার কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে যান। কিছুক্ষণ শোনার পর আবার সামনে অগ্রসর হন। একবার মসজিদে নববীতে আবু মুসা জোর আওয়াযে ইশার নামাযে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। সুমধুর আওয়ায শুনে উন্মুহাতুল মুমিনীন হুজরার পর্দার কাছে এসে কান লাগিয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে থাকেন। সকালে যখন এ কথা জানতে পারলেন, বললেন, আমি যদি তখন একথা জানতে পারতাম তাহলে আরো চিত্তাকর্ষক আওয়াযে তিলাওয়াত করে তাদেরকে কুরআনের আশেক বানিয়ে দিতাম। তাঁর এই অসাধারণ খোশ লাহানের কারণেই রাসূল (সা) মুয়াজ বিন জাবালের সাথে তাকেও নওমুসলিমদের কুরআনের তালীম দানের জন্য ইয়ামনে পাঠান।

হাদিস বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন আবু মূসা (রাঃ)

পবিত্র কুরআনের সাথে সাথে হাদীসের খিদমতেও তাঁর অবদান কোন অংশে কম ছিলনা। কুফায় তার স্বতন্ত্র হালকায়ে দারসে হাদীস ছিল। এই দরসের মাধ্যমে বড় বড় মুহাদ্দিসীন সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৩৬০। তন্মধ্যে ৫০ টি মুত্তফাক আলাইহি, ৪৫টি বুখারী এবং ২৫টি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।

কুরআন ও হাদীসে তাঁর প্রভূত দখল থাকা সত্বেও নিজের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তেমনিভাবে অন্যের জ্ঞানের কদরও করতেন। একবার তিনি মীরাস সংক্রান্ত একটি মাসয়ালায় ফাতওয়া দিলেন। ফাতওয়া জিজ্ঞেসকারী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের কাছেও বিষয়টি জিজ্ঞেস করে। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ অন্য রকম ফাতওয়া দিলেন । আবু মুসা নিজের ভুল স্বীকার করে মন্তব্য করেন, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ জীবিত থাকা পর্যন্ত তোমাদের আমার কাছে আসা উচিত নয় ।

রাসূলের (সাঃ) জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি আবু মূসা (রাঃ)

হযরত আবু মুসার জীবনটি ছিল রাসূলে পাকের জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি । সর্বদা তিনি চেষ্টা করতেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রতিটি কথা, কাজ, চলন, বলন ইত্যাদি হুবহু অনুকরণ ও অনুসরণ করতে। একবার তিনি মককা থেকে মদীনা যাচ্ছিলেন। পথে ইশার নামায দুই রাকায়াত আদায় করলেন । তারপর আবার দাঁড়িয়ে সূরা আন নিসার ১০০টি আয়াত পাঠের মাধ্যমে এক রাকায়াত আদায় করলেন। লোকেরা প্রতিবাদ করলে তিনি বললেন, আমি সব সময় চেষ্টা করি, যেখানে যেখানে রাসূল (সাঃ) কদম রেখেছেন সেখানে সেখানে কদম রাখার এবং তিনি যে কাজ করেছেন, হুবহু তাই, করার ।

"রামাদানের রোযা ছাড়াও নফল রোযা এ জন্য রাখতেন যে, রাসূল (সাঃ) তা রেখেছেন। আশূরার রোযা তিনি বরাবর রাখতেন এবং মানুষকে তা রাখার জন্য বলতেন। সুন্নাত ছাড়া মুস্তাহাবেরও তিনি ভীষণ পাবন্দ ছিলেন । কুরবানীর পশু নিজ হাতে জবেহ করা মুস্তাহাব। শুধু এ কারণে তিনি তাঁর নিজ কন্যাদেরকেও হুকুম দিতেন নিজ হাতে পশু জবেহ করার জন্য।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নির্দেশ ছিল কোন ব্যক্তি যখন কারো বাড়ীতে যাবে তখন ভিতরে প্রবেশ করার আগে যেন অনুমতি নেয়। যদি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরেও অনুমতি না পাওয়া যায় তাহলে সে যেন ফিরে আসে । একবার আবু মূসা গেলেন খলীফা উমারের সাথে দেখা করতে। এক এক করে তিনবার তিনি অনুমতি চাইলেন, কিন্তু খলীফা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় সাড়া দিতে পারলেন না। আবু মূসা ফিরে আসলেন। অন্য এক সময় খলীফা জিজ্ঞেস করলেন আবু মূসা ফিরে গেলে কেন? বললেন, আমি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরেও সাড়া পাইনি তাই ফিরে গেছি। এই কথার পর তিনি এ সম্পর্কিত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) হাদীসটি বর্ণনা করে শুনালেন । 'উমার (রাঃ) বললেন, হাদীসটি তুমি ছাড়া অন্যকেউ শুনেছে এমন একজন সাক্ষী নিয়ে এসো। আবু মূসা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আনসারীদের এক মজলিসে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপস্থিত উবাই বিন কা'বও হাদীসটি শুনেছিলেন। তিনি উমারের (রাঃ) কাছে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেন।

শা'বী বলেনঃ ছয়জনের নিকট থেকে ইলম গ্রহণ করা হয়- 'উমার, আলী, উবাই, ইবন মাসউদ, যায়িদ ও আবু মূসা ।'

খলীফা উমার (রাঃ) তাঁকে বসরার ওয়ালী নিযুক্ত করে পাঠালেন। বসরায় পৌঁছে তিনি সমবেত জনতার সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন 'আমীরুল মু'মিনীন আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে আপনাদের রবের কিতাব ও তার নবীর সুন্নাত শিক্ষা দেব এবং আপনাদের পথ ঘাট সমূহ আপনাদের কল্যাণের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবো।' ভাষণ শুনে জনতাতো অবাক ! জনগণকে সংস্কৃতিবান করে তোলা, তাদেরকে দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত করাতো শাসকের দায়িত্বের আওতায় পড়তে পারে। কিন্তু তাদের পথ ঘাটসমূহ পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব তিনি কেমন করে পালন করতে পারেন? ব্যাপারটি তাদের কাছে ভীষণ আশ্চর্য্যের মনে হলো। তাই হযরত হাসান (রাঃ) তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ 'তাঁর চেয়ে উত্তম আরোহী বসরাবাসীদের জন্য আর কেউ আসেনি।' (রিজালুন হালার রাসুল)। রাসূল (সা) তাঁর সম্পর্কে বলতেনঃ‘আবু মূসা অশ্বারোহীদের নেতা ।'

হযরত আবু মূসার সামনে উম্মাতের কল্যাণ চিন্তাটাই ছিল সবচেয়ে বড়। এজন্য সারাজীবন ব্যক্তিগত সব লাভ ও সুযোগের প্রতি পদাঘাত করেছেন । আলী ও মুয়াবিয়ার (রাঃ) মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছে, তখন একদিন মুয়াবিয়া আবু মুসাকে বলেছেন, যদি তিনি মুয়াবিয়াকে সমর্থন করেন, তাহলে তাঁর দু'ছেলেকে যথাক্রমে বসরা ও কুফার ওয়ালী নিয়োগ করবেন এবং তাঁর সুযোগ-সুবিধার প্রতিও যত্নবান হবেন। জবাবে আবু মূসা লিখলেন, 'আপনি উম্মাতে মুহাম্মাদীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। যে জিনিস আপনি আমার সামনে পেশ করেছেন, তার প্রয়োজন আমার নেই।

লজ্জা শরম ঈমানের অঙ্গ। আবু মূসার মধ্যে এই উপাদানটি পরিপূর্ণরূপে ছিল। রাতে ঘুমানোর সময়ও বিশেষ ধরনের পোশাক পরে নিতেন, যাতে সতর উন্মুক্ত হয়ে না যায়। একবার কিছু লোককে তিনি দেখলেন, তারা পানির মধ্যে উলঙ্গ হয়ে গোসল করছে। তিনি বললেন, বার বার মরে জীবিত হওয়া আমার মনঃপূত, তবুও একাজ আমার পছন্দ নয়।'



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url