সাহাবাগণের জীবনকথা-৭৫ || যায়িদ ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর জীবনী






যায়িদ ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)


নাম যায়িদ, ডাক নাম আবু আবদির রহমান। পিতা খাত্তাব ইবন নুফাইল, মাতা আসমা বিনতু ওয়াহাব। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের বৈমাত্রীয় ভাই এবং বয়সে হযরত 'উমার থেকে বড়। (উসুদুল গাবা- ২/২২৮)

যায়িদ (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ ও ‍হিজরাত


ইসলামের সূচনা পর্বে উমারের বাড়াবাড়ির কারণে যদিও খাত্তাবের বাড়ী সন্ত্রস্ত ছিল; যায়িদ (রাঃ) উমারের পূর্বেই ইসলাম কবুল করেন এবং মুহাজিরদের প্রথম কাফিলার সাথে মদীনায় হিজরাতও করেন। হযরত রাসুলে কারীম (সাঃ) মদীনায় আসার পর মান ইবন 'আদী আল 'আজলানীর সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।

ইসলামের যুদ্ধে যায়িদের (রাঃ) সাহসিকতা


মদীনায় আসার পর সর্বপ্রথম 'বদর' যুদ্ধে শরিক হন। তারপর উহুদেও অংশগ্রহণ করেন। দারুণ সাহসী ছিলেন। প্রত্যেক যুদ্ধে তিনি যতটা না বিজয় কামনা করতেন তারচেয়ে বেশী কামনা করতেন শাহাদাত। উহুদে তিনি অসীম সাহসের সাথে লড়ছেন। এমন সময় তাঁর ভাই উমার লক্ষ্য করলেন যায়িদের বর্মটি খুলে পড়ে গেছে এবং সে দিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি নাঙ্গা শরীরে শত্রু বাহিনীর মাঝখানে ঢুকে পড়ছেন। উমার (রাঃ) ভাইকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি চিৎকার করে ভাইকে ডেকে বললেন, “খুজ দিরয়ী' ইয়া যায়িদ, ফা কাতিল বিহা – যায়িদ, এই নাও আমার বর্মটি। এটি পরে যুদ্ধ কর।”

যায়িদ (রাঃ) উত্তর দিলেন, “ইন্নী উরীদু মিনাশ শাহাদাতি মা তুরীদুহু ইয়া উমার'—ওহে উমার, তোমার মত আমারও তো শাহাদাতের সুমধুর পানীয় পান করার আকাঙ্ক্ষা আছে।” তারপর দু'জনেই বর্ম ছাড়াই যুদ্ধ করেন। (তাবাকাত ইবন সা'দ-৩/২৭৫, হায়াতুস সাহাবা-১/৫১৫, রিজালুন হাওলার- রাসুল-৩৪৪)

তিনি হুদাইবিয়ার ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন এবং হযরত রাসূলে কারীমের (সাঃ) হাতে বাইয়াত করেন। তাছাড়া খন্দক, হুনাইন, আওতাস প্রভৃতি যুদ্ধেও তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বিদায় হজ্জেও তিনি রাসুলুল্লাহর (সাঃ) সফরসঙ্গী ছিলেন। এ সফরেই তিনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) এ বাণী শোনেন, “তোমরা যা নিজেরা খাও, পর, তাই তোমাদের দাস-দাসীদের খাওয়াও, পরাও। যদি তারা কোন অপরাধ করে, আর তোমরা তা ক্ষমা করতে না পার, তাহলে তাকে বিক্রি করে দাও।” (তাবাকাত-৩/২৭৪ )

যায়িদের (রাঃ) শাহাদাত বরণ


হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রাঃ) খিলাফতকালে ধর্মদ্রোহীদের যে ফিতনা বা অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তা নির্মূলের জন্য হযরত যায়িদ অন্যদের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অনেক মুরতাদকে তিনি স্বহস্তে হত্যা করেন। বিখ্যাত মুরতাদ 'নাহার ইবন 'উনফু- যার ইসলাম ত্যাগ করা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার মুসলমান থাকাকালেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তাকে হযরত যায়িদ নিজ হাতে খতম করেন। মুসাইলামা কাজ্জাবের সাথে ইয়ামামার যুদ্ধে ইসলামী ঝাণ্ডা বহনের দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। যুদ্ধ চলাকালে বনু হানীফা একবার এমন মারাত্মক আক্রমণ চালায় যে, মুসলিম বাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। কিছু সৈনিক তো যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এতে যায়িদের সাহস আরও বেড়ে যায়। তিনি চিৎকার করে সাথীদের আহবান জানিয়ে বলতে লাগলেন, “ওহে জনমণ্ডলী, তোমরা দাঁত কামড়ে ধরে শত্রু নিধন কার্য চালিয়ে যাও। তোমরা সুদৃঢ় থাক। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তাদের পরাজিত না করা অথবা আমি আল্লাহর সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কোন কথা আমি বলবো না। আল্লাহর সাথে মিলিত হলে সেখানেই আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে কথা বলবো।” (রিজালুন হাওলার রাসূল-৩৪৫) তারপর তিনি সংগী-সাথীদের ভুলের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বলতে থাকেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আতাজিরু ইলাইকা মিন মিরারে আসহাবী’–হে আল্লাহ, আমার সংগী-সাথীদের ভেগে যাওয়ায় আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই।” (হায়াতুস সাহাবা-১/৫৩৪-৩৫) এ অবস্থায় তিনি পতাকা দুলিয়ে শত্রু বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে চলে যান এবং তরবারি চালাতে চালাতে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর শাহাদাতের পর হযরত সালেম (রাঃ). পতাকা তুলে নেন। হযরত যায়িদের মৃত্যুসন হিজরী ১২। (আল-ইসাবা- ১/৫৬৫)

যায়িদের (রাঃ) জন্য হযরত উমরের (রাঃ) শোক


হযরত যায়িদ ছিলেন হযরত উমারের (রাঃ) অতি প্রিয়জন। তাঁর মৃত্যুতে হযরত উমার অত্যন্ত শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর সামনে কোন মুসীবত উপস্থিত হলেই তিনি বলতেন, ‘যায়িদের মৃত্যুশোক আমি পেয়েছি এবং সবর করেছি।' যায়িদের হত্যাকারীকে দেখে উমার (রাঃ) বলেন, “তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি আমার ভাইকে হত্যা করেছো। প্রভাতের পূবালী বায়ু তারই স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে।” (হায়াতুস সাহাবা-২/৫১২) এত প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুশোকে তিনি কিন্তু দিশেহারা হয়ে পড়েননি। মদীনায় খলীফা আবু বকরের (রাঃ) সাথে তিনি ইয়ামামা প্রত্যাগত সৈনিকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন। তাদের কাছে ভাইয়ের শাহাদাতের খবর শুনে তিনি বলে ওঠেন, “সাবারানী ইলাল হুসনাইন আসলামা কাবলী ওয়া ইসতাশহাদা কাবলী - দু'টি নেক কাজে তিনি আমার থেকে অগ্রগামী রয়ে গেলেন - আমার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আমার আগে শাহাদাতও বরণ করলেন।” (আল-ইসাবা- ১/৫৬৫)

ঠিক এই সময় আরবের তৎকালীন এক বিখ্যাত কবি মুতাম্মিম ইবন নুওয়াইরার এক ভাইও একটি যুদ্ধে হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের হাতে নিহত হয়। কবি মুতাম্মিম তাঁর ভাইকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি মৃত ভাইয়ের স্মরণে এমন এক করুণ মরসিয়া রচনা করেন যে, তা শুনে শ্রোতাদের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। ঘটনাক্রমে হযরত উমারের (রাঃ) সাথে কবির সাক্ষাত হয়। উমার (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, 'তুমি তোমার ভাইয়ের মৃত্যুতে কতখানি শোক পেয়েছো ?” কবি বললেন, “কোন এক রোগে আমার একটি চোখ থেকে অশ্রু বের হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাইয়ের শোকে যেদিন থেকে সেই চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করে আজ পর্যন্ত তা আর বন্ধ হয়নি।” তার কথা শুনে হযরত উমার মন্তব্য করেন, “ শোক-দুঃখের এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত পর্যায়। যে চলে যায় তার জন্য কেউ এতখানি ব্যথাতুর হয় না।” তারপর তিনি বলেন, “আল্লাহ যায়িদকে ক্ষমা করুন। যদি আমি কবি হতাম, তার জন্য আমি মরসিয়া রচনা করতাম।” একথা শুনে কবি মুতাম্মিম বলে ওঠেন, “আমীরুল মু'মিনীন, যদি আপনার ভাইয়ের মত আমার ভাই শহীদ হতো, আমি কক্ষনো অশ্রু বিসর্জন করতাম না।” কবির এ কথায় হযরত উমার (রাঃ) অনেকটা সান্ত্বনা লাভ করেন। তারপর তিনি বলেন, 'এর থেকে উত্তম সান্ত্বনা বাণী আর কেউ আমাকে শুনায়নি।' বিভিন্ন ব্যক্তি হযরত যায়িদ ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।







***************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url