সাহাবাগণের জীবনকথা-৬৯ || বন্ধুত্বের অপূর্ব নজির স্থাপনকারী হযরত সালেম মাওলা আবী হুজাইফা (রা) এর জীবনী





সালেম মাওলা আবী হুজাইফা (রা)

হযরত রাসূলে করীম (সা) একদিন সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন, “তোমরা কুরআন শেখ চার ব্যক্তির নিকট থেকে: আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ, সালেম মাওলা আবী হুজাইফা, উবাই ইবন কা'ব ও মুয়াজ ইবন জাবাল।” কে এই সালেম মাওলা আবী হুজাইফা—যাকে কুরআন শেখার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) নির্ভরযোগ্য বলে ঘোষণা করলেন?

তাঁর নাম সালেম, কুনিয়াত আবু 'আবদিল্লাহ। পিতার নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইবন মুন্দাহ বলেছেন, 'উবায়েদ ইবন রাবী'য়া। আবার কারো মতে, মাকাল। ইরানী বংশোদ্ভূত। পারস্যের ‘ইসতাখরান’ তাঁর পিতৃপুরুষের আবাসভূমি। হযরত সুবাইতা বিনতু ইউ’য়ার আল আনসারিয়্যার দাস হিসেবে মদীনায় পৌঁছেন। হযরত সুবাইতা ছিলেন হযরত আবু হুজাইফার স্ত্রী। সুবাইতা তাকে নিঃশর্ত আযাদ করে দিলে আবু হুজাইফা তাঁকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি সালেম ইবন আবী হুজাইফা হিসেবে পরিচিত হন যেমন হয়েছিলেন যায়িদ ইবন মুহাম্মাদ। কেউ কেউ তাঁকে আবু হুজাইফার দাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এসব কারণে তাঁকে মুহাজিরদের মধ্যে গণ্য করা হয় । অন্যদিকে হযরত সুবাইতার আযাদকৃত দাস হওয়ার কারণে তাঁকে আনসারীও বলা হয়। আবার মূলে পারস্যের সন্তান হওয়ার কারণে কেউ কেউ তাকে আজমী বা অনারব বলেও উল্লেখ করেছেন। হযরত সালেম মক্কায় হযরত আবু হুজাইফার সাথে বসবাস করতেন। এই আবু হুজাইফা ছিলেন মককার কুরাইশ সর্দার ইসলামের চিরদুশমন ‘উতবা’র ছেলে। ইসলামী দাওয়াতের সূচনালগ্নেই যারা লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আবু হুজাইফা ও তাঁর পালিত পুত্র সালেমও ছিলেন। তাঁরা পিতা-পুত্র দু'জন নীরবে ও বিনীতভাবে তাঁদের রবের ইবাদাত করে চললেন এবং কুরাইশদের নির্মম অত্যাচারের মুখে সীমাহীন ধৈর্য্য অবলম্বন করলেন। একদিন পালিতপুত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করে কুরআনের আয়াত নাযিল হলো— 'উদয়ুহুম লি আবায়িহিম’—তাদেরকে তাদের পিতার নামে সম্পৃক্ত করে ডাক। প্রত্যেক পালিত পুত্র আপন আপন জন্মদাতা পিতার নামে পরিচিতি গ্রহণ করলো। যেমন যায়িদ ইবন মুহাম্মাদ হলো যায়িদ ইবন হারিসা। কিন্তু সালেমের পিতৃ পরিচয় ছিল অজ্ঞাত। তাই তিনি পরিচিত হলেন 'সালেম মাওলা আবী হুজাইফা’–আবু হুজাইফার বন্ধু, সাথী, ভাই বা আযাদকৃত দাস সালেম হিসেবে।

   

ইসলাম পালিত পুত্রের প্রথা বাতিল ঘোষণা করে। সম্ভবতঃ ইসলাম মুসলিম জাতিকে এ কথা বলতে চায় যে, রক্ত, আত্মীয়তা বা অন্য কোন সম্পর্ককে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া তোমাদের উচিত নয়। বিশ্বাস বা আকীদার ভিত্তিতেই তোমাদের সম্পর্ক নির্মিত হওয়া উচিত। প্রথম পর্যায়ের মুসলমানরা এ ভাবটি খুব ভালো করে বুঝেছিলেন। তাই, তাঁদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পর তাঁদের দ্বীনী ভাই অপেক্ষা অধিক প্রিয় আর কিছু ছিল না। এটা আমরা আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে দেখেছি। তেমনিভাবে দেখে থাকি সম্ভ্রান্ত কুরাইশ আবু হুজাইফা ও তাঁর পিতৃ পরিচয়হীন অজ্ঞাত-অখ্যাত দাস সালেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।

হযরত সালেমের ঈমান ছিল সিদ্দীকীনদের ঈমানের মত এবং আল্লাহর পথে তিনি চলেছিলেন মুত্তাকীনদের মত। সমাজে তাঁর স্থান কি এবং তাঁর জন্ম-পরিচয়ই বা কি সেদিকে তিনি কোন ভ্রুক্ষেপ করেননি। ইসলাম যে নতুন সমাজ বিনির্মাণ করেছিল, সেই সমাজ তাঁর তাকওয়া ও ইখলাসের জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। এই মহান পুণ্যময় নতুন সমাজেই আবু হুজাইফা- গতকাল যে তাঁর দাস ছিল তাকে ভাই বা বন্ধুরূপে গ্রহণ করে গৌরব বোধ করেছিলেন। এমনকি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ফাতিমা বিনতুল ওয়ালীদকে তাঁর সাথে বিয়ে দিয়ে নিজ পরিবারকে সম্মান ও গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যে সমাজ ব্যবস্থা সকল প্রকার যুলুম-অত্যাচার দূর করে সবরকম মিথ্যা আভিজাত্যকে বাতিল ঘোষণা করেছিল, সেখানে সালেমের ঈমান, সততা ও দৃঢ়তা তাঁকে প্রথম সারির ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে।

প্রথম যুগের শ্রেষ্ট কারী ও হাফেজ সালেম (রা)

হযরত রাসূলে করীমের (সা) হিজরাতের পূর্বেই তিনি তাঁর দ্বীনী বন্ধু আবু হুজাইফার সাথে: মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় তিনি হযরত আব্বাদ ইবন বিশরের অতিথি হন। মককায় রাসূলুল্লাহ (সা) আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহর সাথে তাঁর দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব কায়েম করে দেন। কিন্তু মদীনায় তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় হযরত মুয়াজ ইবন মায়েজ আল-আনসারীর সাথে। সাহাবীদের যুগে ‘কিরআত শিল্পে যাঁদেরকে ইমাম গণ্য করা হতো, সালেম তাদের একজন। রাসূলুল্লাহ (সা) যে চার ব্যক্তির নিকট থেকে কুরআন শেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সালেম তাঁদের অন্যতম। তিনি এমন সুমধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন যে, কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তা শুনতো। একদিন উম্মুল মুমিনীন হযরত 'আয়িশার রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট হাজির হতে দেরী হলো। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার দেরী হলো কেন?” আয়িশা বললেন, “একজন কারী সুমধুর কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করছিল, তাই শুনছিলাম।” তিনি তার তিলাওয়াতের মাধুর্য্য বর্ণনা করলেন। তাঁর বর্ণনা শুনে রাসূলে করীম (সা) চাদরটি টেনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, সেই ক্বারী আর কেউ নয়, তিনি সালেম মাওলা আবী হুজাইফা। রাসূল (সা) তাঁর তিলাওয়াত শুনে মন্তব্য করলেন, “আলহামদুলিল্লাহ আল্লাজী জা'য়ালা ফী উম্মাতী মিছলাকা” –আমার উম্মাতের মধ্যে যিনি তোমার মত লোককে সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। (উসুদুল গাবা- ২/২৪৬)


সুমধুর কন্ঠস্বর এবং বেশী কুরআন হিফ্‌জ থাকার কারণে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে সালেমকে অত্যধিক সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হতো। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের পূর্বে যারা মদীনায় হিজরাত করেছিলেন, মসজিদে কুবায় সালেম তাদের নামাযের ইমামতি করতেন।” (বুখারী) হযরত আবু বকর ও হযরত উমারের মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও তাঁর পেছনে নামায আদায় করতেন।

বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই তিনি হযরত রাসুলে করীমের (সা) সাথে ছিলেন। (উসুদুল গাবা-২/২৪৬) বদর যুদ্ধে তিনি কাফের উমাইর ইবন আবী উমাইরকে নিজ হাতে হত্যা করেন। (ইবন হিশাম- ১/৭০৮ )

মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার চারদিকের গ্রাম ও গোত্রগুলিতে কতকগুলি দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠালেন। তিনি তাদেরকে বলে দিলেন, “যোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং দায়ী বা আহবানকারী হিসেবে তোমাদেরকে পাঠানো হচ্ছে।” এমন একটি দলের নেতা ছিলেন হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ। খালিদ তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর এমন এক ঘটনা ঘটলো যে, তিনি তরবারি চালালেন এবং তাতে প্রতিপক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হলো। এ খবর রাসূলুল্লাহর (সা) কানে পৌঁছলে তিনি দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর কাছে এই বলে ওজর পেশ করেছিলেন—“হে আল্লাহ, খালিদ যা করেছে, তার দায়-দায়িত্ব থেকে আমি তোমার কাছে অব্যাহতি চাই।” এ অভিযানে হযরত সালেম হযরত খালিদের সহগামী ছিলেন। খালিদের এ কাজ সালেম নীরবে মেনে নেননি। তিনি খালিদের এ কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁর প্রতিবাদের মুখে মহাবীর খালিদ কখনও লা জওয়াব হয়ে যান, আবার কখনও আত্মপক্ষ সমর্থন করে যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। আবার কখনও সালেমের সাথে প্রচণ্ড বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হন। কিন্তু সালেম স্বীয় মতের ওপর অটল থাকেন। খালিদের ভয়ে সেদিন তিনি সত্য বলা থেকে চুপ থাকেননি।

সালেম ক'দিন আগেও যিনি ছিলেন মককার এক দাস, আজ তিনি খালিদের মত মককার এক সম্ভ্রান্ত কুরাইশ সিপাহসালারের কোন পরোয়াই করলেন না। খালিদও কোন রকম বিরক্তিবোধ করেননি। কারণ, ইসলাম তাঁদের উভয়কে সম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। নেতার প্রতি, অহেতুক ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সালেম সেদিন খালিদের ভুল মেনে নেননি। বরং তিনি দায়িত্বের অংশীদার হিসেবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আত্মতৃপ্তি বা নামের জন্য একাজ করেননি; বরং বারবার তিনি যে রাসুলুল্লাহর (সা) মুখে শুনেছিলেন, 'আদ-দ্বীন আন-নাসীহা”-দ্বীনের অপর নাম সতোপদেশ। এ উপদেশই তিনি সেদিন খালিদকে দান করেছিলেন।

হযরত খালিদের এ বাড়াবাড়ির কথা রাসূলুল্লাহর (সা) কানে পৌঁছলে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন—“কেউ কি তার এ কাজের প্রতিবাদ বা নিন্দে করেনি ?” রাসূলে পাকের ক্রোধ পড়ে গেল যখন তিনি শুনলেন: “হ্যাঁ, সালেম প্রতিবাদ করেছিল, তার সাথে ঝগড়া করেছিল।”

সালেম মিনাস সালেহীন

হযরত সালেমের কাহিনী বিলাল ও অন্যান্য অসংখ্য অসহায় দাসদের কাহিনীরই মত। ইসলাম তাঁদের সকলের কাঁধ থেকে দাসত্বের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাদেরকে সত্য ও কল্যাণময় সমাজে ইমাম, নেতা ও পরিচালকের আসনে বসিয়ে দেয়। তাঁর মধ্যে মহান ইসলামের যাবতীয় গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি যা সত্য বলে জানতেন অকপটে তা প্রকাশ করে দিতেন, তা বলা থেকে কক্ষণো বিরত থাকতেন না। তাঁর মুমিন বন্ধুরা তাঁর নাম রেখেছিল—'সালেম মিনাস সালেহীন' – সত্যনিষ্ঠদের দলভুক্ত সালেম।

হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) সালেমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে বলেছিলেন, “আজ সালেম জীবিত থাকলে শুরার পরামর্শ ছাড়াই আমি তাঁকে খিলাফতের দায়িত্ব দিতাম।” (উসুদুল গাবা- ২/২৪৬ )

হযরত সালেম ছিলেন নিঃসন্তান। তাই মৃত্যুর পর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তির ব্যাপারে অসীয়াত করে যান। এক তৃতীয়াংশ দাসমুক্তি ও অন্যান্য ইসলামী কাজের জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ পূর্বতন মনিব হযরত সুবাইতার অনুকূলে। হযরত আবু বকর (রা) অসীয়াত মত এক তৃতীয়াংশ সুবাইতার কাছে পাঠালে তিনি এই বলে তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান যে, আমি তো তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছি, বিনিময়ে কোন কিছু আশা করিনি। পরে খলীফা উমার (রা) তা বাইতুল মালে জমা দেন। (আল ইসতিয়াব, উসুদুল গাবা- ২/২৪৭ )

হযরত সালেম থেকে রাসুলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবার অনেক সাহাবী তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

সালেম (রা) এর শাহাদাত বরণ

হযরত রাসুলে করীম (সা) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরের খিলাফত মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হলো। তাদের সাথে সংঘটিত হয় ভয়াবহ ইয়ামামার যুদ্ধ। এমন ভয়াবহ যুদ্ধ ইতিপূর্বে ইসলামের ইতিহাসে আর সংঘটিত হয়নি। মুসলিম বাহিনী মদীনা থেকে ইয়ামামার উদ্দেশ্যে বের হলো। সালেম এবং তাঁর দ্বীনী ভাই আবু হুজাইফা অন্যদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন। যুদ্ধের প্রথম পর্বে মুসলিম বাহিনী কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে তারা বুঝতে পারে যুদ্ধ যুদ্ধই এবং দায়িত্ব দায়িত্বই। হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ নতুন করে তাদের সংগঠিত করেন এবং অভূতপূর্ব কায়দায় তিনি বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। প্রথমতঃ যখন মুসলিম বাহিনী পিছু হটে যাচ্ছিল, তখন হযরত সালেম চিৎকার করে উঠলেন, “আফসুস, রাসূলুল্লাহর (সা) সময়ে আমাদের অবস্থা তো এমন ছিল না।” তিনি নিজের জন্য একটি গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে যান। (উসুদুল গাবা- ২/২৪৬)

ইয়ামামার যুদ্ধে প্রথমে হযরত যায়িদ ইবনুল খাত্তাবের হাতে ছিল মুসলিম বাহিনীর পতাকা। তিনি শাহাদাত বরণ করলে পতাকাটি মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সালেম তা তুলে ধরেন। কেউ কেউ তাঁর পতাকা গ্রহণে আপত্তি করে বলে, “আমরা তোমার দিক থেকে শত্রু বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করছি।” সালেম বলেন, “তাহলে আমি তো হয়ে যাব কুরআনের এক নিকৃষ্ট বাহক। ” (হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৩৫)

শত্রু বাহিনীকে আক্রমণের পূর্বে দুই দ্বীনী ভাই—আবু হুজাইফা ও সালেম পরস্পর বুকে বুক মেলালেন এবং দ্বীনে হকের পথে শহীদ হওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। তারপর উভয়ে শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আবু হুজাইফা একদিকে চিৎকার করে বলছেন, “ওহে কুরআনের ধারকরা, তোমরা তোমাদের 'আমল দ্বারা কুরআনকে সুসজ্জিত কর।” আর অন্যদিকে মুসাইলামা কাজ্জাবের বাহিনীর ওপর তরবারির আঘাত হানছেন। আর একদিকে সালেম চিৎকার করে বলছেন—“আমি হব কুরআনের নিকৃষ্ট বাহক—যদি আমার দিক থেকে শত্রু বাহিনীর আক্রমণ আসে।” মুখে তিনি একথা বলছেন আর দু'হাতে তরবারি শত্রুসৈন্যের গর্দানে মারছেন।

এক ধর্মত্যাগীর অসির তীব্র আঘাত তাঁর ডান হাতে পড়লো। হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি বাম হাতে পতাকাটি উঁচু করে ধরেন। বাম হাতটিও শত্রুর আঘাতে কেটে পড়ে গেলে পতাকাটি গলার সাথে পেঁচিয়ে ধরেন। এ অবস্থায় তিনি উচ্চারণ করতে থাকেন কুরআনের এ আয়াত, “ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসুল, ওয়াকা আইয়্যিন মিন নাবিয়্যিন কা-তালা মা'য়াহু রিব্বিয়্যূনা কাসীর।” ...... - “মুহাম্মাদ আল্লাহর এক রাসুল ছাড়া আর কিছু নন। অতীতে কত নবীর সহযোগী হয়ে কত আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিই না যুদ্ধ করেছে। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যে বিপদ মুসীবত আপতিত হয়েছে, তাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়েনি এবং থেমেও যায়নি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।” এই ছিল তাঁর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের শ্লোগান।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মুরতাদদের একটি দল সালেমকে ঘিরে ফেলে। মহাবীর সালেম লুটিয়ে পড়েন। তখনও তাঁর দেহে জীবনের স্পন্দন অবশিষ্ট ছিল। মুসাইলামা কাজ্জাবের নিহত হওয়ার 'সাথে মুসলমানদের বিজয় ও মুরতাদদের পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। মুসলমানরা আহত-নিহতদের খোঁজ করতে লাগলো। সালেমকে তারা জীবনের শেষ অবস্থায় খুঁজে পেল। এ অবস্থায় সালেম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
- আবু হুজাইফার অবস্থা কি ?
- সে শাহাদাত বরণ করেছে।
- যে ব্যক্তি আমার দিক থেকে শত্রু বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করে পতাকা আমার হাতে দিতে আপত্তি জানিয়েছিল, তার অবস্থা কি?
- শহীদ হয়েছে।
- আমাকে তাদের মাঝখানেই শুইয়ে দাও ।
- তারা দু'জন তোমার দু'পাশেই শহীদ হয়েছে।

হযরত সালেম শেষ বারের মত শুধু একটু মুচকি হাসি হেসেছিলেন। আর কোন কথা বলেননি । সালেম এবং আবু হুজাইফা উভয়ে যা আন্তরিকভাবে কামনা করেছিলেন, লাভ করেন। তাঁরা এক সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন, একসাথে জীবন যাপন করেন এবং এক সাথে একস্থানে শাহাদাত বরণ করেন।




**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url