মা’আরেফুল কোরআন - ৭৬ || সূরা আল-বাকারাহ, ২০৮-২১০ || পরিষ্কার নির্দেশ আসার পরেও যারা পদস্খলিত হয়







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ২০৮-২১০


 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ادۡخُلُوۡا فِی السِّلۡمِ کَآفَّۃً ۪ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّهٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۲۰۸   فَاِنۡ زَلَلۡتُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡکُمُ الۡبَیِّنٰتُ فَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ ﴿۲۰۹   هَلۡ یَنۡظُرُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّاۡتِیَهُمُ اللّٰهُ فِیۡ ظُلَلٍ مِّنَ الۡغَمَامِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ قُضِیَ الۡاَمۡرُ ؕ وَ اِلَی اللّٰهِ تُرۡجَعُ الۡاُمُوۡرُ ﴿۲۱۰

সূরা আল-বাকারাহ ২০৮-২১০ নং আয়াতের অর্থ

(২০৮) হে ঈমানদারগণ ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না — নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। 
(২০৯) অতঃপর তোমাদের মাঝে পরিষ্কার নির্দেশ এসে গেছে বলে জানার পরেও যদি তোমরা পদস্খলিত হও, তাহলে নিশ্চিত জেনে রেখো, আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। 
(২১০) তারা কি সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে যে, মেঘের আড়ালে তাদের সামনে আসবেন আল্লাহ্ ও ফেরেশতাগণ? আর তাতেই সব মীমাংসা হয়ে যাবে। বস্তুত সব কার্যকলাপই আল্লাহর নিকট গিয়ে পৌঁছবে।

সূরা আল-বাকারাহ ২০৮-২১০ নং আয়াতের পূর্বাপর যোগসূত্র


   
যোগসূত্রঃ পূর্ববর্তী আয়াতে নিষ্ঠাবানদের প্রশংসা করা হয়েছিল। অনেক সময় এই নিষ্ঠার মধ্যেও ভুলবশত বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। যদিও উদ্দেশ্য থাকে অধিক আনুগত্য, কিন্তু সে আনুগত্য শরীয়ত ও সুন্নতের সীমারেখা অতিক্রম করে বিদ’আতে পরিণত হয়। যেমন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম প্রমুখ প্রথমে ইহুদী আলেম ছিলেন এবং সে ধর্মমত অনুযায়ী শনিবার ছিল সপ্তাহের পবিত্র দিন, আর উটের গোশত ছিল হারাম। ইসলাম গ্রহণের পর সে সাহাবীর ধারণা হয় যে, হযরত মূসা (আ)-এর ধর্মে শনিবারকে পবিত্র দিন হিসাবে সম্মান করা ছিল ওয়াজিব। কিন্তু মুহাম্মদী শরীয়তে তার অসম্মান করা ওয়াজিব নয়। তেমনিভাবে মূসা (আ)-এর শরীয়তে উটের গোশত ছিল হারাম, কিন্তু মুহাম্মদ (সা)-এর শরীয়তে তা ভক্ষণ করা ফরয নয়। সুতরাং আমরা যদি যথারীতি শনিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে থাকি এবং উটের গোশত হালাল জেনেও কার্যত তা বর্জন করি, তাহলে তো দু’কুলই রক্ষা পায়-মূসা (আ)-এর শরীয়তের প্রতিও আস্থা রইল, অথচ মুহাম্মদ (সা)-এর শরীয়তেরও কোন বিরোধিতা হলো না। পক্ষান্তরে এতে আল্লাহর অধিকতর আনুগত্য এবং ধর্মের ব্যাপারে বেশি বিনয় প্রকাশ পাবে বলে মনে হয়। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই এ ধারণার ’সংশোধনী উচ্চারণ করেছেন। তারই সার-সংক্ষেপ হচ্ছে যে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান! আর ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা তখনই সাধিত হবে, যখন এমন কোন বিষয়কে ধর্ম হিসেবে পালন করা না হবে, যা ইসলামে পালনযোগ্য নয়। বস্তুত এমন সব বিষয়কে ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হলো একটি শয়তানী প্রতারণাজনিত পদস্খলন। আর পাপ হিসেবে তার শাস্তি কঠোরতর হওয়ার আশংকাই বেশি।
হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হও। (ইহুদী ধর্মেরও কিছুটা পক্ষপাতিত্ব করবে এমন নয়) এবং (এমন কোন ধারণার বশবর্তী হয়ে) শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সে মনের উপর এমনই পট্টি পরিয়ে দেয়, যাতে কোন কোন বিষয় আপাতদৃষ্টিতে যথার্থ ধর্ম বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী হয়ে থাকে। বস্তুত তোমাদের কাছে ইসলামী সংবিধানের প্রকৃষ্ট প্রমাণাদি উপস্থিত হওয়ার পরে যদিও সিরাতে মুস্তাকীম বা সরল পথ থেকে) তোমাদের পদস্খলন ঘটে, তাহলে নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ্ তা’আলা (বড়ই) পরাক্রমশালী, (তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবেন, অবশ্য সে শান্তি যদি কিছুকাল নাও দেন, তাতে তোমরা ধোঁকায় পড়ো না। কারণ) তিনি বিজ্ঞ বটে। (বিশেষ কারণেও অনেক সময় শাস্তি দানে বিলম্ব করেন। মনে হয়) এরা (যারা প্রকৃষ্ট দলীল-প্রমাণ সত্ত্বেও সত্য পথ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করে) শুধু সেই নির্দেশেরই অপেক্ষা করে আছে যে, আল্লাহ্ এবং ফেরেশতাগণ মেঘের শামিয়ানায় করে (তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য) তাদের কাছে আসবেন এবং গোটা বিষয়টির যবনিকাপাত ঘটে যাবে। (অর্থাৎ তারা এমন সময়ে সত্য বিষয়টি গ্রহণ করতে চায়, যখন তাদের সেই গ্রহণ করা গ্রাহ্যই হবে না ?) আর (শাস্তি ও প্রতিদানের) সমস্ত বিচার আল্লাহর দরবারে শেষ করা হবে। (অন্য কোন ক্ষমতাবান তখন থাকবে না। কাজেই এহেন পরাক্রমশালীর বিরুদ্ধাচরণের পরিণতি অকল্যাণ ছাড়া আর কি হতে পারে ? )

সূরা আল-বাকারাহ ২০৮-২১০ নং আয়াতের বিষয় বস্তু

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
 سِّلْمِ - ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً - শব্দটি যের ও যবরসহযোগে (সিল্‌ম ও সাল্‌ম’) দুটি পৃথক পৃথক অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটির অর্থ হচ্ছে ’শান্তি’, অপরটি ’ইসলাম’। এখানে অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামের মতে ইসলাম অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।—(ইবনে কাসীর)। كَافَّةً শব্দটি ’পরিপূর্ণভাবে এবং সাধারণভাবে’ এই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যাকরণের রীতি অনুযায়ী এখানে বাক্যটির গঠন হচ্ছে অবস্থাজ্ঞাপক। এতে দু’টি সম্ভাবনা রয়েছে, একটি হচ্ছে। ادْخُلُوا (তোমরা অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও) শব্দে যে সর্বনাম রয়েছে, তার অবস্থা জ্ঞাপন করছে অথবা ইসলাম অর্থে سِّلْمِ শব্দটির অবস্থা জ্ঞাপন করছে। প্রথম ক্ষেত্রে অনুবাদ দাঁড়াবে এই যে- তোমরা সম্পূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও অর্থাৎ তোমাদের হাত-পা, চোখ-কান, মন-মস্তিষ্ক সব কিছুই যেন ইসলামের আওতায় এবং আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে এসে যায়, এমন যেন না হয় যে, হাত-পা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা ইসলামের বিধানসমূহ পালন করে যাচ্ছে, অথচ তোমাদের মন-মস্তিষ্ক তাতে সন্তুষ্ট নয় কিংবা মন-মস্তিষ্ক ইসলামের অনুশাসনে সন্তুষ্ট বটে, কিন্তু হস্ত-পদাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রিয়াকলাপ তার বিরুদ্ধে।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আয়াতটির অনুবাদ এই যে, তোমরা পূর্ণাঙ্গ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও অর্থাৎ এমন যাতে না হয় যে, ইসলামের কিছু বিষয় মেনে নিলে আর কিছু মানতে গিয়ে গড়িমসি করতে থাকলে। তাছাড়া কোরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের নামই হচ্ছে ইসলাম। কাজেই এর সম্পর্ক বিশ্বাস ও ইবাদতের সাথেই হোক কিংবা আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিকতা অথবা রাষ্ট্রের সাথেই হোক কিংবা রাজনীতির সাথে হোক, এর সম্পর্ক বাণিজ্যের সাথেই হোক কিংবা শিল্পের সাথে- ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা দিয়েছে, তোমরা তারই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।
এতদুভয় দিকের মূল প্রতিপাদ্যই মোটামুটিভাবে এই যে, ইসলামের বিধানসমূহ তা মানব জীবনের যে কোন বিভাগের সাথেই সম্পৃক্ত হোক না কেন, যে পর্যন্ত তার সমস্ত বিধি-নিষেধের প্রতি সত্যিকারভাবে স্বীকৃতি না দেবে, সে পর্যন্ত মুসলমান যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না ।
এ আয়াতের যে শানে-নুযুল উপরে বলা হয়েছে, মূলত তার মূল বক্তব্য এই যে, শুধুমাত্র ইসলামের শিক্ষাই তোমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে। একে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করে নিলে সে তোমাদেরকে অন্য সমস্ত ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেবে।

ইসলামকে শুধু মসজিদ এবং ইবাদতের মাঝে সীমাবদ্ধ করা

সতর্কতাঃ যারা ইসলামকে শুধু মসজিদ এবং ইবাদতের মাঝে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে, সামাজিক আচার-ব্যবহারকে ইসলামী সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে না, তাদের জন্য এই আয়াতে কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। তথাকথিত দীনদারদের মধ্যেই ত্রুটি বেশির ভাগ দেখা যায়। এর দৈনন্দিন আচার-আচরণ, বিশেষত সামাজিকতার ক্ষেত্রে পারস্পরিক যে অধিকার রয়েছে, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। মনে হয় এরা যেন এসব রীতিনীতিকে ইসলামের নির্দেশ বলেই বিশ্বাস করে না। তাই এগুলো জানতে-শিখতেও যেমন এদের কোন আগ্রহ নেই, তেমনিভাবে এর অনুশীলনেও তাদের কোন আগ্রহ নেই। নাঊযুবিল্লাহ ! অন্ততপক্ষে হাকীমুল-উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী (র) রচিত ’আদাবে মো‘আশিরাত’ পুস্তিকাটি পড়ে নেওয়া প্রতিটি মুসলমানের উচিত।

আল্লাহ ও ফেরেশতা মেঘের আড়ালে করে তাদের নিকট আগমন করবেন, এমন ঘটনা কিয়ামতের দিন সংঘটিত হবে। এমনিভাবে আল্লাহর আগমন দ্ব্যর্থবোধক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও বুযুর্গানে দীনের রীতি হচ্ছে, বিষয়টিকে সঠিক ও সত্য বলে বিশ্বাস করে নেওয়া, কিন্তু কিভাবে তা সংঘটিত হবে, তা জানার প্রয়োজন নেই। কেননা, আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর সমস্ত গুণাবলী ও অবস্থা জানা মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে।






****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url