কুরবানীর ইতিহাস || ইবরাহীম (আ)-এর কুরবানী সম্পর্কে কাল্পনিক গল্প || কুরবানীর গুরত্ব || কুরবানীর মাহাত্ম্য ||






কুরবানীর ইতিহাস

এখন অর্থাৎ- যিলহজ্ব ১৪০১ হিজরী থেকে ৫২৮১ বছর আগে (এ হিসাবটা ইমামুল হিন্দ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের হিসাব অনুসারে লেখা হয়েছে । তাঁর ঈদায়ন পুস্তিকার ২২ পৃষ্ঠা দেখুন) কলকাতা থেকে পশ্চিমে আনুমানিক আড়াই হাজার মাইল দূরে জনবিরল মক্কা নগরীর এক নির্জন প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ) বলিদানের যে মহান আদর্শ উপস্থাপন করেছিলেন সে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি নিয়ে প্রতি বছর আমাদের সামনে হাজির হয় ঈদুল আযহা বা পবিত্র কুরবানীর ঈদ ।"

এ কুরবানী সম্পর্কে একদা মহানবীকে তাঁর কতিপয় সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন- “ইয়া রাসূলুল্লাহ। মা-হা-যিহিল আদা-হী ।" অর্থ : “হে আল্লাহর রাসূল! এ কুরবানী কি জিনিস ?” তিনি বললেন : “সুন্নাতু আবী কুম ইবরাহীম (আ)।” অর্থ : “এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর আদর্শ।” এবার তাঁরা বললেন, এতে আমাদের উপকার কি? তিনি বললেন : কুরবানীর জানোয়ারের প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তোমরা একটি করে নেকী লাভ করবে।(মুসনাদে আহমদ ৪র্থ খণ্ড, ৩৬৮, বায়হাকী ৯ম খণ্ড, ২৬১, ইবনে মাজাহ, মিশকাত) 

বিশ্বনবীর উল্লেখিত হাদীসটিকে যারা বিশ্বাস করেন এবং যারা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে একটু চিন্তা গবেষণা করেন, তাদের মাথায় একটি প্রশ্ন উদয় হতে পারে যে, ইবরাহীম (আ)-এর মধ্যে এমন কি গুণ ও বৈশিষ্ট্য ছিল যার ফলে মহান আল্লাহ তাঁর এ আদর্শকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবস্ত ও প্রাণবন্ত করে রাখলেন? উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ঐ আদর্শকে আনন্দ ও খুশির উৎসে পরিণত করলেন? কারণ, মানবতার ইতিহাসে মানুষকে সৎপথ দেখানোর জন্যে হাজার হাজার নবী আগমন করেছেন। কিন্তু কারো আদর্শই এ সম্মান ও মর্যাদা পায়নি ।

দুনিয়ার বড় বড় রাজা মহারাজা, বিরাট বিরাট ব্যক্তিত্ব, জলে ও স্থলে শাসন পরিচালনাকারী মহান জাতিসমূহকে আমরা প্রাচীন নিদর্শনসমূহের ভগ্নাবশেষে, পচাসড়া করবসমূহের মধ্যে, জাতীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাসের পুরাতন পাতাগুলোতে দেখতে পারি। কিন্তু পূর্ববর্তী যুগের সমস্ত জনসমাগমের মধ্যে এমন একটিও ব্যক্তিত্ব খুঁজেও পাওয়া যাবে না যার জীবনাদর্শ বইয়ের পাতায় ও মাটির স্তূপে নয়, বরং কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ও তাদের বাস্তব কাজে স্বীয় প্রাণবস্ততার প্রমাণ দিতে পারে। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য আপনি কল্পনার রকেটে চড়ে মক্কায় চলে যান দেখবেন লক্ষ লক্ষ মুসলমান এখনও সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং ইবরাহীম (আ)-এর আদর্শে আদর্শবান হবার জন্য বিশ্ববাসীকে বিপ্লব সৃষ্টিকারী আহ্বান জানাচ্ছে। তাই সবারই জানতে কৌতূহল হয় যে, ইবরাহীম কে এবং তাঁর আদর্শ কি? তারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো।

পারস্য উপসাগর হতে আনুমানিক ১০০ মাইল দূরে বহু বিপ্লবের সাক্ষী দুটি ঐতিহাসিক নদী দজলা ও ফুরাত। এ দুই নদীর তীরবর্তী নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলের একটি দেশ, যার প্রাক্তন নাম ব্যাবিলন এবং বর্তমান নাম ইরাক। ঐ ব্যাবিলনের একটি জনপদের নামা ছিল উর। সেখানে জন্মগ্রহণ করেন ইবরাহীম (আ)। যারা দুনিয়ার খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, পৃথিবীর প্রাক্তন সপ্তম আশ্চর্য বস্তুর মধ্যে একটি আশ্চর্য বস্তু ছিল ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান'। এ শূন্য উদ্যানের যারা আবিষ্কারক তারা ছিলেন সে যুগে পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য ও শিক্ষিত জাতি কালদানি জাতি বা চ্যালডিস জাতি। ঐ জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত হলেও তারা সবাই চাঁদ, সূর্য, তারকা ও প্রতিমার পূজারী মুশরিক ছিল। উক্ত মুশরিকদেরই এক পুরোহিত ছিলেন আযর। এ মুশরিক আযরের ঘরে জন্মেছিলেন একত্ববাদী ইবরাহীম (আ)।

বহুত্ববাদিতা ও নাস্তিকতার জঘন্য পরিবেশে প্রতিপালিত হয়ে যখন ইবরাহীমের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হলো তখন তিনি দেখতে পেলেন কোথাও সে যুগের সভ্যজাতি সূর্যকে দেবতা হিসেবে সেজদা করছে। কোথাও তারা চাঁদকে পূজা দিচ্ছে। কোথাও তারকাকে ইস্ট ও অনিষ্ট দেবতা মনে করছে। আবার কোথাও নিজহাতে গড়া প্রতিমার সামনে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ অসহায়ের মতো মাথা ঠুকছে। এ অভিনব দৃশ্যাবলী দেখে তিনি তাদেরকে নানারকম যুক্তি-তর্ক ও কলা--কৌশল দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা তার কথায় কর্ণপাত না করে তাকেই আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করলেন। মহান মহিমাময়ের কল্পনাতীত মহিমায় তিনি উদ্ধার পেলেন।


অতঃপর তিনি যখন উপলব্ধি করলেন যে, তার জন্মদাতা পিতা ও তার আত্মীয় স্বজনসহ সমস্ত দেশবাসী তার একত্ববাদের বাণী গ্রহণ করতে কোনোমতেই রাজী নয় তখন তিনি স্বীয় ঘর-বাড়ি, স্বীয় ধন-সম্পত্তি, স্বীয় মাতৃভূমি ও স্বজাতি এবং সবরকম সম্পর্ককে আল্লাহর রাস্তায় বিসর্জন দিয়ে স্বীয় মতালম্বী সহধর্মিণী বিবি সারা ও তাঁর মতানুসারী ভাইপো ঘৃত (আ)-কে সাথে নিয়ে সিরিয়ার দিকে হিজরত করলেন এবং দেশবাসীকে বললেন :

إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِيْنِ

“আর ইবরাহীম বললেন: আমি তো আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম, তিনিই আমাকে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেবেন।” (সূরা আস সাফফাত ৩৭ : ৯৯)

কেউ কেউ বলেন, এ হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৭৫ বছর এবং পৃথিবীর ইতিহাসে ইবরাহীমই প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করেন ও স্বীয় মাতৃভূমি ত্যাগ করেন । (ফাতহুল বায়ান; ৭ম খণ্ড, ১৫৩ পৃষ্ঠা)

প্রিয় পাঠক! এখন একটু চিন্তা করেন যে, সারা পৃথিবী যখন শিরক ও কুফরের অন্ধকারে ঠিক সে সময় সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন আল্লাহর নাম গ্রহণকারী তিন ব্যক্তির এ কাফেলা কতই না বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। আজকের এ উন্নত যুগে তার কল্পনাও করা যায় না। পথিমধ্যে তাঁর জীবনসঙ্গিনী বিবি সারার উপর পাশবিক হামলার চেষ্টা হলো। কিন্তু করুণাময়ের অদৃশ্য লীলায় মুসীবতের সে কালো মেঘ কোনোরূপে কেটে গেল সেই সাথে ঐ মুসিবাতের প্রতিফলস্বরূপ তিনি একটি তুফা বিবি হাজেরাকে উপহার পেলেন। পরে যাকে তিনি স্বীয় অর্ধাঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করেন। এভাবে বিপদের পর বিপদের মধ্যে তাঁর জীবনের আশিটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু তাঁর একত্ববাদের মিশন ব্যর্থই রয়ে গেল । মানুষের জীবনের এটাই সে সময় যখন সে বার্ধক্যের লাঠিস্বরূপ কোন এক আশ্রয়ের কথা বেশি করে চিন্তা করে। এতদিন পর্যন্ত ইবরাহীমের ঘরেও কোন সন্তান জন্ম হয়নি। তাই তিনি ভাবতে লাগলেন, তাইতো এ যুগের অভাগা বিশ্ব আমার একত্ববাদের মিশন স্বীকার করতে রাজী নয়। কাজেই এ সময় যদি আমার কোনো উত্তরাধিকারী থাকত তাহলে আমার পরে সে আমার মিশনকে অব্যহত রাখত। এরূপ অনেক কথা চিন্তা ভাবনা করে তিনি স্বীয় প্রভুর দরবারে প্রার্থনা করলেন এবং অনুনয় ও বিনয় সহকারে বললেন-

رَبِّي هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ

“হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সুপুত্র দান করুন । ” (সূরা আস্ সাফ্ফাত : আয়াত-১০০)

কথায় বলে অন্তর থেকে যে কথা বের হয় তা দ্বারা কাজ নিশ্চয়ই সাধিত হয়। তাই ব্যথিতের ফরিয়াদ গ্রহণকারী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বললেন-

فَبَشِّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ .

“অতঃপর আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।” (সূরা আস্ সাফফাত : আয়াত-১০১)


বিখ্যাত মুফাসসির মুকাতিল বলেন, যখন ইবরাহীম বাইতুল মুকাদ্দাসে গমন করেন তখন তিনি এ দু'আ করেন এবং মুফাসসিরে কুরআন ইবনে আব্বাস বলেন, যখন তিনি সিরিয়ায় হিজরত করেন তখন এ প্রার্থনা করেন। (ফাতহুল বায়ান ৮ম খণ্ড, ৬৮ পৃষ্ঠা)

অতঃপর ইবরাহীমের ঘরে একটি ছেলে জন্ম লাভ করল। ছেলেটির ব্যাপারে ইবরাহীম (আ) যখন স্বীয় প্রভুর নিকট দু'আ করেছিলেন তখন তিনি তাঁর প্রভুকে বারবার বলেছিলেন : 'ইসমাঅ ইয়া-য়ীল, ইসমাঅ ইয়া-য়ীল'। অর্থ : “হে আল্লাহ! আমার ফরিয়াদ শোন, হে আল্লাহ! আমার দু'আ কবুল কর।” তাই ছেলেটির নাম রাখা হলো ইসমাঈল। (ফাতহুল বায়ান ১ম খণ্ড, ১৮০ পৃষ্ঠা)

সে সময় ইবরাহীমের বয়স ছিল ৮৬। (ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৫ পৃষ্ঠা) ছেলের মুখ দেখলে কে-না খুশী হয় এবং বুড়ো বয়সে লাঠির ছায়া কে-না চায় । তাই শেষ বয়সে লাঠি স্বরূপ পুত্র পেয়ে ইবরাহীমের মনে খুশীর বান ডেকে উঠলো। অন্যদিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে আবার পরীক্ষার ধারা শুরু হলো। তাই ইবরাহীমকে হুকুম হলো, তুমি তোমার স্ত্রী হাজেরা এবং তোমার নয়নের তারা ইসমাঈলকে মক্কার ঘাস ও পানিহীন মরুভূমিতে রেখে এস। যে ইবরাহীম স্বীয় জানমাল এবং স্বীয় মাতৃভূমি ও স্বজাতিকে পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন তিনি এ হুকুম মানতে কি দ্বিধাবোধ করতে পারেন? তাই তিনি জনমানবহীন মক্কা শহরে হাজেরা ও ইসমাঈলকে রেখে চলে এলেন। অতঃপর কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী-

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعَى

ছেলেটি যখন দৌড়-ঝাঁপ করতে শিখল। (সূরা আস্ সাফ্ফাত ৩৭: ১০2 ) এবং মুফাসসিরে কুরআন ফাররার মতানুযায়ী ছেলেটি যখন ১৩ বছর বয়সে পা রাখল তখন ইবরাহীমকে স্বপ্নে হুকুম দেয়া হলো যে, তুমি তোমার কলিজার টুকরা ইসমাঈলকে আল্লাহর রাস্তায় উত্সর্গ কর। মুকাতিল বলেন, এ স্বপ্ন তিনি পরপর তিন রাতেই দেখলেন। (ফাতহুল বায়ান ৮ম খণ্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা)

যিলহজ্ব মাসের রাতে তিনি সর্বপ্রথম স্বপ্ন দেখেন যে, একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে যবেহ করছেন। স্বপ্নটি দেখার পর ঐ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি এ চিন্তায় বিভোর থাকেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্বপ্ন, না দুঃস্বপ্ন। অতঃপর ৯ম রাতে তিনি আবার ঐ একই স্বপ্ন দেখেন। ফলে ঐ দিন তিনি জানতে ও বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সত্যিকার স্বপ্ন। তারপর ১০ম রাতে তিনি আবার ঐ স্বপ্ন দেখেন। তাই ঐ দিনে তিনি কুরবানী করতে উদ্যত হন। পরপর তিনরাত স্বপ্ন দেখার পর তাঁর মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত তিনটি দিন বিশেষ নামে বিশেষিত হয়েছে। যেমন- যিলহজ্ব ৮ম দিনের নাম 'ইয়াওমুত তারবিয়াহ' বা চিন্তাভাবনার দিন, ৯ম দিনের নাম ইয়াওমুল আরাফাহ' বা জানার দিন, ১০ম দিনের নাম ইয়াওমুন নাহর বা কুরবানীর দিন। (তাফসীরে কাবীর ৭ম খণ্ড, ১৪৯ পৃষ্ঠা, তাফসীরে বাগাভী ও খাযি ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৩ পৃষ্ঠা, রুহুল মাআনী ২৩ নং খণ্ড, ১২৮ পৃষ্ঠা) (মাসিক হুদা)

কুরবানীর ব্যাপারে ইবরাহীমের কাছে সরাসরি ওহি না এসে তাকে স্বপ্ন দেখান হলো কেন? এ সম্পর্কে কোন এক তত্ত্বদর্শী বলেন, আল্লাহ তা'আলা যখন জিবরাঈলকে এ আদেশ দেন যে, ইবরাহীমকে তুমি এ বাণী পৌঁছে দাও যে, সে যেন তাঁর নয়নমনি ইসমাঈলকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করে। তখন জিবরাঈল আমীন আল্লাহকে বলেন: হে পরওয়ারদিগার! ইবরাহীমকে আমি সব সময়ে খুশী ও মঙ্গলের সুসংবাদ দিয়ে এসেছি। সুতরাং বুড়ো বয়সে তার একমাত্র পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী করার কথা আমি কি করে তাকে বলি? ফলে আল্লাহ তা'আলা নাকি ঐ ওহীটিকে স্বপ্নে রূপান্তরিত করে দেন- (দিল্লী)। ইবনে আবী হাতিম বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ অবস্থায় নবীদের স্বপ্ন ওহী স্বরূপ। (ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৬ পৃষ্ঠা) এ স্বপ্ন দেখার পর ইবরাহীম (আ) পুত্রকে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত হলেন এবং স্বীয় বিবি হাজেরাকে বললেন, ছেলেটাকে মুখ হাত ধৌত করে কাপড় পরিয়ে দাও। তাকে একটি কাজে নিয়ে যাব। মুসান্নাফে 'আবদুর রাযযাকে কা'ব আহবার থেকে একটি রেওয়াত রয়েছে যে, যখন ইবরাহীম (আ)-কে কুরবানীর স্বপ্ন দেখানো হয় তখন শয়তান মনে মনে বলে যে, এ সময় যদি আমি তাদেরকে ফিতনায় না ফেলতে পারি তাহলে আর কখনো পারব না।

অতঃপর দুই পিতা-পুত্র যখন ঘর থেকে বের হলেন, তখন শয়তান বিবি হাজেরার কাছে গিয়ে হাজির এবং তাঁকে বলল : তোমার পুত্রকে ইবরাহীম কোথায় নিয়ে গেলেন? তিনি বললেন: কোনো কাজে নিয়ে গেছেন। এবার শয়তান বলল: না, না। তিনি তাকে কোনো প্রয়োজনে নিয়ে যান নি; বরং তাকে যবেহ করতে নিয়ে গেছেন। হাজেরা জিজ্ঞেস করলেন: তিনি তাকে যবেহ করবেন কেন? শয়তান বলল: ইবরাহীমের ধারণা যে, তাঁর প্রভু নাকি তাঁকে এ কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। একথা শুনে হাজেরা বললেন: তাহলে তো তিনি তাঁর পরওয়ারদিগারের হুকুম পালন করে খুব ভালো কাজ করেছেন। এখানে শয়তান নিরাশ হয়ে তাদের দু'জনের পিছনে ছুটলো ।

অতঃপর ছেলেটিকে গিয়ে বলল: তোমার বাপ তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছেলেটি বলল: কোনো কাজে হবে। শয়তান বলল: না! কোন কাজে নয়; বরং তোমাকে যবেহ করতে নিয়ে যাচ্ছেন। সে বলল: আমাকে তিনি যবেহ করবেন কেন? শয়তান, বলল তাঁর ধারণা যে, তাঁর প্রভু নাকি তাঁকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। ছেলেটি বলল: আল্লাহর শপথ! যদি তাঁকে আল্লাহ তা'আলা এ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চই এ কাজ করবেন। এখানেও শয়তান সুবিধা করতে পারল না। [এ রেওয়ায়াতটিতে বিবি সারাহ ও ইসহাকের নাম উল্লেখ আছে। কিন্তু তত্ত্বদর্শী বিদ্বান ও মুসলমানদের সর্ববাদী সম্মত মতে 'যবীহ' যেহেতু ইসমাঈল (আ) সেজন্য অনেকে এ বর্ণনাটিকে ইসমাঈল ও হাজেরার সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন। আমিও তাই তাঁদের অনুকরণে এখানে হাজেরা ও ইসমাঈলের নাম উল্লেখ করেছি।]

তাই এবার সে ইবরাহীমের নিকট গিয়ে ভিড়ল এবং তাঁকে বলল : আপনার ছেলেকে সকালে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? তিনি বললেন: একটি প্রয়োজন। শয়তান বলল: আপনি তো তাকে কোনো প্রয়োজনে নিয়ে যাচ্ছেন না; বরং তাকে যবেহ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বললেন: আমি তাকে যবেহ করব কেন? শয়তান বলল: আপনি মনে করেন যে, আপনার প্রতিপালক নাকি আপনাকে এ কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বললেন: আল্লাহর শপথ! যদি তিনি আমাকে এ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে আমি একাজ অবশ্যই অবশ্যই করব। (ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৬ পৃষ্ঠা)

কতিপয় ঐতিহাসিক ও তাফসীরী বর্ণনা দ্বারা এ বিষয়ে জানা যায় যে, শয়তান তিনবার ইবরাহীম (আ)-কে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারেই তিনি ৭টি করে কাঁকর মেরে শয়তানকে বিতারিত করেন। তাঁর ঐ কাঁকর মারার স্মৃতি আজও প্রতি বছর হজের সময় পালন করা হয়। (তাফসীরে বাগাভী ও খাযিন ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৪) এবং তাফসীরে মাযহারী- (৮ম খণ্ড, ১৩১) 

শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়ার পর ইবরাহীম তাঁর ছেলেকে বললেন-

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعَى قَالَ يُبْنَى إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي اذبحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرى ، قَالَ يَابَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّبِرِينَ .

“তারপর সে যখন তাঁর পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম (আ) বললেন : হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি; এখন তুমি বল, তোমার অভিমত কি? সে বলল : হে আমার পিতা ! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা পূর্ণ করুন। ইনশা আল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা আস-সাফফাত : আয়াত-১০২) এভাবে পিতা পুত্রের সাওয়াল-জাওয়াবের পর ছেলেটি যখন রাজী হয়ে গেল তখন দু'জনই মহান আল্লাহর নিকট নিজেদের সঁপে দিল। কাতাদাহ বলেন: ছেলেটি জীবনের মালিকের সামনে তার জীবনের তুহফা পেশ করল এবং তার পিতা নিজ কলিজার টুকরাকে ছিঁড়ে আল্লাহর সামনে রেখে দিল । (তাফসীরে কাবীর ৭ম খণ্ড, ১৫৩ পৃষ্ঠা, ফাতহুল বায়ান ৮ম খণ্ড, ৭১ পৃষ্ঠা) 

ইবনুল মুনযির ও মুস্তাদরাকে হাকিমে মুজাহিদ থেকে বর্ণনা রয়েছে যে, তারপর ছেলেটি তার পিতাকে বলল: আপনি আমাকে চোখে দেখা অবস্থায় যবেহ করতে পারবেন না। কারণ, আপনার হয়তো ছেলের মায়া উথলে উঠতে পারে, ফলে আপনার ছুরি নাও চলতে পারে? অথবা আমি হয়তো অধৈর্য হয়ে ছটফট করতে পারি এবং আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিতে পারি। সেজন্য আপনি আমার হাত থেকে ঘাড় পর্যন্ত শক্ত করে বেঁধে দিন। তারপর আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন। (ফাতহুল বায়ান ৭৩ পৃষ্ঠা)

অন্য বর্ণনায় আছে, “ছেলেটি আবার বলল: পিতা! আপনি নিজের কাপড়টা জড়িয়ে নিন এবং আমাকে ভালো করে বেঁধে দিন। যাতে আমার রক্তের ছিটে আপনার গায়ে না লাগে এবং আমার নেকী কমে না যায়। আর যবেহের পর আপনি যখন আমার মায়ের কাছে যাবেন তখন তাঁকে আমার সালাম দেবেন। আর আপনি যদি আমার জামাটা মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চান তাহলে নিয়ে যাবেন। যাতে তিনি কিছুটা সান্ত্বনা পান। কলিজার টুকরা একমাত্র কচি বাচ্চার মুখ দিয়ে এ রকম কথা শুনে ইবরাহীমের মনে কি প্রতিক্রিয়াই না হতে পারে ! তবুও তিনি ধৈর্যের অটল পাহাড় হয়ে জওয়াব দিচ্ছেন: বাবা! তুমি আল্লাহর হুকুম পালনার্থে আমার কি উত্তম সাহায্যকারী! কথাটি বলে তিনি পুত্রকে চুমু খেলেন এবং ছলছল চোখে তাকে বাঁধলেন।” (তাফসীরে বাগাভী, খাযিন ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা, কাবীর ৭ম খণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা)

অতঃপর কুরআনের ভাষায়-

فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ.

(সূরা আস্-সাফফাত : আয়াত-১০৩ )

ইবরাহীম তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। মুসনাদে আহমদে একটি হাদীস রয়েছে যে, তখন ইসমাঈলের গায়ে একটি সাদা জামা ছিল। তাই সে বলল : হে আব্বাজান! এটা ছাড়া আমার কাছে আর তো কোনো কাপড় নেই, যদ্বারা আপনি আমাকে কাফন দিতে পারেন। অতএব, আপনি এ জামাটি খুলে নিন যাতে আমার কাফনের কাজ হয়ে যায়। সুতরাং তিনি জামাটা খুলে নিলেন। (ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৬ পৃষ্ঠা)

এবার শুরু হলো আসল ইতিহাসের সূচনা। অর্থাৎ ছেলেটির গলায় ছুরি চালাবার পালা। আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণের মূর্ত প্রতীক ইবরাহীমের হাত যখন ছেলেটির ঘাড়ে ছুরি চালিয়ে দিল বিশ্বজাহান তখন কেঁপে উঠল। সে কি এক অভিনব দৃশ্য! পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে ঘটবে কিনা তাও কে বলতে পারে। একদিকে জনমানবহীন, পশু-পক্ষী ও প্রাণীহীন নীরব মক্কা নগরী। অন্যদিকে ধু ধু বালির মধ্যে খাঁ খা করছে মিনার ঐতিহাসিক প্রান্তর। আর তারই মাঝে একটি ৯৯ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং তাঁর ছুরির তলায় পড়ে রয়েছে ১৩ বছরের সুন্দর ফুটফুটে কুসুমতি এক তরুণ টগবগে যুবক। এ এক অকল্পনীয়, অচিন্তিনীয় প্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে আকাশ যেন অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে এবং আদমের জন্মের সময় প্রবল আপত্তিকারী ফেরেশতারাও যেন ফুফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। গাছপালা কেউ যেন আর নড়ছে না এবং পশু-পক্ষীরাও যেন চলাচল করতে পারছে না। বাতাসের গতিও যেন থমকে গেল এবং পাহাড় ও পর্বতেও যেন একটা নিঝুমভাব ফুটে উঠল । সবাই যখন বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে এ অভাবনীয় দৃশ্য অবলোকন করছে ইবরাহীমের হাত তখন ইসমাঈলের ঘাড়ে অনবরত চলছে। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছা বুঝা বড় ভার। তাই ইমাম সুদ্দী বলেন: এদিকে আল্লাহ ইবরাহীমকে হুকুম দিয়েছেন নিজ হাতে ছেলে যবেহ কর, আর ওদিকে তিনি ছুরিকে নির্দেশ দিয়েছেন, তুমি মোটেই কেটো না। ফলে ছুরি এবং তার ঘাড়ের মাঝখানে আল্লাহর কুদরতে একটি পিতলের পাত আড় সৃষ্টি করে। সেজন্য ইবরাহীম বারবার ছুরি চালালেও কোন কাজ হচ্ছিল না। (ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৭ পৃষ্ঠা ও ফাতহুল বায়ান ৮ম খণ্ড, ৭২ পৃষ্ঠা) এ অচিন্তনীয় পরিস্থিতিতে বিশ্বজগতের সবাই যখন হতভম্ব এবং হতবাক ও শ্বাসরুদ্ধ তখন মহান রব্বুল আলামীন আল্লাহ তাঁর রহস্য ফাঁস করে দিয়ে জান্নাত থেকে জিবরাঈলের মাধ্যমে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন এবং ইসমাঈলকে বাঁচিয়ে নিয়ে ইবরাহীমের অজান্তে সে দুম্বাটিকে তাঁর দ্বারা যবেহ করিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন-

وَنَادَيْنَهُ أَنْ بَإِبْرَاهِيمُ - قَدْ صَدَّقْتَ الدُّنْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِينَ إِنْ هَذَا لَهُوَ الْبَلَزُ الْمُبِينُ ، وَفَدَيْنَهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

“তখন আমি তাকে ডেকে বললাম: হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে প্রমাণ করে দেখালে। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদেরকে পুরুস্কার দিয়ে থাকি । নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান যবেহের বিনিময়ে।” (সূরা সাফফাত : আয়াত-১০৪-১০৭)

ওয়াহিদী বলেন : ইবনে আব্বাসসহ অধিকাংশ মুফাসসিরীনের মতে, ইবরাহীমের কাছে সে দুম্বাটি পাঠানো হয়েছিল যেটাকে জান্নাতে চল্লিশ বছর ধরে লালন পালন করা হয়েছিল। (ফাতহুল বায়ান; ৭৩ পৃষ্ঠা)

কিন্তু ইবনে আবী হাতিম ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এটা সে দুম্বা যেটা আদম (আ)-এর ছেলে (হাবীল) আল্লাহর দরবারে কুরবানী করেছিল এবং সেটা কবূলও হয়েছিল । তখন থেকে ওটা জান্নাতে চলতে থাকে। পরিশেষে তার দ্বারা আল্লাহ তা'আলা ইসমাঈলকে বাঁচিয়ে নেন । (ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৭ পৃষ্ঠা, কাবীর ৭ম খণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা)। 

একটি বর্ণনায় আছে, ইবরাহীম (আ) যখন ইসমাঈলকে যবেহ করছিলেন তখন জিবরাঈল (আ) বলেছিলেন : আল্লাহু আকবার! আল্লা-হু আকবার । অতঃপর ইবরাহীম বলেন, আল্লাহু আকবার। ওয়ালিল্লা-হিল হামদ। তারপর থেকে এ তাকবীরটা চিরস্থায়ী সুন্নাতে পরিণত হয়। (তাফসীরে নাসাফী ৪র্থ খণ্ড, ২০ পৃষ্ঠা, কাশশাফ ৩য় খণ্ড, ৩০৮ পৃষ্ঠা, তাফসীরে আবূস সউদ ৭ম খণ্ড, ৫৪৮ পৃষ্ঠা, ফাতহুল বায়ান ৮ম খণ্ড, ৭৪) 

জন্মদিন থেকে জীবনের ৯৯টি বছর ধরে একটার পর একটা পরীক্ষা করে যখন পরওয়ারদিগারে 'আলাম ইবরাহীমের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন তখন তাঁর এ চিত্তহারী, রোমাঞ্চকর ও বিপ্লব সৃষ্টিকারী কীর্তিকে কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষয়, অমর করে দিলেন এ বলে:

وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ * سَلْمٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ .

“আর আমি তার জন্য এ বিষয়টি ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত রাখলাম । 'সালাম' বর্ষিত হোক ইবরাহীমের ওপর।" (সূরা আস-সাফতাত : আয়াত-১০৮-১০৯)

অতঃপর আল্লাহর ঘোষণা মোতাবেক তখন থেকে চলে আসছে এ ইবরাহীমী আদর্শের বাস্তবায়ন। তাই আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ আল্লাহর হুকুমের প্রতিপালনের সাথে সাথে প্রতি বছর ইবরাহীমের স্মৃতি পালন করে পাপমোচন-সাগরে করছে অবগাহন। আল্লাহর বাণী প্রচারার্থে ৭৫ বছরের মায়া মমতা বিজড়িত মাতৃভূমি ত্যাগকারী, মানবজাতির ইতিহাসে পৃথিবীর সর্বপ্রথম হিজরতকারী ইবরাহীম (আ)-এর বাস্তুভিটা ত্যাগের আদর্শ, যুক্তি ও তর্ক সহকারে তাওহীদের (একত্ববাদের) উদাত্ত আহ্বান বলিষ্ঠকন্ঠে ও নির্ভীকচিত্তে প্রচার করার তাগিদে শিরকের (বহুত্ববাদিতার) মূর্ত প্রতীক জন্মদাতা পিতার অপত্যস্নেহ ও স্বদেশবাসীর অকৃত্রিম ভালোবাসার মায়াজাল ছিন্নকারী, অসহায় ও দৃঢ়চিত্ত ইবরাহীমের প্রেরণাদায়ক আদর্শ, ইচ্ছাময়ের ইচ্ছার কাছে নিজের কামনা ও বাসনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বীয় কলিজার টুকরাকে নিজ হাতে কুরবানীর জন্য ছুরি চালানোর জন্য ইবরাহীমের অনুপম আদর্শাবলী অনাগত বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয়, বরণীয় ও চিরস্মরণীয় হবার যোগ্য নয় কি? এগুলোই হল ইবরাহীমের সেসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যার কারণে মহান আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীমের আদর্শকে কিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী করে দিয়েছেন। সেজন্য ইবরাহীম (আ) পাঁচ হাজার বছর স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন কালজয়ী এবং বিশ্বের তাওহীদ বাদীদের হৃদয়বিজয়ী।

ইবরাহীম (আ)-এর কুরবানী সম্পর্কে কাল্পনিক গল্প

ইবরাহীম (আ)-এর উট কুরবানী ঠিক, না কাল্পনিক? ইবরাহীম (আ) স্বপ্নে যখন কুরবানীর নির্দেশ পান তখন তাঁকে স্বপ্নে কি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল? এ ব্যাপারে ওয়ায়িযীন ও বক্তাদের মুখে এবং কবি-লেখক ও জনগণের মধ্যে প্রচারিত আছে যে, ইবরাহীমকে নাকি বলা হয়েছিল যে, তুমি তোমার প্রিয়বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী কর। ফলে তিনি তিনদিনে তিনশো উট কুরবানী করেন। তারপরে তিনি আবার তাঁর প্রিয়বস্তু কুরবানী করার নির্দেশ পাওয়ায় তিনি বুঝতে পারলেন যে, প্রিয় বস্তু বলতে তাঁর একমাত্র পুত্র ইসমাঈলকেই কুরবানী করতে বলা হয়েছে। তাই তিনি সবশেষে স্বীয় পুত্রকে কুরবানী করতে সচেষ্ট হন।

এ ব্যাপারে মজার কথা হলো যে, 'তুমি তোমার প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী কর'- এ কথাটি আমাদের সমাজে কোথা থেকে প্রচার হলো বোধগম্য নয়। কারণ কুরআনের কোথাও ঐ বাক্যটির সন্ধান খুঁজে পাওয়া যায় না এবং কুরআনের নির্ভরযোগ্য কোন তাফসীরেও ঐ বাক্যটির উৎস নেই। তেমনি তিনশো উট কুরবানীর কথাও কোনো হাদীস ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরে খুঁজে পেলাম না। উক্ত দু'টি বিষয় অর্থাৎ 'প্রিয় বস্তুকে কুরবানী করার নির্দেশ এবং ঐ নির্দেশ পালনার্থে “তিনশো উট কুরবানী'র কথা তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে ফাতহুল কাদীর, তাফসীরে কাবীর, তাফসীরে আবুস সউদ, তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে নাসাফী, কাশশাফ, বায়যাভী, ফাতহুল বায়ান, রূহুল মা'আ-নী, বাগাভী ও তাফসীরে খাযিন প্রভৃতি তাফসীরগুলো তন্নতন্ন করে দেখলাম । কিন্তু কোথাও উক্ত দু'টি বিষয়ের সন্ধান পেলাম না ।

অতঃপর উর্দূ তাফসীরগুলোর মধ্যে তাফসীরে হুসাইনী, হাক্কানী ও ‘উসমান, মা'আ-রিফুল কুরআন ও বায়ানুল কুরআন, মাজিদী ও মওদূদী, সানায়ী ও রিযায়ী প্রভৃতি তাফসীরসমূহ মন্থর করলাম। আমার সাধ্যমতো হাদীস ও শরহে হাদীসের বহু গ্রন্থও অধ্যয়ন করলাম। বহু আলিমকেও এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কোথাও বিষয় দু'টির রেফারেন্স খুঁজে পেলাম না। যারা ঐ কথাগুলো বলে বেড়ান তারা কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভিত্তিতে বলেন কি না জানি না। কুরআন স্পষ্ট বলছে যে, ইবরাহীম তাঁর প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করাকে এ স্বপ্ন দেখেননি, বরং তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, 'স্বীয় পুত্রকেই যবেহ করছেন'। আয়াতটির তাফসীরকার সমস্ত মুফাসসিরগণও তাই বলেছেন যে, তিনি পরপর তিনটি রাতেই স্বপ্ন দেখেন যে, স্বীয় পুত্রকে যবেহ করছেন। তাহলে প্রিয় বস্তু কুরবানীর কথা এল কোথা থেকে? কাসাসুল আম্বিয়ার উর্দূ অনুবাদ গ্রন্থের ৪৫ পৃষ্ঠায় আছে যে, ইবরাহীম (আ) দুইশত করে মোট ছয়শত উট কুরবানী করেন। পরপর তিনরাত স্বপ্ন দেখেন এবং প্রতিদিন কুরবানী করেন। তারপর ৪র্থ রাতে স্বপ্ন দেখেন ৪র্থ দিনে তিনি নিজ পুত্রকে কুরবানী দিতে উদ্যত হন ।

উক্ত কাসাসুল আম্বিয়া গ্রন্থে বহু উদ্ভট ও গাজাখুরী কাল্পনিক বানোয়াট কথা লেখা রয়েছে যার প্রতিবাদ মাও: হিফযুর রহমান (রহ) কাসাসুল কুরআন নামক গ্রন্থে প্রায়ই করেছেন। সমস্ত তাফসীর ওয়ালারা বলছেন, ইবরাহীম (আ) স্বপ্ন দেখেন তিনরাত, কিন্তু কাসাসুল আম্বিয়া বলছে, চার রাত। বাজারে রটে আছে, তিনশত উট কুরবানীর কথা। কিন্তু কাসাসুল আম্বিয়া বলছে, ছয়শত উট। আমার মনে হয় যে, এগুলো ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের বিকৃত বর্ণনার বহিপ্রকাশ ।

তাই সত্যিকার আলিমদের কাছে জানতে চাইছি যে, "প্রিয় বস্তু কুরবানী করার নির্দেশ' এবং ঐ নির্দেশ পালনার্থে ইবরাহীম (আ)-এর তিনশত বা ছয়শত উট কুরবানী'র কথা কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসীরে কিংবা সহীহ হাদীসে আছে কি যদি থাকে তাহলে ঐ তাফসীর বা হাদীস গ্রন্থের খণ্ড ও পৃষ্ঠার বর্ণনাসহ বিষয়টি আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন। অন্যথায় ব্যাপারটি যদি ভিত্তিহীন হয় তাহলে প্রকৃত ব্যাপারটি জনগণকে জানিয়ে ভ্রান্তিমুক্ত করবেন। আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত বিষয় জানার এবং তা প্রচারের তাওফীক দিন- আমীন।

কুরবানীর গুরত্ব

মুহাম্মদ মুস্তফা নবী হবার পর মক্কায় তেরটি বছর অতিবাহিত করেন। তারপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে মদীনায় হিজরত করে চলে যান। অতঃপর কিছুদিনের মধ্যে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরবানী দেবার নির্দেশ পান । এ হুকুম পাবার পর তিনি দশ বছর বেঁচেছিলেন। তাই ঐ দশ বছরই তিনি কুরবানী করতে থাকেন। যেমন 'আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেন, রাসূলূল্লাহ দশ বছর মাদীনায় অবস্থান করেন এবং কুরবানীও করতে থাকেন।

(আত্-তিরমিযী ১ম খণ্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা, মিশকাত ১২৯ পৃষ্ঠা) হাফেয ইবনুল কাইয়্যুম বলেন, রাসূল কখনো কুরবানী বিরতি দেননি । (যাদুল মা'আদ ১ম খণ্ড, ২৪৬ পৃষ্ঠা) উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, কুরবানী সুন্নাতে মুআক্কাদা । এটা ফরয ও ওয়াজিব নয়।

তবে কোনো কোনো হাদীস দ্বারা বাহ্যত মনে হয় যে, কুরবানী ওয়াজিব বা অবশ্য পালনীয় কাজ। যেমন- ইবনে মাজার একটি হাদীসে আছে- রাসূলুল্লাহ জামাল বলেন : যে ব্যক্তি কুরবানীর সামর্থ্য রাখে অথচ কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (ইবনে মাজাহ ২৩২ পৃষ্ঠা)

আল্লামা জামালুদ্দীন ‘আবদুল্লাহ যায়লাঈ বলেন, এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদ, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুসনাদে আবূ ইয়ালা, সুনানে দারাকুতনী ও মুস্তাদরাকে হাকিম প্রভৃতিতেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর কয়েকটি বর্ণনার সনদ রাসূলুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছায় না; বরং তা সাহাবী আবূ হুরায়রাহ (রা) পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়। কাজেই হাদীসটি মারফূ নয়; বরং মাওকুফ (নাসবুর রায়াহ ৪র্থ খণ্ড, ২০৭ পৃষ্ঠা) ইমাম তাহাভীও বলেন, মওকৃষ্ণ হওয়াটা সঠিক। তথ্যটি এ হাদীসে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার স্পষ্ট নির্দেশ নেই। (ফাতহুল বারী ১০ম খণ্ড, ১ম পৃষ্ঠা)

এ হাদীসটির একজন রাবী 'আবদুল্লাহ ইবনে আইয়াশকে ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম নাসায়ী যঈফ ও দুর্বল বলেছেন । (ইবনে মাজার উক্ত পৃষ্ঠায় বায়নাস সুর) সুতরাং হাদীসটি দলীলযোগ্য নয়। আল্লামা ইবনে জাওযী 'তাহ্কীক' গ্রন্থে বলেন, এ হাদীসটি ওয়াজিব প্রমাণ করে না। যেমন- ঐ হাদীস 'যে ব্যক্তি রসুন খায় সে যেন আমাদের সালাত পড়ার জায়গার নিকটেই না আসে' উক্ত হুকুমটিকে ওয়াজিব প্রমাণ করে না। (নাসবুর রায়াহ ৪র্থ খণ্ড, ২০৭ )

সুনানে আরবা'আ ও মুসসনাদে আহমদের একটি হাদীসে রয়েছে- হে মানবমণ্ডলী! প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রতি বছরে একটি করে কুরবানী ও আতীরাহ নিশ্চয়ই আছে। এ হাদীস সম্পর্কে হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) বলেন, এ হাদীসটিতেও কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার স্পষ্ট কোনো শব্দ নেই । তাছাড়া এ রেওয়ায়াতে কুরবানীর সাথে “আতীরা”রও উল্লেখ আছে, যা সর্বসম্মত মতে ওয়াজিব তো নয়ই, বরং অন্য হাদীস দ্বারা বাতিল বলে প্রমাণিত। (ফাতহুল বারী ১০ম খণ্ড, ২য় পৃষ্ঠা)

কোনো সহীহ ও বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা কুরবানী ওয়াজিব প্রমাণিত না হলেও রাসূলুল্লাহর সর্বদা 'আমাল দ্বারা কারো কারো মনে ওয়াজিব হওয়ার সন্দেহ হয়। তাই একজন লোক নবী করীম সুন্নাতের আশেক ‘আবদুল্লাহ ইবনে "উমরকে জিজ্ঞেস করেন, কুরবানী কি ওয়াজিব? অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় কাজ কি? উত্তরে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ কুরবানী দিতেন এবং মুসলমানেরাও করতেন। এ উত্তরে প্রশ্নকারী দ্বিধামুক্ত না হওয়ায় তিনি আবার প্রশ্ন করেন, এটা ওয়াজিব কি-না? উত্তরে তিনিও আবার বললেন, তুমি বুঝতে পারছ না। আমি তো বলছি, রাসূলুল্লাহ কুরবানী করতেন এবং তারপর সাধারণ মুসলমানেরাও কুরবানী দিত। তারপর থেকে এ সুন্নাত প্রচলিত।

(আত্-তিরমিযী ১ম খণ্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা ও ইবনে মাজাহ ২৩২ পৃষ্ঠা) ইমাম তিরমিযী (র) বলেন, আহলে ইলম বা কুরআন হাদীস জ্ঞানীদের 'আমাল এ ছিল যে, কুরবানী ওয়াজিব নয়; বরং নবী করীম এর সুন্নাতের মধ্যে এটি একটি সুন্নাত। (আত্‌-তিরমিযী ১ম খণ্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা)

মুসনাদে আহমদ, আবূ ইয়ালা, তাবারানী, দারাকুতনী ও হাকীম প্রভৃতিতে একটি যঈফ হাদীসে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ বলেন, আমার উপর কুরবানী ফরয, কিন্তু তোমাদের উপর নয়। (ফাতহুল বারী ১০ম খণ্ড, ৪র্থ অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসূল বলেন: কুরবানী আমার উপরে ফরয এবং তোমাদের উপরে সুন্নাত। (তাবারানী কানযুল উম্মা-ল ৫ম খণ্ড, ৪৩) 

কুরবানী “সুন্নাত” হওয়া সম্পর্কে সহীহ ও য'ঈফ হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো য'ঈফ হাদীস দ্বারা পরোক্ষভাবে তা ওয়াজিব হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়ার কারণে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে, কুরবানী সুন্নাত না ওয়াজিব অর্থাৎ- শুধু করণীয় না অবশ্য পালনীয়? ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর মতে প্রত্যেক স্বাধীন, ধনী ও ঘরে অবস্থানকারী মুসলমানের উপরে কুরবানী ওয়াজিব। (হিদায়া ৪র্থ খণ্ড, ৪৪৩ পৃষ্ঠা)

ইমাম শাফিঈ (রহ) বলেন : কুরবানী সুন্নাত। একে আমি পরিত্যাগ করা পছন্দ করি না। (কিতাবুল উম্ম ২য় খণ্ড, ১৮৭ পৃষ্ঠা)

ইমাম মালিক (রহ) বলেন : কুরবানী সুন্নাত; ওয়াজিব নয় এবং কোনো ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি একে বর্জন করে আমি তা পছন্দ করি না। (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক; ১৮৯ পৃষ্ঠা) তিনি ইমাম আবূ হানীফার মত, “ঘরে অবস্থানকারীর” শর্ত লাগাননি। ইমাম আহমদ (রহ) বলেন : সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা বর্জন করা আপত্তিকর । হানাফীদের ইমাম আবূ ইউসুফ, মালিকীদের ইমাম আসহাব এবং জমহুর ও অধিকাংশ আলিমের মতে তা সুন্নাতে মুআক্কাদা। (ফাতহুল বারী ১০ম খণ্ড, ১মা ) কুরবানী সুন্নাত, ফরয নয়। কোনো সাহাবী ইমাম ইবনে হাযম (রহ) বলেন, থেকেও সহীহ সনদে প্রমাণিত নেই যে, কুরবানী ওয়াজিব । (মুহাল্লা ৭ম খণ্ড, ৩৫৫-৩৫৮ পৃষ্ঠা) 

উপরোক্ত বর্ণনার সারকথা হচ্ছে এই যে, কুরবানী বিশ্বনবী এর আজীবন সুন্নাত এবং তাঁর ইন্তিকালের পর থেকে মুসলিম জাহানের সার্বজনীন 'আমল এবং ইসলামের এক মহান বৈশিষ্ট্য। তাই কোনো সামর্থবান মুসলমানের পক্ষে কুরবানী ত্যাগ করা মোটেই উচিত নয়। এমনকি ধার করেও যদি কুরবানী দেয়া সম্ভব হয় তাও দেয়া উচিত। যেমন 'আয়েশা (রা) একদা রাসূলুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি দেনা করেও কুরবানী দেব কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ । কারণ এ দেনা শোধ হবেই। (দারাকুতনী ২য় খণ্ড, ৫৪৪ পৃষ্ঠা)

এ হাদীসটি য'ঈফ হলেও মুহাদ্দিসীনে কিরাম ও ফকীহদের কাছে আমলযোগ্য। কিন্তু কুরবানীদাতাদের একটা কথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, ঐ টাকা যেন সুদের টাকা না হয় এবং তাদের কুরবানী যেন লোক দেখানো অথবা দুনিয়ায় নাম পাওয়া অথবা আত্মঅহংকার প্রকাশ প্রভৃতির জন্য না হয়ে থাকে। কারণ কুরবানীর ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

لن بنالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ .

“আর আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত এবং না এগুলোর রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যেন তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর, যেহেতু তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দান করেছেন। আর সংবাদ দাও সৎকর্মশীল লোকদেরকে।” (সূরা আল-হজ্জ : আয়াত-৩৭ )

হাবীল ও কাবীলের কুরবানীর ব্যাপারেও আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَا ابْنَى أَدَمَ بِالْحَقِّ ، إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِلَ مِنْ أحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ ، قَالَ لَا قَتْلَنَّكَ ، قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ.

“তুমি তাদের সঠিকভাবে শুনাও আদমের দুই পুত্রের বিবরণ। যখন তারা কুরবানী করেছিল তখন তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কুরবানী কবুল করা হয়নি। সে বলল : 'অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব'। অপরজন বলল : আল্লাহ একমাত্র আল্লাহ ভীরুদের কুরবানী কবুল করেন।” (সূরা আল-মায়িদাহ : আয়াত-২৭)

কুরবানীর মাহাত্ম্য

রাসুলুল্লাহ বলেন : ইয়াওমুন নাহরে (অর্থাৎ বকরা ঈদের দিনে) আদম সন্তান যত কাজ করে তন্মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ (কুরবানীর জানোয়ারের) রক্তপাত। ঐ জানোয়ার কিয়ামতের দিনে তার শিং ও পশম এবং খুরসহ নিশ্চয়ই হাযির হবে আর তার বদ্ধ যমীনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবূলিয়াতের (গৃহীত হবার) দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা কুরবানী করে নিজেদের মনকে তৃপ্ত কর । (আত্-তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্ মিশকাত ১২৮) একদা সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ কে জিজ্ঞেস করেন, কুরবানী কি? হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর সুন্নাত ও আদর্শ। তাঁরা আবার প্রশ্ন করলেন, এতে আমাদের উপকার কি? তিনি বললেন, প্রত্যেক পশমের বদলে একটি করে নেকী রয়েছে।

(মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ১২৯ পৃষ্ঠা) একদা তিনি ফাতিমা (রা)-কে বলেন, ঐ জানোয়ারের প্রত্যেক রক্তবিন্দুর বদলে তোমার একটি করে গুনাহ মাফ হবে এবং ঐ জানোয়ারটিকে তার খুন ও গোশতসহ তোমার দাঁড়িপাল্লাতে সত্তর গুণ ভারী করে দেয়া হবে।
(আবুল কাসিম ইসবাহানী, মির'আত ২য় খণ্ড, ৩৬২ পৃষ্ঠা) কথাটি শুনে আবূ সা'ঈদ খুদরী (রা) জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ নেকী মুহাম্মদ এর বংশের জন্য নির্দিষ্ট না সর্বসাধারণের জন্যও? তিনি বললেন, এটা মুহাম্মদ-এর বংশ এবং সর্বসাধারণ সবারই জন্যই নির্দিষ্ট। ('বাইহাকী, কানযুল উম্মাল ৫ম খণ্ড, ১১৯ ও ৫১, মুস্তাদাকে হাকীম ৪র্থ খণ্ড, ২২২ ও নাসবুর রায়াহ ৪র্থ খণ্ড, ২১৯)

আল্লামা আবূ বকর ইবনুল আরাবী তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ আ-রিয়াতুল আহহওয়াযীতে বলেন, কুরবানীর ফযিলত ও মাহাত্ম সংক্রান্ত একটি হাদীসও সহীহ বা বিশুদ্ধ নয়। (তালখীসুল হাবীর ২য় খণ্ড, ৩৮৪ পৃষ্ঠা)
ইমাম ইবনে হাযমও তাই বলেন। (আল-মুহাল্লা ৭ম খণ্ড, ৩৫৭ পৃষ্ঠা) আল্লামা 'উবাইদুল্লাহ রাহমানী বলেন, ঐ সমস্ত হাদীসগুলোর সনদ আপত্তিমুক্ত না হলেও তারা একে অপরকে সমর্থন করার ফলে সবাই সমষ্টিগতভাবে য'ঈফ থেকে হাসানের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, 'আমলের ফযিলত ও মাহাত্ম্য সংক্রান্ত ব্যাপারে য'ঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য । (মির'আত ২য় খণ্ড, ৩৬৩ পৃষ্ঠা)

দারিদ্র্যের কারণে যার উপরে কুরবানী নেই তার কুরবানীদাতার সাথে সাদৃশ্য পেশ করার জন্য কুরবানীর দিনে মুরগি ও মোরগ কুরবানী দেয়া আপত্তিকর। কারণ এটা অগ্নিপূজকদের প্রথা। (ফাতাওয়া আলমগীরী ৪র্থ খণ্ড, ৮১ পৃষ্ঠা)




****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url